প্লেনটা টেক অফ করবে যে কোনো মুহূর্তে। বিমানসেবিকারা যে যার নিজের জায়গায় বসে আছে। জানলার ধারে মাথা এলিয়ে পৃথা বাইরে তাকিয়ে আছে। এই এতদিনের ভালোবাসার শহর, পরিবার পরিজন বন্ধু বান্ধব...সকলকে ছেড়ে বম্বে পাড়ি দেওয়া। তাও আবার পুজোর যখন এক মাস বাকি, তখন। একদম ভালো লাগছে না। মনটা বারবার ফিরে যাচ্ছে ওদের হাউজিঙ কমপ্লেক্সে। ইশ, আজ নিশ্চয়ই কোর কমিটির মিটিং রয়েছে। মা হয়তো সেখানে গিয়েওছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট বলে কথা। তা ছাড়া মেয়ে চলে গেল, সেই মন খারাপ কাটাতেও যাবে। এইসব মিটিং পৃথার খুব পছন্দের ছিল। বেশ গুরুগম্ভীর আলাপ আলোচনার পর আসতো মিটিংয়ের আসল আকর্ষণ। ইটিঙ। গরম গরম ফিশ ফ্রাই, ছানার জিলিপি আর কফি। নাঃ, আর ভাববে না। পৃথা ঠিক করে। এই চাকরির সিদ্ধান্ত ও নিজেই নিয়েছে। খানিকটা বাড়ির অমতেই। কাজেই এখন আর ফিরবার কোনো গল্প নেই। আসলে, কলকাতায় বড্ড হাঁপিয়ে উঠছিল পৃথা। যতই পছন্দের চাকরি থাকুক না কেন, মধ্যে মধ্যেই ঋষির কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ঋষি, ওর প্রাক্তন। দশ বছরের সম্পর্কের পর যে ছেলের একবারও বাধেনি ওকে চিট করতে, চাকরিক্ষেত্রে সুবিধে পাবে বলে বসের মেয়ের সাথে নতুন সম্পর্কে জড়াতে। পৃথা নিজেকে বারবার বুঝিয়েছে। যা হয়েছে, ভালো হয়েছে। ঋষি ওর জন্য ঠিক না। সম্পর্কটা নেই, তাতে পৃথাই বেঁচে গিয়েছে। অনেকটা সময় পৃথা মেনেও নেয়। শুধু বাঁধ সাধে কোনো বর্ষার দিনে, সিসিডির সামনে। বা বাস স্টপে ছাতা ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকা কোনো যুগলকে দেখে। বা ধর্মতলার রাস্তায় ফুটপাথ।দিয়ে হাত ধরে হেঁটে যাওয়া কোনো দম্পতিকে দেখে। বা ট্র্যাফিক সিগনালে গাড়ি আটকে আছে। হঠাৎ চোখে পড়ে বাঁদিকে সেই চিরপরিচিত লাল আই টেনে ঋষি। পাশে বসে মেঘনা। আর তখনই পৃথা আরো জোর দিয়ে চাকরি খোঁজে কলকাতার বাইরে।
প্লেনটা টেক অফ করে নিয়েছে। এখন সন্ধ্যের কলকাতার আকাশের ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে। নীচে জ্বলজ্বল করছে আলোর শহর। তবে আলোগুলো কি একটু বেশিই মিটমিট করছে? কিছু কি সিগনাল দিচ্ছে পৃথাকে? কে জানে। বোঝার চেষ্টা করে পৃথা। সম্বিৎ ফেরে সহযাত্রীর ডাকে। "এক্সকিউজ মি, আপনাকে ডাকছেন।" পৃথা চমকে তাকায়। বিমানসেবিকা ট্রেতে করে ইতিমধ্যেই গরম গরম খাবার এনে রেখেছে। পৃথার দিকে এগিয়ে দেয়। বিমানসেবিকা এগিয়ে যায় সামনের সিটের দিকে। পৃথা সহযাত্রীর দিকে এতক্ষণে তাকায়। মৃদু হেসে থ্যাংক ইউ বলে। বছর তিরিশ বত্রিশের এক ছেলে। চোখে চশমা। হালকা দাড়ি গোঁফ। মুখটা খুব চেনা চেনা লাগে পৃথার। কিন্তু মনে করতে পারে না। কোথায় দেখেছে, কোথাও কি আদৌ দেখেছে?
No comments:
Post a Comment