গতকাল সন্ধ্যেয় আমার মা এবং আমার সাথে একটি অতি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। এখন সেই গল্পই বলছি। ও, তার আগে তো আমার পরিচয়ই দেওয়া হয়নি। আমি এক দ্বাদশ বর্ষীয়া মেয়ে, আমার মায়ের বয়স চৌত্রিশ। এবং ইতিমধ্যেই আমি লম্বায় প্রায় আমার মাকে ছুঁয়ে ফেলেছি। গল্পে ফিরি।
গতকাল দুপুরে মা আমায় লন্ডনে নিয়ে গিয়েছিল, দাঁতের ডাক্তার দেখাতে। ডাক্তারটি আমার মাড়ির দাঁতে পেলেন একটি গর্ত। মোটামুটি ব্যথা না দিয়েই তিনি সেই গর্তটি বুজিয়েও দিলেন। তারপর আমি আর মা একটি ক্যাফেতে গেলাম। ওখানে আমি একটি ফলের আইসক্রিম অর্ডার দিলাম। মা নিলো এক কাপ কফি। আমাদের খাওয়াদাওয়া শেষ হতে হতে ছ'টা বেজে গেল।
ক্যাফে থেকে বেরিয়ে দেখলাম ভালো জোরে বৃষ্টি পড়ছে। আমাদের গায়ে ছিল সাধারণ কোট আর মাথায় হ্যাট। সেই বৃষ্টিতে অবশ্যই ভিজে যাবো। মা বলল, "একটা ট্যাক্সি নিতেই হবে।"
আমি বললাম, "চলো না, খানিক্ষণ অপেক্ষা করি ক্যাফেতে বসে।" কী করব, আমার মন যে তখনও পড়ে আছে ক্যাফের ওই সুস্বাদু আইসক্রিমে।
"উহু, এই বৃষ্টি শিফফিরি থামবার নয়। আমাদের তো বাড়ি ফিরতে হবে," মা বলল।
আমরা ফুটপাথের ধারে এসে দাঁড়ালাম ট্যাক্সির অপেক্ষায়। রাস্তা দিয়ে অনেক ট্যাক্সি গেলো বটে। তবে সবই যাত্রী বোঝাই। সেসব দেখতে দেখতে মা আক্ষেপের সুরে এক সময়ে বলল, "ইশ, আমাদের যদি একটা গাড়ি থাকত... আর সাথে একটা ড্রাইভার..."
এমন সময় এক বৃদ্ধ ব্যক্তি আমাদের সামনে এলেন। ছোটখাটো চেহারা, সত্তরের ওপর বয়স। মাথার টুপিটা সসম্মানে একটু উঁচু করে মায়ের দিকে মেলে বললেন, " এক্সকিউজ মি..." ভদ্রলোকের দিকে এবারে ভালো করে চেয়ে দেখলাম। মুখের গোলাপী চামড়া কুঁচকে আছে। মোটা সাদা ভুরু আর পাকা গোঁফ। হাতে একটি বড় ছাতা, তাই দিয়ে নিজের মাথা ঢেকে দাঁড়িয়ে আছেন।
মা প্রায় ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল, "বলুন?"
"একটা ছোট্ট সাহায্য লাগতো। নিতান্তই ছোট্ট। বলতে পারি?" উনি কিঞ্চিত ইতস্তত করে বললেন।
আমি মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম, মা বেশ সন্দেহজনক দৃষ্টিতে ভদ্রলোকটিকে নিরীক্ষণ করছে। আমার মা খুবই সন্দেহপ্রবণ। বিশেষ করে অপরিচিত লোক এবং সিদ্ধ ডিম, এই দুইয়ের ওপর মায়ের প্রবল অবিশ্বাস। ডিম সিদ্ধর খোলা একটু ফাটিয়ে চামচ দিয়ে এমনভাবে নাড়াঘাঁটা করে, যেন মনে হবে এই বুঝি ভিতর থেকে কোন ইঁদুর বেরিয়ে এলো। আর অপরিচিত লোকজন নিয়ে তো মায়ের আবার একখানি জম্পেশ নিয়ম আছে। "যত বেশি ভালো মনে হবে ব্যক্তিটিকে, তাকে তত বেশি সন্দেহ করবে।" এই ক্ষেত্রে ভদ্রলোকটি অত্যন্ত ভালোমানুষ গোছেরই মনে হচ্ছিল আমার। ইনি যে নিপাট ভদ্রলোক, সেই ব্যাপারে আমি আরো নিশ্চিত হই ওঁর জুতোজোড়া দেখে। তার কারণ? আমার মায়ের আরো একখানি মহামূল্যবান বক্তব্য। "কোন ভদ্রলোককে চিনবার অন্যতম উপায় তার পরনের জুতো।" এবার এই বৃদ্ধের পায়ের খয়েরি জুতো জোড়া বেশ সুন্দর দেখতে। তাই তাঁর আর ভদ্রলোক হওয়া আটকায় কে?
ভদ্রলোক মাকে বলতে লাগলেন, "আসলে ব্যাপারটা হয়েছে কী, ইয়ে, মানে, একটু বিপদে পড়েছি। তাই সামান্য সাহায্য চাইছি আপনার কাছে। তেমন বেশি না। অল্পই। সেইটুকুই আমার খুব প্রয়োজন। আসলে বয়স হয়েছে তো, ভুলে যাওয়ার বাতিক আছে..."
এই অবধি শুনে আমি মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম মা থুতনি উঁচু করে, মুখচোখ গম্ভীর করে, একটা রাগী চোখ মুখ করে সোজা তাকিয়ে আছে মানুষটার দিকে। মায়ের এ হেন মূর্তি আবার বেশ ভয় উদ্রেককারী। বেশিরভাগ লোকজনই মাকে এইরকম দেখলে ভয় পেয়ে যায়। আমার মনে আছে, সেবার আমার স্কুলের হেডমিস্ট্রেস পর্যন্ত মাকে এমনভাবে দেখে রীতিমতো তোতলাতে শুরু করে দিয়েছিলেন। তবে অবাক কাণ্ড, এই ভদ্রলোকটির ওপর মায়ের চেহারার এই পরিবর্তনে কোন প্রভাবই পড়ল না। উনি দিব্যি হাসিমুখে বলতে থাকলেন, "ম্যাডাম, বিশ্বাস করুন। আমি সত্যিই বিপদে পড়েছি। তাই আপনাকে বলছি। নইলে এরকম রাস্তার মাঝখানে ভদ্রমহিলাদের দাঁড় করিয়ে কথা বলাটা মোটেই আমার স্বভাব না।"
"আশা করি!" মা বলল।
মায়ের এই আচরণে আমার খুব লজ্জা লাগছিল। ইচ্ছে হল বলি, "মা, দয়া করে ওঁকে এরকম বলো না। বয়স্ক মানুষ। কোন বিপদে পড়েই নিশ্চয়ই সাহায্য চাইছেন। দয়া করে নির্দয় হয়ো না।" কিন্তু বলতে পারলাম না।
সামনের মানুষটি ছাতাটি এবার এক হাত থেকে আরেক হাতে নিয়ে বললেন, "আসলে এমন ভুল আগে কখনও করিনি।"
মা কড়া স্বরে বলল, "কী ভুল?"
"এই যে, বেরনোর সময় আমার টাকার ব্যাগটা নিয়ে আসতে ভুলে গিয়েছি। কী বিচ্ছিরি বলুন তো?" ভদ্রলোকটি বললেন।
মা পাল্টা প্রশ্ন করলো, "ও, তার মানে আপনি টাকা চাইছেন?"
ভদ্রলোক উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, "ছি ছি, না না। তা কেন। আমি মোটেই টাকা চাইছি না।"
"তাহলে? কী চাই? তাড়াতাড়ি বলুন। আমরা এখানে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি।" মা অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
"হ্যাঁ, জানি তো আপনারা ভিজছেন। দেখতে পাচ্ছি। আর তাই আমি আপনাদের এই ছাতাটি দিতে চাইছি, আপনারা যাতে না ভেজেন। তবে..." ভদ্রলোক বললেন।
"তবে কী?" মা জিজ্ঞেস করলো।
" সাথে টাকা নেই। আর তাই এই ছাতাটির পরিবর্তে যদি আপনারা আমায় আমায় বাড়ি ফেরার ট্যাক্সি ভাড়া বাবদ এক পাউন্ড দিয়ে দেন, তাহলেই হবে।"
মা এখনও বেশ সন্দিগ্ধ হয়েই ওঁর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করলো, "তা আপনার যদি সাথে টাকা নাই থেকে থাকে, তাহলে এখানে এলেন কীভাবে?"
বৃদ্ধ তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, "হেঁটে। আমি রোজ বাড়ি থেকে হেঁটে আসি। তারপর ফেরার পথে ট্যাক্সি ধরে বাড়ি চলে যাই। এইটিই আমার অভ্যেস। সারা বছর এই এক নিয়ম চলে আমার।"
মা প্রশ্ন করলো, "তাহলে এখন হাঁটছেন না কেন?"
বৃদ্ধ আক্ষেপের সুরে উত্তর দিলেন, "যদি পারতাম... যদি হেঁটে ফিরতে পারতাম, কী ভালোই না হতো। কিন্তু আমার এই বুড়ো পায়ে আর জোর নেই। আজকের মতো অনেকটা হাঁটা হয়ে গিয়েছে। এখন ট্যাক্সি ছাড়া আমার আর গতি নেই।"
মাকে দেখলাম ঠোঁট কামড়াচ্ছে। বুঝলাম, একটু হলেও মনে হচ্ছে সামনের মানুষটার দুরবস্থা দেখে মায়ের মন গলতে শুরু করেছে। তাছাড়া এই পরিস্থিতিতে একটা ছাতা পেলে ভালোই হয়, সেই ব্যাপারটাও যে মনের মধ্যে চলছে, তা আমি জানি।
বৃদ্ধ বললেন, "ম্যাডাম, এই ছাতাটি খুবই সুন্দর।"
"সে তো দেখতেই পাচ্ছি," মা উত্তর দিল।
"সিল্কের।" কথাটি উনি যোগ করলেন। তার জবাবে মা বলল, "হ্যাঁ, লক্ষ্য করেছি।"
"তাহলে আপনি দয়া করে নিন এটি। আমি কুড়ি পাউন্ড দিয়ে কিনেছিলাম। তবে এই মুহূর্তে এর কোন মূল্য নেই আমার কাছে। এর চেয়ে ট্যাক্সি ভাড়া বাবদ এক পাউন্ড পেলে বরং আমি বাড়ি ফিরে এই বুড়ো হাড়ে একটু বিশ্রাম দিতে পারি।"
মায়ের হাতটা নিজের পার্সের দিকেই যাচ্ছিল। আমিও এবার মায়ের মতোই বেশ কড়া ভাবে তাকালাম, মায়েরই দিকে। মা ঠিক বুঝেছে আমি কী বলতে চাইছি। "শোনো মা, এইটা কিন্তু এই বয়স্ক মানুষটার অসহায়তার সুযোগে ওঁকে ঠকানো হবে। এমনটা দয়া করে তুমি করো না।" আমি মনে মনে বললাম। মা একটু থমকে আমার দিকে তাকালো, তারপর বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বলল, "শুনুন, আমার মনে হয় আমার এমন কাজ করা ঠিক হবে না। আমি আপনার এত দামী ছাতা এত কম দামে নিতে পারি না। আপনি বরং ছাতাটা আপনার কাছেই রাখুন। আমি এমনিই আপনাকে এক পাউন্ড দিচ্ছি।"
"না না, এ কখনও হতে পারে না। এ হয় না। আমি কিছুতেই এমনি এমনি টাকা নিতে পারি না আপনার থেকে। ম্যাডাম, আপনি দয়া করে ছাতাটা নিন এবং বৃষ্টির ছাট থেকে নিজেদের বাঁচান।" বৃদ্ধ বলে উঠলেন।
মা আমার দিকে তাকিয়ে বেশ একটা বিজয়িনীর হাসি হাসল। ভাবখানা এই যে, দেখ, আমি কিন্তু ঠকালাম না। উনিই নিজে যেচে দিচ্ছেন এই ছাতা, এই দামে।
মা নিজের পার্স থেকে এক পাউন্ডের একটি নোট বের করে ভদ্রলোকটিকে দিল। উনি সেটি সযত্নে পকেটস্থ করে মাকে ছাতাটি ধরিয়ে সম্মান দেখিয়ে টুপি খুলে সামান্য ঝুঁকে "ধন্যবাদ ম্যাডাম" বলে চলে গেলেন।
মা আমায় ছাতার নীচে টেনে নিয়ে বলল, "আয়, ছাতার নীচে আয়। ভিজিস না। দেখেছিস কী সুন্দর সিল্কের ছাতা। এমনটা আমি কোনদিনও কিনতেই পারতাম না।"
আমি প্রশ্ন করলাম, "তাহলে তুমি শুরুতে অমন খারাপ ব্যবহার করছিলে কেন?"
মা উত্তর দিল, "আসলে আমি যাচাই করে নিতে চাইছিলাম। ঠগবাজ না তো? তারপর বুঝলাম যে না, উনি নিপাট ভদ্রলোক।"
"হ্যাঁ মা।"
"যারপরনাই ভদ্র। এবং অর্থবানও। নইলে ওই রকম সিল্কের ছাতা তো যে সে ব্যবহার করে না। উনি কোন উপাধি প্রাপ্ত মানুষ হলেও আমি অবাক হবো না। স্যর হ্যারি গোল্ডসওয়ারদি বা ওই জাতীয় কিছু।"
"হুম।"
"শোন, আজকের ঘটনাটি তোর কাছে একটি শিক্ষনীয় ঘটনা কিন্তু। কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে কখনও তাড়াহুড়ো করবি না। ধীরেসুস্থে বিচার করবি। তাহলে দেখবি, ভুল কম হবে।"
"ওই দেখো মা, ওই যে লোকটা যাচ্ছে।" আমি বলে উঠলাম।
"কোথায়?" মা জিজ্ঞেস করলো।
আমি আঙ্গুল দিয়ে এক দিকে নির্দেশ করে বললাম, "ওই যে। ওইদিকে। দেখো। কী তাড়ায় হাঁটছেন।"
আমরা দেখলাম লোকটিকে। টুকটুক করে ট্র্যাফিক বাঁচিয়ে রাস্তা পেরিয়ে গেলেন। রাস্তার অপর প্রান্তে পৌঁছে বাঁদিক ধরে হাঁটা লাগালেন। বেশ দ্রুত গতিতেই।
"দেখে তো মনে হচ্ছে না পায়ে ব্যথা," আমি মন্তব্য করলাম। মা কিছু বলল না। "এমন কী, ট্যাক্সি ধরতেও যাচ্ছে বলে মনে হলো না।" আমি আরো বলে গেলাম। মা চুপচাপ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিল লোকটিকে। লোকটি বেশ দ্রুত গতিতে দুই হাত দুলিয়ে বাকি পদচারীদের পাশ কাটিয়ে এগোচ্ছিলেন।
মায়ের মুখটা এখন পাথরের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছে। "লোকটার নির্ঘাৎ কোন মতলব আছে। ব্যাপারটা ঠিক লাগছে না।" মা বলল।
"কীরকম?" আমি জিজ্ঞেস করলাম।
মা বিরক্ত হয়ে বলল, "সে আমি জানি না। কিন্তু কিছু একটা ব্যাপার আছেই। আমরা সেটা এবার জানবো।" এই বলে মা আমার হাত ধরে রাস্তা পার হয়ে বাঁদিকে হাঁটা লাগালো।
"ওঁকে দেখতে পাচ্ছিস?" মা আমায় জিজ্ঞেস করলো।
"হ্যাঁ, ওই তো। সামনের রাস্তাটা থেকে ডানদিকে হাঁটছেন।" আমি বললাম।
আমরা ওঁর পিছু নিলাম। রাস্তার মোড়ে এসে আমরাও ডানদিকে গেলাম। বৃদ্ধ লোকটি ক্ষিপ্র গতিতে হেঁটে চলেছেন। আমাদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছিল ওঁর সাথে তাল রাখতে। এদিকে জোরে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। দেখলাম, লোকটির টুপি গড়িয়ে জল পড়ছে। অবশ্য আমাদের মাথায় তখন সিল্কের ছাতা। আমরা বৃষ্টিতে মোটেই কাবু নই।
"বুঝছি না, ওঁর মতলবটা কী?" মা বলল।
আমি ভয় পেয়ে বললাম, "মা, উনি যদি পিছন ফেরেন তাহলে তো আমাদের দেখতে পেয়ে যাবেন?"
"তাতে কিছু যায় আসে না। মিথ্যুক লোক। আমাদের বললেন নাকি হাঁটতে পারছেন না। তিনি নাকি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। এদিকে দেখ, কী জোরে হেঁটে চলেছেন সমানে। ঠগবাজ। প্রতারক।" মা রাগতস্বরে বলল।
"তার মানে উনি কোন উপাধিপ্রাপ্ত বড় মানুষ নন?"
"চুপ চুপ, একদম চুপ।" বলে মা আমায় থামিয়ে দিল।
সামনের মোড়ে পৌঁছে লোকটি ডানদিকে গেলেন, তারপর আবার বাঁদিক। তারপর আবারও ডানদিক।
"আমি ছাড়ছি না ব্যাটাকে", মা বলল।
"একী, লোকটাকে তো আর দেখতে পাচ্ছি না। গেলো কোথায়?" আমি প্রশ্ন করলাম।
"ওই তো, ওই দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখলাম।" মা বলল। "সেকী, এ যে দেখি এক পানশালা", মা উত্তেজিত স্বরে বলল।
পানশালাই বটে। বড় বড় হরফে লেখা "দ্য রেড লায়ন পাব"।
"তুমি তা বলে নিশ্চয়ই ভিতরে যাবে না মা?" আমি জিজ্ঞেস করলাম মা কে।
"না, অবশ্যই না। কিন্তু আমরা বাইরে থেকে দেখবো লোকটা কী করে।" মা জানালো।
পানশালাটির জানলাগুলি বেশ বড় বড়। কাঁচের তৈরি। যদিও ভিতরটা বেশ ধোঁয়াটে, তবুও কাঁচ ঘেঁষে দাঁড়ালে দেখা যাচ্ছে ভিতরের কার্যকলাপ।
আমি মায়ের হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। দুজনেই একে অপরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা আমাদের ছাতার ওপর শব্দ করে পড়ছে। এমন সময়ে লোকটিকে ভিতরে দেখতে পেলাম। মাকে বললাম, "ওই দেখো। ওই যে।"
পানশালার অন্দরটি লোকে লোকারণ্য। সিগারেটের ধোঁওয়ায় ভরে আছে। ওই অত লোকের মধ্যে একেবারে মাঝামাঝি জায়গায় দেখলাম আমাদের বৃদ্ধ লোকটিকে। টুপি, কোট খুলে রাখা। লোকজন কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে মদ কেনার জন্য, সামনের দিকে টেবিলে। সেখানে পৌঁছে, টেবিলের ওপর দুটো হাত রেখে দিয়ে মদ বিক্রেতাকে কিছু একটা বললেন। ঠোঁট নড়া দেখলাম, অবশ্যই কথা কানে আসার কথা না। এলোও না। বিক্রেতা খানিকক্ষণ অন্য পাশ ফিরে তারপর আবার লোকটির সামনে এলেন। হাতে একটি বড় গেলাস। সেটি একটি সোনালি রঙের তরলে কানায় কানায় ভর্তি।
লোকটিকে দেখলাম এক পাউন্ডের একটি নোট দিলেন মদ বিক্রেতাকে।
"হে ভগবান, ওই তো। ওই তো আমার দেওয়া নোটটা।" মা চেঁচিয়ে উঠল। "কী দুঃসাহস লোকটার"! মা আঁতকে উঠল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "গেলাসে ওটা কী মা?"
মা জানালো, "উইস্কি। এক্কেবারে নীট।"
বিক্রেতা কোন পয়সা ফেরত দিলেন না।
"তার মানে ওটি ট্রেবল উইস্কি," মা বলল।
আমি কৌতূহলী প্রশ্ন করলাম, "মানে কী?"
মা বলল, "সাধারণের চেয়ে তিনগুণ বেশি মাপ।"
লোকটিকে দেখলাম গেলাসটা ঠোঁটের কাছে আনলেন। তারপর ঘাড় কাত করে ঢক ঢক করে পুরোটা এক নিমেষে শেষ করে দিলেন।
আমি অবাক হয়ে মন্তব্য করলাম, 'বাপরে, বেশ দামী পানীয় বলতে হয়!"
"জঘন্য। এক পাউন্ড দিয়ে কেনা পানীয় এক ঢোকে শেষ করে দেয়। কী অবস্থা!" মা রাগে গরগর করছে তখন।
আমি মাকে শান্ত করতে বললাম, "দেখো এক পাউন্ড তো নয়। উনি ওঁর সিল্কের ছাতাটিও খরচ করেছেন। কুড়ি পাউন্ডের। নেহাত সস্তা না।"
"হুম। পাগল মানুষ!" মা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল।
লোকটিকে দেখলাম টেবিলের ধারে এখনও দাঁড়িয়ে। চোখে মুখে অদ্ভুত এক আনন্দ। মুখের গোলাপি চামড়া থেকে যেন সোনালী তরলের আভা ঠিকরে বেরোচ্ছে। জিভ বের করে গোঁফ চাটছেন, যদি শেষ কোন ফোঁটার স্বাদ খুঁজে পান।
তারপর দেখলাম ধীর গতিতে ভিড় কাটিয়ে উনি বেরনোর চেষ্টা করছেন। যথাস্থান থেকে নিজের হ্যাট আর কোট বের করে দুইই পরে নিলেন। তারপর কোট র্যাক থেকে অজস্র ভিজে ছাতার ভিড়ের মধ্যে থেকে অত্যন্ত সাবলীল ও স্বছন্দভাবে একটি ছাতা তুলে বেরিয়ে গেলেন, এমন ভাব যেন নিজেরটাই নিলেন।
মা চিৎকার করে উঠল, "দেখলি? দেখলি তুই লোকটার কাণ্ড?"
"আস্তে, দরজার কাছেই আছে।" আমি সাবধান করলাম মাকে।
আমরা নিচু হলাম। ছাতার সাহায্যে নিজেদের মুখ ঢাকলাম। তবে তার অবশ্য দরকার পড়ত না। আমাদের দিকে একবারের জন্যও না তাকিয়ে লোকটি যেদিক দিয়ে এসেছিলেন, সেইদিকেই হাঁটা লাগালেন।
"এই হল তার মানে ব্যাপার!" মা বলল।
"বেশ চৌখস বলতে হয়," আমি মন্তব্য করলাম।
আমরা আবার ওঁর পিছু নিলাম। একই রাস্তা দিয়েই তিনি চলতে লাগলেন। পরবর্তী শিকারের উদ্দেশ্যে। দেখলাম এবারের শিকার এক শীর্ণকায় ব্যক্তি। পরনে হ্যাট বা কোট কিছুই নেই। তার থেকে আবার এক পাউন্ড আদায় করে বৃদ্ধ এবার উল্টোদিকে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলেন।
"দেখলি? কী ধূর্ত। একই পানশালায় কখনও দু'বার যাবে না!" মা বলল।
"যা বুঝছি, সারারাত এরকম করেই যেতে পারেন!" আমি বললাম।
মা উত্তর দিল, "অবশ্যই! তবে এমন বৃষ্টির দিনের জন্য ওঁকে প্রচুর প্রার্থনা করতে হয় বলতে হবে। রোজ রোজ তো তা বলে এরকম সুবর্ণ সুযোগ আসবে না!"
No comments:
Post a Comment