Friday, August 16, 2019

হৃদয়পুর ৭

প্রমিতের মন বলতে থাকে, নাঃ, এইবারে কিছু একটা করতেই হবে। যা হচ্ছে, বা হতে চলেছে, তাকে আটকাতে হবে। একটা পুরোনো আঘাতের রেশ এইভাবে ক্রমশ ও ওর জীবনে প্রভাব ফেলতে দিতে পারে না। আর এটা শুধু ওর জীবন না। এই মোহরের সাথে জড়িয়ে আছে মা বাবা, তুষার সৃজনীরা। ওরা পর্পত্যেকে ওর আপন। নিজের পাস্টের সাথে বোঝাপড়া করতে না পারার মাশুল ও এইভাবে প্রিয়জনদের দুঃখ দিয়ে দিতে পারে না। প্রমিত আরো একটা অমৃতা চায় না জীবনে।
অমৃতা। বাবা মায়ের পীড়াপীড়িতে এক রকম বাধ্য হয়ে দু বছর আগে প্রমিত বিয়ে করতে রাজি হয়। তখন মামাতো বোন টিঙ্কুর ক্লাসমেট অমৃতার সাথে সম্বন্ধটা মামীই আনে। সব ঠিকঠাকই চলছিল। বিয়ের দিনক্ষণ ফাইনাল। কেনাকাটা শুরু হয়ে গিয়েছিল। দুই বাড়িতেই। অমৃতার সাথে অবশ্য প্রমিতের ওই এক দুদিনই কথা হয়েছে। মায়ের জোরাজুরিতে আশীর্বাদের এক সপ্তাহ আগে একদিন ও অমৃতার সাথে দেখা করতে যায়। এদিক ওদিক কথা চলতে থাকে। সেই কথার মধ্যে উঠে আসে প্রাক্তন সম্পর্কের কথা। প্রমিত একটু ইতস্তত করে হলেও রাহীর সঙ্গে সম্পর্কের কথা পুরোটাই বলে। এমনকি শারীরিক সম্পর্কের কথাও। একটু দ্বিধা কাজ করছিল বটে, অমৃতা কীভাবে ব্যাপারটা নেবে। কিন্তু না। প্রমিত দেখলো, অমৃতা দিব্যি শুনে টুনে বললো, "ও ঠিক আছে। ওইটা নিয়ে আর ভেবো না।" প্রমিত অবাক হয়ে বললো, "তোমার খারাপ লাগবে না অমৃতা? তুমি যাকে বিয়ে করবে, সে যে আগেই অন্য নারীর সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল।" প্রমিতকে অবাক করে দিয়েই অমৃতা উত্তর দেয়, "দেখো, এই বয়সে এসে যদি তুমি বলতে যে তোমার কোন সম্পর্কই হয়নি পাস্টে, সেটাই বরং অস্বস্তিকর লাগতো। আর তা ছাড়া শরীর নিয়ে আমার অত কিছু ব্যাপার নেই।" প্রমিত শুনে যাচ্ছে চুপ করে। সামনে রাখা ভার্জিন মোয়িতোর গ্লাসটা না ছোঁয়া অবস্থাতেই রয়ে আছে। অমৃতা নিজের কোল্ড কফিতে এক চুমুক দিয়ে প্রমিতের দিকে চোখ টিপে বললো, "তা ছাড়া একদিকে কিন্তু ভালোই হলো। দুজনেই আনাড়ি হলে বড্ড মুশকিল হয়। আমার বন্ধুরা বলেছে। তা ছাড়া, তোমার যে কলকব্জা সব ঠিকঠাক আছে, এটাও তো জানা রইলো। জানো তো, আমার এক পিসতুতো দিদি,রুমকিদি, কাগজ টাগজ দেখে বিয়ে হলো। ও মা। আগে থেকে তো আর কেউ বোঝেনি। বিয়ের পর জানা গেল, জামাইবাবু ইম্পোটেন্ট। ভাবো? অন্তত আমার সেই হেডেক থাকলো না!"
প্রমিত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অমৃতার দিকে। এই মেয়ে চিরকাল এই মফঃস্বল শহরে থেকেছে। কোনদিনও হোস্টেলেও থাকেনি। বাড়ির পরিবেশে থেকে এই মেয়ে এত আধুনিক হলো কীভাবে? প্রমিতের ভালো লাগে এই খোলাখুলি আলোচনা। আরো সাধারণ টুকটাক কথাবার্তা চলে। তারপর বিল মিটিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ে। প্রমিত সঙ্গে গাড়ি নিয়ে এসেছিল। অমৃতাকে ড্রপ করে দেবে বলে ওদের বাড়ির দিকে গাড়ি ঘোরায়। বাড়ির দুটো গলি আগে একটা অন্ধকার কোণে অমৃতা ওকে গাড়ি থামাতে বলে। প্রমিত অবাক হয়। গাড়ি থামায়। অমৃতা ডান হাত দিয়ে প্রমিতের বাঁ হাতটা চেপে ধরে আলতো করে। তারপর আস্তে করে ওর দিকে ফিরে ঘন হয়ে আসে। বলে, "এ কেমন ওয়ার্কশপ গো? শুধুই থিয়োরি পড়ালে। ডেমো দেবে না? বা অন্তত আমার পরীক্ষা নেবে না?" এই বলে অমৃতা বাঁ হাত দিয়ে প্রমিতের শার্টের কলার চেপে ধরে। তারপর প্রচন্ড তীব্র একটা চুমু খায় প্রমিতের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে। প্রমিতও শরীরী আবেদনে সাড়া জানায়। হাত চলতে থাকে। লিপস্টিক শুষে নেয় প্রাণভরে। আর তখনই বিদ্যুৎরেখা খেলে যায় প্রমিতের শরীর দিয়ে। স্ট্রবেরি লিপস্টিক। সেই স্বাদ। রাহী রাহী বলে ডেকে ওঠে প্রমিত। অমৃতা ছিটকে যায়। নিজেকে ধড়ফড় করে ছাড়িয়ে নেয় প্রমিতের আগল থেকে। প্রমিত হকচকিয়ে যায়। এখনো বোঝেনি কী হলো। অমৃতা নিজের চুল জামা ঠিকঠাক করে ব্যাগটা নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে নেমে যায়। দরজা বন্ধ করার আগে প্রমিতের দিকে ঠান্ডা দৃষ্টি হেনে বলে, "ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু কন্ট্যাক্ট মি এনি মোর মিস্টার প্রমিত মুখার্জি। এন্ড প্লিজ সর্ট আউট ইয়োর পাস্ট। ইউ আর স্টিল স্টাক উইথ রাহী। বাই।" এই বলে গটগট করে মিলিয়ে যায় অন্ধকার রাস্তায়। প্রমিত হতভম্ব হয়ে বসে থাকে। কিচ্ছু বুঝতে পারে না।
সেদিন রাত্রেই অমৃতার বাবা ফোন করে মুখার্জি বাবুকে যা নয় তাই অপমান করেন। ছেলে লম্পট, দুশ্চরিত্র। মেয়ের ওপর জোরজুলুম করতে গিয়েছিল। নেহাৎ মেয়ের কপাল ভালো, তাই পালিয়ে এসেছে। মুখার্জি বাবু হতবাক। তাঁর এমন ভালো ছেলে সম্পর্কে এ কী কথা। শালা বাবুও ফোন করে দিদি জামাইবাবুকে যথেচ্ছ কথা শুনিয়েছেন। ওদের জন্যই নাকি টিঙ্কুর বন্ধুর পরিবারের কাছে অসম্মান হলো। নিজের ছেলেকে আগে সামলাক, তবে তো বিয়ে দেবে,ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ঘটনায় প্রমিত ভেঙে পড়ে প্রচন্ড। মা বাবা জানেন, বোঝেন। কোথাও একটা গন্ডগোল হয়েছে কিছু। ওদের ছেলে এমন হতেই পারে না। কিন্তু... প্রমিত চেষ্টা করেছিল অমৃতার সাথে যোগাযোগ করার। কিন্তু পারেনি। অমৃতা ওর নম্বর ব্লক করে দেয়। টিঙ্কুর মারফত খবর পাঠায়। আর একবার ওকে বিরক্ত করার চেষ্টা করলে পুলিশ কমপ্লেন করবে। প্রমিত দমে যায়। টিঙ্কু চেনে ওর বান্ধবীকে। চেনে দাদাকেও। ও বোঝে, অমৃতারা যা বলছে, তাতে নিশ্চয়ই কিছু গোলমাল আছে। ও আসে একদিন পিসির বাড়ি। আলাদা করে দাদার সাথে কথা বলে। প্রমিত বলবো না বলবো না করেক বোনের কাছে সমস্তটা খুলে বলে। টিঙ্কু খানিক চুপ থাকে। মাথা নেড়ে তারপর বলে, "তাহলে বিপ্লব রুদ্ররা যা বলেছে, তাই ঠিক।" প্রমিত অবাক হয়ে টিঙ্কুর দিকে তাকায়। টিঙ্কু বলতে থাকে, "বিপ্লব আর রুদ্র আমার ক্লাসমেট। এবং খুবই ক্লোজ বন্ধু। ওরা যখন তোর আর অমৃতার বিয়ে ভাঙার খবরটা পায়, আমায় বলেছিল। এ এমন হতেই পারে না। অমৃতা বহুবার কলেজের অনেক ছেলের সাথেই ফিজিক্যাল হয়েছে। এমন কী বিপ্লবকেও এপ্রোচ করে। বিপ্লব না করায় ওর নামে বদনাম করতে যায়। নেহাৎ সাক্ষী ছিল, তাই সে যাত্রা বিপ্লব বেঁচে যায়। অমৃতা পাকাপোক্ত খেলোয়াড় দাদা। এই তো দেখ, একই ডেটে এন আর আই পাত্র জুটিয়ে বিয়ে করছে। আমাদের ধারণা এসব আগে থেকেই ঠিক ছিল। চ্যাট করতে গিয়ে আলাপ। বাড়িতে কনভিন্স করাতে পুরো নাটকটা করলো ও। গেম খেললো পুরো। তুই রাহীর নাম নিয়ে শুধু ওর গেমটা ইজি করে দিলি।" প্রমিত মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে মেঝেতে। ধাক্কা। একের পর এক ধাক্কা। রাহী। তারপর অমৃতা। মেয়েদের ওপর ঘেন্না রাগ জন্মে যাচ্ছে ওর।

প্রমিত পর্দা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো। "এসব কী হচ্ছে? আপনি সার্ভিস এপার্টমেন্ট হোটেল খুঁজছেন কেন? এখানে কী অসুবিধে আপনার?" হঠাৎ প্রমিতের গলা শুনে মোহর চমকে ওঠে। ক্ষনিকের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে ঠাণ্ডা গলায় কেটে কেটে বলে, "আপনি কি আড়ি পাতছেন?"

No comments:

Post a Comment