মুখার্জি কাকীমাকে মোহরের বেশ ভালোই লেগেছে। ছোট্ট খাটো মানুষ। নরম নীচুস্বরে কথা বলেন। আটপৌরে শাড়ি পরেন। সব সময় মনে হয় পান জর্দা খান, কারণ গা দিয়ে একটা জর্দার গন্ধ মোহর বারবার পাচ্ছিল। ভদ্রমহিলার মধ্যে একটা বেশ মাতৃসুলভ ব্যাপার আছে। মোহরের ভালো লেগেছে ওঁকে। উনিও মোহরকে বেশ আদর যত্ন করেই অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। মুখার্জি কাকা মানুষটাও ভালো। একটু কথা বেশি বলেন ঠিকই, তবে আমুদে মানুষ। মোহরের কথা বলার মুড থাকলে কাকার সাথে বসে গল্প করতে দিব্যি সময় কেটে যায়।
মোহরের থাকার ঘরটাও ওর পছন্দ হয়েছে। তিন তলায়। ভালো মতন বড় ঘর। সামনে টানা বারান্দা। দুটো ইজি চেয়ার পাতা। সামনেই একটা পার্ক। এই পার্কে ভোরবেলা লোকজন মর্নিং ওয়াকে এসব। তাই ভোর হতে না হতেই কথাবার্তা শোনা যায়। বিকেলে পার্কে বাচ্চারা খেলে। তবে সন্ধ্যে হলে পার্ক একদম ফাঁকা। মোহরের কাজের সময় তাই কোনো ব্যাঘাত ঘটেনা। বারান্দাটা আবার দক্ষিণমুখী। হাওয়া বাতাস ভালোই। ঘরটিও পুরোনো আমলের বাড়ি হওয়ার দরুণ, বেশ বড়। এবং উঁচু সিলিং। লম্বা ডাণ্ডা দিয়ে পাখা ঝুলছে দুটো। দেওয়ালে এক দুই জায়গায় চুনকাম খসে পড়লেও, মন্দ নয়। সাধারণ ক্রিম রঙের দেওয়াল। টিউবলাইট দুটো আর একটা নাইটল্যাম্প। এই ঘরের সাথেই লাগোয়া বাথরুম। চব্বিশ ঘন্টা জল থাকে। একটা ইনস্ট্যান্ট গিজারও লাগিয়ে দিয়েছেন মুখার্জি কাকা। দু তিনটে বালতি রাখা। মগ। স্নান সেরে কাচাকাচি করে বারান্দাতে মেলার ব্যবস্থা আছে। নইলে ছাদ। বাড়ির ছাদটা মোহরের খুব পছন্দ হয়েছে। প্রচুর ফুলের গাছ, সারি সারি টবে। জুঁই টগর বেল ক্যাকটাস সবই আছে। মোহর ভেবেছে কাকা কাকীমার অনুমতি নিয়ে বারান্দায় এক দুটো টব রাখা যায় কি না।
খাওয়া দাওয়াটা সকালে আলাদা করে করে মোহর। দশটা নাগাদ বেরিয়ে পড়ে কলেজের উদ্দেশ্যে। প্রথম এক দুদিন ও ওই ব্রেকফাস্টের রুটি তরকারি খেয়ে বেরিয়ে যেত। টিফিন সেরকক কিছু নিত না। বলতো ক্যান্টিনে খেয়ে নেবে। কিন্তু কয়েকদিন এমন যাওয়ার পর, কাকীমা নিজে রান্নার লোককে বলে সাড়ে নটার মধ্যে ভাত তরকারি সব রেডি করিয়ে রাখেন। মোহরের একটু অস্বস্তি হয়। ওর জন্য এঁদের এতদিনের রুটিনে ব্যাঘাত হচ্ছে, খারাপ লাগে। কিন্তু কাকীমা কোনো কথাই শুনবেন না। নিজে হাতে মোহরকে খাবার বেড়ে দেন। কোনো কোনো দিন মাছের ঝোল রান্না না হয়ে গেলে, কাকীমা মাছ ভেজে দেন। আর সকালের প্রাপ্য ব্রেকফাস্ট মোহর প্যাক করে নিয়ে যায় কলেজের জন্য।
কলেজটা বাড়ি থেকে নিতান্তই কাছে। নেহাৎ সকালে খুব রোদ থাকে, তাই ও রিকশা নেয়। ফেরার পথে রোজই ও হাঁটে। এই বাড়িতে ভালোই লাগছে মোহরের। সৃজনীরা মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যায়। ও ও যায় ওদের বাড়ি। এদিক সেদিক ঘুরতে যায়। একটাই শপিং মল এখানে। সেখানে সপ্তাহে একবার যায়। সিনেমা দেখতে। কখনো সৃজনীর সাথে। কখনো একা। বা কখনো কাকীমার সাথে। কাকীমার সাথে যাওয়াটা নিয়েই মজার গল্প আছে। একটা রবিবার মোহর ম্যাটিনি শোতে এক সিনেমা দেখতে বেরোচ্ছে। কাকীমা হঠাৎ বললেন, "মৌ মা, কিছু মনে করো না। তুমি কি এক সিনেমা দেখবে?" এঁরা ওর ডাক নাম মৌ জেনে গিয়েছেন। তাই মৌ নামেই ডাকেন। মোহর একটু মজা পেলো প্রশ্নে। বললো, "না। কেন?" কাকীমা বললেন, "সৃজনী যাচ্ছে?" মৌ মাথা নেড়ে না জানালো। "ও, তাহলে কলেজের বন্ধুরা?" মোহর এবার হেসে বললো, "না কাকীমা। আমি একাই যাচ্ছি। আমার অভ্যেস আছে। তবে হাউজফুল। তাই হলে আরো অনেক লোক থাকবে। সেই জন্যই বললাম।" ব্যাপারটা বুঝতে অল্পক্ষণ সময় লাগলো মুখার্জি গিন্নীর। তারপর উনি হো হো করে হাসতে লাগলেন। একটু থিতু হয়ে বললেন, "কিছু যদি মনে না করো, আমায় কখনো নিয়ে যাবে? আসলে তোমার কাকা নাকি খালি ব্যস্ত। সময় হয় না। আর প্রমিতের বাংলা সিনেমায় অরুচি। ওর শুধুই ওই ইংরেজি মারামারি নয় কার্টুন কমিক্স।"
মোহর হেসে বলে, "আচ্ছা বেশ। এরপর থেকে যেটা দেখতে ইচ্ছে করবে, বলবেন। নিয়ে যাবো।"
মাস দেড়েক হয়ে গিয়েছে মোহর এই বাড়িতে আছে। সব ভালো। বরং খুবই ভালো। শুধু একটাই খচখচ। প্রমিত। এক দুবার মোহর যেচে আলাপ করতে গিয়েছে। কিন্তু নিতান্তই ঠান্ডা অভ্যর্থনা পেয়ে দমে গিয়েছে। কে জানে বাবা, এত কীসের দেমাক? যাক গে। দেখা যাবে।
No comments:
Post a Comment