Thursday, February 7, 2019

এমন বরষার দিনে...

আজকেযে গল্পটি বলবো, তার পটভূমিকা ধরুন ওই ২০০৮ কিংবা ৯। কলকাতা শহর। তখনও ফোর জি আছড়ে পড়েনি শহরে। বাসে ট্রামে গাড়িতে মেট্রোয় তখনও লোকে ইয়ারফোন গুঁজে সদ্য জন্ম নেওয়া গুটি কয়েক প্রাইভেট এফ এম চ্যানেলে মশগুল। আর শোনা যায় যখন তখন যেখানে সেখানে এস এম এসে টুং টাং, টিং টিং। এমন সময়ের এক বৃষ্টিমুখর দিনের গল্প।



ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। গত দুইদিন ধরে কলকাতা শহরে টানা বৃষ্টি চলছে। এই অসময়ের বৃষ্টি, জাঁকিয়ে শীতটা আবার যেন পড়েছে। সারা রাত বৃষ্টি পড়ে নিস্তার নেই, সকাল হয়ে গিয়েছে। তবুও অঝোরে ঝরেই চলেছে। আকাশ কালো থমথমে। সূর্য ছুটি কাটাচ্ছে। বছর চব্বিশ পঁচিশের এক মেয়ে, রুমুন, হাতে লাল রঙের কাপ নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তা প্রায় খানিকক্ষণ তো হলই। কাপে রয়েছে ওর পছন্দের প্রিয় কফি। জাস্ট দ্য রাইট ওয়ান। দুই চামচ কফি পাউডার, দুই বড় চামচ চিনি আর বাকিটা গরম দুধ ঘেঁটে বানানো ওর পারফেক্ট কাপ অফ কফি। সকাল শুরুই হয়না এটা ছাড়া।

গলফগ্রিনের এই ফ্ল্যাটে রুমুন একাই থাকে। সেই মাস্টার্স পড়ার সময় থেকেই। বাবা মা দুজনে চাকরিসূত্রে আপাতত দিল্লীতে স্থায়ীভাবে রয়েছে। রুমুন মাস্টার্স করেছে যাদবপুর থেকে, এখন একটি বেসরকারি সংস্থায় নতুন চাকরিতে ঢুকেছে। একাই থাকে। রান্নার লোক, কৃষ্ণাদি দু'বেলা এসে ওর জন্য অল্প কিছু রেঁধে বেড়ে দিয়ে যায়। কফি কাপটা হাতে নিয়ে বাইরে দেখতে দেখতে অনেকটা সময় কেটে যায়। ওদের বিল্ডিঙটার সামনেই পরপর অনেকগুলো স্কুলের বাস আর পুলকার আসে। বাচ্চাগুলো সেই কোন সকালবেলা স্নান টান সেরে স্কুলে যায়, বাবা মায়েরা হাত ধরে বাসে গাড়িতে উঠিয়ে যায়। রুমুনের মনে পড়ে যায়। ও যখন ছোট ছিল, বাবা মা দুজনেরই হসপিটালে একেকদিন একেক সময়ের ডিউটি হওয়ায় মানদামাসী ওকে স্কুএল্র জন্য তৈরি করে দিত। লাল স্কারট, সাদা শার্ট পরে গোলাপী লেডিবার্ড সাইকেলটা চালিয়ে যেত স্কুলে। রাস্তায় কত বন্ধুরাও জুতে যেত। আজকে বাসগুলোও নেই, গাড়ির হর্নও নেই। নির্ঘাৎ স্কুলে রেনি ডে দিয়েছে। এইসব সময়ে রুমুন ভীষণ মিস করে স্কুল জীবন, ছোটবেলা। ওরও তো আজকের দিনে ইচ্ছে করছে সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকার, চরম আলসেমি করার। অথচ দেখো, এই এক্ষুণি শুরু হবে দৌড়, যুদ্ধ। তাড়াহুড়ো করে স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট খেয়েই ছোটো অফিস।
অফিস যেতে রুমুনের মোটেই ভালো লাগেনা। তার মূল কারণ ওর খড়ুস বস। লোকটা একেবারে ইয়ে পাবলিক। কথায় কথায় সকলকে ধরে ধরে বকা দেয়। রুমুন নিজেও কতবার বকুনি শুনেছে, তার ইয়ত্তা নেই। বছর তিরিশ বত্রিশ হবে হয়তো বয়স, এদিকে হাবেভাবে ষাটের জেঠু। যখন প্রথম এই অফিসে রুমুন জয়েন করে, সুপুরুষ বস দেখে অত্যন্ত পুলকিত হলেও, দুদিনেই স্বপ্ন চুরমার হয়ে গিয়েছিল ওর। বাবা রে, যতই হ্যান্ডসাম হোক, এমন কড়া লোক। গোমড়া মুখ করে থাকে সর্বক্ষণ। রুমুন এদিকে হাসি খুশি, আমুদে মেয়ে। এক্কেবারে খড়ুসের উল্টো। ওই জন্যই তো ওর কলিগদের সাথে মিলিয়ে নাম দিয়েছে বসের "খড়ুস"। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে এখন আসল নামও মনে আসে না সহজে!

রেডিও শুনতে শুনতে কফি খেতে গিয়ে আজ সাঙ্ঘাতিক লেট হয়ে গিয়েছে। এই রে, বসবার ঘরে দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে রুমুন জিভ কাটল। একেই বৃষ্টির জেরে ট্র্যাফিক জ্যাম হবে, তার ওপর বেরোতেই লেট। আজ কপালে দুর্ভোগ আছে ওর। গলফগ্রিন থেকে সল্ট লেক। এমনি দিনেই এক ঘণ্টা লেগেই যায়। আজ শেষ। "শিয়োর খড়ুসের চোখ রাঙানি খেটেই হবে তোকে রুমুন আজ, প্রেজেন্টেশন ডিউ তো দশটায়। কেউ বাঁচাতে পারলো না আজ তোকে রুমুন।" নিজেই নিজেকে বলতে থাকে ও। অন্যান্যদিন তাও বা ইস্তিরি করা জামাকাপড় পরে বেরোয় ও। আজ তো হাতের কাছে যা পেয়েছে, সেই পরে কোনমতে ছুট লাগালও। একটার পর একটা ট্যাক্সি মুখের ওপর "যাবো না" বলে চলে যাচ্ছে। কী বিরক্তিকর পরিস্থিতি। প্রায় কুড়ি মিনিট অপেক্ষার পর ও ভাবলও, রিক্সা ধরে এইট বি যাবে। সেখান থেকে এস নাইন। এবার সমস্যা। রিক্সার দেখা নেই। ছাতা মাথায় এদিক সেদিক করেও লাভ নেই। ত্রিসীমানায় একটা রিক্সার দেখা নেই। হাত কামড়ানোর অবস্থা যখন রুমুনের, হঠাৎ দেখতে পেল দূরে একটা রিক্সা আসছে, অবশ্য এমন প্লাস্টিক জড়ানো, বোঝার উপায় নেই তাতে সওয়ারী আছে না নেই। তবে যা অবস্থা এখন, চেষ্টা করতেই হবে। কোনমতে লাল ছাতাটা খুলে দৌড়ে রাস্তা পার হতে এগোল রুমুন। এবং তারপর? ব্যস, যা ভবিতব্য, ঠিক তাইই হল।

রুমুন সুন্দরী, বুদ্ধিদীপ্তা ইত্যাদি আরো নানান বিশেষণে বিভূষিত হলেও কেউ ওকে কখনও সুতন্বী বলতে পারবে না। বরং একটু গোলগাল ভারিই চেহারা ওর। এর ফলে ওকে একটু বেশিই মিষ্টি লাগে দেখতে। তবে সব ভালোর মধ্যে একটা বেজায় খারাপ রকএম্র সাইড এফেক্ট আছে। ও যখন তখন যেখানে সেখানে ধুপধাপ করে উল্টে পড়ে যায়। তা যেই মেয়ে শুকনো ডাঙ্গায় পড়তে কারণ খোঁজে না, যার সেন্টার অফ গ্র্যাভিটি অন্যদের থেকে একটু অতিরিক্ত মাত্রায় বিচ্যুত, সে যে এমন বর্ষার দিনে জলে থইথই রাস্তায় পড়বে না, তা কখনও হয়? ঝপাৎ করে জলের ওপর পড়ল ও। ভাগ্যিস বেশি কাঁদা ছিল না, এই রক্ষে। তবে টের পেল বাঁ পায়ের গোড়ালিতে ভালোই লেগেছে। মচকেই গিয়েছে হয়তো। আর সাথে সাথে জুতোর স্ট্র্যাপ ছিঁড়েছে। রিক্সাও না থেমে চলে গিয়েছে ইতিমধ্যে। কী বিব্রত অবস্থা। ধুর, ভাল্লাগেনা। রুমুনের দুই চোখ ছাপিয়ে জল এসে যাওয়ার জোগাড়। ফ্ল্যাটে ফিরে জামা জুতো বদল করে অফিস যেতে গেলে যা লেট হবে, তার চেয়ে একটা সিক লিভ নিয়ে নেওয়া ভালো। এদিকে যে আজ প্রেজেন্টেশন? সেটা?

ভিজে স্নান, মচকানো পা নিয়ে ল্যাজে গোবরে অবস্থা এখন রুমুনের। কোনমতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চারতলায় উঠল ও। ফ্ল্যাটের দরজায় চাবি খুলে বসার ঘরের সোফায় ব্যাগটা রেখে একটু গা এলিয়ে তবে শান্তি। আস্তে করে পা তুলবার চেষ্টা করল ও। ইতিমধ্যে ফুলে ঢোল। ভাঙেনি তো আবার? তাহলে চরম অসুবিধেয় পড়বে। লক্ষন ভালো না। আশু চিকিৎসার প্রয়োজন। আবার ভিজে জামাকাপড় পালটাতে হবে। হাঁচি কাশি এই এলো বলে। কান্না পাচ্ছে রুমুনের। একা বাড়িতে অসুস্থ ও। কেউ নেই একটু সাহায্য করবে যে। কৃষ্ণাদিও ডুব দিয়েছে।

পা টেনে কোনমতে নিজের ঘরে গিয়ে জামা বদলে সবে মাথাটা টাওয়েলে মুছছে, এমন সময় মোবাইলে তারস্বরে "এসো শ্যামল সুন্দর" বেজে উঠল সরোদে। রুমুনের খুব প্রিয় দুটি মিউজিক জনর - ক্লাসিকাল ইন্সট্রুমেন্টাল আর রবীন্দ্রসঙ্গীত। এই দুইয়ের অপূর্ব মেলবন্ধন ওর ফোনের রিংটোন। অফিসের কন্ট্যাক্ট, বন্ধুরা, ফ্যামিলি - একেক গ্রুপের একেক রিংটোন। অফিসে তাই রুমুনের ডেস্কটা একটা যেন মিউজিকাল জোন। ফোনটা পড়ে আছে ড্রয়িং রুমে। খুঁড়িয়ে লেংচিয়ে ও ঘরে পৌঁছতে পৌঁছতে ফোন বেজে বেজে থেমেই গেল। হাতে নিয়ে দেখল লেখা খড়ুসের নাম। মিসড কল। মোবাইলের ডিসপ্লেতে জ্বলজ্বল করছে সকাল সাড়ে দশটা। বেশ কয়েক গুন বেড়ে গেল রুমুনের হার্টবিট। এই রে, এইবারে একটা বড় রকমের ঝাড় খেতে চলেছে ও। পৃথিবীর আর কোন শক্তিই ওকে বাঁচাতে পারবে না। হে ভগবান, ভূমিকম্প এনে দাও। এনে দাও ঝর ঝঞ্ঝা।
 
ভয়ে ভয়ে রুমুন কীপ্যাড আনলক করে কল ব্যাক করলো। খড়ুসকে কেন জানি না রুমুন ভীষণ ভয় পায়। সেটা কী উনি সারাক্ষণ গম্ভীর মুখ করে থাকেন বলে? হাসেন না, তেমন বাহবে গল্প টল্পও করেন না কারুর সাথে।
বাবা, কলার টিউন লাগানো, তাও রবীন্দ্রসংগীত। আলো আমার আলো। ইন্টারেস্টিং! খড়ুস আবার গান বাজনাও শোনে? ভালোবাসে? দেখে তো মনে হয় না। কে জানে। ভগবান, প্লিজ যেন খড়ুস আমার ওপর না চিৎকার করে, প্লিজ ঠাকুর, প্লিজ। হুম, গান বেজে বেজে শেষ হয়ে গেল। ভগবান আজ প্রসন্ন নাকি? বস ফোন আন্সার করলেন না। কে রে বাবা, নিজে এক্ষুণি কল করে আবার নিজেই আন্সার করছে না। অদ্ভুত তো। যাক গে। ফোনটা সবে কান থেকে নামিয়েছে কি নামায়নি, অমনি সরোদ বেজে উঠল রুমুনের ফোনে। নামটা দেখে "হ্যাঁ স্যর, বলুন" বলেছে কি বলেনি, অমনি উল্টোদিক থেকে ভেসে এলো বাক্যবাণ। "মিস দাশগুপ্ত, আপনার ব্যাপারটা কী বলুন তো? সাড়ে দশটা বেজে গিয়েছে। এখনও ডেস্কে নেই। প্রেজেন্টেশন দেওয়ার কথা আজ, সেটাও আমায় দেখালেন না। ওয়াটস দ্য ম্যাটার?"
এই মুস্কিল। রুমুন ভাবে অনেক কিছু বলবে। এমন কী, ফোন ছেড়ে দেওয়ার পরও ফটফট করে অনেক কথা বলতে পারবে, কিন্তু আসল সময়ে গিয়ে স্পিক্টি নট। খড়ুসের কথার কোন জবাব নেই।
"কী হলো? হ্যালো? মিস দাশগুপ্ত, আপনি শুনতে পারছেন?"
এইবারে রুমুন আমতা আমতা করে বলল, "হ্যাঁ মানে, আসলে স্যর আমি আজ ছুটি নিয়েছি। মানে..." রুমুনের কথা শেষ না করতে দিয়েই খড়ুস বস বলে উঠল, "ছুটি মানে? কেন? কবে? কার পারমিশন নিয়ে?"
রুমুনের বলা উচিত ছিল, "অসুস্থ হয়ে পড়েছি হঠাৎ, মেডিকেল রিজনে ছুটি নিয়েছি। মেল করে দিচ্ছি এইচ আরে। প্রেজেন্টেশন মেল করে দেবো।" কিন্তু রুমুন তা বলতে পারল না। কী বলল? নারভাস কন্ঠে বলল, "আসলে স্যর একটু অসুবিধে হয়ে গিয়েছে। আমি এই এক্ষুণি জানিয়েই দিচ্ছিলাম। প্রেজেন্টেশন্টা পাঠাচ্ছি এক্ষুণি। রেডি আছে।"
"আচ্ছা ইরেস্পন্সিবল তো আপনি মিস দাশগুপ্ত। দুদিন বাদে ক্লায়েন্টকে প্রেজেন্ট করতে হবে, তার আগে কোথায় আজ ফাইনাল করব ব্যাপারটা, আপনি আজকেই অ্যাবসেন্ট। রিয়েলি, আনবিলিভেবল।"
"সরি স্যর। আমি এক্ষুণি পাঠাচ্ছি।" কোনমতে বলেই রুমুন ফোন কেটে দিল। কী যে হয়েছে আজকাল ওর, কথায় কথায় চোখ ফেটে জল আসে। হাপুস নয়নে কাঁদতে বসল।
টুং টাং করে দু তিনবার ফোনে এস এম এস ঢুকল। একটা ওর কলিগ মালবিকার। কেন আসেনি অফিস, জানতে চেয়েছে। আর বাকি খড়ুসের। উফ। একটুও শান্তি দেবে না কেউ। দশ মিনিটও হয়নি, মেসেজ ঢুকেছে খড়ুসের। প্রেজেন্টেশন চেয়ে। চোখ মুছে ল্যাপটপ চালু করে ঝটপট মেল করল ও। শুধুমাত্র সাবজেক্টে "ইয়োর প্রেজন্টেশন" লিখে অ্যাটাচমেন্টে  ফাইলটা। মেলে একটা বাড়তি কথা নেই।
এবারে রুমুন একটু খুড়িয়ে উঠে নিজের ঘরে গেল। ফার্স্ট এডের বাক্সটা ওখানেই। বাথ্রুমে গিয়ে একবার গীজার চালিয়ে ওষুধের বাক্স থেকে পেন কিলারের পাতা বের করল। সাথে নিল পেন রিলিভিং জেল আর ব্যান্ডেজ। কল খুলে গরম জল বালতিতে ভরে একটু পা ডুবিয়ে যদি আরাম পাওয়া যায়। তারপর ওষুধ লাগিয়ে রেস্ট। একা একা এমন মুহূর্তগুলোয় খুব অসহায় লাগে রুমুনের। কেউ নেই পাশে, একটু সেবা শুশ্রূষা করার। বা অন্তত খেয়াল নেওয়ার।
সেঁক দিয়ে ওষুধ লাগিয়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ জড়িয়ে রুমুন মোবাইলটা নিয়ে বসল। অফিসে একবার মালবিকাকে ফোন করে বলে দেবে, এইচ আরে জানিয়ে দিতে ছুটির ব্যাপারে। অবশ্য এতক্ষণে হয়তো খড়ুস ওর নামে কমপ্লেন ঠুকে দিয়েছে। কে জানে বাবা। মালবিকা রুমুনের অফিস কলিগদের মধ্যে বেস্ট ফ্রেন্ড। কাছাকাছি বয়সী বলে বন্ডিংটা দারুণ। তবে সবচেয়ে বেশি ভাব কারণ ওরা দুজনেই খড়ুসকে সমানভাবে অপছন্দ করে।

"হ্যালো। মালো?"
"বলো রুমুনদি। আজ এলে না কেন? তোমায় মেসেজ করেছিলাম।"
"হ্যাঁ আর বলিস না। অফিস যাবো বলে রেডি হয়ে নীচে দাঁড়িয়ে আছি। রিক্সা ধরতে গিয়ে উল্টে পড়ে পা মচকে একশা। আবার তার ওপর ভিজেওছি। হাঁচি শুরু হয়েছে সাথে। ওরে বাবা রে, হ্যাঁচ্চো। হ্যাঁচ্চো। হুম। দেখছিস? ওই জন্যই যাইনি।"
"এদিকে তোমার খড়ুস তো তোমায় চোখে হারাচ্ছিলো। বারবার এসে মিস দাশগুপ্ত কোথায়, মিস দাশগুপ্ত এখনো এলো না কেন করে যাচ্ছিল।"
"চুপ কর। চোখে হারানো না ছাই। প্রেজেন্টেশন দেওয়ার ছিল আমার। তাই। আমায় ফোন করে পঞ্চাশটা কথা শুনিয়ে দিয়েছে জানিস। উফ বাবা রে। কী কর্কশ কী কর্কশ লোক। সারাদিন করলা সিদ্ধ খায় মনে হয়।"
"হিহি! ওষুধ টোশুধ কিছু লাগলে বলো। যাবো সন্ধ্যায়। বাবা রে, কী বৃষ্টি বলো দি।"
"হ্যাঁ। ওই তো হলো আমার কাল। যাক গে। তুই কাজ কর। আবার লোকটা তোকে ফোনে দেখলে ঝাড় দিতে আসবে।"
"হুম। তাই না তাই। তুমি সাবধানে থেকো রুমুনদি। ব্যথার ওষুধ খেয়ো। টেক কেয়ার। বাই।"
"হুম। বাই।"
ফোন ছেড়ে রুমুন দেখল একটা এস এম এস ঢুকেছে ফোনে। খড়ুসের। লেখা "ওয়েল ডান। নো কারেকশন্স নিডেড।" হুহ! তবে? এটা রুমুন দাশগুপ্তর কাজ হে, কোনো খুঁত খুঁজে পাবে না কেউ। নির্ভুল কাজ। ফালতু ফালতু কথা শুনিয়ে দিলো। আর রুমুনও বলিহারি যাই। উত্তর দিতে আর শিখলো না। ক্যাবলা হয়েই রয়ে গেল। ধুর। কোথায় এস এম এসের রিপ্লাইতে এইসব কড়া করে ডোজ দেবে, তা না। শুধু "ওকে। থ্যাংকস" লিখে ছেড়ে দিলো।
মেসেজের ডেলিভারি রিপোর্ট আসার আগেই মালবিকার এস এম এস।
"কখন যে লোকটা কিউবিকলে এসেছিল, টের পাইনি। কে জানে কত কী শুনলো। জিজ্ঞেস করলো তোমার কী হয়েছে। বললাম সব। একটু ও আচ্ছা বলে বেরিয়ে গেল। কোথায় গেল, জানিনা।"
মালবিকার এই স্বভাব। শর্ট করে লিখতেই পারেনা। যার ফলে এই কথাটা আসতে অন্তত চারবার ফোনে টুং টাং হলো। রুমুন লিখলো উত্তরে, "মরুক গে যা। যে চুলোয় ইচ্ছে যাক।"



অনেকদিন পর হঠাৎ একটা এরকম ছুটি পেয়েছে রুমুন। পায়ে ব্যথা। রেস্ট দেওয়ার দরকার খুব। বৃষ্টিও পড়েই চলেছে। তাই বেরোনোর কোনো সিন নেই। দুপুরের রান্না করার ক্ষমতা নেই। ম্যাগি করে নেবে খন মাইক্রোতে। রিমোটটা হাতে নিয়ে টিভি চালালো ও। এ চ্যানেল ও চ্যানেল পরপর ঘুরেই যাচ্ছে। সর্বত্র শুধু প্রেমের গান আর প্রেমের সিনেমা। ভাল্লাগেনা। ব্রেকআপের পর থেকে এই সব ভীষণ বিরক্ত লাগে রুমুনের। পারদপক্ষে এড়িয়েই চলে। কিন্তু আজ কিচ্ছু করার নেই। ভ্যালেন্টাইনস ডে বলে কথা। সব চ্যানেলেই এই দেখাবে। খবরের চ্যানেলেও কোথায় কোন পার্কে কোন যুগলকে কে হ্যারাস করলো আর কোন সেলিব্রিটি কার সাথে কোথায় ঘুরছে। পারেও বটে ওরা।

কী করবে কী করবে? বেশ। ওয়ার্ল্ড সার্ভিস রেডিওতে একটু গান শুনলে হয়। রুমুন গান ভালোবাসে বলে গত বছর জন্মদিনে বাবা এইটির ব্যবস্থা করে দেয়। কত রকমের চ্যানেল। ভাষা কত। খুব পছন্দ এটা ওর। ইনস্টিউমেন্টাল মিউজিকের চ্যানেলটি চালালো। আহা, দরবারী  কানাড়া বাজাচ্ছেন কেউ। এক রাশ মুগ্ধতা।

কখন যে বাজনা শুনতে শুনতে একটু ঘুম এসে গিয়েছিল, কে জানে। মোবাইলের আওয়াজে ধড়ফড় করে উঠলো ও। হাতে নিয়ে দেখল খড়ুস ফোন করছে। আবার কী হল। আর পারা যায় না। ধ্যাৎ।
কোনোমতে ফোনটা রিসিভ করে বললো, "হ্যাঁ স্যর বলুন।"
উত্তর এলো, " ডাব্লু আই বি আর ১২ বাই এইট, এটাই আপনার এড্রেস তো?"
সে কী, ঠিকানা পেলো কোত্থেকে। কী দাবি আবার? রুমুন ঘাবড়ে গিয়ে বলল, "হ্যাঁ।।ওটাই। কেন?"
"দশ মিনিটের ওপর বেল বাজিয়ে যাচ্ছি। দরজাটা খুলুন।"
এহ? বলে কী? এখানে? কী হলো?"
ভেবলে ভ রুমুন। "হ্যাঁ আসছি। একটু দাঁড়ান।" বলে রুমুন উঠলো। ভয় উত্তেজনা সব মিলিয়ে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বাঁ পায়ে চোটের ওপরেই চাপ দিয়ে ফেলল। আর তখুনি "আহ" বলে চেঁচালো।
একটু বেশিই জোরে হয়ে গেল নাকি?
বাইরে শোনা গেল। খড়ুস "সাবধানে মিস দাশগুপ্ত" বলল একটু অস্থির হয়েই।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে রুমুন দরজা খুলে "আসুন। বসুন। বলুন কী হয়েছে" বলে দাঁড়িয়ে রইলো।
"আরে দাঁড়িয়ে রইলেন কেন। আপনার পায়ে ব্যথা। আপনি বসুন।" খড়ুস ওর দিকে এগিয়ে এলো। ধরে বসাতে। বাবাঃ, দরদ! হুহ!
"না ঠিক আছে। আপনি বসুন স্যর। বলুন কী হয়েছে।"
"আসলে আমি অ্যাপলোজাইস করতে এসেছি।"
"অ্যাপলোজাইস? কেন? কীসের? কাকে?"
"উফ মিস দাশগুপ্ত, আপনি বড্ড প্রশ্ন করেন।"
"সরি।" ধুর, যখন কথা বলার দরকার, মুখ ফুটে কথা বেরোয় না। আর এদিকে দেখো, এখন চুপচাপ শুনে যাওয়া উচিত, তা না, মেয়ের মুখে বুলি ছুটছে। ছি রুমুন, কবে যে তোর কোন সেন্স হবে? নিজের মনেই নিজেকে শাসন করতে থাকে রুমুন।
"না না, ওটা কথার কথা।"
"না মানে কথার কথা না। মানে, আমি সত্যিই সরি।" ভেব্লে গিয়ে রুমুন বলল। ব্যাপারটা কী হচ্ছে আজ? সাধারণত নার্ভাস থাকে ও, কিন্তু তা বলে এরকম যাকে বলে ছড়িয়ে ছ তো করে না। এটা কি তাহলে এই ব্লু ফর্মাল শার্ট আর সাঙ্ঘাতিক রকমের ভালো পারফ্যুমের এফেক্ট? অন্যান্য দিন খড়ুসকে দেখে যতটা ইরিটেশন হয়, কই এখন কিন্তু হচ্ছে না। উল্টে একটু যেন আদেখলাপনা করে বারবার ওর দিকে তাকাতেই ইচ্ছে করছে রুমুনের। ছ্যাঃ রুমুন। কী হল টা কী? পায়ে চোট এভাবে ব্রেনকে অ্যাফেক্ট করে নাকি? সাইন্সের বন্ধুদের বলতে হবে, রিসার্চ করতে। সেরোটোনিন ডোপামিনগুলো বেইমানি করছে নাকি?
"না না ভুল বুঝছেন মিস দাশগুপ্ত। যাই হোক, ব্যাপারটা হল তখন প্রেজেন্টেশন নিয়ে আমি খুব চিন্তিত ছিলাম। তাই আপনার ওপর একটু বেশিই কড়া হয়ে গিয়েছিলাম। আপনি যে জেনুইনলি অসুস্থ, সেটা বুঝিনি। না জেনেই চেঁচালাম আপনার ওপর।"
"আর তাই বুঝি এখন এসেছেন ইন্সপেক্ট করতে? যে মালবিকা যা বলেছে, সত্যি না মিথ্যে। যাচাই করতে এসেছেন?"
এই রে, রুমুন অন ফায়ার! কী হল? নিজেই যে অবাক। এসব কী বলে চলেছে।
"এ বাবা মিস দাশগুপ্ত, একদমই তা না। বলছি তো। আয়াম এক্সট্রিমলি সরি। আমি আসলে সত্যিই ক্ষমা চাইতে এসেছি। এই যে দেখুন, একটা কার্ড এনেছি। এই যে, সরি লেখা।" এই বলে খড়ুস পিঠের ব্যাগ থেকে একটা বেগুনি রঙের খাম বের করলো। রুমুন হাতে নিয়ে দেখল, মিষ্টি একটা টেডি বিয়ার। হাতে এক গুচ্ছ বেলুন। কাচুমুচু মুখ করে সরি বলছে। আর রাগ টাগ জমিয়ে রাখতেই পারল না ও। এক্কেবারে হেসে ফেলল।
রুমুনকে হাসতে দেখে খড়ুসও নিশ্চিন্ত। উফ। এম বি এর অ্যাসাইনমেন্ট এর চেয়ে ঢের সোজা। এতক্ষণ তো ভয়ে জেরবার হয়ে ছিল। কীভাবে রুমুনের কাছে ক্ষমা চাইবে, কথাই বা বলবে কী করে। আসলে কাজ পাগল তো ভীষণ, তাই প্রেজেন্টেশনের চিন্তায় এক্কেবারে চ্যাপ্টা হয়ে গিয়েছিল। আর তাই না বুঝে শুনে রুমুনের ওপর চিৎকারও করে ফেলেছে। তারপরে মালবিকার কাছে যখন জানতে পারল, রীতিমতো কুণ্ঠিত বোধ করছিল। আসলে খড়ুস আমাদের মানুষটা বেজায় ভালো। শুধু অভিব্যক্তিগুলো প্রকাশ করতে পারে না। আর তাই এমন নামকরণের শিকার। আসল নাম যে অফিসের কটা স্টাফ মনে রেকেহছে কে জানে। ও জানে, সবাই আড়ালে ওকে একেক রকম নামে ডাকে।

যাক গে। মিটমাট যখন হয়েই গিয়েছে, আর ডিস্টার্ব করে লাভ নেই ওদের। নিজের গাড়ি নিয়েই এসেছে যখন, এবার একটু রুমুনকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাক। পা মালিশ করে দিক। সেবা শুশ্রূষা করুক। ভালো দিনেই দেবীর চরণে স্থান পেল দেখছি!

রুমুনও বেশ খুশি। এক্সট্রা আহ্লাদিত আর কী। এই তো, এত অ্যাটেনশন পাচ্ছে, বেশ লাগছে কিন্তু। একেবারে রাণীর মতো সেবা, আহা। আবার তার সাথে উপরি পাওনা হয়েছে, মিউজিক ওয়ার্ল্ড থেকে কিনে আনা "মনসুন রাগাস" নামের সিডি। শুনছে খড়ুসের তেমন কাজ নেই অফিসে। প্রেজেন্টেশন তো পারফেক্ট আছে। বাইরে বৃষ্টিও পড়েই চলেছে। বলবে নাকি ওকে থেকে যেতে? সারাদিনই তো টিভির সব চ্যানেলে বেশ মাখো মাখো সিনেমা চলছে। একসাথে দেখলে মন্দ হয় নয়। তাই না? 

No comments:

Post a Comment