সবেমাত্র মিঃ সরখেল গেলেন হিসেব নিকেশ বুঝিয়ে দিয়ে। এবং যা বললেন, তা মোটেই সুখকর না। নতুন করে কোন আয় নেই। জমা টাকাপত্র যা আছে, তাতে আর মেরেকেটে বছর পাঁচেক চলে যাবে। কিন্তু তারপর? এই এত বড় বাড়ির মেন্টেনেন্স? কিছুদিন আগেই উৎপাত শুরু। সকাল সকাল শোভা স্নান সেরে ঠাকুর পুজোর তোড়জোড় করছেন, সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ নীচতলা থেকে মলয়ার চীৎকার। "কি সব্বনাশ হল গো। শীগগির এসো কত্তা মা।" মলয়ার সবকিছুতেই বড্ড রঙ চড়িয়ে কথা বলার অভ্যেস। কাজেই প্রথম প্রথম তেমন গা করলেন না শোভা। ভাবলেন, একেবারে পুজো মিটিয়ে তারপরে নীচে নামবেন। কিন্তু তা আর হল না। খানিকক্ষণের মধ্যেই মলয়া ওপরে এসে হাজির। "ও কত্তা মা, সব্বনাশ হয়েছে। তোমায় নীচে ডাকছি, শুনতে পাওনি? এসো এসো, শীগগির এসো, দেখো কাণ্ড।"
"কেন কি হল আবার?"
"এক তলার ঘরে জল ঢুকে টইটুম্বুর অবস্থা। আমি ঘর পরিষ্কার করতে খুলেছি, আরেকটু হলেই মেঝেতে পা হড়কে পড়ছিলাম। মেঝেতে জলে জলাক্কার।"
"কোত্থেকে জল এলো? বাথরুমে কল খোলা ছিল নাকি?"
"না গো না। দেওয়াল ভেদ করে জল এসছে।"
" সে কি? বাহাদুর কে বল প্লাম্বার ডাকতে। চল তো দেখি।"
হাঁটুর ব্যাথাটা আবার বেড়েছে। কোনমতে একতলায় এসে যা দেখলেন, বেশ চিন্তার বিষয়। লাল সিমেন্টের মেঝেতে প্রায় গোড়ালি অবধি জল। খানিক বাদে প্লাম্বার এসে যা বলল দেখেশুনে, তার সারমর্ম এই যে একটা বড় খরচের ধাক্কা। পাইপলাইনে কিছু আটকে আছে, জায়গায় জায়গায় মর্চেও ধরেছে। দেওয়াল ভেঙ্গে পাইপের কাজ করতে হবে। আপাতত অত খরচের জন্য টাকা হুঠ করে এরকম বের করা যে অসম্ভব, ভালোই বোঝেন শোভা। ছাদের জলের লাইন বন্ধ করে বালতি করে জল ব্যবহারের নির্দেশ দিলেন। তড়িঘড়ি সরখেল, অর্থাৎ পারিবারিক উকিলকে ডেকে পাঠালেন।
সরখেলও ওই আসছি, আজ কাল করতে করতে প্রায় এক সপ্তাহ পরে এসে যা হিসেব দিল, তা শুনে শোভার মাথায় হাত। বছর দুই আগে স্বামী মারা গিয়েছেন। প্রাইভেট ফার্মে চাকরীর সুবাদে কোন পেনশন নেই। উত্তর কলকাতার রক্ষণশীল বনেদী বাড়ির মেয়ে ও বৌ হওয়ার সুবাদে অনার্স সহ গ্র্যাজুয়েশন পাস করলেও কোনোদিনও চাকরীর চিন্তা মাথায়ই আসেনি শোভার। কেবলমাত্র স্বামীর উপার্জন ও জমানো টাকার ওপর নির্ভর করে চললেও বর্তমান পরিস্থিতি থেকে কীভাবে মুক্তি পাবেন, এই চিন্তাই করছিলেন। বিমল বাবু কোনদিনও টাকা পয়সার হিসেব পরিস্থিতি কিছু কখনো শোভাকে বলতেন না। নিঃসন্তান হওয়ায়, শেষ দিকে এসে যখন রোগে ভুগে শয্যাশায়ী, তখন সরখেলকে ডেকে শোভার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ওনার মৃত্যুর পর খরচের লাগাম টেনে নিজের হাতে সংসারের দায়িত্ব নিয়ে দিব্যি চলছিল। কখনো কল্পনা করেননি যে টাকার জন্য অসুবিধেয় পড়তে হবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, ঘটে আরেক। এক বছর আগে শোভার এক দূর সম্পর্কের ভাই এসে কান্নাকাটি করে তার মায়ের চিকিৎসা বাবদ বেশ কিছু টাকা নিয়ে গেলেন। চিরকাল সকলের বিপদে আপদে দাঁড়িয়েছেন বিমল ও শোভা, তাই এখনো কেউ কোন বিপদে পড়লে আগে শোভার কাছে আসে। এই রকম করে আরো কয়েকজনকে সাহায্য করে শোভার ভাঁড়ার শূণ্যের দিকে। পাড়ার দুর্গা পুজোয় মোটা চাঁদা দেওয়া, কালী পুজোয় ক্লাবের ছেলেদের বাজি কিনে দেওয়া, দোলে আশেপাশের সমস্ত বাড়িতে ভীম নাগের মিষ্টি পাঠানো, কত কিছু চলত। আর এখন কি না সামান্য একটা রেনোভেশনের জন্য দশবার ভাবতে হচ্ছে। কি দিনকাল পড়ল। খরচ বাঁচাতে গাড়িটাও বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। যেটুকু যা বেরোন শোভা, বাহাদুর ট্যাক্সি ডেকে দিলে প্রয়োজন মিটে যায়।
কে জানে কী করে, কিন্তু এইসব খবর বুঝি বাইরে খুব সহজেই রটে যায়। মাস ছয়েক আগে কাজারিয়া বিল্ডারস থেকে একজন বাড়ি এসে ভালো মতন করে সরেজমিনে দেখে টেখে লোভনীয় অফার করেন। বাড়ি জমির পরিবর্তে এখানে যে নতুন ফ্ল্যাট উঠবে, তাতে দুখানা শোভার প্রাপ্য। আর নগদ পাঁচ লাখ টাকা। প্রচন্ড রেগে গিয়েছিলেন সেদিন এমন অফারের কথা শুনে। এই বাড়ি ওদের আভিজাত্য, ওদের গর্ব। বেঁচে থাকতে কখনোই বিক্রি হতে দেবেন না। রীতিমত রাগে গড়গড় করতে করতে কাজারিয়ার কর্মচারীকে বাড়ি থেকে সেদিন বিদায় করেছিলেন শোভা। দুইদিন পরে চিঠি আসে ওদের থেকে। অফারটি বহাল রয়েছে। উলটে পাঁচের জায়গায় সাত দেওয়া হবে। উনি যেন ভাবনা চিন্তা করেন। যখনই মত বদলাবেন, অবশ্যই যেন ফোন করেন ওদের। ওদের লোক সঙ্গে সঙ্গে এসে এগ্রিমেন্টের ব্যাপারে কথা বলে নেবে। আজ শোওয়ার ঘরের এসে কাঠের আলমারিটা খুলে কাপড়ের নীচে সযত্নে রাখা সেই চিঠিটি বের করলেন শোভা। বাড়িটি তবে বিক্রি করবেন কি? যদি ঠিক করে রাখতেই না পারেন, তাহলে রেখে কি হবে? অন্তত বিক্রি হলে কিছু টাকা আসবে, ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে। কিন্তু...এই বাড়ী, তার শ্বশুর মশাইয়ের ঠাকুরদার নিজের বানানো বাড়ি, সান্যালদের এতদিনের ভিটে বিল্ডারদের হাতে চলে যাবে? এই দালান, গাড়ি বারান্দা, উঠোন, কড়ি বর্গা, কাঁচের ওপর রঙ করা জানলা, চিলেকোঠার ঘর, লম্বা লম্বা টানা পাখা, ঝাড়বাতি, দামী শেগুন কাঠের চেয়ার টেবিল সবার আয়ু ফুরোলো বুঝি?
চিঠিটি হাতে নিয়ে আরামকেদারায় বসে থাকতে থাকতে দুই চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছিল। ঘুম ভাঙল শ্রীরাধার ডাকে। শ্রীরাধা ওদের পাশের বাড়িতে থাকে। বছর তিরিশেক বয়স। আগে বম্বেতে থাকত, এক বছর হতে চলল কলকাতায়। ও আর ওর স্বামী পরিমল একটা স্টার্ট আপের সাথে যুক্ত। সারাদিন তাই অনেক খাটাখাটনি লেগেই আছে। কাজের জন্য অনেক সময়েই বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। সেইসব সময়ে ওদের চার বছরের বাচ্চা, রুমিকে শোভার কাছে রেখে যায়। রুমির সাথে শোভার খুব ভাব। আসলে নিজের কোন সন্তান না হলেও, বরাবরই আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের ছেলে মেয়ে, নাতি নাতনিদের সাথে শোভার আলাপ, ভাব সহজেই হয়ে যায়। ওর মধ্যে কিছু একটা আছে, যাতে বাচ্চারা খুব সহজেই ওর সাথে মিশতে পারে। শ্রীরাধা প্রথম প্রথম দ্বিধা করত রুমিকে খালি খালি শোভার কাছে রেখে যেতে, কিন্তু শোভাই একদিন বলল, " হ্যাঁ রে শ্রী, তোর মেয়েকে ওই কাজের লোকের কাছে সারাক্ষণ রাখিস কেন রে? আমার কাছে তো দিব্যি থাকে। তুই যখন ব্যস্ত থাকবি, ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিবি। আমারও একটু সময় কাটে। রুমিরও ভালো লাগে।"
"আসলে মাসি, আমি তো খুবই নিশ্চিন্ত হব তোমার কাছে রুমিকে রাখতে, শুধু ভাবি যে তোমার অসুবিধে হয় যদি কোন।"
সঙ্গে সঙ্গে শোভার উত্তর, "ও, মাসী বলবি মুখে, কিন্তু ভাবিস না। এই তো? আজ যদি তোর সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক হত, তাহলেও এমন দশবার ভাবতি তো?"
"আরে তা না মাসী। বেশ, ঠিক আছে। এবার থেকে রুমি তোমার কাছে থাকবে। কিন্তু সাথে আমি ওর আয়াকেও পাঠিয়ে দেব যাতে তোমার ওপর বাড়তি হ্যাপা না হয়। রাজি?"
" রাজি।"
সেই থেকেই রুমি শোভার কাছে দিনের মধ্যে বেশ খানিকটা সময় কাটায়। দুজনে মিলে চলে নানান খেলা, লাল কমল নীল কমলের গল্প। শোভার কাছে রামায়ণ মহাভারতের গল্প শুনতে শুনতে ছোট্ট রুমি তখন পৌঁছে যায় কল্পনার রাজ্যে। কিন্তু আজ শ্রীরাধা একা এসছে। একটু অবাক হলেন শোভা। জিজ্ঞেস করলেন, " কী রে, আজ তুই একা? আমার নাতনি কই?"
"নাতনি খেলছে তার বাবার সাথে। আমি তাই এমনিই এলাম তোমার খবরাখবর নিতে।"
" বেশ করেছিস। চা খাবি?"
"হ্যাঁ, দাঁড়াও মলয়া দি কে বলে আসি।"
মলয়াকে চায়ের কথা বলে এসে গুছিয়ে বসল শ্রীরাধা।
"কেমন আছ বল।"
"আর কেমন আছি। ওই আছি এক রকম রে। কবে ডাক পাব, সেই অপেক্ষায়।"
"আহ মাসী।"
" কি হবে বল বেঁচে থেকে? সমস্যাই সমস্যা।"
"কেন? কী হল?"
"টাকা পয়সা রে।"
"টাকা পয়সা কী হয়েছে?"
"বাড়িটা সারানোর জন্য তেমন ফান্ড নেই রে। এই এত বড় বাড়ি মেন্টেন করা চারটিখানি কথা না রে মা।"
" হ্যাঁ সে তো বটে। তা আঁকড়ে পড়ে আছ কেন? ওই কাজারিয়াদের দিয়ে দাও না। দিব্যি ছিমছাম ফ্ল্যাট পেয়ে যাবে। আরামে থাকবে।"
"না রে মা, তুই বুঝবি না। বিক্রি করে দাও বললেই হয়না। কত স্মৃতি এই বাড়ির সাথে।"
" ধুর সারাক্ষণ ওই স্মৃতি স্মৃতি করে গেলে হবে নাকি?"
" কী করব বল। চোখ বন্ধ করলেই যে পরিষ্কার দেখতে পাই সব ফেলে আসা দিনগুলি।"
" সে ঠিক আছে। কিন্ত প্র্যাক্টিকালি ভাবতে হবে তো। "
" দেখ তোর মেসো আর আমার ইচ্ছে অনুযায়ী আমাদের অবর্তমানে এই বাড়ি মিশনে দান করে যাব। তার আগে অবধি এখানে এই ভিটেতে না থাকলে কী করে চলবে বল তো?"
" সবই বুঝি মাসী, কিন্তু।"
" পঞ্চাশ বছর আগে এই বাড়িতে যখন প্রথম পা ফেলি, কতই বা বয়স আমার। উনিশ কি কুড়ি। কত জমজমাট তখন এই বাড়ি। লোকে ভর্তি থাকত সারাক্ষণ। শাশুড়ির তত্ত্বাবধানে কত মানুষের সেবা যত্ন করেছি। আত্মীয়স্বজনের আসা লেগেই থাকত গ্রামের বাড়ি থেকে। এই যে, এই চৌকাঠ, এটা পেরিয়ে এই বাড়িতে যখন ঢুকেছিলাম, আমার দিদিশাশুড়ি বলেছিলেন, ও নাতবৌ, এই যে এলে, আর কিন্তু কক্ষনো যাওয়ার কথা ভুলেও ভেবোনা। তুইই বল শ্রী, আমি কি করে এই বাড়ি ভাঙ্গতে দিই?"
" বুঝি, কিন্তু ওই যে। কিছু করার নেই তো। দাঁড়াও, তুমি এখুনি কাজারিয়াদের সাথে যোগাযোগ করোনা। আমি আর ধ্রুব একটু ভাবি। কিছু করা যায় কিনা।"
শ্রীরাধা চলে যাওয়ার পরে শোভা অনেকক্ষণ দোতলায় নিজের শোওয়ার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন। সামনের রাস্তাটা পার হলেই বড় রাস্তা। বিমল অফিস যেতেন যখন, ঠিক এইখান থেকে দাঁড়িয়ে দেখতেন, যতক্ষণ না গাড়িটা চোখের আড়ালে চলে যায়। আবার সন্ধ্যেবেলা ফেরার সময় হলেই ঠিক সব কাজের মধ্যেও চলে আসতেন। পথ চেয়ে রইতেন। এই অভ্যেস বিয়ের পরপরই। শাশুড়ির কাছে এই নিয়ে প্রথম প্রথম কথা শুনলেও আসতে আসতে সয়ে গিয়েছিল। পুজোর দিনগুলিতে এই বারান্দা থেকে সারা রাত রাস্তার আলো, লোক সমাগম দেখতেন। কাছেই কিছু ঐতিহ্যবাহী পুজোর প্যান্ডেল থাকায় গোটা রাত এই অঞ্চলে ভিড় থাকত। শমুর যখন চার বছর বয়সে হার্টের অসুখ ধরা পড়ল, রাতের পর রাত এইখানে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলেছেন শোভা। ভোর হতে না হতে ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি ছুটেছেন, ছেলের প্রাণভিক্ষা করতে। অসুস্থ শমুর যখন বাড়ির বাইরে বেরোনো বারণ, গরম জামা জড়িয়ে ওকে কোলে নিয়ে বসতেন এই বারান্দায়। চাঁদের পাহাড়, জাতক, টিনটিন সব পড়ে শোনাতেন। শমুর নিথর দেহটা নিয়েও এই বাড়ি থেকে যখন বিমল গেল, একবার মাথা তুলে ওপরে তাকিয়ে দেখেছিলেন শোভাকে। পাথরের মত দাঁড়িয়ে তখন তিনি এই বারান্দায়। এই বারান্দাই ওনার বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ। কিছু টগর, জুঁই, বেল আর নয়নতারায় ভরিয়ে দিয়েছেন। প্রতিদিন এদের পরিচর্যায় কেটে যায় অনেকটা সময়। খড়খড়ে ইটের দেওয়ালে হাত দিয়ে এই বাড়িটার ভেঙ্গে ফেলা ভাবতেই দু চোখ দিয়ে কখন জল নেমেছিল, খেয়ালই করেননি। টনক নড়ল, ঘরের দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটার ঘণ্টা বাজায়। সেই আদ্যিকালের ঘড়ি। বিলেত থেকে শ্বশুরমশাই আনিয়ে দিয়েছিলেন, বিয়ের প্রথম বছরে। না, এই বাড়ি কিছুতেই ভাঙ্গতে দেওয়া যায় না। কিছু একটা করতেই হবে। এত স্মৃতি, এত টান। দুপুরে খাওয়ার পরে শোভা অনেকক্ষণ বসার ঘরে রইলেন। ভাবনা চিন্তা করলেন। বিকেল পাঁচটা বাজতেই সঙ্গে সঙ্গে শ্রীরাধাকে ফোন করলেন।
" হ্যালো শ্রী? ধ্রুব আর তুই কি একবার আমার কাছে আসতে পারবি এখন? একটু জরুরি আলোচনা ছিল।"
" নিশ্চয়ই। আসছি আমরা। সব ঠিক আছে তো?"
" হ্যাঁ রে। সে ঠিক আছে। রুমিকে নিয়ে আসিস। ও খেলবে। আমরা কথা বলব।"
"বেশ। আসছি খানিকক্ষণের মধ্যে।"
আধ ঘণ্টা পরে ওরা এলো। রুমি তার দিদানকে দেখে খুশীতে ডগমগ। দিদিমা নাতনি একে অপরকে খানিক আদর করে তারপরে রুমিকে ওর খেলনার সাথে বসিয়ে দিয়ে শোভা এসে বসলেন শ্রীরাধাদের কাছে। প্রাথমিক কুশল সংবাদ আদান প্রদানের পর আসল কথায় অবতীর্ণ হলেন।
" তোদের যে জন্য আমার ডাকা, এবার বলে ফেলি।"
" হ্যাঁ বল।"
" এই বাড়িটার মেন্টেনেন্স, আমার আগামী দিনের বেঁচে থাকার খরচাপাতি সবের একটা আন্দাজ মোটামুটি করে আর সরখেলের দেওয়া হিসেব দেখে যেটা বুঝেছি, এই বাড়ি আমার পক্ষে রাখা খুব মুস্কিল। অথচ বাড়ির সাথে এত স্মৃতি জড়িয়ে আছে, বিক্রির কথাও ভাবতে পারছিনা। আমি তাই ঠিক করেছি, এই বাড়িটাকে ভাড়া দেব। ওই ধর পেয়িং গেস্ট মত। আর একতলারই আরেকটা অংশে একটা ক্রেশ খুলব। এই বিষয়ে এবারে তোদের মতামত চাইছি।"
ধ্রুব আর শ্রীরাধা খানিক একে ওপরের দিকে তাকাল, তারপর ধ্রুব মুখ খুলল।
" মাসী, এটা কিন্তু বেশ ভালো আইডিয়া, স্পেশালি ক্রেশের ব্যাপারটা। দেখো রুমি তোমার কাছে যতটা ভালো থাকে, আমার বিশ্বাস অনেক বাচ্চারাই তোমার কাছে তেমনি ভালো থাকবে। তোমার তত্ত্বাবধানে রেখে গেলে মায়েরাও নিশ্চিন্ত, তোমারও সময় কাটবে। আর সবেচেয়ে জরুরি যেটা, টাকাও রোজগার হবে। বাড়িতে বসে, যা করতে ভালোবাসো, তাই করে অর্থ উপার্জন, এটার যে কী আনন্দ, আমরা বুঝি।"
"যাক, আমি নিশ্চিন্ত হলাম শুনে। পেয়িং গেস্টের ছাত্রী রাখব, আমায় একটু লোকজন জোগাড় করে দিবি? তোরা তো অনেককে চিনিস টিনিস। "
" না না, ওই পেয়িং গেস্টের চক্করে যেওনা। কেমন না কেমন লোকজন হবে, তাদের কি উৎপাত হবে। তার চেয়ে একটা অফার দিই, ওই অংশটা তুমি আমাদেরকে যদি ভাড়া দাও, তাহলে আমাদের অফিসটা এখানে করতে পারি। এমনিও আমরা একটু এখন আমাদের অফিস বড় করতে চাইছি। নিজেদের ওই এক কামরার অফিসটা খুবই ছোট হয়ে যাচ্ছে। তোমার এখানে যদি দুটো ঘর পেয়ে যাই, তাহলে তোমারও সুবিধে। আমাদেরও সুবিধে। বাজারে যা রেট চলছে ভাড়ার, সেই টাকাই দেব তোমায়।"
" হ্যাঁ, মাসী। আমি আর ধ্রুব দুপুরে এটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। শুধু তোমার কাছে কথাটা পাড়ব কি করে, বুঝে উঠছিলাম না। "
"মন্দ নয় প্রস্তাব। আমি কটাদিন একটু ভেবে তোদের জানাই?"
"নিশ্চয়ই।"
এক বছরের ওপর হতে চলল। আজ শোভার ক্রেশের প্রথম বার্ষিকী। সব বাচ্চাদের মা বাবারা নিমন্ত্রিত। শোভা নিজে হাতে সকলের জন্য রান্না করছেন আজ। অনেকদিন পরে আবার এতজনের জন্য রান্না। প্রথম প্রথম একটু ভয় পেলেও, কড়াইয়ে গরম সর্ষের তেলে যখন প্রথম জিরে ফোড়নটা দিলেন, ওই গন্ধে ও শব্দে সব ভয় উধাও। ভয় কাটাতে আসলে প্রথম পদক্ষেপটাই আসল। ক্রেশটি শুরু করেছিলেন মাত্র চারটে বাচ্চা দিয়ে। এখন মোট ১২ জন বাচ্চা থাকে ওনার ক্রেশে। সারাদিন ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলোর সেবা যত্ন পরিচর্যা করতে করতেই দিন কেটে যায়। মাস গেলে খানিকটা টাকাও আসে। ধ্রুব আর শ্রীরাধার নতুন অফিসও ভালোই চলছে। বর্ষা শেষ হলে বাড়িটার বাইরেটা রঙ করাবেন। আজ বিকেলে এশিয়ান পেন্টসের লোকজন আসবে কোটেশন দিতে। জীবন অনেকটাই এখন মসৃণ গতিতে চলছে। বাড়িটায় এসেছে নতুন প্রাণ, নব কিশলয়ের কলকাকলিতে থাকে মুখরিত। বারান্দায় নতুন নতুন গাছ বসেছে, নীল অপরাজিতা গাছটা ফুলে ফুলে ভরে থাকে। রাত্রে জুঁইয়ের সুগন্ধে শোওয়ার ঘরটা তখন যেন নন্দনকানন ।
Tuesday, August 29, 2017
Friday, August 25, 2017
শুভ বিবাহ আবার (২)
আমি কৌশাণি মিত্র। মেয়েদের বয়স জানতে নেই, তাই বললাম না। গড়িয়াহাটের কাছে এক নামকরা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের হিস্ট্রি টিচার। বাড়ি যোধপুর পার্কে, ছয় বছর আগে, রিটায়রমেন্টের আগে আগে আমার বাবা এই ফ্ল্যাটটি কেনেন। আমার মা অতি যত্নে নিজের অত্যন্ত রুচিশীল সৃজনশীলতায় এই বাড়ির অন্দরসজ্জা প্ল্যান করেছিলেন, কিন্তু বিধাতার অন্য পরিকল্পনা থাকায় বাড়ির পোজেশন পাওয়ার মাস খানেক আগে মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে। হিমাচল প্রদেশ থেকে বেড়িয়ে ফেরার পরে পরেই শুরু হয় সাংঘাতিক পেটের যন্ত্রণা, ডাক্তার বদ্যি দেখিয়ে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা করে অবশেষে জানা যায় যে প্যাঙ্ক্রিয়াসে ক্যান্সার। তখন শুরু হয় টাটা মেমোরিয়ালে ছোটাছুটি। আমি সেই সময় প্রেসিডেন্সিতে, ফাইনাল ইয়ার হিস্ট্রি অনার্স। প্রতিদিন ২৪০ এ উঠে একদম পিছনের সীটে বসতাম, কলেজ স্ট্রীট অবধি যেতে যেতে গোটা রাস্তাটা কেঁদে কেঁদে পার করতাম। আর ফেরার পথে দক্ষিনাপণে নেমে বিভিন্ন দোকান ঘুরে ঘুরে মায়ের ডিরেকশন মত ঘর সাজানোর জিনিসপত্র কিনতাম। সেই গুলি নিয়ে ফেরার পরে মা তার কেমোয় রুগ্ন শরীর নিয়ে নিজের হাতে করে এদিক সেদিক এ কোণা সেই কোণাতে সাজাত। মায়ের বড় হওয়া বোলপুরে, আমার দাদু সঙ্গীত ভবনে গান শেখাতেন। মায়ের মধ্যে তাই একটা অন্যরকমের সৌন্দর্যবোধ ছিল, যার ফলে ছোট থেকেই আমি কখনোই ওই সলমা চুমকি দেওয়া পোশাক না পড়েও প্রতিটি অনুষ্ঠানে, স্কুলের প্রতিটি এনুয়াল ফাঙ্কশানে যাকে বলে সবার নজর কাড়তাম। আধুনিকা অথচ নিজের শিকড়কে না ভোলার এক হাসি খুশী মেলবন্ধন ছিল আমাদের জীবন। মা নিজেকে ভুলিয়ে রাখত সঞ্চয়িতা আর গীতবিতানে, বাবা অফিসে। আর আমি? আমি ছিলাম কুশানের সান্নিধ্যে। কুশান প্রেসিডেন্সিতে আমার এক ব্যাচ সিনিয়র ছিল। আমাদের ফ্রেশারসের পর থেকেই ওর সাথে প্রেম। প্রথম প্রথম প্লেটোনিক দিয়ে শুরু হলেও পরে উত্তাল উদ্দাম ভালোবাসা। ও কোর্স শেষ করে চলে গেল দিল্লী, JNUতে মাস্টার্স করতে। মায়ের অসুস্থতার খবর জানার পর থেকে ওই যেন হয়ে উঠল আমার অভিভাবক। এই ভাবেই চলছিল সব। মায়ের শরীর কখনোই ভালোর দিকে যায়নি। নানান ডাক্তার পথ্যি চেষ্টা চরিত্র করে ঠিক আমার B.A. ফাইনাল পরীক্ষা শুরুর এক মাস আগে বসন্তের এক ভোরে চোখে মুখে স্নিগ্ধ হাসির আভাটুকু রেখে মা চলে গেল।
তারপরে কি করে যে পরীক্ষা দিয়েছি, গোল্ড মেডেলটাও পেয়েছিলাম, কিচ্ছু জানিনা। মাস্টার্স করতে হায়দ্রাবাদে গেলাম। দুই বছর বাবা কলকাতায় একদম একা রইল। আমি তখন নতুন জীবনে, নতুন উদ্দীপনা। কুশানের সাথে ব্রেক আপ হয়ে গিয়েছে। তখন জীবনে অরুণ, এক তামিল ব্রাহ্মণ ছেলে। এক বছরের সম্পর্ক ছিল, কিন্তু পুরোটাই খুব আলগা আলগা। আসলে দুজনেই জানতাম, টু স্টেটসটা বইয়ে আর সিনেমার পর্দাতেই ভালো মানায়। সেকেন্ড ইয়ারে পরিচয় হল অভীকের সাথে Bengali film festivalএ। এক বছর চুটিয়ে প্রেম, প্রতি উইকেন্ডে টুকটাক ঘুরতে যাওয়া। আগে দিনে তিন বার করে বাবার সাথে কথা বলতাম ফোনে বা স্কাইপে, তখন এসে ঠেকেছিল সপ্তাহে তিনবারে। পুরনো বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন সবার থেকে দূরে দূরে থাকতাম, যোগাযোগ রাখতাম না প্রায়। কথা হলেই সবাই শুধুই মায়ের কথা বলত, আমার দিকে করুণা ভরে তাকিয়ে থাকত। আমার একদম ভালো লাগত না। যেন পালিয়ে থাকতে পারলে বাঁচতাম। বুঝতাম যে এই পন্থাটি ঠিক হচ্ছে না, কিন্তু এ ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না আমার কাছে। সাত মাস প্রেম চলল অভীকের সাথে, তারপরে ও অন সাইটে গেল সিডনি। টাইম জোন পলাতে গেল। কথা বলা কমতে থাকলো। ভৌগলিক দূরত্বের সাথে সাথে বাড়ল মনের দূরত্ব। একে একে স্কাইপ থেকে কমে শুধু ওয়াটসাপ, তারপরে শুধু ফেসবুকে লাইক। একদিন এই করতে গিয়ে জানলাম লিন্ডার কথা। লিন্ডা ওর সহকর্মী ছিল, বর্তমানে অভীকের বাগদত্তা। সেই খবর আমায় জানতে হয় স্যোশাল মিডিয়া থেকে। এর পরে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। সাংঘাতিক রকমের মানসিক আঘাত পাই। মানুষের প্রতি, সম্পর্কের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে গিয়েছিল। এই ট্রমার জেরে স্লিপিং পিলও খাই। রুমমেটদের তৎপরতায় সেই যাত্রা আমি বেঁচে যাই। ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম। সারাদিন সারারাত শুয়ে শুয়ে কেঁদে চলতাম। বাবা কে একবারের জন্যও কিচ্ছু জানতে দিইনি। মা কে খুব মনে পড়ত। তারপর একদিন কি যে হল, আবার ক্লাসে যাওয়া শুরু করলাম। পরীক্ষা দিলাম। পঞ্চম স্থান পেলাম পরীক্ষায়। ততদিনে আর পড়াশোনা করবার ইচ্ছেই ছিল না। একটা NGOর সাথে যুক্ত হলাম। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করতাম। ওদের সাথে সময় কাটালে কত বিচিত্র উপলব্ধি হত; কত অল্পেই ওরা খুশী হয়ে যায়। কত সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ওরা বড় হয়। এসব দেখে শুনে নিজের জীবনের সমস্যাকে যেন তুচ্ছাতিতুচ্ছ লাগত।
কলকাতায় ফ্ল্যাটে তখনো পরতে পরতে মায়ের ছোঁয়া। একদিন বুক শেলফটার ধুলো ঝাড়তে গিয়ে মায়ের গানের খাতায় চোখ পড়ল। পেজ মার্ক করা পাতাটি বের করলাম, মুক্তোর মত মায়ের হাতের লেখা। মায়ের প্রিয় চেলপার্ক কলমে লেখা " তখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাঁটে, কাটবে দিন কাটবে। কাটবে গো দিন আজও যেমন দিন কাটে..." কি যে হল, ওই শব্দ গুলি নাকি মায়ের হাতের লেখা। অঝোরে কান্না শুরু হল আমার। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে বাবা পাশে এসেছে, টেরও পাইনি। সারাটা দুপুর বাবার কোলে মাথা রেখে কাঁদলাম। বাবা যে এই কটা বছরে কতটা একলা হয়ে গিয়েছে, হাসি খুশী মুখে এত বলিরেখা, সব চোখে পড়ল। সেইদিন মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা করলাম। বাবা কে আর কক্ষনো কষ্ট দেবো না। সব সময় সাথে থাকবো। তাই JNUতে PhDর চান্স পেলেও নিলাম না। এই স্কুলটাতে জয়েন করলাম। দিব্যি চলছিল আমাদের বাবা মেয়ের দুজনের এই জীবন। প্রতি মুহূর্তে মা কে মিস করতাম, খুব। মাসি এক রবিবার এলো দুপুরবেলা, এসেই বাবাকে বলল, "কি জামাই বাবু, বুবাই তো আর ছোটোটি নেই। ওর তো একটা বিয়ে দিতে হয় এই বারে। কিছু ভেবেছেন?" বাবা যেন আকাশ থেকে পড়ল, এমন মুখ করে বলল, " কই না তো। কি আর এমন বয়স হল। এই সামনের মাসে সবে ছাব্বিশ হবে। এখনই কি?"
" জামাইবাবু আপনি বুঝছেন না। দিদি নেই। আপনি একা সামলাবেন কি করে সব। আপনার বয়স হচ্ছে। এটাই সঠিক বয়স ওর বিয়ের। চাকরি করছে। কেরিয়ারে স্থিতু, এবার বিয়েটা করেই নিক।"
"না মিনু, আমি ওকে ছেড়ে থাকতে পারব না।"
" ওরকম বললে কি করে হবে? ছেলে মানুষী করবেন না। এখন থেকে তোড়জোড় শুরু না করলে হবে না। ভালো পাত্র পাওয়া চারটিখানি কথা নাকি। তারপর আবার ও মেয়ের যা ট্র্যাক রেকর্ড, না জানি কাকে না কাকে এনে ধরবে আপনার কাছে। তার চেয়ে বলি কি একটা ভালো সম্বন্ধ দেখে ওর বিয়ের ব্যবস্থা করুন দেখি।"
" মিনু ওসব বুবাইয়ের কম বয়সের কাণ্ড। এখন বুবাই অনেক অনেক বেশী পরিণত, ও কক্ষনো এমন কাজ করবেই না যাতে আমার মাথা হেঁট হয়।"
মায়ের শিক্ষার ফল। তাই আমায় নিয়ে আমার জীবন নিয়ে এত গভীর আলোচনা চললেও আমি কোন কথা বলিনি। খানিক বাদে মাসী নানান খেজুরে গল্প করে চলে যাওয়ার পরে সটান গেলাম বাবার কাছে।
" বাবা আমি বিয়ে করব না। "
" কেন বুবাই? এখন না হয় করিস না, কিন্তু একদিন না একদিন তো করতে হবেই।"
" না। বিয়ে করে সুখী হব কে বলেছে?"
" আরে বোকা মেয়ে, এক অভীক ঠকাল বলে কি সবাই ওরকম হবে নাকি?"
" না। আমি এরকম arranged marriageএর পক্ষপাতী না। প্লীজ। আমায় জোর করোনা।"
" আচ্ছা। ঠিক আছে।"
মাস খানেক সব ঠিকঠাক চলছিল। বাবা অবশ্য তলে তলে যে ম্যাট্রিমোনি ওয়েবসাইট ঘাঁটছিল, আমি তা ব্রাউসিং হিস্ট্রি দেখে ঠিকই বুঝেছিলাম। কিছু বলিনি। থাক, যা পারে করুক। একদিন আবার মাসীর আগমন। সাথে পাত্রের ছবি। বায়োডাটা। দিল্লীতে থাকে। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। ভালো চাকরি করে। ২৯ বছর বয়স। পালটি ঘর। এরকম নাকি ভালো সম্বন্ধ সচারচর পাওয়া যায় না। মেসোর অফিসের এক ভদ্রলোক, কমল ঘটক (পদবীর সাথে মিলিয়ে ঘটকালিও করে বেড়ান পার্ট টাইম) এই "হীরের টুকরো" ছেলের সন্ধান এনেছেন। বাবা চিরকালই একটু কম কথা বলেন, তার ওপর শ্বশুর বাড়ির লোকেদের সাথে তো আরও কম। মাসির সাথে কথায় পেরেই উঠলো না। আমায় জিজ্ঞেস করারও তো কোন প্রয়োজন বোধ না করে আমাদের বাড়িতে বসেই মাসী কমল ঘটকের সাথে ফোনে কথা বলে আগামী রবিবার ওনাদের নেমন্তন্ন করে দিল আমায় "দেখতে আসার" জন্য। কিরকম একটা নিজেকে গাড়ীর শোরুমের পণ্য মনে হচ্ছিল। জানি, মাসিকে বলে কোন লাভ নেই। মাসীর সামনে বাবা কে বলেও কোন লাভ নেই। অগত্যা মাসী চলে যেতেই বাবাকে বললাম মনের কথা।
" বাবা। প্লীজ। আমার কিন্তু ভালো লাগছেনা। এরকম চায়ের ট্রে হাতে করে নিজেকে মার্কেট করা, এ আবার কি। আমি রাজি না।"
" দেখ মা, আমি কক্ষনো এমন কোন কাজ করব না যাতে তুই একটুও অস্বস্তিতে পড়িস। আমার ওপর ভরসা রাখ।"
" বিসাইডস আমি ওই দু পাঁচটা কথা বলে কি করে বুঝব ভালো মন্দ। It is a matter of a lifelong decision"
"আমি কোনরকমের তাড়া দেব না তোকে। তুই কিছুদিন কথা বল। ভাব না যেন ডেট করছিস। Just that ডেটটা আমি ঠিক করে দিলাম। এবার পছন্দ হলে কথা এগোবে, না হলে না। সিম্পল!"
" কিন্তু..."
" না আর কোন কিন্তু কিন্তু না। এবার চল তো, একটু হাঁটতে যাই। মাসীর বকর বকরে মাথাটা ধরে গিয়েছে। লেকের ধারে গিয়ে হাওয়া খেয়ে আসি চল।"
এক সপ্তাহ পরে অর্ণব আর ওর মা বাবা এলেন। আমায় দেখতে। ছবিতে যতটা না ভালো দেখতে লেগেছিল, সামনাসামনি দেখলাম আরো অনেক সুপুরুষ। ব্যবহার ভালো। একটু চঞ্চল, কিন্তু যা বুঝলাম, প্রাণ খুলে জীবনটা উপভোগ করতে পারে। কথাবার্তা মোটামুটি মার্জিত। শিক্ষিত। বাবা মা অন্ত প্রাণ। গান, নাটক, লেখালিখিতেও শখ আছে। ওর বাবা মাকেও খুব পছন্দ হয়েছিল। কি অমায়িক। বাপি, মানে আমার শ্বশুরমশাই যখন আমায় নিজের মেয়ের মত ভালবাসবেন বললেন, সত্যি সত্যি মনে হল যেন বাবার প্রতিচ্ছবি। আর মাম্মান, মানে শাশুড়ি মা, প্রথমে একটু কড়া লাগলেও ঠিক আছে, মানিয়ে নেব স্থির করলাম। আসলে আমার বাবার দিকে তাকিয়ে দেখে মনে হল যে এত আনন্দ আর নিশ্চিন্ত অনেকদিন বাদে হয়েছে। খানিকটা বাবার মুখ চেয়ে আর খানিকটা আমার ভালোলাগাকে ভরসা করে বিয়েতে হ্যাঁ বললাম। সেদিনের পরে কয়েকদিন অর্ণবের সাথে ফোনে কথা বললাম। আবার পুজোয় যখন ও কলকাতা এলো, দেখা করলাম কয়েকবার। আমাদের বাড়ি, ওদের বাড়ি। ইতিমধ্যে ওর মা বাবার সাথেও যোগাযোগ রেখেছিলাম ভালোই। মাম্মান তো আমার পার্টনার ইন ক্রাইম। স্কুলের যাবতীয় গসিপ, শপিং, রান্নাবান্না সবের জন্যই মাম্মান। মনে হল যেন মায়ের অভাবটা অনেকটাই কমবে। বাবা আর বাপির মধ্যে এত বন্ধুত্ব, কারুর নজর না লাগে। এমন হল যে বিয়ের আগে অবধি ওর থেকে বেশী ওর মা বাবার সাথেই বেশী ভাব ভালোবাসা ছিল আমার।
****************************************************************************
বিয়ের পরে আমরা দিল্লীতে কাটালাম দেড় বছর। কলকাতার স্কুলের চাকরীটা ছেড়ে ওখানে একটা স্কুলে জয়েন করেছিলাম।বাবা, মাম্মান, বাপি এদের সকলকে ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট হত। ওরা তিনজনেই পালা করে করে দেড় বছরে দশ মাস আমাদের সাথে থেকে গিয়েছে, কিন্তু প্রত্যেকবারেই ওদের যাওয়ার সময় আমি এমন কেঁদে ভাসাতাম যে অর্ণব খুব বেশী রকমের তৎপর হয়ে কলকাতায় ট্রান্সফারের ব্যবস্থাটা করল। আগামী সপ্তাহে আমরা পাকাপাকি ভাবে কলকাতা যাচ্ছি। অনেক হয়েছে বাবা। দিল্লী, হায়দ্রাবাদ অনেক হল। কলকাতার মত জায়গা দুটো হয়না। আমি পরিষ্কার বলে দিয়েছি, আমি আর এক পাও নড়ছিনা। আবার পুরনো স্কুলে চাকরিতে জয়েনিং পেয়েছি। বাবার কাছেও যাতায়াতটা সহজেই হবে তাহলে। দুই বাড়ি মিলিয়ে আনন্দে আহ্লাদে আটখানা যে হবই, সে ব্যাপারে আমি সুনিশ্চিত। স্যুটকেস গোছাতে গিয়ে আবার মায়ের গানের খাতাটা উল্টে পাল্টে দেখছিলাম। মা কে যখনই খুব বেশী রকমের মিস করি, এই খাতাটি নিয়ে থাকি। মায়ের সত্ত্বা যেন এই খাতায় বন্দী আছে। প্রতিটি পাতায় মায়ের গন্ধ, মায়ের স্পর্শ।
"কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।
সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি-- আহা,
নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহু-ডোরে,
আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।" (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
Monday, August 21, 2017
যে তোরে পাগল বলে
- এই মাছের ঝোলের গানটা শুনেছিস?
- কোনটা?
- ওই যে, যে তোরে পাগল বলে।
- ওটা আবার মাছের ঝোলের গান কে বলল? রবীন্দ্রসঙ্গীত ওটা হতভাগা।
- হ্যাঁ আর তোর ঠাকুর কিনা C'est le mode de vie.. / Ils peuvent t’appeler fou / La vie d'un rêveur n'est pas facile লিখেছেন!
- উফ ওটা তো অনুপমের মডিফিকেশন রে হাঁদা। গানটার মূল এসেন্স কিন্তু ওই রবীন্দ্রসঙ্গীত। By the way, French এত ভালো করে উচ্চারণ করলি কি করে?
- Alliance Francaise হে! তোর মত ওই BBC online course না। সব কিছু অনলাইন হয় না বুঝলি?
- ওমনি?
- জ্বলজ্যান্ত দেখতে পারছি! অনলাইনে জামা কাপড় কিনে সেই ছুটছিস টেলর শপে ফিটিং করাতে।
- আরে বাবা, এগুলো পোক্ত করাতে নিয়ে যাচ্ছি। যা বুঝিস না তা নিয়ে বাজে বকা তোর স্বভাব হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।
- বেশ, এটা না হয় মানলাম, যদিও তোর লজিকে বড়সড় গোলমাল আছে। কিন্তু বল, এই যে সারাক্ষণ টিন্ডার টিন্ডার করে গেলি, একটাও ডেট পেলি? ম্যাডক্সে যাবি কার সাথে?
- সে পৃথিবীতে যদি ভালো ছেলেপুলে না থাকে, আমার দোষ?
- ছাড়। অনেক হয়েছে। কাল বিকেলে ফ্রি আছিস কি না বল।
- কাল? কখন? কলেজ ফেরতা একবার সাউথ সিটি যাওয়ার কথা ছিল।
- সাতটায়, প্রিয়ায় চলে আসিস। মাছের ঝোলের দুটো টিকিট কেটে রেখেছি।
- একবার আগে বলবি তো টিকিট কাটার আগে।
- আর হ্যাঁ, তারপরে ডিনার করতে যাব। It's a semi final to our Pujo date!
- ডেট না হাতির মাথা! ওই আনন্দেই থাক। দেখিস, আমি ঠিক অষ্টমীর অঞ্জলি একটা হেব্বি হ্যান্ডু ছেলের সাথে দেব।
- Yeah of course, আমি grooming কি এমনি এমনি করছি নাকি? বর্তে যাবি রে আমার সাথে ঘুরলে। হুহ!
- হুহ!
- কোনটা?
- ওই যে, যে তোরে পাগল বলে।
- ওটা আবার মাছের ঝোলের গান কে বলল? রবীন্দ্রসঙ্গীত ওটা হতভাগা।
- হ্যাঁ আর তোর ঠাকুর কিনা C'est le mode de vie.. / Ils peuvent t’appeler fou / La vie d'un rêveur n'est pas facile লিখেছেন!
- উফ ওটা তো অনুপমের মডিফিকেশন রে হাঁদা। গানটার মূল এসেন্স কিন্তু ওই রবীন্দ্রসঙ্গীত। By the way, French এত ভালো করে উচ্চারণ করলি কি করে?
- Alliance Francaise হে! তোর মত ওই BBC online course না। সব কিছু অনলাইন হয় না বুঝলি?
- ওমনি?
- জ্বলজ্যান্ত দেখতে পারছি! অনলাইনে জামা কাপড় কিনে সেই ছুটছিস টেলর শপে ফিটিং করাতে।
- আরে বাবা, এগুলো পোক্ত করাতে নিয়ে যাচ্ছি। যা বুঝিস না তা নিয়ে বাজে বকা তোর স্বভাব হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।
- বেশ, এটা না হয় মানলাম, যদিও তোর লজিকে বড়সড় গোলমাল আছে। কিন্তু বল, এই যে সারাক্ষণ টিন্ডার টিন্ডার করে গেলি, একটাও ডেট পেলি? ম্যাডক্সে যাবি কার সাথে?
- সে পৃথিবীতে যদি ভালো ছেলেপুলে না থাকে, আমার দোষ?
- ছাড়। অনেক হয়েছে। কাল বিকেলে ফ্রি আছিস কি না বল।
- কাল? কখন? কলেজ ফেরতা একবার সাউথ সিটি যাওয়ার কথা ছিল।
- সাতটায়, প্রিয়ায় চলে আসিস। মাছের ঝোলের দুটো টিকিট কেটে রেখেছি।
- একবার আগে বলবি তো টিকিট কাটার আগে।
- আর হ্যাঁ, তারপরে ডিনার করতে যাব। It's a semi final to our Pujo date!
- ডেট না হাতির মাথা! ওই আনন্দেই থাক। দেখিস, আমি ঠিক অষ্টমীর অঞ্জলি একটা হেব্বি হ্যান্ডু ছেলের সাথে দেব।
- Yeah of course, আমি grooming কি এমনি এমনি করছি নাকি? বর্তে যাবি রে আমার সাথে ঘুরলে। হুহ!
- হুহ!
পুজো আসছে
আমার এই দীর্ঘ জীবনে (আরে বাবা দেখতে শুনতে একটু ইয়ং হলেই কি আর কচি বয়স হয় নাকি? সে না হয় ভগবানের কৃপায় আমায় ওই অ্যান্টি রিঙ্কল ক্রিম মাখতে হয় না, আদপে কিন্তু বয়সের গাছ পাথর নেই) কেবল মাত্র এক বছর (২০১৩) আমি পুজোর সময় কলকাতায় ছিলাম না। সবে চেন্নাইতে এসেছিলাম, তক্ষুনি ছুটি পাবোনা ভেবে দরখাস্তও করিনি। কিন্তু পরিষ্কার মনে আছে, এত ডিপ্রেসিং কেটেছিল, কি বলব। যদিও ষষ্ঠী থেকে শুরু করে দশমী অবধি চেন্নাইয়ের কেবলমাত্র দুটো মণ্ডপে "পরিক্রমা" করেছিলাম ( আজকাল প্রায় ১৫-১৬টা পুজো হয় এখানে), ২০০+ ছবি তুলেছিলাম, বন্ধুবান্ধবদের সাথে খেয়েছি, ঘুরেছি, সব করেছি, কিন্তু তবুও খুব মন খারাপ করা একটা ভাব ছিল। আর তাই আমি ঠিক করে নিই যে আর কক্ষনো পুজোয় কলকাতার বাইরে থাকবনা। সারা বছর দাঁতে দাঁত চিপে পড়ে থাকব এখানে, কিন্তু পুজোয় কলকাতা যাওয়াটা মাস্ট! গত তিন বছর মেনেছি সেটা, দুর্ভাগ্যবশত এইবারে আর হচ্ছেনা। চেন্নাইতেই থাকব। যবে থেকে এটা স্থির হয়েছে (এবং আমি জানি, এর নড়ন চড়ন হবেনা। কারণ আমার বুকে অত ধক নেই যে পনেরো হাজার টাকা দিয়ে যাতায়াত করব প্লেনে) তবে থেকে (মাস খানেকের ওপর হতে চলেছে) সারাক্ষণ একটা মন খারাপ করা আমায় ঘিরে রেখেছে। নিজের সাহায্য নিজেকেই করতে হবে, তাই ভাবলাম যে নাহ, অনেক হয়েছে। এর একটা বিহিত দরকার। ঠিক করলাম তাই যে পুজোয় কলকাতা গেলে কি কি অসুবিধে, সেই সব নিয়ে বরং চর্চা করি। অন্তত দিনের শেষে মনটা শান্ত হবে।
আমি যেহেতু গত তিন বছরে শুধু মাত্র পুজোয় বাড়ি গিয়েছি, তাই ছুটিটা একটু লম্বা হয়। সাধারণত মহালয়ার আশেপাশে যাই আর ফিরি লক্ষ্মী পুজোয়। তাই পুজোর কেনাকাটাগুলিও বাড়ি গিয়ে করি। এবার শেষ মুহূর্তে বাজার করতে গেলে যা হয়, প্রায়ই ঝটতি পটতি জামাকাপড় পড়ে থাকে। কিছু পছন্দ হলে তার সাইজ আসেনা, নয়তো সাইজ এলে রঙ আসেনা। কি যন্ত্রণা। তারপর আবার দর্জির দোকানে তিন মাস আগে থেকে অর্ডার ক্লোজডের চোখ রাঙানি। উফ। রেডিমেড জামা পড়ে কম্প্রোমাইজ করতেই হয়। তা আপনি বলতেই পারেন যে চেন্নাইতে শপিঙটা করে নিলেই হল। প্যান্টালুন্স ওইয়েস্টসাইড লাইফস্টাইল সবই সব জায়গায় আছে। আজ্ঞে হ্যাঁ, আছে, কিন্তু স্টক আলাদা। কলকাতায় যেটা ফ্যাশনেবল, সেটা মোটেই এখানে না। একটা জামা পড়লে তো সেই ফিলটা আসতে হবে যে হ্যাঁ, এটা সারা বছরের থেকে আলাদা। এটা শারদোৎসব। অগত্যা ওই লাস্ট মোমেন্ট শপিং। সন্ধ্যে হতেই এমন ভিড় শুরু হয়ে যায়, রাস্তায় ঘাটে চলা ফেরা করা মুস্কিল। তাই নিরুপায় হয়ে একদিন কি দুইদিন ওই দুপুর হতে না হতেই ছোট! ভাত ঘুমের জলাঞ্জলি একেবারে। হয় গনগনে রোদে পুড়ে কেনাকাটি করো, নয়তো বৃষ্টিতে ভেজো। Essay বইয়ের ওই শরতের নীল আকাশে সাদা পেঁজা তুলোর মত মেঘ আদপে যে কবে দেখা যায়, পাব্লিশারের ঠাকুরদাও জানেন কিনা কে জানে।
আর তারপরে ওই সারা রাত বাড়ির পিছনের প্যান্ডেলে পেরেক ঠোকার বিরক্তিকর শব্দ। বাচ্চাকাচ্চাগুলোর তৃতীয়া থেকেই ক্যাপ ফাটানো শুরু। আনন্দবাজার খুলতেই শুধুই ওই কোন প্যান্ডেলে কোন থিম, মহালয়া থেকে কোথায় কোথায় কে কোন পুজো উদ্বোধন করলেন, সেখানে কত লম্বা লাইন। আরে বাবা এসব দেখলে কমপ্লেক্স হয়ে যায় তো। আমি কিনা ক্লস্ট্রোফোবিক মানুষ। পাড়ার ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে ওই অষ্টমীর সকালে (আজকাল আবার সাত সকালে হচ্ছে, ভালো করে মাঞ্জা দেওয়ার সময়টুকু পাওয়া যাচ্ছেনা) সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে, শিবে, সর্বার্থসাধিকে অবধি ঠিক আছি। নিদেনপক্ষে একদিন সকাল সকাল উত্তর কলকাতার কিছু সাবেকী ঠাকুর দেখব। ব্যস। তা না। কোন প্যান্ডেলে রাতের আলোয় কতটা মায়াবী লাগছিল এসব ছবি দেখিয়ে যত সব লোভ দেখানো। যাব তো না রাত্রে বাইরে, ওই ভিড় আর লোকের গুঁতোগুঁতি। মিছিমিছি ফ্রাস্ট্রেটেড করে দেওয়া। বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাবে ঠিক করো, সবাইকে একসাথে পাওয়া আরেক কীর্তি। দুই মাস আগে থেকে গ্রুপ চ্যাটে একেবারে ডিপ্লোম্যাটিক লেভেলের চেয়েও জরুরি ভাবে আলোচনা করে দিনক্ষণ ঠিক করেও ঠিক লাস্ট মোমেন্টে কেউ না কেউ ডুব মারবেই। তারপর কোনমতে দেখা হল, তো আরেক প্রস্থ বিরক্তিকর ব্যাপার শুরু। খালি খালি ওই সেলফি তোলো নয়তো ক্যামেরায় ছবি তুলে দাও, পোজ দাও। আরে বাবা এই ঢাউস ক্যামেরা বয়ে বেড়ানো চারটিখানি কথা নাকি? তারপরে রেস্টুরেন্টে যাও খেতে। একেই তো টাকার শ্রাদ্ধ, তার ওপরে লম্বা লাইন। সেই লাইন বুঝি কলকাতা থেকে প্রায় হনলুলু পৌঁছে যাওয়ার জোগাড়। খেতে বসে হয় এইটা নেই, নয় ওটা নেই। অনেক কষ্টে অর্ডার যাও বা করব, খাবার আসতে আরেক পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়ে যাবে। এলেও টেস্টের তো মা বাপ নেই। ছ্যাঃ। তারপর হুজুগে পড়ে দেশপ্রিয় আর ম্যাডক্স যাওয়া। ট্যাক্সি পাওয়া তো প্রায় ডেটল দিয়ে ঘর মুছে জীবাণু পাওয়ার মত, বা তার চেয়েও কম চান্স হয়তো। আর বাই চান্স যদি বৃষ্টি পড়ে (ইদানীং তো তাই হচ্ছে প্রতি বছর), তাহলেই হল। ওই জল আর কাদায় আনারকলিটা তো গেলই, তারপরে ম্যাডক্সে গিয়েও খবরের কাগজ পেতে বসে যে আড্ডা দেওয়ার কথা, তাও মা ভবানীর ভোগে। কোন মানে হয়? এর চেয়ে এমনি সময়ে শান্তিতে বসে কোন কফি শপে আড্ডা মারলে কি ক্ষতি? পাতি সেন্টিমেন্ট যত।
এসব মিটিয়ে ফেলতে ফেলতেই নবমী। অনেক কষ্টে একটু শান্তিতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আনন্দমেলাটা পড়ব, ওমনি মায়ের আদেশ ( catalysed by "গলফ গ্রীন পূজা মণ্ডপ থেকে বলছি। আমাদের নবমী ভোগ বিতরণ শুরু হয়েছে। দয়া করে আপনারা সপরিবারে আসুন...") যে বাবু প্লীজ একটু ক্যুপন নিয়ে যা। প্যাকড ভোগ দিচ্ছে এবারে (কত কিছুই দেখবো!)। নিয়ে আয়। দুই বার চেষ্টা করেও কাকুটি মিনতিতে কাজ হবেনা। সেই আমায় আবার ড্রেস চেঞ্জ করে প্যান্ডেলে যেতেই হবে। কি লাইন রে বাবা। এমন করে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে যেন বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রাণ এসেছে। ওই লাইনে দাঁড়ালেও লোকে তার মধ্যেও ক্যাচাল করবে। বসে খেলে আপনার পাতে খিচুরি পড়ার আগেই পরের ব্যাচের জন্য লোক চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে। উফ। এ কি ভদ্রলোকের শোভা পায় বলুন? এমন হাঘরেপনা কেন? বুঝি না বাপু। চেন্নাইয়ে কি সুন্দর। স্টলে যাও, পছন্দসই খাবার খাও। আরো ভালো, পুজো মণ্ডপেই যেয়োনা। সাধারণ দিনের মত যে কোন রেস্টুরেন্টে যাও, খাও, চলে এসো। কোন ভিড় পাবে না। আরাম।
এতেই শেষ হলে বুঝতাম। আবার পরের দিন দর্পণে বিসর্জনের পরে প্যান্ডেলে যাও, ঠাকুরের পায়ের ফুল তুলে আন, নমস্কার করো। বাবা রে! তারপরে ওই সিঁদুর খেলা নিয়ে ন্যাকামি। দোলের দিন রঙ খেলে হয় না যেন এদের, আবার একটা এক্সট্রা দিন চাই। বিবাহিত অবিবাহিত পুরুষ নারী বাচ্চা বুড়ো সব এমন সিঁদুর মেখে থাকবে, আর তারপরে ডি এস এল আর নিয়ে কিছু পাবলিকের সেই ছবি তোলা। গা জ্বলে যায় যত ন্যাকামি দেখলে। গঙ্গার জল যে কি পরিমাণে দূষিত হয় এই ভাসানের পরে, কারুর খেয়াল আছে? শোভাযাত্রা করে রাস্তা দিয়ে যখন বাবুঘাটে যায়, তখন যে সাধারণ লোকের কি অবস্থা হয়, ট্রাফিক জ্যামে বাসে অটোতে বসে...তার হিসেব কেউ রাখে? পুজো বলে অটোর ভাড়া রিক্সার ভাড়া লাগামহীন ভাবে বেড়ে যায়, কত ট্যাঁক ফাঁকা হয়, সেই বেলা? পুজোয় কলকাতা না গেলে কত টাকা বাঁচে ভাবুন তো!
সবচেয়ে বিরক্তিকর তো ওই বিজয়া দশমীর নাম করে আত্মীয়দের বাড়ি যাওয়া। প্রণাম করো রে। মিষ্টি খাও রে। ক্যালোরিস। জঘন্য। I mean, who prefers নারকেল নাড়ু and চন্দ্রপুলি to wraps and rolls? এক গাদা ওই whatsapp facebook messages, বিরক্তিকর। আর সব শেষে ফেরার দিনে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি। কেউ যেচে এমন বাঁশ নেয় নিজের ওপর বলুন? এর চেয়ে বাবা পুজোয় কলকাতা যাব না। অন্তত ঘরে বসে ফেসবুক ডিএক্টিভেট করে চুপচাপ শারদীয়াগুলো পড়তে পারব। ওই মুহূর্তে মুহূর্তে ফেসবুকে ছবি দেওয়া, লোকের চেক-ইন দেখা এসব হবে না। এই আমার ভালো! অন্তত আফসোস থাকবেনা। এশিয়ান পেন্টসের সেরা দশ দেখা হল না বলে। বাগবাজারের মা কে না হয় ডি ড্রাইভের কোন পুরনো ফোল্ডারে দেখে নেব। মা তো মাই। সে সাত লক্ষ পঁচানব্বই হোক কি ছয় লক্ষ ছত্রিশ।
আমি যেহেতু গত তিন বছরে শুধু মাত্র পুজোয় বাড়ি গিয়েছি, তাই ছুটিটা একটু লম্বা হয়। সাধারণত মহালয়ার আশেপাশে যাই আর ফিরি লক্ষ্মী পুজোয়। তাই পুজোর কেনাকাটাগুলিও বাড়ি গিয়ে করি। এবার শেষ মুহূর্তে বাজার করতে গেলে যা হয়, প্রায়ই ঝটতি পটতি জামাকাপড় পড়ে থাকে। কিছু পছন্দ হলে তার সাইজ আসেনা, নয়তো সাইজ এলে রঙ আসেনা। কি যন্ত্রণা। তারপর আবার দর্জির দোকানে তিন মাস আগে থেকে অর্ডার ক্লোজডের চোখ রাঙানি। উফ। রেডিমেড জামা পড়ে কম্প্রোমাইজ করতেই হয়। তা আপনি বলতেই পারেন যে চেন্নাইতে শপিঙটা করে নিলেই হল। প্যান্টালুন্স ওইয়েস্টসাইড লাইফস্টাইল সবই সব জায়গায় আছে। আজ্ঞে হ্যাঁ, আছে, কিন্তু স্টক আলাদা। কলকাতায় যেটা ফ্যাশনেবল, সেটা মোটেই এখানে না। একটা জামা পড়লে তো সেই ফিলটা আসতে হবে যে হ্যাঁ, এটা সারা বছরের থেকে আলাদা। এটা শারদোৎসব। অগত্যা ওই লাস্ট মোমেন্ট শপিং। সন্ধ্যে হতেই এমন ভিড় শুরু হয়ে যায়, রাস্তায় ঘাটে চলা ফেরা করা মুস্কিল। তাই নিরুপায় হয়ে একদিন কি দুইদিন ওই দুপুর হতে না হতেই ছোট! ভাত ঘুমের জলাঞ্জলি একেবারে। হয় গনগনে রোদে পুড়ে কেনাকাটি করো, নয়তো বৃষ্টিতে ভেজো। Essay বইয়ের ওই শরতের নীল আকাশে সাদা পেঁজা তুলোর মত মেঘ আদপে যে কবে দেখা যায়, পাব্লিশারের ঠাকুরদাও জানেন কিনা কে জানে।
আর তারপরে ওই সারা রাত বাড়ির পিছনের প্যান্ডেলে পেরেক ঠোকার বিরক্তিকর শব্দ। বাচ্চাকাচ্চাগুলোর তৃতীয়া থেকেই ক্যাপ ফাটানো শুরু। আনন্দবাজার খুলতেই শুধুই ওই কোন প্যান্ডেলে কোন থিম, মহালয়া থেকে কোথায় কোথায় কে কোন পুজো উদ্বোধন করলেন, সেখানে কত লম্বা লাইন। আরে বাবা এসব দেখলে কমপ্লেক্স হয়ে যায় তো। আমি কিনা ক্লস্ট্রোফোবিক মানুষ। পাড়ার ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে ওই অষ্টমীর সকালে (আজকাল আবার সাত সকালে হচ্ছে, ভালো করে মাঞ্জা দেওয়ার সময়টুকু পাওয়া যাচ্ছেনা) সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে, শিবে, সর্বার্থসাধিকে অবধি ঠিক আছি। নিদেনপক্ষে একদিন সকাল সকাল উত্তর কলকাতার কিছু সাবেকী ঠাকুর দেখব। ব্যস। তা না। কোন প্যান্ডেলে রাতের আলোয় কতটা মায়াবী লাগছিল এসব ছবি দেখিয়ে যত সব লোভ দেখানো। যাব তো না রাত্রে বাইরে, ওই ভিড় আর লোকের গুঁতোগুঁতি। মিছিমিছি ফ্রাস্ট্রেটেড করে দেওয়া। বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাবে ঠিক করো, সবাইকে একসাথে পাওয়া আরেক কীর্তি। দুই মাস আগে থেকে গ্রুপ চ্যাটে একেবারে ডিপ্লোম্যাটিক লেভেলের চেয়েও জরুরি ভাবে আলোচনা করে দিনক্ষণ ঠিক করেও ঠিক লাস্ট মোমেন্টে কেউ না কেউ ডুব মারবেই। তারপর কোনমতে দেখা হল, তো আরেক প্রস্থ বিরক্তিকর ব্যাপার শুরু। খালি খালি ওই সেলফি তোলো নয়তো ক্যামেরায় ছবি তুলে দাও, পোজ দাও। আরে বাবা এই ঢাউস ক্যামেরা বয়ে বেড়ানো চারটিখানি কথা নাকি? তারপরে রেস্টুরেন্টে যাও খেতে। একেই তো টাকার শ্রাদ্ধ, তার ওপরে লম্বা লাইন। সেই লাইন বুঝি কলকাতা থেকে প্রায় হনলুলু পৌঁছে যাওয়ার জোগাড়। খেতে বসে হয় এইটা নেই, নয় ওটা নেই। অনেক কষ্টে অর্ডার যাও বা করব, খাবার আসতে আরেক পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়ে যাবে। এলেও টেস্টের তো মা বাপ নেই। ছ্যাঃ। তারপর হুজুগে পড়ে দেশপ্রিয় আর ম্যাডক্স যাওয়া। ট্যাক্সি পাওয়া তো প্রায় ডেটল দিয়ে ঘর মুছে জীবাণু পাওয়ার মত, বা তার চেয়েও কম চান্স হয়তো। আর বাই চান্স যদি বৃষ্টি পড়ে (ইদানীং তো তাই হচ্ছে প্রতি বছর), তাহলেই হল। ওই জল আর কাদায় আনারকলিটা তো গেলই, তারপরে ম্যাডক্সে গিয়েও খবরের কাগজ পেতে বসে যে আড্ডা দেওয়ার কথা, তাও মা ভবানীর ভোগে। কোন মানে হয়? এর চেয়ে এমনি সময়ে শান্তিতে বসে কোন কফি শপে আড্ডা মারলে কি ক্ষতি? পাতি সেন্টিমেন্ট যত।
এসব মিটিয়ে ফেলতে ফেলতেই নবমী। অনেক কষ্টে একটু শান্তিতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আনন্দমেলাটা পড়ব, ওমনি মায়ের আদেশ ( catalysed by "গলফ গ্রীন পূজা মণ্ডপ থেকে বলছি। আমাদের নবমী ভোগ বিতরণ শুরু হয়েছে। দয়া করে আপনারা সপরিবারে আসুন...") যে বাবু প্লীজ একটু ক্যুপন নিয়ে যা। প্যাকড ভোগ দিচ্ছে এবারে (কত কিছুই দেখবো!)। নিয়ে আয়। দুই বার চেষ্টা করেও কাকুটি মিনতিতে কাজ হবেনা। সেই আমায় আবার ড্রেস চেঞ্জ করে প্যান্ডেলে যেতেই হবে। কি লাইন রে বাবা। এমন করে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে যেন বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রাণ এসেছে। ওই লাইনে দাঁড়ালেও লোকে তার মধ্যেও ক্যাচাল করবে। বসে খেলে আপনার পাতে খিচুরি পড়ার আগেই পরের ব্যাচের জন্য লোক চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে। উফ। এ কি ভদ্রলোকের শোভা পায় বলুন? এমন হাঘরেপনা কেন? বুঝি না বাপু। চেন্নাইয়ে কি সুন্দর। স্টলে যাও, পছন্দসই খাবার খাও। আরো ভালো, পুজো মণ্ডপেই যেয়োনা। সাধারণ দিনের মত যে কোন রেস্টুরেন্টে যাও, খাও, চলে এসো। কোন ভিড় পাবে না। আরাম।
এতেই শেষ হলে বুঝতাম। আবার পরের দিন দর্পণে বিসর্জনের পরে প্যান্ডেলে যাও, ঠাকুরের পায়ের ফুল তুলে আন, নমস্কার করো। বাবা রে! তারপরে ওই সিঁদুর খেলা নিয়ে ন্যাকামি। দোলের দিন রঙ খেলে হয় না যেন এদের, আবার একটা এক্সট্রা দিন চাই। বিবাহিত অবিবাহিত পুরুষ নারী বাচ্চা বুড়ো সব এমন সিঁদুর মেখে থাকবে, আর তারপরে ডি এস এল আর নিয়ে কিছু পাবলিকের সেই ছবি তোলা। গা জ্বলে যায় যত ন্যাকামি দেখলে। গঙ্গার জল যে কি পরিমাণে দূষিত হয় এই ভাসানের পরে, কারুর খেয়াল আছে? শোভাযাত্রা করে রাস্তা দিয়ে যখন বাবুঘাটে যায়, তখন যে সাধারণ লোকের কি অবস্থা হয়, ট্রাফিক জ্যামে বাসে অটোতে বসে...তার হিসেব কেউ রাখে? পুজো বলে অটোর ভাড়া রিক্সার ভাড়া লাগামহীন ভাবে বেড়ে যায়, কত ট্যাঁক ফাঁকা হয়, সেই বেলা? পুজোয় কলকাতা না গেলে কত টাকা বাঁচে ভাবুন তো!
সবচেয়ে বিরক্তিকর তো ওই বিজয়া দশমীর নাম করে আত্মীয়দের বাড়ি যাওয়া। প্রণাম করো রে। মিষ্টি খাও রে। ক্যালোরিস। জঘন্য। I mean, who prefers নারকেল নাড়ু and চন্দ্রপুলি to wraps and rolls? এক গাদা ওই whatsapp facebook messages, বিরক্তিকর। আর সব শেষে ফেরার দিনে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি। কেউ যেচে এমন বাঁশ নেয় নিজের ওপর বলুন? এর চেয়ে বাবা পুজোয় কলকাতা যাব না। অন্তত ঘরে বসে ফেসবুক ডিএক্টিভেট করে চুপচাপ শারদীয়াগুলো পড়তে পারব। ওই মুহূর্তে মুহূর্তে ফেসবুকে ছবি দেওয়া, লোকের চেক-ইন দেখা এসব হবে না। এই আমার ভালো! অন্তত আফসোস থাকবেনা। এশিয়ান পেন্টসের সেরা দশ দেখা হল না বলে। বাগবাজারের মা কে না হয় ডি ড্রাইভের কোন পুরনো ফোল্ডারে দেখে নেব। মা তো মাই। সে সাত লক্ষ পঁচানব্বই হোক কি ছয় লক্ষ ছত্রিশ।
Sunday, August 20, 2017
স্বাধীন স্বপ্ন
আমি নিজে কতটা স্বাধীন, তা ঠিক জানিনা। (মানে কেউ কোনভাবেই বেঁধে রাখেনি আমায়। তবে ওই আর কি, কাজ কর্মের কিছু নিয়ম নীতি তো মানতেই হয়। সে যাই হোক। ) তবে আমার মন বড়ই স্বাধীন। তার ভাবতে কোনরকম ট্যাক্স লাগেনা। আমার পা এক অদৃশ্য শিকলে বাঁধা থাকলেও মন কিন্তু লাগাম ছাড়া।
আজ যেমন দুপুরবেলা ঘুমোতে ঘুমোতে (না, এটা পাওয়ার ন্যাপ না। ভালো মতই প্রায় ঘণ্টা খানেকের ঘুম, তাও অ্যালার্ম না সেট করে) একটা কিম্ভুতকিমার্কা স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম একটি পোষা বিড়াল (জীবনে অনেক বিড়াল পুষেছি, কিন্তু এইটিকে ঠিক চিনলাম না, বেশ হাট্টাগোট্টা দেখতে, প্রায় বাঘের মত গায়ে স্ট্রাইপ) আমার ক্যামেরার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। ক্যামেরাটিকেও চিনতে পারলাম না। আমার আজ অবধি চারটে ক্যামেরা হয়েছে, কিন্তু এটি ওগুলির একটিও না। (হতে পারে আমাজনে সারাক্ষণ চড়ে বেড়াই বলে, ওখানে দেখা কোন মডেল হবে হয়তো) আমি (জানি না কেন এমন মনে হল) আবার ক্যামেরার জুম টেস্ট করছিলাম। ফোকাস করছিলাম এমন এক বারান্দায় বসে যেখানে রাজ্যের জামা কাপড় মেলা (মনে হয় বর্ষাকাল বলে ভিজে জামা কাপড়ের চিন্তা মাথায় ছিল), গ্রিলে একটা টব বসানো, তাতে নয়নতারা ফুটে আছে (এটার কারণ বলতে পারব, আজ দুপুরেই নয়নতারার বীজ পুঁতেছি)। সেইটেরই ছবি তুলে পোষা বিড়ালটাকে ডেমো দিচ্ছি। বিড়ালটি আবার এক কাঠি ওপরে। সে দেখি তার বাঁ হাত দিয়ে (আমার দেখা আজ অবধি বেশীর ভাগ বিড়ালই বাঁ হাতি, কোইন্সিডেন্স?) দিয়ে জুম বাটনটা টিপে টিপে লেন্সটাকে যে কোথায় নিয়ে গিয়েছে। মাপলে বোধহয় সিধে চাঁদে না হলেও অন্তত স্ট্রাটোস্ফিয়ার ক্রস করে যেত।
স্বাধীনতা যেমন নিয়ম নীতি মেনে রেগুলেটেড হতে হয়, ভাগ্যিস আমার ব্রেনেরও কিছু এরকম মেকানিজম আছে। ঠিক ওই সময়ে ঘুমটা ভাঙল আর আমি পড়ি কি মরি করে ল্যাবে ফেরত এলাম।
Onion cookies ও সাইকেল
আমার স্বপ্ন গুলো আজকাল যে কি রেটে বিটকেল হচ্ছে, তার আর ইয়ত্তা নেই। মানে মনে হচ্ছে একটা গোটা সমগ্র বের করতে পারব বুঝি যার নাম হবে "Dream wise, sleep tight"। এই যেমন আজকেরটা, কয়েকটি কেমন বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত জিনিসপত্র। মানে এরকম যদি incoherent thought process আমার হয়, তাহলে কপালে ঘোরতর দুঃখ। তা যাই হোক, ভ্যান্তারা না কষে বলেই ফেলি। আজকে রোববার, ইস্পেশাল ভাত ঘুম ( রবিবারে ঘুমের সাথে no compromise, ওসব power nap, quick nap, etc etc weekdaysএ চলতে পারে, রবিবার solid দুই ঘণ্টার ভাত ঘুম is a necessity। এরপর রাত্রে মুঝে নীন্দ না আয়ে syndrome হলেও কিচ্ছু যায় আসেনা, monday morning blues বলে সহজেই ম্যানেজ করে দেওয়া যায়।) দিয়ে যেই স্বপ্নটি দেখলুম, তার setting হল গিয়ে একটি জম্পেশ দেখতে (বেশ সিনেমা সিরিয়াল এ যেমন রাইচাঁদ, মালহোত্রা মার্কা বাড়ির) ড্রয়িং রুম, হাল্কা হলুদ আলো জ্বলছে। কিন্তু আমি জানি, এটা নাকি আমাদেরই বাড়ির ঘর। এরকম transformation কোন কেয়া শেঠের সৌজন্যে হয়েছে, ঠিক জানিনা। তা এ হেন বাড়িতে আত্মীয় স্বজন সব এসেছে, পরিষ্কার মনে আছে সোমা পিসি এসছে। আর কে কে, অত মনে নেই। আমার খুব শখ হয়েছে কিছু একটা dessert বানাবো (হ্যাঁ আমি স্বপ্নেও খাই/খাবার কথা ভাবি। এমনি এমনি মেন্টেন করছি নাকি নিজেকে?)। তার জন্য বাজারে যে ব্রাউন রঙের ডিম পাওয়া যায় না, সেই নিয়েছি বেশ কয়েকটা; তবে একটু পার্থক্য আছে। এই ডিমগুলি অস্বাভাবিক ভাবে বেশী রকমের গোল, ডায়ামিটার অন্তত ৫-৬ ইঞ্চি হবেই (কম করে বললাম হয়ত, আমার মাপ ঝোঁকের আইডিয়া তেমন নেই)। তা সেই ডিম ফেটিয়ে কিছু একটা করব (মনে হয় কুকি বানাবো ঠিক করেছিলাম, কিন্তু তার মধ্যে জানিনা কেন এক গাদা বেশ রিফাইন্ড সুগারের সাথে পিঁয়াজ কুচিও মিশিয়েছি। Onion cookies বলে কিছু আদৌ হয়? তারপরে সেই রান্নার ভূত ভবিষ্যৎ কিচ্ছু জানিনা, স্বপ্নটা জঘন্য ভাবে সেটিং পাল্টে ফেলল।
দেখলাম গভীর আলোচনা হচ্ছে, ওই একই ঘরে বসে। বাবা মায়ের সাথে, বন্ধুরাও আছে। কি করতে, কেন, no clue, IIT থেকে নাকি যাদবপুরে (simultaneously Lady Brabourneএও) আসছি। পাব্লিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার না করে (জানি না কার মাথার দিব্যিতে) সাইকেল চালিয়েই নাকি আমায় যেতে হবে। আর আমি সমানে বলে চলেছি বেশ, রাস্তা দিয়ে না হয় সাইকেলে যাব (এত দুঃসাহস কি করে হল? স্বপ্ন বলেই বোধহয়। এমনিতে তো ক্যাম্পাসের থেকে বাইরে দুই পা ও সাইকেলে যাই না), কিন্তু ইউনিভারসিটি/কলেজে গিয়ে কেন গেটে সাইকেল রেখে হেঁটে যেতে হবে?এই নিয়ে অদৃশ্য কারুর সাথে এঁড়ে তর্ক করে চলেছি!!!
বাকিটা আর মনে নেই। আদৌ আর দেখেছি কিনা কিছু, খেয়াল নেই। তবে এইটুকু বলতে পারি যে এরকম কনফিউসিং স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙতে আমি নিজেও খুবই কনফিউসড হয়ে গিয়েছিলাম। ঘুম ভাঙতে মোবাইলে টাইম দেখি ৫ঃ৫৭। বাইরে বেশ অন্ধকার অন্ধকার অবস্থা। খানিকক্ষণ আমি ভাবলাম, যে এটা কি সোমবার সকাল ৫ঃ৫৭? (আমার আসলে এরকম অভ্যেস আছে যে যখন তখন রাত্রে/ভোরে ঘুম ভাঙ্গে, আবার ঘড়ি দেখে আরেক সেট ঘুমোই) বেশ খানিক বাদে বুঝলাম যে না, এটা রোব্বার বিকেল। এইসব ভাবতে ভাবতে অবশ্য ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা সাড়ে সাতটা ছুঁয়ে গিয়েছিল। স্বপ্নে/ঘুমে কোন টাইম স্কেল ব্যবহার হয় কে যানে! না হয় আজ রাত্রে এই প্রব্লেমটাই আমার চ্যাইন চুড়াক!!!!
Friday, August 18, 2017
ইচ্ছেডানা
টুবাইরা খুব বেড়াতে যায়। বছরে দুবার যাবেই যাবে। একবার ওই সেশান ব্রেকের সময়ে, মার্চ এপ্রিলে। ওটা ছোট ট্রিপ, দিন সাতেক ম্যাক্সিমাম। কাছে পিঠে কোথাও যাওয়া হয়। দ্বিতীয়টা হয় ডিসেম্বরে। শীতের ছুটিতে। একটু দূরে। কেদার বদ্রী দেরাদুন মুসৌরি হরিদ্বার গঙ্গোত্রী সিমলা কুলু মানালি থেকে শুরু করে দক্ষিণে মাদ্রাস কন্যাকুমারী ত্রিবান্দ্রম সব ঘোরে এই শীতের ছুটিতে। চার বছরে একবার বাবা অফিস থেকে এল টি সি পান, তাই সেই বেড়ানোগুলো আরো একটু বিলাসবহুল হয়। তেমনি, এইবারে ওরা যাবে আন্দামান। কলকাতা থেকে হয় প্লেনে নয় জাহাজে যেতে হয়। সাধারণত চেনা পরিচিতদের মধ্যে টুবাই শুনেছে যে এক পিঠ প্লেনে আর এক পিঠ জাহাজে চললে নাকি বেশী আনন্দ। অবশ্য টুবাইয়ের কপালে তা নেই। মায়ের সাথে হাওড়ায় মাসির বাড়ি যেতে গিয়ে একবার লঞ্চে উঠে যা কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘটিয়েছিল, ওই ১৫ মিনিটের জার্নিতেই যা গা গুলনো অবস্থা, মা বাবা আর সেই রিস্ক নিতেই পারল না। তাই দুই পিঠই প্লেনের ব্যবস্থা। খরচা বেশী হবে, বাবার পকেট থেকে একটু বেশী বেরোবে, তাও সুস্থভাবে থাকতে পারবে। স্কুল ছুটির দিন ক্লাসমেটদের সাথে যখন আসন্ন ট্রিপের গল্প করছিল টুবাই, সে কি আনন্দ আর উত্তেজনা। প্রথম প্লেনে চড়বে। মেঘের মধ্যে দিয়ে ভেসে যাবে প্লেন। ঠিক যেমন টিভিতে দেখায়। কি মজাই না লাগছে ওর। প্লেনে উঠলেই এত এত লজেন্স আর চকলেট পাবে। মুঠো ভরে নিয়ে আসবে বন্ধুদের জন্য, মিতুলের জন্য; যেমনটা সই ঠাম্মা এনে দেয় যখনই ইউ এস এ থেকে আসে।
অবশেষে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। বোর্ডিং পাস হাতে নিয়ে প্লেনের ভিতরে ঢুকতেই একটা ছোট্ট করে লাফ দিল টুবাই। কাঁটায় কাঁটায় দশটায় ককপিট থেকে ভেসে এলো পাইলটের কণ্ঠস্বর। "Ladies and gentlemen, welcome to Air India. This is your captain speaking. Today we shall be flying non stop from Calcutta to Port Blair...."
আজ বারো বছর কেটে গিয়েছে। কিন্তু টুবাই এর মনের মধ্যে আজও সেই একই প্রথম উড়ানের উত্তেজনা। সেই একই এয়ার ইন্ডিয়া। সিকিউরিটি চেক পর্ব মিটিয়ে প্লেনে উঠল। তারপর কাঁটায় কাঁটায় দশটায় ককপিট থেকে ভেসে এলো টুবাই, ওরফে প্রিয়দর্শিনী মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ। "Ladies and gentlemen. This is your captain Priyadarshini Mukherjee welcoming you to Air India flight AI 21 from Kolkata to New Delhi..."
দুই ঘণ্টা পরে নিজের প্রথম প্লেন চালানো ভালোয় ভালোয় উতরে সেই ছোটবেলার মতই একটা লাফ দিয়ে ককপিট থেকে বেরোল টুবাই। চোখে মুখে বিশ্বজয়ের হাসি। দূরে দেখতে পেল আনন্দীকে, জীবনের প্রথম প্লেন চড়ার আনন্দে তখনও মশগুল।
Wednesday, August 16, 2017
মেঘদূত ৬
মেঘদূত ৬
ইউনিভার্সিটি অফ এসেক্সে পড়ানোর চাকরীটা নিয়ে সুনন্দ যখন এ দেশে এলো, তখন ওদের বিয়ের এক মাসও হয়নি। বাবা মায়ের অমতে পালিয়ে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে। দেশ ছাড়ার আগে যখন বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল পূরবী, ওর বাবা তো কথাই বলেননি; উল্টে মায়ের মাধ্যমে এ কথাও জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ওইদিন অর্থাৎ ৩০শে শ্রাবণ থেকে ওনার কাছে ওনার আদরের মেয়ে রুবি মৃত। আর কোনদিনও যেন সে তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টাও না করে। কাঁদতে কাঁদতে ভবানীপুরের বাড়িটা ছেড়েছিল সেদিন পূরবী শেষবারের মত।
এরপর কেটে গিয়েছে দীর্ঘ কুড়ি বছর। জীবনে এসেছে নানান পরিবর্তন। পি এইচ ডি শেষ করে এখন পূরবী এসেক্সের এক কলেজে পড়ায়। ওদের মেয়ে, সুরভী এই বছর কলেজে ভর্তি হবে। সুনন্দর মা বাবার জীবদ্দশায় নিয়ম করে প্রতি বছর কলকাতা যাওয়া হলেও কখনো আর ভবানীপুরে যাওয়া হয়নি। দুই পক্ষেরই সমান মান অভিমান। এখন তো শ্বশুর শাশুড়ির মৃত্যুর পরে আর কলকাতা যাওয়া হয় না। যদিও পাড়াতুতো দাদা বৌদিদের কাছ থেকে নিয়মিত এখনো নিজের বাবা মায়ের খোঁজ নেয় পূরবী, ফোন নম্বরও নিয়ে রেখেছে, কিন্তু তবুও সুনন্দ বা সুরভীর হাজার বার বলা সত্ত্বেও কক্ষনো একটা ফোন করে কথাও বলেনি। প্রতি পুজোয়, জন্মদিনে, মা বাবার জন্মদিনে মা কে সকাল থেকে মন খারাপ করে থাকতে দেখে সুরভী কতবার ফোনটা নিয়ে ডায়ালও করে দিয়েছে নম্বর, কিন্তু সব সময় পূরবী কেটে দিয়েছে লাইন।
গতকাল যখন সুনন্দ অফিস থেকে ফিরে ওকে নিজের সপরিবারে সেরা বাঙালীর অনুষ্ঠানে কলকাতা যাওয়ার নিমন্ত্রণপত্র দেখাল, ভীষণ উচ্ছ্বসিত হয়ে গিয়েছিল পূরবী। কত বড় সম্মান প্রাপ্তি এটা সুনন্দর। কিন্তু তারপরেই সুনন্দ আর সুরভী যখন আবদার করল যে এই সুযোগে তিনজনেই ওরা কলকাতা যাবে, প্রায় দশ বছর পর, পূরবী যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। ও কিছুতেই যাবে না। রাগে দুঃখে রাত্রে খেলো পর্যন্ত না। ওরা যে কেন বুঝছেনা ওর কথা, ও ভেবেই পায় না। যে বাবার এত আদুরে মেয়ে ছিল ও, সেই বাবাই যখন ওকে সর্বজনসমক্ষে মৃত বলে ঘোষণা করেছিলেন একদিন, তাদের কাছে গিয়ে কিই বা হবে? আবার তো বাবা রেগে যাবেন, এখন বয়স হয়েছে। এই বয়সে উত্তেজিত হয়ে পড়লে বাবার কিছু হয়ে গেলে? নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না যে ও। তাই হাজার ইচ্ছে থাকলেও কিছুতেই ও যাবে না কলকাতা, দেখা করবে না মা বাবার সাথে।
মন খারাপ নিয়েই সেদিন কলেজ গেল পূরবী। ক্লাস নিতে গিয়ে বুঝল যে মন মেজাজ ঠিক নেই, মাথা কাজ করছেনা। হাফ ডে লিভ নিয়ে বাড়ি ফিরে দুপুরবেলা লাঞ্চ সারছে, এমন সময় মেঘা বৌদির ফোন। তখন কলকাতায় সন্ধ্যে, অফিস থেকে ফিরে মেঘা বৌদির ফোনের এটাই সময়।
- হ্যাঁ বৌদি বল। কেমন আছ?
- হ্যালো? হ্যালো?
খানিকক্ষণ কোন শব্দ নেই ওদিকে। তারপর একটা হাল্কা ফোঁপানি।
- রুবি?
ছ্যাঁত করে এসে বুকের মধ্যে যেন বিঁধল মায়ের গলাটা।
-মা?
সন্ধ্যেবেলা কলেজ থেকে ফিরে সুরভী আর ওর বাবা দেখে পূরবী চোখ মুখ ফুলিয়ে নাক ফোচ ফোচ করতে করতে স্যুটকেস গোছাচ্ছে।
- এ কি মা? তুমি কোথায় চললে? ব্যাগ গুছাচ্ছ কেন? আবার সর্দি বাধালে কি করে? মুখ চোখ ফোলা কেন? কান্নাকাটি না ঠাণ্ডা লাগা?
- হ্যাঁ রুবি? কোথায় যাওয়ার প্যাকিং করছ? কোন কনফারেন্স নাকি? কি ব্যাপার?
বেশ একটা যুদ্ধ জয় সুলভ হাসি হেসে পূরবী বলল, "কলকাতা যাব। To be more precise, ভবানীপুর। সবাই মিলে। এবারের পুজোটা ওখানেই কাটাবো। এত বছর পর।"
- যাক, তাহলে আমি যে আজ মাকে ফোন করলাম সব জানিয়ে, তাহলে সেটা সার্থক হল! এবার দেখলে তো? মিছিমিছি এতগুলো বছর ইগোর লড়াইয়ে নষ্ট করলে। যাক গে।
- হুম। এটা একটা বিরাট প্রাপ্তি সুনন্দ। কৃতজ্ঞতা। এর চেয়ে ভালো এনিভারসারি গিফট আর কিচ্ছু হয় না সুনন্দ। Thank you so much!
অনেক বছর পর সেদিন পূরবী ওর প্রিয় বর্ষার রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোল। বাইরে টুপটাপ টিপটিপ বৃষ্টি, ঠোঁটে এক অনাবিল হাসি। দুই চোখে কলকাতা যাওয়ার স্বপ্ন।
"যে মিলনের মালাগুলি ধুলায় মিশে হল ধূলি
গন্ধ তারই ভেসে আসে আজই সজল সমীরণে।" (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
Tuesday, August 15, 2017
মেঘদূত ৫
প্রতিদিনের মত ঠিক ভোর সাড়ে পাঁচটায় মোবাইলে মিষ্টি করে কোকিলের ডাকে শুনে ঘুম ভাঙল রুপুর। আজ রবিবার, ছুটি। তাই খানিক আলসেমি করে কম্বলের তলায় পড়ে রইল ও। অন্যান্য দিনে অ্যালার্ম snooze করার বিলাসিতা টুকুও থাকে না। এক ঘণ্টার মধ্যে ছেলে মেয়ে দুটোকে স্কুলের জন্য তৈরি করতে হয়। তারপরে ঘরের কাজ টুকটাক সেরে নিজে রেডি হয়ে অফিস বেরোনো। বছর খানেক হতে চলল রুপু ইপসউইচে এসেছে; ব্যাঙ্গালোরের কোম্পানিটা থেকে ট্রান্সফার নিয়ে। একা মা, তায় দু দুটো ছেলে মেয়ে, উঠতে বসতে প্রতিবেশীদের বাঁকা মন্তব্য, সব মিলিয়ে একটা দম বন্ধ করা পরিবেশ, আর তার থেকে মুক্তি পেতেই ইপসউইচ। অফিসের কিছু কলিগ আর নেবারহুডের কয়েকজন ছাড়া তেমন বিশেষ কারুর সাথে আলাপ পরিচিতি নেই। এখানে কেউ কারুর ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলায় না, সাধারণ সৌজন্যতা ছাড়া খুব একটা আশে পাশের কারুর সাথে তেমন আলাপ পরিচয়ও নেই। ধারে কাছে ভারতীয়র সংখ্যা খুবই কম, বাঙালি পরিবার তো প্রায় হাতে গোনা যায়। শহরের থেকে একটু দূরে এপার্টমেন্ট নিয়ে মা ও ছেলে মেয়ের নিশ্চিন্তের সংসার। দিব্যি আছে। এখানের চাকরীটাও মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাট, ছেলে মেয়ের স্কুল ডে কেয়ার, উইকেন্ডে সময় বের করে তিনজনে এদিক সেদিক গাড়ী নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, এই বেশ ভালো আছে।
আজ ওদের তেমন কোন প্ল্যান নেই। কদিন ধরেই খুব বৃষ্টি চলছে। আগামী দুদিন তো আবার ভারী বৃষ্টির ফোরকাস্ট। বাড়িতেই কিছু সিনেমা দেখে কাটিয়ে দেবে ছুটির দিনটা। তাতান আর তিতির তখনও ঘুমোচ্ছে। ওদের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত ভালো লাগা আসে। থাক, ওরা ঘুমোক। আসতে আসতে উঠে হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো রুপু। তখনো সকালের আলো তেমন ফোটেনি, আলো আঁধারির খেলায় সামনের লেকটা অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে। ধারে ফুটে আছে অসংখ্য white lillies, ওর বড় প্রিয় ফুল। কোন কারণ নেই, কিন্তু দেখলেই ছোটবেলার পুজোর দিনগুলির কথা মনে পড়ে যায়। কাশ ফুলের মধ্যে দিয়েই শরতের আগমন হত। এখানে সেসব টের পাওয়ার প্রায় কোন অবকাশই নেই বলা চলে। এখনো তো বোধহয় শ্রাবণ চলছে, হিন্দু সমাজ থেকে এখনো পুজোর ফ্লায়ার আসেনি।
কি মনে হল, দৌড়ে গিয়ে স্কেচ প্যাড আর পেন নিয়ে বসে ঝটপট একে ফেলল সিনারিটা। বহুদিন বাদে আঁকল, তাই পারফেকশন আসেনি, কিন্তু আনন্দ নির্ভেজাল। খানিক বাদে তাতান তিতিরের ঘুম ভাঙ্গতেই ওরা রুপুকে জড়িয়ে ধরে খানিক আদর করল। "হ্যাপি বার্থডে মা" শুনে রুপুর খুশী আর ধরে না।
" তোদের মনে আছে বুঝি?"
"হ্যাঁ মা। আমাদের তো মনে আছে। তোমার বার্থডে ভুলব কি করে?"
" ইয়েস, তা ছাড়া স্তেফান আঙ্কেলও তো কাল রিমাইন্ডার দিল। আস- Oops! I almost let the secret out!"
"স্তেফান আসবে? এখানে? কখন? কই আমায় বলে নি তো?"
" না না মা, তাতান বাজে কথা বলছে। স্তেফান আঙ্কেল আসবে না।"
রুপুর চোখ এড়ালো না ভাই বোনের একে ওপরের দিকে চোখ রাঙানি। ও এই তাহলে ব্যাপার। কদিন ধরে মনেই হচ্ছিল স্তেফান আর বাচ্চা দুটো মিলে কিছু একটা নিয়ে সারাক্ষণ আলোচনা করছে। স্তেফান ওর কলিগ, জার্মান ছেলে। ইন্ডিয়া সম্পর্কে খুব আগ্রহ, ইউনিভার্সিটিতে ইন্ডিয়ান হিষ্ট্রি নিয়ে পড়াশোনাও করেছে। আর তাই রুপুর সাথে ভালোই ভাব। ছেলে মেয়ে দুটোও স্তেফান আঙ্কেল বলতে অজ্ঞান। মাঝে মাঝে ওরা চারজন একসাথে waterfrontএ ঘুরতে যায়।
" তা কখন আসবে স্তেফান আঙ্কেল?"
"না না মা, আঙ্কেল আসবে না।"
"আবার মিথ্যে তিতির? বল? আমি সেই মত ব্রেকফাস্ট লাঞ্চের ব্যবস্থা করব তো!"
তাতান আর তিতিরের তখন একে ওপরের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, মা কে বলবে কি বলবে না। এমন সময়ে কলিং বেল বেজে উঠতেই ভাই বোনে ছুট লাগাল, কে আগে দরজা খুলবে।
"আসতে যাও, পড়ে যাবে তো!"
কে শোনে কার কথা। এগিয়ে আসতে দেখে, সামনে একটা বড় ফুলের তোড়া হাতে দাঁড়িয়ে স্তেফান।
"Happy birthday Rup. I got you your favourite white lilies."
"Thank you. Do come in. I'll make you your favourite breakfast then. "
"Oh, loochi, is it?"
"Yep, wanna help?"
"Sure! Actually, it's better if you sit back and relax. It's your day today. We will manage."
"Are you sure? You will make luchi?"
"Just wait and watch Ma'am!"
রান্নাঘর থেকে হাসির খিল খিল আর স্তেফান আর বাচ্চা দুটোর অপটু হাতে ময়দা মাখা দেখে রুপুও আজ কত কাল বাদে যেন প্রাণ খুলে হাসল। তানপুরা অ্যাপ চালিয়ে মনের সুখে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠল ওর প্রিয় গান।
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে
তোমারি সুরটি আমার মুখের 'পরে, বুকের 'পরে ॥
আজ ওদের তেমন কোন প্ল্যান নেই। কদিন ধরেই খুব বৃষ্টি চলছে। আগামী দুদিন তো আবার ভারী বৃষ্টির ফোরকাস্ট। বাড়িতেই কিছু সিনেমা দেখে কাটিয়ে দেবে ছুটির দিনটা। তাতান আর তিতির তখনও ঘুমোচ্ছে। ওদের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত ভালো লাগা আসে। থাক, ওরা ঘুমোক। আসতে আসতে উঠে হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো রুপু। তখনো সকালের আলো তেমন ফোটেনি, আলো আঁধারির খেলায় সামনের লেকটা অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে। ধারে ফুটে আছে অসংখ্য white lillies, ওর বড় প্রিয় ফুল। কোন কারণ নেই, কিন্তু দেখলেই ছোটবেলার পুজোর দিনগুলির কথা মনে পড়ে যায়। কাশ ফুলের মধ্যে দিয়েই শরতের আগমন হত। এখানে সেসব টের পাওয়ার প্রায় কোন অবকাশই নেই বলা চলে। এখনো তো বোধহয় শ্রাবণ চলছে, হিন্দু সমাজ থেকে এখনো পুজোর ফ্লায়ার আসেনি।
কি মনে হল, দৌড়ে গিয়ে স্কেচ প্যাড আর পেন নিয়ে বসে ঝটপট একে ফেলল সিনারিটা। বহুদিন বাদে আঁকল, তাই পারফেকশন আসেনি, কিন্তু আনন্দ নির্ভেজাল। খানিক বাদে তাতান তিতিরের ঘুম ভাঙ্গতেই ওরা রুপুকে জড়িয়ে ধরে খানিক আদর করল। "হ্যাপি বার্থডে মা" শুনে রুপুর খুশী আর ধরে না।
" তোদের মনে আছে বুঝি?"
"হ্যাঁ মা। আমাদের তো মনে আছে। তোমার বার্থডে ভুলব কি করে?"
" ইয়েস, তা ছাড়া স্তেফান আঙ্কেলও তো কাল রিমাইন্ডার দিল। আস- Oops! I almost let the secret out!"
"স্তেফান আসবে? এখানে? কখন? কই আমায় বলে নি তো?"
" না না মা, তাতান বাজে কথা বলছে। স্তেফান আঙ্কেল আসবে না।"
রুপুর চোখ এড়ালো না ভাই বোনের একে ওপরের দিকে চোখ রাঙানি। ও এই তাহলে ব্যাপার। কদিন ধরে মনেই হচ্ছিল স্তেফান আর বাচ্চা দুটো মিলে কিছু একটা নিয়ে সারাক্ষণ আলোচনা করছে। স্তেফান ওর কলিগ, জার্মান ছেলে। ইন্ডিয়া সম্পর্কে খুব আগ্রহ, ইউনিভার্সিটিতে ইন্ডিয়ান হিষ্ট্রি নিয়ে পড়াশোনাও করেছে। আর তাই রুপুর সাথে ভালোই ভাব। ছেলে মেয়ে দুটোও স্তেফান আঙ্কেল বলতে অজ্ঞান। মাঝে মাঝে ওরা চারজন একসাথে waterfrontএ ঘুরতে যায়।
" তা কখন আসবে স্তেফান আঙ্কেল?"
"না না মা, আঙ্কেল আসবে না।"
"আবার মিথ্যে তিতির? বল? আমি সেই মত ব্রেকফাস্ট লাঞ্চের ব্যবস্থা করব তো!"
তাতান আর তিতিরের তখন একে ওপরের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, মা কে বলবে কি বলবে না। এমন সময়ে কলিং বেল বেজে উঠতেই ভাই বোনে ছুট লাগাল, কে আগে দরজা খুলবে।
"আসতে যাও, পড়ে যাবে তো!"
কে শোনে কার কথা। এগিয়ে আসতে দেখে, সামনে একটা বড় ফুলের তোড়া হাতে দাঁড়িয়ে স্তেফান।
"Happy birthday Rup. I got you your favourite white lilies."
"Thank you. Do come in. I'll make you your favourite breakfast then. "
"Oh, loochi, is it?"
"Yep, wanna help?"
"Sure! Actually, it's better if you sit back and relax. It's your day today. We will manage."
"Are you sure? You will make luchi?"
"Just wait and watch Ma'am!"
রান্নাঘর থেকে হাসির খিল খিল আর স্তেফান আর বাচ্চা দুটোর অপটু হাতে ময়দা মাখা দেখে রুপুও আজ কত কাল বাদে যেন প্রাণ খুলে হাসল। তানপুরা অ্যাপ চালিয়ে মনের সুখে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠল ওর প্রিয় গান।
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে
তোমারি সুরটি আমার মুখের 'পরে, বুকের 'পরে ॥
Monday, August 14, 2017
মেঘদূত ৪
আজ ২৯শে শ্রাবণ। বসু মল্লিক বাড়িতে সকাল থেকে উৎসব। বাড়ির ছোট মেয়ের আজ বিয়ে। আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবে এত বড় বাড়ি আজ লোকে লোকারণ্য। ছাদে ম্যাড়াপ বেঁধে রান্না খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। আকাশের অবস্থা ভালো না। ঘন কালো মেঘে ঢাকা, থেকে থেকে ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। মানসী দেবীর চিন্তিত মুখ দেখে রজতাভ বাবু বললেন, "আরে মানু, বৃষ্টি দেখে চিন্তা করছ কেন? আমাদের পারু যেদিন জন্মেছিল, মনে নেই কি অসম্ভব বৃষ্টি হয়েছিল? তাও অকালের বৃষ্টি। নইলে ওই জানুয়ারি মাসে ওরকম তুমুল বৃষ্টি কল্পনা করা যায়? আজ ওর বিয়েতে বৃষ্টি যে হবেই, এ তো জানা কথাই।" তবুও যেন মানসী দেবীর কপালের ভাঁজ কমে না। "হ্যাঁ সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু চিন্তা হচ্ছে যে অতিথিরা কি করে আসবেন। বরযাত্রীরাই বা আসবেন কি করে। কত দূর থেকে আসা।"
"আহা তুমি চিন্তা করো না। দুর্গাপুর এমন কিছু দূর না। তোমায় বিয়ে করতে সেই মালদা গিয়েছিলাম। আজকাল সবই শর্টকাট। যাই হোক, ওদিকের কি অবস্থা? গায়ে হলুদ পর্ব মিটেছে? আমি একবার মণ্ডপ থেকে ঘুরে আসি। মাঠে জল জমল কি না দেখি। দরকার হলে বালির বস্তা পাততে হবে। তুমি খামোখা চিন্তা করো না। জামাইরা আছে। ঠিক সব ভালোয় ভালোয় মিটে যাবে।"
সন্ধ্যেবেলা রাজরানী রূপে পারুকে দেখে সকলের চোখ আর সরে না। তুমুল বৃষ্টি উপেক্ষা করে আসতে আসতে নিমন্ত্রিতরা একে একে এসেছে। প্রথম ব্যাচ খাওয়া শুরুও হয়ে গিয়েছে। অথচ বরযাত্রীদের বাস আর বরের গাড়ীর তখনও দেখা নেই। অতিথিদের সামনে হাসি মুখ থাকলেও মনের ভিতরে একটা চিন্তা থেকেই যাচ্ছে কনের ও তার মা বাবার। ফটোগ্রাফারের আলোর ঝলকানিতে মেকি একটা হাসি দিতে হচ্ছেই, কিন্তু বুকের ভিতরে দুরুদুরু ভাব কমছেনা। একটা নতুন জীবন শুরু করতে চলেছে, বরাবরই বৃষ্টি বাদলা ভালো লাগেনা পারুর। কিরকম জানি নিজের বিয়েতে এরকম আবহাওয়া দেখে মুষড়ে পড়েছে তাই ও। দিদিদের সাথে বৌদিদের সাথে সেলফিতেও তাই কিরকম পানসে মুখের ছবি উঠেছে। দাদা তো দেখে একবার বকেও গেল। আটটা বাজতে যায়, এমন সময় হঠাৎ পারুর ফোনে whatsappএ একটা মেসেজ ঢুকল। " এই যে, আশা করছি আজকের এই দিনটা আর আসবে না। মানে, বিয়েটা মনে হয় একবারই করবে। তাই প্লীজ একটু হাসি মুখে থাকো। নইলে যে ভালো ডিপি পাবে না। সেলফিটা দিদিভাই পাঠাল, কি বাংলার পাঁচের মত করে আছ। আর হ্যাঁ, চিন্তা করো না, কোনদিনও লেট করিনা, আজ এই বৃষ্টিতে রাস্তায় খুব জ্যাম, আটকে আছি। তবে দেশপ্রিয় পৌঁছে গিয়েছি, এবার সোজা ফ্লাইওভার ধরে এক্ষুণি হাজির হচ্ছি। এবার তো হাসো।"
বিসমিল্লার শানাইয়ে আর ফিস ফ্রাইয়ের গন্ধে তখন বিয়ে বাড়ি জমজমাট।
মেঘদূত ৩
সেই যে কাল রাত্তির থেকে শুরু হয়েছে বৃষ্টিটা, এখনো থামবার কোন লক্ষণই নেই। ছুটির দিন। কোথায় বেরোনোর প্ল্যান ছিল শপিঙ করতে ওদের কয়েকজনের, সেল চলছে বড় বড় দোকানগুলিতে। তা না। সেই ঘরে বসে বসেই কাটাও। রুমমেট দুজন অবশ্য এতেও খুশি। সেই যে দুপুরে খাওয়ার পরে ফোনে গুজুর গুজুর শুরু করেছে, এখনো ম্যারাথন চলছে। তুয়া ভেবে পায়না এত কী কথা। মা বাবা দিদির কাছে গিয়েছে, তাই কলেজ ছুটি থাকলেও লঙ উইকএন্ডে ও পিজিতে। রেডিয়োতে পরপর বৃষ্টির গান হচ্ছে। "এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন। কাছে যাব কবে পাব ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।"
ধুর ভাল্লাগেনা। কতক্ষণ আর এই ফেসবুক নিয়ে খুট খুট করতে পারা যায়। খানিক বাদে হঠাৎ একটা নোটিফিকেশন এল।
"Sounak Bhattacharya is near you"; messengerএ একই সময়ে একটা টেক্সট এলো। "নীচে নাম। গাড়ি নিয়ে এসছি। লঙ ড্রাইভ। The weather is too awesome to waste by sulking
at home।"
এরপর আর কি। টিপটিপ বৃষ্টি। বিদ্যাসাগর সেতু। শৌণক। তুয়া। গাড়ির রেডিয়োতে শ্রীকান্ত আচার্য। "আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ। বৃষ্টি তোমাকে দিলাম।"
Sunday, August 13, 2017
মেঘদূত ২
সকাল থেকে বৃষ্টিটা এমন মুষলধারায় পড়েই চলেছে, তুতুলের একটুও ভালোই লাগছেনা। অঙ্ক ট্যুশনটা ভেস্তে গেল। প্রিটেস্ট সামনের মাসে। এখনো ইন্টিগ্রেশনে সড়গড় হয়নি। অথচ স্যার রিপিট করবেননা। হাতে সময় নেই। কি জ্বালা। মায়ের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতে করতে কখন দুই চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছে খেয়াল নেই তুতুলের। মায়ের ডাকে ধড়মড়িয়ে উঠে দেখে টেবিলের ওপর গরম গরম কফি আর মায়ের হাতে প্লেটে ওর ফেভারিট পিঁয়জি।
"ওরে ওঠ। দেখ মিঠির ড্রাইভার তোকে ওর আজকের নোট্স জেরক্স করে দিয়ে গিয়েছে। কি লক্ষ্মী মেয়ে। থ্যান্ক ইউ জানাস।"
নোট্স হাতে নিয়েই তুতুলের চোখে মুখে আলাদা একখানা চমক খেলে উঠল। মাও দেখে অবাক। বাব্বাহ একটা অঙ্ক খাতা দেখে মেয়ের মুখে হাসি ধরে আর না।
মা প্লেটটা নামিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। "পড়তে বস। খেতে খেতেই পড়।" তুতুল তখনো হাঁ করে তাকিয়ে খাতার পাতায়। জ্বলজ্বল করছে ওর নাম। পাশে একটা পুঁচকি হার্ট।
পাশের বাড়ি থেকে রেওয়াজ শোনা যায় বিনুর। "মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো।" শ্রাবণের ধারার মত হ্দয়ে ঝরে প্রেমের রস। অমর্ত্যর হাতের লেখাটা যে ওর বড্ড চেনা।
"ওরে ওঠ। দেখ মিঠির ড্রাইভার তোকে ওর আজকের নোট্স জেরক্স করে দিয়ে গিয়েছে। কি লক্ষ্মী মেয়ে। থ্যান্ক ইউ জানাস।"
নোট্স হাতে নিয়েই তুতুলের চোখে মুখে আলাদা একখানা চমক খেলে উঠল। মাও দেখে অবাক। বাব্বাহ একটা অঙ্ক খাতা দেখে মেয়ের মুখে হাসি ধরে আর না।
মা প্লেটটা নামিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। "পড়তে বস। খেতে খেতেই পড়।" তুতুল তখনো হাঁ করে তাকিয়ে খাতার পাতায়। জ্বলজ্বল করছে ওর নাম। পাশে একটা পুঁচকি হার্ট।
পাশের বাড়ি থেকে রেওয়াজ শোনা যায় বিনুর। "মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো।" শ্রাবণের ধারার মত হ্দয়ে ঝরে প্রেমের রস। অমর্ত্যর হাতের লেখাটা যে ওর বড্ড চেনা।
Friday, August 11, 2017
মেঘদূত
বিকেল চারটেয় ছুটি হয় গার্লস স্কুল। শেষ ঘণ্টা বাজতেই ওরা একদল বান্ধবীরা বেরিয়ে পড়ে গেট দিয়ে। ওরা মানে ক্লাস নাইনের সাদা শাড়ী লাল পাড় কিছু প্রজাপতিরা। প্রথমেই ভিড় আচার কাকুর কাছে। এরপর একে একে বাড়ি ফেরা। শ্রাবণের আকাশ কালো মেঘে ভারাক্রান্ত। যে কোন সময়ে আকাশ ভেঙ্গে নামবে মুশলধারায় বৃষ্টি। তবে এই মুহূর্তে ওদের কলকাকলিতে আকাশ বাতাস মুখরিত। উলটো দিক থেকে আসছে বয়েজ স্কুলের একটা বড় দল। প্রতিদিনের মতই। ওদের দেখে শুরু হয় এর ওর একে তাকে ঠ্যালা মারা, গুঁতো দেওয়া। ওই দেখ, কি রকম তোকে দেখছে। আরে এদিকে দেখ, আমাদের দিদিমণির গাল লাল। এক সময় সাদা শাড়ি আর নীল শার্টের দল একে অপরকে ক্রস করে। বৈজ্ঞানিক নিয়ম মাফিকই র্যান্ডম মোশনও বেরে যায় তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে। আবার তারপরে দুই দল নিজেদের মত চলে। বলে না কেউই, "পালাত, পালাট, পালাট"। সবার অগোচরে এক জোড়া চিঠি চালাচালি হয়ে যায় লালে নীলে।
আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামে। হৃদয় নাচে প্রেমের টানে। মাঠের সবুজ ঘাসের ওপর চাঁপা ফুলগুলি ভিজতে থাকতে।
আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামে। হৃদয় নাচে প্রেমের টানে। মাঠের সবুজ ঘাসের ওপর চাঁপা ফুলগুলি ভিজতে থাকতে।
Thursday, August 10, 2017
যাত্রাপথে
এক মাস গরমের ছুটিতে শ্বশুরবাড়িতে কাটিয়ে রঞ্জনা ফিরছে নিজের বাড়ী, জামনগরে। পছন্দমত ফ্লাইট না পাওয়ায় ট্রেনে যাওয়া। সাথে রয়েছে চার বছরের ছেলে বিটলাই। সুনন্দর অফিসের ছুটি শেষ মুহূর্তে বাতিল হয়ে যাওয়ায় ওদের এসে নিয়ে যেতে পারেনি। বিটলাই ওদের দত্তক নেওয়া সন্তান, বলা চলে খানিকটা সুনন্দর জেদেই ওকে ওরা তিন বছর আগে একটি সরকারী সংস্থা থেকে দত্তক নিয়েছে। বিয়ের চার বছর পরেও নিজের সন্তান আসেনি ওদের। বরং তিনবার মিসক্যারেজ হওয়ার পরে ডাক্তার ওদের জবাব দিয়ে দেন। সুনন্দ চাকরী করে একটি তেলের কোম্পানিতে, বেশ সিনিয়র পোস্টে, তাই দিনের মধ্যে বারো চৌদ্দ ঘণ্টা কাজেকর্মে ডুবে থাকে। তখনও রঞ্জনা স্কুলের চাকরীটা পায়নি। অত বড় বাড়ীতে সারাদিন বসে বসে ও খুব একা বোধ করত, তার উপর বারবার মিসক্যারেজ হওয়ায় মানসিক ভাবে বিপর্যস্তও হয়ে পড়ে। আর তখনই আত্মীয় বন্ধুদের পরামর্শে সুনন্দ ঠিক করে ওরা একটি বাচ্চা দত্তক নেবে। রঞ্জনা বড় হয়েছে অত্যন্ত গোঁড়া পরিবারে, তাই শুরু থেকে একদমই সায় দেয়নি দত্তক নেওয়ায়। না জানি কার সন্তান, কি তার ইতিহাস। সে বড় হলে কেমনই বা হবে তার স্বভাব চরিত্র। এই সমস্ত নানান চিন্তায় বারবার সুনন্দ কে বোঝানোর চেষ্টা করত, দত্তক নেওয়া থেকে বিরত করার প্রচেষ্টায় প্রায় উঠে পড়ে লেগেছিল। কিন্তু সুনন্দ ও ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেদের অনেক বোঝানোয় অবশেষে একরকম বাধ্য হয়েই রাজি হয়। তিন বছরেও এখনো বিটলাইকে কেন জানিনা তেমন আপন করে উঠতে পারেনি রঞ্জনা। আসলে বরাবরই ওর স্বপ্ন ছিল, নিজের ছেলে মেয়ে হবে। তাদেরকে নিজে হাতে বড় করবে। প্রথম বার কনসিভ করার পর তো নাম পর্যন্ত ঠিক করে নিয়েছিল। ছেলে হলে তাতান, মেয়ে হলে তিতির। একজনকে নাচ শেখাবে, একজনকে গান। একজন ডাক্তার হবে, আরেকজন ইঞ্জিনিয়ার। বিটলাইকে যখন এজেন্সি থেকে আনল ওরা, কিছুতেই ওর জন্য তাতান নামটা ব্যবহার করতেই দেয়নি ও। সুনন্দ বহুবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, এই তো ওদের সন্তান। হক না রঞ্জনার আপন গর্ভের না, কিন্তু এরপর থেকে তো এই শিশুর আপনজন বলতে ওরাই। রঞ্জনার বাপের বাড়ীর লোকজনও খুব একটা ভালো মনে মেনে নিতে পারেনি বিটলাইকে। দিদির মেয়েকে যখন ওর মা পুজোয় জামা কিনে দিত, সেই ফ্রিল দেওয়া পরীর মত ফ্রক দেখে ও ভাবত, কিছুদিন পরে মা ওকেও এরকম পাঠাবে। কিন্তু গত তিন বছর দুর্গা পুজোয় দিতে হয় বলে দেবে, এমন ধরণের পোশাক উপহার আসত ক্যুরিয়ারে, বিটলাইয়ের জন্য, ওর মামা বাড়ি থেকে। ওদিকে ঠাকুমার নয়নের মণি বিটলাই। রঞ্জনার স্কুলের গ্রীষ্মের ছুটিতে তাই এক মাস ওকে বিটলাই আর ওর দাদু ঠাকুমার আবদার মেনে মালদায় থাকতেই হল।
ট্রেনে ওঠা ইস্তক বিটলাই একবার এই জানলা একবার ওই জানলা করে চলেছে। সেকেন্ড এসিতে ওদের আশেপাশে চলছে কয়েকজন বয়স্ক মানুষ। তারা ছোট্ট বাচ্চার সাথে একটু আধটু খেলার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছে। এত দুরন্ত বাচ্চা। রঞ্জনা মাঝে মাঝে অস্থির হয়ে যায়। ঘণ্টায় ঘণ্টায় আধো আধো বুলিতে " মাম্মাম খিদে পেয়েছে"। "মাম্মাম কখন বাড়ি যাব?" " মাম্মাম ট্রেনটা উল্টো দিকে কেন যাচ্ছে?" " মাম্মাম আমি দরজার দিকে যাই?" "মাম্মাম আমার ওই খেলনাটা চাই।"
দুপুরবেলা প্যান্ট্রি কার থেকে যখন খাবার কিনে খাওয়াতে বসেছিল ও, বিটলাই এমন জেদ শুরু করল। কিছুতেই ও চিকেন ছাড়া খাবে না। এদিকে রঞ্জনাও ট্রেনের ওই তেল ঝাল খাবার ওকে দেবে না। মা ছেলেতে লাগল তুমুল লড়াই। আশ্চর্যের বিষয় এই যে সুনন্দ থাকলে কিন্তু বিটলাই কক্ষনো এমনটা করেনা। ওর যত জেদ আবদার সবই মায়ের কাছে। এমনিতেই প্লেনের জায়গায় ট্রেনে, তাও এই দুরন্ত বাচ্চাকে নিয়ে একা একা যেতে হচ্ছিল বলে রঞ্জনার মেজাজ খিঁচরে ছিল, এইবারে সব সহ্যশক্তি বাঁধ ভেঙ্গে মারল এক থাপ্পড় বিটলাইয়ের গালে। বেচারা মায়ের এই আকস্মিক রুদ্রাণী মূর্তি দেখে থ। দুই চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তে লাগল, বড় বড় ফোঁটায়।
- অনেক হয়েছে। তখন থেকে বলছি চুপ করে খেয়ে নিতে, তা না। আমাকে জ্বালানোর জন্য জুটেছে যত সব।
ছোট্ট বিটলাই চুপ করে এরপরে টুঁ শব্দটি না করে ভাত ডাল দিয়ে খেয়ে নিলো। মা গরস করে করে মুখে দিল আর ও টক করে খেল। হাত মুখ ধুয়ে এসে ওকে নিজের সীটে বিছানা করে শুইয়ে সবে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে বসে হাত ব্যাগ থেকে বই বের করে পড়তে যাবে, মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে উঠল সুনন্দর নাম। ওর কথার শব্দে আবার বিটলাইয়ের ঘুম ভেঙ্গে গেলেই শুরু হবে তাণ্ডব। বড় ক্লান্ত লাগছে। আবার ওকে ঘুম পারানো কঠিন কাজ। এখন যখন ও ঘুমিয়ে আছে, কি নিষ্পাপ লাগছে। অথচ এরই জাগ্রত অবস্থায় আরেক চেহারা। ভাবলেও অবাক লাগে। কি জেদ ছেলের। নির্ঘাত বাপ মা কেউ এমন ছিল। উল্টো দিকের সীটের এক বয়স্কা মহিলা কে একটু বিটলাইয়ের দিকে নজর রাখতে বলে ও ডানদিকের দরজার দিকে গেল। মিনিট কুড়ি পরে নিজের সীটে এসে দেখে বিটলা নেই। সীট খালি। উল্টো দিকের ভদ্রমহিলাও নেই। এদিক ওদিক খুঁজেও চোখে পড়ল না বিটলাইকে। আশেপাশের সীটের লোকজন ঘুমোচ্ছিল, তাদের ডেকে তুলে বিটলাই বা ওই মহিলার কোন খবরই পেল না। কি হল, বিটলাই কোথায় গেল। এদিক ওদিক দরজায় আশে পাশের সীট গুলিতেও কোথাও নেই। হঠাৎ একটা বিচ্ছিরি চিন্তা মাথায় এলো।
তা হলে কি ওই মহিলা ছেলেধরা? বিটলাইকে চুরি করে লুকিয়ে আছে কোন কম্পারটমেন্টে? পোশাক পরিচ্ছদ দেখে তো মনে হয় না। অবশ্য এটা ডেকয় হতে পারে। রেল পুলিশ কে টিটি কে ডেকে এক্ষুণি সার্চ করাতে হবে ট্রেন। ছি ছি ছি ছি ছি। কি দায়িত্বজ্ঞানহীন কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল ও। কি করে একজন সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের ভরসায় বিটলাইকে ফেলে গেল ও? ওর জায়গায় সুনন্দ থাকলে এমন করত? করত না। কেন করল ও এরকম? বিটলাই ওর নিজের ছেলে না বলে? লোকে তো তাই বলবে? সুনন্দ কি বলবে? আদৌ ওকে ক্ষমা করবে? বাচ্চা চুরি করে না জানি কোথায় নিয়ে ফেলবে, কোথায় কোথায় ভিক্ষে করাবে। কি না কি অত্যাচার করবে, আজকাল যা সব দেখায় টিভিতে, খবরে। ভাবতেই গা শিউড়ে উঠল রঞ্জনার। আহা, দুধের শিশু। একটু না হয় দুরন্ত, কিন্তু বড্ড ন্যাওটা মায়ের। ও যখন স্কুলের জন্য বেরোয়, তখন সদর দরজা অবধি মায়ের আঁচল ধরে চলে। স্কুল থেকে ফিরলে পরে জড়িয়ে ধরে আদর খায়। ভয়ে মুখ চোখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে রঞ্জনার। একটাই নিশ্চিন্ত হওয়ার কথা, ট্রেন এখন মাঝে কোথাও থামেনি আর আগামী আধ ঘণ্টায় থামবেও না। কাজেই বিটলাইকে নিয়ে ওই মহিলা কোথাও পালিয়ে যেতে পারবেই না, যদি না চেন টেনে ট্রেন থামায়। এখুনি টিটি কে ডেকে ব্যাপারটা বলতে হবে। ভগবান। রক্ষা করো। হে মা বিপত্তারিনী চণ্ডী, বিটলাইকে খুঁজে দাও। টিটিকে দেখতে পেয়ে রঞ্জনা পুরো ঘটনাটা খুলে বলল। ওর ফোনে বিটলাইয়ের ছবি ছিল, সেটিও দেখাল। সবে ওর নিজের সীটের দিকে এসছে, শুনতে পেল, " মাম্মাআআআআম"। বিটলাই। সাথে ওই মহিলা।
- কোথায় ছিলি?
- আপনি বিটলাই কে নিয়ে কোথায় চলে গিয়েছিলেন? জানেন আমি হয়রান হয়ে গিয়েছি ওকে খুঁজতে খুঁজতে।
- আরে ম্যাডাম, আপনি যাওয়ার পরে পরেই বাচ্চাটা জেগে উঠে আপনাকে না দেখতে পেয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। কিছুতেই থাকছিল না। এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছিল। আমি ওর পিছন পিছন গিয়ে গোটা ট্রেন আপনাকে খুঁজে না পেয়ে এদিকে এলাম। ভাগ্যিস।
খানিক থতমত খেয়ে গেল রঞ্জনা।
- মাম্মাম তুমি আমায় ফেলে কোথায় গিয়েছিলে? প্রমিস করো, আর যাবে না?
- যাব না সোনা, যাব না। আমার সোনা তাতান।
- উফ মাম্মাম, my name is Bitlai, you may also call me Srinjan।
- তাইই তাইই তাই।
রঞ্জনা বিটলাইকে জড়িয়ে গালে কপালে চুমু খেয়ে লেপটে শুল। মা ছেলেতে কানে ইয়ার ফোন গুঁজে জমিয়ে Peppa pigs দেখবে এবার ওরা। সামনে অনেক দীর্ঘ পথ বাকি।
ট্রেনে ওঠা ইস্তক বিটলাই একবার এই জানলা একবার ওই জানলা করে চলেছে। সেকেন্ড এসিতে ওদের আশেপাশে চলছে কয়েকজন বয়স্ক মানুষ। তারা ছোট্ট বাচ্চার সাথে একটু আধটু খেলার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছে। এত দুরন্ত বাচ্চা। রঞ্জনা মাঝে মাঝে অস্থির হয়ে যায়। ঘণ্টায় ঘণ্টায় আধো আধো বুলিতে " মাম্মাম খিদে পেয়েছে"। "মাম্মাম কখন বাড়ি যাব?" " মাম্মাম ট্রেনটা উল্টো দিকে কেন যাচ্ছে?" " মাম্মাম আমি দরজার দিকে যাই?" "মাম্মাম আমার ওই খেলনাটা চাই।"
দুপুরবেলা প্যান্ট্রি কার থেকে যখন খাবার কিনে খাওয়াতে বসেছিল ও, বিটলাই এমন জেদ শুরু করল। কিছুতেই ও চিকেন ছাড়া খাবে না। এদিকে রঞ্জনাও ট্রেনের ওই তেল ঝাল খাবার ওকে দেবে না। মা ছেলেতে লাগল তুমুল লড়াই। আশ্চর্যের বিষয় এই যে সুনন্দ থাকলে কিন্তু বিটলাই কক্ষনো এমনটা করেনা। ওর যত জেদ আবদার সবই মায়ের কাছে। এমনিতেই প্লেনের জায়গায় ট্রেনে, তাও এই দুরন্ত বাচ্চাকে নিয়ে একা একা যেতে হচ্ছিল বলে রঞ্জনার মেজাজ খিঁচরে ছিল, এইবারে সব সহ্যশক্তি বাঁধ ভেঙ্গে মারল এক থাপ্পড় বিটলাইয়ের গালে। বেচারা মায়ের এই আকস্মিক রুদ্রাণী মূর্তি দেখে থ। দুই চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তে লাগল, বড় বড় ফোঁটায়।
- অনেক হয়েছে। তখন থেকে বলছি চুপ করে খেয়ে নিতে, তা না। আমাকে জ্বালানোর জন্য জুটেছে যত সব।
ছোট্ট বিটলাই চুপ করে এরপরে টুঁ শব্দটি না করে ভাত ডাল দিয়ে খেয়ে নিলো। মা গরস করে করে মুখে দিল আর ও টক করে খেল। হাত মুখ ধুয়ে এসে ওকে নিজের সীটে বিছানা করে শুইয়ে সবে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে বসে হাত ব্যাগ থেকে বই বের করে পড়তে যাবে, মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে উঠল সুনন্দর নাম। ওর কথার শব্দে আবার বিটলাইয়ের ঘুম ভেঙ্গে গেলেই শুরু হবে তাণ্ডব। বড় ক্লান্ত লাগছে। আবার ওকে ঘুম পারানো কঠিন কাজ। এখন যখন ও ঘুমিয়ে আছে, কি নিষ্পাপ লাগছে। অথচ এরই জাগ্রত অবস্থায় আরেক চেহারা। ভাবলেও অবাক লাগে। কি জেদ ছেলের। নির্ঘাত বাপ মা কেউ এমন ছিল। উল্টো দিকের সীটের এক বয়স্কা মহিলা কে একটু বিটলাইয়ের দিকে নজর রাখতে বলে ও ডানদিকের দরজার দিকে গেল। মিনিট কুড়ি পরে নিজের সীটে এসে দেখে বিটলা নেই। সীট খালি। উল্টো দিকের ভদ্রমহিলাও নেই। এদিক ওদিক খুঁজেও চোখে পড়ল না বিটলাইকে। আশেপাশের সীটের লোকজন ঘুমোচ্ছিল, তাদের ডেকে তুলে বিটলাই বা ওই মহিলার কোন খবরই পেল না। কি হল, বিটলাই কোথায় গেল। এদিক ওদিক দরজায় আশে পাশের সীট গুলিতেও কোথাও নেই। হঠাৎ একটা বিচ্ছিরি চিন্তা মাথায় এলো।
তা হলে কি ওই মহিলা ছেলেধরা? বিটলাইকে চুরি করে লুকিয়ে আছে কোন কম্পারটমেন্টে? পোশাক পরিচ্ছদ দেখে তো মনে হয় না। অবশ্য এটা ডেকয় হতে পারে। রেল পুলিশ কে টিটি কে ডেকে এক্ষুণি সার্চ করাতে হবে ট্রেন। ছি ছি ছি ছি ছি। কি দায়িত্বজ্ঞানহীন কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল ও। কি করে একজন সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের ভরসায় বিটলাইকে ফেলে গেল ও? ওর জায়গায় সুনন্দ থাকলে এমন করত? করত না। কেন করল ও এরকম? বিটলাই ওর নিজের ছেলে না বলে? লোকে তো তাই বলবে? সুনন্দ কি বলবে? আদৌ ওকে ক্ষমা করবে? বাচ্চা চুরি করে না জানি কোথায় নিয়ে ফেলবে, কোথায় কোথায় ভিক্ষে করাবে। কি না কি অত্যাচার করবে, আজকাল যা সব দেখায় টিভিতে, খবরে। ভাবতেই গা শিউড়ে উঠল রঞ্জনার। আহা, দুধের শিশু। একটু না হয় দুরন্ত, কিন্তু বড্ড ন্যাওটা মায়ের। ও যখন স্কুলের জন্য বেরোয়, তখন সদর দরজা অবধি মায়ের আঁচল ধরে চলে। স্কুল থেকে ফিরলে পরে জড়িয়ে ধরে আদর খায়। ভয়ে মুখ চোখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে রঞ্জনার। একটাই নিশ্চিন্ত হওয়ার কথা, ট্রেন এখন মাঝে কোথাও থামেনি আর আগামী আধ ঘণ্টায় থামবেও না। কাজেই বিটলাইকে নিয়ে ওই মহিলা কোথাও পালিয়ে যেতে পারবেই না, যদি না চেন টেনে ট্রেন থামায়। এখুনি টিটি কে ডেকে ব্যাপারটা বলতে হবে। ভগবান। রক্ষা করো। হে মা বিপত্তারিনী চণ্ডী, বিটলাইকে খুঁজে দাও। টিটিকে দেখতে পেয়ে রঞ্জনা পুরো ঘটনাটা খুলে বলল। ওর ফোনে বিটলাইয়ের ছবি ছিল, সেটিও দেখাল। সবে ওর নিজের সীটের দিকে এসছে, শুনতে পেল, " মাম্মাআআআআম"। বিটলাই। সাথে ওই মহিলা।
- কোথায় ছিলি?
- আপনি বিটলাই কে নিয়ে কোথায় চলে গিয়েছিলেন? জানেন আমি হয়রান হয়ে গিয়েছি ওকে খুঁজতে খুঁজতে।
- আরে ম্যাডাম, আপনি যাওয়ার পরে পরেই বাচ্চাটা জেগে উঠে আপনাকে না দেখতে পেয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। কিছুতেই থাকছিল না। এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছিল। আমি ওর পিছন পিছন গিয়ে গোটা ট্রেন আপনাকে খুঁজে না পেয়ে এদিকে এলাম। ভাগ্যিস।
খানিক থতমত খেয়ে গেল রঞ্জনা।
- মাম্মাম তুমি আমায় ফেলে কোথায় গিয়েছিলে? প্রমিস করো, আর যাবে না?
- যাব না সোনা, যাব না। আমার সোনা তাতান।
- উফ মাম্মাম, my name is Bitlai, you may also call me Srinjan।
- তাইই তাইই তাই।
রঞ্জনা বিটলাইকে জড়িয়ে গালে কপালে চুমু খেয়ে লেপটে শুল। মা ছেলেতে কানে ইয়ার ফোন গুঁজে জমিয়ে Peppa pigs দেখবে এবার ওরা। সামনে অনেক দীর্ঘ পথ বাকি।
Monday, August 7, 2017
রেনেসাঁ
সালটা ১৯৯৮। উচ্চ মাধ্যমিকে রাজ্যে পঞ্চম হওয়ার পরে, এবার জয়েন্টে তৃতীয় হল হুগলীর ছেলে অনন্য ভট্টাচার্য। বাড়িতে খুশীর জোয়ার। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় পরিজন, বন্ধু বান্ধব, স্কুলের মাস্টারমশাই থেকে শুরু করে সংবাদ মাধ্যমে ছেয়ে রয়েছে ওদের ছোট একতলা বাড়িটা। সারাদিন এই ভিড়ের মধ্যে ঠিক করে ছেলেকে আদরও করতে পারেননি মা বাবা। রাত্রে সবাই ফেরত যেতে খেতে বসে বাবা মা ঠাকুমা আর বোনের সাথে গল্প শুরু হল অনন্যর।
- হ্যাঁ রে দাদা তুই কি তাহলে শিবপুরে ভর্তি হবি? নাকি যাদবপুর?
- অনু কোন স্ট্রীম নিয়ে পড়বি কিছু ভেবেছিস? আমার অফিসের সুব্রত দা বলছিলেন যে আজকাল নাকি কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়লে বেশ স্কোপ আছে চাকরীর।
- বাবু যেখানেই পড়বি, হোস্টেলে থাকতে হবে। একদম মাথা ঠাণ্ডা করে থাকবি। শান্ত ছেলের মত। কারুর কোন কথায় ড়া কাটবি না।
- দাদুভাই প্রতি সপ্তাহে কিন্তু তোমায় আসতে হবে বাড়ি। আমি নইলে যে খুব মন খারাপ করে থাকব। এই প্রথম তুমি বাড়ির থেকে দূরে থাকবে।
- মা, দাদার জন্য যখন নতুন জামাকাপড় কিনতে যাবে, আমায় নিয়ে যাবে কিন্তু সাথে। ওর ফ্যাশন সেন্স এত সেকেলে, কলকাতার কলেজে গেলে কিন্তু লোকজন ওকে নিয়ে মস্করা করবে এরকম দেখলে।
- এবার থাম তো, ছেলেটা কদিন বাদে চলে যাবে। হোস্টেলে কি খাবে না খাবে। ওকে কদিন শান্তিতে একটু খেতে দে।
নানান জল্পনা কল্পনার পর অবশেষে অনন্য ভর্তি হল শিবপুরে, কম্পিউটার সায়েন্স নিয়েই। হোস্টেলে ওকে যেদিন পৌঁছে দিয়ে এলো মা বাবা আর বোন, চারজনেরই খুব মন খারাপ। বোন আর মা তো হাপুস নয়নে কেঁদেই চলেছে কতক্ষণ ধরে। শেষমেশ বাবার বকুনিতে কান্না থামল।
- দেখো তোমরা যদি এরকম কান্নাকাটি করো, অনু কি ভাবে পারবে বলো তো? ওকেও তো একা থাকতে হবে। দেখো আশেপাশে এত নতুন ছাত্র ছাত্রী। তাদের বাবা মায়েরা। কই কেউ কি এরকম করছে?
- আহা তুমি বুঝছ না। অনু আমাদের ভারী লাজুক ছেলে।
- হ্যাঁ বাবা। ওই কাকিমাটা বলছিল শুনলে না? এখানে র্যাগিং হয় খুব। আর হোস্টেলে থাকলে আরোই।
- আহ মিনু, ওসব পুরনো খবর। এখন দেখলি না? ভর্তির সময় anti ragging ফর্মে সই সাবুদ করাচ্ছে? না না। এখানে সবাই পড়াশোনা করতে এসছে, পড়াশোনাই করবে। এছাড়া দেখ হোস্টেলেও আলাদা। কিছু চিন্তার কারণ নেই।
- দাদা শোন, গেটের বাইরেই একটা বুথ আছে। কোন অসুবিধে হলেই তুই বাড়িতে ফোন করে দিবি।
- হ্যাঁ অনু, কেউ কিছু বললে tactfully handle করবি।
- সিনিয়রদের কথার ওপর কথা বলবই না। চুপচাপ যা বলবে, শুনে নিবি। দেখবি দুদিনেই ঠিকঠাক হয়ে যাবে।
- মা, বোনু তোমরা খামোখা এত চিন্তা করোনা তো। সব ঠিকঠাক চলবে। এই তো প্রশান্ত, মলয় সব আছে। আমাদের ব্যাচের আরও সকলের সাথে দুদিনেই আলাপ হয়ে যাবে। একসাথে থাকবও। কোন চিন্তার কারণ নেই। এবার যাও। ফিরতে রাত হয়ে যাবে নইলে।
- দুগগা দুগগা।
- দাদা রাখীতে আসবি তো? ছুটি আছে।
- একদম। কি গিফট চাই, বলে দিবি আগে থেকে।
*********************************************************************************
- নমস্কার। উপস্থিত সকল শিক্ষক শিক্ষিকা ছাত্র ছাত্রী ও কর্মীদের স্বাগত জানাই। আজ আমাদের কলেজের anti ragging cell এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমরা পেয়েছি আমাদের মধ্যে স্বনামধন্যা social activist শ্রীমতী মীনাক্ষী ভট্টাচার্যকে। আসুন ওনার থেকে কিছু কথা শুনে নিই।
- ধন্যবাদ আপনাকে। আজ আপনাদের কিছু কথা বলি। আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগের ঘটনা। হুগলীর এক অত্যন্ত মেধাবী ছেলে একটি সরকারী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছিল কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে। দুই চোখ ভরে ছিল অসীম স্বপ্ন; বড় হওয়ার, জীবনে উন্নতি করার। কলেজের প্রথম এক সপ্তাহেই ছেলেটির ওপর শুরু হল র্যাগিং এর নামে অকথ্য মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার। কিছু তথাকথিত সিনিয়র ছাত্র ছাত্রীরা তাদের সাময়িক মানসিক তৃপ্তির জন্য ছেলেটির ওপর যে অমানবিক অত্যাচার চালালো, ছেলেটি মুখ বুজে, বাবা মায়ের বোনের কথা মত সহ্য করে যাচ্ছিল। রাতের ঘুম জলাঞ্জলি দিয়ে, গায়ে হাতে ব্যথা নিয়ে সকাল সকাল ছুটত ক্লাসে। কোনমতে বিকেলের মধ্যে পড়া শেষ করে তৈরি হত রাতের বিভীষিকার জন্য। এই অবধি ঠিক ছিল। হয়তো সয়ে যেত। মিটে যেত। কিন্তু বাঁধ সাধল ক্লাসের দশম দিনে। সেদিন গোটা ব্যাচ, ছেলে ও মেয়ে নির্বিশেষে একসাথে শুরু হল র্যাগিং। সিনিয়র ছেলেরা কয়েকজন মিলে ওদের ব্যাচের একটি মেয়ের ওপর শুরু করল অশ্লীল ভাষায় কথা বলা। মেয়েটি এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা, জয়েন্টে ভালো র্যাঙ্ক করে এসেছিল শহরের কলেজে পড়াশোনা করতে। এই প্রথম ওর বাড়ির বাইরে আসা, সিনিয়র দাদাদের এই ব্যবহারে সে কান্নাকাটি শুরু করে। তাতে মজা পেয়ে ওর ওপর র্যাগিং এর মাত্রা বাড়ে। হুগলীর ছেলেটি আর চুপ করে থাকতে পারেনি। উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে। মেয়েটিকে দেখে ওর যে বড় নিজের বোনের মুখ মনে পরে যাচ্ছিল, যে বোনের সাথে ওর দুদিন পরে রাখীতে দেখা হওয়ার কথা। দুদিন আগে আসা ছেলের মুখে কথা মেনে নিতে পারেনি সিনিয়র "দাদা"রা। সেই রাত্রে ওর ওপর চলল চূড়ান্ত অত্যাচার। হকি স্টিক, সাইকেলের চেন, লাঠি কিছুই বাদ পড়েনি। দিন পনেরো হাসপাতালে কাটিয়ে ছেলেটিকে তার বাড়ি ফিরিয়ে আনা হল। এতটা মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যায়, যে আর কোনদিনও ও কোথাও পড়তে পারেনি। এখনো প্রায় জড়ভরতের মত বাড়িতে জানলার ধারে চুপ করে বসে থাকে, কারুর সাথে একটা কোথাও বলেনা। ওই সিনিয়রদের মধ্যে থেকে দশজন কে সনাক্ত করা হয়েছিল তদন্ত করে। ওদেরও কোর্স থেকে বের করে দেওয়া হয়। জানিনা ওরা পরে কে কি করেছে বা করছে জীবনে। শুধু এইটুকু জানি যে সাময়িক superiority দেখাতে গিয়ে এতগুলো ছাত্র ছাত্রীর কেরিয়ার তো নষ্ট হলই, সাথে সাথে এদের পরিবার পরিজনও কত ভুগল। সেদিনের ওই ছেলেটি আমার দাদা। আমি চাইনি আর কোন পরিবার এরকম ভাবে ভেঙ্গে পড়ুক। আর সেই জন্যই আমি এই anti ragging প্রতিষ্ঠান গুলির সাথে এত নিবিড় ভাবে যুক্ত। আমি চাই তোমরা সকলে ভালো মানুষ হও। সকলের সাথে সদ্ভাব রেখে চল। সিনিয়র হয়েছ, তার মর্যাদা দাও। দাদা দিদি সুলভ আচরণ করো, গুণ্ডাগিরি না। এটি একটি educational institute, শিক্ষার মর্যাদা দাও। মানুষের মত মানুষ হও। বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করো। ওদের গর্ব হও। ধন্যবাদ।
********************************************************************************
- এই দাদা, আজ আরেকটা কলেজে আমি বক্তব্য রাখলাম। জানিস তো, আমার মনে হয়, এখন awarenessটা অনেক বাড়ছে। শিবপুরে কত নতুন নিয়ম implemented হয়েছে। দেখবি, খুব তাড়াতাড়ি আমাদের দেশ ragging মুক্ত হবে।
বিকেলের পড়ন্ত রোদের আলো এসে পড়েছে অনন্যর মুখে। ভাবলেশহীন। পরিবর্তনের অপেক্ষায়।
- হ্যাঁ রে দাদা তুই কি তাহলে শিবপুরে ভর্তি হবি? নাকি যাদবপুর?
- অনু কোন স্ট্রীম নিয়ে পড়বি কিছু ভেবেছিস? আমার অফিসের সুব্রত দা বলছিলেন যে আজকাল নাকি কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়লে বেশ স্কোপ আছে চাকরীর।
- বাবু যেখানেই পড়বি, হোস্টেলে থাকতে হবে। একদম মাথা ঠাণ্ডা করে থাকবি। শান্ত ছেলের মত। কারুর কোন কথায় ড়া কাটবি না।
- দাদুভাই প্রতি সপ্তাহে কিন্তু তোমায় আসতে হবে বাড়ি। আমি নইলে যে খুব মন খারাপ করে থাকব। এই প্রথম তুমি বাড়ির থেকে দূরে থাকবে।
- মা, দাদার জন্য যখন নতুন জামাকাপড় কিনতে যাবে, আমায় নিয়ে যাবে কিন্তু সাথে। ওর ফ্যাশন সেন্স এত সেকেলে, কলকাতার কলেজে গেলে কিন্তু লোকজন ওকে নিয়ে মস্করা করবে এরকম দেখলে।
- এবার থাম তো, ছেলেটা কদিন বাদে চলে যাবে। হোস্টেলে কি খাবে না খাবে। ওকে কদিন শান্তিতে একটু খেতে দে।
নানান জল্পনা কল্পনার পর অবশেষে অনন্য ভর্তি হল শিবপুরে, কম্পিউটার সায়েন্স নিয়েই। হোস্টেলে ওকে যেদিন পৌঁছে দিয়ে এলো মা বাবা আর বোন, চারজনেরই খুব মন খারাপ। বোন আর মা তো হাপুস নয়নে কেঁদেই চলেছে কতক্ষণ ধরে। শেষমেশ বাবার বকুনিতে কান্না থামল।
- দেখো তোমরা যদি এরকম কান্নাকাটি করো, অনু কি ভাবে পারবে বলো তো? ওকেও তো একা থাকতে হবে। দেখো আশেপাশে এত নতুন ছাত্র ছাত্রী। তাদের বাবা মায়েরা। কই কেউ কি এরকম করছে?
- আহা তুমি বুঝছ না। অনু আমাদের ভারী লাজুক ছেলে।
- হ্যাঁ বাবা। ওই কাকিমাটা বলছিল শুনলে না? এখানে র্যাগিং হয় খুব। আর হোস্টেলে থাকলে আরোই।
- আহ মিনু, ওসব পুরনো খবর। এখন দেখলি না? ভর্তির সময় anti ragging ফর্মে সই সাবুদ করাচ্ছে? না না। এখানে সবাই পড়াশোনা করতে এসছে, পড়াশোনাই করবে। এছাড়া দেখ হোস্টেলেও আলাদা। কিছু চিন্তার কারণ নেই।
- দাদা শোন, গেটের বাইরেই একটা বুথ আছে। কোন অসুবিধে হলেই তুই বাড়িতে ফোন করে দিবি।
- হ্যাঁ অনু, কেউ কিছু বললে tactfully handle করবি।
- সিনিয়রদের কথার ওপর কথা বলবই না। চুপচাপ যা বলবে, শুনে নিবি। দেখবি দুদিনেই ঠিকঠাক হয়ে যাবে।
- মা, বোনু তোমরা খামোখা এত চিন্তা করোনা তো। সব ঠিকঠাক চলবে। এই তো প্রশান্ত, মলয় সব আছে। আমাদের ব্যাচের আরও সকলের সাথে দুদিনেই আলাপ হয়ে যাবে। একসাথে থাকবও। কোন চিন্তার কারণ নেই। এবার যাও। ফিরতে রাত হয়ে যাবে নইলে।
- দুগগা দুগগা।
- দাদা রাখীতে আসবি তো? ছুটি আছে।
- একদম। কি গিফট চাই, বলে দিবি আগে থেকে।
*********************************************************************************
- নমস্কার। উপস্থিত সকল শিক্ষক শিক্ষিকা ছাত্র ছাত্রী ও কর্মীদের স্বাগত জানাই। আজ আমাদের কলেজের anti ragging cell এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমরা পেয়েছি আমাদের মধ্যে স্বনামধন্যা social activist শ্রীমতী মীনাক্ষী ভট্টাচার্যকে। আসুন ওনার থেকে কিছু কথা শুনে নিই।
- ধন্যবাদ আপনাকে। আজ আপনাদের কিছু কথা বলি। আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগের ঘটনা। হুগলীর এক অত্যন্ত মেধাবী ছেলে একটি সরকারী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছিল কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে। দুই চোখ ভরে ছিল অসীম স্বপ্ন; বড় হওয়ার, জীবনে উন্নতি করার। কলেজের প্রথম এক সপ্তাহেই ছেলেটির ওপর শুরু হল র্যাগিং এর নামে অকথ্য মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার। কিছু তথাকথিত সিনিয়র ছাত্র ছাত্রীরা তাদের সাময়িক মানসিক তৃপ্তির জন্য ছেলেটির ওপর যে অমানবিক অত্যাচার চালালো, ছেলেটি মুখ বুজে, বাবা মায়ের বোনের কথা মত সহ্য করে যাচ্ছিল। রাতের ঘুম জলাঞ্জলি দিয়ে, গায়ে হাতে ব্যথা নিয়ে সকাল সকাল ছুটত ক্লাসে। কোনমতে বিকেলের মধ্যে পড়া শেষ করে তৈরি হত রাতের বিভীষিকার জন্য। এই অবধি ঠিক ছিল। হয়তো সয়ে যেত। মিটে যেত। কিন্তু বাঁধ সাধল ক্লাসের দশম দিনে। সেদিন গোটা ব্যাচ, ছেলে ও মেয়ে নির্বিশেষে একসাথে শুরু হল র্যাগিং। সিনিয়র ছেলেরা কয়েকজন মিলে ওদের ব্যাচের একটি মেয়ের ওপর শুরু করল অশ্লীল ভাষায় কথা বলা। মেয়েটি এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা, জয়েন্টে ভালো র্যাঙ্ক করে এসেছিল শহরের কলেজে পড়াশোনা করতে। এই প্রথম ওর বাড়ির বাইরে আসা, সিনিয়র দাদাদের এই ব্যবহারে সে কান্নাকাটি শুরু করে। তাতে মজা পেয়ে ওর ওপর র্যাগিং এর মাত্রা বাড়ে। হুগলীর ছেলেটি আর চুপ করে থাকতে পারেনি। উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে। মেয়েটিকে দেখে ওর যে বড় নিজের বোনের মুখ মনে পরে যাচ্ছিল, যে বোনের সাথে ওর দুদিন পরে রাখীতে দেখা হওয়ার কথা। দুদিন আগে আসা ছেলের মুখে কথা মেনে নিতে পারেনি সিনিয়র "দাদা"রা। সেই রাত্রে ওর ওপর চলল চূড়ান্ত অত্যাচার। হকি স্টিক, সাইকেলের চেন, লাঠি কিছুই বাদ পড়েনি। দিন পনেরো হাসপাতালে কাটিয়ে ছেলেটিকে তার বাড়ি ফিরিয়ে আনা হল। এতটা মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যায়, যে আর কোনদিনও ও কোথাও পড়তে পারেনি। এখনো প্রায় জড়ভরতের মত বাড়িতে জানলার ধারে চুপ করে বসে থাকে, কারুর সাথে একটা কোথাও বলেনা। ওই সিনিয়রদের মধ্যে থেকে দশজন কে সনাক্ত করা হয়েছিল তদন্ত করে। ওদেরও কোর্স থেকে বের করে দেওয়া হয়। জানিনা ওরা পরে কে কি করেছে বা করছে জীবনে। শুধু এইটুকু জানি যে সাময়িক superiority দেখাতে গিয়ে এতগুলো ছাত্র ছাত্রীর কেরিয়ার তো নষ্ট হলই, সাথে সাথে এদের পরিবার পরিজনও কত ভুগল। সেদিনের ওই ছেলেটি আমার দাদা। আমি চাইনি আর কোন পরিবার এরকম ভাবে ভেঙ্গে পড়ুক। আর সেই জন্যই আমি এই anti ragging প্রতিষ্ঠান গুলির সাথে এত নিবিড় ভাবে যুক্ত। আমি চাই তোমরা সকলে ভালো মানুষ হও। সকলের সাথে সদ্ভাব রেখে চল। সিনিয়র হয়েছ, তার মর্যাদা দাও। দাদা দিদি সুলভ আচরণ করো, গুণ্ডাগিরি না। এটি একটি educational institute, শিক্ষার মর্যাদা দাও। মানুষের মত মানুষ হও। বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করো। ওদের গর্ব হও। ধন্যবাদ।
********************************************************************************
- এই দাদা, আজ আরেকটা কলেজে আমি বক্তব্য রাখলাম। জানিস তো, আমার মনে হয়, এখন awarenessটা অনেক বাড়ছে। শিবপুরে কত নতুন নিয়ম implemented হয়েছে। দেখবি, খুব তাড়াতাড়ি আমাদের দেশ ragging মুক্ত হবে।
বিকেলের পড়ন্ত রোদের আলো এসে পড়েছে অনন্যর মুখে। ভাবলেশহীন। পরিবর্তনের অপেক্ষায়।
Saturday, August 5, 2017
একটি গাছ, একটি প্রাণ
প্রায় বছর দেড়েক হতে চলেছে সুখদেব আর নয়নার বিয়ের। বিয়ের পরে পরেই নয়না এসেছিল বম্বে ওর বরের সাথে। সুখদেব চাকরী করে একটি বেসরকারী অফিসে, পিয়নের পদে। মাইনে পত্তর তেমন আহামরি না; সংসারে বারতি আয়ের কথা ভেবে নয়না একটি ডে কেয়ার সেন্টারে আয়ার কাজ করে। এক কামরার ছোট্ট ভাড়া বাড়িতে মোটামুটি মানিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে ওরা। এই এলাকায় জলের একটু কষ্ট, এই যা। সকাল হতে না হতেই পাড়ার মোড়ে কলের লাইনে দাঁড়ায় দুজনে। এরপরে ঘরে ফিরে টুকটাক কাজ কর্ম করতে করতে একটা সময় দুজনেই কাজে বেরিয়ে যায়।
নয়না ফেরে বিকেল বিকেল, এসেই একটু জিরিয়ে নিয়ে ওদের পুঁচকি এক ফালি বারান্দায় মেলা শুকনো কাপড় জামা তুলে আনে। এরপরে এক কাপ চা বানিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়। বাড়ির সামনের মাঠটা তখন ছেলেমেয়েদের কলকাকলিতে ভরপুর। সারাদিন বাচ্চাদের সাথে কাটিয়েও একটুও এক ঘেয়ে লাগে না ওর। বরং সারাদিনের ক্লান্তি, নানান চিন্তা ভাবনার থেকে যেন মুক্তি আসে ওর। ক্রমে বেলা পড়ে আসে। রাস্তার আলো জ্বলে। ছেলেমেয়েগুলো যে যার নিজের বাড়ী ফেরত যায়। আশে পাশের বাড়ি থেকে কানে ভেসে আসতে থাকে মারাঠি সিরিয়ালের শব্দ। নীচে চায়ের দোকানের থেকে শোনা যায় লোকজনের নানা বিষয়ে তর্ক বিতর্ক। নয়নাদের টিভি নেই, নানান খরচাপাতির জেরে এখনো টিভি, ফ্রিজ কেনা হয়ে ওঠেনি। ইচ্ছে আছে এই বারে গণপতিতে ডে কেয়ারে বোনাস পেলে অন্তত একটা টিভি কিনবে। সুখদেব এত খাটে, সারাদিন অফিসে চাকরীর পরে আবার সন্ধ্যায় এক উকিল বাবুর চেম্বারেও তিন চার ঘণ্টা কাজ করে। ওর ওপর তাই ইচ্ছে হলেও কোনদিনও কোন দাবী করেনি। নয়না ভারী লক্ষ্মী মেয়ে, টানাটানির সংসারেও দিব্যি মানিয়ে গুছিয়ে চালায়। দুইবেলা মাংস ভাত না খেলেও, রুটি ডাল সব্জীর ঠিক যোগান করে ফেলে। রেডিয়ো চালিয়ে ও রান্নাঘরে ঢুকে চটপট রান্না সেরে ফেলে। কোন কোন দিন, রাঁধতে রাঁধতে গুণগুণ করে গলাও মেলায় রেডিয়োর সাথে। তারপরে রাত দশটা নাগাদ বাড়ি ফেরে সুখদেব। দুজনে একটু সুখ দুঃখের গল্প করে। এরপরে খেয়ে নিয়ে ওদের এক কামরার বাড়ির আলো নিভে যায়। পরের দিন আবার সকাল হয়। আবার একই নিয়মে চলতে থাকে ওদের অতি সাধারণ জীবন।
ওদের এই নিস্তরঙ্গ জীবনে হঠাৎ এলো এক বড় ঢেউ। ডাক্তারের রিপোর্ট এলো, "সুখবর" সহ। সবে এক মাস। দুই জনে বসল ওদের আয় ও ব্যয়ের হিসেব নিকেশ নিয়ে। রাত্তিরটা দুজনে দুজনকে পিঠ দেখিয়ে ঠায় জেগে কাটালো। পরের দিন ডে কেয়ারের দিদিমণি সদা হাস্যময়ী নয়নার গোমড়া মুখ, চোখের কোলের কালি দেখে অবাক হলেন। শুনলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। এ যে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সন্ধ্যেবেলা এক ক্লিনিকের ফোন নম্বর দিলেন। আর সাথে এও বললেন, খরচা একটু বেশী, তবে নিরাপদ। আপাতত দিদি টাকাটা ধার দেবেন, মাসে মাসে শোধ করে দিলেই হবে। নয়না এত গুছিয়ে কাজ করে, ওর এখন ছুটি নেওয়া কিছুতেই সামলে উঠতে পারবেনা দিদি। বিকেলে নয়না বাড়ি ফিরল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আজ তেমন মন নেই কোথাও। আনমনা ভাবে বারান্দার বাগানে (যা আসলে ওই তিনতে টবে তুলসী, টগর আর নয়নতারা গাছ) পাতাগুলোর গায়ে হাত বোলাতে লাগল। ভরা বর্ষার মরসুম, গাছের পাতাগুলো সবুজ সতেজ। নজরে এলো, তুলসীর টবে দু তিনতে আগাছা। সবে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়েছে, আকাশের পানে লম্বা হয়ে ঘাড় তুলবার অসীম প্রচেষ্টায়। উফ, একেই সাড় মাটির অভাব। কাঁচা তরি তরকারির খোসা ফেলে ফেলে যা একটু সাড় তৈরি হয়, এর মধ্যেও আবার ভাগ বসাতে আসবে নাকি। তাহলে তো তুলসী গাছের বরাদ্দ পুষ্টি কমে যাবে। টেনে তুলে ফেলল, তারপরে একদম নীচে ছুঁড়ে ফেলে দিল নয়না। কাজে মন নেই। সুখদেব এলে ওকে দিদির দেওয়া নম্বরটা দিয়ে একবার কাল কথা বলে আসতে বলবে। খবরাখবর সব যা নেওয়ার, নিয়ে আঁটঘাঁট বেঁধে এগোতে হবে। এই যাহ! গেল রুটিটা পুড়ে। রাত্রে খেতে বসে দুজনের কেউই টের পেল না শাক ভাজাটা নুনে পোড়া।
রাত্রে শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখল নয়না। দুটি বড় গাছ। একটি কাঁদছে, ওর মোটা গুঁড়ির থেকে অনবরত জল ঝরে পড়ছে। অন্যজন, ওর সঙ্গী, ভারী মমতাময় কণ্ঠে ওর দিকে স্নেহের হাত বাড়িয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
- ওরা যে মরে শান্তি পেল। তুমি কেঁদো না। এই রুঢ় পৃথিবীতে ওরা পেরে উঠত না। সম্বল কোথায়?
- কেন পারত না গো? আমরা পারি নি?
- রসদ কমে এসেছে যে।
- সূর্য তো একই আছে, বৃষ্টিও এক। তাহলে? হতে পারে একটু লড়াইটা বেশী হত, সকলের। কিন্তু তবুও, বাঁচত তো।
নয়না ফেরে বিকেল বিকেল, এসেই একটু জিরিয়ে নিয়ে ওদের পুঁচকি এক ফালি বারান্দায় মেলা শুকনো কাপড় জামা তুলে আনে। এরপরে এক কাপ চা বানিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়। বাড়ির সামনের মাঠটা তখন ছেলেমেয়েদের কলকাকলিতে ভরপুর। সারাদিন বাচ্চাদের সাথে কাটিয়েও একটুও এক ঘেয়ে লাগে না ওর। বরং সারাদিনের ক্লান্তি, নানান চিন্তা ভাবনার থেকে যেন মুক্তি আসে ওর। ক্রমে বেলা পড়ে আসে। রাস্তার আলো জ্বলে। ছেলেমেয়েগুলো যে যার নিজের বাড়ী ফেরত যায়। আশে পাশের বাড়ি থেকে কানে ভেসে আসতে থাকে মারাঠি সিরিয়ালের শব্দ। নীচে চায়ের দোকানের থেকে শোনা যায় লোকজনের নানা বিষয়ে তর্ক বিতর্ক। নয়নাদের টিভি নেই, নানান খরচাপাতির জেরে এখনো টিভি, ফ্রিজ কেনা হয়ে ওঠেনি। ইচ্ছে আছে এই বারে গণপতিতে ডে কেয়ারে বোনাস পেলে অন্তত একটা টিভি কিনবে। সুখদেব এত খাটে, সারাদিন অফিসে চাকরীর পরে আবার সন্ধ্যায় এক উকিল বাবুর চেম্বারেও তিন চার ঘণ্টা কাজ করে। ওর ওপর তাই ইচ্ছে হলেও কোনদিনও কোন দাবী করেনি। নয়না ভারী লক্ষ্মী মেয়ে, টানাটানির সংসারেও দিব্যি মানিয়ে গুছিয়ে চালায়। দুইবেলা মাংস ভাত না খেলেও, রুটি ডাল সব্জীর ঠিক যোগান করে ফেলে। রেডিয়ো চালিয়ে ও রান্নাঘরে ঢুকে চটপট রান্না সেরে ফেলে। কোন কোন দিন, রাঁধতে রাঁধতে গুণগুণ করে গলাও মেলায় রেডিয়োর সাথে। তারপরে রাত দশটা নাগাদ বাড়ি ফেরে সুখদেব। দুজনে একটু সুখ দুঃখের গল্প করে। এরপরে খেয়ে নিয়ে ওদের এক কামরার বাড়ির আলো নিভে যায়। পরের দিন আবার সকাল হয়। আবার একই নিয়মে চলতে থাকে ওদের অতি সাধারণ জীবন।
ওদের এই নিস্তরঙ্গ জীবনে হঠাৎ এলো এক বড় ঢেউ। ডাক্তারের রিপোর্ট এলো, "সুখবর" সহ। সবে এক মাস। দুই জনে বসল ওদের আয় ও ব্যয়ের হিসেব নিকেশ নিয়ে। রাত্তিরটা দুজনে দুজনকে পিঠ দেখিয়ে ঠায় জেগে কাটালো। পরের দিন ডে কেয়ারের দিদিমণি সদা হাস্যময়ী নয়নার গোমড়া মুখ, চোখের কোলের কালি দেখে অবাক হলেন। শুনলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। এ যে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সন্ধ্যেবেলা এক ক্লিনিকের ফোন নম্বর দিলেন। আর সাথে এও বললেন, খরচা একটু বেশী, তবে নিরাপদ। আপাতত দিদি টাকাটা ধার দেবেন, মাসে মাসে শোধ করে দিলেই হবে। নয়না এত গুছিয়ে কাজ করে, ওর এখন ছুটি নেওয়া কিছুতেই সামলে উঠতে পারবেনা দিদি। বিকেলে নয়না বাড়ি ফিরল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আজ তেমন মন নেই কোথাও। আনমনা ভাবে বারান্দার বাগানে (যা আসলে ওই তিনতে টবে তুলসী, টগর আর নয়নতারা গাছ) পাতাগুলোর গায়ে হাত বোলাতে লাগল। ভরা বর্ষার মরসুম, গাছের পাতাগুলো সবুজ সতেজ। নজরে এলো, তুলসীর টবে দু তিনতে আগাছা। সবে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়েছে, আকাশের পানে লম্বা হয়ে ঘাড় তুলবার অসীম প্রচেষ্টায়। উফ, একেই সাড় মাটির অভাব। কাঁচা তরি তরকারির খোসা ফেলে ফেলে যা একটু সাড় তৈরি হয়, এর মধ্যেও আবার ভাগ বসাতে আসবে নাকি। তাহলে তো তুলসী গাছের বরাদ্দ পুষ্টি কমে যাবে। টেনে তুলে ফেলল, তারপরে একদম নীচে ছুঁড়ে ফেলে দিল নয়না। কাজে মন নেই। সুখদেব এলে ওকে দিদির দেওয়া নম্বরটা দিয়ে একবার কাল কথা বলে আসতে বলবে। খবরাখবর সব যা নেওয়ার, নিয়ে আঁটঘাঁট বেঁধে এগোতে হবে। এই যাহ! গেল রুটিটা পুড়ে। রাত্রে খেতে বসে দুজনের কেউই টের পেল না শাক ভাজাটা নুনে পোড়া।
রাত্রে শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখল নয়না। দুটি বড় গাছ। একটি কাঁদছে, ওর মোটা গুঁড়ির থেকে অনবরত জল ঝরে পড়ছে। অন্যজন, ওর সঙ্গী, ভারী মমতাময় কণ্ঠে ওর দিকে স্নেহের হাত বাড়িয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
- ওরা যে মরে শান্তি পেল। তুমি কেঁদো না। এই রুঢ় পৃথিবীতে ওরা পেরে উঠত না। সম্বল কোথায়?
- কেন পারত না গো? আমরা পারি নি?
- রসদ কমে এসেছে যে।
- সূর্য তো একই আছে, বৃষ্টিও এক। তাহলে? হতে পারে একটু লড়াইটা বেশী হত, সকলের। কিন্তু তবুও, বাঁচত তো।
Friday, August 4, 2017
বাবা
অঙ্কুর চক্রবর্তী গত পনেরো বছর ধরে নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা। বয়স আন্দাজ চল্লিশ বিয়াল্লিশ। বিয়ে করেননি। একার সংসার। চাকরী করেন অতি উচ্চ পদে, একটি ফরচ্যুন ৫০০ কোম্পানিতে। IIT Bombay ও তারপরে IIM Ahmedabadএর সুবাদে খুব সহজেই আজকের পোস্টে পৌঁছে গিয়েছেন। কেরিয়ারের দিক থেকে যতটা তরতর করে উঠেছেন, ততটাই ক্রমশ দূরে সরে এসেছেন পরিবার পরিজন ও বন্ধু বান্ধবদের থেকে। কেয়াতলার ফ্ল্যাটে আছেন বয়স্ক মা ও বাবা। বার বার বলা সত্ত্বেও ওনাদেরকে নিজের কাছে এনে রাখতে পারেননি। আগে তাও বছরে একবার করে দেশে আসতেন দিন দশেকের জন্য কিংবা বাবা মা যেতেন, মাস খানেক ঘুরে আসতেন। বয়সের অজুহাতে ওনাদের যাওয়া প্রায় গত পাঁচ বছর বন্ধ। অঙ্কুরও এসে উঠতে পারেনি। লন্ডন, প্যারিস, বার্সিলোনা, সিডনি, সিঙ্গাপুর করে বেড়ালেও, কলকাতা কোনদিনও ম্যাপে ছিল না।
আজ সকাল সকাল মানদা দি, মানে ওদের বাড়িতে সর্বক্ষণের যে লোক থাকে, বাবা মায়ের দেখাশোনার জন্য, তার ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি এয়ারপোর্টে ছুটে এসে প্রথম ফ্লাইটের টিকিট কেটেছেন। বাবার খুব শরীর খারাপ। রাত্রের খাওয়ার পর হঠাৎ বুকে ভীষণ ব্যথা অনুভব করছিলেন; মা যেহেতু বাতের ব্যথায় শয্যাশায়ী, মানদাদিই উল্টোদিকের বাড়ির পলাশ বাবুদের সাহায্যে বাবা কে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। ডাক্তার বলেছেন একটা মাইল্ড এট্যাক হয়েছে, কিছুদিন হাসপাতালেই থাকতে হবে। মানদাদি ফোনে এত কান্নাকাটি করছিল, হঠাৎ করে নিজেকে বড় অসহায় লাগছিল অঙ্কুরের।
সাতাশ ঘণ্টার ফ্লাইট থেকে নেমে আগেই ছুটলেন হাসপাতালে। সেখানে তখন দেখেন পলাশ বাবু ও তার স্ত্রী, মিনু বৌদি রয়েছেন। অঙ্কুরকে দেখে ওরা এগিয়ে এলেন কথা বলতে।
- শোন অঙ্কুর, চিন্তার কিছু কারণ নেই তেমন। ডাক্তার বাবুর সাথে এই এক্ষুণি কথা হল, বলেছেন everything is fine; vital parameters are stable; হয়তো আর কয়েকদিন observationএ রেখে release করে দেবেন।
- আপনাদের যে কী ভাবে ধন্যবাদ জানাবো, আমি বুঝতেই পারছিনা। আপনারা না থাকলে যে কি হত। আসলে অত দূরে বসে তো কিছুই করতে পারিনা।
- আরে না না, প্রতিবেশীর ধর্ম পালন করেছি। এতে এত ধন্যবাদের কি আছে। এছাড়া সুব্রত কাকু আর রুমা কাকিমার সাথে আমাদের তো পারিবারিক সম্পর্ক প্রায়। একদম নিজের কাকা কাকিমার মত আদর যত্নে রাখেন আমাদের। এইটুকু করব না?
- আচ্ছা, এখন কি বাবা কে একবার দেখা যাবে?
- ICUতে আছেন, এখন ঢুকতে দেবে না। তবে বাইরে থেকে দেখতে পারবে। এসো তোমায় নিয়ে যাই।
- আসুন।
কাঁচের জানলা দিয়ে দেখলেন অঙ্কুর, ওর বাবা, মানে একদা দাপুটে হেডমাস্টার, সুব্রত বাবু নিস্তেজ হয়ে শুয়ে রয়েছেন। শরীরের বিভিন্ন অংশ নানান যন্ত্রপাতির সাথে লাগানো। হাতে চ্যানেল করে ওষুধ চলছে। দুই চোখ বন্ধ, কিন্তু মুখে একটা স্নিগ্ধ হাসি। কেন কে জানে, চোখের কোণগুলো চিকচিক করে উঠল।
- এসো অঙ্কুর। তোমার মা অপেক্ষা করছেন। বাড়ী চল, আবার সন্ধ্যেবেলা আসবে। তখন দেখাও করতে পারবে, ডাক্তারের সাথেও কথা বলে নেবে।
- চলুন।
বাড়ি ঢুকে প্রথমেই মায়ের ঘরে গেলেন অঙ্কুর। মা ছেলেকে বুকে টেনে নিলেন। আহ! এতক্ষণে যেন শান্তি অনুভব করলেন। দুজনেই দুজনকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদলেন কিছুক্ষণ। মানদাদি খানিক পরে ঘরে এলেন জলের গ্লাস নিয়ে।
- ও দাদা, এত কেঁদো না। মা কেও একটু থামতে বল। সেই পরশু থেকে কেঁদেই চলেছে, কিছুতেই থামছেনা।
- এই তুই চুপ কর মানদা। আমি আর কাঁদব না। আমার বাবু এসে গিয়েছে। ব্যস আর কোন চিন্তা নেই। দেখবি এবার তোর বাবাও খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসবেন।
- তাই যেন হয় মা।
- হ্যাঁ মা, পলাশ বাবু বললেন ডাক্তার বলেছেন চিন্তার কোন কারণ নেই। আমি বিকেলে যাব হাসপাতালে। তুমি একদম চিন্তা করো না।
- যা, তুই ফ্রেশ হয়ে নে। মানদা, ওকে খেতে দাও।
- মানদা দি, তুমি এই ঘরে দিয়ো। মা আর আমি আজ একসাথে খাবো।
- ঠিক আছে।
দুপুরে খেতে বসে মা ও ছেলে দুজনে দুজনকে খাইয়ে দিল। মায়ের চেহারাটা আগের থেকে অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছে। সবে তো পঁয়ষট্টি, এখনই এইরকম জীর্ণ চেহারা।
- মা তুমি একদম নিজের খেয়াল রাখো না। দেখেছ চেহারার কি অবস্থা করেছ?
- ও মা, এ আজকের কথা নাকি। এরকম অনেকদিন হয়ে আছে। তুই বহু বছর পরে আমায় দেখলি। তাই এমন বলছিস।
- তা হবে। আসলে কাজের চাপে আর স্কাইপ করে ওঠা হয়না।
- ওসব ছাড়। আচ্ছা শোন বাবু। পলাশ বলছিল যে হাসপাতালে মেডিকালের কাগজ চেয়েছে।
- ইন্সিউরেন্স?
- হ্যাঁ। আজ যখন যাবি, তখন নিয়ে যাস। অবশ্য তাড়া নেই।
- কোথায় আছে?
- ওই ঘরের আলমারিতে আছে। একটা ব্রাউন কালারের ফাইলে।
- ঠিক আছে। দেখি, দুপুরে একটু ঘুমোই। খুব টায়ার্ড লাগছে। তেমন হলে রাত্রে খুঁজে নেব। কাল সকালে দেবো ওদের। এমনিও জেট ল্যাগের জন্য রাত্রে ঘুম আসবেনা।
- ঠিক আছে।
সন্ধ্যেবেলা হাসপাতালে যখন গেল অঙ্কুর, বাবার সাথে কথা হয়নি। উনি ঘুমচ্ছিলেন, কড়া সেডেটিভের ফলে। তবে ডাক্তার বিশ্বাস খুবই খুশী পেশেন্টের উন্নতি দেখে। বললেন পরশুদিনই রিলিজ দিয়ে দেবেন। রাত্রে মা কে খাইয়ে শুইয়ে ও নিজে খেয়ে তারপরে অঙ্কুর গেলেন বাবার ঘরে। ওখানে কাঠের বড় আলমারিটা খুলতে গিয়ে ছেলেবেলার কথা মনে পরে যাচ্ছিল। কোনদিনও ওটিতে হাত দেওয়ার অনুমতি ছিলনা। একবার কি মনে করে চাবি চুরি করে আলমারি খুলে ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলেন অঙ্কুর, সেদিন কোন কারণে বাবার মন মেজাজ ভালো ছিল না, বাবার থেকে মার যা খেয়েছিলেন, সেটা ভেবে এখনো হাত কেঁপে উঠল আলমারি খুলতে গিয়ে। চোখে পড়ল দুটো ফাইল। একটা ব্রাউন, আরেকটা কালো। মা কোনটা বলেছিল, মনে পড়েনি। তাই প্রথমে কালোটা বের করল। এবং খুলে অবাক। সুন্দর করে ওখানে পরপর ফাইল করে রাখা এক গাদা হাতে লেখা চিঠি, তারপরে ইমেলের প্রিন্ট-আউট। প্রত্যেকেটাই লেখা অঙ্কুরের, তার মা কে। এয়ারমেলের চিঠি গুলো দেখে মনে পড়ে গেল, তখন সবে সবে আমেরিকা গিয়েছে। নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখত মা কে। অবাক চোখে আশেপাশে যা দেখত, সব কিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে মা কে চিঠিতে জানাত। তারপরে আসতে আসতে সব চোখ সওয়া হয়ে গেল। ন মাসে ছ মাসে একটা করে চিঠি হয়তো আসতও। তখন তো ফোনের যুগ, আই এস ডি কলের দাম ক্রমশ কমছে। তাই চিঠির বদলে এলো ফোন। মা কে বলে বলেও কখনো ইমেল করানোটা শেখাতে পারেনি। রাশভারী বাবার সাথে খুবই কেজো কারণ ছাড়া ইমেল হতনা। তাহলে এইগুলি? প্রত্যেকটা সেন্ডার এড্রেস ankur.babu@ymail.com, মনে পড়ল, প্রথম একবার ইমেল এড্রেস খুলেছিল বটে এরকম; কিন্তু এটার পাসওয়ার্ড তো বাবা ছাড়া আর কেউ জানেন না। তবে কি বাবাই? প্রতি দুই সপ্তাহে একটা করে ইমেল। আজ নায়াগ্রা গিয়েছিলাম; আজ ইয়েলোস্টোন, আজ হাওয়াই গিয়েছিলাম। সাথে এটাচমেন্টে গুগুল থেকে নামানো ছবি। ছেলে হয়ে যে দায়িত্ব উনি পালন করেননি, সেই দায়িত্বও সুব্রত বাবু পালন করেছেন। চিরকালই স্নেহান্ধ ছিলেন, প্রতি পদে ছেলের দোষ ঢেকে ঢেকে চলতেন। ঠাকুমার কাছে তো বাবা কত বকাও খেয়েছেন, যে ছেলের কোন দোষই তিনি দেখেন না বলে। এই বয়সে এসেও, মায়ের প্রতি ছেলের কর্তব্যও তাই ওনাকেই পালন করতে হল।
পরেরদিন সকালে অবশেষে বাবার সাথে দেখা হল। অঙ্কুরকে দেখে সুব্রত বাবুর চোখে মুখে এক আলাদা হাসি ফুটল। কষ্ট করে দুই হাতে ছেলের হাত জড়িয়ে ধরতে অঙ্কুর বলে উঠলেন, "Thank you বাবা।"
আজ সকাল সকাল মানদা দি, মানে ওদের বাড়িতে সর্বক্ষণের যে লোক থাকে, বাবা মায়ের দেখাশোনার জন্য, তার ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি এয়ারপোর্টে ছুটে এসে প্রথম ফ্লাইটের টিকিট কেটেছেন। বাবার খুব শরীর খারাপ। রাত্রের খাওয়ার পর হঠাৎ বুকে ভীষণ ব্যথা অনুভব করছিলেন; মা যেহেতু বাতের ব্যথায় শয্যাশায়ী, মানদাদিই উল্টোদিকের বাড়ির পলাশ বাবুদের সাহায্যে বাবা কে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। ডাক্তার বলেছেন একটা মাইল্ড এট্যাক হয়েছে, কিছুদিন হাসপাতালেই থাকতে হবে। মানদাদি ফোনে এত কান্নাকাটি করছিল, হঠাৎ করে নিজেকে বড় অসহায় লাগছিল অঙ্কুরের।
সাতাশ ঘণ্টার ফ্লাইট থেকে নেমে আগেই ছুটলেন হাসপাতালে। সেখানে তখন দেখেন পলাশ বাবু ও তার স্ত্রী, মিনু বৌদি রয়েছেন। অঙ্কুরকে দেখে ওরা এগিয়ে এলেন কথা বলতে।
- শোন অঙ্কুর, চিন্তার কিছু কারণ নেই তেমন। ডাক্তার বাবুর সাথে এই এক্ষুণি কথা হল, বলেছেন everything is fine; vital parameters are stable; হয়তো আর কয়েকদিন observationএ রেখে release করে দেবেন।
- আপনাদের যে কী ভাবে ধন্যবাদ জানাবো, আমি বুঝতেই পারছিনা। আপনারা না থাকলে যে কি হত। আসলে অত দূরে বসে তো কিছুই করতে পারিনা।
- আরে না না, প্রতিবেশীর ধর্ম পালন করেছি। এতে এত ধন্যবাদের কি আছে। এছাড়া সুব্রত কাকু আর রুমা কাকিমার সাথে আমাদের তো পারিবারিক সম্পর্ক প্রায়। একদম নিজের কাকা কাকিমার মত আদর যত্নে রাখেন আমাদের। এইটুকু করব না?
- আচ্ছা, এখন কি বাবা কে একবার দেখা যাবে?
- ICUতে আছেন, এখন ঢুকতে দেবে না। তবে বাইরে থেকে দেখতে পারবে। এসো তোমায় নিয়ে যাই।
- আসুন।
কাঁচের জানলা দিয়ে দেখলেন অঙ্কুর, ওর বাবা, মানে একদা দাপুটে হেডমাস্টার, সুব্রত বাবু নিস্তেজ হয়ে শুয়ে রয়েছেন। শরীরের বিভিন্ন অংশ নানান যন্ত্রপাতির সাথে লাগানো। হাতে চ্যানেল করে ওষুধ চলছে। দুই চোখ বন্ধ, কিন্তু মুখে একটা স্নিগ্ধ হাসি। কেন কে জানে, চোখের কোণগুলো চিকচিক করে উঠল।
- এসো অঙ্কুর। তোমার মা অপেক্ষা করছেন। বাড়ী চল, আবার সন্ধ্যেবেলা আসবে। তখন দেখাও করতে পারবে, ডাক্তারের সাথেও কথা বলে নেবে।
- চলুন।
বাড়ি ঢুকে প্রথমেই মায়ের ঘরে গেলেন অঙ্কুর। মা ছেলেকে বুকে টেনে নিলেন। আহ! এতক্ষণে যেন শান্তি অনুভব করলেন। দুজনেই দুজনকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদলেন কিছুক্ষণ। মানদাদি খানিক পরে ঘরে এলেন জলের গ্লাস নিয়ে।
- ও দাদা, এত কেঁদো না। মা কেও একটু থামতে বল। সেই পরশু থেকে কেঁদেই চলেছে, কিছুতেই থামছেনা।
- এই তুই চুপ কর মানদা। আমি আর কাঁদব না। আমার বাবু এসে গিয়েছে। ব্যস আর কোন চিন্তা নেই। দেখবি এবার তোর বাবাও খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসবেন।
- তাই যেন হয় মা।
- হ্যাঁ মা, পলাশ বাবু বললেন ডাক্তার বলেছেন চিন্তার কোন কারণ নেই। আমি বিকেলে যাব হাসপাতালে। তুমি একদম চিন্তা করো না।
- যা, তুই ফ্রেশ হয়ে নে। মানদা, ওকে খেতে দাও।
- মানদা দি, তুমি এই ঘরে দিয়ো। মা আর আমি আজ একসাথে খাবো।
- ঠিক আছে।
দুপুরে খেতে বসে মা ও ছেলে দুজনে দুজনকে খাইয়ে দিল। মায়ের চেহারাটা আগের থেকে অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছে। সবে তো পঁয়ষট্টি, এখনই এইরকম জীর্ণ চেহারা।
- মা তুমি একদম নিজের খেয়াল রাখো না। দেখেছ চেহারার কি অবস্থা করেছ?
- ও মা, এ আজকের কথা নাকি। এরকম অনেকদিন হয়ে আছে। তুই বহু বছর পরে আমায় দেখলি। তাই এমন বলছিস।
- তা হবে। আসলে কাজের চাপে আর স্কাইপ করে ওঠা হয়না।
- ওসব ছাড়। আচ্ছা শোন বাবু। পলাশ বলছিল যে হাসপাতালে মেডিকালের কাগজ চেয়েছে।
- ইন্সিউরেন্স?
- হ্যাঁ। আজ যখন যাবি, তখন নিয়ে যাস। অবশ্য তাড়া নেই।
- কোথায় আছে?
- ওই ঘরের আলমারিতে আছে। একটা ব্রাউন কালারের ফাইলে।
- ঠিক আছে। দেখি, দুপুরে একটু ঘুমোই। খুব টায়ার্ড লাগছে। তেমন হলে রাত্রে খুঁজে নেব। কাল সকালে দেবো ওদের। এমনিও জেট ল্যাগের জন্য রাত্রে ঘুম আসবেনা।
- ঠিক আছে।
সন্ধ্যেবেলা হাসপাতালে যখন গেল অঙ্কুর, বাবার সাথে কথা হয়নি। উনি ঘুমচ্ছিলেন, কড়া সেডেটিভের ফলে। তবে ডাক্তার বিশ্বাস খুবই খুশী পেশেন্টের উন্নতি দেখে। বললেন পরশুদিনই রিলিজ দিয়ে দেবেন। রাত্রে মা কে খাইয়ে শুইয়ে ও নিজে খেয়ে তারপরে অঙ্কুর গেলেন বাবার ঘরে। ওখানে কাঠের বড় আলমারিটা খুলতে গিয়ে ছেলেবেলার কথা মনে পরে যাচ্ছিল। কোনদিনও ওটিতে হাত দেওয়ার অনুমতি ছিলনা। একবার কি মনে করে চাবি চুরি করে আলমারি খুলে ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলেন অঙ্কুর, সেদিন কোন কারণে বাবার মন মেজাজ ভালো ছিল না, বাবার থেকে মার যা খেয়েছিলেন, সেটা ভেবে এখনো হাত কেঁপে উঠল আলমারি খুলতে গিয়ে। চোখে পড়ল দুটো ফাইল। একটা ব্রাউন, আরেকটা কালো। মা কোনটা বলেছিল, মনে পড়েনি। তাই প্রথমে কালোটা বের করল। এবং খুলে অবাক। সুন্দর করে ওখানে পরপর ফাইল করে রাখা এক গাদা হাতে লেখা চিঠি, তারপরে ইমেলের প্রিন্ট-আউট। প্রত্যেকেটাই লেখা অঙ্কুরের, তার মা কে। এয়ারমেলের চিঠি গুলো দেখে মনে পড়ে গেল, তখন সবে সবে আমেরিকা গিয়েছে। নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখত মা কে। অবাক চোখে আশেপাশে যা দেখত, সব কিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে মা কে চিঠিতে জানাত। তারপরে আসতে আসতে সব চোখ সওয়া হয়ে গেল। ন মাসে ছ মাসে একটা করে চিঠি হয়তো আসতও। তখন তো ফোনের যুগ, আই এস ডি কলের দাম ক্রমশ কমছে। তাই চিঠির বদলে এলো ফোন। মা কে বলে বলেও কখনো ইমেল করানোটা শেখাতে পারেনি। রাশভারী বাবার সাথে খুবই কেজো কারণ ছাড়া ইমেল হতনা। তাহলে এইগুলি? প্রত্যেকটা সেন্ডার এড্রেস ankur.babu@ymail.com, মনে পড়ল, প্রথম একবার ইমেল এড্রেস খুলেছিল বটে এরকম; কিন্তু এটার পাসওয়ার্ড তো বাবা ছাড়া আর কেউ জানেন না। তবে কি বাবাই? প্রতি দুই সপ্তাহে একটা করে ইমেল। আজ নায়াগ্রা গিয়েছিলাম; আজ ইয়েলোস্টোন, আজ হাওয়াই গিয়েছিলাম। সাথে এটাচমেন্টে গুগুল থেকে নামানো ছবি। ছেলে হয়ে যে দায়িত্ব উনি পালন করেননি, সেই দায়িত্বও সুব্রত বাবু পালন করেছেন। চিরকালই স্নেহান্ধ ছিলেন, প্রতি পদে ছেলের দোষ ঢেকে ঢেকে চলতেন। ঠাকুমার কাছে তো বাবা কত বকাও খেয়েছেন, যে ছেলের কোন দোষই তিনি দেখেন না বলে। এই বয়সে এসেও, মায়ের প্রতি ছেলের কর্তব্যও তাই ওনাকেই পালন করতে হল।
পরেরদিন সকালে অবশেষে বাবার সাথে দেখা হল। অঙ্কুরকে দেখে সুব্রত বাবুর চোখে মুখে এক আলাদা হাসি ফুটল। কষ্ট করে দুই হাতে ছেলের হাত জড়িয়ে ধরতে অঙ্কুর বলে উঠলেন, "Thank you বাবা।"
Tuesday, August 1, 2017
অদ্ভুতুড়ে
- এই যে শুনুন?
- আমাকে বলছেন?
- না তো কাকে বলব? ধারে কাছে কি আর কেউ আছে নাকি?
- (মনে মনেঃ ওরে বাবা কি মুখরা রে বাবা!) তা তো দেখছি না। আসলে এই পার্কে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি। শান্তিতে যে বসে দুটো হা হুতাশ করব, তার উপায় নেই। লোকে একেবারে গায়ের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। অবশ্য লোকের তো আর দোষ নেই, চোখের মাথা খেয়ে রেখেছে সব।
- হুম।
- তা কি বলছিলেন বলুন?
- বলি আপনার শিক্ষা দীক্ষা কবে হবে বলুন তো মশাই?
- না মানে যতদূর মনে আছে, আমি এম এ পাস। মাসটার ডিগ্রী কিন্তু খারাপ না। ইন ফ্যাক্ট, গোল্ড মেডালিস্ট ছিলাম। নেটটা কিছুতেই লাগাতে পারিনি, নইলে পি এইচ ডি তে ঢুকে যেতাম। শেলী বাইরন গড়গড় করে আউড়ে দিতে পারি। রেনেসাঁ টু রাউলিং, সব বিষয়ে কাজ চালানোর জ্ঞান আছে ম্যাডাম। কোন চাকরীর ওপেনিং আছে বুঝি?
- মরণ। এখানে এসেও চাকরী! আরে ধুর, সেই শিক্ষার কথা বলছি না। যাক গে। সেই শিক্ষার দিক দিয়ে ভাবলে আমি আপনার নখের যুগ্যিও নই। মোটে টুয়েলভ পাস।
- তা হলে কি?
- ওরকম ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছেন কেন আমার দিকে?
- ওরকম তাকালে বুঝি আপনি ক্যাবলা হয়ে যান?
- ঘাটের মরা কোথাকার। উফ। সালমাকে ভালবাসলেন বলে আজ আপনার এই দশা। তারপরেও আবার? আমার দিকেও আবার?
- (মনে মনেঃ বাব্বাহ! এর দেখি সব দিকে কান, সবজান্তা) সে সালমার আব্বু হিন্দু ঘরের পাত্র চাননি, তায় আবার বেকার। নদীর ধারে একসাথে দেখতে পেয়ে তাই জন্যই তো ওই কেলেঙ্কারিটা হয়ে গেল। কিন্তু আপনি তো দেখছি হিন্দু ঘরেরই মেয়ে। গলায় লোকনাথ বাবার লকেট। তাহলে? কি সমস্যা? আপনার দিকে তাকালে বুঝি আমায় ভস্ম করে দেবেন? তা একবার তো হলাম, আবার?
- আমি ওরকম narrow minded নই। কিন্তু ধারে কাছে আমার বাবা দাদারা আছে সব। ঠাকুরদাও আছে। দেখে ফেললে আপনাকে ছাড়বে না।
- ওরে বাবা। গোটা গুষ্টি? তা আপনারা কি ফ্যামিলি কম্বো প্যাকেজে এসছেন বুঝি এখানে? মানে, এখানেও কি ওই Thomas Cookএর কোন deal চলে নাকি? অবশ্য ওরা তো মাঝে মাঝেই দেখি out of the world experienceএর বিজ্ঞাপন দেয়, ও হরি। আজ বুঝলাম তার মানে এই!
- ধুর মশাই, তা না।
- তাহলে?
- এক সাথে আসিনি। কিন্তু পরপর এসেছি। আর ব্লাড রিলেটিভ বলে এখানেও একই জায়গায় থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। তাই আমার মায়ের সেই এটা তুই কি করলি মার্কা মরা কান্না আর বাবা দাদাদের চোখ রাঙানি এখনো প্রতি পদে আমায় সহ্য করে চলতে হচ্ছে। শালা মরেও শান্তি নেই।
- তা কি আর করবেন বলুন। জায়গা পত্তরের বড়ই অভাব। এর মধ্যেই মানিয়ে গুছিয়ে চলতে হবে।
- আপনি এত calm and composed কিভাবে থাকেন মশাই? বিরক্ত লাগছে না এখানে এসেও চারিদিকে এত লোক, ক্যাচর ম্যাচর। মা গো।
- বয়সের সাথে সাথে ওসব এসে যায়, বুঝলেন?
- না সকলের আসেনা। সেই জন্যই তো বলছি। আমার বাপ ঠাকুরদা কে তো জানেন না। বামুনের মেয়ের দিকে তাকাচ্ছেন, নিজের জাতের কথা মাথায় না রেখে? আপনি আচ্ছা ইয়ে তো? নেড়া কতবার বেলতলায় যায় হে শুনি?
- আসলে এই পাড়ায়ও যে এমন হবে, বুঝতেই পারিনি, বিশ্বাস করুন।
- শুনুন, আপনি পায়রা উড়িয়ে, জোনাকির আলোয় সভা করতে পারেন। কিন্তু এখনো বেশীরভাগেরই বোধোদয় ঘটেনি। এসব স্থান কালের ধার এরা কোন দিনই ধারেনা। আমি ঠেকে শিখেছি বস।
- কেমন শুনি?
- ওই তো, আপনারই মত এক পাবলিক, সেদিন আমায় এক খানা গোলাপ দিতে এলো, বুঝলেন। ও মা, বলা নেই, কওয়া নেই। কোত্থেকে দেখি আমার দাদারা উড়ে এসে ধাক্কা মেরে ওকে ওই নিমগাছের মগডালে বেঁধে ফেলল। তারপরে এই মারে কি সেই মারে। নেহাত একবার মরেছে, তাই এ যাত্রায় রক্ষে পেল। তবে বেচারা মাঝখান থেকে বাস্তুহারা হয়ে গেল।
- স্যাড, ভেরি স্যাড।
- এমনি এমনি বলছি? নেহাত আপনাকে খুব খারাপ লাগেনি। আর ইয়ে, আমি কিনা বেশ প্রোগ্রেসিভ, জাত পাত মানিনা বাপু। কিন্তু বাপ ঠাকুরদা দাদাদের হাতে বেঘোরে আপনার কিছু হয়ে গেলে ভালো লাগবেনা কিনা, তাই সাবধান করে রাখলাম।
- বাহ। আপনি তো ভারী লক্ষ্মী মেয়ে দেখি। আমার মায়ের আপনাকে খুব পছন্দ হবে। দেখো।
- আপনার মা কি এখানে থাকেন? নাকি শীগগিরই আসছেন?
- এই না না। মায়ের আসতে দেরী আছে। আমি শুধু বলছিলাম যে মা যবে আসবে, আপনাকে দেখলে মায়ের পছন্দ হবে।
- শুনুন, ওসব মা বাবা আসা অবধি কে কোথায় চলে যাবে, তার কোন ইয়ত্তা আছে? আমি তো থাকব না। সামনের মাসে একটা অডিশন আছে। ওখানে আসবেন আমার সাথে? ঠিক যেমন যেমন শিখিয়ে দেবো,তেমন তেমন বলবেন। দেখবেন চান্স পেয়ে যাবেন ।
- কিসের অডিশন? কিসের চান্স?
- আরে আবার ফিরতে হবে না? ওই ধানসিঁড়িটির তীরে? বিরাট waiting list। অডিশনে lucky 10 বাছাই করবে, seniority list ছাড়াও যাদের পাঠানো হবে। মানে ওই যাকে বলে Wild card entry।
- এই তো সবে এলাম, এত তাড়াতাড়ি চান্স পাবো নাকি?
- হ্যাঁ হ্যাঁ পাবেন। ট্যাঁকের জোর থাকলে সব হয়। এমনিও এখানে জায়গার বড়ই অভাব। বেশিদিন ফেলে রাখা যাবেনা। যত তাড়াতাড়ি পারে এরা end of season saleএ ছেড়ে দেবে। আরে রেজাল্টের মরসুম এখন, তায় আবার বর্ষাকাল; অনেক নতুন কেস আসবে। বোঝেন না নাকি?
- কিন্তু আমার তো টাকার জোর নেই। এম এ পাস করে বেকার ছিলাম। ওই এক দুটো টিউশনি করে যা অল্প পেতাম।
- আরে শুনুন। আমার সাথে ওই লাইনম্যানের হেব্বি ইয়ে আছে। সব ম্যানেজ হয়ে যাবে।
- ইয়ে মানে কি? আপনি তো কথায় কথায় খালি ইয়ে ইয়ে করে যাচ্ছেন দেখছি।
- আরে ওই ইয়ে রে বাবা।
- কি ইয়ে?
- উফ। আপনি যেতে চান কি চান না, সেটা বলুন তো। তখন থেকে ইম্মেটিরিয়াল প্রশ্ন করে যাচ্ছেন।
- আচ্ছা যাব। কিন্তু হঠাৎ আমার ওপর আপনি এত সদয় হলেন যে?
- এই মাসে আসলে couple scheme চলছে, বুঝলেন। একমাত্র জোড়ায় গেলে তবে অডিশনে চান্স দেবে। আর শর্ত আছে যে যেই জোড়ে যাবে, সামনের বার সেই জোড়েই গোটাটা কাটাতে হবে। নইলে নেক্সট অডিশনে চান্স কবে যে পাবে, তার ইয়ত্তা নেই।
- বুঝলাম। তাতে?
- তাতে আর কি। দেখলাম যে আপনি নেহাত ইয়ে মন্দ নন। একখান জীবন কাটানোই যায় আপনার সাথে। তাই বললাম আমার সাথে যেতে। আর আপনিও তো মনে হয় অরাজি হবেন না। যা বুঝছি।
- আর আপনার বাপ ঠাকুরদা?
- একটু ভেক ধরতে হবে। তবে ম্যানেজ হয়ে যাবে। আমার ওপর ভরসা রাখুন।
- ভরসা তো ম্যাডাম ডিডি গেঞ্জির ওপরও ছিল, তাও সেদিন সাদা ডিডিটাই লাল...
- রাখুন তো ওই প্যানপ্যানানি। ওসব গেঞ্জি ফেঞ্জিতে হবে না। আমিই আসল ডিডি। দেবদত্তা। যা করার ও পারার, আমিই করব।
- ঠিক আছে। আমি না হয় আসব। কিন্তু দিনক্ষণ জানব কি করে?
- আরে ad দেবে তো কাগজে। কাগজ পড়েন না? এমা! পড়তে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়।
- ও তাই বুঝি? আসলে আমি নতুন কিনা। পাড়াপড়শিতেও কেউ বলে দেওয়ার মত নেই। জানতাম না।
- এসব highly competetive, বয়েই গিয়েছে পারা প্রতিবেশীর আপনাকে বলার। চোখ কান খুলে চলতে হয়।
- ও। আচ্ছা পড়ব। কিন্তু ধরুন বাই চান্স যদি মিস করে যাই, বা এমনিও প্ল্যানিং করতে গেলে, কি ভাবে করব? আপনি খুব অসুবিধেয় না পড়লে প্লীজ আপনার ফোনের নম্বরটি দেবেন? আমি মিসড কল মেরে দিচ্ছি।
(মনে মনে উবাচ - শালা মরেও মেয়েদের ফোন নম্বর নেওয়ার হ্যাবিট কাটেনা এদের)
- হ্যাঁ লিখুন। 98xxxxxxxx।
- সেভড।
- যান এবার একটা মেসেজ করে দিন। আমি সময়মত যোগাযোগ করে নেব।
- আচ্ছা তার আগে এমনি একদিন একটু হাওয়া খেতে বেরোবেন?
- এত অধৈর্য কেন? এ কদিন শান্তিতে আছেন, উপভোগ করে নিন। সামনে পড়ে আছে গোটা জীবন, তখন রোজ চা- হাওয়া সব খাবেন। বুঝেছেন?
মনে মনে উবাচ ( এখন থেকেই জরু কা গুলাম বানানোর মতলব। নেহাত সুন্দরী, নইলে...)
- বেশ। তাই হোক।
- আচ্ছা এবার আসতে পারেন।
- নমস্কার।
Subscribe to:
Posts (Atom)