Thursday, August 29, 2019

আলোতে আলো ঢাকা ৩

"আপনি কি বরাবরই ফোন এলে বা মেসেজ এলে এমন অন্যমনস্ক হয়ে যান?" উপমন্যুর প্রশ্নে অবাক হয়ে ফোন থেকে মুখ তুলে দেখলো পৃথা। বিস্ময় প্রকাশ করেই ও জিজ্ঞেস করলো, "মানে?" উপমন্যু হাসলো। কিছু বললো না। ইতিমধ্যে একজন ওয়েটার এসে ওদের টেবিলে ওয়েলকাম ড্রিংক হিসেবে তরমুজের জ্যুস রেখে গেল। আরেকজন এসে স্টার্টারের প্রথম রাউন্ডের মাছ মাংসের কাবাব এনে রাখলো। উপমন্যু জ্যুসের গ্লাসটা তুলে পৃথার দিকে তাকিয়ে বললো, "উল্লাস।" পৃথাও নিজের গ্লাসটা উপমন্যুর গ্লাসে ঠেকিয়ে নামাতে যাচ্ছিল, উপমন্যু বাঁ হাত দিয়ে পৃথার ডান হাতটা চেপে ধরে প্রায় আর্তনাদ করে উঠলো, "আরে আরে। রাখবেন না। রাখবেন না। এক চুমুক খান। তারপর নামিয়ে রাখবেন। উল্লাস বলে গ্লাস নামাতে নেই।" পৃথা এমন অপরিকল্পিত ঘটনায় খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে সামলে জ্যুসের গ্লাস থেকে এক চুমুক জ্যুস খেয়ে নামিয়ে রাখলো গ্লাস। উপমন্যু ইতিমধ্যে হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে। এবং দুই হাতে কাঁটা চামচ ছুরি সব সহযোগে মনের সুখে কাবাবে মন দিয়েছে। পৃথা কী দিয়ে শুরু করবে, বুঝে উঠতে পারে না। একটু এদিক ওদিক করছে দেখে উপমন্যু বলে, "ফিশ দিয়ে শুরু করুন। মেছো বাঙালি আফটার অল। ওটাই বেস্ট লাগলো।" পৃথা উত্তর দেয়না। কিন্তু ফিশ অমৃৎসরী দিয়েই খাওয়া শুরু করে। মুখে এক টুকরো পুরে বোঝে, সত্যিই বড় সুস্বাদু। "কী, ভালো না?" পৃথার হাসিমুখ দেখে উপমন্যু প্রশ্ন করে। পৃথা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। তারপর উপমন্যুকে জিজ্ঞেস করে, "তখন কিছু একটা বলছিলেন। ওয়েটার চলে এলো। কথা থেমে গেলো।" উপমন্যু খাওয়া থামিয়ে খানিক ভাবে। তারপর মাথা নেড়ে বলে, "ও কিছু না। খান খান। নেক্সট আইটেম আনতে বলি? নাকি এটার রিপিট?" পৃথা উত্তর দেয়, "নেক্সটটাই বলুন। কিন্তু কিছু না বললে তো হবে না। বলুন, তখন কী বলছিলেন ফোন নিয়ে।" উপমন্যু বলে, "আরে, বললাম তো। কিছু না। যেই জন্য আজ এখানে আসা, সেটাতেই বরং মন দিই?" পৃথা একটু ক্ষুণ্ন হয়। ফোন মেসেজ অন্যমনস্ক কী বলছিল। কেন। যাক গে, বলতে না চাইলে আর কীই বা করতে পারে, এই ভেবে ও খাওয়াতে মন দেয়। ঠিকই তো। উপমন্যুর সাথে এই লাঞ্চ প্ল্যানটা তো ভালো মন্দ খাবে বলেই। গোড়া থেকেই বলি তাহলে।
সেদিন এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফিরেই ফেসবুকে উপমন্যু রায় চৌধুরী নামে সার্চ দেয় পৃথা। তিনটে প্রোফাইল আসে। প্রত্যেকটিতে গিয়ে ঢুঁ মেরে হতাশ হয়। একটাও যে ওর সহযাত্রীর না। কে জানে, হয়তো কোন ট্যাশ নামে আছে। একটু দমে যায় পৃথা। কিন্তু হাজার ব্যস্ততার মধ্যে আর মনে পড়ে না। নতুন শহর। নতুন চাকরি। এইসবের মধ্যেই কেটে যায় এক সপ্তাহ। উইকেন্ডে অফিস নেই। সারাদিন কী করবে, ভেবে পায় না। শনিবার সারা সকাল ঘরদোর গুছিয়ে বাজারহাট করে মোটামুটি কেটে গেলেও সন্ধ্যে থেকে কাঠ বেকার। পৃথা বরাবরই খুব মিশুকে। আর তাই যে কোনো জায়গায় বন্ধু পাতিয়ে ফেলে। সেই জন্যই কখনো একা সময় কাটায়নি স্বেচ্ছাতে। আর এখন তো আরোই কষ্ট হচ্ছে। মন কেমন করছে। কলকাতার জন্য। ঋষির জন্য। বন্ধুও খুব একটা এখনো এত তাড়াতাড়ি হয়নি যে উইকেন্ডে প্ল্যান করবে। প্রিয় বান্ধবী সুদেষ্ণাকে ফোন করলো পৃথা। এদিক ওদিক কথা প্রসঙ্গে শেষমেশ ঋষির কথা সেই উঠলোই। জানতে পারলো, সামনের মাঘেই ঋষির বিয়ে। এতক্ষণে সেদিন ঋষির "প্লিজ একবার ফোন ধরো, কথা আছে" লেখা মেসেজের মানে বোঝে পৃথা। মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। যতই ঋষি ওকে ঠকাক, ভালো তো বেসেছিলো পৃথা ওকে। আর তাই সুদেষ্ণার কাছে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে ও। সুদেষ্ণা বিহ্বল হয়ে যায়। কীভাবে বন্ধুকে সামলাবে, বোঝে না। শনিবার রাতটা ঘুমোতে পারে না পৃথা। সারা রাত ছটফট করতে থাকে। বিছানায় শুয়ে একবার এপাশ একবার ওপাশ। শেষমেশ ভোর রাত্রির দিকে প্লে স্টোর থেকে ডেটিং app নামায়। নিজের প্রোফাইল বানায়। বেশ ঝকঝকে আকর্ষণীয় করে। তারপর এলোমেলো করে একটার পর একটা ছেলের ছবি আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে দেখতে থাকে। ধুর। একটা কারুর প্রোফাইলে গিয়ে একটুও মনে ধরলো না। প্রেম তো দূর অস্ত, সামান্য কথোপকথনের যোগ্যও কাউকে লাগলো না। আরো বিরক্তি ধরে গেল ওর। ফোনটা নামিয়ে রাখবে, এমন সময় চোখ আটকে গেলো স্ক্রিনে। আরে, এ যে সহযাত্রী। উপমন্যু রায় চৌধুরী। বয়স একত্রিশ। পেশায় কপিরাইটার। সেপিওসেক্সুয়াল। খাদ্যরসিক। বিড়াল ভালোবাসে। হুম। ইন্টারেস্টিং। মনে মনে ভাবে পৃথা। একটা সুযোগ দেওয়াই যায়। কিছু না হোক, অজানা শহরে একজন চেনা জানা বাঙালি তো হবে। রাইট সোয়াইপ করেই দেয় পৃথা। আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই নোটিফিকেশন আসে, "ম্যাচ"। শুরু হয় চ্যাটে কথাবার্তা। আর সেই থেকেই ঠিক হয় পরেরদিন, অর্থাৎ আজকের এই লাঞ্চ প্ল্যান।

No comments:

Post a Comment