বিটকেল হর্ন বাজাতে বাজাতে পাহাড়ি রাস্তার শুনশান নিস্তব্ধতা চুরচুর করে দিয়ে ট্রাকটি মোড়ের মাথা থেকে এগিয়ে এলো। রাস্তায় চলছিল যে ভেড়ার দল, এই শব্দ শুনে উদ্ভ্রান্তের মতো তারা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। ধুলো উড়িয়ে পাথুরে রাস্তা দিয়ে ট্রাকটি ওদের ফেলে এগিয়ে চলল সামনের দিকে। ধুলোর মেঘে ঢাকা পড়ে মেষপালকেরা ট্রাকটিকে গালাগালি দিতে দিতে আবার চলতে লাগল নিজেদের পথে।
ট্রাকটি চালাচ্ছিল প্রীতম সিং। বয়স্ক পাগড়িধারী শিখ চালক। এক হাতে স্টিয়ারিং উইল ধরা, অন্য হাত দিয়ে মাঝে মাঝেই সাদা পুরু গোঁফ পাকাচ্ছেন। ট্রাকটি ওঁর নিজস্ব। বড় সাধের জিনিস, আর তাই নিজেই চালান। অন্য কাউকে স্টিয়ারিঙের ধারে কাছেও আসতে দেন না। প্রতিদিন চুনাপাথরের খনি থেকে পাথর তুলে পাহাড়ের একদম নীচে যে ডিপো রয়েছে, সেখানে পৌঁছে দেন। এর জন্য যাতায়াত সংখ্যার ওপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট টাকা পান, আর তাই প্রীতম সিংএর লক্ষ্যই থাকে যাতে দিনে অন্তত দু'বার পাথর আনা নেওয়া করতে পারেন।
প্রীতম সিংএর পাশে বসে আছে নত্থু। গোলগাল চেহারার হাসি খুশি ছেলে নত্থু ওঁর সহকারী। ট্রাকটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার দায়িত্ব ওর ওপর। নত্থুর বয়স বলা মুস্কিল, বারোও হতে পারে, আবার পনেরোও। ও জানে না। কেউ কোনদিনও ওর জন্ম সময় কোথাও নথিভুক্তও করে যায়নি। কঠোর জীবনযাত্রার ছাপ প্রবলভাবে চেহারায় প্রতিফলিত। আর তাই, মুখ দেখেও বয়স বোঝার উপায় নেই। নত্থুর বাড়ি এই পাহাড়েই, তবে অন্য দিকে। খানিকটা দূরেই।
গত বছর বৃষ্টির অভাবে আলুর ফসল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হল। নত্থুর পরিবারের পক্ষে দৈনন্দিন খাবারের ব্যবস্থা করা কঠিন হয়ে পড়ছিল। তাই নত্থু গ্রামের বাড়ি ছেড়ে এই শহরে আসে কাজের সন্ধানে। কে জানি ওকে বলেছিল এই চুনাপাথরের খাদানের কথা। ওখানে গেলে হয়তো কাজ জুটে যেতে পারে। নত্থু সেই মতো পৌঁছে গেলো ওখানে। তবে নিতান্তই ছোট ও। খাদানে পাথর ভাঙ্গা বা ভাঙ্গা পাথরকে গাড়িতে মালবোঝাই করা, কোনটাই ও পারবে না। তবে নত্থুর কপাল ভালো। প্রীতম সিং, এক বয়স্ক ড্রাইভার, তখন একটি চতুর ও ঝটপট কাজ করবে, এমন ছেলে খুঁজছিলেন নিজের ট্রাকের দেখভালের জন্য। নত্থুকে দেখে তাঁর পছন্দ হয়ে গেলো। তারপর দিনে দশ টাকা মাইনেতে কাজে নিয়োগ হয়ে গেলো।
এ অবশ্য মাস ছয় আগের ঘটনা। এখন নত্থু আগের চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ, ট্রাকের দেখভাল বেশ ভালো করেই করে। ট্রাকেই থাকে, ট্রাকেই শোয়। প্রীতম সিং, যার কিনা আত্মসম্মান, আত্মাভিমান একটু বেশিই, এমনই বেশি যে পঞ্জাবে শক্ত সমর্থ তিন ছেলে থাকলেও তাদের ভরসায় না থেকে এখনও নিজেই ট্রাক চালান, সেই প্রীতম সিং এর সাথেও নত্থুর দিব্যি ভালোই বনিবনা হয়ে গিয়েছে।
প্রীতম সিং ট্রাকের হর্নটি মাঝেমধ্যেই বাজাতে খুবই পছন্দ করেন। বা বলা চলে, হর্নের শব্দ তাঁর কানে বড়ই মধুর। আর তাই শুনশান রাস্তায় যেখানে কোন লোক নেই, নেই কোন জন্তু, তবুও তিনি চেপে হর্ন বাজালেন খানিক।
গাড়ি চলছে ফাঁকা পথে। নত্থুর দিকে একবার তাকিয়ে, তারপর আবার সোজা রাস্তায় চোখ রেখে বললেন, "আর এক বছর। ব্যস। আর এক বছর আমার গাড়িটা চালাবো। তারপর বেচে দিয়ে ঘরে বসে আরামই আরাম।"
"কে কিনবে আপনার এই ট্রাক? আপনার অবসরের আগেই না ট্রাক অবসর নিয়ে নেয়!" নত্থু ফুট কাটল।
"চুপ কর হতভাগা। তুই জানিস আমার এই ট্রাক এখনও যুবতী? মোটে বাইশ বছর। হেসে খেলে আরো কিছু বছর দিব্যি চালানো যাবে।" প্রীতম সিং বিরক্ত হয়ে বলতে বলতে প্রমাণ হিসেবে আবার জোরে হর্ন বাজালেন। ফাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় সেই বিটকেল আওয়াজের প্রতিধ্বনি শুনে বিরক্ত হয়ে কিছু জংলি মোরগ ঝোপ থেকে বেরিয়ে ট্রাকের সামনে দিয়ে ছুট লাগালো রাস্তা দিয়ে।
গাড়ি চলতে থাকে। প্রীতমের খিদে পায়। ভাবেন, কী খাওয়া যেতে পারে।
"কতদিন ভালোমন্দ খাওয়া হয়নি", বিড়বিড় করতে থাকেন উনি।
পাশ থেকে নত্থু বলে ওঠে, "কত সপ্তাহ হয়ে গেল আমারও কোন ভাল মন্দ খাবার জোটেনি। ধুর।" অবশ্য নত্থুর গোলগাল চেহারা দেখে এমন কথা কেউ বিশ্বাসই করবে না।
প্রীতম সিং একবার ওর দিকে তাকান, তারপর পরেরদিন ওকে তন্দুরী মুরগি আর পোলাও খাওানোর প্রতিশ্রুতি দেন। নত্থু অবশ্য কথায় মানতে নারাজ। "আগে খাই, তারপর বিশ্বাস করব," বলে ও।
পাহাড়ি রাস্তা এতক্ষণে সামনের দিকে খানিকটা সরু হয়ে গিয়েছে। সেই সরু রাস্তা দিয়ে আবার একগাদা খচ্চর চলেছে, হেলতে দুলতে। ওই জন্তুগুলোর পালের মধ্যে পড়লেই বিপত্তি। বিপজ্জনক পরিস্থিতির কথা ভেবেই প্রীতম সিং গাড়ির গতি কমালেন। সাথে আবার হর্নও বাজালেন।
এবং অবধারিত তাতে কাজ হলও। খচ্চরগুলো শব্দের জেরে এদিক ওদিক ওপর নীচে ছুটে পালালো।
"এই খচ্চরগুলো বড্ড জ্বালায়। যখন তখন যেখানে সেখানে এসে পৌঁছে যায়" প্রীতম সিং বিরক্ত হয়ে বললেন।
ওরা যে রাস্তা দিয়ে চলেছে, পাহাড় এখানে বড্ড ন্যাড়া। শুকনো। প্রায় কোন গাছ নেই বলা চলে। চুনাপাথরের চক্করে লোকজন এই পাহাড় থেকে সমস্ত গাছপাতা কেটে কুটে শেষ করে দিয়েছে। এখন শুধুমাত্র ওই এদিক সেদিকে ছড়ানো ছিটনো এক আধটা বড় ওক গাছ যা একটু চোখে পড়ে। ব্যস।
প্রীতম রাস্তার দিকে চারপাশে দেখতে দেখতে গাড়ি চালাচ্ছেন। একবার নত্থুর দিকে ফিরে বললেন, "হ্যাঁ রে নত্থু, তোদের দিকেও বুঝি পাহাড় এমন ন্যাড়া?"
"না না। আমাদের ওদিকে এখনও খোঁড়াখুঁড়ি খাদান এইসবের চক্কর শুরু হয়নি। তাই এখনও কিছু গাছপালা পড়ে আছে। জানেন, আমাদের বাড়ির সামনে একটা আখরোট গাছ আছে। সেখান থেকে প্রায় দুই ঝুড়ি বাদাম পাই বছরে।" নত্থুর গলায় ফেলে আসা বাড়ি ঘর দোরের জন্য টান শোনা যায়।
"আর জল? সেইসব আছে?"
" হ্যাঁ কাকা। পাহাড়ের নীচে একটা ঝর্ণা আছে। তাতে খাবার জলের ব্যবস্থা হয়ে যায়। তবে ক্ষেতির জন্য আমাদের বৃষ্টির ওপর নির্ভর করতে হয়। গত বছর এক ফোঁটাও বৃষ্টি হলো না। ব্যস। সব ফসল নষ্ট।"
"চিন্তা করিস না। শিগগিরই বৃষ্টি আসছে দেখিস। আমি গন্ধ পাচ্ছি। তুইও পাবি। শোঁকার চেষ্টা কর।"
"হলে ভালো কাকা। ধুলোগুলো থেকে একটু মুক্তি।"
ওদের গাড়ি এগোতে থাকে। যত ওরা চুনাপাথরের খনির কাছে যায়, রাস্তায় ধুলো বাড়তে থাকে ক্রমশ। তবে এই ধুলোর প্রকৃতি আলাদা। এ এক্কেবারে খাস চুনাপাথরের গুঁড়ো। এ গুঁড়োর চোটে চোখ জ্বলতে থাকে, নাকে ঝাঁঝ লাগে।
খনিতে এখন পাথর ভাঙ্গাভাঙ্গি আর খনন পর্ব চলছে।
প্রীতম সিং ট্রাকটিকে দাঁড় করিয়ে বললেন, "এবার একটু অপেক্ষা করি।"
ওরা দুজনে ট্রাকের ভিতরেই চুপচাপ বসে রইল। এদিক ওদিকের রুক্ষ প্রকৃতির দিকে বারবার চোখ চলে যাচ্ছে। অনেক দূর পর্যন্ত জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই।
হঠাৎ চারিদিক কাঁপিয়ে বিশাল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাহাড়ের এক অংশের সমস্ত পাথর এদিক ওদিক ছিটকে গেল।
নত্থু অবাক হয়ে এসব দেখে। না, পাথর ভাঙ্গা, গড়ানো না। ও অবাক হয়ে দেখতে থাকে বড় বড় গাছ, ছোট মাঝারি ঝোপ সব কেমন এলোমেলো হয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে যায়। গুঁড়িয়ে যায়। দেখতে দেখতে নত্থুর নিজেদের গ্রামের বাড়ির কথা মনে পড়ে যায়। বাড়ির সামনের প্রিয় আখরোট গাছটার কথা ভাবতে থাকে। একদিন কি ওগুলোরও এই অবস্থা হবে? ওদের গ্রামও একদিন কি এরকম শূন্য, রিক্ত হয়ে যাবে? পাইন গাছগুলোর কী হবে? আর বাদাম গাছগুলো? কোন গাছ থাকবে না। বৃষ্টি হবে না। শুধু ধুলো। শুধু পাথর।
ইতিমধ্যে প্রীতম সিং একবার ট্রাকের হর্ন বাজালেন জোরে। উদ্দেশ্য এই যে আশেপাশের লোকজনকে জানানো, তিনি এসেছেন। মালপত্র বোঝাই হওয়ার অপেক্ষায় আছেন।
এরপর নত্থুকে নিয়ে উনি ট্রাক থেকে নামলেন। সামনেই একটা ছোট্ট ছাউনি। সেখানে কন্ট্রাক্টর ও তার সহকারি দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। অনতিদূরে কিছু শ্রমিক সদ্য খনি থেকে তুলে আনা কিছু পাথর ভাঙ্গা ভাঙ্গি করছে। পাশেই স্তূপ করে রাখা আরো পাথর। গাড়িতে বোঝাই হওয়ার অপেক্ষায়।
কন্ট্রাক্টর প্রীতম সিংকে ডেকে বললেন, "দাদা, আসুন। চা খেয়ে যান।"
প্রীতম জবাব দেন, "না হে ভায়া। সময় নেই। আরো এক ট্রিপ দিতে হবে আজ। একেই তাড়াতাড়ি আলো কমে আসছে আজকাল। জলদি জলদি হাতা চালাতে বলো ওদের। ঝটপট মাল তোলো। আমি এগোই।"
তবে মুখে না বললেও সিংজি নিজের জন্য এক কাপ চা চাইলেন, চা-ওয়ালার থেকে। ইতিমধ্যে কন্ট্রাক্টর শ্রমিকদের আস্তে আস্তে পাথর বোঝাই করার নির্দেশ দিলেন। নত্থু ট্রাকের পিছনের ডালাটা খুলে দিল। সাথে সাথে শ্রমিকদের সঙ্গে কাজেও হাত লাগালো। হাত চালালে শরীর গরম থাকবে। যদিও ভারি চেহারার দরুণ আর পাঁচজনে চেয়ে ওর ঠাণ্ডা বোধটা কম। তাও।
নত্থুকে কাজে হাত লাগাতে দেখে কন্ট্রাক্টরের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। ওকে যদি এর জন্য টাকা দিতে হয়, তাহলে তো নিজের লাভ কমে যাবে। তাই সে তড়িঘড়ি বলল, "শোন ভায়া, কাজ করছিস, কর। কিন্তু এর জন্য এক পয়সাও পাবি না জেনে রাখিস, পরে চাইতে আসবি না যেন।"
নত্থু হেসে বলল, "চিন্তা করবেন না দাদা। আমি টাকা চাইব না। আমি প্রীতম সিংজির কাছে কাজ করি। উনি আমার মালিক।"
পাশ থেকে প্রীতম সিং চেঁচিয়ে উঠলেন, "হ্যাঁ, নত্থু ঠিক বলেছে। ও আমার কাছে কাজ করে। কিন্তু ও কারুর চাকর না। মুখ সামলে কথা বলবে সবাই ওর সাথে।"
প্রায় ঘন্টাখানেক পর কন্ট্রাক্টর যখন এক্কেবারে নিশ্চিত হল যে ট্রাকে আর একটা কুঁচিও পাথর আঁটানোর জায়গা নেই, তখন পাথর বোঝাই গাড়ি যাওয়ার অনুমতি পেলো। চারজন শ্রমিক পাথরের ওপর বসে বসে যাবে। আর দুজন শ্রমিক, কন্ট্রাক্টর এবং তার সহকারী, পিছন পিছন একটা গাড়িতে আসবে। এই ব্যবস্থা। নত্থু এক ধার দিয়ে নিজের সিটে উঠে বসল। দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করলো। প্রীতম সিং এর ট্রাকের এটাই মজা। জোর না দিলে দরজা বন্ধই হয়না। এদিকে আলতো ছোঁয়ায় খুলে যায়। ঠিক যেন সেলোটেপ দেওয়া।
প্রীতম সিং গাড়ি স্টার্ট করে বলেন, "চলা যাক তাহলে। আমায় তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে আজ। রাত্রে বিয়েবাড়ি আছে।"
গাড়ি চলার সাথে সাথে মাঝে মাঝে প্রীতম সিং গুনগুন করে গান গাইতে লাগলেন আপন মনে।
গানের এমন জাদু, শ্রমিকের দলও তাতে যোগ দিল এইবারে।
ট্রাকটি পাহাড়ি রাস্তার মোড় অতিক্রম করে চলেছে। আজ যেন গাড়ির গতি নত্থুকে বড় অস্বস্তিতে ফেলছে। মাঝে মাঝে গাড়ি যখন এদিক ওদিক বাঁকে ঘুরছে, পাশে দরজাটা এমনভাবে কেঁপে কেঁপে উঠছে যে ওর মাথা ঘুরে যাচ্ছে, গা গুলিয়ে যাচ্ছে। প্রীতমকে বললো, "একটু আস্তে চালান না কাকা।"
প্রীতম একটু আমোদ পেলেন এমন কথায়। বললেন, "হঠাৎ? কবে থেকে তুই ভয় পেতে লাগলি বাচ্চা?"
"আজ থেকে।" নত্থু বললো।
"কেন? আজ কী বিশেষ ব্যাপার হয়েছে?"
"জানি না। মনে হচ্ছে। মন বলছে বলতে পারেন।"
"ধুর ধুর। বয়স হচ্ছে তোর। আর কিচ্ছু না।"
নত্থুও এবারে মজা পেয়ে গিয়েছে। ও বললো, "আমার বয়সে পৌঁছোন, তারপর বুঝবেন।"
প্রীতম সিং কিঞ্চিৎ হেসে বললেন, "এই। অনেক ফাজলামি হলো। এবার চুপ করে বোস তো।"
গাড়ি আরো একটা বাঁক পার করলো। নত্থু জানলার বাইরে দিয়ে নীল আকাশ দেখতে থাকে। নীচে উপত্যকা। ওরা যেন বড্ড খাদের ধারে চলে এসেছে। অবশ্য এ আর নতুন কী। প্রীতম সিং এরকমই গাড়ি চালান।
আরো কিছু বাঁক পড়লো রাস্তায়। এবার রাস্তাটি সোজা ঢালে নামবে উপত্যকায়। প্রীতম সিং ভাবলেন একবার গাড়ির ব্রেক দেখে নেবেন। ঠিকঠাক কাজ করছে তো?
যেমন ভাবা তেমন কাজ। চেপে ব্রেক কষলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় পিছনে বসে থাকা শ্রমিকেরা প্রায় ছিটকে পড়ছিল এদিক ওদিক।
"কাকা, আস্তে! কী হচ্ছে টা কী?" ওরা চেঁচিয়ে উঠলো প্রতিবাদে।
প্রীতম হেসে বললেন, "দাঁড়াও দাঁড়াও। এই তো এক্ষুণি পৌঁছে যাব।"
তা শুনে ঘাবড়ে গিয়ে নত্থু প্রীতমকে কোনো শর্টকাট নিতে বারণ করলো।
ঠিক এই সময়ে রাস্তার মধ্যিখানে হঠাৎ একটা খচ্চর কোত্থেকে উদয় হলো। প্রীতম স্টিয়ারিং উইলটা ডানদিকে কাটালেন। কিন্ত রাস্তা যে বাঁদিকে গিয়েছে। ট্রাক গিয়ে পড়লো এক্কেবারে খাদের ধারে।
ট্রাকটি খাদের ওপর বিপজ্জনকভাবে ঝুলছে। শ্রমিকগুলো পড়ি কি মরি লাফ মেরে নেমে পড়লো। গাড়ি আরো ঝুলতে থাকে। পাথরে ধাক্কা খেয়ে নত্থুর পাশের দরজাটা খুলে যায়। ও ছিটকে পড়ে বাইরে।
এইবারে ট্রাকটি পাথরের খণ্ডের ওপর ধাক্কা খেতে খেতে আরো গড়াতে থাকে খাদের দিকে। উল্টে পাল্টে অবশেষে গিয়ে একটা পুরনো ওক গাছের ডালপালার মধ্যে আটকালো। ভাগ্যিস! গাছটা না থাকলে এক্কেবারে গভীর খাদে গিয়ে পড়ত।
দুইজন শ্রমিক একটু দূরে চুপ করে বসে আছে। ঘটনার আকস্মিকতা এখনও ঝেড়ে ফেলতে পারেনি গা থেকে। বাকি দুজন ছুটেছে খনির দিকে, সাহায্যের আশায়।
নত্থু পড়েছে কাঁটা ঝোপের মধ্যে। গায়ে কাঁটা লেগে ছড়ে গিয়েছে। তবে ব্যথা তেমন লাগেনি। কোনমতে নিজেকে তুলে ও দুই শ্রমিকের সাথে খনির দিকেই যাবে ভাবছিল, এমন সময় মনে পড়ল প্রীতম সিং এর কথা। উনি তো এখনও গাড়ির ভিতরেই আছেন। কপাল জোরে বেঁচে গেলে তো ভালো মতো জখম হবেন। ওঁকে আগে বের করতে হবে গাড়ি থেকে।
"কাকা? কাকা?" নত্থুর ডাকে কোন সারা নেই।
ও এগিয়ে গেলো। দেখতে পেল ট্রাকের খোলা দরজা দিয়ে প্রীতমের আদ্ধেকটা শরীর বেরিয়ে আছে। বাকি আদ্ধেক গাড়ির ভিতরে। স্টিয়ারিং উইলটা বুকে চেপে রয়েছে। নত্থু সেই দৃশ্য দেখে ভাবল, প্রীতম সিং বুঝি আর বেঁচে নেই। ট্রাক থেকে সরে যাচ্ছিলই, এমন সময় পিট করে কালশিটে পড়া ফোলা একটা চোখ খুললেন প্রীতম সিং।
নত্থু অবাক।
"আপনি বেঁচে আছেন কাকা?" ও জিজ্ঞেস করলো।
"তাই তো মনে হচ্ছে," জবাব এলো।
এইটুকু বলেই আবার চোখ বন্ধ করে নিলেন উনি।
ইতিমধ্যে কন্ট্রাক্টর আর তার দলবল এসে পৌঁছেছে দুর্ঘটনা স্থলে। যতক্ষণে লোকজন এসে প্রীতমকে উদ্ধার করলো, প্রায় ঘন্টাখানেক পেরিয়ে গিয়েছে। এরপর গাড়ি এসে প্রীতমকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। সেখানে গিয়ে জানা গেলো, কাঁধের হাড় ভেঙ্গেছে, সাথে অনেকগুলো পাঁজরের হাড়ও গুরুতর জখম। অবশ্য ডাক্তার আশ্বাস দিলেন, সেরে উঠবেন প্রীতম।
কিছুদিন পর নত্থু যখন প্রীতম সিংকে দেখতে গেলো হাসপাতালে, উনি আক্ষেপের সুরে বললেন, "হায় রে নত্থু। আমার ট্রাকটা শেষ হয়ে গেলো। আমায় এবারে দেশে ফিরে ছেলেদের সাথে থাকতে হবে। হায় হায়। অবশ্য তুই জোয়ান আছিস। অন্য কারুর গাড়িতে কাজ পেয়ে যাবি।"
"নাহ, আমিও বাড়ি ফিরে যাবো", নত্থু বলে।
"গিয়ে কী করবি?" প্রীতম জিজ্ঞেস করেন।
"দেখি, ক্ষেতি করব। গাছপালা লাগাবো। সব গাছ পালা উড়িয়ে দেওয়ার চেয়ে কিছু লাগানো ভালো। ক্ষেত। জঙ্গল।" নত্থু আস্তে আস্তে জবাব দেয়।
তারপর খানিকক্ষণ ওরা দুজনেই চুপ করে থাকে।
অবশেষে প্রীতম মুখ খোলেন, "জানিস তো নত্থু, একটা গাছের জন্যই আমি সেদিন আমার জীবন ফিরে পেলাম। ওই গাছটা ওখানে না থাকলে সেদিন আমার মৃত্যু অবধারিত ছিল রে। ওই গাছই আমায় নতুন প্রাণ দিয়েছে। মনে রাখিস নত্থু। কক্ষনো ভুলিস না কথাটা।"
"অবশ্যই কাকা। মনে থাকবে। চিরকাল।"
No comments:
Post a Comment