রাত্রে শোওয়ার আগে ফ্লাস্কে গরম জল ভরে রাখছি ইদানীং। যাতে পরেরদিন সকালে উষ্ণ জল দিয়ে দিন শুরু করতে পারি, গলাটার যা অবস্থা, তাই। গতকাল রাত্রে, ওই ধরুন সাড়ে এগারোটার দিকে অভ্যেসমতোই তাই ফ্লাস্কটি হাতে নিয়ে হোস্টেলের অন্য উইঙে যেখানে জলের ডিস্পেন্সার আছে, সেদিকে গিয়েছি। দেখলাম অবধারিতভাবেই জলের ক্যান শেষ। এবার কী করি?
লিফট ডাকলাম। সাত তলায় গেলাম। দেখলাম ওখানেও জল শেষ। নীচেই নামি। আর কীই বা করব। লিফটটা অনেক ফ্লোরেই থামতে থামতে আসছিল। এক দুজন করে উঠছে, নামছে। পাঁচতলায় লিফটটা যখন ছাড়ল, মোবাইল থেকে চোখ তুলে দেখলাম একটা মেয়ে, হাল্কা সবুজ ম্যাক্সি পরা, চুলে তেল মেখে টানটান করে আঁচড়ানো, হাতে ওরও একটা ফ্লাস্ক। আমায় দেখে হাসল। আমিও হাসলাম।
ইংরেজিতে আমায় বলল, "গরম জল খুঁজছ?"
আমি বললাম, "হ্যাঁ। দেখো না তখন থেকে ওপর নীচ করছি। কোন ফ্লোরে পাচ্ছিনা। কী বিরক্তিকর বলো তো।"
মেয়েটি বলল, "ফার্স্ট ফ্লোরে যাও, পেয়ে যাবে। আমি এই এক্ষুণি নিয়েছি।"
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, "না মানে ফার্স্ট ফ্লোরে আমি ঠিক যাই না।"
মেয়েটি কৌতুকভরে আমায় প্রশ্ন করলো, "কেন? ফার্স্ট ফ্লোর কী দোষ করলো?"
আমি বললাম, "আসলে দু মাস আগে হোস্টেলে যে সুইসাইড কেসটা হলো না? শুনেছি নাকি মেয়েটার ঘর ওই জলের ডিস্পেন্সারের ঠিক গায়েই ছিল। তাই এই রাত্তিরবেলা আর কী ওইদিকে যেতে কেমন গা ছমছম করে।"
মেয়েটা এবার একটু গম্ভীর হয়ে বলল, "এই দেখো, লিফট ফার্স্ট ফ্লোরেই থেমেছে। একা একা যেতে ভয় করবে। বুঝতে পারি। এখন তুমি চলো আমার সাথে। আমি তো আছি। ভয়টা কাটাতে হবে তো।"
আমি ভেবে দেখলাম, প্রস্তাব মন্দ না। দুজনে মিলে যাওয়াই যায়। তাছাড়া এত মেয়ে এই ফ্লোরে রোজ থাকছে। তারা পারলে আমারও এমন ভয় পাওয়া অনৈতিক। মেয়েটি লিফট আটকে দাঁড়িয়েছিল। লিফট এবার বিপ বিপ শব্দ শুরু করলো। ও একটু অধৈর্য হয়ে আমায় বলল, "কী? আসবে নাকি আসবে না? আমি দাঁড়াবো?"
আমি তাড়াহুড়ো করে বেরোলাম ওর সাথে। ওর পিছন পিছন চলেছি। কোন ডিপার্টমেন্ট, পি এইচ ডি নাকি এম এস এইসব জিজ্ঞেস করতে করতে ডিস্পেন্সারের কাছে পৌঁছেছি। আমায় বলল, "নাও, জল ভরে নাও। আমি আছি।"
আমার ফ্লাস্কটা নেহাতই ছোট। জল ভরতে বেশি সময় লাগে না। জল ভরা হয়ে গেলে ফ্লাস্কের ঢাকনা লাগিয়ে পিছন ফিরে দেখি আধো অন্ধকার শুনশান লম্বা করিডরটা ফাঁকা। ওইদিকটা তো ডেড এন্ড। আর ধারেকাছের সবকটা ঘরে তালা ঝুলছে। তাহলে? তাহলে মেয়েটা কোথায় গেল? ভোজবাজি নাকি?
হঠাৎ মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। আমি পড়ি কি মরি ছুট লাগালাম লিফটের দিকে। লিফট তখন সাত তলায়। আমি পাগলের মতো ওপর নীচের বোতাম টিপে চলেছি ক্রমাগত। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। লিফটা প্রতিটা ফ্লোরে থামতে থামতে যতক্ষণে দোতলায় এসে পৌঁছল, ওই দুই তিন মিনিটে আমি প্রায় কোলাপ্স করবো, এমন অবস্থা। লিফট ফাঁকা। কোনভাবে হাঁপাতে হাঁপাতে তিন টিপে দিয়েছি। বিড়বিড় করে ঠাকুরকে ডাকছি। চোখ বন্ধ। "থার্ড ফ্লোর" অ্যানাউন্সমেন্ট শুনে আমি স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বেরোলাম। লিফটের দরজা আস্তে আস্তে বন্ধ হতে লাগল। পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে লিফটের ভিতরের বড় আয়নাটায় একবার চোখ পড়ে গেল। দেখলাম একটা আবছা ছায়া। হাল্কা সবুজ ম্যাক্সি পরা একটি মেয়ের।
No comments:
Post a Comment