Sunday, August 11, 2019

হৃদয়পুর ২

মোহরের হাবভাব দেখেই সৃজনী বুঝে যায় সব। হতেই হবে। এতদিনের বন্ধু বলে কথা। প্রমিতের এই আচরণে যে মোহর মোটেই খুশি হয়নি, তা ওর মুখ চোখ আর অদ্ভুত ভাবে 'ওহ' বলাতেই সৃজনী বুঝে নিয়েছে। অবস্থার সামাল দিতে তাই ওই আবার ফিল্ডে নামলো। বললো, "কী গো প্রমিতদা, মুখার্জি কাকা আছেন? আমি কি ওপরে যাবো?" সৃজনীর কথায় সম্বিৎ ফেরে প্রমিতের। ওদের ওখানে সোফায় বসতে দিয়ে "আমি এক্ষুণি বাবাকে জানাচ্ছি গিয়ে। তোমরা বসো বৌদি" বলে হড়বড় করে সিঁড়ির দিকে ছুটতে থাকে। এবং একবার হোঁচট খেয়ে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে তবে ওপরে ওঠে। মোহর লক্ষ্য করে, অফিস ঘরের লাগোয়া একটা লোহার রেলিং দেওয়া সিঁড়ি। সিঁড়ির পাশে দেওয়ালে অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর অয়েল পেইন্টিং টাঙানো। মোহর নিজে ভালো নাচ করে। তাই স্বাভাবিকভাবেই শিল্পের কদর ও করে। সৃজনীকে মৃদু টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "হ্যাঁ রে, এই পেইন্টিং দিয়ে বাড়ি সাজানোর আইডিয়া কার রে?" সৃজনী মুখ টিপে হেসে বলে, "ও ওগুলো? ওগুলো তো সবই মাসিমার কাজ। প্রমিতদার আঁকা যত্ন করে তো মাসীমাই সব বাঁধিয়ে সাজিয়ে রাখে। প্রমিতদা মুখচোরা মানুষ। এইসব লোককে দেখাতে চায় না। মাসীমাই জোর করে রাখেন।" মোহরের অবাক হওয়ার পালা। "এক মিনিট এক মিনিট। এই মাসীমা কে?"
সৃজনী হো হো করে হেসে বলে, "ওই তো। মুখার্জি কাকার স্ত্রী। বেলা মাসীমা।" মোহর ভুরু কুঁচকে বলে, "ওয়াট? কাকার স্ত্রী মাসী?" সৃজনীর হাসি আর থামে না। ও বলতে থাকে, "আরে হ্যাঁ হ্যাঁ। কাকা হলেন বাপির বন্ধু। আর মাসীমা মায়ের বন্ধু। সেই সূত্র ধরেই এরকম।" মোহর ভাবে, এ কীরকম জায়গা, কীসব মানুষ। উদ্ভট। পরমুহূর্তেই মনে পড়ে যায় পেইন্টিংগুলোর কথা। সৃজনীকে বলে, "ইউ মিন, ওই ভূতটা এঁকেছে অমন সুন্দর পেন্টিং?" সৃজনী উত্তরে চুপ থাকে। শুধু বান্ধবীর অবাক হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসে। মোহর বলতে থাকে, "যে লোক কিনা একটা সামান্য ল্যাপটপ সামলাতে পারে না, নিজের বাড়ির সিঁড়িতে উঠতে হোঁচট খায়, সে? সে এমন আঁকলো কী করে? এই, তুই নির্ঘাত গুণধরের গুণকীর্তন করতে গিয়ে বানিয়ে বলছিস।" সৃজনী মোহরের দিকে কটমট করে তাকায়। মোহর আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময়ে ওদের কানে এলো এক গম্ভীর গলায় "কী হয়েছে সৃজনী? তোমার বান্ধবী কী বলছে?" সৃজনী উঠে গিয়ে প্রণাম করতে গেল। মোহরও পিছু পিছু উঠলো। ভদ্রলোক দুই হাত ওদের মাথায় রেখে "বেঁচে থাক মা" বলে এসে বসলেন। ওদেরও বসতে দিলেন। মোহর অবাক হয়ে ওঁকে দেখছিল। ইনিই তাহলে মুখার্জি কাকা। কী সৌম্য চেহারা। লম্বা। চুল পেকে গেলেও বয়সের তেমন প্রভাব নেই চেহারায়। মুখটা যেন একদম ছেলের মতো।
ভারী অমায়িক কণ্ঠস্বরে কথা বলছিলেন। ওদের জন্য কাজের লোক শম্ভুকে ডেকে চা জলখাবার আনতে বললেন। সৃজনী আপত্তি করলেও উনি আপত্তি শোনেননি। মোহরের দিকে তাকিয়ে বললেন, "তা মা, বলো, তোমার কী সমস্যা হচ্ছে?" মোহর একটু হকচকিয়ে যায়। অবস্থার সামাল দিতে সৃজনী কথা শুরু করতে গেলে মুখার্জি কাকা ওকে থামিয়ে বলেন, "দরকার যার, সেই বলুক।"
মোহর একটু নড়েচড়ে বসে বলে, "আসলে ব্যাপারটা হলো আমি হৃদয়পুর গভর্নমেন্ট কলেজে ম্যাথস পড়াতে এসেছি। এসিস্টেন্ট প্রফেসর হিসেবে।" এইটুকু শুনেই মুখার্জি কাকা "বাহ বাহ। খুব ভালো। খুব ভালো। তা এটা নিশ্চয়ই সমস্যা না। বলো কী চাই।" মোহর ভাবে, বড্ড কথা থামিয়ে দেন তো। আচ্ছা লোক। যাই হোক, ও বলতে থাকে, "তা আমি একটা থাকার জায়গা খুঁজছি। ভাড়া গোছের। পেয়িং গেস্ট হলেও হয়। তবে দক্ষিণ খোলা ঘর। এবং আমার কলেজ থেকে হাঁটা পথ। বাজেটের ব্যাপার আছে। আর হ্যাঁ, আমার পি এইচ ডি চলছে এখনো। তাই লেখাপড়া থাকে। সেই জন্যই একটু শান্ত পরিবেশ খুঁজছি। সাথে সেই এরিয়াতে ভালো ইন্টারনেট চাই। নইলে আমার রিসার্চে অসুবিধে হবে।"
মুখার্জি কাকা খানিক চুপ করে থাকলেন। তারপর মাথা এদিক ওদিক নেড়ে পাশে রাখা ল্যান্ডলাইন ফোন থেকে কাউকে একটা ফোন করলেন। অপর প্রান্তে যিনি আছেন, তিনি সম্ভবত বাড়ির দালাল। কাকা ওঁকে সব বললেন। তারপর খানিক চুকচাক আক্ষেপ করে ফোন কেটে বললেন, "নাঃ। সহদেবকে ফোন করলাম। হৃদয়পুরের সব বাড়ি ভাড়ার হদিস ওঁর কাছে থাকে। ও বললো এমন বাড়ি নেই কোনো। বেশ চিন্তার কথা।"
মোহরের মুখ কালো হয়ে গেল। যাঃ। শুরুতেই এই। কেন যে এখানে চাকরিটা নিলো।
সৃজনীর সাথে ওর বাড়ি ফিরলো ওরা। সারা রাস্তা আর কেউ কথা বলেনি বিশেষ। সৃজনী যেন চুপসে গিয়েছে। মুখার্জি কাকার বাড়ি থেকে সৃজনীর বাড়ি রিকশায় মিনিট সাতেক। বাড়ি ঢুকে সৃজনী সোজা রান্নাঘরে ঢুকলো। কাজের মাসী সোনাদিকে চা বসাতে বলে তবে মোহরের ঘরে এলো। বললো, "মোহর, চিন্তা করিস না। কাকা কিছু না কিছু ব্যবস্থা করবেনই। উনি খুব দায়িত্ববান।" মোহর মাথা নেড়ে জামাকাপড় বদলাতে ঢুকে যায় বাথরুমে।
চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে সোনাদি ওদের ডাকে। তুষারের মা বাবা আর তুষার ইতিমধ্যেই এসে গিয়েছে লিভিং রুমে। মোহর আর সৃজনী এলো একসাথে। সবে চায়ের কাপে চুমুক পড়েছে, তক্ষুনি সৃজনীর মোবাইলে ফোন বাজলো। স্ক্রিনে মুখার্জি কাকার নাম।

No comments:

Post a Comment