বিটকেল হর্ন বাজাতে বাজাতে পাহাড়ি রাস্তার শুনশান নিস্তব্ধতা চুরচুর করে দিয়ে ট্রাকটি মোড়ের মাথা থেকে এগিয়ে এলো। রাস্তায় চলছিল যে ভেড়ার দল, এই শব্দ শুনে উদ্ভ্রান্তের মতো তারা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। ধুলো উড়িয়ে পাথুরে রাস্তা দিয়ে ট্রাকটি ওদের ফেলে এগিয়ে চলল সামনের দিকে। ধুলোর মেঘে ঢাকা পড়ে মেষপালকেরা ট্রাকটিকে গালাগালি দিতে দিতে আবার চলতে লাগল নিজেদের পথে।
ট্রাকটি চালাচ্ছিল প্রীতম সিং। বয়স্ক পাগড়িধারী শিখ চালক। এক হাতে স্টিয়ারিং উইল ধরা, অন্য হাত দিয়ে মাঝে মাঝেই সাদা পুরু গোঁফ পাকাচ্ছেন। ট্রাকটি ওঁর নিজস্ব। বড় সাধের জিনিস, আর তাই নিজেই চালান। অন্য কাউকে স্টিয়ারিঙের ধারে কাছেও আসতে দেন না। প্রতিদিন চুনাপাথরের খনি থেকে পাথর তুলে পাহাড়ের একদম নীচে যে ডিপো রয়েছে, সেখানে পৌঁছে দেন। এর জন্য যাতায়াত সংখ্যার ওপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট টাকা পান, আর তাই প্রীতম সিংএর লক্ষ্যই থাকে যাতে দিনে অন্তত দু'বার পাথর আনা নেওয়া করতে পারেন।
প্রীতম সিংএর পাশে বসে আছে নত্থু। গোলগাল চেহারার হাসি খুশি ছেলে নত্থু ওঁর সহকারী। ট্রাকটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার দায়িত্ব ওর ওপর। নত্থুর বয়স বলা মুস্কিল, বারোও হতে পারে, আবার পনেরোও। ও জানে না। কেউ কোনদিনও ওর জন্ম সময় কোথাও নথিভুক্তও করে যায়নি। কঠোর জীবনযাত্রার ছাপ প্রবলভাবে চেহারায় প্রতিফলিত। আর তাই, মুখ দেখেও বয়স বোঝার উপায় নেই। নত্থুর বাড়ি এই পাহাড়েই, তবে অন্য দিকে। খানিকটা দূরেই।
গত বছর বৃষ্টির অভাবে আলুর ফসল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হল। নত্থুর পরিবারের পক্ষে দৈনন্দিন খাবারের ব্যবস্থা করা কঠিন হয়ে পড়ছিল। তাই নত্থু গ্রামের বাড়ি ছেড়ে এই শহরে আসে কাজের সন্ধানে। কে জানি ওকে বলেছিল এই চুনাপাথরের খাদানের কথা। ওখানে গেলে হয়তো কাজ জুটে যেতে পারে। নত্থু সেই মতো পৌঁছে গেলো ওখানে। তবে নিতান্তই ছোট ও। খাদানে পাথর ভাঙ্গা বা ভাঙ্গা পাথরকে গাড়িতে মালবোঝাই করা, কোনটাই ও পারবে না। তবে নত্থুর কপাল ভালো। প্রীতম সিং, এক বয়স্ক ড্রাইভার, তখন একটি চতুর ও ঝটপট কাজ করবে, এমন ছেলে খুঁজছিলেন নিজের ট্রাকের দেখভালের জন্য। নত্থুকে দেখে তাঁর পছন্দ হয়ে গেলো। তারপর দিনে দশ টাকা মাইনেতে কাজে নিয়োগ হয়ে গেলো।
এ অবশ্য মাস ছয় আগের ঘটনা। এখন নত্থু আগের চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ, ট্রাকের দেখভাল বেশ ভালো করেই করে। ট্রাকেই থাকে, ট্রাকেই শোয়। প্রীতম সিং, যার কিনা আত্মসম্মান, আত্মাভিমান একটু বেশিই, এমনই বেশি যে পঞ্জাবে শক্ত সমর্থ তিন ছেলে থাকলেও তাদের ভরসায় না থেকে এখনও নিজেই ট্রাক চালান, সেই প্রীতম সিং এর সাথেও নত্থুর দিব্যি ভালোই বনিবনা হয়ে গিয়েছে।
প্রীতম সিং ট্রাকের হর্নটি মাঝেমধ্যেই বাজাতে খুবই পছন্দ করেন। বা বলা চলে, হর্নের শব্দ তাঁর কানে বড়ই মধুর। আর তাই শুনশান রাস্তায় যেখানে কোন লোক নেই, নেই কোন জন্তু, তবুও তিনি চেপে হর্ন বাজালেন খানিক।
গাড়ি চলছে ফাঁকা পথে। নত্থুর দিকে একবার তাকিয়ে, তারপর আবার সোজা রাস্তায় চোখ রেখে বললেন, "আর এক বছর। ব্যস। আর এক বছর আমার গাড়িটা চালাবো। তারপর বেচে দিয়ে ঘরে বসে আরামই আরাম।"
"কে কিনবে আপনার এই ট্রাক? আপনার অবসরের আগেই না ট্রাক অবসর নিয়ে নেয়!" নত্থু ফুট কাটল।
"চুপ কর হতভাগা। তুই জানিস আমার এই ট্রাক এখনও যুবতী? মোটে বাইশ বছর। হেসে খেলে আরো কিছু বছর দিব্যি চালানো যাবে।" প্রীতম সিং বিরক্ত হয়ে বলতে বলতে প্রমাণ হিসেবে আবার জোরে হর্ন বাজালেন। ফাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় সেই বিটকেল আওয়াজের প্রতিধ্বনি শুনে বিরক্ত হয়ে কিছু জংলি মোরগ ঝোপ থেকে বেরিয়ে ট্রাকের সামনে দিয়ে ছুট লাগালো রাস্তা দিয়ে।
গাড়ি চলতে থাকে। প্রীতমের খিদে পায়। ভাবেন, কী খাওয়া যেতে পারে।
"কতদিন ভালোমন্দ খাওয়া হয়নি", বিড়বিড় করতে থাকেন উনি।
পাশ থেকে নত্থু বলে ওঠে, "কত সপ্তাহ হয়ে গেল আমারও কোন ভাল মন্দ খাবার জোটেনি। ধুর।" অবশ্য নত্থুর গোলগাল চেহারা দেখে এমন কথা কেউ বিশ্বাসই করবে না।
প্রীতম সিং একবার ওর দিকে তাকান, তারপর পরেরদিন ওকে তন্দুরী মুরগি আর পোলাও খাওানোর প্রতিশ্রুতি দেন। নত্থু অবশ্য কথায় মানতে নারাজ। "আগে খাই, তারপর বিশ্বাস করব," বলে ও।
পাহাড়ি রাস্তা এতক্ষণে সামনের দিকে খানিকটা সরু হয়ে গিয়েছে। সেই সরু রাস্তা দিয়ে আবার একগাদা খচ্চর চলেছে, হেলতে দুলতে। ওই জন্তুগুলোর পালের মধ্যে পড়লেই বিপত্তি। বিপজ্জনক পরিস্থিতির কথা ভেবেই প্রীতম সিং গাড়ির গতি কমালেন। সাথে আবার হর্নও বাজালেন।
এবং অবধারিত তাতে কাজ হলও। খচ্চরগুলো শব্দের জেরে এদিক ওদিক ওপর নীচে ছুটে পালালো।
"এই খচ্চরগুলো বড্ড জ্বালায়। যখন তখন যেখানে সেখানে এসে পৌঁছে যায়" প্রীতম সিং বিরক্ত হয়ে বললেন।
ওরা যে রাস্তা দিয়ে চলেছে, পাহাড় এখানে বড্ড ন্যাড়া। শুকনো। প্রায় কোন গাছ নেই বলা চলে। চুনাপাথরের চক্করে লোকজন এই পাহাড় থেকে সমস্ত গাছপাতা কেটে কুটে শেষ করে দিয়েছে। এখন শুধুমাত্র ওই এদিক সেদিকে ছড়ানো ছিটনো এক আধটা বড় ওক গাছ যা একটু চোখে পড়ে। ব্যস।
প্রীতম রাস্তার দিকে চারপাশে দেখতে দেখতে গাড়ি চালাচ্ছেন। একবার নত্থুর দিকে ফিরে বললেন, "হ্যাঁ রে নত্থু, তোদের দিকেও বুঝি পাহাড় এমন ন্যাড়া?"
"না না। আমাদের ওদিকে এখনও খোঁড়াখুঁড়ি খাদান এইসবের চক্কর শুরু হয়নি। তাই এখনও কিছু গাছপালা পড়ে আছে। জানেন, আমাদের বাড়ির সামনে একটা আখরোট গাছ আছে। সেখান থেকে প্রায় দুই ঝুড়ি বাদাম পাই বছরে।" নত্থুর গলায় ফেলে আসা বাড়ি ঘর দোরের জন্য টান শোনা যায়।
"আর জল? সেইসব আছে?"
" হ্যাঁ কাকা। পাহাড়ের নীচে একটা ঝর্ণা আছে। তাতে খাবার জলের ব্যবস্থা হয়ে যায়। তবে ক্ষেতির জন্য আমাদের বৃষ্টির ওপর নির্ভর করতে হয়। গত বছর এক ফোঁটাও বৃষ্টি হলো না। ব্যস। সব ফসল নষ্ট।"
"চিন্তা করিস না। শিগগিরই বৃষ্টি আসছে দেখিস। আমি গন্ধ পাচ্ছি। তুইও পাবি। শোঁকার চেষ্টা কর।"
"হলে ভালো কাকা। ধুলোগুলো থেকে একটু মুক্তি।"
ওদের গাড়ি এগোতে থাকে। যত ওরা চুনাপাথরের খনির কাছে যায়, রাস্তায় ধুলো বাড়তে থাকে ক্রমশ। তবে এই ধুলোর প্রকৃতি আলাদা। এ এক্কেবারে খাস চুনাপাথরের গুঁড়ো। এ গুঁড়োর চোটে চোখ জ্বলতে থাকে, নাকে ঝাঁঝ লাগে।
খনিতে এখন পাথর ভাঙ্গাভাঙ্গি আর খনন পর্ব চলছে।
প্রীতম সিং ট্রাকটিকে দাঁড় করিয়ে বললেন, "এবার একটু অপেক্ষা করি।"
ওরা দুজনে ট্রাকের ভিতরেই চুপচাপ বসে রইল। এদিক ওদিকের রুক্ষ প্রকৃতির দিকে বারবার চোখ চলে যাচ্ছে। অনেক দূর পর্যন্ত জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই।
হঠাৎ চারিদিক কাঁপিয়ে বিশাল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাহাড়ের এক অংশের সমস্ত পাথর এদিক ওদিক ছিটকে গেল।
নত্থু অবাক হয়ে এসব দেখে। না, পাথর ভাঙ্গা, গড়ানো না। ও অবাক হয়ে দেখতে থাকে বড় বড় গাছ, ছোট মাঝারি ঝোপ সব কেমন এলোমেলো হয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে যায়। গুঁড়িয়ে যায়। দেখতে দেখতে নত্থুর নিজেদের গ্রামের বাড়ির কথা মনে পড়ে যায়। বাড়ির সামনের প্রিয় আখরোট গাছটার কথা ভাবতে থাকে। একদিন কি ওগুলোরও এই অবস্থা হবে? ওদের গ্রামও একদিন কি এরকম শূন্য, রিক্ত হয়ে যাবে? পাইন গাছগুলোর কী হবে? আর বাদাম গাছগুলো? কোন গাছ থাকবে না। বৃষ্টি হবে না। শুধু ধুলো। শুধু পাথর।
ইতিমধ্যে প্রীতম সিং একবার ট্রাকের হর্ন বাজালেন জোরে। উদ্দেশ্য এই যে আশেপাশের লোকজনকে জানানো, তিনি এসেছেন। মালপত্র বোঝাই হওয়ার অপেক্ষায় আছেন।
এরপর নত্থুকে নিয়ে উনি ট্রাক থেকে নামলেন। সামনেই একটা ছোট্ট ছাউনি। সেখানে কন্ট্রাক্টর ও তার সহকারি দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। অনতিদূরে কিছু শ্রমিক সদ্য খনি থেকে তুলে আনা কিছু পাথর ভাঙ্গা ভাঙ্গি করছে। পাশেই স্তূপ করে রাখা আরো পাথর। গাড়িতে বোঝাই হওয়ার অপেক্ষায়।
কন্ট্রাক্টর প্রীতম সিংকে ডেকে বললেন, "দাদা, আসুন। চা খেয়ে যান।"
প্রীতম জবাব দেন, "না হে ভায়া। সময় নেই। আরো এক ট্রিপ দিতে হবে আজ। একেই তাড়াতাড়ি আলো কমে আসছে আজকাল। জলদি জলদি হাতা চালাতে বলো ওদের। ঝটপট মাল তোলো। আমি এগোই।"
তবে মুখে না বললেও সিংজি নিজের জন্য এক কাপ চা চাইলেন, চা-ওয়ালার থেকে। ইতিমধ্যে কন্ট্রাক্টর শ্রমিকদের আস্তে আস্তে পাথর বোঝাই করার নির্দেশ দিলেন। নত্থু ট্রাকের পিছনের ডালাটা খুলে দিল। সাথে সাথে শ্রমিকদের সঙ্গে কাজেও হাত লাগালো। হাত চালালে শরীর গরম থাকবে। যদিও ভারি চেহারার দরুণ আর পাঁচজনে চেয়ে ওর ঠাণ্ডা বোধটা কম। তাও।
নত্থুকে কাজে হাত লাগাতে দেখে কন্ট্রাক্টরের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। ওকে যদি এর জন্য টাকা দিতে হয়, তাহলে তো নিজের লাভ কমে যাবে। তাই সে তড়িঘড়ি বলল, "শোন ভায়া, কাজ করছিস, কর। কিন্তু এর জন্য এক পয়সাও পাবি না জেনে রাখিস, পরে চাইতে আসবি না যেন।"
নত্থু হেসে বলল, "চিন্তা করবেন না দাদা। আমি টাকা চাইব না। আমি প্রীতম সিংজির কাছে কাজ করি। উনি আমার মালিক।"
পাশ থেকে প্রীতম সিং চেঁচিয়ে উঠলেন, "হ্যাঁ, নত্থু ঠিক বলেছে। ও আমার কাছে কাজ করে। কিন্তু ও কারুর চাকর না। মুখ সামলে কথা বলবে সবাই ওর সাথে।"
প্রায় ঘন্টাখানেক পর কন্ট্রাক্টর যখন এক্কেবারে নিশ্চিত হল যে ট্রাকে আর একটা কুঁচিও পাথর আঁটানোর জায়গা নেই, তখন পাথর বোঝাই গাড়ি যাওয়ার অনুমতি পেলো। চারজন শ্রমিক পাথরের ওপর বসে বসে যাবে। আর দুজন শ্রমিক, কন্ট্রাক্টর এবং তার সহকারী, পিছন পিছন একটা গাড়িতে আসবে। এই ব্যবস্থা। নত্থু এক ধার দিয়ে নিজের সিটে উঠে বসল। দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করলো। প্রীতম সিং এর ট্রাকের এটাই মজা। জোর না দিলে দরজা বন্ধই হয়না। এদিকে আলতো ছোঁয়ায় খুলে যায়। ঠিক যেন সেলোটেপ দেওয়া।
প্রীতম সিং গাড়ি স্টার্ট করে বলেন, "চলা যাক তাহলে। আমায় তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে আজ। রাত্রে বিয়েবাড়ি আছে।"
গাড়ি চলার সাথে সাথে মাঝে মাঝে প্রীতম সিং গুনগুন করে গান গাইতে লাগলেন আপন মনে।
গানের এমন জাদু, শ্রমিকের দলও তাতে যোগ দিল এইবারে।
ট্রাকটি পাহাড়ি রাস্তার মোড় অতিক্রম করে চলেছে। আজ যেন গাড়ির গতি নত্থুকে বড় অস্বস্তিতে ফেলছে। মাঝে মাঝে গাড়ি যখন এদিক ওদিক বাঁকে ঘুরছে, পাশে দরজাটা এমনভাবে কেঁপে কেঁপে উঠছে যে ওর মাথা ঘুরে যাচ্ছে, গা গুলিয়ে যাচ্ছে। প্রীতমকে বললো, "একটু আস্তে চালান না কাকা।"
প্রীতম একটু আমোদ পেলেন এমন কথায়। বললেন, "হঠাৎ? কবে থেকে তুই ভয় পেতে লাগলি বাচ্চা?"
"আজ থেকে।" নত্থু বললো।
"কেন? আজ কী বিশেষ ব্যাপার হয়েছে?"
"জানি না। মনে হচ্ছে। মন বলছে বলতে পারেন।"
"ধুর ধুর। বয়স হচ্ছে তোর। আর কিচ্ছু না।"
নত্থুও এবারে মজা পেয়ে গিয়েছে। ও বললো, "আমার বয়সে পৌঁছোন, তারপর বুঝবেন।"
প্রীতম সিং কিঞ্চিৎ হেসে বললেন, "এই। অনেক ফাজলামি হলো। এবার চুপ করে বোস তো।"
গাড়ি আরো একটা বাঁক পার করলো। নত্থু জানলার বাইরে দিয়ে নীল আকাশ দেখতে থাকে। নীচে উপত্যকা। ওরা যেন বড্ড খাদের ধারে চলে এসেছে। অবশ্য এ আর নতুন কী। প্রীতম সিং এরকমই গাড়ি চালান।
আরো কিছু বাঁক পড়লো রাস্তায়। এবার রাস্তাটি সোজা ঢালে নামবে উপত্যকায়। প্রীতম সিং ভাবলেন একবার গাড়ির ব্রেক দেখে নেবেন। ঠিকঠাক কাজ করছে তো?
যেমন ভাবা তেমন কাজ। চেপে ব্রেক কষলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় পিছনে বসে থাকা শ্রমিকেরা প্রায় ছিটকে পড়ছিল এদিক ওদিক।
"কাকা, আস্তে! কী হচ্ছে টা কী?" ওরা চেঁচিয়ে উঠলো প্রতিবাদে।
প্রীতম হেসে বললেন, "দাঁড়াও দাঁড়াও। এই তো এক্ষুণি পৌঁছে যাব।"
তা শুনে ঘাবড়ে গিয়ে নত্থু প্রীতমকে কোনো শর্টকাট নিতে বারণ করলো।
ঠিক এই সময়ে রাস্তার মধ্যিখানে হঠাৎ একটা খচ্চর কোত্থেকে উদয় হলো। প্রীতম স্টিয়ারিং উইলটা ডানদিকে কাটালেন। কিন্ত রাস্তা যে বাঁদিকে গিয়েছে। ট্রাক গিয়ে পড়লো এক্কেবারে খাদের ধারে।
ট্রাকটি খাদের ওপর বিপজ্জনকভাবে ঝুলছে। শ্রমিকগুলো পড়ি কি মরি লাফ মেরে নেমে পড়লো। গাড়ি আরো ঝুলতে থাকে। পাথরে ধাক্কা খেয়ে নত্থুর পাশের দরজাটা খুলে যায়। ও ছিটকে পড়ে বাইরে।
এইবারে ট্রাকটি পাথরের খণ্ডের ওপর ধাক্কা খেতে খেতে আরো গড়াতে থাকে খাদের দিকে। উল্টে পাল্টে অবশেষে গিয়ে একটা পুরনো ওক গাছের ডালপালার মধ্যে আটকালো। ভাগ্যিস! গাছটা না থাকলে এক্কেবারে গভীর খাদে গিয়ে পড়ত।
দুইজন শ্রমিক একটু দূরে চুপ করে বসে আছে। ঘটনার আকস্মিকতা এখনও ঝেড়ে ফেলতে পারেনি গা থেকে। বাকি দুজন ছুটেছে খনির দিকে, সাহায্যের আশায়।
নত্থু পড়েছে কাঁটা ঝোপের মধ্যে। গায়ে কাঁটা লেগে ছড়ে গিয়েছে। তবে ব্যথা তেমন লাগেনি। কোনমতে নিজেকে তুলে ও দুই শ্রমিকের সাথে খনির দিকেই যাবে ভাবছিল, এমন সময় মনে পড়ল প্রীতম সিং এর কথা। উনি তো এখনও গাড়ির ভিতরেই আছেন। কপাল জোরে বেঁচে গেলে তো ভালো মতো জখম হবেন। ওঁকে আগে বের করতে হবে গাড়ি থেকে।
"কাকা? কাকা?" নত্থুর ডাকে কোন সারা নেই।
ও এগিয়ে গেলো। দেখতে পেল ট্রাকের খোলা দরজা দিয়ে প্রীতমের আদ্ধেকটা শরীর বেরিয়ে আছে। বাকি আদ্ধেক গাড়ির ভিতরে। স্টিয়ারিং উইলটা বুকে চেপে রয়েছে। নত্থু সেই দৃশ্য দেখে ভাবল, প্রীতম সিং বুঝি আর বেঁচে নেই। ট্রাক থেকে সরে যাচ্ছিলই, এমন সময় পিট করে কালশিটে পড়া ফোলা একটা চোখ খুললেন প্রীতম সিং।
নত্থু অবাক।
"আপনি বেঁচে আছেন কাকা?" ও জিজ্ঞেস করলো।
"তাই তো মনে হচ্ছে," জবাব এলো।
এইটুকু বলেই আবার চোখ বন্ধ করে নিলেন উনি।
ইতিমধ্যে কন্ট্রাক্টর আর তার দলবল এসে পৌঁছেছে দুর্ঘটনা স্থলে। যতক্ষণে লোকজন এসে প্রীতমকে উদ্ধার করলো, প্রায় ঘন্টাখানেক পেরিয়ে গিয়েছে। এরপর গাড়ি এসে প্রীতমকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। সেখানে গিয়ে জানা গেলো, কাঁধের হাড় ভেঙ্গেছে, সাথে অনেকগুলো পাঁজরের হাড়ও গুরুতর জখম। অবশ্য ডাক্তার আশ্বাস দিলেন, সেরে উঠবেন প্রীতম।
কিছুদিন পর নত্থু যখন প্রীতম সিংকে দেখতে গেলো হাসপাতালে, উনি আক্ষেপের সুরে বললেন, "হায় রে নত্থু। আমার ট্রাকটা শেষ হয়ে গেলো। আমায় এবারে দেশে ফিরে ছেলেদের সাথে থাকতে হবে। হায় হায়। অবশ্য তুই জোয়ান আছিস। অন্য কারুর গাড়িতে কাজ পেয়ে যাবি।"
"নাহ, আমিও বাড়ি ফিরে যাবো", নত্থু বলে।
"গিয়ে কী করবি?" প্রীতম জিজ্ঞেস করেন।
"দেখি, ক্ষেতি করব। গাছপালা লাগাবো। সব গাছ পালা উড়িয়ে দেওয়ার চেয়ে কিছু লাগানো ভালো। ক্ষেত। জঙ্গল।" নত্থু আস্তে আস্তে জবাব দেয়।
তারপর খানিকক্ষণ ওরা দুজনেই চুপ করে থাকে।
অবশেষে প্রীতম মুখ খোলেন, "জানিস তো নত্থু, একটা গাছের জন্যই আমি সেদিন আমার জীবন ফিরে পেলাম। ওই গাছটা ওখানে না থাকলে সেদিন আমার মৃত্যু অবধারিত ছিল রে। ওই গাছই আমায় নতুন প্রাণ দিয়েছে। মনে রাখিস নত্থু। কক্ষনো ভুলিস না কথাটা।"
"অবশ্যই কাকা। মনে থাকবে। চিরকাল।"
Wednesday, February 27, 2019
তুই
- সরি। এবার তো খেতে চল।
- ইটস ওকে। তুমি খেয়ে নাও। আমার খিদে নেই।
- প্লিজ, প্লিজ। এরকম করিস না। বলছি তো, আই এপোলোজাইস।
- আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু আমার খিদে নেই।
- তা বললে হয় নাকি? চল না রে বাবা।
- না বললাম তো। আমার খিদে পায়নি। তুমি যাও।
- উফ, সরি বলছি তো কতবার ধরে। তাও কেন ড্র্যাগ করছিস বল তো?
- ড্র্যাগ তো তুমি করছ। তখন থেকে বলে চলেছি যেটা হয়ে গিয়েছে, হয়ে গিয়েছে। তুমি সরি বলেছ। ইনাফ। আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। তাও খেতে চল খেতে চল বলে ঘ্যান ঘ্যান করছ কেন বলো তো?
- করছি এই জন্য যে আমি সরি বললেও তুই তো আমায় ক্ষমা করিসনি। আমি জানি।
- আরে ধ্যাত্তেরিকি। এক কথা কতবার করে বলাবি বল তো? বলছি তো ক্ষমা করলাম। আর আমার খিদে পায়নি। তাই খেতে যাবো না। তুই খেয়ে নে।
- এইবারে বিশ্বাস করলাম।
- মুখ ঝামটা না খেলে তো কোন কাজ হয় না তোর।
- উহু। মুখ ঝামটা না। ব্যাপারটা অন্য।
- কী?
- এই যে। তুই রাগ করলে তুমি আর এমনি সময়ে তুই বলিস। যেই তুই বললি, ওমনি বুঝে গেলাম।
- মরণ! যা সাঁটিয়ে আয় খাবার।
- তুই শিয়োর খাবি না?
- খুন হবে আমার হাতে??
- ইটস ওকে। তুমি খেয়ে নাও। আমার খিদে নেই।
- প্লিজ, প্লিজ। এরকম করিস না। বলছি তো, আই এপোলোজাইস।
- আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু আমার খিদে নেই।
- তা বললে হয় নাকি? চল না রে বাবা।
- না বললাম তো। আমার খিদে পায়নি। তুমি যাও।
- উফ, সরি বলছি তো কতবার ধরে। তাও কেন ড্র্যাগ করছিস বল তো?
- ড্র্যাগ তো তুমি করছ। তখন থেকে বলে চলেছি যেটা হয়ে গিয়েছে, হয়ে গিয়েছে। তুমি সরি বলেছ। ইনাফ। আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। তাও খেতে চল খেতে চল বলে ঘ্যান ঘ্যান করছ কেন বলো তো?
- করছি এই জন্য যে আমি সরি বললেও তুই তো আমায় ক্ষমা করিসনি। আমি জানি।
- আরে ধ্যাত্তেরিকি। এক কথা কতবার করে বলাবি বল তো? বলছি তো ক্ষমা করলাম। আর আমার খিদে পায়নি। তাই খেতে যাবো না। তুই খেয়ে নে।
- এইবারে বিশ্বাস করলাম।
- মুখ ঝামটা না খেলে তো কোন কাজ হয় না তোর।
- উহু। মুখ ঝামটা না। ব্যাপারটা অন্য।
- কী?
- এই যে। তুই রাগ করলে তুমি আর এমনি সময়ে তুই বলিস। যেই তুই বললি, ওমনি বুঝে গেলাম।
- মরণ! যা সাঁটিয়ে আয় খাবার।
- তুই শিয়োর খাবি না?
- খুন হবে আমার হাতে??
Tuesday, February 26, 2019
ডিক্যাফ
দমদম এয়ারপোর্টের কফিশপে বসে কিং সাইজ লাতে খাচ্ছি। চেন্নাইয়ের ফ্লাইটের দেরি আছে ঘন্টাখানেক। হঠাৎ কানে এলো,
"ওয়ান ডিক্যাফ এস্প্রেসো প্লিজ।"
চমকে উঠলাম।
"ওয়ান ডিক্যাফ এস্প্রেসো প্লিজ।"
চমকে উঠলাম।
"অগ্নি, তোর এই ডিক্যাফের ঢপবাজিটা বন্ধ কর তো। কফিশপে এসে এস্প্রেসো খাবি। এদিকে তা হবে নাকি ডিক্যাফ।"
"আমি তো আসি জাস্ট তোকে কম্পানি দিতে।"
"কম্পানি দিবি তো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবি। বেকার টাকা খরচা করে ডিক্যাফ নেওয়ার কী আছে? বসে বসে সিসিডিকে বড়লোক বানানো শুধু। সেভ করা প্র্যাকটিস কর। অন্তত তাতান আর তিতিরের জন্য।"
"অত ফিউচার ফিউচার করলে প্রেজেন্টকে উপভোগ করবি কী করে? তুই বুঝবি না রুমুন। ছাড়।"
"হুহ।"
"আরে, রুমুন না?" ভেবেছিলাম কফি কাপ আর সাতকাহনের আড়ালে আমায় দেখতে পাবে না ও। কিন্তু না। দশ বছর আগের মতোই হাজার ভিড়ের মধ্যেও ওই চোখ জোড়া আমায় ঠিক খুঁজে নিয়েছে।
"অগ্নি যে! কেমন আছিস?"
"খুব ভালো। তুই?"
"ফার্স্ট ক্লাস!"
ও এসে আমার টেবিলেই বসল। উল্টোদিকে।
"তা, কোথায় আছিস এখন? চললি কোথায়?"
"চেন্নাই। ছুটিতে বাড়ি এসেছিলাম। ফিরছি। তুই?"
"আমি যাচ্ছি বম্বে। কাজ কাম ভেকেশন।"
"স্যার, আপনার এস্প্রেসো। ডিক্যাফ।" ওয়েটার একটা কাঁচের কাপ নামিয়ে গেল ওর সামনে। আমি বললাম, "এখনও অভ্যেস গেল না?"
হাসলো। কিছু বলল না।
আমি আবার বললাম, "কী রে, হাসছিস যে?"
উত্তর দিলো, "ভাগ্যিস আজও অভ্যেসটা যায়নি। তাই তো এই যে, কম্পানি দিতে পারছি।"
"রুমুন, হলো কফি খাওয়া? তাতানকে মোমো খাইয়ে আনলাম। আমিও খেলাম। তোমার জন্য আনবো?" মুখ তুলে দেখলাম। সোমক। সাথে আমার সাত বছরের ছেলে, তাতান।
আমি অগ্নির সাথে পরিচয় করে দিলাম সোমকের।
"সোমক, অগ্নি। আমার মাস্টার্সের বন্ধু। অগ্নি, সোমক। আমার বর। আর এই আমার ছেলে। তাতান।"
দুজনে করমর্দন করলো।
তাতানের গালে আলতো হাত বুলিয়ে আমার দিকে ফিরে বললো, "ওই যে ওইখানে দেখ, নীল কুর্তা, লাল কার্ডিগান, কাঁধে গ্রে ব্যাগ...ও শ্রেয়া। আমার বউ। ওর পাশে ঠেস দিয়ে বসে বই পড়ছে... আমার মেয়ে। তিতির। এখন থেকেই বইয়ের পোকা। ঠিক তোর মতো। আয়, আলাপ করিয়ে দিই।"
আমি একবার রিস্ট ওয়াচের দিকে তাকালাম। তারপর সোমকের দিকে।
বললাম, "আজ থাক। পরে কখনও। বোর্ডিং শুরু হবে এইবার আমাদের। এগোই। দেখা হয়ে ভালো লাগলো। ভালো থাকিস।"
কফি কাপটা টেবিলে নামিয়ে তাতানের হাত ধরে "চলো" বলে সোমককে ডেকে আমি কফিশপ থেকে বেরিয়ে গেলাম। কফিশপে ডিক্যাফ হাতে রয়ে গেল অগ্নি। দশ বছর আগের মতোই।
প্লেনে বসেছি। ওয়াটসআপটা খুললাম একবার। দেখলাম দশ বছর পর একটা চ্যাট উইন্ডোতে আবার একটা ছোট্ট মেসেজ ঢুকেছে।
"পরেরবার কলকাতায় এলে অন্তত দেখা দিস। আর হ্যাঁ, ভালো থাকিস।"
ফোনটাকে দুই হাত দিয়ে চেপে বুকের ওপর ধরে রাখলাম খানিকক্ষণ। কিছু মুহূর্ত চোখ দুটো বন্ধ করলাম।
এয়ারহোস্টেসের সিকিউরিটি এনাউন্সমেন্টে আবার চোখ মেলতে দেখি সোমক ব্যস্ত ছেলের সিট বেল্ট বাঁধতে। আমায় দেখে বললো, "টায়ার্ড? ঘুমিয়ে নাও খানিক। তাতানকে আমি ম্যানেজ করছি।" কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ওর হাতটা মুঠোর মধ্যে বন্দী করলাম।
প্লেন যথাসময়ে চলতে লাগলো। পাশে দাঁড়ানো অনেকগুলোর মধ্যে বম্বেরটা কোনটা ছিল, কে জানে?
"আমি তো আসি জাস্ট তোকে কম্পানি দিতে।"
"কম্পানি দিবি তো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবি। বেকার টাকা খরচা করে ডিক্যাফ নেওয়ার কী আছে? বসে বসে সিসিডিকে বড়লোক বানানো শুধু। সেভ করা প্র্যাকটিস কর। অন্তত তাতান আর তিতিরের জন্য।"
"অত ফিউচার ফিউচার করলে প্রেজেন্টকে উপভোগ করবি কী করে? তুই বুঝবি না রুমুন। ছাড়।"
"হুহ।"
"আরে, রুমুন না?" ভেবেছিলাম কফি কাপ আর সাতকাহনের আড়ালে আমায় দেখতে পাবে না ও। কিন্তু না। দশ বছর আগের মতোই হাজার ভিড়ের মধ্যেও ওই চোখ জোড়া আমায় ঠিক খুঁজে নিয়েছে।
"অগ্নি যে! কেমন আছিস?"
"খুব ভালো। তুই?"
"ফার্স্ট ক্লাস!"
ও এসে আমার টেবিলেই বসল। উল্টোদিকে।
"তা, কোথায় আছিস এখন? চললি কোথায়?"
"চেন্নাই। ছুটিতে বাড়ি এসেছিলাম। ফিরছি। তুই?"
"আমি যাচ্ছি বম্বে। কাজ কাম ভেকেশন।"
"স্যার, আপনার এস্প্রেসো। ডিক্যাফ।" ওয়েটার একটা কাঁচের কাপ নামিয়ে গেল ওর সামনে। আমি বললাম, "এখনও অভ্যেস গেল না?"
হাসলো। কিছু বলল না।
আমি আবার বললাম, "কী রে, হাসছিস যে?"
উত্তর দিলো, "ভাগ্যিস আজও অভ্যেসটা যায়নি। তাই তো এই যে, কম্পানি দিতে পারছি।"
"রুমুন, হলো কফি খাওয়া? তাতানকে মোমো খাইয়ে আনলাম। আমিও খেলাম। তোমার জন্য আনবো?" মুখ তুলে দেখলাম। সোমক। সাথে আমার সাত বছরের ছেলে, তাতান।
আমি অগ্নির সাথে পরিচয় করে দিলাম সোমকের।
"সোমক, অগ্নি। আমার মাস্টার্সের বন্ধু। অগ্নি, সোমক। আমার বর। আর এই আমার ছেলে। তাতান।"
দুজনে করমর্দন করলো।
তাতানের গালে আলতো হাত বুলিয়ে আমার দিকে ফিরে বললো, "ওই যে ওইখানে দেখ, নীল কুর্তা, লাল কার্ডিগান, কাঁধে গ্রে ব্যাগ...ও শ্রেয়া। আমার বউ। ওর পাশে ঠেস দিয়ে বসে বই পড়ছে... আমার মেয়ে। তিতির। এখন থেকেই বইয়ের পোকা। ঠিক তোর মতো। আয়, আলাপ করিয়ে দিই।"
আমি একবার রিস্ট ওয়াচের দিকে তাকালাম। তারপর সোমকের দিকে।
বললাম, "আজ থাক। পরে কখনও। বোর্ডিং শুরু হবে এইবার আমাদের। এগোই। দেখা হয়ে ভালো লাগলো। ভালো থাকিস।"
কফি কাপটা টেবিলে নামিয়ে তাতানের হাত ধরে "চলো" বলে সোমককে ডেকে আমি কফিশপ থেকে বেরিয়ে গেলাম। কফিশপে ডিক্যাফ হাতে রয়ে গেল অগ্নি। দশ বছর আগের মতোই।
প্লেনে বসেছি। ওয়াটসআপটা খুললাম একবার। দেখলাম দশ বছর পর একটা চ্যাট উইন্ডোতে আবার একটা ছোট্ট মেসেজ ঢুকেছে।
"পরেরবার কলকাতায় এলে অন্তত দেখা দিস। আর হ্যাঁ, ভালো থাকিস।"
ফোনটাকে দুই হাত দিয়ে চেপে বুকের ওপর ধরে রাখলাম খানিকক্ষণ। কিছু মুহূর্ত চোখ দুটো বন্ধ করলাম।
এয়ারহোস্টেসের সিকিউরিটি এনাউন্সমেন্টে আবার চোখ মেলতে দেখি সোমক ব্যস্ত ছেলের সিট বেল্ট বাঁধতে। আমায় দেখে বললো, "টায়ার্ড? ঘুমিয়ে নাও খানিক। তাতানকে আমি ম্যানেজ করছি।" কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ওর হাতটা মুঠোর মধ্যে বন্দী করলাম।
প্লেন যথাসময়ে চলতে লাগলো। পাশে দাঁড়ানো অনেকগুলোর মধ্যে বম্বেরটা কোনটা ছিল, কে জানে?
Monday, February 25, 2019
দ্য আমব্রেলা ম্যান
গতকাল সন্ধ্যেয় আমার মা এবং আমার সাথে একটি অতি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। এখন সেই গল্পই বলছি। ও, তার আগে তো আমার পরিচয়ই দেওয়া হয়নি। আমি এক দ্বাদশ বর্ষীয়া মেয়ে, আমার মায়ের বয়স চৌত্রিশ। এবং ইতিমধ্যেই আমি লম্বায় প্রায় আমার মাকে ছুঁয়ে ফেলেছি। গল্পে ফিরি।
গতকাল দুপুরে মা আমায় লন্ডনে নিয়ে গিয়েছিল, দাঁতের ডাক্তার দেখাতে। ডাক্তারটি আমার মাড়ির দাঁতে পেলেন একটি গর্ত। মোটামুটি ব্যথা না দিয়েই তিনি সেই গর্তটি বুজিয়েও দিলেন। তারপর আমি আর মা একটি ক্যাফেতে গেলাম। ওখানে আমি একটি ফলের আইসক্রিম অর্ডার দিলাম। মা নিলো এক কাপ কফি। আমাদের খাওয়াদাওয়া শেষ হতে হতে ছ'টা বেজে গেল।
ক্যাফে থেকে বেরিয়ে দেখলাম ভালো জোরে বৃষ্টি পড়ছে। আমাদের গায়ে ছিল সাধারণ কোট আর মাথায় হ্যাট। সেই বৃষ্টিতে অবশ্যই ভিজে যাবো। মা বলল, "একটা ট্যাক্সি নিতেই হবে।"
আমি বললাম, "চলো না, খানিক্ষণ অপেক্ষা করি ক্যাফেতে বসে।" কী করব, আমার মন যে তখনও পড়ে আছে ক্যাফের ওই সুস্বাদু আইসক্রিমে।
"উহু, এই বৃষ্টি শিফফিরি থামবার নয়। আমাদের তো বাড়ি ফিরতে হবে," মা বলল।
আমরা ফুটপাথের ধারে এসে দাঁড়ালাম ট্যাক্সির অপেক্ষায়। রাস্তা দিয়ে অনেক ট্যাক্সি গেলো বটে। তবে সবই যাত্রী বোঝাই। সেসব দেখতে দেখতে মা আক্ষেপের সুরে এক সময়ে বলল, "ইশ, আমাদের যদি একটা গাড়ি থাকত... আর সাথে একটা ড্রাইভার..."
এমন সময় এক বৃদ্ধ ব্যক্তি আমাদের সামনে এলেন। ছোটখাটো চেহারা, সত্তরের ওপর বয়স। মাথার টুপিটা সসম্মানে একটু উঁচু করে মায়ের দিকে মেলে বললেন, " এক্সকিউজ মি..." ভদ্রলোকের দিকে এবারে ভালো করে চেয়ে দেখলাম। মুখের গোলাপী চামড়া কুঁচকে আছে। মোটা সাদা ভুরু আর পাকা গোঁফ। হাতে একটি বড় ছাতা, তাই দিয়ে নিজের মাথা ঢেকে দাঁড়িয়ে আছেন।
মা প্রায় ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল, "বলুন?"
"একটা ছোট্ট সাহায্য লাগতো। নিতান্তই ছোট্ট। বলতে পারি?" উনি কিঞ্চিত ইতস্তত করে বললেন।
আমি মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম, মা বেশ সন্দেহজনক দৃষ্টিতে ভদ্রলোকটিকে নিরীক্ষণ করছে। আমার মা খুবই সন্দেহপ্রবণ। বিশেষ করে অপরিচিত লোক এবং সিদ্ধ ডিম, এই দুইয়ের ওপর মায়ের প্রবল অবিশ্বাস। ডিম সিদ্ধর খোলা একটু ফাটিয়ে চামচ দিয়ে এমনভাবে নাড়াঘাঁটা করে, যেন মনে হবে এই বুঝি ভিতর থেকে কোন ইঁদুর বেরিয়ে এলো। আর অপরিচিত লোকজন নিয়ে তো মায়ের আবার একখানি জম্পেশ নিয়ম আছে। "যত বেশি ভালো মনে হবে ব্যক্তিটিকে, তাকে তত বেশি সন্দেহ করবে।" এই ক্ষেত্রে ভদ্রলোকটি অত্যন্ত ভালোমানুষ গোছেরই মনে হচ্ছিল আমার। ইনি যে নিপাট ভদ্রলোক, সেই ব্যাপারে আমি আরো নিশ্চিত হই ওঁর জুতোজোড়া দেখে। তার কারণ? আমার মায়ের আরো একখানি মহামূল্যবান বক্তব্য। "কোন ভদ্রলোককে চিনবার অন্যতম উপায় তার পরনের জুতো।" এবার এই বৃদ্ধের পায়ের খয়েরি জুতো জোড়া বেশ সুন্দর দেখতে। তাই তাঁর আর ভদ্রলোক হওয়া আটকায় কে?
ভদ্রলোক মাকে বলতে লাগলেন, "আসলে ব্যাপারটা হয়েছে কী, ইয়ে, মানে, একটু বিপদে পড়েছি। তাই সামান্য সাহায্য চাইছি আপনার কাছে। তেমন বেশি না। অল্পই। সেইটুকুই আমার খুব প্রয়োজন। আসলে বয়স হয়েছে তো, ভুলে যাওয়ার বাতিক আছে..."
এই অবধি শুনে আমি মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম মা থুতনি উঁচু করে, মুখচোখ গম্ভীর করে, একটা রাগী চোখ মুখ করে সোজা তাকিয়ে আছে মানুষটার দিকে। মায়ের এ হেন মূর্তি আবার বেশ ভয় উদ্রেককারী। বেশিরভাগ লোকজনই মাকে এইরকম দেখলে ভয় পেয়ে যায়। আমার মনে আছে, সেবার আমার স্কুলের হেডমিস্ট্রেস পর্যন্ত মাকে এমনভাবে দেখে রীতিমতো তোতলাতে শুরু করে দিয়েছিলেন। তবে অবাক কাণ্ড, এই ভদ্রলোকটির ওপর মায়ের চেহারার এই পরিবর্তনে কোন প্রভাবই পড়ল না। উনি দিব্যি হাসিমুখে বলতে থাকলেন, "ম্যাডাম, বিশ্বাস করুন। আমি সত্যিই বিপদে পড়েছি। তাই আপনাকে বলছি। নইলে এরকম রাস্তার মাঝখানে ভদ্রমহিলাদের দাঁড় করিয়ে কথা বলাটা মোটেই আমার স্বভাব না।"
"আশা করি!" মা বলল।
মায়ের এই আচরণে আমার খুব লজ্জা লাগছিল। ইচ্ছে হল বলি, "মা, দয়া করে ওঁকে এরকম বলো না। বয়স্ক মানুষ। কোন বিপদে পড়েই নিশ্চয়ই সাহায্য চাইছেন। দয়া করে নির্দয় হয়ো না।" কিন্তু বলতে পারলাম না।
সামনের মানুষটি ছাতাটি এবার এক হাত থেকে আরেক হাতে নিয়ে বললেন, "আসলে এমন ভুল আগে কখনও করিনি।"
মা কড়া স্বরে বলল, "কী ভুল?"
"এই যে, বেরনোর সময় আমার টাকার ব্যাগটা নিয়ে আসতে ভুলে গিয়েছি। কী বিচ্ছিরি বলুন তো?" ভদ্রলোকটি বললেন।
মা পাল্টা প্রশ্ন করলো, "ও, তার মানে আপনি টাকা চাইছেন?"
ভদ্রলোক উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, "ছি ছি, না না। তা কেন। আমি মোটেই টাকা চাইছি না।"
"তাহলে? কী চাই? তাড়াতাড়ি বলুন। আমরা এখানে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি।" মা অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
"হ্যাঁ, জানি তো আপনারা ভিজছেন। দেখতে পাচ্ছি। আর তাই আমি আপনাদের এই ছাতাটি দিতে চাইছি, আপনারা যাতে না ভেজেন। তবে..." ভদ্রলোক বললেন।
"তবে কী?" মা জিজ্ঞেস করলো।
" সাথে টাকা নেই। আর তাই এই ছাতাটির পরিবর্তে যদি আপনারা আমায় আমায় বাড়ি ফেরার ট্যাক্সি ভাড়া বাবদ এক পাউন্ড দিয়ে দেন, তাহলেই হবে।"
মা এখনও বেশ সন্দিগ্ধ হয়েই ওঁর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করলো, "তা আপনার যদি সাথে টাকা নাই থেকে থাকে, তাহলে এখানে এলেন কীভাবে?"
বৃদ্ধ তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, "হেঁটে। আমি রোজ বাড়ি থেকে হেঁটে আসি। তারপর ফেরার পথে ট্যাক্সি ধরে বাড়ি চলে যাই। এইটিই আমার অভ্যেস। সারা বছর এই এক নিয়ম চলে আমার।"
মা প্রশ্ন করলো, "তাহলে এখন হাঁটছেন না কেন?"
বৃদ্ধ আক্ষেপের সুরে উত্তর দিলেন, "যদি পারতাম... যদি হেঁটে ফিরতে পারতাম, কী ভালোই না হতো। কিন্তু আমার এই বুড়ো পায়ে আর জোর নেই। আজকের মতো অনেকটা হাঁটা হয়ে গিয়েছে। এখন ট্যাক্সি ছাড়া আমার আর গতি নেই।"
মাকে দেখলাম ঠোঁট কামড়াচ্ছে। বুঝলাম, একটু হলেও মনে হচ্ছে সামনের মানুষটার দুরবস্থা দেখে মায়ের মন গলতে শুরু করেছে। তাছাড়া এই পরিস্থিতিতে একটা ছাতা পেলে ভালোই হয়, সেই ব্যাপারটাও যে মনের মধ্যে চলছে, তা আমি জানি।
বৃদ্ধ বললেন, "ম্যাডাম, এই ছাতাটি খুবই সুন্দর।"
"সে তো দেখতেই পাচ্ছি," মা উত্তর দিল।
"সিল্কের।" কথাটি উনি যোগ করলেন। তার জবাবে মা বলল, "হ্যাঁ, লক্ষ্য করেছি।"
"তাহলে আপনি দয়া করে নিন এটি। আমি কুড়ি পাউন্ড দিয়ে কিনেছিলাম। তবে এই মুহূর্তে এর কোন মূল্য নেই আমার কাছে। এর চেয়ে ট্যাক্সি ভাড়া বাবদ এক পাউন্ড পেলে বরং আমি বাড়ি ফিরে এই বুড়ো হাড়ে একটু বিশ্রাম দিতে পারি।"
মায়ের হাতটা নিজের পার্সের দিকেই যাচ্ছিল। আমিও এবার মায়ের মতোই বেশ কড়া ভাবে তাকালাম, মায়েরই দিকে। মা ঠিক বুঝেছে আমি কী বলতে চাইছি। "শোনো মা, এইটা কিন্তু এই বয়স্ক মানুষটার অসহায়তার সুযোগে ওঁকে ঠকানো হবে। এমনটা দয়া করে তুমি করো না।" আমি মনে মনে বললাম। মা একটু থমকে আমার দিকে তাকালো, তারপর বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বলল, "শুনুন, আমার মনে হয় আমার এমন কাজ করা ঠিক হবে না। আমি আপনার এত দামী ছাতা এত কম দামে নিতে পারি না। আপনি বরং ছাতাটা আপনার কাছেই রাখুন। আমি এমনিই আপনাকে এক পাউন্ড দিচ্ছি।"
"না না, এ কখনও হতে পারে না। এ হয় না। আমি কিছুতেই এমনি এমনি টাকা নিতে পারি না আপনার থেকে। ম্যাডাম, আপনি দয়া করে ছাতাটা নিন এবং বৃষ্টির ছাট থেকে নিজেদের বাঁচান।" বৃদ্ধ বলে উঠলেন।
মা আমার দিকে তাকিয়ে বেশ একটা বিজয়িনীর হাসি হাসল। ভাবখানা এই যে, দেখ, আমি কিন্তু ঠকালাম না। উনিই নিজে যেচে দিচ্ছেন এই ছাতা, এই দামে।
মা নিজের পার্স থেকে এক পাউন্ডের একটি নোট বের করে ভদ্রলোকটিকে দিল। উনি সেটি সযত্নে পকেটস্থ করে মাকে ছাতাটি ধরিয়ে সম্মান দেখিয়ে টুপি খুলে সামান্য ঝুঁকে "ধন্যবাদ ম্যাডাম" বলে চলে গেলেন।
মা আমায় ছাতার নীচে টেনে নিয়ে বলল, "আয়, ছাতার নীচে আয়। ভিজিস না। দেখেছিস কী সুন্দর সিল্কের ছাতা। এমনটা আমি কোনদিনও কিনতেই পারতাম না।"
আমি প্রশ্ন করলাম, "তাহলে তুমি শুরুতে অমন খারাপ ব্যবহার করছিলে কেন?"
মা উত্তর দিল, "আসলে আমি যাচাই করে নিতে চাইছিলাম। ঠগবাজ না তো? তারপর বুঝলাম যে না, উনি নিপাট ভদ্রলোক।"
"হ্যাঁ মা।"
"যারপরনাই ভদ্র। এবং অর্থবানও। নইলে ওই রকম সিল্কের ছাতা তো যে সে ব্যবহার করে না। উনি কোন উপাধি প্রাপ্ত মানুষ হলেও আমি অবাক হবো না। স্যর হ্যারি গোল্ডসওয়ারদি বা ওই জাতীয় কিছু।"
"হুম।"
"শোন, আজকের ঘটনাটি তোর কাছে একটি শিক্ষনীয় ঘটনা কিন্তু। কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে কখনও তাড়াহুড়ো করবি না। ধীরেসুস্থে বিচার করবি। তাহলে দেখবি, ভুল কম হবে।"
"ওই দেখো মা, ওই যে লোকটা যাচ্ছে।" আমি বলে উঠলাম।
"কোথায়?" মা জিজ্ঞেস করলো।
আমি আঙ্গুল দিয়ে এক দিকে নির্দেশ করে বললাম, "ওই যে। ওইদিকে। দেখো। কী তাড়ায় হাঁটছেন।"
আমরা দেখলাম লোকটিকে। টুকটুক করে ট্র্যাফিক বাঁচিয়ে রাস্তা পেরিয়ে গেলেন। রাস্তার অপর প্রান্তে পৌঁছে বাঁদিক ধরে হাঁটা লাগালেন। বেশ দ্রুত গতিতেই।
"দেখে তো মনে হচ্ছে না পায়ে ব্যথা," আমি মন্তব্য করলাম। মা কিছু বলল না। "এমন কী, ট্যাক্সি ধরতেও যাচ্ছে বলে মনে হলো না।" আমি আরো বলে গেলাম। মা চুপচাপ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিল লোকটিকে। লোকটি বেশ দ্রুত গতিতে দুই হাত দুলিয়ে বাকি পদচারীদের পাশ কাটিয়ে এগোচ্ছিলেন।
মায়ের মুখটা এখন পাথরের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছে। "লোকটার নির্ঘাৎ কোন মতলব আছে। ব্যাপারটা ঠিক লাগছে না।" মা বলল।
"কীরকম?" আমি জিজ্ঞেস করলাম।
মা বিরক্ত হয়ে বলল, "সে আমি জানি না। কিন্তু কিছু একটা ব্যাপার আছেই। আমরা সেটা এবার জানবো।" এই বলে মা আমার হাত ধরে রাস্তা পার হয়ে বাঁদিকে হাঁটা লাগালো।
"ওঁকে দেখতে পাচ্ছিস?" মা আমায় জিজ্ঞেস করলো।
"হ্যাঁ, ওই তো। সামনের রাস্তাটা থেকে ডানদিকে হাঁটছেন।" আমি বললাম।
আমরা ওঁর পিছু নিলাম। রাস্তার মোড়ে এসে আমরাও ডানদিকে গেলাম। বৃদ্ধ লোকটি ক্ষিপ্র গতিতে হেঁটে চলেছেন। আমাদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছিল ওঁর সাথে তাল রাখতে। এদিকে জোরে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। দেখলাম, লোকটির টুপি গড়িয়ে জল পড়ছে। অবশ্য আমাদের মাথায় তখন সিল্কের ছাতা। আমরা বৃষ্টিতে মোটেই কাবু নই।
"বুঝছি না, ওঁর মতলবটা কী?" মা বলল।
আমি ভয় পেয়ে বললাম, "মা, উনি যদি পিছন ফেরেন তাহলে তো আমাদের দেখতে পেয়ে যাবেন?"
"তাতে কিছু যায় আসে না। মিথ্যুক লোক। আমাদের বললেন নাকি হাঁটতে পারছেন না। তিনি নাকি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। এদিকে দেখ, কী জোরে হেঁটে চলেছেন সমানে। ঠগবাজ। প্রতারক।" মা রাগতস্বরে বলল।
"তার মানে উনি কোন উপাধিপ্রাপ্ত বড় মানুষ নন?"
"চুপ চুপ, একদম চুপ।" বলে মা আমায় থামিয়ে দিল।
সামনের মোড়ে পৌঁছে লোকটি ডানদিকে গেলেন, তারপর আবার বাঁদিক। তারপর আবারও ডানদিক।
"আমি ছাড়ছি না ব্যাটাকে", মা বলল।
"একী, লোকটাকে তো আর দেখতে পাচ্ছি না। গেলো কোথায়?" আমি প্রশ্ন করলাম।
"ওই তো, ওই দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখলাম।" মা বলল। "সেকী, এ যে দেখি এক পানশালা", মা উত্তেজিত স্বরে বলল।
পানশালাই বটে। বড় বড় হরফে লেখা "দ্য রেড লায়ন পাব"।
"তুমি তা বলে নিশ্চয়ই ভিতরে যাবে না মা?" আমি জিজ্ঞেস করলাম মা কে।
"না, অবশ্যই না। কিন্তু আমরা বাইরে থেকে দেখবো লোকটা কী করে।" মা জানালো।
পানশালাটির জানলাগুলি বেশ বড় বড়। কাঁচের তৈরি। যদিও ভিতরটা বেশ ধোঁয়াটে, তবুও কাঁচ ঘেঁষে দাঁড়ালে দেখা যাচ্ছে ভিতরের কার্যকলাপ।
আমি মায়ের হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। দুজনেই একে অপরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা আমাদের ছাতার ওপর শব্দ করে পড়ছে। এমন সময়ে লোকটিকে ভিতরে দেখতে পেলাম। মাকে বললাম, "ওই দেখো। ওই যে।"
পানশালার অন্দরটি লোকে লোকারণ্য। সিগারেটের ধোঁওয়ায় ভরে আছে। ওই অত লোকের মধ্যে একেবারে মাঝামাঝি জায়গায় দেখলাম আমাদের বৃদ্ধ লোকটিকে। টুপি, কোট খুলে রাখা। লোকজন কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে মদ কেনার জন্য, সামনের দিকে টেবিলে। সেখানে পৌঁছে, টেবিলের ওপর দুটো হাত রেখে দিয়ে মদ বিক্রেতাকে কিছু একটা বললেন। ঠোঁট নড়া দেখলাম, অবশ্যই কথা কানে আসার কথা না। এলোও না। বিক্রেতা খানিকক্ষণ অন্য পাশ ফিরে তারপর আবার লোকটির সামনে এলেন। হাতে একটি বড় গেলাস। সেটি একটি সোনালি রঙের তরলে কানায় কানায় ভর্তি।
লোকটিকে দেখলাম এক পাউন্ডের একটি নোট দিলেন মদ বিক্রেতাকে।
"হে ভগবান, ওই তো। ওই তো আমার দেওয়া নোটটা।" মা চেঁচিয়ে উঠল। "কী দুঃসাহস লোকটার"! মা আঁতকে উঠল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "গেলাসে ওটা কী মা?"
মা জানালো, "উইস্কি। এক্কেবারে নীট।"
বিক্রেতা কোন পয়সা ফেরত দিলেন না।
"তার মানে ওটি ট্রেবল উইস্কি," মা বলল।
আমি কৌতূহলী প্রশ্ন করলাম, "মানে কী?"
মা বলল, "সাধারণের চেয়ে তিনগুণ বেশি মাপ।"
লোকটিকে দেখলাম গেলাসটা ঠোঁটের কাছে আনলেন। তারপর ঘাড় কাত করে ঢক ঢক করে পুরোটা এক নিমেষে শেষ করে দিলেন।
আমি অবাক হয়ে মন্তব্য করলাম, 'বাপরে, বেশ দামী পানীয় বলতে হয়!"
"জঘন্য। এক পাউন্ড দিয়ে কেনা পানীয় এক ঢোকে শেষ করে দেয়। কী অবস্থা!" মা রাগে গরগর করছে তখন।
আমি মাকে শান্ত করতে বললাম, "দেখো এক পাউন্ড তো নয়। উনি ওঁর সিল্কের ছাতাটিও খরচ করেছেন। কুড়ি পাউন্ডের। নেহাত সস্তা না।"
"হুম। পাগল মানুষ!" মা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল।
লোকটিকে দেখলাম টেবিলের ধারে এখনও দাঁড়িয়ে। চোখে মুখে অদ্ভুত এক আনন্দ। মুখের গোলাপি চামড়া থেকে যেন সোনালী তরলের আভা ঠিকরে বেরোচ্ছে। জিভ বের করে গোঁফ চাটছেন, যদি শেষ কোন ফোঁটার স্বাদ খুঁজে পান।
তারপর দেখলাম ধীর গতিতে ভিড় কাটিয়ে উনি বেরনোর চেষ্টা করছেন। যথাস্থান থেকে নিজের হ্যাট আর কোট বের করে দুইই পরে নিলেন। তারপর কোট র্যাক থেকে অজস্র ভিজে ছাতার ভিড়ের মধ্যে থেকে অত্যন্ত সাবলীল ও স্বছন্দভাবে একটি ছাতা তুলে বেরিয়ে গেলেন, এমন ভাব যেন নিজেরটাই নিলেন।
মা চিৎকার করে উঠল, "দেখলি? দেখলি তুই লোকটার কাণ্ড?"
"আস্তে, দরজার কাছেই আছে।" আমি সাবধান করলাম মাকে।
আমরা নিচু হলাম। ছাতার সাহায্যে নিজেদের মুখ ঢাকলাম। তবে তার অবশ্য দরকার পড়ত না। আমাদের দিকে একবারের জন্যও না তাকিয়ে লোকটি যেদিক দিয়ে এসেছিলেন, সেইদিকেই হাঁটা লাগালেন।
"এই হল তার মানে ব্যাপার!" মা বলল।
"বেশ চৌখস বলতে হয়," আমি মন্তব্য করলাম।
আমরা আবার ওঁর পিছু নিলাম। একই রাস্তা দিয়েই তিনি চলতে লাগলেন। পরবর্তী শিকারের উদ্দেশ্যে। দেখলাম এবারের শিকার এক শীর্ণকায় ব্যক্তি। পরনে হ্যাট বা কোট কিছুই নেই। তার থেকে আবার এক পাউন্ড আদায় করে বৃদ্ধ এবার উল্টোদিকে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলেন।
"দেখলি? কী ধূর্ত। একই পানশালায় কখনও দু'বার যাবে না!" মা বলল।
"যা বুঝছি, সারারাত এরকম করেই যেতে পারেন!" আমি বললাম।
মা উত্তর দিল, "অবশ্যই! তবে এমন বৃষ্টির দিনের জন্য ওঁকে প্রচুর প্রার্থনা করতে হয় বলতে হবে। রোজ রোজ তো তা বলে এরকম সুবর্ণ সুযোগ আসবে না!"
গতকাল দুপুরে মা আমায় লন্ডনে নিয়ে গিয়েছিল, দাঁতের ডাক্তার দেখাতে। ডাক্তারটি আমার মাড়ির দাঁতে পেলেন একটি গর্ত। মোটামুটি ব্যথা না দিয়েই তিনি সেই গর্তটি বুজিয়েও দিলেন। তারপর আমি আর মা একটি ক্যাফেতে গেলাম। ওখানে আমি একটি ফলের আইসক্রিম অর্ডার দিলাম। মা নিলো এক কাপ কফি। আমাদের খাওয়াদাওয়া শেষ হতে হতে ছ'টা বেজে গেল।
ক্যাফে থেকে বেরিয়ে দেখলাম ভালো জোরে বৃষ্টি পড়ছে। আমাদের গায়ে ছিল সাধারণ কোট আর মাথায় হ্যাট। সেই বৃষ্টিতে অবশ্যই ভিজে যাবো। মা বলল, "একটা ট্যাক্সি নিতেই হবে।"
আমি বললাম, "চলো না, খানিক্ষণ অপেক্ষা করি ক্যাফেতে বসে।" কী করব, আমার মন যে তখনও পড়ে আছে ক্যাফের ওই সুস্বাদু আইসক্রিমে।
"উহু, এই বৃষ্টি শিফফিরি থামবার নয়। আমাদের তো বাড়ি ফিরতে হবে," মা বলল।
আমরা ফুটপাথের ধারে এসে দাঁড়ালাম ট্যাক্সির অপেক্ষায়। রাস্তা দিয়ে অনেক ট্যাক্সি গেলো বটে। তবে সবই যাত্রী বোঝাই। সেসব দেখতে দেখতে মা আক্ষেপের সুরে এক সময়ে বলল, "ইশ, আমাদের যদি একটা গাড়ি থাকত... আর সাথে একটা ড্রাইভার..."
এমন সময় এক বৃদ্ধ ব্যক্তি আমাদের সামনে এলেন। ছোটখাটো চেহারা, সত্তরের ওপর বয়স। মাথার টুপিটা সসম্মানে একটু উঁচু করে মায়ের দিকে মেলে বললেন, " এক্সকিউজ মি..." ভদ্রলোকের দিকে এবারে ভালো করে চেয়ে দেখলাম। মুখের গোলাপী চামড়া কুঁচকে আছে। মোটা সাদা ভুরু আর পাকা গোঁফ। হাতে একটি বড় ছাতা, তাই দিয়ে নিজের মাথা ঢেকে দাঁড়িয়ে আছেন।
মা প্রায় ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল, "বলুন?"
"একটা ছোট্ট সাহায্য লাগতো। নিতান্তই ছোট্ট। বলতে পারি?" উনি কিঞ্চিত ইতস্তত করে বললেন।
আমি মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম, মা বেশ সন্দেহজনক দৃষ্টিতে ভদ্রলোকটিকে নিরীক্ষণ করছে। আমার মা খুবই সন্দেহপ্রবণ। বিশেষ করে অপরিচিত লোক এবং সিদ্ধ ডিম, এই দুইয়ের ওপর মায়ের প্রবল অবিশ্বাস। ডিম সিদ্ধর খোলা একটু ফাটিয়ে চামচ দিয়ে এমনভাবে নাড়াঘাঁটা করে, যেন মনে হবে এই বুঝি ভিতর থেকে কোন ইঁদুর বেরিয়ে এলো। আর অপরিচিত লোকজন নিয়ে তো মায়ের আবার একখানি জম্পেশ নিয়ম আছে। "যত বেশি ভালো মনে হবে ব্যক্তিটিকে, তাকে তত বেশি সন্দেহ করবে।" এই ক্ষেত্রে ভদ্রলোকটি অত্যন্ত ভালোমানুষ গোছেরই মনে হচ্ছিল আমার। ইনি যে নিপাট ভদ্রলোক, সেই ব্যাপারে আমি আরো নিশ্চিত হই ওঁর জুতোজোড়া দেখে। তার কারণ? আমার মায়ের আরো একখানি মহামূল্যবান বক্তব্য। "কোন ভদ্রলোককে চিনবার অন্যতম উপায় তার পরনের জুতো।" এবার এই বৃদ্ধের পায়ের খয়েরি জুতো জোড়া বেশ সুন্দর দেখতে। তাই তাঁর আর ভদ্রলোক হওয়া আটকায় কে?
ভদ্রলোক মাকে বলতে লাগলেন, "আসলে ব্যাপারটা হয়েছে কী, ইয়ে, মানে, একটু বিপদে পড়েছি। তাই সামান্য সাহায্য চাইছি আপনার কাছে। তেমন বেশি না। অল্পই। সেইটুকুই আমার খুব প্রয়োজন। আসলে বয়স হয়েছে তো, ভুলে যাওয়ার বাতিক আছে..."
এই অবধি শুনে আমি মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম মা থুতনি উঁচু করে, মুখচোখ গম্ভীর করে, একটা রাগী চোখ মুখ করে সোজা তাকিয়ে আছে মানুষটার দিকে। মায়ের এ হেন মূর্তি আবার বেশ ভয় উদ্রেককারী। বেশিরভাগ লোকজনই মাকে এইরকম দেখলে ভয় পেয়ে যায়। আমার মনে আছে, সেবার আমার স্কুলের হেডমিস্ট্রেস পর্যন্ত মাকে এমনভাবে দেখে রীতিমতো তোতলাতে শুরু করে দিয়েছিলেন। তবে অবাক কাণ্ড, এই ভদ্রলোকটির ওপর মায়ের চেহারার এই পরিবর্তনে কোন প্রভাবই পড়ল না। উনি দিব্যি হাসিমুখে বলতে থাকলেন, "ম্যাডাম, বিশ্বাস করুন। আমি সত্যিই বিপদে পড়েছি। তাই আপনাকে বলছি। নইলে এরকম রাস্তার মাঝখানে ভদ্রমহিলাদের দাঁড় করিয়ে কথা বলাটা মোটেই আমার স্বভাব না।"
"আশা করি!" মা বলল।
মায়ের এই আচরণে আমার খুব লজ্জা লাগছিল। ইচ্ছে হল বলি, "মা, দয়া করে ওঁকে এরকম বলো না। বয়স্ক মানুষ। কোন বিপদে পড়েই নিশ্চয়ই সাহায্য চাইছেন। দয়া করে নির্দয় হয়ো না।" কিন্তু বলতে পারলাম না।
সামনের মানুষটি ছাতাটি এবার এক হাত থেকে আরেক হাতে নিয়ে বললেন, "আসলে এমন ভুল আগে কখনও করিনি।"
মা কড়া স্বরে বলল, "কী ভুল?"
"এই যে, বেরনোর সময় আমার টাকার ব্যাগটা নিয়ে আসতে ভুলে গিয়েছি। কী বিচ্ছিরি বলুন তো?" ভদ্রলোকটি বললেন।
মা পাল্টা প্রশ্ন করলো, "ও, তার মানে আপনি টাকা চাইছেন?"
ভদ্রলোক উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, "ছি ছি, না না। তা কেন। আমি মোটেই টাকা চাইছি না।"
"তাহলে? কী চাই? তাড়াতাড়ি বলুন। আমরা এখানে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি।" মা অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
"হ্যাঁ, জানি তো আপনারা ভিজছেন। দেখতে পাচ্ছি। আর তাই আমি আপনাদের এই ছাতাটি দিতে চাইছি, আপনারা যাতে না ভেজেন। তবে..." ভদ্রলোক বললেন।
"তবে কী?" মা জিজ্ঞেস করলো।
" সাথে টাকা নেই। আর তাই এই ছাতাটির পরিবর্তে যদি আপনারা আমায় আমায় বাড়ি ফেরার ট্যাক্সি ভাড়া বাবদ এক পাউন্ড দিয়ে দেন, তাহলেই হবে।"
মা এখনও বেশ সন্দিগ্ধ হয়েই ওঁর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করলো, "তা আপনার যদি সাথে টাকা নাই থেকে থাকে, তাহলে এখানে এলেন কীভাবে?"
বৃদ্ধ তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, "হেঁটে। আমি রোজ বাড়ি থেকে হেঁটে আসি। তারপর ফেরার পথে ট্যাক্সি ধরে বাড়ি চলে যাই। এইটিই আমার অভ্যেস। সারা বছর এই এক নিয়ম চলে আমার।"
মা প্রশ্ন করলো, "তাহলে এখন হাঁটছেন না কেন?"
বৃদ্ধ আক্ষেপের সুরে উত্তর দিলেন, "যদি পারতাম... যদি হেঁটে ফিরতে পারতাম, কী ভালোই না হতো। কিন্তু আমার এই বুড়ো পায়ে আর জোর নেই। আজকের মতো অনেকটা হাঁটা হয়ে গিয়েছে। এখন ট্যাক্সি ছাড়া আমার আর গতি নেই।"
মাকে দেখলাম ঠোঁট কামড়াচ্ছে। বুঝলাম, একটু হলেও মনে হচ্ছে সামনের মানুষটার দুরবস্থা দেখে মায়ের মন গলতে শুরু করেছে। তাছাড়া এই পরিস্থিতিতে একটা ছাতা পেলে ভালোই হয়, সেই ব্যাপারটাও যে মনের মধ্যে চলছে, তা আমি জানি।
বৃদ্ধ বললেন, "ম্যাডাম, এই ছাতাটি খুবই সুন্দর।"
"সে তো দেখতেই পাচ্ছি," মা উত্তর দিল।
"সিল্কের।" কথাটি উনি যোগ করলেন। তার জবাবে মা বলল, "হ্যাঁ, লক্ষ্য করেছি।"
"তাহলে আপনি দয়া করে নিন এটি। আমি কুড়ি পাউন্ড দিয়ে কিনেছিলাম। তবে এই মুহূর্তে এর কোন মূল্য নেই আমার কাছে। এর চেয়ে ট্যাক্সি ভাড়া বাবদ এক পাউন্ড পেলে বরং আমি বাড়ি ফিরে এই বুড়ো হাড়ে একটু বিশ্রাম দিতে পারি।"
মায়ের হাতটা নিজের পার্সের দিকেই যাচ্ছিল। আমিও এবার মায়ের মতোই বেশ কড়া ভাবে তাকালাম, মায়েরই দিকে। মা ঠিক বুঝেছে আমি কী বলতে চাইছি। "শোনো মা, এইটা কিন্তু এই বয়স্ক মানুষটার অসহায়তার সুযোগে ওঁকে ঠকানো হবে। এমনটা দয়া করে তুমি করো না।" আমি মনে মনে বললাম। মা একটু থমকে আমার দিকে তাকালো, তারপর বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বলল, "শুনুন, আমার মনে হয় আমার এমন কাজ করা ঠিক হবে না। আমি আপনার এত দামী ছাতা এত কম দামে নিতে পারি না। আপনি বরং ছাতাটা আপনার কাছেই রাখুন। আমি এমনিই আপনাকে এক পাউন্ড দিচ্ছি।"
"না না, এ কখনও হতে পারে না। এ হয় না। আমি কিছুতেই এমনি এমনি টাকা নিতে পারি না আপনার থেকে। ম্যাডাম, আপনি দয়া করে ছাতাটা নিন এবং বৃষ্টির ছাট থেকে নিজেদের বাঁচান।" বৃদ্ধ বলে উঠলেন।
মা আমার দিকে তাকিয়ে বেশ একটা বিজয়িনীর হাসি হাসল। ভাবখানা এই যে, দেখ, আমি কিন্তু ঠকালাম না। উনিই নিজে যেচে দিচ্ছেন এই ছাতা, এই দামে।
মা নিজের পার্স থেকে এক পাউন্ডের একটি নোট বের করে ভদ্রলোকটিকে দিল। উনি সেটি সযত্নে পকেটস্থ করে মাকে ছাতাটি ধরিয়ে সম্মান দেখিয়ে টুপি খুলে সামান্য ঝুঁকে "ধন্যবাদ ম্যাডাম" বলে চলে গেলেন।
মা আমায় ছাতার নীচে টেনে নিয়ে বলল, "আয়, ছাতার নীচে আয়। ভিজিস না। দেখেছিস কী সুন্দর সিল্কের ছাতা। এমনটা আমি কোনদিনও কিনতেই পারতাম না।"
আমি প্রশ্ন করলাম, "তাহলে তুমি শুরুতে অমন খারাপ ব্যবহার করছিলে কেন?"
মা উত্তর দিল, "আসলে আমি যাচাই করে নিতে চাইছিলাম। ঠগবাজ না তো? তারপর বুঝলাম যে না, উনি নিপাট ভদ্রলোক।"
"হ্যাঁ মা।"
"যারপরনাই ভদ্র। এবং অর্থবানও। নইলে ওই রকম সিল্কের ছাতা তো যে সে ব্যবহার করে না। উনি কোন উপাধি প্রাপ্ত মানুষ হলেও আমি অবাক হবো না। স্যর হ্যারি গোল্ডসওয়ারদি বা ওই জাতীয় কিছু।"
"হুম।"
"শোন, আজকের ঘটনাটি তোর কাছে একটি শিক্ষনীয় ঘটনা কিন্তু। কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে কখনও তাড়াহুড়ো করবি না। ধীরেসুস্থে বিচার করবি। তাহলে দেখবি, ভুল কম হবে।"
"ওই দেখো মা, ওই যে লোকটা যাচ্ছে।" আমি বলে উঠলাম।
"কোথায়?" মা জিজ্ঞেস করলো।
আমি আঙ্গুল দিয়ে এক দিকে নির্দেশ করে বললাম, "ওই যে। ওইদিকে। দেখো। কী তাড়ায় হাঁটছেন।"
আমরা দেখলাম লোকটিকে। টুকটুক করে ট্র্যাফিক বাঁচিয়ে রাস্তা পেরিয়ে গেলেন। রাস্তার অপর প্রান্তে পৌঁছে বাঁদিক ধরে হাঁটা লাগালেন। বেশ দ্রুত গতিতেই।
"দেখে তো মনে হচ্ছে না পায়ে ব্যথা," আমি মন্তব্য করলাম। মা কিছু বলল না। "এমন কী, ট্যাক্সি ধরতেও যাচ্ছে বলে মনে হলো না।" আমি আরো বলে গেলাম। মা চুপচাপ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিল লোকটিকে। লোকটি বেশ দ্রুত গতিতে দুই হাত দুলিয়ে বাকি পদচারীদের পাশ কাটিয়ে এগোচ্ছিলেন।
মায়ের মুখটা এখন পাথরের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছে। "লোকটার নির্ঘাৎ কোন মতলব আছে। ব্যাপারটা ঠিক লাগছে না।" মা বলল।
"কীরকম?" আমি জিজ্ঞেস করলাম।
মা বিরক্ত হয়ে বলল, "সে আমি জানি না। কিন্তু কিছু একটা ব্যাপার আছেই। আমরা সেটা এবার জানবো।" এই বলে মা আমার হাত ধরে রাস্তা পার হয়ে বাঁদিকে হাঁটা লাগালো।
"ওঁকে দেখতে পাচ্ছিস?" মা আমায় জিজ্ঞেস করলো।
"হ্যাঁ, ওই তো। সামনের রাস্তাটা থেকে ডানদিকে হাঁটছেন।" আমি বললাম।
আমরা ওঁর পিছু নিলাম। রাস্তার মোড়ে এসে আমরাও ডানদিকে গেলাম। বৃদ্ধ লোকটি ক্ষিপ্র গতিতে হেঁটে চলেছেন। আমাদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছিল ওঁর সাথে তাল রাখতে। এদিকে জোরে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। দেখলাম, লোকটির টুপি গড়িয়ে জল পড়ছে। অবশ্য আমাদের মাথায় তখন সিল্কের ছাতা। আমরা বৃষ্টিতে মোটেই কাবু নই।
"বুঝছি না, ওঁর মতলবটা কী?" মা বলল।
আমি ভয় পেয়ে বললাম, "মা, উনি যদি পিছন ফেরেন তাহলে তো আমাদের দেখতে পেয়ে যাবেন?"
"তাতে কিছু যায় আসে না। মিথ্যুক লোক। আমাদের বললেন নাকি হাঁটতে পারছেন না। তিনি নাকি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। এদিকে দেখ, কী জোরে হেঁটে চলেছেন সমানে। ঠগবাজ। প্রতারক।" মা রাগতস্বরে বলল।
"তার মানে উনি কোন উপাধিপ্রাপ্ত বড় মানুষ নন?"
"চুপ চুপ, একদম চুপ।" বলে মা আমায় থামিয়ে দিল।
সামনের মোড়ে পৌঁছে লোকটি ডানদিকে গেলেন, তারপর আবার বাঁদিক। তারপর আবারও ডানদিক।
"আমি ছাড়ছি না ব্যাটাকে", মা বলল।
"একী, লোকটাকে তো আর দেখতে পাচ্ছি না। গেলো কোথায়?" আমি প্রশ্ন করলাম।
"ওই তো, ওই দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখলাম।" মা বলল। "সেকী, এ যে দেখি এক পানশালা", মা উত্তেজিত স্বরে বলল।
পানশালাই বটে। বড় বড় হরফে লেখা "দ্য রেড লায়ন পাব"।
"তুমি তা বলে নিশ্চয়ই ভিতরে যাবে না মা?" আমি জিজ্ঞেস করলাম মা কে।
"না, অবশ্যই না। কিন্তু আমরা বাইরে থেকে দেখবো লোকটা কী করে।" মা জানালো।
পানশালাটির জানলাগুলি বেশ বড় বড়। কাঁচের তৈরি। যদিও ভিতরটা বেশ ধোঁয়াটে, তবুও কাঁচ ঘেঁষে দাঁড়ালে দেখা যাচ্ছে ভিতরের কার্যকলাপ।
আমি মায়ের হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। দুজনেই একে অপরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা আমাদের ছাতার ওপর শব্দ করে পড়ছে। এমন সময়ে লোকটিকে ভিতরে দেখতে পেলাম। মাকে বললাম, "ওই দেখো। ওই যে।"
পানশালার অন্দরটি লোকে লোকারণ্য। সিগারেটের ধোঁওয়ায় ভরে আছে। ওই অত লোকের মধ্যে একেবারে মাঝামাঝি জায়গায় দেখলাম আমাদের বৃদ্ধ লোকটিকে। টুপি, কোট খুলে রাখা। লোকজন কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে মদ কেনার জন্য, সামনের দিকে টেবিলে। সেখানে পৌঁছে, টেবিলের ওপর দুটো হাত রেখে দিয়ে মদ বিক্রেতাকে কিছু একটা বললেন। ঠোঁট নড়া দেখলাম, অবশ্যই কথা কানে আসার কথা না। এলোও না। বিক্রেতা খানিকক্ষণ অন্য পাশ ফিরে তারপর আবার লোকটির সামনে এলেন। হাতে একটি বড় গেলাস। সেটি একটি সোনালি রঙের তরলে কানায় কানায় ভর্তি।
লোকটিকে দেখলাম এক পাউন্ডের একটি নোট দিলেন মদ বিক্রেতাকে।
"হে ভগবান, ওই তো। ওই তো আমার দেওয়া নোটটা।" মা চেঁচিয়ে উঠল। "কী দুঃসাহস লোকটার"! মা আঁতকে উঠল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "গেলাসে ওটা কী মা?"
মা জানালো, "উইস্কি। এক্কেবারে নীট।"
বিক্রেতা কোন পয়সা ফেরত দিলেন না।
"তার মানে ওটি ট্রেবল উইস্কি," মা বলল।
আমি কৌতূহলী প্রশ্ন করলাম, "মানে কী?"
মা বলল, "সাধারণের চেয়ে তিনগুণ বেশি মাপ।"
লোকটিকে দেখলাম গেলাসটা ঠোঁটের কাছে আনলেন। তারপর ঘাড় কাত করে ঢক ঢক করে পুরোটা এক নিমেষে শেষ করে দিলেন।
আমি অবাক হয়ে মন্তব্য করলাম, 'বাপরে, বেশ দামী পানীয় বলতে হয়!"
"জঘন্য। এক পাউন্ড দিয়ে কেনা পানীয় এক ঢোকে শেষ করে দেয়। কী অবস্থা!" মা রাগে গরগর করছে তখন।
আমি মাকে শান্ত করতে বললাম, "দেখো এক পাউন্ড তো নয়। উনি ওঁর সিল্কের ছাতাটিও খরচ করেছেন। কুড়ি পাউন্ডের। নেহাত সস্তা না।"
"হুম। পাগল মানুষ!" মা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল।
লোকটিকে দেখলাম টেবিলের ধারে এখনও দাঁড়িয়ে। চোখে মুখে অদ্ভুত এক আনন্দ। মুখের গোলাপি চামড়া থেকে যেন সোনালী তরলের আভা ঠিকরে বেরোচ্ছে। জিভ বের করে গোঁফ চাটছেন, যদি শেষ কোন ফোঁটার স্বাদ খুঁজে পান।
তারপর দেখলাম ধীর গতিতে ভিড় কাটিয়ে উনি বেরনোর চেষ্টা করছেন। যথাস্থান থেকে নিজের হ্যাট আর কোট বের করে দুইই পরে নিলেন। তারপর কোট র্যাক থেকে অজস্র ভিজে ছাতার ভিড়ের মধ্যে থেকে অত্যন্ত সাবলীল ও স্বছন্দভাবে একটি ছাতা তুলে বেরিয়ে গেলেন, এমন ভাব যেন নিজেরটাই নিলেন।
মা চিৎকার করে উঠল, "দেখলি? দেখলি তুই লোকটার কাণ্ড?"
"আস্তে, দরজার কাছেই আছে।" আমি সাবধান করলাম মাকে।
আমরা নিচু হলাম। ছাতার সাহায্যে নিজেদের মুখ ঢাকলাম। তবে তার অবশ্য দরকার পড়ত না। আমাদের দিকে একবারের জন্যও না তাকিয়ে লোকটি যেদিক দিয়ে এসেছিলেন, সেইদিকেই হাঁটা লাগালেন।
"এই হল তার মানে ব্যাপার!" মা বলল।
"বেশ চৌখস বলতে হয়," আমি মন্তব্য করলাম।
আমরা আবার ওঁর পিছু নিলাম। একই রাস্তা দিয়েই তিনি চলতে লাগলেন। পরবর্তী শিকারের উদ্দেশ্যে। দেখলাম এবারের শিকার এক শীর্ণকায় ব্যক্তি। পরনে হ্যাট বা কোট কিছুই নেই। তার থেকে আবার এক পাউন্ড আদায় করে বৃদ্ধ এবার উল্টোদিকে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলেন।
"দেখলি? কী ধূর্ত। একই পানশালায় কখনও দু'বার যাবে না!" মা বলল।
"যা বুঝছি, সারারাত এরকম করেই যেতে পারেন!" আমি বললাম।
মা উত্তর দিল, "অবশ্যই! তবে এমন বৃষ্টির দিনের জন্য ওঁকে প্রচুর প্রার্থনা করতে হয় বলতে হবে। রোজ রোজ তো তা বলে এরকম সুবর্ণ সুযোগ আসবে না!"
জলের সন্ধানে
রাত্রে শোওয়ার আগে ফ্লাস্কে গরম জল ভরে রাখছি ইদানীং। যাতে পরেরদিন সকালে উষ্ণ জল দিয়ে দিন শুরু করতে পারি, গলাটার যা অবস্থা, তাই। গতকাল রাত্রে, ওই ধরুন সাড়ে এগারোটার দিকে অভ্যেসমতোই তাই ফ্লাস্কটি হাতে নিয়ে হোস্টেলের অন্য উইঙে যেখানে জলের ডিস্পেন্সার আছে, সেদিকে গিয়েছি। দেখলাম অবধারিতভাবেই জলের ক্যান শেষ। এবার কী করি?
লিফট ডাকলাম। সাত তলায় গেলাম। দেখলাম ওখানেও জল শেষ। নীচেই নামি। আর কীই বা করব। লিফটটা অনেক ফ্লোরেই থামতে থামতে আসছিল। এক দুজন করে উঠছে, নামছে। পাঁচতলায় লিফটটা যখন ছাড়ল, মোবাইল থেকে চোখ তুলে দেখলাম একটা মেয়ে, হাল্কা সবুজ ম্যাক্সি পরা, চুলে তেল মেখে টানটান করে আঁচড়ানো, হাতে ওরও একটা ফ্লাস্ক। আমায় দেখে হাসল। আমিও হাসলাম।
ইংরেজিতে আমায় বলল, "গরম জল খুঁজছ?"
আমি বললাম, "হ্যাঁ। দেখো না তখন থেকে ওপর নীচ করছি। কোন ফ্লোরে পাচ্ছিনা। কী বিরক্তিকর বলো তো।"
মেয়েটি বলল, "ফার্স্ট ফ্লোরে যাও, পেয়ে যাবে। আমি এই এক্ষুণি নিয়েছি।"
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, "না মানে ফার্স্ট ফ্লোরে আমি ঠিক যাই না।"
মেয়েটি কৌতুকভরে আমায় প্রশ্ন করলো, "কেন? ফার্স্ট ফ্লোর কী দোষ করলো?"
আমি বললাম, "আসলে দু মাস আগে হোস্টেলে যে সুইসাইড কেসটা হলো না? শুনেছি নাকি মেয়েটার ঘর ওই জলের ডিস্পেন্সারের ঠিক গায়েই ছিল। তাই এই রাত্তিরবেলা আর কী ওইদিকে যেতে কেমন গা ছমছম করে।"
মেয়েটা এবার একটু গম্ভীর হয়ে বলল, "এই দেখো, লিফট ফার্স্ট ফ্লোরেই থেমেছে। একা একা যেতে ভয় করবে। বুঝতে পারি। এখন তুমি চলো আমার সাথে। আমি তো আছি। ভয়টা কাটাতে হবে তো।"
আমি ভেবে দেখলাম, প্রস্তাব মন্দ না। দুজনে মিলে যাওয়াই যায়। তাছাড়া এত মেয়ে এই ফ্লোরে রোজ থাকছে। তারা পারলে আমারও এমন ভয় পাওয়া অনৈতিক। মেয়েটি লিফট আটকে দাঁড়িয়েছিল। লিফট এবার বিপ বিপ শব্দ শুরু করলো। ও একটু অধৈর্য হয়ে আমায় বলল, "কী? আসবে নাকি আসবে না? আমি দাঁড়াবো?"
আমি তাড়াহুড়ো করে বেরোলাম ওর সাথে। ওর পিছন পিছন চলেছি। কোন ডিপার্টমেন্ট, পি এইচ ডি নাকি এম এস এইসব জিজ্ঞেস করতে করতে ডিস্পেন্সারের কাছে পৌঁছেছি। আমায় বলল, "নাও, জল ভরে নাও। আমি আছি।"
আমার ফ্লাস্কটা নেহাতই ছোট। জল ভরতে বেশি সময় লাগে না। জল ভরা হয়ে গেলে ফ্লাস্কের ঢাকনা লাগিয়ে পিছন ফিরে দেখি আধো অন্ধকার শুনশান লম্বা করিডরটা ফাঁকা। ওইদিকটা তো ডেড এন্ড। আর ধারেকাছের সবকটা ঘরে তালা ঝুলছে। তাহলে? তাহলে মেয়েটা কোথায় গেল? ভোজবাজি নাকি?
হঠাৎ মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। আমি পড়ি কি মরি ছুট লাগালাম লিফটের দিকে। লিফট তখন সাত তলায়। আমি পাগলের মতো ওপর নীচের বোতাম টিপে চলেছি ক্রমাগত। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। লিফটা প্রতিটা ফ্লোরে থামতে থামতে যতক্ষণে দোতলায় এসে পৌঁছল, ওই দুই তিন মিনিটে আমি প্রায় কোলাপ্স করবো, এমন অবস্থা। লিফট ফাঁকা। কোনভাবে হাঁপাতে হাঁপাতে তিন টিপে দিয়েছি। বিড়বিড় করে ঠাকুরকে ডাকছি। চোখ বন্ধ। "থার্ড ফ্লোর" অ্যানাউন্সমেন্ট শুনে আমি স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বেরোলাম। লিফটের দরজা আস্তে আস্তে বন্ধ হতে লাগল। পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে লিফটের ভিতরের বড় আয়নাটায় একবার চোখ পড়ে গেল। দেখলাম একটা আবছা ছায়া। হাল্কা সবুজ ম্যাক্সি পরা একটি মেয়ের।
লিফট ডাকলাম। সাত তলায় গেলাম। দেখলাম ওখানেও জল শেষ। নীচেই নামি। আর কীই বা করব। লিফটটা অনেক ফ্লোরেই থামতে থামতে আসছিল। এক দুজন করে উঠছে, নামছে। পাঁচতলায় লিফটটা যখন ছাড়ল, মোবাইল থেকে চোখ তুলে দেখলাম একটা মেয়ে, হাল্কা সবুজ ম্যাক্সি পরা, চুলে তেল মেখে টানটান করে আঁচড়ানো, হাতে ওরও একটা ফ্লাস্ক। আমায় দেখে হাসল। আমিও হাসলাম।
ইংরেজিতে আমায় বলল, "গরম জল খুঁজছ?"
আমি বললাম, "হ্যাঁ। দেখো না তখন থেকে ওপর নীচ করছি। কোন ফ্লোরে পাচ্ছিনা। কী বিরক্তিকর বলো তো।"
মেয়েটি বলল, "ফার্স্ট ফ্লোরে যাও, পেয়ে যাবে। আমি এই এক্ষুণি নিয়েছি।"
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, "না মানে ফার্স্ট ফ্লোরে আমি ঠিক যাই না।"
মেয়েটি কৌতুকভরে আমায় প্রশ্ন করলো, "কেন? ফার্স্ট ফ্লোর কী দোষ করলো?"
আমি বললাম, "আসলে দু মাস আগে হোস্টেলে যে সুইসাইড কেসটা হলো না? শুনেছি নাকি মেয়েটার ঘর ওই জলের ডিস্পেন্সারের ঠিক গায়েই ছিল। তাই এই রাত্তিরবেলা আর কী ওইদিকে যেতে কেমন গা ছমছম করে।"
মেয়েটা এবার একটু গম্ভীর হয়ে বলল, "এই দেখো, লিফট ফার্স্ট ফ্লোরেই থেমেছে। একা একা যেতে ভয় করবে। বুঝতে পারি। এখন তুমি চলো আমার সাথে। আমি তো আছি। ভয়টা কাটাতে হবে তো।"
আমি ভেবে দেখলাম, প্রস্তাব মন্দ না। দুজনে মিলে যাওয়াই যায়। তাছাড়া এত মেয়ে এই ফ্লোরে রোজ থাকছে। তারা পারলে আমারও এমন ভয় পাওয়া অনৈতিক। মেয়েটি লিফট আটকে দাঁড়িয়েছিল। লিফট এবার বিপ বিপ শব্দ শুরু করলো। ও একটু অধৈর্য হয়ে আমায় বলল, "কী? আসবে নাকি আসবে না? আমি দাঁড়াবো?"
আমি তাড়াহুড়ো করে বেরোলাম ওর সাথে। ওর পিছন পিছন চলেছি। কোন ডিপার্টমেন্ট, পি এইচ ডি নাকি এম এস এইসব জিজ্ঞেস করতে করতে ডিস্পেন্সারের কাছে পৌঁছেছি। আমায় বলল, "নাও, জল ভরে নাও। আমি আছি।"
আমার ফ্লাস্কটা নেহাতই ছোট। জল ভরতে বেশি সময় লাগে না। জল ভরা হয়ে গেলে ফ্লাস্কের ঢাকনা লাগিয়ে পিছন ফিরে দেখি আধো অন্ধকার শুনশান লম্বা করিডরটা ফাঁকা। ওইদিকটা তো ডেড এন্ড। আর ধারেকাছের সবকটা ঘরে তালা ঝুলছে। তাহলে? তাহলে মেয়েটা কোথায় গেল? ভোজবাজি নাকি?
হঠাৎ মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। আমি পড়ি কি মরি ছুট লাগালাম লিফটের দিকে। লিফট তখন সাত তলায়। আমি পাগলের মতো ওপর নীচের বোতাম টিপে চলেছি ক্রমাগত। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। লিফটা প্রতিটা ফ্লোরে থামতে থামতে যতক্ষণে দোতলায় এসে পৌঁছল, ওই দুই তিন মিনিটে আমি প্রায় কোলাপ্স করবো, এমন অবস্থা। লিফট ফাঁকা। কোনভাবে হাঁপাতে হাঁপাতে তিন টিপে দিয়েছি। বিড়বিড় করে ঠাকুরকে ডাকছি। চোখ বন্ধ। "থার্ড ফ্লোর" অ্যানাউন্সমেন্ট শুনে আমি স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বেরোলাম। লিফটের দরজা আস্তে আস্তে বন্ধ হতে লাগল। পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে লিফটের ভিতরের বড় আয়নাটায় একবার চোখ পড়ে গেল। দেখলাম একটা আবছা ছায়া। হাল্কা সবুজ ম্যাক্সি পরা একটি মেয়ের।
Saturday, February 23, 2019
জিরো_থ্রি_থ্রি 2
#জিরো_থ্রি_থ্রি
সকালের এই সময়টা, মানে এই ধরুন এগারোটা সাড়ে এগারোটার দিকে কীরকম জানি ঝিম ঝিম লাগে। আটটা নটার ব্যস্ততা তখন যেন একটু জিরিয়ে নিতে বসে। হাজার হাজার কাজ পড়ে থাকে হাতে। তবুও কিছুতেই যেন ইচ্ছেই করেনা সেগুলিকে শেষ করতে। বড় অবাধ্য হয়ে যায় মনটা এই সময়।
খালি ইচ্ছে করে চুপচাপ বসে থাকব। হয়তো হাতে থাকবে কোন বই। কানে থাকবে হেডফোন। বইয়ের পাতা গোটা সময়টা জুড়েই একই জায়গায় আটকে থাকবে। আর গান? কী কী গান হল, জানতে চাইলেও বলতে পারবো না। কান্ট্রি ফোক, ব্লুজ, রবীন্দ্রনাথ...পরপর আপন মনে বেজেই যাবে ইউটিউবে। খোলা জানলা দিয়ে হাওয়া এসে পাতা উল্টে পাল্টে যাবে। ফোনে নোটিফিকেশনের ঘণ্টা বেজে যাবে আপন খেয়ালে।
কিংবা হাঁ করে এই এত্ত বড় জানলার দিকে তাকিয়ে থাকব হয়তো। আকাশে তখন রোদের ঝলমল। মাঝে মধ্যে সাদা মেঘের পাল এসে ভেসে যাবে। লম্বা লম্বা নারকোল আর সুপুরি গাছগুলি কখনও কখনও হাওয়ায় মাথা দোলাবে।
হঠাৎই কানে বাজবে ল্যান্ডলাইনের রিংটোনটা। ২৪৭৩৭১০০। এই নম্বরে এখনও ফোন বাজে? এক ছুট্টে গিয়ে ধরবো। গল্প শুরু হবে হয়তো মধুরিমার সাথে। বা অপর প্রান্তে থাকবে ঋত্বিকা। কিংবা সুকন্যা। রমা। সকাল সকাল টিউশন ক্লাসে কী কী হল, কে কে এসছিল, সে ছিল কি না... স্কুলের গসিপ, কত কিছু।
গল্পের মধ্যে দিয়েই কখন জানি ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছাড়াবে। ভালো মুহূর্তগুলো যেন বড্ড তাড়াতাড়ি কেটে যায়। আমাদের গল্প আর শেষ হবে না। হঠাৎ চোখ চলে যাবে জানলার বাইরে। একী, এত বড় কাঁচের জানলাটা কোথায় গেল? এ তো দিব্যি আমার ছোট্টবেলাকার চেনা ঘরটা। সেই আধখোলা জানলার পাল্লা। সবুজ সুতির পর্দা। দখিনা বাতাসের আলতো ছোঁয়ায় বারবার উড়ে উড়ে আসছে ভিতরে। পাশে পড়ে থাকা কালো ফিলিপ্স রেডিও থেকে ১০৭ মেগাহার্টজ থেকে বাজবে ফিল কলিন্স। কিংবা ভ্যানেসা উইলিয়ামস। সেভ দ্য বেস্ট ফর দ্য লাস্ট... পিছনের সি এস ১৭র একতলা থেকে মিউজিক প্লেয়ারে আবছা শুনতে পাবো দেবব্রত বিশ্বাসের "প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে।" পাশের বাড়ির রান্নাঘর থেকে কড়াইতে খন্তি নাড়ার টুকটাক আওয়াজ আসবে।
মনে পড়বে, আরে, এবার তো স্নান সারতে হবে। বেলা তো হল অনেক। কাল স্কুলে দেখা হবে। এই বলে ফোন ছাড়ব। দুটো মিনিট। দুটো মিনিট একটু চোখ বুজি। বড্ড ঘুম পাচ্ছে। গাঢ় লাল কটকী বিছানার চাদরটায় শুয়ে ভীষণ আরাম। প্রাণ জুড়িয়ে যায়। চোখে নেমে আসে ঘুম। গাঢ়। আরো গাঢ়।
ঘুম যেন না ভাঙে। ভাঙলেই তো আবার সেই ইয়া বড় কাঁচের জানলা। নারকোল গাছ। তাল গাছ। সুপুরি গাছ। সাদাটে নীল আকাশ। প্রচণ্ড রোদ।
এখানে বসন্ত নেই। এখানে কোকিল ডাকে না।
Friday, February 22, 2019
ফাল্গুনী
মাস তিনেক হয়ে গিয়েছে রুমুন এসেছে নিউ জার্সির ব্লুমসফিল্ডে। চাকরিসূত্রে। কাউকেই চেনেনা এখানে এখনও। রুমুনের বড় হওয়া খাস কলকাতায়। অনেক আত্মীয়স্বজনের মধ্যে। আর তাই মার্কিন মুলুকে এসে আরোই একা বোধ করে। সোম থেকে শুক্র অফিস বাড়ি করতেই কেটে যায়। উইকেন্ডে কাছাকাছি সুপারমার্কেট থেকে সারা সপ্তাহের বাজার আর টুকটাক রান্না। এখনও গাড়ি কেনেনি। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ভরসা। আর তাই এখনও ধারেকাছে যে ভারতীয় দোকানপাট আছে এডিসনে, সেখানেও যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
সারা সপ্তাহে ব্যস্ততা থাকলেও শনি রবিগুলো বড্ড একলা লাগে রুমুনের। ও ব্যালকনি থেকে দেখেছে পাশের এপার্টমেন্টে যারা থাকে, তাদের দুটো পোষা লোমশ কুকুর রয়েছে। কলকাতায় রুমুনদের বাড়িতেও অনেক বছর অবধি ভুট্টা, কাজু, ভুট্টার মা এই নামের সব পোষ্য নেড়ি ছিল। এদের দুটোকে দেখলে রুমুনের খুব মনে পড়ে যায় বাড়ির কথা। ইচ্ছে করে একটু আদর করতে। কিন্তু বন্ধুরা সাবধান করে দিয়েছে। এ দেশে ওইসব করলে পুলিশ কেস হয়ে যেতে পারে। রুমুনের মোটেই ভালো লাগছে না এই দেশ। বড্ড বেশিই যেন ফরম্যাল সব। হুঠহাঠ যাকে তাকে তেমন আপন করেও নেওয়া যায় না। এখানে অমন পাড়াতুতো কাকা মাসি দাদা বৌদির কোনো গল্পই নেই। মাঝে মাঝে রুমুনের বড্ড হাঁসফাঁস লাগে।
এক শনিবার দুপুর দুপুর ঝটপট খাওয়া দাওয়া সেরে একটু বেরিয়েছে পায়ে হেঁটে এদিক ওদিক ঘুরবে বলে। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ। অথচ এখনও কী জব্বর শীত। হাওয়াও দিচ্ছে ভালোই। কালো ওভারকোটের বোতামগুলো আটকে নিলো রুমুন। লাল স্কার্ফটাকে জাপ্টে দিলো গলায়। ঠান্ডার মরসুমের দুপুরের রোদ, যতটা শুষে নেওয়া যায় আর কী, সেই ভেবেই বেরোনো। ওদের নেবারহুডের বাড়িগুলো প্রায় সব এক দেখতে। খয়েরি পাথরের মত দেওয়াল। ঢালু লাল ছাদ। সাদা কাঠের দরজা জানালা। সিঁড়ি উঠে আছে এক তলা। অনেকেরই বারান্দায় মার্কিন দেশের পতাকা ঝোলানো। কারুর আবার মরসুমি ফুলের গাছে ভরা। বেশ লাগছিলো ঘুরে বেড়াতে। নির্জন রাস্তা। মাঝে মাঝে এক দুটো গাড়ি সাঁ সাঁ বেগে ছুটে চলে যাচ্ছে। মোবাইল ক্যামেরায় টুকটাক এদিক ওদিক ছবি তুলতে থাকে রুমুন। মাঝে সাঝে এক দুটো সেলফিও।
হঠাৎ একটা বাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো ও। পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে প্রেশার কুকারের সিটি। ভুরভুর করে ভেসে আসছে গরম মশলা মাখা পাঁঠার মাংসের সুগন্ধ। মাথা উঁচু করে খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে রইলো ও। যেন চেটে পুটে নিতে চায় এই ঘ্রাণ। এক ঝটকায় রুমুন পৌঁছে গেল ছোটবেলার রবিবারে। মায়ের হাতের মাংসের ঝোল ভাত। আর চাটনি। যা না হলে ছুটির দিন হতো অপূর্ণ।
কতক্ষণ এমন দাঁড়িয়ে রয়েছে রুমুন, খেয়াল নেই। সম্বিৎ ফিরল "এক্সকিউজ মি" ডাকে। পুরুষ কন্ঠ। ওপরে তাকিয়ে যেন সেই কলকাতার বাড়ির ঘোরের মধ্যে থেকেই রুমুনের গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো, "কিছু বলছেন?" বলেই জিভ কাটলো ও। "আই মিন, ডিড ইউ সে সামথিং?" জিজ্ঞেস করলো ও। ওপর তলা থেকে উত্তর এলো, "বাংলাই চলুক না। দিব্যি লাগলো কানে। আশে পাশে তো বাংলা শুনতেই পাই না।"
রুমুন হাসলো। ওপরতলা থেকে আবারও কথা ভেসে এলো, "পাঁঠা রাঁধছি। মানে চেষ্টা করছি। সেই জোগাড় যন্ত্র করতে করতেই এত বেলা হয়ে গেল। বলছি যে অসুবিধে না থাকলে ওপরে চলে আসুন না। একটু টেস্ট করে বলবেন কেমন রেঁধেছি। মাকে বলতে হবে তো।"
পাড়া পড়শীদের মধ্যে বাঙালি পাবে, ভাবতেই পারেনি রুমুন। উফ। এইবারে ভালো করে আলাপটা করতেই হচ্ছে যে। হেসে তাই ও বললো, "আসছি।"
"আসুন। ও, আমি অগ্নি বাই দ্য ওয়ে।"
"আমি রুমুন।"
রুমুন যখন ঢুকলো অগ্নির এপার্টমেন্টে, তখন সাউন্ড সিস্টেমে গমগম করছে শান্তিদেব ঘোষের কণ্ঠে 'রাঙিয়ে দিয়ে যাও..'। কিচেন থেকে আসছে মাংসের ঝোলের অসাধারণ সুবাস। বিরাট জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বড় বড় গাছ। শীত শেষে তাদের শুকনো ডালে এবার আস্তে আস্তে কচি সবুজ পাতা ধরতে শুরু করেছে। বিদেশ বিভূঁইয়েও বুঝি ফাল্গুনী ছোঁয়া লাগলো বলে।
সারা সপ্তাহে ব্যস্ততা থাকলেও শনি রবিগুলো বড্ড একলা লাগে রুমুনের। ও ব্যালকনি থেকে দেখেছে পাশের এপার্টমেন্টে যারা থাকে, তাদের দুটো পোষা লোমশ কুকুর রয়েছে। কলকাতায় রুমুনদের বাড়িতেও অনেক বছর অবধি ভুট্টা, কাজু, ভুট্টার মা এই নামের সব পোষ্য নেড়ি ছিল। এদের দুটোকে দেখলে রুমুনের খুব মনে পড়ে যায় বাড়ির কথা। ইচ্ছে করে একটু আদর করতে। কিন্তু বন্ধুরা সাবধান করে দিয়েছে। এ দেশে ওইসব করলে পুলিশ কেস হয়ে যেতে পারে। রুমুনের মোটেই ভালো লাগছে না এই দেশ। বড্ড বেশিই যেন ফরম্যাল সব। হুঠহাঠ যাকে তাকে তেমন আপন করেও নেওয়া যায় না। এখানে অমন পাড়াতুতো কাকা মাসি দাদা বৌদির কোনো গল্পই নেই। মাঝে মাঝে রুমুনের বড্ড হাঁসফাঁস লাগে।
এক শনিবার দুপুর দুপুর ঝটপট খাওয়া দাওয়া সেরে একটু বেরিয়েছে পায়ে হেঁটে এদিক ওদিক ঘুরবে বলে। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ। অথচ এখনও কী জব্বর শীত। হাওয়াও দিচ্ছে ভালোই। কালো ওভারকোটের বোতামগুলো আটকে নিলো রুমুন। লাল স্কার্ফটাকে জাপ্টে দিলো গলায়। ঠান্ডার মরসুমের দুপুরের রোদ, যতটা শুষে নেওয়া যায় আর কী, সেই ভেবেই বেরোনো। ওদের নেবারহুডের বাড়িগুলো প্রায় সব এক দেখতে। খয়েরি পাথরের মত দেওয়াল। ঢালু লাল ছাদ। সাদা কাঠের দরজা জানালা। সিঁড়ি উঠে আছে এক তলা। অনেকেরই বারান্দায় মার্কিন দেশের পতাকা ঝোলানো। কারুর আবার মরসুমি ফুলের গাছে ভরা। বেশ লাগছিলো ঘুরে বেড়াতে। নির্জন রাস্তা। মাঝে মাঝে এক দুটো গাড়ি সাঁ সাঁ বেগে ছুটে চলে যাচ্ছে। মোবাইল ক্যামেরায় টুকটাক এদিক ওদিক ছবি তুলতে থাকে রুমুন। মাঝে সাঝে এক দুটো সেলফিও।
হঠাৎ একটা বাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো ও। পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে প্রেশার কুকারের সিটি। ভুরভুর করে ভেসে আসছে গরম মশলা মাখা পাঁঠার মাংসের সুগন্ধ। মাথা উঁচু করে খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে রইলো ও। যেন চেটে পুটে নিতে চায় এই ঘ্রাণ। এক ঝটকায় রুমুন পৌঁছে গেল ছোটবেলার রবিবারে। মায়ের হাতের মাংসের ঝোল ভাত। আর চাটনি। যা না হলে ছুটির দিন হতো অপূর্ণ।
কতক্ষণ এমন দাঁড়িয়ে রয়েছে রুমুন, খেয়াল নেই। সম্বিৎ ফিরল "এক্সকিউজ মি" ডাকে। পুরুষ কন্ঠ। ওপরে তাকিয়ে যেন সেই কলকাতার বাড়ির ঘোরের মধ্যে থেকেই রুমুনের গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো, "কিছু বলছেন?" বলেই জিভ কাটলো ও। "আই মিন, ডিড ইউ সে সামথিং?" জিজ্ঞেস করলো ও। ওপর তলা থেকে উত্তর এলো, "বাংলাই চলুক না। দিব্যি লাগলো কানে। আশে পাশে তো বাংলা শুনতেই পাই না।"
রুমুন হাসলো। ওপরতলা থেকে আবারও কথা ভেসে এলো, "পাঁঠা রাঁধছি। মানে চেষ্টা করছি। সেই জোগাড় যন্ত্র করতে করতেই এত বেলা হয়ে গেল। বলছি যে অসুবিধে না থাকলে ওপরে চলে আসুন না। একটু টেস্ট করে বলবেন কেমন রেঁধেছি। মাকে বলতে হবে তো।"
পাড়া পড়শীদের মধ্যে বাঙালি পাবে, ভাবতেই পারেনি রুমুন। উফ। এইবারে ভালো করে আলাপটা করতেই হচ্ছে যে। হেসে তাই ও বললো, "আসছি।"
"আসুন। ও, আমি অগ্নি বাই দ্য ওয়ে।"
"আমি রুমুন।"
রুমুন যখন ঢুকলো অগ্নির এপার্টমেন্টে, তখন সাউন্ড সিস্টেমে গমগম করছে শান্তিদেব ঘোষের কণ্ঠে 'রাঙিয়ে দিয়ে যাও..'। কিচেন থেকে আসছে মাংসের ঝোলের অসাধারণ সুবাস। বিরাট জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বড় বড় গাছ। শীত শেষে তাদের শুকনো ডালে এবার আস্তে আস্তে কচি সবুজ পাতা ধরতে শুরু করেছে। বিদেশ বিভূঁইয়েও বুঝি ফাল্গুনী ছোঁয়া লাগলো বলে।
Thursday, February 21, 2019
আ মরি বাংলা ভাষা
প্রখর গ্রীষ্মের দুপুরে জলতেষ্টা পেলে যেমন কোনো শরবতে কাজ হয় না, লাগে মাটির কলসী থেকে গড়ানো এক গেলাস শীতল পানীয় জল,
বা জন্মদিনে হাজার জৌলুসে মোড়া মহার্ঘ্য কেকের চেয়েও বেশি আপন মায়ের গন্ধ মাখা আতপ চালের পায়েস,
অথবা অলস দুপুরে ফাঁকা বাসের জানলার ধারে বসে যেমন নিরভানার চেয়ে বেশি নির্বাণ লাভ হয় শ্যামল মিত্রর সুরেলা গানে,
কিংবা যেমন বর্ষব্যাপী ছাড়ের ঠান্ডা বইঘরের চেয়ে বেশি প্রিয় ময়দানের ধুলোবালি মাখা বইমেলার ঘ্রাণ...
ঠিক তেমনই বিশ্বজোড়া ঝাঁ চকচকে কেতাদুরস্ত ইংরেজিতে নিজেকে আপাদমস্তক ঢেকে রাখলেও, দিনের শেষে কোথায় যেন এই মন খোঁজে আটপৌরে বাংলা মায়ের তেল হলুদ মাখা শাড়ির আঁচল। সেই স্নিগ্ধ পরশ যেন বসন্ত সন্ধ্যার দখিনা বাতাসের মতোই সযত্নে ঘুম এনে দেয় শ্রান্ত আঁখিপাতে।
আর তখনই কোনো এক পল্লীঘরে মাটির পিদিম জ্বেলে ঠাকুমার ঝুলি থেকে বেরিয়ে আসে অরুণ বরুণ কিরণমালারা, অবাক বিস্ময়ে সেই গল্প শোনে কত কত সাত ভাই চম্পা।
আরো একটা দিন কেটে যায়। নাগরিক সভ্যতায় সহজ পাঠের গল্পগুলো গল্পেই রয়ে যায়..
বা জন্মদিনে হাজার জৌলুসে মোড়া মহার্ঘ্য কেকের চেয়েও বেশি আপন মায়ের গন্ধ মাখা আতপ চালের পায়েস,
অথবা অলস দুপুরে ফাঁকা বাসের জানলার ধারে বসে যেমন নিরভানার চেয়ে বেশি নির্বাণ লাভ হয় শ্যামল মিত্রর সুরেলা গানে,
কিংবা যেমন বর্ষব্যাপী ছাড়ের ঠান্ডা বইঘরের চেয়ে বেশি প্রিয় ময়দানের ধুলোবালি মাখা বইমেলার ঘ্রাণ...
ঠিক তেমনই বিশ্বজোড়া ঝাঁ চকচকে কেতাদুরস্ত ইংরেজিতে নিজেকে আপাদমস্তক ঢেকে রাখলেও, দিনের শেষে কোথায় যেন এই মন খোঁজে আটপৌরে বাংলা মায়ের তেল হলুদ মাখা শাড়ির আঁচল। সেই স্নিগ্ধ পরশ যেন বসন্ত সন্ধ্যার দখিনা বাতাসের মতোই সযত্নে ঘুম এনে দেয় শ্রান্ত আঁখিপাতে।
আর তখনই কোনো এক পল্লীঘরে মাটির পিদিম জ্বেলে ঠাকুমার ঝুলি থেকে বেরিয়ে আসে অরুণ বরুণ কিরণমালারা, অবাক বিস্ময়ে সেই গল্প শোনে কত কত সাত ভাই চম্পা।
আরো একটা দিন কেটে যায়। নাগরিক সভ্যতায় সহজ পাঠের গল্পগুলো গল্পেই রয়ে যায়..
Tuesday, February 19, 2019
চিরকুট
সকাল থেকেই মনটা চিড়বিড় চিড়বিড় করছে অগ্নির। ফোনের অ্যালারমটা বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আজ সকাল সকাল বেরোনোর কথা ছিল। অফিসে প্রচুর কাজের পাহাড়। এদিকে ঘুম ভাঙতেই দেরি হয়ে গেল এত... রুমুনের সাথে গত তিনদিন ধরে একটা ঝগড়া চলছে। আপাতত কথা বলাবলি বন্ধ। তাই স্বাভাবিকভাবেই ওকে বলতেও পারেনি ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেওয়ার কথা। ঘুম ভাঙল যখন, দেখল রুমুন প্রতিদিনের মতোই স্নান সেরে রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করে যাচ্ছে। দুজনের জন্য ব্রেকফাস্ট বানানো, লাঞ্চ প্যাক করা। রেডিওতে বাংলা গান বাজছে আপন মনে। অগ্নি ঘড়িতে সময়টা দেখে একটু বকাবকি করতেই যাচ্ছিল, তখনই মনে পড়ে গেল গত কয়দিনের ঝগড়ার কথা। কিছু বলল না। তাড়াহুড়ো করে স্নান করে এসে যখন ডাইনিং টেবিলে পৌঁছল, দেখল বউ ইতিমধ্যে বেরিয়ে গিয়েছে। টেবিলের ওপর ওর ব্রেকফাস্ট ঢাকা দিয়ে রাখা। প্লেটের ওপর একটা হলুদ স্টিকি নোট সাঁটানো। তাতে লাল কালিতে গোটা গোটা করে লেখা, "অ্যালারমের শব্দটা আরো একটু জোরে দিবি। নয়তো এরপর থেকে আমায় বলে রাখবি। ঝগড়া ঝগড়ার জায়গায়, প্র্যাকটিকালিটি নিজের জায়গায়..."। রাগ হল অগ্নির। হুহ, তার মানে রুমুন সবই বুঝেইছিল, কিন্তু তবুও ওর ঘুম ভাঙ্গায়নি। ভাগ্যিস পছন্দসই স্ক্র্যাম্বল্ড এগস আর বাটার টোস্ট ছিল ব্রেকফাস্টে। তাই একটু হলেও ক্ষতে প্রলেপ পড়ল ওর।
যেদিন তাড়া থাকে, সেদিনই পৃথিবীর সমস্ত জ্যামজট ওরই রাস্তায় পড়ে। এই ব্যাপারটা অগ্নির বিরক্তিকর লাগে বড্ড। যাদবপুর থানার সিগনালে আটকে আছে প্রায় সাত মিনিট হতে চলল। সাউথ সিটির দিক থেকে একের পর এক গাড়ি এসেই চলেছে। বাইপাসের কানেক্টরের মুখে লম্বা জ্যাম। এদিক ওদিক থেকে অধৈর্য গাড়িগুলো সমানে হর্ন বাজিয়েই চলেছে। গাড়ির এসিটা বাড়াতে অগ্নির নজর গেল ড্যাশবোর্ডের ওপর। সুইঙ্গিং ডলের ঠিক নীচে, একটু আড়ালে রয়েছে বলে এতক্ষণ চোখে পড়েনি। আরো একটা স্টিকি নোট। এবারে আবার গোলাপী রঙের। তাতে বেগুনি রঙে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা "দেখ, অপেক্ষা করা ছাড়া যখন এই মুহূর্তে আর কোন রাস্তা নেই, বরং এখন আমাদের পরবর্তী ভেকেশনের প্ল্যান কর। কাজে দেবে।" হুম। আগামী গ্রীষ্মে একটা দিন সাত দশের ট্যুর তো প্ল্যান করারই কথা। শতদ্রু, ওদের বন্ধু, সম্প্রতি সিকিমের কোনো জায়গা থেকে ঘুরে এসে ছবি দিয়েছিল ফেসবুকে। সান্দাকফু হয়তো। ওর থেকে জেনে নিতে হবে। ওদের দুজনেরই যখন পাহাড় পছন্দের, আশা করছে ট্রিপটা ভালোই হবে। চোখ তুলে অগ্নি দেখল, ট্র্যাফিক লাইট সবুজ হতে আর কুড়ি সেকেন্ড। থাক তাহলে। এখন ফোন করা যাবে না। পরের সিগনালে শতদ্রুকে একটা কল করে দেখবে।
অফিস পৌঁছে অগ্নি কাজের জগতে ডুবে গেল। একটার পর একটা এক্সেল শিট, প্রেজেন্টেশন, ফাইল সই। হাজার একটা কাজ। আসে পাশের কিউবিকল থেকে একে একে লোকজনকে ক্যান্টিনের দিকে যেতে দেখল। তখন খেয়াল হলো, আরে। লাঞ্চ টাইম হয়ে গিয়েছে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল দুটো বেজে গিয়েছে। আর রুমুনের একটা মিসড কল, দেড়টা নাগাদ। প্যান্ট্রিতে বসে খেতে খেতে কল ব্যাক করে নেবে ভেবে অগ্নি লাঞ্চ বক্সটা বের করলো ব্যাগ থেকে। এবং বের করেই কীরকম যেন অন্য দিনের থেকে আলাদা কিছু, এমন বোধ হল। আরে, বক্সটা এত হাল্কা কেন। অন্যান্যদিন তো স্যান্ডউইচ, কেক, ফল ইত্যাদির ভালোই ওজন হয়। আজ কী ব্যাপার? রহস্যের সমাধান ঘটল ঢাকনা খুলতেই। খালি টিফিন বাক্স। না, ঠিক খালি অবশ্য না। ভিতরে আরো একটা চিরকুট। এইবারে নীল রঙের স্টিকি নোটে, সাদা দিয়ে লেখা, আবারও গোটা গোটা অক্ষরে। "অনেকদিন লাঞ্চ করিনা একসাথে। প্ল্যান করে করতে গেলে তো হচ্ছিল না, তাই এমন উদ্ভট কাণ্ড করলাম। চল এখন কোথাও খেতে যাই। ফোন কর।"
সত্যি, রুমুনটা বড্ড পাগল, ছেলেমানুষ। সপ্তাহের মধ্যিখানে এমন ব্যস্ত দিনে নইলে কেউ এরকম কাণ্ডকারখানা করে? তবে আইডিয়াটা নেহাত মন্দ না। ফোনে ফেভারিট কন্ট্যাক্টস থেকে প্রথম নামটিই ডায়াল করলো অগ্নি। ফেলুদা থিম মিউজিক বাজছে। ওদের দুজনেরই একই রিংটোন। অনেক একই পছন্দ অপছন্দের মধ্যে এইটা অন্যতম। অল্প রিং হতেই রুমুন ফোন ধরে বলল, "বাপরে বাপ, এতক্ষণে তোর খিদে পেল? আমার পেটে ছুঁচো ডন বৈঠক দিচ্ছে সেই কখন থেকে!"
অগ্নি হেসে বলল, "ফোনটা একবার করে ছেড়ে দিলে হয়? খিদের মতো এমারজেন্সিতে বারবার ডায়াল করবি তো? যতই ব্যস্ত থাকি, ঠিক ধরব তাহলে..."
রুমুন কপট রাগতস্বরে বলে, "আর তারপর ন্যাগিং বউয়ের তকমা পাই আর কী। হুহ। ওই ট্র্যাপে আমি পড়ছিনা। যাই হোক। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি দশ মিনিটে। সিসি টু পার্কিং লটে মিট করছি।"
"আসছি আসছি। এক্ষুণি।" বলল অগ্নি।
"এক মিনিট। একটা পুনশ্চ আছে", রুমুন থামায়।
"কী"? অগ্নি প্রশ্ন করে।
"এইবারের ঝগড়াটা যেহেতু তোর শুরু করা, ডেসার্টটা তুই স্পন্সর করছিস। ঠিক আছে?" মিষ্টি প্রিয় রুমুনের গলায় খুশি স্পষ্ট।
"ডান! যদিও..." কিছু একটা আরো বলতে যাচ্ছিল অগ্নি। রুমুন থামিয়ে দিয়ে বলল, "ঘাড়ে কটা মাথা রে তোর? এক সেট ঝগড়া মিটতে না মিটতেই আবার সংলাপে যদিও আনছিস? উফ। ফোন রাখ। শিগগির আয়। আই অ্যাম স্টারভিং!"
"আসছি!"
যেদিন তাড়া থাকে, সেদিনই পৃথিবীর সমস্ত জ্যামজট ওরই রাস্তায় পড়ে। এই ব্যাপারটা অগ্নির বিরক্তিকর লাগে বড্ড। যাদবপুর থানার সিগনালে আটকে আছে প্রায় সাত মিনিট হতে চলল। সাউথ সিটির দিক থেকে একের পর এক গাড়ি এসেই চলেছে। বাইপাসের কানেক্টরের মুখে লম্বা জ্যাম। এদিক ওদিক থেকে অধৈর্য গাড়িগুলো সমানে হর্ন বাজিয়েই চলেছে। গাড়ির এসিটা বাড়াতে অগ্নির নজর গেল ড্যাশবোর্ডের ওপর। সুইঙ্গিং ডলের ঠিক নীচে, একটু আড়ালে রয়েছে বলে এতক্ষণ চোখে পড়েনি। আরো একটা স্টিকি নোট। এবারে আবার গোলাপী রঙের। তাতে বেগুনি রঙে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা "দেখ, অপেক্ষা করা ছাড়া যখন এই মুহূর্তে আর কোন রাস্তা নেই, বরং এখন আমাদের পরবর্তী ভেকেশনের প্ল্যান কর। কাজে দেবে।" হুম। আগামী গ্রীষ্মে একটা দিন সাত দশের ট্যুর তো প্ল্যান করারই কথা। শতদ্রু, ওদের বন্ধু, সম্প্রতি সিকিমের কোনো জায়গা থেকে ঘুরে এসে ছবি দিয়েছিল ফেসবুকে। সান্দাকফু হয়তো। ওর থেকে জেনে নিতে হবে। ওদের দুজনেরই যখন পাহাড় পছন্দের, আশা করছে ট্রিপটা ভালোই হবে। চোখ তুলে অগ্নি দেখল, ট্র্যাফিক লাইট সবুজ হতে আর কুড়ি সেকেন্ড। থাক তাহলে। এখন ফোন করা যাবে না। পরের সিগনালে শতদ্রুকে একটা কল করে দেখবে।
অফিস পৌঁছে অগ্নি কাজের জগতে ডুবে গেল। একটার পর একটা এক্সেল শিট, প্রেজেন্টেশন, ফাইল সই। হাজার একটা কাজ। আসে পাশের কিউবিকল থেকে একে একে লোকজনকে ক্যান্টিনের দিকে যেতে দেখল। তখন খেয়াল হলো, আরে। লাঞ্চ টাইম হয়ে গিয়েছে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল দুটো বেজে গিয়েছে। আর রুমুনের একটা মিসড কল, দেড়টা নাগাদ। প্যান্ট্রিতে বসে খেতে খেতে কল ব্যাক করে নেবে ভেবে অগ্নি লাঞ্চ বক্সটা বের করলো ব্যাগ থেকে। এবং বের করেই কীরকম যেন অন্য দিনের থেকে আলাদা কিছু, এমন বোধ হল। আরে, বক্সটা এত হাল্কা কেন। অন্যান্যদিন তো স্যান্ডউইচ, কেক, ফল ইত্যাদির ভালোই ওজন হয়। আজ কী ব্যাপার? রহস্যের সমাধান ঘটল ঢাকনা খুলতেই। খালি টিফিন বাক্স। না, ঠিক খালি অবশ্য না। ভিতরে আরো একটা চিরকুট। এইবারে নীল রঙের স্টিকি নোটে, সাদা দিয়ে লেখা, আবারও গোটা গোটা অক্ষরে। "অনেকদিন লাঞ্চ করিনা একসাথে। প্ল্যান করে করতে গেলে তো হচ্ছিল না, তাই এমন উদ্ভট কাণ্ড করলাম। চল এখন কোথাও খেতে যাই। ফোন কর।"
সত্যি, রুমুনটা বড্ড পাগল, ছেলেমানুষ। সপ্তাহের মধ্যিখানে এমন ব্যস্ত দিনে নইলে কেউ এরকম কাণ্ডকারখানা করে? তবে আইডিয়াটা নেহাত মন্দ না। ফোনে ফেভারিট কন্ট্যাক্টস থেকে প্রথম নামটিই ডায়াল করলো অগ্নি। ফেলুদা থিম মিউজিক বাজছে। ওদের দুজনেরই একই রিংটোন। অনেক একই পছন্দ অপছন্দের মধ্যে এইটা অন্যতম। অল্প রিং হতেই রুমুন ফোন ধরে বলল, "বাপরে বাপ, এতক্ষণে তোর খিদে পেল? আমার পেটে ছুঁচো ডন বৈঠক দিচ্ছে সেই কখন থেকে!"
অগ্নি হেসে বলল, "ফোনটা একবার করে ছেড়ে দিলে হয়? খিদের মতো এমারজেন্সিতে বারবার ডায়াল করবি তো? যতই ব্যস্ত থাকি, ঠিক ধরব তাহলে..."
রুমুন কপট রাগতস্বরে বলে, "আর তারপর ন্যাগিং বউয়ের তকমা পাই আর কী। হুহ। ওই ট্র্যাপে আমি পড়ছিনা। যাই হোক। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি দশ মিনিটে। সিসি টু পার্কিং লটে মিট করছি।"
"আসছি আসছি। এক্ষুণি।" বলল অগ্নি।
"এক মিনিট। একটা পুনশ্চ আছে", রুমুন থামায়।
"কী"? অগ্নি প্রশ্ন করে।
"এইবারের ঝগড়াটা যেহেতু তোর শুরু করা, ডেসার্টটা তুই স্পন্সর করছিস। ঠিক আছে?" মিষ্টি প্রিয় রুমুনের গলায় খুশি স্পষ্ট।
"ডান! যদিও..." কিছু একটা আরো বলতে যাচ্ছিল অগ্নি। রুমুন থামিয়ে দিয়ে বলল, "ঘাড়ে কটা মাথা রে তোর? এক সেট ঝগড়া মিটতে না মিটতেই আবার সংলাপে যদিও আনছিস? উফ। ফোন রাখ। শিগগির আয়। আই অ্যাম স্টারভিং!"
"আসছি!"
Thursday, February 14, 2019
ছাড়
মর্নিং ওয়াক থেকে ফেরার সময় পলাশের চায়ের দোকানে বসে এক কাপ বেশ অনেকটা চিনি দিয়ে দুধ চা খেয়ে তবে বাড়ি ঢোকার অভ্যেস নিত্যহরিবাবুর। ডায়াবিটিসের পেশেন্ট তো, বাড়িতে তাই দুধ চিনি ছাড়া চা জোটে। তাই আর কী... প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে একবার আনন্দবাজারটা উল্টে পাল্টে দেখলেন রোজের মতো। পাতা জুড়ে শুধুই ভ্যালেন্টাইনস ডের বিজ্ঞাপন।
তাই তো। আজ তো চোদ্দ তারিখ। হুম। ওই জন্যই ফুল দিদির দোকানে আজ বেশি বেশি লাল গোলাপ নজরে পড়লো। এইবার বুঝেছেন নিত্যহরিবাবু।
ছেলে বৌমা নাতি নাতনি নিয়ে ভরা সংসার ওঁর। আদ্যোপান্ত রোমান্টিক নিত্যবাবু তবুও লোকলজ্জার ভয়ে চাইলেও গিন্নির জন্য ফুল কিনে নিয়ে যেতে সাহস পেলেন না। তবে অন্যভাবে সেলিব্রেট করতেই হবে। ভালোবাসার দিন বলে কথা।
"জেঠু, তোমার চা টা এবার দিই?" পলাশের প্রশ্নে নিত্যহরিবাবু স্মিত হেসে বললেন, "না রে পলাশ। আজ আর দুধ চিনি চা খাবো না। আজ বাড়ি গিয়ে তোর জেঠির হাতের গ্রীন টি খাবো। আজ জানি, ওটা এমনিই বেশি মিষ্টি লাগবে। তুই বরং পনেরোটা জিলিপি প্যাক করে দে দেখি। নিয়ে যাই। তোর জেঠি তো খুব ভালোবাসে।"
গরম গরম ভাজা জিলিপির ঠোঙা হাতে নিত্যহরিবাবু বাড়ি ফিরে বললেন, "কই গো। ঝটপট চা দাও তো।"
রান্নাঘর থেকে স্ত্রীর কন্ঠস্বর শোনা গেল। "কেন, আজ পলাশের দোকান বন্ধ ছিল নাকি?"
নিত্যহরিবাবু চুপ। এ কী, পলাশের চায়ের কথা তো ওর জানার কথা না। তাহলে? গেল রে। বাড়ির চাও জুটল না বোধহয় আজ। পলাশের কাছে কেন যে ভালোমানুষী করতে খেয়ে এলো না... আক্ষেপ।
এইবার রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আঁচলে ভিজে হাত মুছতে মুছতে স্ত্রী বললেন, "অবাক হচ্ছ? আমি অনেকদিন ধরেই জানি। একদিন পুষ্প তোমায় দেখেছে চা খেতে। আমি তবে থেকেই জানি।"
"তা তাহলে এতদিন কিছু বলোনি যে?"
"ও একটু আধটু ছাড় তো দিতেই হয়।"
"তাহলে এই নাও। জিলিপি ভাজছিলো গরম গরম। এনে দিলাম। তুমি ভালোবাসো..." বলে ঠোঙাটি স্ত্রীর দিকে এগিয়ে দিলেন নিত্যবাবু।
"তুমিও পাবে। তোমার জন্য আজ সব ছাড়। দাঁড়াও, চা টা এনে দিই। অনেকটা দুধ আর মাঝারি চিনি দিয়ে করছি। চলবে তো?"
"গিন্নি, তোমার হাতের ছোঁয়ায় তো উচ্ছেও চাটনির মতো লাগে।"
"তাই বুঝি? আচ্ছা। কাল থেকে দুবেলা সেই চাটনি খেয়ো।" বলে হাসতে হাসতে উনি রান্নাঘরের দিকে চলে যান।
তাই তো। আজ তো চোদ্দ তারিখ। হুম। ওই জন্যই ফুল দিদির দোকানে আজ বেশি বেশি লাল গোলাপ নজরে পড়লো। এইবার বুঝেছেন নিত্যহরিবাবু।
ছেলে বৌমা নাতি নাতনি নিয়ে ভরা সংসার ওঁর। আদ্যোপান্ত রোমান্টিক নিত্যবাবু তবুও লোকলজ্জার ভয়ে চাইলেও গিন্নির জন্য ফুল কিনে নিয়ে যেতে সাহস পেলেন না। তবে অন্যভাবে সেলিব্রেট করতেই হবে। ভালোবাসার দিন বলে কথা।
"জেঠু, তোমার চা টা এবার দিই?" পলাশের প্রশ্নে নিত্যহরিবাবু স্মিত হেসে বললেন, "না রে পলাশ। আজ আর দুধ চিনি চা খাবো না। আজ বাড়ি গিয়ে তোর জেঠির হাতের গ্রীন টি খাবো। আজ জানি, ওটা এমনিই বেশি মিষ্টি লাগবে। তুই বরং পনেরোটা জিলিপি প্যাক করে দে দেখি। নিয়ে যাই। তোর জেঠি তো খুব ভালোবাসে।"
গরম গরম ভাজা জিলিপির ঠোঙা হাতে নিত্যহরিবাবু বাড়ি ফিরে বললেন, "কই গো। ঝটপট চা দাও তো।"
রান্নাঘর থেকে স্ত্রীর কন্ঠস্বর শোনা গেল। "কেন, আজ পলাশের দোকান বন্ধ ছিল নাকি?"
নিত্যহরিবাবু চুপ। এ কী, পলাশের চায়ের কথা তো ওর জানার কথা না। তাহলে? গেল রে। বাড়ির চাও জুটল না বোধহয় আজ। পলাশের কাছে কেন যে ভালোমানুষী করতে খেয়ে এলো না... আক্ষেপ।
এইবার রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আঁচলে ভিজে হাত মুছতে মুছতে স্ত্রী বললেন, "অবাক হচ্ছ? আমি অনেকদিন ধরেই জানি। একদিন পুষ্প তোমায় দেখেছে চা খেতে। আমি তবে থেকেই জানি।"
"তা তাহলে এতদিন কিছু বলোনি যে?"
"ও একটু আধটু ছাড় তো দিতেই হয়।"
"তাহলে এই নাও। জিলিপি ভাজছিলো গরম গরম। এনে দিলাম। তুমি ভালোবাসো..." বলে ঠোঙাটি স্ত্রীর দিকে এগিয়ে দিলেন নিত্যবাবু।
"তুমিও পাবে। তোমার জন্য আজ সব ছাড়। দাঁড়াও, চা টা এনে দিই। অনেকটা দুধ আর মাঝারি চিনি দিয়ে করছি। চলবে তো?"
"গিন্নি, তোমার হাতের ছোঁয়ায় তো উচ্ছেও চাটনির মতো লাগে।"
"তাই বুঝি? আচ্ছা। কাল থেকে দুবেলা সেই চাটনি খেয়ো।" বলে হাসতে হাসতে উনি রান্নাঘরের দিকে চলে যান।
Tuesday, February 12, 2019
আলিঙ্গন।
ছয়মাসের ম্যাটার্নিটি লিভটা শেষ হচ্ছে আজ। কাল থেকে আবার অফিসে জয়েন করতে হবে তুতুলকে। এতদিন পর কাল অফিস, নার্ভাস লাগছে খুব। রুনিকে ঘুম পাড়িয়ে আস্তে আস্তে পরেরদিনের জন্য ব্যাগ গুছিয়ে তারপর আলমারি থেকে জামাকাপড় বের করে একটু বসেছে সবে। এমন সময় রুনি ঘুম চোখে ভ্যাঁ করে কাঁদতে শুরু করে দিলো।
তুতুল ঝটপট ওকে কোলে নিয়ে "কী হয়েছে সোনা মা আমার? কাঁদে না মা। আমার লক্ষ্মী মা তো। খিদে পেয়েছে?" বলে ওকে ফিডিং বোতল থেকে খাওয়াতে চেষ্টা করে। রুনি অল্প একটু দুধ খেয়ে মুখ সরিয়ে নিয়ে আবারও কাঁদতে থাকে। দীপালিদি, যার ভরসায় কাল থেকে রুনিকে রেখে অফিস যাবে তুতুল, তাড়াতাড়ি এসে ওকে সামলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু রুনির কান্না থামেনা।
সেই তুতুলকেই তারপর আবার ওকে কোলে নিয়ে এ ঘর ও ঘর করতে হয়। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে, পিঠ থাবরে তবে আবার রুনি শান্ত হয়। ঘুমোয়। ছোট্ট দুটি হাতের মুঠি দিয়ে তুতুলের হাতের আঙুল আকড়ে থাকে। তুতুল ওকে কোলে নিয়েই সোফায় বসল।
এই প্রাণের টুকরোকে কী ভাবে যে বাড়িতে রেখে কাল থেকে আবার অফিস করবে, ভাবলেই কান্না পেয়ে যাচ্ছে ওর। এই কয়েক মাস একটা অন্যরকম জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। রুনির সাথে তাল মিলিয়ে জাগা, ঘুমানো। কখনো কখনো রাগ হওয়া। কেন ও ঘুমোচ্ছে না। কেন ও কাঁদছে। আর এখন মনে হচ্ছে, তাও তো সারাক্ষণ চোখের সামনেই থাকত। কাল থেকে কী হবে?
লিভিং রুমের বড় ঘড়িতে আটটার কাঁটা ঢং ঢং করে বাজতে শুরু করেছে। চুপি চুপি চাবি ঘুরিয়ে বাড়ি ঢুকল ঋজু। পা টিপে টিপে এগোলো মেয়ের দিকে। পাছে ওর ঘুম ভেঙে যায়। এসে দেখে, তুতুল রুনির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। আর দুই গাল বেয়ে কান্না নামছে।
"কী হলো রে? কাঁদছিস কেন?" তুতুলের কানের কাছে।গিয়ে ফিসফিস করে বলে ঋজু।
"ওকে ছেড়ে কী করে থাকবো রে?" তুতুল কাঁদতে থাকে।
ঋজু ওর কাঁধে হাত রেখে আলতো চাপ দিয়ে বলে, "ঠিক পারবি। পারতেই হবে। রুনিকে জানতে হবে না ওর মা কতটা পারদর্শী?"
"না জানলেও চলবে।" তুতুল আধো আধো কণ্ঠে বলে।
"উহু। এটা আমার রুনির মা বলছে। কিন্তু আমার তুতুল মোটেই এইরকম বলবে না। তুই একদম ভাববি না। দেখবি, ঠিক অভ্যেস হয়ে যাবে। আমার মা, তোর মা, দিদি...এরা করেনি?" ঋজু বলতে থাকে।
"হুম। কিন্তু আমার অত সাহস নেই।"
"কে বলেছে? যুদ্ধে নামলে তবে না বুঝবি নিজের ক্ষমতা? এন্ড আই নো, মাই তুতুল ইজ এ ব্রেভ গার্ল। ও ঠিক লড়ে জিতবেই। পারবেই। আর তাছাড়া, আমি তো রইলামই।" বলে ঋজু তুতুলকে আঁটোসাঁটো করে জড়িয়ে ধরে। রুনিও বাবার স্পর্শে একটু একবার চোখ মেলে চারিদিক দেখে আবার চলে যায় ঘুমের রাজ্যে।
তুতুল ঝটপট ওকে কোলে নিয়ে "কী হয়েছে সোনা মা আমার? কাঁদে না মা। আমার লক্ষ্মী মা তো। খিদে পেয়েছে?" বলে ওকে ফিডিং বোতল থেকে খাওয়াতে চেষ্টা করে। রুনি অল্প একটু দুধ খেয়ে মুখ সরিয়ে নিয়ে আবারও কাঁদতে থাকে। দীপালিদি, যার ভরসায় কাল থেকে রুনিকে রেখে অফিস যাবে তুতুল, তাড়াতাড়ি এসে ওকে সামলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু রুনির কান্না থামেনা।
সেই তুতুলকেই তারপর আবার ওকে কোলে নিয়ে এ ঘর ও ঘর করতে হয়। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে, পিঠ থাবরে তবে আবার রুনি শান্ত হয়। ঘুমোয়। ছোট্ট দুটি হাতের মুঠি দিয়ে তুতুলের হাতের আঙুল আকড়ে থাকে। তুতুল ওকে কোলে নিয়েই সোফায় বসল।
এই প্রাণের টুকরোকে কী ভাবে যে বাড়িতে রেখে কাল থেকে আবার অফিস করবে, ভাবলেই কান্না পেয়ে যাচ্ছে ওর। এই কয়েক মাস একটা অন্যরকম জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। রুনির সাথে তাল মিলিয়ে জাগা, ঘুমানো। কখনো কখনো রাগ হওয়া। কেন ও ঘুমোচ্ছে না। কেন ও কাঁদছে। আর এখন মনে হচ্ছে, তাও তো সারাক্ষণ চোখের সামনেই থাকত। কাল থেকে কী হবে?
লিভিং রুমের বড় ঘড়িতে আটটার কাঁটা ঢং ঢং করে বাজতে শুরু করেছে। চুপি চুপি চাবি ঘুরিয়ে বাড়ি ঢুকল ঋজু। পা টিপে টিপে এগোলো মেয়ের দিকে। পাছে ওর ঘুম ভেঙে যায়। এসে দেখে, তুতুল রুনির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। আর দুই গাল বেয়ে কান্না নামছে।
"কী হলো রে? কাঁদছিস কেন?" তুতুলের কানের কাছে।গিয়ে ফিসফিস করে বলে ঋজু।
"ওকে ছেড়ে কী করে থাকবো রে?" তুতুল কাঁদতে থাকে।
ঋজু ওর কাঁধে হাত রেখে আলতো চাপ দিয়ে বলে, "ঠিক পারবি। পারতেই হবে। রুনিকে জানতে হবে না ওর মা কতটা পারদর্শী?"
"না জানলেও চলবে।" তুতুল আধো আধো কণ্ঠে বলে।
"উহু। এটা আমার রুনির মা বলছে। কিন্তু আমার তুতুল মোটেই এইরকম বলবে না। তুই একদম ভাববি না। দেখবি, ঠিক অভ্যেস হয়ে যাবে। আমার মা, তোর মা, দিদি...এরা করেনি?" ঋজু বলতে থাকে।
"হুম। কিন্তু আমার অত সাহস নেই।"
"কে বলেছে? যুদ্ধে নামলে তবে না বুঝবি নিজের ক্ষমতা? এন্ড আই নো, মাই তুতুল ইজ এ ব্রেভ গার্ল। ও ঠিক লড়ে জিতবেই। পারবেই। আর তাছাড়া, আমি তো রইলামই।" বলে ঋজু তুতুলকে আঁটোসাঁটো করে জড়িয়ে ধরে। রুনিও বাবার স্পর্শে একটু একবার চোখ মেলে চারিদিক দেখে আবার চলে যায় ঘুমের রাজ্যে।
Monday, February 11, 2019
গোটা সিদ্ধ
টুকটুকি বারান্দায় টুল নিয়ে বসে পড়ছে। সামনেই মাধ্যমিক, এখন শেষ মুহূর্তের পড়াশোনা তুঙ্গে। তবে আজ তেমন মন বসছে না পড়ায়। সকাল সকাল দেখেছে ওপর তলার জন্য বাজার করে এনেছে মিনতি মাসি। ব্যাগ ভর্তি ছিল সিম, বেগুন, পালং, রাঙা আলু, মটরশুঁটি। আজ তো ষষ্ঠী। টুকটুকি জানে, জেঠিমা আজ গোটা সেদ্ধ বানাবে। ওদের চক্রবর্তী বাড়ির তো এটাই রেওয়াজ। সরস্বতী পুজোর পরেরদিন গোটা সেদ্ধ খাওয়া। ঠাকুমা কত রসিয়ে রাঁধত। সব্বাই আঙ্গুল চাটত খাওয়ার পরে। স্কুল ও পাড়ার বন্ধুরাও আসত কেউ কেউ ওদের বাড়ি, একেক বছর একেক বন্ধু। জেঠিমার রান্না মনে হয় হয়ে গিএয়ছে। দারুণ গন্ধনাকে ভেসে আসছে ওর।
ঠাকুমা চলে গিয়েছে পাঁচ বছর হয়ে গেল। তারপর বাবা জ্যাঠার মধ্যে মন কষাকষি, সম্পত্তি ভাগাভাগি করে এখন দুই পরিবারের হেঁসেল আলাদা। একই বাড়িতে থাকলেও ওপর তলা থেকে নীচ তলা বা নীচ থেকে ওপর, এই সাড়ে চার বছরে কখনও খাবার আদান প্রদান হয়নি।
টুকটুকির মা পাঁচদিন হল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে। শরীর দুর্বল। তাই স্বাভাবিকভাবেই এবার ওদের বাড়ি গোটা সিদ্ধ হচ্ছেনা। আর সেই জন্যই মেয়েটার এত মন খারাপ। এই ষোল বছরে প্রথম ও ওর প্রিয় গোটা খেতে পাবে না। বাবাও সকালে বাজার করে এসে একটু আক্ষেপ করছিল বটে এই নিয়ে। কিন্তু ঠাকুমার আমল থেকে নিয়ম চলে আসছে, বাড়ির বউরা ছাড়া কেউ রাঁধতে পারবেনা এটা। তাই রান্নার দিদিকেও বলতে পারেনি ওরা।
এক রাশ মন খারাপ নিয়ে টুকটুকি উঠল, মাকে খাবার বেড়ে দিয়ে নিজে খাবে বলে। এমনসময় সিঁড়ি দিয়ে চটাস চটাস শব্দ করতে করতে দেখল জেঠিমা নামছে, হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ার।
"টুকটুকি, এই এদিকে শুনে যা একবার।" কতদিন পর জেঠিমার মুখে নিএজ্র নাম শুনে টুকটুকি অবাক।
"আসছি বড়মা" বলে ও ছুটল।
"শোন, ছোট তো নিশ্চয়ই রাঁধতে পারেনি আজ গোটা। আমি করেছি। এই নে। তোরাও খাস। অন্যান্যদিন যাই যেমন হোক না কেন, গোটা বাড়িটাই তো একটা পরিবার। তাই না? তাই এক হেঁশেলের গোটা, গোটা পরিবারের জন্যই রইল আজ।"
টুকটুকি আনন্দে বিহ্বল, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
"দাঁড়িয়েরইলি কেন রে মেয়ে? ধর এটা। আমার মেলা কাজ। আর শোন, পাকামি করে কিছু ভরে ফেরত দিতে যাস না। তোর মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোক, ঠেসে মিষ্টি ভরে দিস তখন, কেমন?" টুকটুকির মাথায় হাত বুলিয়ে কৌটো ধরিয়ে জেঠিমা আবার ওপরে উঠতে লাগল। টুকটুকি এখনও হাঁ।
ঠাকুমা চলে গিয়েছে পাঁচ বছর হয়ে গেল। তারপর বাবা জ্যাঠার মধ্যে মন কষাকষি, সম্পত্তি ভাগাভাগি করে এখন দুই পরিবারের হেঁসেল আলাদা। একই বাড়িতে থাকলেও ওপর তলা থেকে নীচ তলা বা নীচ থেকে ওপর, এই সাড়ে চার বছরে কখনও খাবার আদান প্রদান হয়নি।
টুকটুকির মা পাঁচদিন হল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে। শরীর দুর্বল। তাই স্বাভাবিকভাবেই এবার ওদের বাড়ি গোটা সিদ্ধ হচ্ছেনা। আর সেই জন্যই মেয়েটার এত মন খারাপ। এই ষোল বছরে প্রথম ও ওর প্রিয় গোটা খেতে পাবে না। বাবাও সকালে বাজার করে এসে একটু আক্ষেপ করছিল বটে এই নিয়ে। কিন্তু ঠাকুমার আমল থেকে নিয়ম চলে আসছে, বাড়ির বউরা ছাড়া কেউ রাঁধতে পারবেনা এটা। তাই রান্নার দিদিকেও বলতে পারেনি ওরা।
এক রাশ মন খারাপ নিয়ে টুকটুকি উঠল, মাকে খাবার বেড়ে দিয়ে নিজে খাবে বলে। এমনসময় সিঁড়ি দিয়ে চটাস চটাস শব্দ করতে করতে দেখল জেঠিমা নামছে, হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ার।
"টুকটুকি, এই এদিকে শুনে যা একবার।" কতদিন পর জেঠিমার মুখে নিএজ্র নাম শুনে টুকটুকি অবাক।
"আসছি বড়মা" বলে ও ছুটল।
"শোন, ছোট তো নিশ্চয়ই রাঁধতে পারেনি আজ গোটা। আমি করেছি। এই নে। তোরাও খাস। অন্যান্যদিন যাই যেমন হোক না কেন, গোটা বাড়িটাই তো একটা পরিবার। তাই না? তাই এক হেঁশেলের গোটা, গোটা পরিবারের জন্যই রইল আজ।"
টুকটুকি আনন্দে বিহ্বল, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
"দাঁড়িয়েরইলি কেন রে মেয়ে? ধর এটা। আমার মেলা কাজ। আর শোন, পাকামি করে কিছু ভরে ফেরত দিতে যাস না। তোর মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোক, ঠেসে মিষ্টি ভরে দিস তখন, কেমন?" টুকটুকির মাথায় হাত বুলিয়ে কৌটো ধরিয়ে জেঠিমা আবার ওপরে উঠতে লাগল। টুকটুকি এখনও হাঁ।
Promise day 2
-রাস্তা পার হওয়ার সময়ে সব সময়ে হাত ধরবি বল?
-সে তো বটেই। তার সাথে সাথে গাড়ির দিকে সব সময় আমি থাকব।
-শাহরুখ খানের সব সিনেমা ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো আমার সাথেই দেখবি। আর তারপরে মাথা ব্যাথার গল্প দিবি না বল?
-চকলেট পপকর্ন আর চিকেন উইংস নিয়ে বসবো দেখতে।
-ফুচকায় ঝাল আলু চাইবি না বল?
-শেষের ফাউ শুকনো ফুচকাটাও তোকেই দিয়ে দেব।
-মোমোর প্লেটে অড নাম্বারের পিস থাকলে, বেশিটা আমার কিন্তু।
-ইভেন নাম্বারের হলেও এক পিস বেশি তোর জন্য, অলওয়েজ।
-যেদিন যেদিন বলব, আমার সাথে রঙ ম্যাচ করে জামা পরতে হবে।
-শুধু তাই না। ভদ্রভাবে সেলফি তুলে অনেকগুলো হ্যাশট্যাগ দিয়ে আপলোড করেও দেব সোশ্যাল মিডিয়ায়।
-কখনো বিপথে যদি, ভ্রমিতে চায় এ হৃদি?
-ঘাড় ধরে টেনে আনবো ফেরত।
-চিরসখা হে,ছেড়ো না মোরে।
-কোনো সিনই নেই। সাত জন্মের জন্য আপাতত কন্ত্র্যাক্ট সাইনটা করে নিই। বাকিটা, ক্রমশ প্রকাশ্য...
-সে তো বটেই। তার সাথে সাথে গাড়ির দিকে সব সময় আমি থাকব।
-শাহরুখ খানের সব সিনেমা ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো আমার সাথেই দেখবি। আর তারপরে মাথা ব্যাথার গল্প দিবি না বল?
-চকলেট পপকর্ন আর চিকেন উইংস নিয়ে বসবো দেখতে।
-ফুচকায় ঝাল আলু চাইবি না বল?
-শেষের ফাউ শুকনো ফুচকাটাও তোকেই দিয়ে দেব।
-মোমোর প্লেটে অড নাম্বারের পিস থাকলে, বেশিটা আমার কিন্তু।
-ইভেন নাম্বারের হলেও এক পিস বেশি তোর জন্য, অলওয়েজ।
-যেদিন যেদিন বলব, আমার সাথে রঙ ম্যাচ করে জামা পরতে হবে।
-শুধু তাই না। ভদ্রভাবে সেলফি তুলে অনেকগুলো হ্যাশট্যাগ দিয়ে আপলোড করেও দেব সোশ্যাল মিডিয়ায়।
-কখনো বিপথে যদি, ভ্রমিতে চায় এ হৃদি?
-ঘাড় ধরে টেনে আনবো ফেরত।
-চিরসখা হে,ছেড়ো না মোরে।
-কোনো সিনই নেই। সাত জন্মের জন্য আপাতত কন্ত্র্যাক্ট সাইনটা করে নিই। বাকিটা, ক্রমশ প্রকাশ্য...
Promise day
-পরশু যে এই এত্ত এত্ত চকোলেট পাঠালাম, একটা একনলেজমেন্ট তো করে মানুষে!
-থ্যাংক ইউ বললাম। ফোন করলাম। আর কী করব? ফেসবুকে ছবি দিয়ে পি ডি এ?
-মন্দ কী?
-না। কিছু কিছু জিনিস নিতান্তই ব্যক্তিগত। সেগুলো গোটা দুনিয়াকে না জানালেও চলে।
-ল্যা! উঠতে বসতে যে মেয়ে ফেসবুক করে উল্টে যায়, তার মুখে এ কেমন কথা?
-না। ওগুলো তো বারোয়ারি। এইগুলো শুধুমাত্র আমাদের দুজনের।
-বুঝলাম।
-আমাদের এই নিজস্ব মুহূর্তগুলো শুধুমাত্র আমাদের মধ্যেই থাকবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় যাবে না।
-আচ্ছা।
-প্রমিস?
-হুম।
-আরেকটা প্রমিস কর আজ।
-এইরকম ভাবে সারা জীবন আমায় প্যাম্পার করে যাবি আর আমার সমস্ত মুড সুইংস সহ্য করবি।
-ফর ইউ, আ থাউজ্যান্ড টাইমস ওভার...
-
Saturday, February 9, 2019
সরস্বতী পুজো
ভোরবেলা ঘুম ভাঙার অভ্যেস ওর চিরকালের। তানপুরাটা নিয়ে বসে ও যখন রেওয়াজ করে বারান্দায় বসে, কোকিল তার কূজন থামিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে। সুরলোক থেকে ভেসে আসে যেন সেই সঙ্গীত মূর্ছনা।
আজ অবশ্য প্রভাতী সঙ্গীত সাধনার সময় কিঞ্চিৎ কমেছে। বসন্ত পঞ্চমী তিথি লেগেছে এইমাত্র। বাগদেবীর আরাধনা ছাড়াও অন্য বিশেষ কারণে আজ বঙ্গসমাজে যুবক যুবতীদের মধ্যে অন্যরকমের উত্তেজনা। বুকের ভিতর দামামা বাজছে।
আমাদের নায়িকাও এই জ্বরে কাবু হতে চায়। আর তাই এক মাস আগে থেকে মাতৃদেবীর আলমারি ঘেঁটে অনেক ট্রায়াল দিয়ে শেষ পর্যন্ত একটি দুধ সাদা জমিতে সোনালী জরির কাজ করা পার আঁচল কেরালা কটন শাড়ি পরবে ঠিক করেছে।
গত রাত্রে চুলে শ্যাম্পু করে রাখা আছে, যাতে আজ সকালে এক ঢাল কোঁকড়া চুল শুকোতে সময় নষ্ট না হয়। কিঞ্চিৎ অপটু হাতে শাড়িটি পরে নায়িকা মাতৃদেবীর শরণাপন্ন হলো। উনি 'এত বড় হয়ে গেলি, তাও কুচি ধরতে জানিস না, আঁচলটা এত ছোট করলে কী করে চলবে' ইত্যাদি ভর্ৎসনা করে মেয়েকে রাজরাণীর মতোই সাজালেন। যত্ন করে লম্বা চুল বেঁধে দিলেন একটি বড় খোঁপায়। তখনও একপ্রস্থ 'চুলে তেল না দিলে পেকে যাবে, কী উস্ক খুস্কো চুল তোর' চলল।
নায়িকা গয়নার বাক্স খুলে এবার ছোট্ট এক জোড়া সাদা মুক্তোর ঝুমকো দুল কানে পরলো। গলায় দিলো মুক্তোর চোকার।
ডাগর দুই চোখে সযত্নে লাগলো কালো কাজলের আঁচড়। মা বাবাকে প্রণাম করতে মা সদ্য বেটে আনা সাদা চন্দনের একটা ছোট্ট টিপ এঁকে দিলেন নায়িকার কপালে।
"খুউব সুন্দর লাগছে তোকে। দাঁড়া, সাজটা পরিপূর্ণ হয়নি। আসছি।" এই বলে মা ছুট লাগালেন বাগানে। সেখানে শীতের চন্দ্রমল্লিকা ডালিয়া সূর্যমুখী গাঁদার ভিড়। একটা হলুদ গাঁদা তুলে মেয়ের খোঁপায় গুঁজে বললেন, "এইবারে যেন লাগছে, বাসন্তী।" চোখের কোণ থেকে একটু কাজল নিয়ে মেয়ের কপালের এক ধারে লাগিয়ে বললেন, "নজর না লাগে আমার মেয়ের উপর। এত সুন্দর লাগছে।"
নায়িকাও "মা, তুমি প্রত্যেকবার এই বলে বলে আমার সব চান্স বন্ধ করে দাও। তোমার নজর কাটানোর টোটকায় আর কোনো ছেলেই যে আর আমার দিকে তাকায় না। সবাই খালি জ্যান্ত সরস্বতীর খোঁজে ঘুরে বেড়ায়। বাসন্তীর ভিড়ে" বলে আক্ষেপ করতে থাকে।
"বিজয়িনী হও মা। আমার আশীর্বাদ রইলো।" বলে মেয়েকে এগিয়ে দিতে যান মা। মনে মনে বলেন, "দুগ্গা দুগ্গা।"
(বলি কী, এক ঝাঁক সুন্দরীদের ভিড়ে যদি কোনো শান্ত স্নিগ্ধ শুভ্রবসনাকে দেখেন চুপ করে আড়ালে একা একা বসে আছে, একবার কনফার্ম করে নিতে পারেন। বীণাপাণি নয় তো?)
আজ অবশ্য প্রভাতী সঙ্গীত সাধনার সময় কিঞ্চিৎ কমেছে। বসন্ত পঞ্চমী তিথি লেগেছে এইমাত্র। বাগদেবীর আরাধনা ছাড়াও অন্য বিশেষ কারণে আজ বঙ্গসমাজে যুবক যুবতীদের মধ্যে অন্যরকমের উত্তেজনা। বুকের ভিতর দামামা বাজছে।
আমাদের নায়িকাও এই জ্বরে কাবু হতে চায়। আর তাই এক মাস আগে থেকে মাতৃদেবীর আলমারি ঘেঁটে অনেক ট্রায়াল দিয়ে শেষ পর্যন্ত একটি দুধ সাদা জমিতে সোনালী জরির কাজ করা পার আঁচল কেরালা কটন শাড়ি পরবে ঠিক করেছে।
গত রাত্রে চুলে শ্যাম্পু করে রাখা আছে, যাতে আজ সকালে এক ঢাল কোঁকড়া চুল শুকোতে সময় নষ্ট না হয়। কিঞ্চিৎ অপটু হাতে শাড়িটি পরে নায়িকা মাতৃদেবীর শরণাপন্ন হলো। উনি 'এত বড় হয়ে গেলি, তাও কুচি ধরতে জানিস না, আঁচলটা এত ছোট করলে কী করে চলবে' ইত্যাদি ভর্ৎসনা করে মেয়েকে রাজরাণীর মতোই সাজালেন। যত্ন করে লম্বা চুল বেঁধে দিলেন একটি বড় খোঁপায়। তখনও একপ্রস্থ 'চুলে তেল না দিলে পেকে যাবে, কী উস্ক খুস্কো চুল তোর' চলল।
নায়িকা গয়নার বাক্স খুলে এবার ছোট্ট এক জোড়া সাদা মুক্তোর ঝুমকো দুল কানে পরলো। গলায় দিলো মুক্তোর চোকার।
ডাগর দুই চোখে সযত্নে লাগলো কালো কাজলের আঁচড়। মা বাবাকে প্রণাম করতে মা সদ্য বেটে আনা সাদা চন্দনের একটা ছোট্ট টিপ এঁকে দিলেন নায়িকার কপালে।
"খুউব সুন্দর লাগছে তোকে। দাঁড়া, সাজটা পরিপূর্ণ হয়নি। আসছি।" এই বলে মা ছুট লাগালেন বাগানে। সেখানে শীতের চন্দ্রমল্লিকা ডালিয়া সূর্যমুখী গাঁদার ভিড়। একটা হলুদ গাঁদা তুলে মেয়ের খোঁপায় গুঁজে বললেন, "এইবারে যেন লাগছে, বাসন্তী।" চোখের কোণ থেকে একটু কাজল নিয়ে মেয়ের কপালের এক ধারে লাগিয়ে বললেন, "নজর না লাগে আমার মেয়ের উপর। এত সুন্দর লাগছে।"
নায়িকাও "মা, তুমি প্রত্যেকবার এই বলে বলে আমার সব চান্স বন্ধ করে দাও। তোমার নজর কাটানোর টোটকায় আর কোনো ছেলেই যে আর আমার দিকে তাকায় না। সবাই খালি জ্যান্ত সরস্বতীর খোঁজে ঘুরে বেড়ায়। বাসন্তীর ভিড়ে" বলে আক্ষেপ করতে থাকে।
"বিজয়িনী হও মা। আমার আশীর্বাদ রইলো।" বলে মেয়েকে এগিয়ে দিতে যান মা। মনে মনে বলেন, "দুগ্গা দুগ্গা।"
(বলি কী, এক ঝাঁক সুন্দরীদের ভিড়ে যদি কোনো শান্ত স্নিগ্ধ শুভ্রবসনাকে দেখেন চুপ করে আড়ালে একা একা বসে আছে, একবার কনফার্ম করে নিতে পারেন। বীণাপাণি নয় তো?)
Friday, February 8, 2019
propose day
প্রোপোজ ডে স্পেশাল।
- তখন থেকে বলে যাচ্ছি। আমার কথা কানেই তুলিস না।
- কী যা ইচ্ছে বলে যাবি আর আমায় তা পাত্তা দিতে হবে?
-যা ইচ্ছে মানে? আমার ডিলে কোনো লুপ হোল পেলি তুই?
-বলা নেই কওয়া নেই, খামোখা তোকে প্রোপোজ করতে যাবো কেন?
-কারণ জানতে চাস?
-হুম। অন্তত তিনটে সলিড কারণ। মনোমত না হলে প্রোপোজ টোপজ করছি না।
-বেশ। শোন তবে।
১। তুই বই পড়তে ভালোবাসিস। আমিও। মোটামুটি একই ধরণের। আমরা এক সাথে থাকলে একই বইয়ের দুটো কপি কিনতে হবে না। যে টাকা বাঁচবে সেই টাকায় আরো অনেক বই কেনা যাবে।
-কন্টিনিউ।
-২। তুই হাঙ্গরের মতো খাস। আর আমি পাখির আহার। প্রত্যেকবার রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে দুই প্লেট মাটন বিরিয়ানি অর্ডার করলে, তুই অবধারিত দেড় প্লেট পাবিই।
-সে তো এমনিই এখন পাই।
-ধুর গাধা, আরে সে তো আমি এখনো সিঙ্গল আর তাই তোর সাথে বেরোই বলে। আমি বিয়ে করে নিলে থোড়াই তোর সাথে এত খেতে যাবো। প্লাস ধর তোর বউ যদি রাক্ষসের মতো খায়, তোরই কপালে না শেষে হাফ প্লেট জোটে।
-পয়েন্ট!
-আর লাস্টটা বলি। এই যে তোর জঘন্য জঘন্য পিজেতে আমি হো হো করে হাসি, আর সমান তালে আরো জঘন্য পিজে ক্র্যাক করি, আর তো কেউ আমল দেয় না। স্ট্যান্ড আপ ওপেন মাইকে গিয়ে তো দেখা হয়েই গিয়েছে।
-ট্রু।
-নে, আরো একটা পয়েন্ট ফাউ দিই। মনের মধ্যে যখন ঝড় বয়ে যায় তোর, এদিকে মুখে হাসি। মাথার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিস এদিকে কাজের ডেডলাইন আছে। শেষ করতে হবেই হবে। অসহ্য গেট টুগেদার বা ভুলভাল ডেট থেকে রেসকিউ করতে হয়। তারপর রাত বিরেতে ড্রিঙ্ক করে এসে ভুলভাল মেসেজ করে কান্নাকাটি করিস যখন। এই সমস্ত সময়ে, কে থাকে তোর সাথে?
-তুই।
-এরপরেও আরো কারণ লাগবে?
-এ কী রে, ঠিক করে হাঁটু গেড়ে বসতেও পারছিস না। কী রকম ভুঁড়ি বাগিয়েছিস খালি দেখ। ধ্যাৎ। কাল থেকে সকল সকাল দৌড়তে যাবি।
- বেশ। তার আগে আমায় কথা বলতে দে।
-হুম। বল। ঝটপট।
- দেবী, আমার জীবনের অধিষ্ঠাত্রী হবি? এই দেখ, কেমন পদ্য হয়ে গেল!
-যদি হ্যাঁ বলি, তাহলে কি মাঝে মাঝেই এরকম জঘন্য কবিতা শুনতে হবে?
- উহু। রোজ শোনাবো।
-তাহলে আমি পালাই...
-এই, এই... এই শোন না... গাছে উঠিয়ে মই কেড়ে নিস না। এই...
Thursday, February 7, 2019
এমন বরষার দিনে...
আজকেযে গল্পটি বলবো, তার পটভূমিকা ধরুন ওই ২০০৮ কিংবা ৯। কলকাতা শহর। তখনও ফোর জি আছড়ে পড়েনি শহরে। বাসে ট্রামে গাড়িতে মেট্রোয় তখনও লোকে ইয়ারফোন গুঁজে সদ্য জন্ম নেওয়া গুটি কয়েক প্রাইভেট এফ এম চ্যানেলে মশগুল। আর শোনা যায় যখন তখন যেখানে সেখানে এস এম এসে টুং টাং, টিং টিং। এমন সময়ের এক বৃষ্টিমুখর দিনের গল্প।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। গত দুইদিন ধরে কলকাতা শহরে টানা বৃষ্টি চলছে। এই অসময়ের বৃষ্টি, জাঁকিয়ে শীতটা আবার যেন পড়েছে। সারা রাত বৃষ্টি পড়ে নিস্তার নেই, সকাল হয়ে গিয়েছে। তবুও অঝোরে ঝরেই চলেছে। আকাশ কালো থমথমে। সূর্য ছুটি কাটাচ্ছে। বছর চব্বিশ পঁচিশের এক মেয়ে, রুমুন, হাতে লাল রঙের কাপ নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তা প্রায় খানিকক্ষণ তো হলই। কাপে রয়েছে ওর পছন্দের প্রিয় কফি। জাস্ট দ্য রাইট ওয়ান। দুই চামচ কফি পাউডার, দুই বড় চামচ চিনি আর বাকিটা গরম দুধ ঘেঁটে বানানো ওর পারফেক্ট কাপ অফ কফি। সকাল শুরুই হয়না এটা ছাড়া।
গলফগ্রিনের এই ফ্ল্যাটে রুমুন একাই থাকে। সেই মাস্টার্স পড়ার সময় থেকেই। বাবা মা দুজনে চাকরিসূত্রে আপাতত দিল্লীতে স্থায়ীভাবে রয়েছে। রুমুন মাস্টার্স করেছে যাদবপুর থেকে, এখন একটি বেসরকারি সংস্থায় নতুন চাকরিতে ঢুকেছে। একাই থাকে। রান্নার লোক, কৃষ্ণাদি দু'বেলা এসে ওর জন্য অল্প কিছু রেঁধে বেড়ে দিয়ে যায়। কফি কাপটা হাতে নিয়ে বাইরে দেখতে দেখতে অনেকটা সময় কেটে যায়। ওদের বিল্ডিঙটার সামনেই পরপর অনেকগুলো স্কুলের বাস আর পুলকার আসে। বাচ্চাগুলো সেই কোন সকালবেলা স্নান টান সেরে স্কুলে যায়, বাবা মায়েরা হাত ধরে বাসে গাড়িতে উঠিয়ে যায়। রুমুনের মনে পড়ে যায়। ও যখন ছোট ছিল, বাবা মা দুজনেরই হসপিটালে একেকদিন একেক সময়ের ডিউটি হওয়ায় মানদামাসী ওকে স্কুএল্র জন্য তৈরি করে দিত। লাল স্কারট, সাদা শার্ট পরে গোলাপী লেডিবার্ড সাইকেলটা চালিয়ে যেত স্কুলে। রাস্তায় কত বন্ধুরাও জুতে যেত। আজকে বাসগুলোও নেই, গাড়ির হর্নও নেই। নির্ঘাৎ স্কুলে রেনি ডে দিয়েছে। এইসব সময়ে রুমুন ভীষণ মিস করে স্কুল জীবন, ছোটবেলা। ওরও তো আজকের দিনে ইচ্ছে করছে সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকার, চরম আলসেমি করার। অথচ দেখো, এই এক্ষুণি শুরু হবে দৌড়, যুদ্ধ। তাড়াহুড়ো করে স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট খেয়েই ছোটো অফিস।
অফিস যেতে রুমুনের মোটেই ভালো লাগেনা। তার মূল কারণ ওর খড়ুস বস। লোকটা একেবারে ইয়ে পাবলিক। কথায় কথায় সকলকে ধরে ধরে বকা দেয়। রুমুন নিজেও কতবার বকুনি শুনেছে, তার ইয়ত্তা নেই। বছর তিরিশ বত্রিশ হবে হয়তো বয়স, এদিকে হাবেভাবে ষাটের জেঠু। যখন প্রথম এই অফিসে রুমুন জয়েন করে, সুপুরুষ বস দেখে অত্যন্ত পুলকিত হলেও, দুদিনেই স্বপ্ন চুরমার হয়ে গিয়েছিল ওর। বাবা রে, যতই হ্যান্ডসাম হোক, এমন কড়া লোক। গোমড়া মুখ করে থাকে সর্বক্ষণ। রুমুন এদিকে হাসি খুশি, আমুদে মেয়ে। এক্কেবারে খড়ুসের উল্টো। ওই জন্যই তো ওর কলিগদের সাথে মিলিয়ে নাম দিয়েছে বসের "খড়ুস"। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে এখন আসল নামও মনে আসে না সহজে!
রেডিও শুনতে শুনতে কফি খেতে গিয়ে আজ সাঙ্ঘাতিক লেট হয়ে গিয়েছে। এই রে, বসবার ঘরে দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে রুমুন জিভ কাটল। একেই বৃষ্টির জেরে ট্র্যাফিক জ্যাম হবে, তার ওপর বেরোতেই লেট। আজ কপালে দুর্ভোগ আছে ওর। গলফগ্রিন থেকে সল্ট লেক। এমনি দিনেই এক ঘণ্টা লেগেই যায়। আজ শেষ। "শিয়োর খড়ুসের চোখ রাঙানি খেটেই হবে তোকে রুমুন আজ, প্রেজেন্টেশন ডিউ তো দশটায়। কেউ বাঁচাতে পারলো না আজ তোকে রুমুন।" নিজেই নিজেকে বলতে থাকে ও। অন্যান্যদিন তাও বা ইস্তিরি করা জামাকাপড় পরে বেরোয় ও। আজ তো হাতের কাছে যা পেয়েছে, সেই পরে কোনমতে ছুট লাগালও। একটার পর একটা ট্যাক্সি মুখের ওপর "যাবো না" বলে চলে যাচ্ছে। কী বিরক্তিকর পরিস্থিতি। প্রায় কুড়ি মিনিট অপেক্ষার পর ও ভাবলও, রিক্সা ধরে এইট বি যাবে। সেখান থেকে এস নাইন। এবার সমস্যা। রিক্সার দেখা নেই। ছাতা মাথায় এদিক সেদিক করেও লাভ নেই। ত্রিসীমানায় একটা রিক্সার দেখা নেই। হাত কামড়ানোর অবস্থা যখন রুমুনের, হঠাৎ দেখতে পেল দূরে একটা রিক্সা আসছে, অবশ্য এমন প্লাস্টিক জড়ানো, বোঝার উপায় নেই তাতে সওয়ারী আছে না নেই। তবে যা অবস্থা এখন, চেষ্টা করতেই হবে। কোনমতে লাল ছাতাটা খুলে দৌড়ে রাস্তা পার হতে এগোল রুমুন। এবং তারপর? ব্যস, যা ভবিতব্য, ঠিক তাইই হল।
রুমুন সুন্দরী, বুদ্ধিদীপ্তা ইত্যাদি আরো নানান বিশেষণে বিভূষিত হলেও কেউ ওকে কখনও সুতন্বী বলতে পারবে না। বরং একটু গোলগাল ভারিই চেহারা ওর। এর ফলে ওকে একটু বেশিই মিষ্টি লাগে দেখতে। তবে সব ভালোর মধ্যে একটা বেজায় খারাপ রকএম্র সাইড এফেক্ট আছে। ও যখন তখন যেখানে সেখানে ধুপধাপ করে উল্টে পড়ে যায়। তা যেই মেয়ে শুকনো ডাঙ্গায় পড়তে কারণ খোঁজে না, যার সেন্টার অফ গ্র্যাভিটি অন্যদের থেকে একটু অতিরিক্ত মাত্রায় বিচ্যুত, সে যে এমন বর্ষার দিনে জলে থইথই রাস্তায় পড়বে না, তা কখনও হয়? ঝপাৎ করে জলের ওপর পড়ল ও। ভাগ্যিস বেশি কাঁদা ছিল না, এই রক্ষে। তবে টের পেল বাঁ পায়ের গোড়ালিতে ভালোই লেগেছে। মচকেই গিয়েছে হয়তো। আর সাথে সাথে জুতোর স্ট্র্যাপ ছিঁড়েছে। রিক্সাও না থেমে চলে গিয়েছে ইতিমধ্যে। কী বিব্রত অবস্থা। ধুর, ভাল্লাগেনা। রুমুনের দুই চোখ ছাপিয়ে জল এসে যাওয়ার জোগাড়। ফ্ল্যাটে ফিরে জামা জুতো বদল করে অফিস যেতে গেলে যা লেট হবে, তার চেয়ে একটা সিক লিভ নিয়ে নেওয়া ভালো। এদিকে যে আজ প্রেজেন্টেশন? সেটা?
ভিজে স্নান, মচকানো পা নিয়ে ল্যাজে গোবরে অবস্থা এখন রুমুনের। কোনমতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চারতলায় উঠল ও। ফ্ল্যাটের দরজায় চাবি খুলে বসার ঘরের সোফায় ব্যাগটা রেখে একটু গা এলিয়ে তবে শান্তি। আস্তে করে পা তুলবার চেষ্টা করল ও। ইতিমধ্যে ফুলে ঢোল। ভাঙেনি তো আবার? তাহলে চরম অসুবিধেয় পড়বে। লক্ষন ভালো না। আশু চিকিৎসার প্রয়োজন। আবার ভিজে জামাকাপড় পালটাতে হবে। হাঁচি কাশি এই এলো বলে। কান্না পাচ্ছে রুমুনের। একা বাড়িতে অসুস্থ ও। কেউ নেই একটু সাহায্য করবে যে। কৃষ্ণাদিও ডুব দিয়েছে।
পা টেনে কোনমতে নিজের ঘরে গিয়ে জামা বদলে সবে মাথাটা টাওয়েলে মুছছে, এমন সময় মোবাইলে তারস্বরে "এসো শ্যামল সুন্দর" বেজে উঠল সরোদে। রুমুনের খুব প্রিয় দুটি মিউজিক জনর - ক্লাসিকাল ইন্সট্রুমেন্টাল আর রবীন্দ্রসঙ্গীত। এই দুইয়ের অপূর্ব মেলবন্ধন ওর ফোনের রিংটোন। অফিসের কন্ট্যাক্ট, বন্ধুরা, ফ্যামিলি - একেক গ্রুপের একেক রিংটোন। অফিসে তাই রুমুনের ডেস্কটা একটা যেন মিউজিকাল জোন। ফোনটা পড়ে আছে ড্রয়িং রুমে। খুঁড়িয়ে লেংচিয়ে ও ঘরে পৌঁছতে পৌঁছতে ফোন বেজে বেজে থেমেই গেল। হাতে নিয়ে দেখল লেখা খড়ুসের নাম। মিসড কল। মোবাইলের ডিসপ্লেতে জ্বলজ্বল করছে সকাল সাড়ে দশটা। বেশ কয়েক গুন বেড়ে গেল রুমুনের হার্টবিট। এই রে, এইবারে একটা বড় রকমের ঝাড় খেতে চলেছে ও। পৃথিবীর আর কোন শক্তিই ওকে বাঁচাতে পারবে না। হে ভগবান, ভূমিকম্প এনে দাও। এনে দাও ঝর ঝঞ্ঝা।
ভয়ে ভয়ে রুমুন কীপ্যাড আনলক করে কল ব্যাক করলো। খড়ুসকে কেন জানি না রুমুন ভীষণ ভয় পায়। সেটা কী উনি সারাক্ষণ গম্ভীর মুখ করে থাকেন বলে? হাসেন না, তেমন বাহবে গল্প টল্পও করেন না কারুর সাথে।
বাবা, কলার টিউন লাগানো, তাও রবীন্দ্রসংগীত। আলো আমার আলো। ইন্টারেস্টিং! খড়ুস আবার গান বাজনাও শোনে? ভালোবাসে? দেখে তো মনে হয় না। কে জানে। ভগবান, প্লিজ যেন খড়ুস আমার ওপর না চিৎকার করে, প্লিজ ঠাকুর, প্লিজ। হুম, গান বেজে বেজে শেষ হয়ে গেল। ভগবান আজ প্রসন্ন নাকি? বস ফোন আন্সার করলেন না। কে রে বাবা, নিজে এক্ষুণি কল করে আবার নিজেই আন্সার করছে না। অদ্ভুত তো। যাক গে। ফোনটা সবে কান থেকে নামিয়েছে কি নামায়নি, অমনি সরোদ বেজে উঠল রুমুনের ফোনে। নামটা দেখে "হ্যাঁ স্যর, বলুন" বলেছে কি বলেনি, অমনি উল্টোদিক থেকে ভেসে এলো বাক্যবাণ। "মিস দাশগুপ্ত, আপনার ব্যাপারটা কী বলুন তো? সাড়ে দশটা বেজে গিয়েছে। এখনও ডেস্কে নেই। প্রেজেন্টেশন দেওয়ার কথা আজ, সেটাও আমায় দেখালেন না। ওয়াটস দ্য ম্যাটার?"
এই মুস্কিল। রুমুন ভাবে অনেক কিছু বলবে। এমন কী, ফোন ছেড়ে দেওয়ার পরও ফটফট করে অনেক কথা বলতে পারবে, কিন্তু আসল সময়ে গিয়ে স্পিক্টি নট। খড়ুসের কথার কোন জবাব নেই।
"কী হলো? হ্যালো? মিস দাশগুপ্ত, আপনি শুনতে পারছেন?"
এইবারে রুমুন আমতা আমতা করে বলল, "হ্যাঁ মানে, আসলে স্যর আমি আজ ছুটি নিয়েছি। মানে..." রুমুনের কথা শেষ না করতে দিয়েই খড়ুস বস বলে উঠল, "ছুটি মানে? কেন? কবে? কার পারমিশন নিয়ে?"
রুমুনের বলা উচিত ছিল, "অসুস্থ হয়ে পড়েছি হঠাৎ, মেডিকেল রিজনে ছুটি নিয়েছি। মেল করে দিচ্ছি এইচ আরে। প্রেজেন্টেশন মেল করে দেবো।" কিন্তু রুমুন তা বলতে পারল না। কী বলল? নারভাস কন্ঠে বলল, "আসলে স্যর একটু অসুবিধে হয়ে গিয়েছে। আমি এই এক্ষুণি জানিয়েই দিচ্ছিলাম। প্রেজেন্টেশন্টা পাঠাচ্ছি এক্ষুণি। রেডি আছে।"
"আচ্ছা ইরেস্পন্সিবল তো আপনি মিস দাশগুপ্ত। দুদিন বাদে ক্লায়েন্টকে প্রেজেন্ট করতে হবে, তার আগে কোথায় আজ ফাইনাল করব ব্যাপারটা, আপনি আজকেই অ্যাবসেন্ট। রিয়েলি, আনবিলিভেবল।"
"সরি স্যর। আমি এক্ষুণি পাঠাচ্ছি।" কোনমতে বলেই রুমুন ফোন কেটে দিল। কী যে হয়েছে আজকাল ওর, কথায় কথায় চোখ ফেটে জল আসে। হাপুস নয়নে কাঁদতে বসল।
টুং টাং করে দু তিনবার ফোনে এস এম এস ঢুকল। একটা ওর কলিগ মালবিকার। কেন আসেনি অফিস, জানতে চেয়েছে। আর বাকি খড়ুসের। উফ। একটুও শান্তি দেবে না কেউ। দশ মিনিটও হয়নি, মেসেজ ঢুকেছে খড়ুসের। প্রেজেন্টেশন চেয়ে। চোখ মুছে ল্যাপটপ চালু করে ঝটপট মেল করল ও। শুধুমাত্র সাবজেক্টে "ইয়োর প্রেজন্টেশন" লিখে অ্যাটাচমেন্টে ফাইলটা। মেলে একটা বাড়তি কথা নেই।
এবারে রুমুন একটু খুড়িয়ে উঠে নিজের ঘরে গেল। ফার্স্ট এডের বাক্সটা ওখানেই। বাথ্রুমে গিয়ে একবার গীজার চালিয়ে ওষুধের বাক্স থেকে পেন কিলারের পাতা বের করল। সাথে নিল পেন রিলিভিং জেল আর ব্যান্ডেজ। কল খুলে গরম জল বালতিতে ভরে একটু পা ডুবিয়ে যদি আরাম পাওয়া যায়। তারপর ওষুধ লাগিয়ে রেস্ট। একা একা এমন মুহূর্তগুলোয় খুব অসহায় লাগে রুমুনের। কেউ নেই পাশে, একটু সেবা শুশ্রূষা করার। বা অন্তত খেয়াল নেওয়ার।
সেঁক দিয়ে ওষুধ লাগিয়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ জড়িয়ে রুমুন মোবাইলটা নিয়ে বসল। অফিসে একবার মালবিকাকে ফোন করে বলে দেবে, এইচ আরে জানিয়ে দিতে ছুটির ব্যাপারে। অবশ্য এতক্ষণে হয়তো খড়ুস ওর নামে কমপ্লেন ঠুকে দিয়েছে। কে জানে বাবা। মালবিকা রুমুনের অফিস কলিগদের মধ্যে বেস্ট ফ্রেন্ড। কাছাকাছি বয়সী বলে বন্ডিংটা দারুণ। তবে সবচেয়ে বেশি ভাব কারণ ওরা দুজনেই খড়ুসকে সমানভাবে অপছন্দ করে।
"হ্যালো। মালো?"
"বলো রুমুনদি। আজ এলে না কেন? তোমায় মেসেজ করেছিলাম।"
"হ্যাঁ আর বলিস না। অফিস যাবো বলে রেডি হয়ে নীচে দাঁড়িয়ে আছি। রিক্সা ধরতে গিয়ে উল্টে পড়ে পা মচকে একশা। আবার তার ওপর ভিজেওছি। হাঁচি শুরু হয়েছে সাথে। ওরে বাবা রে, হ্যাঁচ্চো। হ্যাঁচ্চো। হুম। দেখছিস? ওই জন্যই যাইনি।"
"এদিকে তোমার খড়ুস তো তোমায় চোখে হারাচ্ছিলো। বারবার এসে মিস দাশগুপ্ত কোথায়, মিস দাশগুপ্ত এখনো এলো না কেন করে যাচ্ছিল।"
"চুপ কর। চোখে হারানো না ছাই। প্রেজেন্টেশন দেওয়ার ছিল আমার। তাই। আমায় ফোন করে পঞ্চাশটা কথা শুনিয়ে দিয়েছে জানিস। উফ বাবা রে। কী কর্কশ কী কর্কশ লোক। সারাদিন করলা সিদ্ধ খায় মনে হয়।"
"হিহি! ওষুধ টোশুধ কিছু লাগলে বলো। যাবো সন্ধ্যায়। বাবা রে, কী বৃষ্টি বলো দি।"
"হ্যাঁ। ওই তো হলো আমার কাল। যাক গে। তুই কাজ কর। আবার লোকটা তোকে ফোনে দেখলে ঝাড় দিতে আসবে।"
"হুম। তাই না তাই। তুমি সাবধানে থেকো রুমুনদি। ব্যথার ওষুধ খেয়ো। টেক কেয়ার। বাই।"
"হুম। বাই।"
ফোন ছেড়ে রুমুন দেখল একটা এস এম এস ঢুকেছে ফোনে। খড়ুসের। লেখা "ওয়েল ডান। নো কারেকশন্স নিডেড।" হুহ! তবে? এটা রুমুন দাশগুপ্তর কাজ হে, কোনো খুঁত খুঁজে পাবে না কেউ। নির্ভুল কাজ। ফালতু ফালতু কথা শুনিয়ে দিলো। আর রুমুনও বলিহারি যাই। উত্তর দিতে আর শিখলো না। ক্যাবলা হয়েই রয়ে গেল। ধুর। কোথায় এস এম এসের রিপ্লাইতে এইসব কড়া করে ডোজ দেবে, তা না। শুধু "ওকে। থ্যাংকস" লিখে ছেড়ে দিলো।
মেসেজের ডেলিভারি রিপোর্ট আসার আগেই মালবিকার এস এম এস।
"কখন যে লোকটা কিউবিকলে এসেছিল, টের পাইনি। কে জানে কত কী শুনলো। জিজ্ঞেস করলো তোমার কী হয়েছে। বললাম সব। একটু ও আচ্ছা বলে বেরিয়ে গেল। কোথায় গেল, জানিনা।"
মালবিকার এই স্বভাব। শর্ট করে লিখতেই পারেনা। যার ফলে এই কথাটা আসতে অন্তত চারবার ফোনে টুং টাং হলো। রুমুন লিখলো উত্তরে, "মরুক গে যা। যে চুলোয় ইচ্ছে যাক।"
অনেকদিন পর হঠাৎ একটা এরকম ছুটি পেয়েছে রুমুন। পায়ে ব্যথা। রেস্ট দেওয়ার দরকার খুব। বৃষ্টিও পড়েই চলেছে। তাই বেরোনোর কোনো সিন নেই। দুপুরের রান্না করার ক্ষমতা নেই। ম্যাগি করে নেবে খন মাইক্রোতে। রিমোটটা হাতে নিয়ে টিভি চালালো ও। এ চ্যানেল ও চ্যানেল পরপর ঘুরেই যাচ্ছে। সর্বত্র শুধু প্রেমের গান আর প্রেমের সিনেমা। ভাল্লাগেনা। ব্রেকআপের পর থেকে এই সব ভীষণ বিরক্ত লাগে রুমুনের। পারদপক্ষে এড়িয়েই চলে। কিন্তু আজ কিচ্ছু করার নেই। ভ্যালেন্টাইনস ডে বলে কথা। সব চ্যানেলেই এই দেখাবে। খবরের চ্যানেলেও কোথায় কোন পার্কে কোন যুগলকে কে হ্যারাস করলো আর কোন সেলিব্রিটি কার সাথে কোথায় ঘুরছে। পারেও বটে ওরা।
কী করবে কী করবে? বেশ। ওয়ার্ল্ড সার্ভিস রেডিওতে একটু গান শুনলে হয়। রুমুন গান ভালোবাসে বলে গত বছর জন্মদিনে বাবা এইটির ব্যবস্থা করে দেয়। কত রকমের চ্যানেল। ভাষা কত। খুব পছন্দ এটা ওর। ইনস্টিউমেন্টাল মিউজিকের চ্যানেলটি চালালো। আহা, দরবারী কানাড়া বাজাচ্ছেন কেউ। এক রাশ মুগ্ধতা।
কখন যে বাজনা শুনতে শুনতে একটু ঘুম এসে গিয়েছিল, কে জানে। মোবাইলের আওয়াজে ধড়ফড় করে উঠলো ও। হাতে নিয়ে দেখল খড়ুস ফোন করছে। আবার কী হল। আর পারা যায় না। ধ্যাৎ।
কোনোমতে ফোনটা রিসিভ করে বললো, "হ্যাঁ স্যর বলুন।"
উত্তর এলো, " ডাব্লু আই বি আর ১২ বাই এইট, এটাই আপনার এড্রেস তো?"
সে কী, ঠিকানা পেলো কোত্থেকে। কী দাবি আবার? রুমুন ঘাবড়ে গিয়ে বলল, "হ্যাঁ।।ওটাই। কেন?"
"দশ মিনিটের ওপর বেল বাজিয়ে যাচ্ছি। দরজাটা খুলুন।"
এহ? বলে কী? এখানে? কী হলো?"
ভেবলে ভ রুমুন। "হ্যাঁ আসছি। একটু দাঁড়ান।" বলে রুমুন উঠলো। ভয় উত্তেজনা সব মিলিয়ে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বাঁ পায়ে চোটের ওপরেই চাপ দিয়ে ফেলল। আর তখুনি "আহ" বলে চেঁচালো।
একটু বেশিই জোরে হয়ে গেল নাকি?
বাইরে শোনা গেল। খড়ুস "সাবধানে মিস দাশগুপ্ত" বলল একটু অস্থির হয়েই।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে রুমুন দরজা খুলে "আসুন। বসুন। বলুন কী হয়েছে" বলে দাঁড়িয়ে রইলো।
"আরে দাঁড়িয়ে রইলেন কেন। আপনার পায়ে ব্যথা। আপনি বসুন।" খড়ুস ওর দিকে এগিয়ে এলো। ধরে বসাতে। বাবাঃ, দরদ! হুহ!
"না ঠিক আছে। আপনি বসুন স্যর। বলুন কী হয়েছে।"
"আসলে আমি অ্যাপলোজাইস করতে এসেছি।"
"অ্যাপলোজাইস? কেন? কীসের? কাকে?"
"উফ মিস দাশগুপ্ত, আপনি বড্ড প্রশ্ন করেন।"
"সরি।" ধুর, যখন কথা বলার দরকার, মুখ ফুটে কথা বেরোয় না। আর এদিকে দেখো, এখন চুপচাপ শুনে যাওয়া উচিত, তা না, মেয়ের মুখে বুলি ছুটছে। ছি রুমুন, কবে যে তোর কোন সেন্স হবে? নিজের মনেই নিজেকে শাসন করতে থাকে রুমুন।
"না না, ওটা কথার কথা।"
"না মানে কথার কথা না। মানে, আমি সত্যিই সরি।" ভেব্লে গিয়ে রুমুন বলল। ব্যাপারটা কী হচ্ছে আজ? সাধারণত নার্ভাস থাকে ও, কিন্তু তা বলে এরকম যাকে বলে ছড়িয়ে ছ তো করে না। এটা কি তাহলে এই ব্লু ফর্মাল শার্ট আর সাঙ্ঘাতিক রকমের ভালো পারফ্যুমের এফেক্ট? অন্যান্য দিন খড়ুসকে দেখে যতটা ইরিটেশন হয়, কই এখন কিন্তু হচ্ছে না। উল্টে একটু যেন আদেখলাপনা করে বারবার ওর দিকে তাকাতেই ইচ্ছে করছে রুমুনের। ছ্যাঃ রুমুন। কী হল টা কী? পায়ে চোট এভাবে ব্রেনকে অ্যাফেক্ট করে নাকি? সাইন্সের বন্ধুদের বলতে হবে, রিসার্চ করতে। সেরোটোনিন ডোপামিনগুলো বেইমানি করছে নাকি?
"না না ভুল বুঝছেন মিস দাশগুপ্ত। যাই হোক, ব্যাপারটা হল তখন প্রেজেন্টেশন নিয়ে আমি খুব চিন্তিত ছিলাম। তাই আপনার ওপর একটু বেশিই কড়া হয়ে গিয়েছিলাম। আপনি যে জেনুইনলি অসুস্থ, সেটা বুঝিনি। না জেনেই চেঁচালাম আপনার ওপর।"
"আর তাই বুঝি এখন এসেছেন ইন্সপেক্ট করতে? যে মালবিকা যা বলেছে, সত্যি না মিথ্যে। যাচাই করতে এসেছেন?"
এই রে, রুমুন অন ফায়ার! কী হল? নিজেই যে অবাক। এসব কী বলে চলেছে।
"এ বাবা মিস দাশগুপ্ত, একদমই তা না। বলছি তো। আয়াম এক্সট্রিমলি সরি। আমি আসলে সত্যিই ক্ষমা চাইতে এসেছি। এই যে দেখুন, একটা কার্ড এনেছি। এই যে, সরি লেখা।" এই বলে খড়ুস পিঠের ব্যাগ থেকে একটা বেগুনি রঙের খাম বের করলো। রুমুন হাতে নিয়ে দেখল, মিষ্টি একটা টেডি বিয়ার। হাতে এক গুচ্ছ বেলুন। কাচুমুচু মুখ করে সরি বলছে। আর রাগ টাগ জমিয়ে রাখতেই পারল না ও। এক্কেবারে হেসে ফেলল।
রুমুনকে হাসতে দেখে খড়ুসও নিশ্চিন্ত। উফ। এম বি এর অ্যাসাইনমেন্ট এর চেয়ে ঢের সোজা। এতক্ষণ তো ভয়ে জেরবার হয়ে ছিল। কীভাবে রুমুনের কাছে ক্ষমা চাইবে, কথাই বা বলবে কী করে। আসলে কাজ পাগল তো ভীষণ, তাই প্রেজেন্টেশনের চিন্তায় এক্কেবারে চ্যাপ্টা হয়ে গিয়েছিল। আর তাই না বুঝে শুনে রুমুনের ওপর চিৎকারও করে ফেলেছে। তারপরে মালবিকার কাছে যখন জানতে পারল, রীতিমতো কুণ্ঠিত বোধ করছিল। আসলে খড়ুস আমাদের মানুষটা বেজায় ভালো। শুধু অভিব্যক্তিগুলো প্রকাশ করতে পারে না। আর তাই এমন নামকরণের শিকার। আসল নাম যে অফিসের কটা স্টাফ মনে রেকেহছে কে জানে। ও জানে, সবাই আড়ালে ওকে একেক রকম নামে ডাকে।
যাক গে। মিটমাট যখন হয়েই গিয়েছে, আর ডিস্টার্ব করে লাভ নেই ওদের। নিজের গাড়ি নিয়েই এসেছে যখন, এবার একটু রুমুনকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাক। পা মালিশ করে দিক। সেবা শুশ্রূষা করুক। ভালো দিনেই দেবীর চরণে স্থান পেল দেখছি!
রুমুনও বেশ খুশি। এক্সট্রা আহ্লাদিত আর কী। এই তো, এত অ্যাটেনশন পাচ্ছে, বেশ লাগছে কিন্তু। একেবারে রাণীর মতো সেবা, আহা। আবার তার সাথে উপরি পাওনা হয়েছে, মিউজিক ওয়ার্ল্ড থেকে কিনে আনা "মনসুন রাগাস" নামের সিডি। শুনছে খড়ুসের তেমন কাজ নেই অফিসে। প্রেজেন্টেশন তো পারফেক্ট আছে। বাইরে বৃষ্টিও পড়েই চলেছে। বলবে নাকি ওকে থেকে যেতে? সারাদিনই তো টিভির সব চ্যানেলে বেশ মাখো মাখো সিনেমা চলছে। একসাথে দেখলে মন্দ হয় নয়। তাই না?
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। গত দুইদিন ধরে কলকাতা শহরে টানা বৃষ্টি চলছে। এই অসময়ের বৃষ্টি, জাঁকিয়ে শীতটা আবার যেন পড়েছে। সারা রাত বৃষ্টি পড়ে নিস্তার নেই, সকাল হয়ে গিয়েছে। তবুও অঝোরে ঝরেই চলেছে। আকাশ কালো থমথমে। সূর্য ছুটি কাটাচ্ছে। বছর চব্বিশ পঁচিশের এক মেয়ে, রুমুন, হাতে লাল রঙের কাপ নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তা প্রায় খানিকক্ষণ তো হলই। কাপে রয়েছে ওর পছন্দের প্রিয় কফি। জাস্ট দ্য রাইট ওয়ান। দুই চামচ কফি পাউডার, দুই বড় চামচ চিনি আর বাকিটা গরম দুধ ঘেঁটে বানানো ওর পারফেক্ট কাপ অফ কফি। সকাল শুরুই হয়না এটা ছাড়া।
গলফগ্রিনের এই ফ্ল্যাটে রুমুন একাই থাকে। সেই মাস্টার্স পড়ার সময় থেকেই। বাবা মা দুজনে চাকরিসূত্রে আপাতত দিল্লীতে স্থায়ীভাবে রয়েছে। রুমুন মাস্টার্স করেছে যাদবপুর থেকে, এখন একটি বেসরকারি সংস্থায় নতুন চাকরিতে ঢুকেছে। একাই থাকে। রান্নার লোক, কৃষ্ণাদি দু'বেলা এসে ওর জন্য অল্প কিছু রেঁধে বেড়ে দিয়ে যায়। কফি কাপটা হাতে নিয়ে বাইরে দেখতে দেখতে অনেকটা সময় কেটে যায়। ওদের বিল্ডিঙটার সামনেই পরপর অনেকগুলো স্কুলের বাস আর পুলকার আসে। বাচ্চাগুলো সেই কোন সকালবেলা স্নান টান সেরে স্কুলে যায়, বাবা মায়েরা হাত ধরে বাসে গাড়িতে উঠিয়ে যায়। রুমুনের মনে পড়ে যায়। ও যখন ছোট ছিল, বাবা মা দুজনেরই হসপিটালে একেকদিন একেক সময়ের ডিউটি হওয়ায় মানদামাসী ওকে স্কুএল্র জন্য তৈরি করে দিত। লাল স্কারট, সাদা শার্ট পরে গোলাপী লেডিবার্ড সাইকেলটা চালিয়ে যেত স্কুলে। রাস্তায় কত বন্ধুরাও জুতে যেত। আজকে বাসগুলোও নেই, গাড়ির হর্নও নেই। নির্ঘাৎ স্কুলে রেনি ডে দিয়েছে। এইসব সময়ে রুমুন ভীষণ মিস করে স্কুল জীবন, ছোটবেলা। ওরও তো আজকের দিনে ইচ্ছে করছে সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকার, চরম আলসেমি করার। অথচ দেখো, এই এক্ষুণি শুরু হবে দৌড়, যুদ্ধ। তাড়াহুড়ো করে স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট খেয়েই ছোটো অফিস।
অফিস যেতে রুমুনের মোটেই ভালো লাগেনা। তার মূল কারণ ওর খড়ুস বস। লোকটা একেবারে ইয়ে পাবলিক। কথায় কথায় সকলকে ধরে ধরে বকা দেয়। রুমুন নিজেও কতবার বকুনি শুনেছে, তার ইয়ত্তা নেই। বছর তিরিশ বত্রিশ হবে হয়তো বয়স, এদিকে হাবেভাবে ষাটের জেঠু। যখন প্রথম এই অফিসে রুমুন জয়েন করে, সুপুরুষ বস দেখে অত্যন্ত পুলকিত হলেও, দুদিনেই স্বপ্ন চুরমার হয়ে গিয়েছিল ওর। বাবা রে, যতই হ্যান্ডসাম হোক, এমন কড়া লোক। গোমড়া মুখ করে থাকে সর্বক্ষণ। রুমুন এদিকে হাসি খুশি, আমুদে মেয়ে। এক্কেবারে খড়ুসের উল্টো। ওই জন্যই তো ওর কলিগদের সাথে মিলিয়ে নাম দিয়েছে বসের "খড়ুস"। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে এখন আসল নামও মনে আসে না সহজে!
রেডিও শুনতে শুনতে কফি খেতে গিয়ে আজ সাঙ্ঘাতিক লেট হয়ে গিয়েছে। এই রে, বসবার ঘরে দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে রুমুন জিভ কাটল। একেই বৃষ্টির জেরে ট্র্যাফিক জ্যাম হবে, তার ওপর বেরোতেই লেট। আজ কপালে দুর্ভোগ আছে ওর। গলফগ্রিন থেকে সল্ট লেক। এমনি দিনেই এক ঘণ্টা লেগেই যায়। আজ শেষ। "শিয়োর খড়ুসের চোখ রাঙানি খেটেই হবে তোকে রুমুন আজ, প্রেজেন্টেশন ডিউ তো দশটায়। কেউ বাঁচাতে পারলো না আজ তোকে রুমুন।" নিজেই নিজেকে বলতে থাকে ও। অন্যান্যদিন তাও বা ইস্তিরি করা জামাকাপড় পরে বেরোয় ও। আজ তো হাতের কাছে যা পেয়েছে, সেই পরে কোনমতে ছুট লাগালও। একটার পর একটা ট্যাক্সি মুখের ওপর "যাবো না" বলে চলে যাচ্ছে। কী বিরক্তিকর পরিস্থিতি। প্রায় কুড়ি মিনিট অপেক্ষার পর ও ভাবলও, রিক্সা ধরে এইট বি যাবে। সেখান থেকে এস নাইন। এবার সমস্যা। রিক্সার দেখা নেই। ছাতা মাথায় এদিক সেদিক করেও লাভ নেই। ত্রিসীমানায় একটা রিক্সার দেখা নেই। হাত কামড়ানোর অবস্থা যখন রুমুনের, হঠাৎ দেখতে পেল দূরে একটা রিক্সা আসছে, অবশ্য এমন প্লাস্টিক জড়ানো, বোঝার উপায় নেই তাতে সওয়ারী আছে না নেই। তবে যা অবস্থা এখন, চেষ্টা করতেই হবে। কোনমতে লাল ছাতাটা খুলে দৌড়ে রাস্তা পার হতে এগোল রুমুন। এবং তারপর? ব্যস, যা ভবিতব্য, ঠিক তাইই হল।
রুমুন সুন্দরী, বুদ্ধিদীপ্তা ইত্যাদি আরো নানান বিশেষণে বিভূষিত হলেও কেউ ওকে কখনও সুতন্বী বলতে পারবে না। বরং একটু গোলগাল ভারিই চেহারা ওর। এর ফলে ওকে একটু বেশিই মিষ্টি লাগে দেখতে। তবে সব ভালোর মধ্যে একটা বেজায় খারাপ রকএম্র সাইড এফেক্ট আছে। ও যখন তখন যেখানে সেখানে ধুপধাপ করে উল্টে পড়ে যায়। তা যেই মেয়ে শুকনো ডাঙ্গায় পড়তে কারণ খোঁজে না, যার সেন্টার অফ গ্র্যাভিটি অন্যদের থেকে একটু অতিরিক্ত মাত্রায় বিচ্যুত, সে যে এমন বর্ষার দিনে জলে থইথই রাস্তায় পড়বে না, তা কখনও হয়? ঝপাৎ করে জলের ওপর পড়ল ও। ভাগ্যিস বেশি কাঁদা ছিল না, এই রক্ষে। তবে টের পেল বাঁ পায়ের গোড়ালিতে ভালোই লেগেছে। মচকেই গিয়েছে হয়তো। আর সাথে সাথে জুতোর স্ট্র্যাপ ছিঁড়েছে। রিক্সাও না থেমে চলে গিয়েছে ইতিমধ্যে। কী বিব্রত অবস্থা। ধুর, ভাল্লাগেনা। রুমুনের দুই চোখ ছাপিয়ে জল এসে যাওয়ার জোগাড়। ফ্ল্যাটে ফিরে জামা জুতো বদল করে অফিস যেতে গেলে যা লেট হবে, তার চেয়ে একটা সিক লিভ নিয়ে নেওয়া ভালো। এদিকে যে আজ প্রেজেন্টেশন? সেটা?
ভিজে স্নান, মচকানো পা নিয়ে ল্যাজে গোবরে অবস্থা এখন রুমুনের। কোনমতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চারতলায় উঠল ও। ফ্ল্যাটের দরজায় চাবি খুলে বসার ঘরের সোফায় ব্যাগটা রেখে একটু গা এলিয়ে তবে শান্তি। আস্তে করে পা তুলবার চেষ্টা করল ও। ইতিমধ্যে ফুলে ঢোল। ভাঙেনি তো আবার? তাহলে চরম অসুবিধেয় পড়বে। লক্ষন ভালো না। আশু চিকিৎসার প্রয়োজন। আবার ভিজে জামাকাপড় পালটাতে হবে। হাঁচি কাশি এই এলো বলে। কান্না পাচ্ছে রুমুনের। একা বাড়িতে অসুস্থ ও। কেউ নেই একটু সাহায্য করবে যে। কৃষ্ণাদিও ডুব দিয়েছে।
পা টেনে কোনমতে নিজের ঘরে গিয়ে জামা বদলে সবে মাথাটা টাওয়েলে মুছছে, এমন সময় মোবাইলে তারস্বরে "এসো শ্যামল সুন্দর" বেজে উঠল সরোদে। রুমুনের খুব প্রিয় দুটি মিউজিক জনর - ক্লাসিকাল ইন্সট্রুমেন্টাল আর রবীন্দ্রসঙ্গীত। এই দুইয়ের অপূর্ব মেলবন্ধন ওর ফোনের রিংটোন। অফিসের কন্ট্যাক্ট, বন্ধুরা, ফ্যামিলি - একেক গ্রুপের একেক রিংটোন। অফিসে তাই রুমুনের ডেস্কটা একটা যেন মিউজিকাল জোন। ফোনটা পড়ে আছে ড্রয়িং রুমে। খুঁড়িয়ে লেংচিয়ে ও ঘরে পৌঁছতে পৌঁছতে ফোন বেজে বেজে থেমেই গেল। হাতে নিয়ে দেখল লেখা খড়ুসের নাম। মিসড কল। মোবাইলের ডিসপ্লেতে জ্বলজ্বল করছে সকাল সাড়ে দশটা। বেশ কয়েক গুন বেড়ে গেল রুমুনের হার্টবিট। এই রে, এইবারে একটা বড় রকমের ঝাড় খেতে চলেছে ও। পৃথিবীর আর কোন শক্তিই ওকে বাঁচাতে পারবে না। হে ভগবান, ভূমিকম্প এনে দাও। এনে দাও ঝর ঝঞ্ঝা।
ভয়ে ভয়ে রুমুন কীপ্যাড আনলক করে কল ব্যাক করলো। খড়ুসকে কেন জানি না রুমুন ভীষণ ভয় পায়। সেটা কী উনি সারাক্ষণ গম্ভীর মুখ করে থাকেন বলে? হাসেন না, তেমন বাহবে গল্প টল্পও করেন না কারুর সাথে।
বাবা, কলার টিউন লাগানো, তাও রবীন্দ্রসংগীত। আলো আমার আলো। ইন্টারেস্টিং! খড়ুস আবার গান বাজনাও শোনে? ভালোবাসে? দেখে তো মনে হয় না। কে জানে। ভগবান, প্লিজ যেন খড়ুস আমার ওপর না চিৎকার করে, প্লিজ ঠাকুর, প্লিজ। হুম, গান বেজে বেজে শেষ হয়ে গেল। ভগবান আজ প্রসন্ন নাকি? বস ফোন আন্সার করলেন না। কে রে বাবা, নিজে এক্ষুণি কল করে আবার নিজেই আন্সার করছে না। অদ্ভুত তো। যাক গে। ফোনটা সবে কান থেকে নামিয়েছে কি নামায়নি, অমনি সরোদ বেজে উঠল রুমুনের ফোনে। নামটা দেখে "হ্যাঁ স্যর, বলুন" বলেছে কি বলেনি, অমনি উল্টোদিক থেকে ভেসে এলো বাক্যবাণ। "মিস দাশগুপ্ত, আপনার ব্যাপারটা কী বলুন তো? সাড়ে দশটা বেজে গিয়েছে। এখনও ডেস্কে নেই। প্রেজেন্টেশন দেওয়ার কথা আজ, সেটাও আমায় দেখালেন না। ওয়াটস দ্য ম্যাটার?"
এই মুস্কিল। রুমুন ভাবে অনেক কিছু বলবে। এমন কী, ফোন ছেড়ে দেওয়ার পরও ফটফট করে অনেক কথা বলতে পারবে, কিন্তু আসল সময়ে গিয়ে স্পিক্টি নট। খড়ুসের কথার কোন জবাব নেই।
"কী হলো? হ্যালো? মিস দাশগুপ্ত, আপনি শুনতে পারছেন?"
এইবারে রুমুন আমতা আমতা করে বলল, "হ্যাঁ মানে, আসলে স্যর আমি আজ ছুটি নিয়েছি। মানে..." রুমুনের কথা শেষ না করতে দিয়েই খড়ুস বস বলে উঠল, "ছুটি মানে? কেন? কবে? কার পারমিশন নিয়ে?"
রুমুনের বলা উচিত ছিল, "অসুস্থ হয়ে পড়েছি হঠাৎ, মেডিকেল রিজনে ছুটি নিয়েছি। মেল করে দিচ্ছি এইচ আরে। প্রেজেন্টেশন মেল করে দেবো।" কিন্তু রুমুন তা বলতে পারল না। কী বলল? নারভাস কন্ঠে বলল, "আসলে স্যর একটু অসুবিধে হয়ে গিয়েছে। আমি এই এক্ষুণি জানিয়েই দিচ্ছিলাম। প্রেজেন্টেশন্টা পাঠাচ্ছি এক্ষুণি। রেডি আছে।"
"আচ্ছা ইরেস্পন্সিবল তো আপনি মিস দাশগুপ্ত। দুদিন বাদে ক্লায়েন্টকে প্রেজেন্ট করতে হবে, তার আগে কোথায় আজ ফাইনাল করব ব্যাপারটা, আপনি আজকেই অ্যাবসেন্ট। রিয়েলি, আনবিলিভেবল।"
"সরি স্যর। আমি এক্ষুণি পাঠাচ্ছি।" কোনমতে বলেই রুমুন ফোন কেটে দিল। কী যে হয়েছে আজকাল ওর, কথায় কথায় চোখ ফেটে জল আসে। হাপুস নয়নে কাঁদতে বসল।
টুং টাং করে দু তিনবার ফোনে এস এম এস ঢুকল। একটা ওর কলিগ মালবিকার। কেন আসেনি অফিস, জানতে চেয়েছে। আর বাকি খড়ুসের। উফ। একটুও শান্তি দেবে না কেউ। দশ মিনিটও হয়নি, মেসেজ ঢুকেছে খড়ুসের। প্রেজেন্টেশন চেয়ে। চোখ মুছে ল্যাপটপ চালু করে ঝটপট মেল করল ও। শুধুমাত্র সাবজেক্টে "ইয়োর প্রেজন্টেশন" লিখে অ্যাটাচমেন্টে ফাইলটা। মেলে একটা বাড়তি কথা নেই।
এবারে রুমুন একটু খুড়িয়ে উঠে নিজের ঘরে গেল। ফার্স্ট এডের বাক্সটা ওখানেই। বাথ্রুমে গিয়ে একবার গীজার চালিয়ে ওষুধের বাক্স থেকে পেন কিলারের পাতা বের করল। সাথে নিল পেন রিলিভিং জেল আর ব্যান্ডেজ। কল খুলে গরম জল বালতিতে ভরে একটু পা ডুবিয়ে যদি আরাম পাওয়া যায়। তারপর ওষুধ লাগিয়ে রেস্ট। একা একা এমন মুহূর্তগুলোয় খুব অসহায় লাগে রুমুনের। কেউ নেই পাশে, একটু সেবা শুশ্রূষা করার। বা অন্তত খেয়াল নেওয়ার।
সেঁক দিয়ে ওষুধ লাগিয়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ জড়িয়ে রুমুন মোবাইলটা নিয়ে বসল। অফিসে একবার মালবিকাকে ফোন করে বলে দেবে, এইচ আরে জানিয়ে দিতে ছুটির ব্যাপারে। অবশ্য এতক্ষণে হয়তো খড়ুস ওর নামে কমপ্লেন ঠুকে দিয়েছে। কে জানে বাবা। মালবিকা রুমুনের অফিস কলিগদের মধ্যে বেস্ট ফ্রেন্ড। কাছাকাছি বয়সী বলে বন্ডিংটা দারুণ। তবে সবচেয়ে বেশি ভাব কারণ ওরা দুজনেই খড়ুসকে সমানভাবে অপছন্দ করে।
"হ্যালো। মালো?"
"বলো রুমুনদি। আজ এলে না কেন? তোমায় মেসেজ করেছিলাম।"
"হ্যাঁ আর বলিস না। অফিস যাবো বলে রেডি হয়ে নীচে দাঁড়িয়ে আছি। রিক্সা ধরতে গিয়ে উল্টে পড়ে পা মচকে একশা। আবার তার ওপর ভিজেওছি। হাঁচি শুরু হয়েছে সাথে। ওরে বাবা রে, হ্যাঁচ্চো। হ্যাঁচ্চো। হুম। দেখছিস? ওই জন্যই যাইনি।"
"এদিকে তোমার খড়ুস তো তোমায় চোখে হারাচ্ছিলো। বারবার এসে মিস দাশগুপ্ত কোথায়, মিস দাশগুপ্ত এখনো এলো না কেন করে যাচ্ছিল।"
"চুপ কর। চোখে হারানো না ছাই। প্রেজেন্টেশন দেওয়ার ছিল আমার। তাই। আমায় ফোন করে পঞ্চাশটা কথা শুনিয়ে দিয়েছে জানিস। উফ বাবা রে। কী কর্কশ কী কর্কশ লোক। সারাদিন করলা সিদ্ধ খায় মনে হয়।"
"হিহি! ওষুধ টোশুধ কিছু লাগলে বলো। যাবো সন্ধ্যায়। বাবা রে, কী বৃষ্টি বলো দি।"
"হ্যাঁ। ওই তো হলো আমার কাল। যাক গে। তুই কাজ কর। আবার লোকটা তোকে ফোনে দেখলে ঝাড় দিতে আসবে।"
"হুম। তাই না তাই। তুমি সাবধানে থেকো রুমুনদি। ব্যথার ওষুধ খেয়ো। টেক কেয়ার। বাই।"
"হুম। বাই।"
ফোন ছেড়ে রুমুন দেখল একটা এস এম এস ঢুকেছে ফোনে। খড়ুসের। লেখা "ওয়েল ডান। নো কারেকশন্স নিডেড।" হুহ! তবে? এটা রুমুন দাশগুপ্তর কাজ হে, কোনো খুঁত খুঁজে পাবে না কেউ। নির্ভুল কাজ। ফালতু ফালতু কথা শুনিয়ে দিলো। আর রুমুনও বলিহারি যাই। উত্তর দিতে আর শিখলো না। ক্যাবলা হয়েই রয়ে গেল। ধুর। কোথায় এস এম এসের রিপ্লাইতে এইসব কড়া করে ডোজ দেবে, তা না। শুধু "ওকে। থ্যাংকস" লিখে ছেড়ে দিলো।
মেসেজের ডেলিভারি রিপোর্ট আসার আগেই মালবিকার এস এম এস।
"কখন যে লোকটা কিউবিকলে এসেছিল, টের পাইনি। কে জানে কত কী শুনলো। জিজ্ঞেস করলো তোমার কী হয়েছে। বললাম সব। একটু ও আচ্ছা বলে বেরিয়ে গেল। কোথায় গেল, জানিনা।"
মালবিকার এই স্বভাব। শর্ট করে লিখতেই পারেনা। যার ফলে এই কথাটা আসতে অন্তত চারবার ফোনে টুং টাং হলো। রুমুন লিখলো উত্তরে, "মরুক গে যা। যে চুলোয় ইচ্ছে যাক।"
অনেকদিন পর হঠাৎ একটা এরকম ছুটি পেয়েছে রুমুন। পায়ে ব্যথা। রেস্ট দেওয়ার দরকার খুব। বৃষ্টিও পড়েই চলেছে। তাই বেরোনোর কোনো সিন নেই। দুপুরের রান্না করার ক্ষমতা নেই। ম্যাগি করে নেবে খন মাইক্রোতে। রিমোটটা হাতে নিয়ে টিভি চালালো ও। এ চ্যানেল ও চ্যানেল পরপর ঘুরেই যাচ্ছে। সর্বত্র শুধু প্রেমের গান আর প্রেমের সিনেমা। ভাল্লাগেনা। ব্রেকআপের পর থেকে এই সব ভীষণ বিরক্ত লাগে রুমুনের। পারদপক্ষে এড়িয়েই চলে। কিন্তু আজ কিচ্ছু করার নেই। ভ্যালেন্টাইনস ডে বলে কথা। সব চ্যানেলেই এই দেখাবে। খবরের চ্যানেলেও কোথায় কোন পার্কে কোন যুগলকে কে হ্যারাস করলো আর কোন সেলিব্রিটি কার সাথে কোথায় ঘুরছে। পারেও বটে ওরা।
কী করবে কী করবে? বেশ। ওয়ার্ল্ড সার্ভিস রেডিওতে একটু গান শুনলে হয়। রুমুন গান ভালোবাসে বলে গত বছর জন্মদিনে বাবা এইটির ব্যবস্থা করে দেয়। কত রকমের চ্যানেল। ভাষা কত। খুব পছন্দ এটা ওর। ইনস্টিউমেন্টাল মিউজিকের চ্যানেলটি চালালো। আহা, দরবারী কানাড়া বাজাচ্ছেন কেউ। এক রাশ মুগ্ধতা।
কখন যে বাজনা শুনতে শুনতে একটু ঘুম এসে গিয়েছিল, কে জানে। মোবাইলের আওয়াজে ধড়ফড় করে উঠলো ও। হাতে নিয়ে দেখল খড়ুস ফোন করছে। আবার কী হল। আর পারা যায় না। ধ্যাৎ।
কোনোমতে ফোনটা রিসিভ করে বললো, "হ্যাঁ স্যর বলুন।"
উত্তর এলো, " ডাব্লু আই বি আর ১২ বাই এইট, এটাই আপনার এড্রেস তো?"
সে কী, ঠিকানা পেলো কোত্থেকে। কী দাবি আবার? রুমুন ঘাবড়ে গিয়ে বলল, "হ্যাঁ।।ওটাই। কেন?"
"দশ মিনিটের ওপর বেল বাজিয়ে যাচ্ছি। দরজাটা খুলুন।"
এহ? বলে কী? এখানে? কী হলো?"
ভেবলে ভ রুমুন। "হ্যাঁ আসছি। একটু দাঁড়ান।" বলে রুমুন উঠলো। ভয় উত্তেজনা সব মিলিয়ে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বাঁ পায়ে চোটের ওপরেই চাপ দিয়ে ফেলল। আর তখুনি "আহ" বলে চেঁচালো।
একটু বেশিই জোরে হয়ে গেল নাকি?
বাইরে শোনা গেল। খড়ুস "সাবধানে মিস দাশগুপ্ত" বলল একটু অস্থির হয়েই।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে রুমুন দরজা খুলে "আসুন। বসুন। বলুন কী হয়েছে" বলে দাঁড়িয়ে রইলো।
"আরে দাঁড়িয়ে রইলেন কেন। আপনার পায়ে ব্যথা। আপনি বসুন।" খড়ুস ওর দিকে এগিয়ে এলো। ধরে বসাতে। বাবাঃ, দরদ! হুহ!
"না ঠিক আছে। আপনি বসুন স্যর। বলুন কী হয়েছে।"
"আসলে আমি অ্যাপলোজাইস করতে এসেছি।"
"অ্যাপলোজাইস? কেন? কীসের? কাকে?"
"উফ মিস দাশগুপ্ত, আপনি বড্ড প্রশ্ন করেন।"
"সরি।" ধুর, যখন কথা বলার দরকার, মুখ ফুটে কথা বেরোয় না। আর এদিকে দেখো, এখন চুপচাপ শুনে যাওয়া উচিত, তা না, মেয়ের মুখে বুলি ছুটছে। ছি রুমুন, কবে যে তোর কোন সেন্স হবে? নিজের মনেই নিজেকে শাসন করতে থাকে রুমুন।
"না না, ওটা কথার কথা।"
"না মানে কথার কথা না। মানে, আমি সত্যিই সরি।" ভেব্লে গিয়ে রুমুন বলল। ব্যাপারটা কী হচ্ছে আজ? সাধারণত নার্ভাস থাকে ও, কিন্তু তা বলে এরকম যাকে বলে ছড়িয়ে ছ তো করে না। এটা কি তাহলে এই ব্লু ফর্মাল শার্ট আর সাঙ্ঘাতিক রকমের ভালো পারফ্যুমের এফেক্ট? অন্যান্য দিন খড়ুসকে দেখে যতটা ইরিটেশন হয়, কই এখন কিন্তু হচ্ছে না। উল্টে একটু যেন আদেখলাপনা করে বারবার ওর দিকে তাকাতেই ইচ্ছে করছে রুমুনের। ছ্যাঃ রুমুন। কী হল টা কী? পায়ে চোট এভাবে ব্রেনকে অ্যাফেক্ট করে নাকি? সাইন্সের বন্ধুদের বলতে হবে, রিসার্চ করতে। সেরোটোনিন ডোপামিনগুলো বেইমানি করছে নাকি?
"না না ভুল বুঝছেন মিস দাশগুপ্ত। যাই হোক, ব্যাপারটা হল তখন প্রেজেন্টেশন নিয়ে আমি খুব চিন্তিত ছিলাম। তাই আপনার ওপর একটু বেশিই কড়া হয়ে গিয়েছিলাম। আপনি যে জেনুইনলি অসুস্থ, সেটা বুঝিনি। না জেনেই চেঁচালাম আপনার ওপর।"
"আর তাই বুঝি এখন এসেছেন ইন্সপেক্ট করতে? যে মালবিকা যা বলেছে, সত্যি না মিথ্যে। যাচাই করতে এসেছেন?"
এই রে, রুমুন অন ফায়ার! কী হল? নিজেই যে অবাক। এসব কী বলে চলেছে।
"এ বাবা মিস দাশগুপ্ত, একদমই তা না। বলছি তো। আয়াম এক্সট্রিমলি সরি। আমি আসলে সত্যিই ক্ষমা চাইতে এসেছি। এই যে দেখুন, একটা কার্ড এনেছি। এই যে, সরি লেখা।" এই বলে খড়ুস পিঠের ব্যাগ থেকে একটা বেগুনি রঙের খাম বের করলো। রুমুন হাতে নিয়ে দেখল, মিষ্টি একটা টেডি বিয়ার। হাতে এক গুচ্ছ বেলুন। কাচুমুচু মুখ করে সরি বলছে। আর রাগ টাগ জমিয়ে রাখতেই পারল না ও। এক্কেবারে হেসে ফেলল।
রুমুনকে হাসতে দেখে খড়ুসও নিশ্চিন্ত। উফ। এম বি এর অ্যাসাইনমেন্ট এর চেয়ে ঢের সোজা। এতক্ষণ তো ভয়ে জেরবার হয়ে ছিল। কীভাবে রুমুনের কাছে ক্ষমা চাইবে, কথাই বা বলবে কী করে। আসলে কাজ পাগল তো ভীষণ, তাই প্রেজেন্টেশনের চিন্তায় এক্কেবারে চ্যাপ্টা হয়ে গিয়েছিল। আর তাই না বুঝে শুনে রুমুনের ওপর চিৎকারও করে ফেলেছে। তারপরে মালবিকার কাছে যখন জানতে পারল, রীতিমতো কুণ্ঠিত বোধ করছিল। আসলে খড়ুস আমাদের মানুষটা বেজায় ভালো। শুধু অভিব্যক্তিগুলো প্রকাশ করতে পারে না। আর তাই এমন নামকরণের শিকার। আসল নাম যে অফিসের কটা স্টাফ মনে রেকেহছে কে জানে। ও জানে, সবাই আড়ালে ওকে একেক রকম নামে ডাকে।
যাক গে। মিটমাট যখন হয়েই গিয়েছে, আর ডিস্টার্ব করে লাভ নেই ওদের। নিজের গাড়ি নিয়েই এসেছে যখন, এবার একটু রুমুনকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাক। পা মালিশ করে দিক। সেবা শুশ্রূষা করুক। ভালো দিনেই দেবীর চরণে স্থান পেল দেখছি!
রুমুনও বেশ খুশি। এক্সট্রা আহ্লাদিত আর কী। এই তো, এত অ্যাটেনশন পাচ্ছে, বেশ লাগছে কিন্তু। একেবারে রাণীর মতো সেবা, আহা। আবার তার সাথে উপরি পাওনা হয়েছে, মিউজিক ওয়ার্ল্ড থেকে কিনে আনা "মনসুন রাগাস" নামের সিডি। শুনছে খড়ুসের তেমন কাজ নেই অফিসে। প্রেজেন্টেশন তো পারফেক্ট আছে। বাইরে বৃষ্টিও পড়েই চলেছে। বলবে নাকি ওকে থেকে যেতে? সারাদিনই তো টিভির সব চ্যানেলে বেশ মাখো মাখো সিনেমা চলছে। একসাথে দেখলে মন্দ হয় নয়। তাই না?
Monday, February 4, 2019
লে হালুয়া
বেলা তিনটে। রবিবার। পাড়ার সিগারেটের দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে সবে একটা ব্ল্যাকে আগুন ধরিয়ে একটা টান দিয়েছে শৌর্য, "কী কাকা, ব্যাপার কী বলো। এই অবেলায় সিগারেট?" বলে ওর পিঠে একটা চাপড় মানলো পাড়াতুতো ভাই, সংগ্রাম।
"কিচ্ছু না কাকা। জীবনে তো সবই ধোঁয়া, তাই আরেকটু বাড়িয়ে নিচ্ছি।" শৌর্যর গলায় হতাশা স্পষ্ট।
"বিশুদা, আমায় একটা গোল্ড দাও" বলে সংগ্রাম প্লাস্টিকের টুলটা টেনে বসল। একটা সুখটান দিয়ে শৌর্যর দিকে তাকিয়ে বলল, "কাকা কেস কী বলো দেখি। কেমন একটা ভেবলে গেছো মনে হচ্ছে।"
"ভাইপো, কী আর বলি। একটা জ্ঞান দিতে পারি। এই যে কথায় বলে না, the way to a man's heart is through the stomach, এটা কিন্তু মেয়েদের জন্য খাটে না। ছেলেদের ক্ষেত্রেও আজকাল খাটে কি, জানিনা। অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু মেয়েদের জন্য নৈব নৈব চ।" শৌর্য বেশ জোর দিয়েই বলে।
"বাবাঃ, কাকা, এত বড় কথা! খুলেই বলো কেসটা।" সংগ্রাম এবার আর কৌতূহল দমন না করতে পেরে বলে।
"আরে, ওই যে রুমুন.." শৌর্য শুরু করে।
"তোমার তো বিশাল চাপ রুমুনদির ওপর", সংগ্রাম একটু হেসে বলে।
"হুম। একটু না। ভালোই। তা আমি তো জানি ও হেব্বি খেতে টেতে ভালোবাসে। তাই একটু সেই সুযোগে ভাবলাম প্রোপোজ করে ফেলি। ফেব্রুয়ারি মাস বলে কথা। সেই জন্য বলে কয়ে ওকে নিয়ে খেতে গেলাম 'খাই খাই'তে।"
"আরি শালা, খাই-খাই। তা তারপর?"
"ওর পছন্দসই সব খাবার অর্ডার করলাম। চিংড়ির পকোড়াটা দারুণ বানিয়েছিল। মিন্ট চাটনি দিয়ে খেতে খেতে খুড়তুতো বোনের বিয়ের গল্প শুরু করলাম। ভাবলাম বুঝি এইভাবে কন্টেক্সট আনবো। ও হুম হা করে গেল। ভাবলাম খাবারেই মন দিচ্ছে মনে হয়। শুনছে টুনছে না।"
"হতেই পারে। যা পেটুক রুমুনদি।" সংগ্রাম ফুট কাটলো।
"দোকানের স্টাফগুলো আবার দেখি এক্সট্রা এফিশিয়েন্ট। ভাবছিলাম স্টার্টার আর মেন কোর্সের মাঝে গ্যাপ পাবো। তখন ঝেড়ে কাশবো। যাতে কিনা রসগোল্লা দিয়ে ডাইরেক্ট প্রোপোজ করতে পারি। ধুর ধুর। পকোড়ার প্লেট উঠিয়ে নিয়ে যেতে যেতেই দেখি গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত আর তরকারি ইত্যাদি নিয়ে সব হাজির। আমার বোঝা উচিত ছিল। সবই সাইন। আমার প্ল্যানও ওরকম ধোঁয়ায় উড়ে যাবে।" কাঁচুমাচু মুখ করে কথাগুলো বলতে থাকলো শৌর্য।
"তা মেনু কী ছিল?" সংগ্রাম জিজ্ঞেস করলো।
"আমি মরছি মনের জ্বালায়, আর ভাইপো তুই কিনা মেনু জানতে চাস!" রাগ করে শৌর্য বলল।
"আহা কাকা, রাগ করে না। বলোই না। অন্তত ভালো খাওয়া দাওয়া তো করেছ। আমার মতো তো ডাটা চচ্চড়ি আর শিং মাছের ঝোল খেতে হয়নি রবিবারের বাজারে। রান্নার দিদির আজ হেব্বি তাড়া ছিল। তাই এই জুটেছে কপালে আমার।" বেশ দুঃখ করেই কথাগুলো বললো সংগ্রাম।
শুনে শৌর্যর মন গলে গেল। আহা রে, রবিবার দুপুরে একটু এলাহী খাবার খেতে হয়। বেচারা ছেলেটা। বললো, "হ্যাঁ। তা ট্যাংরা মাছের শুক্তো, মাথা দিয়ে ডাল, চিংড়ি দিয়ে এঁচোর, ইলিশ ভাপা, মাটন কারি, টমেটোর চাটনি এইসব খেলাম।"
"আরিববাস। হেব্বি মেনু।"
"হুম। রান্নাও দারুণ। মাংসটা যা ভালো সিদ্ধ হয়েছিল..আর ইলিশ ভাপাতে সর্ষের কী ঝাঁজ!"
"মিষ্টিতে কী খেলে?"
"আর মিষ্টি। ততক্ষণে দিদিমণি ঠারে ঠোরে শুনিয়ে দিয়েছে। তিনি অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে মন দিয়ে ফেলেছেন ইতিমধ্যে। আমার সব আশায় এমন জল ঢেলে দিল, কী বলি। ঠিক যেন আমার নতুন সাদা পাঞ্জাবিতে কেউ লাইম মিন্ট সোডা ঢেলে দাগ করে দিলো। ধুর ধুর।" শৌর্যর চোখে মুখে দুঃখ স্পষ্ট।
"কাকা, ইটস ওকে। দেয়ার আর মোর ফিশ ইন দ্য রিভার। তুমি হাল ছেড়ে জাল গুটিয়ে ফেলো না।" সংগ্রাম সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে।
"ভাইপো, হচ্ছে না। হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেছি। এবার মনে হচ্ছে নিরামিষাশী হয়ে যেতে হবে। মাছ আর ধরা পড়লো না। বড্ড স্ট্রাগল ভাইপো।"
"কত ধসলো, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড মি আস্কিং। মানে, এই অসময়ে ইলিশ... আবার চিংড়ি, মাটন..."
"আড়াই তো ওখানেই। এছাড়া দুপিঠ এসি সেডান। তাতে আরো হাজার খানেক।"
"ইশ। ইশ। পুরো চুনা লেগে গেলো তো কাকা।"
"তা আর বলতে?"
"না না কাকা। মন খারাপ করো না। ইউ ডিসার্ভ মাচ বেটার। যে মেয়ে এত এফোর্টকে সম্মান করতে পারে না, তার দিকে মনোযোগ দিয়ে লাভ নেই। চলো কাকা, রাত্রে বিরিয়ানি সাঁটাবে চলো। মন ভালো হয়ে যাবে।"
"ধুর। আর টাকা নেই।"
"কাকা, আজ এটা এই ভাইপোর ট্রিট। শোনো কাকা, জেনে রেখো, দুনিয়া এদিক থেকে ওদিক হয়ে যাবে। মেয়ের জন্য মন ভেঙে যাবে। কিন্তু এই ভাইপো, অলওয়েজ অ্যাট ইয়োর সার্ভিস কাকা। অনেক খাইয়েছ আমায় তুমি। আমি নেমকহারামি করবো না। চলো আজ। আর শোনো কাকা, আরেকটা কথা। এইসব সানন্দা বর্তমান মার্কা ম্যাগাজিন পড়া বন্ধ করো তো। যত ভুলভাল জ্ঞানের কথা লিখবে আর তোমাদের মতো সরল লোকজনের ট্যাঁক ফাঁকা করবে। সামনেই আবার ভ্যালেনটাইন্স ডে। হুহ।"
"বুকে আয় ভাই। বুকে।"
মিনওয়াইল, নিজের ঘরে, আরাম করে এসি চালিয়ে শুয়ে রুমুন দেবী গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। খাওয়াটা জব্বর হয়েছে। এবার একটু জমিয়ে অগ্নির স্বপ্ন দেখতেই হচ্ছে!
Friday, February 1, 2019
Yellow Melancholy
Wake up to receive notice to vacate apartment. Difficult times ahead.
Presentation due in an hour's time. Laptop battery dead. Editing work of at least half an hour unsaved.
Office shuttle cancelled.
Incessant rains. Life looks gloomy. Weather reflects it. Need to wade through water to work after water logging.
Decide to wear my lucky charm. A yellow saree gifted by Ma last birthday.
Yellow to me is happiness. Cheer. Positivity.
Desperate to believe that it will weave its magic today too. Like never before.
Take a yellow taxi to work. For added benefit.
Running late.
The yellow taxi spots a yellow light that slowly turns red.
Dead stop.
I look out of the window.
Smog engulfs the city.
My eyes fall upon a lonely yellow orange leaf stuck in the rusted wire railing.
Yellow is melancholy.
Presentation due in an hour's time. Laptop battery dead. Editing work of at least half an hour unsaved.
Office shuttle cancelled.
Incessant rains. Life looks gloomy. Weather reflects it. Need to wade through water to work after water logging.
Decide to wear my lucky charm. A yellow saree gifted by Ma last birthday.
Yellow to me is happiness. Cheer. Positivity.
Desperate to believe that it will weave its magic today too. Like never before.
Take a yellow taxi to work. For added benefit.
Running late.
The yellow taxi spots a yellow light that slowly turns red.
Dead stop.
I look out of the window.
Smog engulfs the city.
My eyes fall upon a lonely yellow orange leaf stuck in the rusted wire railing.
Yellow is melancholy.
Subscribe to:
Posts (Atom)