রবিবারগুলো একটু আয়েশ করে বেলা করেই সাধারণত ঘুম থেকে ওঠে মোহর। শনিবার অনেক রাত অবধি বই পড়ে। তাই ঘুম ভাঙতে দেরি হয়। কাকিমাকেও বলা আছে সেটা। আর তাই সকালের চা ওর জন্য ভোরবেলা আসেনা। বেলা প্রায় এগারোটা। মোহর স্নান করে বারান্দায় কাচা জামাকাপড় মেলছে। এই হৃদয়পুরের জল হাওয়া বেশ ভালো বলতে হয়। দু আড়াই মাসেই ওর কাঁধ অবধি চুল এখন প্রায় কোমর ছুঁই ছুঁই। ভিজে শ্যাম্পু করে মাথায় তোয়ালে বেঁধে আপন মনে গুনগুন করতে করতেই কাজ করছিল বারান্দায়। এমন সময় চোখ চলে গেল নীচে। দেখলো, গ্যারেজ থেকে বাইক বের করছে প্রমিত। নীল জিন্সের শর্টস আর হলুদ টিশার্ট। চোখে রোদচশমা। কে জানে কেন, প্রমিত একবার ওপর দিকে তাকালো। এবং মোহরের সাথে চোখাচুখি হলো। মোহর এক ঝটকায় মুখ ঘুরিয়ে নিলো। মুহূর্তেই বাইক বেরিয়ে যাওয়ার শব্দ শুনলো। মোহর অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো। মনে পড়ে গেলো এক সপ্তাহ আগের কথা।
সবে ইন্টারনেট ঘেঁটে ঘেঁটে সার্ভিস এপার্টমেন্টের খোঁজ না পেয়ে বাধ্য হয়ে কলিগ অর্পিতাদির বরকে ফোনে ধরেছে। ভদ্রলোক সার্কিট হাউজের ক্যাটারিংয়ের কন্ত্র্যাক্টর। প্রচুর জানাশোনা। বিডিও লেভেল টেভেল অবধি। তাই ওঁকে বলছিল মোহর। মা বাবা এলে থাকার জায়গা চাই তো। মায়ের গলস্টোন অপারেশনের পর থেকে খাওয়া নিয়ে খুব সমস্যা। কিচেন না পেলে মুশকিল। তাই এই ব্যবস্থা। ও মা, তক্ষুণি ঘরে প্রবেশ শ্রীমানের। এবং এসেই প্রশ্ন। কেন মোহর এইসব খুঁজছে। মোহরের মুহূর্তেই মাথা গরম হয়ে গেল। বরাবরের স্বাধীনচেতা মেয়ে। মা বাবা তেমনভাবেই মানুষ করেছেন। হঠাৎ করেই তাই কাজের কৈফিয়ৎ চাওয়ায় মোহর স্বাভাবিকভাবেই রেগে গিয়েছিল। ঠান্ডা গলায় তাই জিজ্ঞেসও করে, "আপনি কি আমার কথায় আড়ি পাতছেন?" প্রমিতের মুখটা দেখার মতো ছিল। মুহূর্তেই চুপসে গেল। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, হকচকিয়ে গিয়ে। মোহর সুযোগ না দিয়েই বললো, "আমি কী করছি না করছি, তার ব্যাপারে কি আপনাকে কৈফিয়ৎ দিতে বাধ্য নাকি?" প্রমিত এতক্ষণে মুখে কথা খুঁজে পেয়ে বলে, "না মানে আমার তখনের ব্যবহারটা খুবই আনকল্ড ফর ছিল। আই এম এক্সট্রিমলি সরি আবাউট ইট। আমি তাই ভাবলাম যে হয়তো আপনি তাই রেগে গিয়ে অন্যত্র যাওয়ার জন্য জায়গা খুঁজছেন। প্লিজ এরকমটা করবেন না। মা বাবা তাহলে..." প্রমিতের কথা মাঝখানেই কেটে দিয়ে মোহর বলে, "নিজেকে এতটা ইম্পরট্যান্ট ভেবে ফেললে তো বড্ড মুশকিল মিস্টার মুখার্জি।" ব্যস। আর একটা কথাও বলতে হয়নি মোহরকে। প্রমিত মুখ কালো করে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সেদিন। তখন মোহরের কিছু মনে না হলেও, পরে কিন্তু বেশ খারাপ লেগেছে। একটু বেশিই কি রূঢ় হয়ে গেল না? প্রমিতকে তো দেখে মন্দ লোক বলে মনে হয়না। হয়তো কোন পাস্ট ইস্যু আছে। সেই জন্যই এমন ব্যবহার করে। মোহর ম্যাথসের স্টুডেন্ট হলেও সাইকোলজি নিয়ে জ্ঞান ছিল অল্পবিস্তর। কলেজে পড়াকালীন একজন সাইকোলজি অনার্সের ছেলের ওপর হালকা চাপ ছিল। তাকে ইমপ্রেস করতে প্রচুর বইপত্র পড়েছে। কলেজ স্ট্রীট গিয়ে পুরোনো বইপত্র ঘেঁটে নেট ঘেঁটে কম রিসার্চ করেনি। নাহয় সম্পর্কটা এগোয়নি। কিন্তু জ্ঞানটা রয়েই গিয়েছে। আর তাই মোহর ভিতরে ভিতরে খুব অস্বস্তি বোধ করছে। আচ্ছা, ওর এই ব্যবহারের জন্য প্রমিত আরো এফেক্টেড হবে না তো? যদি এতে প্রমিতের ক্ষতি হয়?
সারা সপ্তাহ মোহর অনেক চেষ্টা করেছে প্রমিতের সাথে মিটমাট করে নেওয়ার। কিন্তু পারেনি। সুযোগ আসেনি। প্রমিত একবারের জন্যও ওর মুখোমুখি বা সামনাসামনি হয়নি। বরং বারবার এড়িয়ে গিয়েছে মোহরকে। ওর সাথে যাতে দেখা না হয়, বেশিরভাগ দিনই প্রমিত আগে বা পরে খাচ্ছে। পাশাপাশি ঘর হলেও, ঘরের দরজা বন্ধ সব সময়। গত বুধবার, সকাল সকাল মোহর ব্রেকফাস্ট করছে, এমন সময় প্রমিত ঘুম চোখে মাকে খুঁজতে খুঁজতে এসেছিল, চায়ের সন্ধানে। কাকীমা তখন বললেন, "ও, তুই উঠে গেছিস? দাঁড়া, চা দিচ্ছি। ব্রেকফাস্টও করে নে। সুজি করেছি।" প্রমিত একবার টেবিলের দিকে দেখলো, মোহর মাথা নিচু করে খাচ্ছে। "থাক। পরে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ো। কাজ আছে ঘরে।" এই বলে নিজের ঘরে ফিরে গেল। কথাগুলো শুনে মোহর চমকে উঠলো। কাকীমাও অবাক। "কী যে করে ছেলেটা, কিচ্ছু বুঝিনা আমি", বলতে বলতে রান্নাঘরে ঢুকে যান। মোহর বোঝে। সব বোঝে। বাবু এখনও রেগেই আছেন ওর ওপর। গোঁসা করেছেন। এই অভিমান ভাঙাতেই হবে।
আনমনা হয়েই এসইব ভাবছিল মোহর। সম্বিৎ ফিরলো মোবাইলের শব্দে। ফোন বাজছে। স্ক্রিনে সৃজনীর নাম। হাসি হাসি মুখ করেই ও ফোন তুললো, বললো, "হ্যাঁ রে বল।" তারপর অপরপ্রান্ত থেকে যা শুনলো, তা শোনার জন্য একটুও প্রস্তুত ছিল না মোহর।
No comments:
Post a Comment