Friday, February 22, 2019

ফাল্গুনী

মাস তিনেক হয়ে গিয়েছে রুমুন এসেছে নিউ জার্সির ব্লুমসফিল্ডে। চাকরিসূত্রে। কাউকেই চেনেনা এখানে এখনও। রুমুনের বড় হওয়া খাস কলকাতায়। অনেক আত্মীয়স্বজনের মধ্যে। আর তাই মার্কিন মুলুকে এসে আরোই একা বোধ করে। সোম থেকে শুক্র অফিস বাড়ি করতেই কেটে যায়। উইকেন্ডে কাছাকাছি সুপারমার্কেট থেকে সারা সপ্তাহের বাজার আর টুকটাক রান্না। এখনও গাড়ি কেনেনি। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ভরসা। আর তাই এখনও ধারেকাছে যে ভারতীয় দোকানপাট আছে এডিসনে, সেখানেও যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
সারা সপ্তাহে ব্যস্ততা থাকলেও শনি রবিগুলো বড্ড একলা লাগে রুমুনের। ও ব্যালকনি থেকে দেখেছে পাশের এপার্টমেন্টে যারা থাকে, তাদের দুটো পোষা লোমশ কুকুর রয়েছে। কলকাতায় রুমুনদের বাড়িতেও অনেক বছর অবধি ভুট্টা, কাজু, ভুট্টার মা এই নামের সব পোষ্য নেড়ি ছিল। এদের দুটোকে দেখলে রুমুনের খুব মনে পড়ে যায় বাড়ির কথা। ইচ্ছে করে একটু আদর করতে। কিন্তু বন্ধুরা সাবধান করে দিয়েছে। এ দেশে ওইসব করলে পুলিশ কেস হয়ে যেতে পারে। রুমুনের মোটেই ভালো লাগছে না এই দেশ। বড্ড বেশিই যেন ফরম্যাল সব। হুঠহাঠ যাকে তাকে তেমন আপন করেও নেওয়া যায় না। এখানে অমন পাড়াতুতো কাকা মাসি দাদা বৌদির কোনো গল্পই নেই। মাঝে মাঝে রুমুনের বড্ড হাঁসফাঁস লাগে।
এক শনিবার দুপুর দুপুর ঝটপট খাওয়া দাওয়া সেরে একটু বেরিয়েছে পায়ে হেঁটে এদিক ওদিক ঘুরবে বলে। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ। অথচ এখনও কী জব্বর শীত। হাওয়াও দিচ্ছে ভালোই। কালো ওভারকোটের বোতামগুলো আটকে নিলো রুমুন। লাল স্কার্ফটাকে জাপ্টে দিলো গলায়। ঠান্ডার মরসুমের দুপুরের রোদ, যতটা শুষে নেওয়া যায় আর কী, সেই ভেবেই বেরোনো। ওদের নেবারহুডের বাড়িগুলো প্রায় সব এক দেখতে। খয়েরি পাথরের মত দেওয়াল। ঢালু লাল ছাদ। সাদা কাঠের দরজা জানালা। সিঁড়ি উঠে আছে এক তলা। অনেকেরই বারান্দায় মার্কিন দেশের পতাকা ঝোলানো। কারুর আবার মরসুমি ফুলের গাছে ভরা। বেশ লাগছিলো ঘুরে বেড়াতে। নির্জন রাস্তা। মাঝে মাঝে এক দুটো গাড়ি সাঁ সাঁ বেগে ছুটে চলে যাচ্ছে। মোবাইল ক্যামেরায় টুকটাক এদিক ওদিক ছবি তুলতে থাকে রুমুন। মাঝে সাঝে এক দুটো সেলফিও।
হঠাৎ একটা বাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো ও। পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে প্রেশার কুকারের সিটি। ভুরভুর করে ভেসে আসছে গরম মশলা মাখা পাঁঠার মাংসের সুগন্ধ। মাথা উঁচু করে খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে রইলো ও। যেন চেটে পুটে নিতে চায় এই ঘ্রাণ। এক ঝটকায় রুমুন পৌঁছে গেল ছোটবেলার রবিবারে। মায়ের হাতের মাংসের ঝোল ভাত। আর চাটনি। যা না হলে ছুটির দিন হতো অপূর্ণ।
কতক্ষণ এমন দাঁড়িয়ে রয়েছে রুমুন, খেয়াল নেই। সম্বিৎ ফিরল "এক্সকিউজ মি" ডাকে। পুরুষ কন্ঠ। ওপরে তাকিয়ে যেন সেই কলকাতার বাড়ির ঘোরের মধ্যে থেকেই রুমুনের গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো, "কিছু বলছেন?" বলেই জিভ কাটলো ও। "আই মিন, ডিড ইউ সে সামথিং?" জিজ্ঞেস করলো ও। ওপর তলা থেকে উত্তর এলো, "বাংলাই চলুক না। দিব্যি লাগলো কানে। আশে পাশে তো বাংলা শুনতেই পাই না।"
রুমুন হাসলো। ওপরতলা থেকে আবারও কথা ভেসে এলো, "পাঁঠা রাঁধছি। মানে চেষ্টা করছি। সেই জোগাড় যন্ত্র করতে করতেই এত বেলা হয়ে গেল। বলছি যে অসুবিধে না থাকলে ওপরে চলে আসুন না। একটু টেস্ট করে বলবেন কেমন রেঁধেছি। মাকে বলতে হবে তো।"
পাড়া পড়শীদের মধ্যে বাঙালি পাবে, ভাবতেই পারেনি রুমুন। উফ। এইবারে ভালো করে আলাপটা করতেই হচ্ছে যে। হেসে তাই ও বললো, "আসছি।"
"আসুন। ও, আমি অগ্নি বাই দ্য ওয়ে।"
"আমি রুমুন।"

রুমুন যখন ঢুকলো অগ্নির এপার্টমেন্টে, তখন সাউন্ড সিস্টেমে গমগম করছে শান্তিদেব ঘোষের কণ্ঠে 'রাঙিয়ে দিয়ে যাও..'। কিচেন থেকে আসছে মাংসের ঝোলের অসাধারণ সুবাস। বিরাট জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বড় বড় গাছ। শীত শেষে তাদের শুকনো ডালে এবার আস্তে আস্তে কচি সবুজ পাতা ধরতে শুরু করেছে। বিদেশ বিভূঁইয়েও বুঝি ফাল্গুনী ছোঁয়া লাগলো বলে।

No comments:

Post a Comment