মোহর এর মধ্যে একটা লং উইকেন্ড দেখে কলকাতা থেকে ঘুরে এসেছে। বাড়ি গিয়ে, নিজের চেনা পরিবেশ পেয়ে খুব যে আনন্দ পেয়েছে, তা বলার না। কিন্তু এবার ওই রবিবার রাতে ট্রেন ধরতে হাওড়া স্টেশন যেতেই মন খারাপ। হৃদয়পুর ভালো। লোকজন ভালো। কলেজটাও কপাল করে ভালোই। কোন ঝুটঝামেলা নেই। রাজনীতির ঝঞ্ঝাট বলতে গেলে নেই। ছাত্র ছাত্রীরা ক্লাস টাস করে। থাকা খাওয়ার সমস্যা নেই। তবুও... বাড়ি, বাড়িই। মা বাবার এখনো রিটায়ারমেন্ট হয়নি। তাই ওদের পক্ষে হুট করে ছুটি পাওয়া সমস্যা। তবুও ওরা ঠিক করেছে, পুজোর ছুটি পড়ার আগে ওরা যাবার মোহরের কাছে। কাছে পিঠে ঘুরে মোহরকে নিয়ে কলকাতা ফিরবে। তারপর অষ্টমীর অঞ্জলি দিয়ে সেদিন রাত্রের ফ্লাইট ধরে সোজা লখনৌ। ওখান থেকে কুমায়ুন ঘুরবে। পুজোর আগে যখন মা বাবা হৃদয়পুর আসবে, তখন অফ সিজন। তবুও, মোহর ঠিক করে। ফিরে গিয়েই কাকার সাথে আলাপ আলোচনা করে মা বাবার জন্য হোটেল বুক করে নিতে হবে।
সোমবার একদম ভোরবেলা মোহর ফিরলো হৃদয়পুর। স্টেশন থেকে একটা অটো পেয়ে গিয়েছিল। বাড়ি ঢুকতেই কাকীমা ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললেন, "উফ, মৌ, তুই এলি। আমি বাঁচলাম।" হ্যাঁ, কয়েকটা সিনেমা একসাথে দেখার সাথে সাথে মোহর উষ্ণ মৌ আর তুমি আপনি এখন তুইয়ের পর্যায়ে নেমে গিয়েছে। মোহর অবশ্য এখনো আপনি আজ্ঞে করেই চলে। ও বললো, "কেন কী হয়েছে কাকীমা?" সব ঠিক আছে তো? কাকুর কিছু হয়নি তো? মোহর মনে মনে ভয় পায়। নিশ্চয়ই না। এ বাড়িতে কিছু হলে সৃজনী নিশ্চয়ই জানতো ওকে। ও তাও টেনশনে থাকে। কাকীমা ওকে বসতে বলে ওর জন্য ঝটপট চা করে আনেন। তারপর দুজনে চা খেতে খেতে গল্প জোড়েন। কলকাতার খবর। পুজোর তোড়জোড় কেমন চলছে, ইত্যাদি। এই সুবাদে মোহর ওর মা বাবার আসার কথাটা কাকীমাকে বলে রাখলো। সাথে এও জানালো যে ও মা বাবার সাথে পুজোর ছুটি পড়তেই বাড়ি চলে যাবে। একদম দেড় মাসের ছুটি কাটিয়ে তবে ফিরবে হৃদয়পুর। কথাটা শুনে যেন কাকীমা একটু দমে গেলেন, মোহর লক্ষ্য করলো। ও বললো, "কাকীমা, বলুন তখন কী বলছিলেন। বললেন না তো, আমায় দেখে বাঁচলেন কেন?"
কাকীমা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে এবার বলতে লাগলেন, " জানিস তো মৌ, তোর কাকাদের পরিবার বিশাল বড়। নানান শরিক। কেউ বর্ধমানে, কেউ বাঁকুড়া, কেউ কুচবিহার, তো কেউ হৃদয়পুর। চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। অনেকে তো আবার পশ্চিম বাংলার বাইরে, এমনকি দেশেরও বাইরে আছে। তা হয়েছে কী, এই মুখার্জি পরিবারের একটা দুর্গা পুজো হয়। সেটা একেকবার একেক শরিক করে। এই তো আমরা পাঁচ বছর আগে করেছিলাম। হিসেবমত আগামী বছর আমাদের আবার পালা হওয়ার কথা। কিন্তু আমার ভাসুর অসুস্থ। ট্রিটমেন্টের জন্য এদিক সেদিক চলছে। তাই এইবারে পুজোটা ওরা করতে পারবে না। আমাদের ওপর এসো পড়েছে দায়িত্ব। এমন দুম করে এলো... কিচ্ছু বুঝছিনা কী করে কী হবে।" মোহর কৌতূহল ভরে জিজ্ঞেস করলো, "পুজো কত বড় করে হয়?" কাকীমা বললেন, "খুব বড়, তা না। তবে হ্যাঁ। প্রতিমা গড়ানো হয়। অষ্টমীর দিন প্রচুর লোকজন দুপুরে ভোগ খায়। এ ছাড়া রোজই চেনাজানার মধ্যে অনেকেই আসেন। ভোগ প্রসাদ খান। কাকার তো জানাশোনা লোকের অভাব নেইম জানিসই তুই।"
"হুম" বলে মোহর মাথা নাড়ে। কাকীমা আরো বলতে থাকেন, "তা তোর কাকা তো বলেছে প্যান্ডেল প্রতিমা সবের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। প্রমিতও আছে। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। পাঁচ বছর আগে যতটা পারতাম, এখন অটো পারিনা রে। পুজোর কাজে সাহায্য কে করবে। দুর্গা পুজো মানে চারটিখানি কথা না। সে যতই ছোট করে পুজো হোক। তবুও, হাজারটা কাজ থাকে। প্রমিতটা কতটা সামলাতে পারবে, জানি না। এবারে তো মনে হয় ওকেই পুজোয় বসতে হবে। কাকার ডায়াবিটিস। উপোস টুপস পারবে না। তাই পুজোও করতে পারবে না। তাই আর কী, আমি ভাবছিলাম, কী করে কী ম্যানেজ হবে। তারপর ভাবলাম, কেন, এই তো তুই আছিস। তুই পারবি না বল সামলে নিতে? ইয়ং মেয়ে। কত ডাইনামিক। আমি সেই থেকে উচাটন করছি। তুই কখন আসবি। তোর সাথে বসে ঠিক করবো। হাজার হাজার কাজ। প্ল্যান করতে হবে তো। তোকে কত কিছু শেখাতেও হবে। পারবি না, বল?" কাকীমা এক রাশ আশা নিয়ে মোহরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। মোহরের এবার মুখ কালো করার পালা। কী হবে এবার? অষ্টমী রাতের লখনৌ যাওয়ার প্ল্যানটা? টিকিটও কাটা হয়ে গিয়েছে যে। কী করবে? কাকীমা আবার ওকে একটু ঠ্যালা দিয়ে বলেন, "কী রে, পারবি তো মা?" মোহর কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই প্রমিতের গলা শোনা যায়। "দেখছ না মা, ওঁর মুখ চোখের অবস্থা? সবাই সব বোঝে না। আটাচমেন্ট বলো আর হেরিটেজ, সবটা সবার বোঝার ক্ষমতা নেই। উনি আদৌ ইন্টারেস্টেড বলে তো মনেই হয় না। কেন জোর করছো? বলেছি তো, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট টিম এনে দেবো। টাকা ফেললে কাজ হয় না, এখনো এ অবস্থা আসেনি দেশে। চিন্তা করো না মা। আর ম্যাডাম, আপনিও খামোখা টেনশন করবেন না। আপনার ওপর কোনো দায়িত্ব পড়বে না।"
কখন যে প্রমিত এসেছে ঘরে, কেউ টের পায়নি। প্রমিতের কথা শুনে গোটা ঘরে পিন ড্রপ সাইলেন্স। মোহর কী বলবে উত্তরে, বুঝতে পারে না। কাকীমাও বিহ্বল।
No comments:
Post a Comment