সকাল থেকেই মনটা চিড়বিড় চিড়বিড় করছে অগ্নির। ফোনের অ্যালারমটা বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আজ সকাল সকাল বেরোনোর কথা ছিল। অফিসে প্রচুর কাজের পাহাড়। এদিকে ঘুম ভাঙতেই দেরি হয়ে গেল এত... রুমুনের সাথে গত তিনদিন ধরে একটা ঝগড়া চলছে। আপাতত কথা বলাবলি বন্ধ। তাই স্বাভাবিকভাবেই ওকে বলতেও পারেনি ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেওয়ার কথা। ঘুম ভাঙল যখন, দেখল রুমুন প্রতিদিনের মতোই স্নান সেরে রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করে যাচ্ছে। দুজনের জন্য ব্রেকফাস্ট বানানো, লাঞ্চ প্যাক করা। রেডিওতে বাংলা গান বাজছে আপন মনে। অগ্নি ঘড়িতে সময়টা দেখে একটু বকাবকি করতেই যাচ্ছিল, তখনই মনে পড়ে গেল গত কয়দিনের ঝগড়ার কথা। কিছু বলল না। তাড়াহুড়ো করে স্নান করে এসে যখন ডাইনিং টেবিলে পৌঁছল, দেখল বউ ইতিমধ্যে বেরিয়ে গিয়েছে। টেবিলের ওপর ওর ব্রেকফাস্ট ঢাকা দিয়ে রাখা। প্লেটের ওপর একটা হলুদ স্টিকি নোট সাঁটানো। তাতে লাল কালিতে গোটা গোটা করে লেখা, "অ্যালারমের শব্দটা আরো একটু জোরে দিবি। নয়তো এরপর থেকে আমায় বলে রাখবি। ঝগড়া ঝগড়ার জায়গায়, প্র্যাকটিকালিটি নিজের জায়গায়..."। রাগ হল অগ্নির। হুহ, তার মানে রুমুন সবই বুঝেইছিল, কিন্তু তবুও ওর ঘুম ভাঙ্গায়নি। ভাগ্যিস পছন্দসই স্ক্র্যাম্বল্ড এগস আর বাটার টোস্ট ছিল ব্রেকফাস্টে। তাই একটু হলেও ক্ষতে প্রলেপ পড়ল ওর।
যেদিন তাড়া থাকে, সেদিনই পৃথিবীর সমস্ত জ্যামজট ওরই রাস্তায় পড়ে। এই ব্যাপারটা অগ্নির বিরক্তিকর লাগে বড্ড। যাদবপুর থানার সিগনালে আটকে আছে প্রায় সাত মিনিট হতে চলল। সাউথ সিটির দিক থেকে একের পর এক গাড়ি এসেই চলেছে। বাইপাসের কানেক্টরের মুখে লম্বা জ্যাম। এদিক ওদিক থেকে অধৈর্য গাড়িগুলো সমানে হর্ন বাজিয়েই চলেছে। গাড়ির এসিটা বাড়াতে অগ্নির নজর গেল ড্যাশবোর্ডের ওপর। সুইঙ্গিং ডলের ঠিক নীচে, একটু আড়ালে রয়েছে বলে এতক্ষণ চোখে পড়েনি। আরো একটা স্টিকি নোট। এবারে আবার গোলাপী রঙের। তাতে বেগুনি রঙে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা "দেখ, অপেক্ষা করা ছাড়া যখন এই মুহূর্তে আর কোন রাস্তা নেই, বরং এখন আমাদের পরবর্তী ভেকেশনের প্ল্যান কর। কাজে দেবে।" হুম। আগামী গ্রীষ্মে একটা দিন সাত দশের ট্যুর তো প্ল্যান করারই কথা। শতদ্রু, ওদের বন্ধু, সম্প্রতি সিকিমের কোনো জায়গা থেকে ঘুরে এসে ছবি দিয়েছিল ফেসবুকে। সান্দাকফু হয়তো। ওর থেকে জেনে নিতে হবে। ওদের দুজনেরই যখন পাহাড় পছন্দের, আশা করছে ট্রিপটা ভালোই হবে। চোখ তুলে অগ্নি দেখল, ট্র্যাফিক লাইট সবুজ হতে আর কুড়ি সেকেন্ড। থাক তাহলে। এখন ফোন করা যাবে না। পরের সিগনালে শতদ্রুকে একটা কল করে দেখবে।
অফিস পৌঁছে অগ্নি কাজের জগতে ডুবে গেল। একটার পর একটা এক্সেল শিট, প্রেজেন্টেশন, ফাইল সই। হাজার একটা কাজ। আসে পাশের কিউবিকল থেকে একে একে লোকজনকে ক্যান্টিনের দিকে যেতে দেখল। তখন খেয়াল হলো, আরে। লাঞ্চ টাইম হয়ে গিয়েছে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল দুটো বেজে গিয়েছে। আর রুমুনের একটা মিসড কল, দেড়টা নাগাদ। প্যান্ট্রিতে বসে খেতে খেতে কল ব্যাক করে নেবে ভেবে অগ্নি লাঞ্চ বক্সটা বের করলো ব্যাগ থেকে। এবং বের করেই কীরকম যেন অন্য দিনের থেকে আলাদা কিছু, এমন বোধ হল। আরে, বক্সটা এত হাল্কা কেন। অন্যান্যদিন তো স্যান্ডউইচ, কেক, ফল ইত্যাদির ভালোই ওজন হয়। আজ কী ব্যাপার? রহস্যের সমাধান ঘটল ঢাকনা খুলতেই। খালি টিফিন বাক্স। না, ঠিক খালি অবশ্য না। ভিতরে আরো একটা চিরকুট। এইবারে নীল রঙের স্টিকি নোটে, সাদা দিয়ে লেখা, আবারও গোটা গোটা অক্ষরে। "অনেকদিন লাঞ্চ করিনা একসাথে। প্ল্যান করে করতে গেলে তো হচ্ছিল না, তাই এমন উদ্ভট কাণ্ড করলাম। চল এখন কোথাও খেতে যাই। ফোন কর।"
সত্যি, রুমুনটা বড্ড পাগল, ছেলেমানুষ। সপ্তাহের মধ্যিখানে এমন ব্যস্ত দিনে নইলে কেউ এরকম কাণ্ডকারখানা করে? তবে আইডিয়াটা নেহাত মন্দ না। ফোনে ফেভারিট কন্ট্যাক্টস থেকে প্রথম নামটিই ডায়াল করলো অগ্নি। ফেলুদা থিম মিউজিক বাজছে। ওদের দুজনেরই একই রিংটোন। অনেক একই পছন্দ অপছন্দের মধ্যে এইটা অন্যতম। অল্প রিং হতেই রুমুন ফোন ধরে বলল, "বাপরে বাপ, এতক্ষণে তোর খিদে পেল? আমার পেটে ছুঁচো ডন বৈঠক দিচ্ছে সেই কখন থেকে!"
অগ্নি হেসে বলল, "ফোনটা একবার করে ছেড়ে দিলে হয়? খিদের মতো এমারজেন্সিতে বারবার ডায়াল করবি তো? যতই ব্যস্ত থাকি, ঠিক ধরব তাহলে..."
রুমুন কপট রাগতস্বরে বলে, "আর তারপর ন্যাগিং বউয়ের তকমা পাই আর কী। হুহ। ওই ট্র্যাপে আমি পড়ছিনা। যাই হোক। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি দশ মিনিটে। সিসি টু পার্কিং লটে মিট করছি।"
"আসছি আসছি। এক্ষুণি।" বলল অগ্নি।
"এক মিনিট। একটা পুনশ্চ আছে", রুমুন থামায়।
"কী"? অগ্নি প্রশ্ন করে।
"এইবারের ঝগড়াটা যেহেতু তোর শুরু করা, ডেসার্টটা তুই স্পন্সর করছিস। ঠিক আছে?" মিষ্টি প্রিয় রুমুনের গলায় খুশি স্পষ্ট।
"ডান! যদিও..." কিছু একটা আরো বলতে যাচ্ছিল অগ্নি। রুমুন থামিয়ে দিয়ে বলল, "ঘাড়ে কটা মাথা রে তোর? এক সেট ঝগড়া মিটতে না মিটতেই আবার সংলাপে যদিও আনছিস? উফ। ফোন রাখ। শিগগির আয়। আই অ্যাম স্টারভিং!"
"আসছি!"
No comments:
Post a Comment