প্রমিত চুপ করে ঘরে বসে আছে। ভারী পর্দা সরায়নি। দরজা জানালা সব বন্ধ। বাইরে আলো হলেও, ঘরের ভিতরটা অন্ধকার। ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। ঠিক যেন নিজের জীবনের মতো। হ্যাঁ তাইই তো। বাইরে থেকে দেখলে প্রমিতের জীবন ঈর্ষণীয়। ভালো রোজগার, শান্তিপূর্ণ জীবন, মা বাবার সাথে থাকা। বিশেষ কোনো চিন্তা নেই। শরীর স্বাস্থ্যও দিব্যি ভালো। কিন্তু কেউ বোঝেনা, মনের কষ্টটা। এই যে আজ, আজ যেমন একটু আগে মা আর মোহর কথা বলছিল, কোনো প্রয়োজন ছিল না কিন্তু প্রমিতের তার মধ্যে নাক গলানোর। ফ্রিজ থেকে জল নিতে বেরিয়েছিল, জল নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে যেতেই পারতো। তা না। কানে এলো পুজো। শুনলো মা মোহরকে বলছে সাহায্য করতে, তারপর কী যে হলো। কোনো কারণ ছাড়াই কথা শুনিয়ে দিলো মোহরকে। কী ভাবছে কে জানে। নিশ্চয়ই খুবই রুড ভাবছে ওকে। ঠিক কারণ ছাড়া করেছে তাও বলা যায় না। কারণ আছে। জ্বলজ্যান্ত কারণ। কিন্তু সেই কারণ কেউ বুঝবার না। দশ বছর আগে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা, এতদিন পর মনে রাখাও মুশকিল। এবং অযৌক্তিকও।
কিন্তু প্রমিত কী করবে? ও তো চেষ্টা করলেও ভুলতে পারে না।
ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল ইয়ার। এম বি এ তে চান্স পেয়ে গিয়েছে আহমেদাবাদে। কলেজ কেটে প্রমিত এসেছে গড়িয়াহাট। আনন্দমেলার সামনে। ঠিক আড়াইটা নাগাদ। এই সময়েই আসতে বলেছে ওকে রাহী। রাহী, ওর প্রেমিকা। প্রেমিকা কি আদৌ বলা যায়? তখনও অবধি প্রমিত জানতো, হ্যাঁ। যার সাথে চুটিয়ে তিন বছর প্রেম করেছে, যে প্রেম শরীরী খেলায় পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল, যার সাথে মনের সব কথা ভাগ করে নিতে পারতো, সুখে দুঃখে যার পাশে থাকতো, তাকে তো প্রমিতের সরল মন প্রেমিকা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনি। রাহী থাকতো প্রমিতের পিজির ঠিক দুটো বাড়ি পরে। ওর রুমমেট না থাকলেই রাহী চলে আসতো পিজিতে। প্রথম প্রথম গল্প, একসাথে বসে সিনেমা দেখা, হালকা হাত ধরাধরি করলেও একদিন সাহসী হলো দুজনে। প্রমিত ভুলতে পারেনি সেই দিনটা। ঈদের ছুটি। লং উইকেন্ড। অভিষেক ট্রেকিং ক্লাবের সাথে গিয়েছে পুরুলিয়া। দুদিনের জন্য। রাহী সক্কাল সক্কাল এসে হাজির। পরনে লাল টুকটুকে সালোয়ার কামিজ। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। বাদামী কালো চুল ঝুঁটি বাঁধা। মুগ্ধ হয়ে প্রমিত দেখছিলো রাহীকে। মুখোমুখি বসে। তারপর কী থেকে যে কী হয়ে গেল, রাহী ঝাঁপিয়ে পড়লো প্রমিতের বুকে। রাহীর দামি সুগন্ধী আর শ্যাম্পু করে চুলের নরম স্পর্শে প্রমিত পাগল হয়ে গেল। এতদিনের চেপে রাখা সমস্ত ইচ্ছে দিয়ে প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরলো রাহীকে। তারপর নিজের কড়া ফাটা ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো রাহীর নরম দুই ঠোঁটের ফাঁকে। মেয়েদের লিপস্টিকে যে এমন সুন্দর স্বাদ আছে, কই, আগে তো কখনো ভাবতে পারেনি প্রমিত। ওই প্রথম। তারপর আরো যত দিন গিয়েছে, প্রমিত আর রাহী হয়েছে আরো সাহসী। ক্রমশ মেতে উঠেছে ওরা শরীরী খেলায়। মনে প্রাণে ভালোবেসেছে প্রমিত রাহীকে। প্রেমিকা বলবে না তো কী বলবে?
কী বলবে? কেন, রাহী তো ওকে সেদিন বুঝিয়েই দিলো। আনন্দমেলার সামনে। সেদিন রাহী এসেছিল প্রায় তিনটে নাগাদ। প্রমিত অপেক্ষা করতে করতে অস্থির। বারবার ফোন করছে রাহীকে। উত্তর নেই। মেসেজেরও কোনো জবাব নেই। কোনো বিপদ অপদ কিছু হলো না তো? কী হলো? রাহী কোথায়? এইসব ভাবতে ভাবতে ব্যস্ত শহরের ব্যস্ততম রাস্তায় পায়চারি করছিল প্রমিত। আর ঠিক তখনই ট্রেডার্সের সামনে দেখলো বাস থেকে নামছে রাহী। পরনে কালো জিন্স। সবুজ মেরুন জংলা কুর্তা। চুলটা টেনে উঁচু করে ঝুঁটি বাঁধা। কানে বড় বড় ঝোলা দুল। ঠোঁটে প্রমিতের প্রিয় স্ট্রবেরি লিপবাম। ট্র্যাফিক সিগনালে গাড়িগুলো যখন অবশেষে দাঁড়ালো, রাহী এসে পৌঁছলো প্রমিতের সামনে। প্রমিত এগিয়ে গিয়ে রাহীকে জিজ্ঞেস করতে গেল, কী হয়েছে। রাহীর মুখ আজ থমথমে। চোখে মুখে সেই স্বভাবসিদ্ধ হাসিটুকু লেগে নেই। ডান হাত তুলে প্রমিতকে থামালো ও। প্রমিত খেয়াল করলো। ম্যানিকীয়র করা আঙুলগুলো আজ লাল নেলপলিশে মায়াবী লাগছে। সরু লম্বা এই আঙুলের ফাঁকে কতবার যে নিজের আঙ্গুল ছুঁয়েছে, প্রমিতের আর হিসেব নেই। রাহী কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে একটা মোটা জাবেদা খাম বের করে প্রমিতের হাতে ধরিয়েএ বললো, "প্রমিত, ইট ইজ ওভার বিটুইন আস। সামনের মাসে আমার বিয়ে। তোমার সাথে আর সম্পর্কে থাকতে চাই না। এইগুলো সব তোমার আমায় পাঠানো চিঠি। আমার আর প্রয়োজন নেই। আজ থেকে তুমি মুক্ত। আই হ্যাড আ গুড টাইম উইথ ইউ। থ্যাংকস। বাট নো মোর। আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো না ভুলেও। আমার উড বির ফ্যামিলি খুবই ইনফ্লুয়েন্সিয়াল। জানতে পারলে তোমার কলকাতায় থাকাটা ইম্পসিবল করে দেবে। গুড লাক এন্ড গুডবাই।" প্রমিত থ। কোনোভাবে কিছু রিএক্ট করার আগেই রাহী গটগট করে চলে গেল। প্রমিত ওর পিছনে ধাওয়া করার চেষ্টা করলো বটে। দু তিনবার রাহী রাহী বলে ডাকলো, কিন্তু কোনো উত্তর পেলো না। উল্টে রাহী সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সিতে চেপে বেরিয়ে গেল চোখের সামনে দিয়ে।
প্রমিত আজও জানে না কেন রাহী এমনটা করেছিল ওর সাথে। বন্ধুবান্ধবদের থেকে পরে জেনেছে, বিয়েটা নাকি এক বছর আগে থেকেই ঠিক ছিল। তা সত্ত্বেও, জেনে বুঝে কেন এমন করলো রাহী? উত্তর অজানা রয়েই গেল। আর সাথে এলো প্রমিতের মধ্যে এই প্রেমের প্রতি বিদ্বেষ। মেয়েদের রীতিমতো এড়িয়ে চলতো। এইভাবেই কাটিয়ে দিয়েছিল এতগুলো বছর। চলেও যাচ্ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে এসে বাঁধ সাধলো মোহর। সেই একই সবুজ মেরুন জংলা কুর্তি। সেই একই লিপবাম। একই চার্লি গোল্ড পারফিউম। এমনও হয়? সেই হেসে হেসে কথা বলা। আলাপের চেষ্টা। কী করে? কী করে এমন হয়? প্রমিত ভাবতে থাকে। অনেক পরে মনে হয় যা করলো আজ, ব্যাপারটা ঠিক করেনি ও। এভাবে কতদিন চলবে? নাঃ। মোহরের কাছে ক্ষমা চাইবে।
এই ভেবে মোহরের ঘরের দিকে পা বাড়ায় প্রমিত। পাশেই ঘর। দরজার বাইরে নক করতে যাবে, এমন সময়ে কানে আসে কারুর সাথে ফোনে কথা বলছে ও। "আমায় প্লীজ হৃদয়পুরে কোনো ভালো হোটেল বা সার্ভিস এপার্টমেন্টের খোঁজ দিতে পারেন? খুব আর্জেন্ট।" প্রমিত থমকে যায়।
No comments:
Post a Comment