বেলা তিনটে। রবিবার। পাড়ার সিগারেটের দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে সবে একটা ব্ল্যাকে আগুন ধরিয়ে একটা টান দিয়েছে শৌর্য, "কী কাকা, ব্যাপার কী বলো। এই অবেলায় সিগারেট?" বলে ওর পিঠে একটা চাপড় মানলো পাড়াতুতো ভাই, সংগ্রাম।
"কিচ্ছু না কাকা। জীবনে তো সবই ধোঁয়া, তাই আরেকটু বাড়িয়ে নিচ্ছি।" শৌর্যর গলায় হতাশা স্পষ্ট।
"বিশুদা, আমায় একটা গোল্ড দাও" বলে সংগ্রাম প্লাস্টিকের টুলটা টেনে বসল। একটা সুখটান দিয়ে শৌর্যর দিকে তাকিয়ে বলল, "কাকা কেস কী বলো দেখি। কেমন একটা ভেবলে গেছো মনে হচ্ছে।"
"ভাইপো, কী আর বলি। একটা জ্ঞান দিতে পারি। এই যে কথায় বলে না, the way to a man's heart is through the stomach, এটা কিন্তু মেয়েদের জন্য খাটে না। ছেলেদের ক্ষেত্রেও আজকাল খাটে কি, জানিনা। অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু মেয়েদের জন্য নৈব নৈব চ।" শৌর্য বেশ জোর দিয়েই বলে।
"বাবাঃ, কাকা, এত বড় কথা! খুলেই বলো কেসটা।" সংগ্রাম এবার আর কৌতূহল দমন না করতে পেরে বলে।
"আরে, ওই যে রুমুন.." শৌর্য শুরু করে।
"তোমার তো বিশাল চাপ রুমুনদির ওপর", সংগ্রাম একটু হেসে বলে।
"হুম। একটু না। ভালোই। তা আমি তো জানি ও হেব্বি খেতে টেতে ভালোবাসে। তাই একটু সেই সুযোগে ভাবলাম প্রোপোজ করে ফেলি। ফেব্রুয়ারি মাস বলে কথা। সেই জন্য বলে কয়ে ওকে নিয়ে খেতে গেলাম 'খাই খাই'তে।"
"আরি শালা, খাই-খাই। তা তারপর?"
"ওর পছন্দসই সব খাবার অর্ডার করলাম। চিংড়ির পকোড়াটা দারুণ বানিয়েছিল। মিন্ট চাটনি দিয়ে খেতে খেতে খুড়তুতো বোনের বিয়ের গল্প শুরু করলাম। ভাবলাম বুঝি এইভাবে কন্টেক্সট আনবো। ও হুম হা করে গেল। ভাবলাম খাবারেই মন দিচ্ছে মনে হয়। শুনছে টুনছে না।"
"হতেই পারে। যা পেটুক রুমুনদি।" সংগ্রাম ফুট কাটলো।
"দোকানের স্টাফগুলো আবার দেখি এক্সট্রা এফিশিয়েন্ট। ভাবছিলাম স্টার্টার আর মেন কোর্সের মাঝে গ্যাপ পাবো। তখন ঝেড়ে কাশবো। যাতে কিনা রসগোল্লা দিয়ে ডাইরেক্ট প্রোপোজ করতে পারি। ধুর ধুর। পকোড়ার প্লেট উঠিয়ে নিয়ে যেতে যেতেই দেখি গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত আর তরকারি ইত্যাদি নিয়ে সব হাজির। আমার বোঝা উচিত ছিল। সবই সাইন। আমার প্ল্যানও ওরকম ধোঁয়ায় উড়ে যাবে।" কাঁচুমাচু মুখ করে কথাগুলো বলতে থাকলো শৌর্য।
"তা মেনু কী ছিল?" সংগ্রাম জিজ্ঞেস করলো।
"আমি মরছি মনের জ্বালায়, আর ভাইপো তুই কিনা মেনু জানতে চাস!" রাগ করে শৌর্য বলল।
"আহা কাকা, রাগ করে না। বলোই না। অন্তত ভালো খাওয়া দাওয়া তো করেছ। আমার মতো তো ডাটা চচ্চড়ি আর শিং মাছের ঝোল খেতে হয়নি রবিবারের বাজারে। রান্নার দিদির আজ হেব্বি তাড়া ছিল। তাই এই জুটেছে কপালে আমার।" বেশ দুঃখ করেই কথাগুলো বললো সংগ্রাম।
শুনে শৌর্যর মন গলে গেল। আহা রে, রবিবার দুপুরে একটু এলাহী খাবার খেতে হয়। বেচারা ছেলেটা। বললো, "হ্যাঁ। তা ট্যাংরা মাছের শুক্তো, মাথা দিয়ে ডাল, চিংড়ি দিয়ে এঁচোর, ইলিশ ভাপা, মাটন কারি, টমেটোর চাটনি এইসব খেলাম।"
"আরিববাস। হেব্বি মেনু।"
"হুম। রান্নাও দারুণ। মাংসটা যা ভালো সিদ্ধ হয়েছিল..আর ইলিশ ভাপাতে সর্ষের কী ঝাঁজ!"
"মিষ্টিতে কী খেলে?"
"আর মিষ্টি। ততক্ষণে দিদিমণি ঠারে ঠোরে শুনিয়ে দিয়েছে। তিনি অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে মন দিয়ে ফেলেছেন ইতিমধ্যে। আমার সব আশায় এমন জল ঢেলে দিল, কী বলি। ঠিক যেন আমার নতুন সাদা পাঞ্জাবিতে কেউ লাইম মিন্ট সোডা ঢেলে দাগ করে দিলো। ধুর ধুর।" শৌর্যর চোখে মুখে দুঃখ স্পষ্ট।
"কাকা, ইটস ওকে। দেয়ার আর মোর ফিশ ইন দ্য রিভার। তুমি হাল ছেড়ে জাল গুটিয়ে ফেলো না।" সংগ্রাম সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে।
"ভাইপো, হচ্ছে না। হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেছি। এবার মনে হচ্ছে নিরামিষাশী হয়ে যেতে হবে। মাছ আর ধরা পড়লো না। বড্ড স্ট্রাগল ভাইপো।"
"কত ধসলো, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড মি আস্কিং। মানে, এই অসময়ে ইলিশ... আবার চিংড়ি, মাটন..."
"আড়াই তো ওখানেই। এছাড়া দুপিঠ এসি সেডান। তাতে আরো হাজার খানেক।"
"ইশ। ইশ। পুরো চুনা লেগে গেলো তো কাকা।"
"তা আর বলতে?"
"না না কাকা। মন খারাপ করো না। ইউ ডিসার্ভ মাচ বেটার। যে মেয়ে এত এফোর্টকে সম্মান করতে পারে না, তার দিকে মনোযোগ দিয়ে লাভ নেই। চলো কাকা, রাত্রে বিরিয়ানি সাঁটাবে চলো। মন ভালো হয়ে যাবে।"
"ধুর। আর টাকা নেই।"
"কাকা, আজ এটা এই ভাইপোর ট্রিট। শোনো কাকা, জেনে রেখো, দুনিয়া এদিক থেকে ওদিক হয়ে যাবে। মেয়ের জন্য মন ভেঙে যাবে। কিন্তু এই ভাইপো, অলওয়েজ অ্যাট ইয়োর সার্ভিস কাকা। অনেক খাইয়েছ আমায় তুমি। আমি নেমকহারামি করবো না। চলো আজ। আর শোনো কাকা, আরেকটা কথা। এইসব সানন্দা বর্তমান মার্কা ম্যাগাজিন পড়া বন্ধ করো তো। যত ভুলভাল জ্ঞানের কথা লিখবে আর তোমাদের মতো সরল লোকজনের ট্যাঁক ফাঁকা করবে। সামনেই আবার ভ্যালেনটাইন্স ডে। হুহ।"
"বুকে আয় ভাই। বুকে।"
মিনওয়াইল, নিজের ঘরে, আরাম করে এসি চালিয়ে শুয়ে রুমুন দেবী গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। খাওয়াটা জব্বর হয়েছে। এবার একটু জমিয়ে অগ্নির স্বপ্ন দেখতেই হচ্ছে!
No comments:
Post a Comment