"All my bags are packed
I'm ready to go
I'm standing here outside your door
I hate to wake you up to say goodbye..."
It is a little past eleven on a chilly 31st December night. The whole world is partying like crazy. Cars can be heard whizzing past on the roads. Their speakers boom the latest EDM. The night is still very much young. In fact, there is a party going on in my house too. My friends have all come over. There's dance and music. There is food and wine. This year has been a wonderful one for me. A huge raise at work, recognition in the society, an award for my food blogging... and on the personal front too - the proposal from Sankarshan, Munni Didi's precious little one after a much prolonged IVF treatment - indeed, this year has been a fantastic one.
I sit at one corner of my bedroom balcony - one of the very few secluded corners of my house tonight, with a glass of red wine in hand. Tonight, I am tired. I'm tired of all things fancy. I'm overwhelmed with all things bright and beautiful. I sit back and retrospect at the year gone by. And then, suddenly the door opens. In comes an old man, wearing a grey overcoat and a dark grey bowler hat. He looks weary and tired.
"May I please?" he asks, putting his worn out suitcase down and pointing at the empty cane chair. I look up, startled, who is he? What brings him here? I hesitantly nod my head and he obliges. I continue sipping my wine. The night is cold. I notice the man wrapping his red muffler tightly around his neck. He strangely reminds me of my grandpa. I ask him, "Would you like to have something to eat or drink? May be something warm?" He smiles and I notice a twinkle in his eyes. " It's okay Beta. I'm fine. I am just a little tired. Tired of all the burdens that I carry, the baggage that I bear", he says.His eyes wander off outside. A couple of stray dogs start to bark. I continue gazing outside. The silence is disturbingly calming. Yet the otherwise bubbly Anahita in me takes over.
"Umm...Uncle, I'm sorry to put it in this way, but I really did not recognise you. Are you a friend of one of my guests?" The old man, looking wistfully outside, answers, "Friend? Yeah.. to a few. The ones who've had a great year so far. Indeed I am their friend." I notice a melancholy on his face. The yellow streetlight on his face accentuates the creases on his pale skin, making him look sadder. I cannot but wonder, what is he talking about. "I'm sorry. But I do not understand. Could you please be a little less vague?"
"Beta, tell me, how was 2018 for you?"
"It was wonderful", I wanted to say. Could not. Memories flashed across my eyes. Little boys pelting stones at the ginger kitten on the EM Bypass connector I saw last summer. I was driving to work and had deadlines to meet. I could not spare ten minutes to protest and protect. And then Siyahi's face popped up. The ever smiling cheerful classmate of ours. But that is not how I saw her last. She was in all shambles. Though she tried hard to mask it, her favourite yellow or the most expensive cosmetics were unable to mask her pains. The dark circles around her sunken eyes helped her sing "Ek pyar ka nagma" with ultimate perfection on stage at our batch reunion. And then that night, her social media accounts started flowing with RIPs.
"Yes Beta? How was the year?" The old man asked me again. I gave a weak smile and said, "It went well Uncle. But I hope the coming year does bring in so much more. I have so much to do, yet there's so little time. I need to close a few deals at work, travel to places where I haven't checked in yet. Read a few books too - I have a long list of TBR."
"Wait, wait, wait, wait", he stops me midway, looks at his watch. I notice a worn out belt and a damaged glass. But the hands shine bright and keep ticking. it is five minutes to the new year. people are seen coming out to the streets, crackers and confetti in hand. The music gets louder in my house.
"Slow, my child. You are rattling off like a sprinter." When he laughs, I notice the smile reaching his eyes, the wrinkles make him look so genuine. He looks a bit irritated though when he stares out of the balcony and mumbles, "Less thanfive minutes to go and still no sight of him. These youngsters..." He looks at me kindly and then says, "beta, I've seen a lot more in life than you. " I smile and say, "Yeah, you do look so." He grins. And continues, "True. So while I wait for him to come..."
"Who?" I stop him.
"Beta, you interrupt a lot. I will introduce you to him in due course of time. He should have been here by now. Wonder what is keeping him occupied. So as I was saying, did you realise that you never said that you wanted to be happy in the coming year?" Slow down a bit. Enjoy the moments as they come. Don't just spend them instead, live them. Be kind, be compassionate. Be happy."
The clock struck twelve. I expected people to barge in and wish me a "Happy New Year". Strangely, nothing happened. The old man looked up at the clock, then outside and finally at me.
"Oh Uncle, I know all that you say is so wise. But honestly, it sounds so much like those Moral Science classes in high school."
His bright face darkens, immediately. And then in a voice that strangely resembles my grandpa's, he mutters, "I don't want you to live with regrets my child. I don't want you to be silent when someone asks you next year on 31st December, how the year went. I don't want you to wake up in the middle of the night, feeling guilty for all the things that you should have taken care of and did not. I don't want you to feel "comfortably numb". I want you to embrace life and be happy from within." His voice trails off.
I hear a taxi stop at the gate. I look down the balcony railing to see ahandsome young man coming out of it. The driver unloads his baggage. There is quite a load of it, looks brand new and shining. The old man raises his hand and asks the driver to wait, picks his shabby suitcase and walks to the door. He stops, looks back at me and says, "take care Beta" and walks out of the room. The young gentleman looks up, sees me and winks at me with a warm smile on his face.
The digital clock on my table shows "JAN 01 2019 00:05". The city erupts in celebrations as the taxi moves away into oblivion.
"Kuch pakar khona hai
kuch khokar pana hi
jiwan k matlab to ana aur jana hai
do pal ke jiwan se
ek umra churani hai
zindagi aur kuch bh nahi
teri meri kahani hai..."
Saturday, December 29, 2018
Thursday, December 27, 2018
ক্রিসমাস চিঠি
১।
চিঠিটা আরেকবার পড়ে খামে ভরলেন ভদ্রমহিলা। তারপর সেটাকে একটা লাল বাক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। ক্রিসমাস আসতে আর বেশিদিন নেই। তার আগেই এটাকে পৌঁছতে হবে গন্তব্যে।
২।
ক্রিসমাসের সকাল। প্যানকেক, ব্লুবেরি সস, স্মোকড পোট্যাটো আর স্মোকড সামন দিয়ে ব্রেকফাস্ট সবে শেষ হয়েছে। ঠাকুমাকে আদর করে "মেরি ক্রিসমাস" জানিয়ে জিনা ছুট্টে গিয়েছে ওদের ক্রিসমাস ট্রিয়ের সামনে। সারি সারি বাক্স, বিভিন্ন সাইজে, বিভিন্ন রঙে। ফায়ারপ্লেসের ওপর ওর স্টকিংটা পেট মোটা হয়ে উপচে পড়ছে। এই বছরও জিনা বাধ্য মেয়ে ছিল। স্যান্টা ওর জন্য অনেক কিছু এনেছে। বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু জিনা কিছুতেই সাহস করে এগোতে পারছে না ওইদিকে। কিছুতেই না। এক দুইবার চেষ্টা করলো। কিন্তু ফায়ারপ্লেস অবধি পৌঁছে আবার ফেরত এলো। অজানা এক আতঙ্ক। কী জানি, কী আছে ওতে?
ডিসেম্বরের ছুটিটার জন্য যখন স্কুলের সব বাচ্চারা মুখিয়ে থাকে, জিনার মনে তখন গ্রাস করে আসে এক রাশ দুঃখ। ভিলেজের আর পাঁচটা বাড়ির মতো যদিও আভেন থেকে সদ্য বের করা প্লাম কেকের সৌরভে গোটা বাড়ি ম-ম করে, মাংসের নানান সুস্বাদু পদ রাঁধা হয়, সাজানো হয় রঙ বেরঙের টাটকা শীতের সব্জি ও ফল দিয়ে স্যালাড, লিভিং রুমে ইয়া বড় ক্রিসমাস ট্রিও আসে, সাজানো হয় কনফেটি আর আলো দিয়ে, ট্রিয়ের নীচে বাক্স বাক্স উপহার রাখা থাকে, তবুও জিনার ইচ্ছেই করেনা হোস্টেল থেকে বাড়ি ফিরতে। ঐশ্বর্য ও বৈভবের কোন রকম অভাব না থাকলেও ওর বন্ধুদের বাড়ির মতো সেখানে থাকেনা বাবা মায়ের আদরমাখা উষ্ণতা, থাকেনা হই হই করে একটা প্রাণভরা উৎসবের আনন্দ।
জিনাদের বাড়িতে থাকেন ওর বয়স্কা ঠাকুমা, জিল আর জিনার গভর্নেস, শেলী। মারগারেট এসে রান্না বানা করে দিয়ে যায়। ক্রিসমাস ইভে এই চারজনে এক সাথে এলাহি ডিনার সারে। তারপর ঠাকুমা জিলের কিনে আনা স্টকিংটাকে সযত্নে লিভিং রুমের ফায়ারপ্লেসটার ওপর শেলীর সাহায্যে টাঙ্গিয়ে জিনা চুপটি করে লেপের তলায় ঢুকে যায় বাধ্য মেয়ের মতো। জিনার যবে থেকে জ্ঞান হয়েছে, এই একই ব্যবস্থাই সে দেখে আসছে। মা বাবা বলতে শুধুই একদম জন্মের কিছু মাস অবধি সময়ের ছবিতেই তাঁরা সীমাবদ্ধ।
ঠাকুমাকে খুব জিজ্ঞেস করত আগে ওঁদের কথা। জিল চোখ ছলছল করে নাতনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। বলতেন না কিছুই। কোথায় জিনার মা বাবা? কেনই বা তাঁরা আসেন না তাদের এই মিষ্টি মেয়েটিকে দেখতে কখনও, কোনরকম যোগাযোগও করেন না। এই রহস্যের উত্তর জানতে চেয়ে কত রাত ছোট্ট জিনা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছে। জিল কিছুই বলতে পারেননি। শুধু একবার বলেছিলেন, "জিনা, সোনা মেয়ে। কেঁদো না। দেখো, তোমার জন্য তোমার সমস্ত পছন্দের উপহার রয়েছে। খেলা করব তো আমরা এইগুলি নিয়ে। মা বাবার কথা জিজ্ঞেস করো না।" ঠাকুমার আর্তিতেও জিনা গলেনি, ও আবারও জিজ্ঞেস করতেই থেকেছে, "আমার মা বাবা কোথায়?" অসহায় জিল তখন ঝোঁকের বসেই বলে ফেলেন, "যেদিন তুমি জীবনের পঞ্চাশতম ক্রিসমাস উপহার পাবে, সেইদিন জানতে পারবে বাবা মায়ের কথা।" জিনা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ঠাকুমার মুখের দিকে। সপ্রশ্ন নেত্রে। খানিক চুপ করে থেকে বলে, "কী করে জানবো?" জিল উত্তর দেন, "তোমার স্টকিং এর ভিতর থাকবে হদিশ। নাও ডার্লিং, এইবারে ঘুমিয়ে পড়ো।"
সেই রাত্তিরটা ঠাকুমা ও নাতনি প্রায় কেউই ঘুমোতে পারেনি। সারা রাত জিল এ পাশ ও পাশ করে গিয়েছেন। কী করে বলবেন এই ফুটফুটে শিশুটিকে ওর গুণধর বাপ মায়ের কথা? সেই বাবা মা যারা এই ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুটির জন্মের পর থেকে কোন রকম দায় দায়িত্ব নিতে রাজি হয়নি ওর। শুধু বছরের এই একটা সময়ে মেয়ের নামে উপহার পাঠিয়ে দেয় একাধিক। জিলের স্বামী, মরগানের টাকার অভাব ছিল না, তাই কখনও অর্থকষ্টে ভুগতে হবে না ওদের, এইটুকু যা ভরসা। এমনিতেই জিলের অবর্তমানে জিনার কী হবে, সেই ভেবেই ভয় পান, তার ওপর আজ এই পরিস্থিতি। নেহাত বাচ্চা মেয়েটিকে সাময়িক স্তোক বাক্য দিলেন। কিন্তু কতদিন?
জিনার মনে সেইদিন থেকে শুরু হয়ে যায় এক অজানা উৎকণ্ঠা। কী জানবে ও? সেই খবর সুখের হবে তো? জিল বা শেলীর অজান্তেই সেই ক্রিসমাস সকালেই জিনা ওর এ যাবত পাওয়া সমস্ত উপহারের ফিরিস্তি করতে থাকে, ওর ছোট্ট পকেট ডায়েরিতে। একদম ছোটবেলার কথা মনে নেই, কিন্তু জিলের ডায়রি লেখার অভ্যেসের সুবাদে সেই সমস্যাও মিটে গেল।
জিনা গুনে দেখেছে। গতকালই। জিলের সামনে বসে। গত ক্রিসমাস অবধি ও আটচল্লিশটা উপহার পেয়েছে। আজ ওর স্টকিংটা উপচে পড়ছে। তার মানে আজ সেই উপহারের সংখ্যা পঞ্চাশ পেরিয়ে যাবেই। তার মানে তো ঠাকুমার কথা অনুযায়ী আজকেই ও জানতে পারবে ওর বাবা মায়ের হদিশ।
"কী হলো সোনা মেয়ে, স্টকিংটা দেখবে না? দেখো কী কী গিফটস আছে ওতে?" ঠাকুমার আদুরে কণ্ঠস্বরে জিনার সম্বিত ফেরে। ফ্যাকাশে মুখ করে জিনা বলে, "ঠাকুমা, আজ যে আমি আমার পঞ্চাশতম ক্রিসমাস গিফটটি পাবো। মনে আছে, তুমি বলেছিলে সেই কত বছর আগে?"
পলকেই জিলের মুখটা পার্চমেন্ট পেপারের মতো শুকিয়ে গেল। সেদিন কথায় কথায় ওরকম বলেছিলেন। মনেও ছিল না। এইবারে কী বলবেন? নাতনি এখন টিনএজার। মিছে স্তোকবাক্যে ভোলানো মুস্কিল। তবে কি...
"ঠাকুমা, আমার ভয় করছে। নার্ভাস লাগছে। তুমি প্লিজ খুলে দেখাও কী আছে।" কাঁপা কাঁপা গলায় জিনা বলল।
নিরুপায় হয়ে জিল স্টকিংটা নামালেন। ভিতর থেকে এক এক করে বের করলেন নিজের হাতে কেনা জিনার পছন্দের উপহার। আর তার সাথে আরেকটা লাল বাক্স। ছোট্ট। এসেছে প্রতি বছরের মতোই, জিনার বাবা মায়ের থেকে।
"ওটা কি বাবা মায়ের পাঠানো বক্স?" জিনা জিজ্ঞেস করে।
"হুম।" জিল উত্তর দেন।
"ওটাই আগে খোলো প্লিজ।" এক অদ্ভুত আকুতি মিশিয়ে বলে জিনা।
আস্তে আস্তে সভয়ে জিল ফিতেটা খোলেন। বাক্সের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা চিঠি। জিনাকে উদ্দেশ্য করে। লেখা রয়েছে...
চিঠিটা আরেকবার পড়ে খামে ভরলেন ভদ্রমহিলা। তারপর সেটাকে একটা লাল বাক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। ক্রিসমাস আসতে আর বেশিদিন নেই। তার আগেই এটাকে পৌঁছতে হবে গন্তব্যে।
২।
ক্রিসমাসের সকাল। প্যানকেক, ব্লুবেরি সস, স্মোকড পোট্যাটো আর স্মোকড সামন দিয়ে ব্রেকফাস্ট সবে শেষ হয়েছে। ঠাকুমাকে আদর করে "মেরি ক্রিসমাস" জানিয়ে জিনা ছুট্টে গিয়েছে ওদের ক্রিসমাস ট্রিয়ের সামনে। সারি সারি বাক্স, বিভিন্ন সাইজে, বিভিন্ন রঙে। ফায়ারপ্লেসের ওপর ওর স্টকিংটা পেট মোটা হয়ে উপচে পড়ছে। এই বছরও জিনা বাধ্য মেয়ে ছিল। স্যান্টা ওর জন্য অনেক কিছু এনেছে। বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু জিনা কিছুতেই সাহস করে এগোতে পারছে না ওইদিকে। কিছুতেই না। এক দুইবার চেষ্টা করলো। কিন্তু ফায়ারপ্লেস অবধি পৌঁছে আবার ফেরত এলো। অজানা এক আতঙ্ক। কী জানি, কী আছে ওতে?
ডিসেম্বরের ছুটিটার জন্য যখন স্কুলের সব বাচ্চারা মুখিয়ে থাকে, জিনার মনে তখন গ্রাস করে আসে এক রাশ দুঃখ। ভিলেজের আর পাঁচটা বাড়ির মতো যদিও আভেন থেকে সদ্য বের করা প্লাম কেকের সৌরভে গোটা বাড়ি ম-ম করে, মাংসের নানান সুস্বাদু পদ রাঁধা হয়, সাজানো হয় রঙ বেরঙের টাটকা শীতের সব্জি ও ফল দিয়ে স্যালাড, লিভিং রুমে ইয়া বড় ক্রিসমাস ট্রিও আসে, সাজানো হয় কনফেটি আর আলো দিয়ে, ট্রিয়ের নীচে বাক্স বাক্স উপহার রাখা থাকে, তবুও জিনার ইচ্ছেই করেনা হোস্টেল থেকে বাড়ি ফিরতে। ঐশ্বর্য ও বৈভবের কোন রকম অভাব না থাকলেও ওর বন্ধুদের বাড়ির মতো সেখানে থাকেনা বাবা মায়ের আদরমাখা উষ্ণতা, থাকেনা হই হই করে একটা প্রাণভরা উৎসবের আনন্দ।
জিনাদের বাড়িতে থাকেন ওর বয়স্কা ঠাকুমা, জিল আর জিনার গভর্নেস, শেলী। মারগারেট এসে রান্না বানা করে দিয়ে যায়। ক্রিসমাস ইভে এই চারজনে এক সাথে এলাহি ডিনার সারে। তারপর ঠাকুমা জিলের কিনে আনা স্টকিংটাকে সযত্নে লিভিং রুমের ফায়ারপ্লেসটার ওপর শেলীর সাহায্যে টাঙ্গিয়ে জিনা চুপটি করে লেপের তলায় ঢুকে যায় বাধ্য মেয়ের মতো। জিনার যবে থেকে জ্ঞান হয়েছে, এই একই ব্যবস্থাই সে দেখে আসছে। মা বাবা বলতে শুধুই একদম জন্মের কিছু মাস অবধি সময়ের ছবিতেই তাঁরা সীমাবদ্ধ।
ঠাকুমাকে খুব জিজ্ঞেস করত আগে ওঁদের কথা। জিল চোখ ছলছল করে নাতনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। বলতেন না কিছুই। কোথায় জিনার মা বাবা? কেনই বা তাঁরা আসেন না তাদের এই মিষ্টি মেয়েটিকে দেখতে কখনও, কোনরকম যোগাযোগও করেন না। এই রহস্যের উত্তর জানতে চেয়ে কত রাত ছোট্ট জিনা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছে। জিল কিছুই বলতে পারেননি। শুধু একবার বলেছিলেন, "জিনা, সোনা মেয়ে। কেঁদো না। দেখো, তোমার জন্য তোমার সমস্ত পছন্দের উপহার রয়েছে। খেলা করব তো আমরা এইগুলি নিয়ে। মা বাবার কথা জিজ্ঞেস করো না।" ঠাকুমার আর্তিতেও জিনা গলেনি, ও আবারও জিজ্ঞেস করতেই থেকেছে, "আমার মা বাবা কোথায়?" অসহায় জিল তখন ঝোঁকের বসেই বলে ফেলেন, "যেদিন তুমি জীবনের পঞ্চাশতম ক্রিসমাস উপহার পাবে, সেইদিন জানতে পারবে বাবা মায়ের কথা।" জিনা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ঠাকুমার মুখের দিকে। সপ্রশ্ন নেত্রে। খানিক চুপ করে থেকে বলে, "কী করে জানবো?" জিল উত্তর দেন, "তোমার স্টকিং এর ভিতর থাকবে হদিশ। নাও ডার্লিং, এইবারে ঘুমিয়ে পড়ো।"
সেই রাত্তিরটা ঠাকুমা ও নাতনি প্রায় কেউই ঘুমোতে পারেনি। সারা রাত জিল এ পাশ ও পাশ করে গিয়েছেন। কী করে বলবেন এই ফুটফুটে শিশুটিকে ওর গুণধর বাপ মায়ের কথা? সেই বাবা মা যারা এই ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুটির জন্মের পর থেকে কোন রকম দায় দায়িত্ব নিতে রাজি হয়নি ওর। শুধু বছরের এই একটা সময়ে মেয়ের নামে উপহার পাঠিয়ে দেয় একাধিক। জিলের স্বামী, মরগানের টাকার অভাব ছিল না, তাই কখনও অর্থকষ্টে ভুগতে হবে না ওদের, এইটুকু যা ভরসা। এমনিতেই জিলের অবর্তমানে জিনার কী হবে, সেই ভেবেই ভয় পান, তার ওপর আজ এই পরিস্থিতি। নেহাত বাচ্চা মেয়েটিকে সাময়িক স্তোক বাক্য দিলেন। কিন্তু কতদিন?
জিনার মনে সেইদিন থেকে শুরু হয়ে যায় এক অজানা উৎকণ্ঠা। কী জানবে ও? সেই খবর সুখের হবে তো? জিল বা শেলীর অজান্তেই সেই ক্রিসমাস সকালেই জিনা ওর এ যাবত পাওয়া সমস্ত উপহারের ফিরিস্তি করতে থাকে, ওর ছোট্ট পকেট ডায়েরিতে। একদম ছোটবেলার কথা মনে নেই, কিন্তু জিলের ডায়রি লেখার অভ্যেসের সুবাদে সেই সমস্যাও মিটে গেল।
জিনা গুনে দেখেছে। গতকালই। জিলের সামনে বসে। গত ক্রিসমাস অবধি ও আটচল্লিশটা উপহার পেয়েছে। আজ ওর স্টকিংটা উপচে পড়ছে। তার মানে আজ সেই উপহারের সংখ্যা পঞ্চাশ পেরিয়ে যাবেই। তার মানে তো ঠাকুমার কথা অনুযায়ী আজকেই ও জানতে পারবে ওর বাবা মায়ের হদিশ।
"কী হলো সোনা মেয়ে, স্টকিংটা দেখবে না? দেখো কী কী গিফটস আছে ওতে?" ঠাকুমার আদুরে কণ্ঠস্বরে জিনার সম্বিত ফেরে। ফ্যাকাশে মুখ করে জিনা বলে, "ঠাকুমা, আজ যে আমি আমার পঞ্চাশতম ক্রিসমাস গিফটটি পাবো। মনে আছে, তুমি বলেছিলে সেই কত বছর আগে?"
পলকেই জিলের মুখটা পার্চমেন্ট পেপারের মতো শুকিয়ে গেল। সেদিন কথায় কথায় ওরকম বলেছিলেন। মনেও ছিল না। এইবারে কী বলবেন? নাতনি এখন টিনএজার। মিছে স্তোকবাক্যে ভোলানো মুস্কিল। তবে কি...
"ঠাকুমা, আমার ভয় করছে। নার্ভাস লাগছে। তুমি প্লিজ খুলে দেখাও কী আছে।" কাঁপা কাঁপা গলায় জিনা বলল।
নিরুপায় হয়ে জিল স্টকিংটা নামালেন। ভিতর থেকে এক এক করে বের করলেন নিজের হাতে কেনা জিনার পছন্দের উপহার। আর তার সাথে আরেকটা লাল বাক্স। ছোট্ট। এসেছে প্রতি বছরের মতোই, জিনার বাবা মায়ের থেকে।
"ওটা কি বাবা মায়ের পাঠানো বক্স?" জিনা জিজ্ঞেস করে।
"হুম।" জিল উত্তর দেন।
"ওটাই আগে খোলো প্লিজ।" এক অদ্ভুত আকুতি মিশিয়ে বলে জিনা।
আস্তে আস্তে সভয়ে জিল ফিতেটা খোলেন। বাক্সের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা চিঠি। জিনাকে উদ্দেশ্য করে। লেখা রয়েছে...
Tuesday, December 25, 2018
ক্রিসমাস ২
মায়ের কাছে শুনলাম, মীনা দি, মানে আমাদের বাড়িতে যে দিদি কাজ করে, পরশু
দিন পাড়ার দোকান থেকে একটা ফ্রুট কেক কিনে আমাদের ফ্রিজে রেখেছে। বাড়িতে ওর
নাতি নাতনিদের খাওয়াবে বলে। গতকাল সোমবার ছিল। দোকান বন্ধ থাকবে। আর
রবিবারেই বাড়ি নিয়ে গেলে নাতি নাতনিরা ওইদিনই খেয়ে ফেলবে। অগত্যা, এই
ব্যবস্থা।
শুনলাম আজ মীনা দি কেকটা নিয়ে গিয়েছে। নিশ্চয়ই ওর বাড়িতেও আজ বড়দিনের কেক উৎসব পালন হল। আয়োজন যতই সামান্য হোক না কেন।
ওদিকে আমার জেঠু জেঠি আজ সক্কাল সক্কাল তাদের (আমাদের সব্বার) আদরের নাতনি আরিয়ার জন্য ওর পছন্দের কেক-কুকিজ ইত্যাদি নিয়ে গিয়েছে নামী কেকশপ থেকে, ঝুড়ি ঝুড়ি। সাথে খেলনা, চকলেট, কমলালেবু। সব ওর প্রিয়।
কোথায় গিয়ে যেন এই অপত্য স্নেহে সামাজিক সমস্ত স্তর ভেদাভেদ ইত্যাদি সব একাকার হয়ে যায়। সামর্থ্য তখন অনেকটা ছোট হয়ে দাঁড়ালে, ইচ্ছেটাই হয়ে যায় বাঁধা অতিক্রমের উপায়।
আসলে, উৎসব উদযাপনের যে কোন সুনির্দিষ্ট স্থান কাল পাত্র হয় না।
শুনলাম আজ মীনা দি কেকটা নিয়ে গিয়েছে। নিশ্চয়ই ওর বাড়িতেও আজ বড়দিনের কেক উৎসব পালন হল। আয়োজন যতই সামান্য হোক না কেন।
ওদিকে আমার জেঠু জেঠি আজ সক্কাল সক্কাল তাদের (আমাদের সব্বার) আদরের নাতনি আরিয়ার জন্য ওর পছন্দের কেক-কুকিজ ইত্যাদি নিয়ে গিয়েছে নামী কেকশপ থেকে, ঝুড়ি ঝুড়ি। সাথে খেলনা, চকলেট, কমলালেবু। সব ওর প্রিয়।
কোথায় গিয়ে যেন এই অপত্য স্নেহে সামাজিক সমস্ত স্তর ভেদাভেদ ইত্যাদি সব একাকার হয়ে যায়। সামর্থ্য তখন অনেকটা ছোট হয়ে দাঁড়ালে, ইচ্ছেটাই হয়ে যায় বাঁধা অতিক্রমের উপায়।
আসলে, উৎসব উদযাপনের যে কোন সুনির্দিষ্ট স্থান কাল পাত্র হয় না।
ক্রিসমাস
শীতের
কলকাতার এক অন্ধকার ফুটপাথে সদ্যোজাত সন্তানটিকে নিজের একমাত্র ছেঁড়া
কাঁথায় মুড়ে ঠাণ্ডা থেকে বাঁচাতে যে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে অসহায়া মা,
কই তাকে দেখতে তো সাত সমুদ্র পার করে এলো না কোন তিন রাজা, হাতে দামী
উপহারের ডালি নিয়ে? শীতের আকাশের তারাটি কিন্তু আজও সমানভাবে উজ্জ্বল।
ও, তাঁরা বোধহয় ইন্সটাতে চেক-ইন করতে ব্যস্ত। "ফিলিং ফেস্টিভ"। 🙂🙂🙂
ও, তাঁরা বোধহয় ইন্সটাতে চেক-ইন করতে ব্যস্ত। "ফিলিং ফেস্টিভ"। 🙂🙂🙂
Christmas 2018
তথাকথিত "ট্যাঁশ" ইংলিশ মিডিয়াম কনভেন্ট স্কুলের ছাত্রী হলেও কোনদিনও
ক্রিসমাস নিয়ে আলাদা কিছু করিনি। এমন কি, স্কুলেও যেতাম না এইদিনে। অনেক
বন্ধুরা, সিনিয়ররা, জুনিয়ররা যেত, যায়। শুধু ওই দুদিন আগে স্কুল ছুটি পড়ার
দিন স্কুলে কোন একজন স্যর স্যান্টা সেজে আমাদের চকলেট দিতেন। খুব মজা লাগত।
চকলেট খেতে, পেতে ও কিনতে বড্ড ভালোবাসি, এখনও। আর স্যোশাল সার্ভিস না কী
জানি নামে ওই আশে পাশের "less fortunate" (হ্যাঁ, বেশ ডিপ্লোম্যাটিক এবং
পোলাইট শুনতে লাগে) পরিবারের জন্য বিস্কিট, জ্যাম, জেলি, ইত্যাদি নিয়ে যেতে হত স্কুলে। ব্যস।
পিকনিক টিকনিক বোধহয় ইউনিভার্সিটিতে ওই দুই বছর ছাড়া আর কখনও যাইওনি।
কাজেই আর পাঁচটা পাতি ছুটির দিনের মতোই ক্রিসমাসও কাটিয়েছি চিরকাল। হ্যাঁ,
সকালবেলা ব্রেকফাস্ট টেবিলে মামার দিয়ে যাওয়া নাহুমের রিচ ফ্রুট কেক বা
বাবার আনা ক্যাথলিন বা মোঞ্জিনিসের ফ্রুট কেকের একটা টুকরো পেতাম। আর সাথে
ইউজুয়াল ছুটির দিনের ব্রেকফাস্ট। লুচি, ইত্যাদি। শীত স্পেশাল মোয়া হয়তো...
স্যান্টা বলে যে আদপে কেউ নেই, সেটা অনেক ছোটবেলাতেই জেনে গিয়েছিলাম (বরাবরের ইস্মারট বাচ্চা কি না :P ), তবুও উম্মি, মানে আমার ঠাকুমার কাছে আবদার থাকত। ক্রিসমাসে একটা গল্পের বই চাইই চাই আমার। বাবা কয়েকদিন আগে অফিস ফেরতা এনে দিত সেই বই। আমার থেকে জেনে নিয়েই, কোন বই আনবে সেই বছর। সব জানি। সকাল সকাল কী পাব, ইত্যাদি। তবুও, কোথাও জানি একটা অদ্ভুত আনন্দ মাখা থাকত ওই শীতের সকালে ঘুম ঘুম চোখে লেপের তলা থেকে হাত বার করে (আমি বাপু বরাবরের শীত কাতুরে। অল্পেই লেপ লাগে। কম্বল লাইজাম্পিতে হয় না) বালিশের নীচ থেকে প্রিয় গল্পের বইটিকে স্পর্শ করতে। নতুন পাতার গন্ধ, সাদার ওপর ওই কালো কালো অক্ষরগুলো আগামী দিনের নতুন বন্ধু... তাদের সাথে বন্ধুত্ব পাতানোয়।
তারপর একদিন বড় হলাম। উম্মিও চলে গেল। ক্রিসমাসের উপহার বলে আর কিছু রইল না। এখন যখন খুশি যবে খুশি যা ইচ্ছে বই কিনতে পারি। কিনি। পড়ি। তবু, গিফট পাওয়ার চার্ম রইল না আর।
থুড়ি, ছিল না। তারপর দুই বছর আগে আমার জীবনে এলো এক নতুন স্যান্টা। আমাদের সকলের আদরের সায়ন্তী। ব্যক্তিগত চিঠিপত্র অনুভব অনুভূতিগুলো যখন whatsapp আর facebookএর emojisএর পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে, এই মেয়েটি নিয়ম করে প্রতি বছর hand written note আর আমার প্রিয় চকলেট রেখে যায় আমার জন্য। এবং ঠিক রাত্তিরবেলা, চুপি চুপি, আমার হোস্টেলের দরজার বাইরে। যাতে সেই ছোটবেলার মতোই সকাল সকাল ওই একই রকম আনন্দ পাই।
এই বছরও তার কোন ব্যতিক্রম হয়নি। স্যান্টা, নাকি সায়ন্তী (দেখ, নামে কী মিল!) অনেক অনেক ভালোবাসা এই উপহারের জন্য।
বিঃ দ্রঃ এবারের নোটটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছিস কিন্তু!
ভালো থাক, ভালো রাখ।
স্যান্টা বলে যে আদপে কেউ নেই, সেটা অনেক ছোটবেলাতেই জেনে গিয়েছিলাম (বরাবরের ইস্মারট বাচ্চা কি না :P ), তবুও উম্মি, মানে আমার ঠাকুমার কাছে আবদার থাকত। ক্রিসমাসে একটা গল্পের বই চাইই চাই আমার। বাবা কয়েকদিন আগে অফিস ফেরতা এনে দিত সেই বই। আমার থেকে জেনে নিয়েই, কোন বই আনবে সেই বছর। সব জানি। সকাল সকাল কী পাব, ইত্যাদি। তবুও, কোথাও জানি একটা অদ্ভুত আনন্দ মাখা থাকত ওই শীতের সকালে ঘুম ঘুম চোখে লেপের তলা থেকে হাত বার করে (আমি বাপু বরাবরের শীত কাতুরে। অল্পেই লেপ লাগে। কম্বল লাইজাম্পিতে হয় না) বালিশের নীচ থেকে প্রিয় গল্পের বইটিকে স্পর্শ করতে। নতুন পাতার গন্ধ, সাদার ওপর ওই কালো কালো অক্ষরগুলো আগামী দিনের নতুন বন্ধু... তাদের সাথে বন্ধুত্ব পাতানোয়।
তারপর একদিন বড় হলাম। উম্মিও চলে গেল। ক্রিসমাসের উপহার বলে আর কিছু রইল না। এখন যখন খুশি যবে খুশি যা ইচ্ছে বই কিনতে পারি। কিনি। পড়ি। তবু, গিফট পাওয়ার চার্ম রইল না আর।
থুড়ি, ছিল না। তারপর দুই বছর আগে আমার জীবনে এলো এক নতুন স্যান্টা। আমাদের সকলের আদরের সায়ন্তী। ব্যক্তিগত চিঠিপত্র অনুভব অনুভূতিগুলো যখন whatsapp আর facebookএর emojisএর পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে, এই মেয়েটি নিয়ম করে প্রতি বছর hand written note আর আমার প্রিয় চকলেট রেখে যায় আমার জন্য। এবং ঠিক রাত্তিরবেলা, চুপি চুপি, আমার হোস্টেলের দরজার বাইরে। যাতে সেই ছোটবেলার মতোই সকাল সকাল ওই একই রকম আনন্দ পাই।
এই বছরও তার কোন ব্যতিক্রম হয়নি। স্যান্টা, নাকি সায়ন্তী (দেখ, নামে কী মিল!) অনেক অনেক ভালোবাসা এই উপহারের জন্য।
বিঃ দ্রঃ এবারের নোটটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছিস কিন্তু!
ভালো থাক, ভালো রাখ।
Monday, December 24, 2018
শিকড়
এয়ারপোর্টে বসে আছি। সর্বক্ষণের অভ্যেসমতোই হাতে রয়েছে একটি বই। খুব বেশি মনোযোগ সহকারে পড়ছিনা যদিও। মাঝে মধ্যেই এদিক ওদিক চোখ চলে যাচ্ছে। পাশে বসে এক মা তার পুত্রটিকে মাফিন খাইয়ে ব্রেকফাস্ট করানোর চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ ইতিউতি ধূমায়িত কফির কাপ নিয়ে ঘুরছেন। সেলফিও উঠে চলেছে খচাখচ। ছুটির মরসুমে ভোরের এয়ারপোর্ট। হাজার ব্যস্ততা। পরপর অনেকগুলো কলকাতার ফ্লাইট। তাই স্বাভাবিকভাবেই চারিদিকে বাংলার ছড়াছড়ি। আমি খুব একটা কোনদিকে পাত্তা দিচ্ছি না বিশেষভাবে। হঠাৎ কানে এলো এক বাংলাদেশী (accent শুনে বুঝলাম) ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর। ফোনে কাউকে বলছেন, " হ্যাঁ, এই আট বিশের ফ্লাইট। কলকাতা পৌঁছব সাড়ে দশটায়। দমদম স্টেশন থেকে শিয়ালদা গিয়ে ওখান থেকে ট্রেনে বনগাঁ। অটো ধরে তারপর পেট্রপোল। বর্ডার পেরোলেই গাড়ি থাকবে। ঠিকঠাক মতো লঞ্চ পেয়ে গেলে সাড়ে পাঁচটা ছটার মধ্যে বরিশাল পৌঁছে যাব।" আরো অনেক কথাই বলছিলেন উনি। আর কানে ঢোকেনি কিছু। ঠিক ওই একটা শব্দ। "বরিশাল"। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। কোন মানে নেই কিন্তু। কোনদিনও সেখানে যাইনি। এমনকি বাবা জ্যাঠাও যাননি। শুধু জানি পূর্বপুরুষের বাস বরিশালে। গল্পও সেরকম শুনিনি। শোনার মধ্যে ওই পুকুর নদী আর তা থেকে মাছ ধরে রান্নার গল্প (কী করব, বরাবরের খাদ্যরসিক আমি)। ঠাকুরদার বাবা পুলিশে ছিলেন, আগেভাগেই খবর পেতেন। তাই দেশভাগের ওই দুঃখজনক ঘটনা ঘটার আগেই তাঁরা সপরিবারে তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে আসেন এই দেশে। ভিটে মাটি বিক্রি করে দিয়ে। (সেই বাড়ির ছবিটুকু দেখেছি মোটে।) কোনরকম ভয়াবহ অভিজ্ঞতাও নেই। ওপর ওপর দেখলে কোন শোকের অবকাশও নেই। স্বেচ্ছায় চলে এসেছেন তাঁরা।
তবুও, নিজের পূর্বপুরুষের দেশ, বাড়ি সব ছেড়ে এক সম্পূর্ণ অচেনা অজানা জায়গায় নতুন করে জীবন শুরু করা... একটুও কি কষ্ট হয়নি তাঁদের? হয়তো ওঁদের সেই শিকড়ের প্রতি টান, সেইটাই আমি বংশানুক্রমে পেয়েছি। আর তাই কলকাতা, বরিশাল এইসব জায়গা থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে বসেও ওই একটি শব্দে একটা অদ্ভুত আত্মিক টান অনুভব
করেছি। সেই শিকড়ের টানটুকু প্রতিফলিত হয়েছে এমন অভূতপূর্ব অনুভূতিতে।
করেছি। সেই শিকড়ের টানটুকু প্রতিফলিত হয়েছে এমন অভূতপূর্ব অনুভূতিতে।
আর তাই গতকাল যখন ফ্লাইটে সহযাত্রী দেখলাম দুজনই বাংলাদেশের, যে আমি কিনা সচরাচর অচেনা অজানা লোকের সাথে কথা বলিনা, নিজে যেচে ওঁদের সাথে কথা বলেছি। এবং শেষে ফিরবার সময়ে ওই ভাইটির থেকে "বাংলাদেশে অবশ্যই আসবেন আপু, নিমন্ত্রণ রইল। ও যে আপনারও দেশ..." শুনে মনটা ভরে গেল।
ছবিটি আমাদের বরিশালের বাড়িটির। ফ্যামিলি গ্রুপ থেকে পাওয়া whatsappএ।
Friday, December 14, 2018
টুপুরের মন খারাপ
টুপুরের আজ খুব মন খারাপ। স্কুল থেকে ফিরে টুপুর কলকল করে সারাদিনে স্কুলে কী কী হল, কোন মিস কী বলল, কে কে হোমওয়ার্ক করেনি বলে বকা খেলও, টিফিনটাইমে কী কী খেলেছে, কে কতবার উল্টে পড়েছে, এই সমস্ত কথা ঠাম্মাকে না বলতে পারলে টুপুরের বিকেলের ভাত গলা দিয়ে নামেনা। আজ তো ঠাম্মা অবাক। টুপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে ফ্ল্যাট অবধি এক্কেবারে চুপ, একটা শব্দও নেই মুখে। খেতে বসে ফোনে গেম খেলারও আবদার নেই। কিছু তো একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। ঠাম্মা জানে নাতিবাবুর মন মেজাজ ভালো রাখতে গেলে ভালো মন্দ খাবার খাওয়ানো একটা মোক্ষম উপায়।
ঠাম্মা কড়াইয়ে গরম তেলে লুচি ছাড়তে ছাড়তে "টুপুর সোনা, খেতে দিচ্ছি কিন্তু, ঝটপট হাতমুখ ধুয়ে নাও" বলে হাঁক পাড়ল। টুপুরের দিক থেকে কোন উত্তর পেল না। লুচি ভাজা শেষ করে থালায় চারটে, আলুর তরকারি আর এক বাটি চালের পায়েসে সাজিয়ে ঠাম্মা যখন খাওয়ার ঘরে এলো, দেখল টুপুর শান্ত চুপচাপ হয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে।
"কী হয়েছে বাবাই? মন খারাপ আমার টুপুর সোনার?" নাতির চুলে বিলি কাটতে কাটতে ঠাম্মা জিজ্ঞেস করল। টুপুর ওর বড় বড় চোখ মেলে ঠাম্মার দিকে তাকালো, তারপর মাথা নেড়ে "কিছু না" বলেমুখ নামিয়ে খাবারের দিকে মনোযোগ দিলো।
কী করে বলবে ও ঠাম্মিকে? আজকে স্কুলে যা ঘটে গেল, ঠাম্মিকে বলা যায়? এমনিতে টুপুরের বেস্ট ফ্রেন্ড ওর ঠাম্মি। সব কথা বলে, ভালো হোক কি মন্দ। ক্লাস টিচারের প্রশংসা থেকে বকুনি, সব। কিন্তু এই কথাটা কী করে বলবে? যদি ঠাম্মা বকে? যদি মাকে বলে দেয়? কী লজ্জা।
"টুপুর লুচি খেতে ভালো লাগছে তো?" ঠাম্মার কথায় সম্বিত ফিরল টুপুরের। মাথা নেড়ে "হ্যাঁ" বলল।
"ঝটপট খেয়ে নাও সোনা। একটু ঘুমিয়ে নিয়ে আবার স্কুলে যেতে হবে।" ঠাম্মির কথায় মনে পড়ে যায় টুপুরের। আচ্ছা, ও যখন থাকবে না, সেই সময়ে মা যদি জেনে যায়? কি হবে? মা তো জানতে পারবে ওহাটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে। ওই যে, টু এর সব ছাত্রদের মায়েদের যে গ্রুপটা আছে, তাতে তো সারাদিন স্কুলে ক্লাসে কী কী হল, সব খবর এসে যায়। এতক্ষণে হয়তো এসেও গিয়েছে। তবে হ্যাঁ, মায়ের ফোনে নেটপ্যাক ভরা নেই। এই বাঁচোয়া। বাড়ি এসে wifi কানেক্ট না করা অবধি জানতে পারবে না। বাড়ি ফিরলেই তো পরীক্ষা, হোমওয়ার্ক, পি টি এম এইসবের খবর পেয়েই যায়। চন্দনা মিসও এই গ্রুপে আঁচে, যদি মায়ের কাছে ওর নামে নালিশ করে? কিন্তু টুপুর যে এত করে সরি বলল, পানিশমেন্টও পেয়েছে। তাও মিস বলে দেবে? ভাবতে ভাবতে কখন যে টুপুরের দুই চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করেছে, ও বুঝতেই পারেনি।
ঠাম্মি রান্নাঘরের কাজ মিটিয়ে টুপুরের ঘরে এসে দেখে ওই কাণ্ড মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল," সোনা বাবা আমার, ঠাম্মির কাছে লুকোস না কিছু প্লিজ। বল কী হয়েছে?" ঠাম্মা টুপুরের বেস্ট ফ্রেন্ড। স্কুলের সব কথাই ঠাম্মার সাথে শেয়ার করে ও। তাহলে আজ কেন বলবে না ও? হতেও তো পারে ঠাম্মা কোন সলিউশন দিতে পারে? এমনিও মা ঠিক জানতে পারবেই। বকুনিও দেবে। তার চেয়ে বরং ঠাম্মাকে আগেভাগে বলে রাখলে অন্তত ওর দলে থাকবে। মা অত বকতে পারবে না। এইসব ভেবে টুপুর বলতে শুরু করলো।
"ঠাম্মি আজ স্কুলে ইংলিশ ওয়ানের সারপ্রাইজ টেস্ট হল। তা আমি করেছি কী, একেকটা কোয়েসচেনের আন্সার লিখে সাথে সাথে রাফ খাতায় সেটা লিখে নিচ্ছিলাম।"
ঠাম্মি মাঝপথে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "কেন বাবু? এতে তোমার টাইম ওয়েস্ট হচ্ছিল না?"
টুপুর উত্তর দিল, "হুম, হচ্ছিল তো বটেই। কিন্তু কী করব? মা কোয়েসচেন আর তার আন্সারে কী লিখেছই জানতে চাইলে বলতে পারি না বলে বকে। কোয়েসচেন পেপারও তো ফেরত দেয়না। কী করব? তাই লিখে নিচ্ছিলাম।"
ঠাম্মা বলল, "তারপর?"
টুপুর বলতে লাগল, "মিস দেখতে পেয়ে আমায় খুব বকল। ভাবল আমি চিটিং করছি। দেখে দেখে লিখছি। আমার আন্সার শিট নিয়ে ফ্রেশ পেপার দিল।"
"এ বাবা। কী টিচার রে। মিলিয়ে মিলিয়ে তুই ঠিক ওই প্রশ্নের উত্তরগুলিই কী করে লিখে নিয়ে যাবি ভাবল, অদ্ভুত তো? তা যাক গে, তুই শেষ করতে পেরেছিলি ফুল পেপার?"
"না, প্লাস ক্লাসের সবাই আমার দিকে কেমন একটা করে তাকাচ্ছিল। যেন আমি চুরি করেছি। আমার খুব খারাপ লেগেছে ঠাম্মি।"
"হ্যাঁ, খারাপ তো লাগারই কথা বাবু। দাঁড়া, আমি মাকে বলব। সব গুছিয়ে বুঝিয়ে বলব। মা আর তোকে বকবে না। আর ভবিষ্যতেও এরকম দাবী করবে না। তুই নিশ্চিন্তে ঘুমো।"
"আর বন্ধুদের কাছে আমার রেপুটেশন?"
"আমি সব সামলে দেবো। ভরসা রাখ ঠাম্মির ওপর।"
টুপুর এখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত। যাক। ঠাম্মি বলেছে যখন, নিশ্চয়ই কিছু একটা হবে ঠিক। আর ওর ভয় নেই। বাইরে মেঘ করে এসেছে। বৃষ্টি নামবে বোধ হয়। চাদর চাপা দিয়ে টুপুর শুয়ে পড়ল। ঠাম্মি রোজের মতো ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গল্প বলতে লাগল। সেই গল্প শুনতে শুনতে প্রতিদিনের মতোই টুপুর কখন জানি ঘুমিয়েও পড়েছে। ঘুম ভাঙল যখন, দেখল বাইরে অন্ধকার। ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। চোখ কচলে বিছানা ছেড়ে উঠল ও। রান্নাঘর থেকে টুংটাং কড়াইয়ের শব্দ আসছে। ছ্যাঁক ছোক তেলের আওয়াজও। ঠাম্মি আর মায়ের গলার স্বর শুনতে পাচ্ছে। মনে হছে হাসির শব্দ। ঘরের আলো জ্বালিয়ে টুপুর দেখল সাড়ে ছটা বাজে। এ বাবা। ওর যে ছটা থেকে গানের ক্লাস ছিল? যাহ, আজ আবসেন্ট। মা বকবে না তো?
ঘরে আলো জ্বলছে দেখে ঠাম্মি হাঁক দিল, "টুপুর বাবু, উঠেছ?"
"হ্যাঁ ঠাম্মি।" টুপুর জোরে উত্তর দিল।
"হাত মুখ ধুয়ে একবার এদিকে আসো তো সোনা। আমি রান্নাঘরে আছি।"
কে জানে, মা কী বলবে। একটু দুরুদুরু বুকেই টুপুর মুখ হাত ধুয়ে রান্নাঘরে গেল। আহ, ঠাম্মি নিমকি ভাজছে। কী দারুণ গন্ধ। স্তূপ করে রাখা নিমকিগুলি। গরম গরম। মুচমুচে। দেখেই খেতে ইচ্ছে হয়। আর ঠাম্মির নিমকির স্বাদ যে কোন কেনা নিমকিকে বলে বলে দশ গোলে হারিয়ে দেবে, টুপুর জানে। আর তাই টুক করে একটা নিমকি মুখে দিল ও। আহ, অমৃত।
ঠাম্মি বলল, "টুপুর বাবু, এগুলো তোমার বন্ধুদের জন্য বানাচ্ছি। কাল স্কুলে নিয়ে যেয়ো। টিফিনে সবাইকে খাইয়ো। দেখবে, সবাই আজকের কথা ভুলে যাবে।" টুপুর হাঁ করে শুনছিল ঠাম্মির কথা। একবার মায়ের দিকে তাকালো। দেখল মা মুচকি মুচকি হাসছে। যাক, তার মানে হাওয়া গরম না।
"আর শোন, আমি মাকে সব বলেছি। বুঝিয়েছি। মা তোকে বকবে তো নাই। বরং ইন ফিউচারও এমন কিছু যাতে তোকে করতে না হয়, তেমন অন্যায্য দাবীও করবে না। ঠিক আছে তো?" থামির কথাগুলো শুনে তুপুর এইবারে এক্কেবারে নিশ্চিন্ত হল।
মা হাসিমুখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, " সরি সোনা। আমার জন্য তোকে এইসব ফেস করতে হল। আমি ক্লাস টিচারকে নোট লিখে দেবো। সব এক্সপ্লেইন করবো। তুই চিন্তা করিস না। কেউ তোকে আর ট্রাবল করবে না।"
"আর বন্ধুরা?" টুপুর জিজ্ঞেস করলো।
"সে তো ঠাম্মিস ম্যাজিক নিমকি খেয়েই সব সল্ভড হয়ে যাবে। চল, আজ গানের ক্লাস যখন মিস হয়েই গেল, আমরা তিনজনে মিলে বরং অন্তাক্ষরী খেলই। বাবাকে ফোন করে দিচ্ছি। তোর ফেভারিট চাইনিজ ডিনার নিয়ে আসতে বলি। লেটস সেলিব্রেট দ্য পারফেক্ট ওয়েদার।" মায়ের কথা শুনে টুপুর "ইয়াহু" বলে লাফিয়ে উঠল। কী আনন্দ।
ঠাম্মা কড়াইয়ে গরম তেলে লুচি ছাড়তে ছাড়তে "টুপুর সোনা, খেতে দিচ্ছি কিন্তু, ঝটপট হাতমুখ ধুয়ে নাও" বলে হাঁক পাড়ল। টুপুরের দিক থেকে কোন উত্তর পেল না। লুচি ভাজা শেষ করে থালায় চারটে, আলুর তরকারি আর এক বাটি চালের পায়েসে সাজিয়ে ঠাম্মা যখন খাওয়ার ঘরে এলো, দেখল টুপুর শান্ত চুপচাপ হয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে।
"কী হয়েছে বাবাই? মন খারাপ আমার টুপুর সোনার?" নাতির চুলে বিলি কাটতে কাটতে ঠাম্মা জিজ্ঞেস করল। টুপুর ওর বড় বড় চোখ মেলে ঠাম্মার দিকে তাকালো, তারপর মাথা নেড়ে "কিছু না" বলেমুখ নামিয়ে খাবারের দিকে মনোযোগ দিলো।
কী করে বলবে ও ঠাম্মিকে? আজকে স্কুলে যা ঘটে গেল, ঠাম্মিকে বলা যায়? এমনিতে টুপুরের বেস্ট ফ্রেন্ড ওর ঠাম্মি। সব কথা বলে, ভালো হোক কি মন্দ। ক্লাস টিচারের প্রশংসা থেকে বকুনি, সব। কিন্তু এই কথাটা কী করে বলবে? যদি ঠাম্মা বকে? যদি মাকে বলে দেয়? কী লজ্জা।
"টুপুর লুচি খেতে ভালো লাগছে তো?" ঠাম্মার কথায় সম্বিত ফিরল টুপুরের। মাথা নেড়ে "হ্যাঁ" বলল।
"ঝটপট খেয়ে নাও সোনা। একটু ঘুমিয়ে নিয়ে আবার স্কুলে যেতে হবে।" ঠাম্মির কথায় মনে পড়ে যায় টুপুরের। আচ্ছা, ও যখন থাকবে না, সেই সময়ে মা যদি জেনে যায়? কি হবে? মা তো জানতে পারবে ওহাটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে। ওই যে, টু এর সব ছাত্রদের মায়েদের যে গ্রুপটা আছে, তাতে তো সারাদিন স্কুলে ক্লাসে কী কী হল, সব খবর এসে যায়। এতক্ষণে হয়তো এসেও গিয়েছে। তবে হ্যাঁ, মায়ের ফোনে নেটপ্যাক ভরা নেই। এই বাঁচোয়া। বাড়ি এসে wifi কানেক্ট না করা অবধি জানতে পারবে না। বাড়ি ফিরলেই তো পরীক্ষা, হোমওয়ার্ক, পি টি এম এইসবের খবর পেয়েই যায়। চন্দনা মিসও এই গ্রুপে আঁচে, যদি মায়ের কাছে ওর নামে নালিশ করে? কিন্তু টুপুর যে এত করে সরি বলল, পানিশমেন্টও পেয়েছে। তাও মিস বলে দেবে? ভাবতে ভাবতে কখন যে টুপুরের দুই চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করেছে, ও বুঝতেই পারেনি।
ঠাম্মি রান্নাঘরের কাজ মিটিয়ে টুপুরের ঘরে এসে দেখে ওই কাণ্ড মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল," সোনা বাবা আমার, ঠাম্মির কাছে লুকোস না কিছু প্লিজ। বল কী হয়েছে?" ঠাম্মা টুপুরের বেস্ট ফ্রেন্ড। স্কুলের সব কথাই ঠাম্মার সাথে শেয়ার করে ও। তাহলে আজ কেন বলবে না ও? হতেও তো পারে ঠাম্মা কোন সলিউশন দিতে পারে? এমনিও মা ঠিক জানতে পারবেই। বকুনিও দেবে। তার চেয়ে বরং ঠাম্মাকে আগেভাগে বলে রাখলে অন্তত ওর দলে থাকবে। মা অত বকতে পারবে না। এইসব ভেবে টুপুর বলতে শুরু করলো।
"ঠাম্মি আজ স্কুলে ইংলিশ ওয়ানের সারপ্রাইজ টেস্ট হল। তা আমি করেছি কী, একেকটা কোয়েসচেনের আন্সার লিখে সাথে সাথে রাফ খাতায় সেটা লিখে নিচ্ছিলাম।"
ঠাম্মি মাঝপথে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "কেন বাবু? এতে তোমার টাইম ওয়েস্ট হচ্ছিল না?"
টুপুর উত্তর দিল, "হুম, হচ্ছিল তো বটেই। কিন্তু কী করব? মা কোয়েসচেন আর তার আন্সারে কী লিখেছই জানতে চাইলে বলতে পারি না বলে বকে। কোয়েসচেন পেপারও তো ফেরত দেয়না। কী করব? তাই লিখে নিচ্ছিলাম।"
ঠাম্মা বলল, "তারপর?"
টুপুর বলতে লাগল, "মিস দেখতে পেয়ে আমায় খুব বকল। ভাবল আমি চিটিং করছি। দেখে দেখে লিখছি। আমার আন্সার শিট নিয়ে ফ্রেশ পেপার দিল।"
"এ বাবা। কী টিচার রে। মিলিয়ে মিলিয়ে তুই ঠিক ওই প্রশ্নের উত্তরগুলিই কী করে লিখে নিয়ে যাবি ভাবল, অদ্ভুত তো? তা যাক গে, তুই শেষ করতে পেরেছিলি ফুল পেপার?"
"না, প্লাস ক্লাসের সবাই আমার দিকে কেমন একটা করে তাকাচ্ছিল। যেন আমি চুরি করেছি। আমার খুব খারাপ লেগেছে ঠাম্মি।"
"হ্যাঁ, খারাপ তো লাগারই কথা বাবু। দাঁড়া, আমি মাকে বলব। সব গুছিয়ে বুঝিয়ে বলব। মা আর তোকে বকবে না। আর ভবিষ্যতেও এরকম দাবী করবে না। তুই নিশ্চিন্তে ঘুমো।"
"আর বন্ধুদের কাছে আমার রেপুটেশন?"
"আমি সব সামলে দেবো। ভরসা রাখ ঠাম্মির ওপর।"
টুপুর এখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত। যাক। ঠাম্মি বলেছে যখন, নিশ্চয়ই কিছু একটা হবে ঠিক। আর ওর ভয় নেই। বাইরে মেঘ করে এসেছে। বৃষ্টি নামবে বোধ হয়। চাদর চাপা দিয়ে টুপুর শুয়ে পড়ল। ঠাম্মি রোজের মতো ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গল্প বলতে লাগল। সেই গল্প শুনতে শুনতে প্রতিদিনের মতোই টুপুর কখন জানি ঘুমিয়েও পড়েছে। ঘুম ভাঙল যখন, দেখল বাইরে অন্ধকার। ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। চোখ কচলে বিছানা ছেড়ে উঠল ও। রান্নাঘর থেকে টুংটাং কড়াইয়ের শব্দ আসছে। ছ্যাঁক ছোক তেলের আওয়াজও। ঠাম্মি আর মায়ের গলার স্বর শুনতে পাচ্ছে। মনে হছে হাসির শব্দ। ঘরের আলো জ্বালিয়ে টুপুর দেখল সাড়ে ছটা বাজে। এ বাবা। ওর যে ছটা থেকে গানের ক্লাস ছিল? যাহ, আজ আবসেন্ট। মা বকবে না তো?
ঘরে আলো জ্বলছে দেখে ঠাম্মি হাঁক দিল, "টুপুর বাবু, উঠেছ?"
"হ্যাঁ ঠাম্মি।" টুপুর জোরে উত্তর দিল।
"হাত মুখ ধুয়ে একবার এদিকে আসো তো সোনা। আমি রান্নাঘরে আছি।"
কে জানে, মা কী বলবে। একটু দুরুদুরু বুকেই টুপুর মুখ হাত ধুয়ে রান্নাঘরে গেল। আহ, ঠাম্মি নিমকি ভাজছে। কী দারুণ গন্ধ। স্তূপ করে রাখা নিমকিগুলি। গরম গরম। মুচমুচে। দেখেই খেতে ইচ্ছে হয়। আর ঠাম্মির নিমকির স্বাদ যে কোন কেনা নিমকিকে বলে বলে দশ গোলে হারিয়ে দেবে, টুপুর জানে। আর তাই টুক করে একটা নিমকি মুখে দিল ও। আহ, অমৃত।
ঠাম্মি বলল, "টুপুর বাবু, এগুলো তোমার বন্ধুদের জন্য বানাচ্ছি। কাল স্কুলে নিয়ে যেয়ো। টিফিনে সবাইকে খাইয়ো। দেখবে, সবাই আজকের কথা ভুলে যাবে।" টুপুর হাঁ করে শুনছিল ঠাম্মির কথা। একবার মায়ের দিকে তাকালো। দেখল মা মুচকি মুচকি হাসছে। যাক, তার মানে হাওয়া গরম না।
"আর শোন, আমি মাকে সব বলেছি। বুঝিয়েছি। মা তোকে বকবে তো নাই। বরং ইন ফিউচারও এমন কিছু যাতে তোকে করতে না হয়, তেমন অন্যায্য দাবীও করবে না। ঠিক আছে তো?" থামির কথাগুলো শুনে তুপুর এইবারে এক্কেবারে নিশ্চিন্ত হল।
মা হাসিমুখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, " সরি সোনা। আমার জন্য তোকে এইসব ফেস করতে হল। আমি ক্লাস টিচারকে নোট লিখে দেবো। সব এক্সপ্লেইন করবো। তুই চিন্তা করিস না। কেউ তোকে আর ট্রাবল করবে না।"
"আর বন্ধুরা?" টুপুর জিজ্ঞেস করলো।
"সে তো ঠাম্মিস ম্যাজিক নিমকি খেয়েই সব সল্ভড হয়ে যাবে। চল, আজ গানের ক্লাস যখন মিস হয়েই গেল, আমরা তিনজনে মিলে বরং অন্তাক্ষরী খেলই। বাবাকে ফোন করে দিচ্ছি। তোর ফেভারিট চাইনিজ ডিনার নিয়ে আসতে বলি। লেটস সেলিব্রেট দ্য পারফেক্ট ওয়েদার।" মায়ের কথা শুনে টুপুর "ইয়াহু" বলে লাফিয়ে উঠল। কী আনন্দ।
Wednesday, December 12, 2018
শীত ইত্যাদি (সাম্পান)
কবে থেকে খুঁজছি জানেন, কিন্তু পাচ্ছিইনা। মনে হয় শব্দগুলো সব চড়ুইভাতি
করতে গিয়েছে। আর নইলে পরিযায়ী পাখিদের সাথে ডানা মেলে উড়ছে এদিক ওদিক। আর
নয়তো বলতে পারি, যা ঠাণ্ডা পড়েছে, ল্যাদ মোড অন। লেপ কম্বলের তলা থেকে
আমাদেরই বের হওয়া, বড়ই মুস্কিল ব্যাপার। স্কুলগুলোরও তো ছুটি পড়ল বলে। আর
হয়তো হাতে গুণে দিন দশেক। তাহলে শব্দগুলোরই বা কী দোষ বলুন তো? ওদেরও তো শখ
আহ্লাদ আছে। নাকি?
আমরা যখন তখন নতুন গুড়ের মোয়া, পাটালি খাবো। বড়দিনের স্পেশাল নাহুমের রিচ ফ্রুট কেক খাবো। চিড়িয়াখানায় লুচি আর নতুন আলুর দম নিয়ে গিয়ে পিকনিক করব। বাড়ি বসে ফুলকপির তরকারি, পালং শাক, পাবদা পার্শে খেয়ে একটা ছোট্ট ঢেকুর তুলে ছাদে মিঠেকড়া রোদে বসে কমলালেবুর খোসা ছাড়াব। সাথে থাকবে দুপুর দুটোর আকাশবাণীর নাটক। একটু রোদ পড়তে থাকবে যখন, একটা কনকনে বাতাস হঠাৎ ছুঁয়ে যাবে। বেশ জাপ্টে নেবো শালটাকে।
আমরা যখন তখন নতুন গুড়ের মোয়া, পাটালি খাবো। বড়দিনের স্পেশাল নাহুমের রিচ ফ্রুট কেক খাবো। চিড়িয়াখানায় লুচি আর নতুন আলুর দম নিয়ে গিয়ে পিকনিক করব। বাড়ি বসে ফুলকপির তরকারি, পালং শাক, পাবদা পার্শে খেয়ে একটা ছোট্ট ঢেকুর তুলে ছাদে মিঠেকড়া রোদে বসে কমলালেবুর খোসা ছাড়াব। সাথে থাকবে দুপুর দুটোর আকাশবাণীর নাটক। একটু রোদ পড়তে থাকবে যখন, একটা কনকনে বাতাস হঠাৎ ছুঁয়ে যাবে। বেশ জাপ্টে নেবো শালটাকে।
(আমার আবার শাল নিয়ে রোমান্টিসিজম আছে খুব। মায়ের সাথে নিউ মার্কেট থেকে
কাশ্মীরি কাজ করা কালো শাল বা হিমাচল প্রদেশ ঘুরতে গিয়ে কেনা কুলু শাল। বা
বন্ধু সোহিনীর কথা অনুযায়ী গুরজারি থেকে কেনা সেই "ভুস্কু" শাল। উফ। কী ওম।
কী আরাম। বেশ জড়িয়ে জাপটে আরাম। হ্যাঁ, প্র্যাক্টিকালি ভাবতে গেলে সোয়েটার
জ্যাকেট অনেক কনভিনিয়েন্ট ঠিকই। কিন্তু শাল হল আভিজাত্য। ভাবুন তো, শীত
মানেই বিয়েবাড়ি। ভারী সিল্কের শাড়ির সাথে কি কোন সোয়েটার চলে? উহু। চাই
একটা জম্পেশ শাল। আর যদি পরেন পাজামা পাঞ্জাবি, কাঁধে একটা কাশ্মীরি শাল
ঝোলানো কিন্তু মাস্ট! এই দেখুন গিয়ে কী লিখতে বসে কীসব ফ্যাশনের গল্প করে
ফেললাম...)
তা যা বলছিলাম। হয়েছে কী, আমার শব্দগুলোও সব আবদার করেছে। ওদেরও শীতের ছুটি চাই। ওরা বেশ উড়ে বেড়াবে। ঘুরে বেড়াবে। এদিক সেদিক। অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবে। আমি তো আবার দয়ালু মানুষ। ছুটি মঞ্জুর করেই দিলাম। তবে হ্যাঁ, একটু কড়াও হতে হয়। এক্কেবারে প্রথমেই ছুটি দেওয়া যায় না। তাই বলেছি, এক সপ্তাহ কাজ করতে হবে। তারপর যেখানে খুশি যাও। ওরাও মেনে নিয়েছে।
আগামীকাল থেকে তাই এক সপ্তাহ ব্যাপী "কিশলয়" থিমের ওপর গান গল্প কবিতা থাকছে। আর তারপর?
ছুটি ছুটি ছুটি...
কবে ফেরা? দেখি, ওরা কবে ফেরে?
শীত এঞ্জয় করুন।
(এ তল্লাটেও অল্প বিস্তর ঠাণ্ডা পড়েছে বই কি)
তা যা বলছিলাম। হয়েছে কী, আমার শব্দগুলোও সব আবদার করেছে। ওদেরও শীতের ছুটি চাই। ওরা বেশ উড়ে বেড়াবে। ঘুরে বেড়াবে। এদিক সেদিক। অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবে। আমি তো আবার দয়ালু মানুষ। ছুটি মঞ্জুর করেই দিলাম। তবে হ্যাঁ, একটু কড়াও হতে হয়। এক্কেবারে প্রথমেই ছুটি দেওয়া যায় না। তাই বলেছি, এক সপ্তাহ কাজ করতে হবে। তারপর যেখানে খুশি যাও। ওরাও মেনে নিয়েছে।
আগামীকাল থেকে তাই এক সপ্তাহ ব্যাপী "কিশলয়" থিমের ওপর গান গল্প কবিতা থাকছে। আর তারপর?
ছুটি ছুটি ছুটি...
কবে ফেরা? দেখি, ওরা কবে ফেরে?
শীত এঞ্জয় করুন।
(এ তল্লাটেও অল্প বিস্তর ঠাণ্ডা পড়েছে বই কি)
শীত ইত্যাদি
https://youtu.be/pSfci8hdQ1E
দুপুরগুলোয় আর সেই গা চিড়বিড় করা গরমটা বোধ করিনা। ছাতা তো কোন জন্মেই ব্যবহার করিনা (বৃষ্টি ছাড়া), এখন যেন তার প্রয়োজনটুকুও হয় না। ফাটা ঠোঁটে পড়ছে অরিফ্লেমের স্নিগ্ধ পরশ। খুব ঘন ঘনই। সকালে স্নানের সময়ে গরম জলের কলেই প্রায়দিন কাজ চলে যাচ্ছে। সন্ধ্যের দিকে পাতলা চাদরে কান মাথা ভালো করে মুড়ি না দিলে হচ্ছে না। অবশ্য নিন্দুকেরা বলবে চেন্নাইয়ে পাঁচ বছরের ওপর থেকে আমি নাকি স্থানীয়দের মতোই হয়ে গিয়েছি। অল্পেই ঠাণ্ডায় কাতর। তবে সত্যি বলছি, ঠাণ্ডা কিন্তু পড়েছে। হতেই পারে, কলকাতার মতো না। তবুও, রাত্রে গায়ে একটা হাল্কা চাপা দিতেই হচ্ছে।
দুপুরগুলোয় আর সেই গা চিড়বিড় করা গরমটা বোধ করিনা। ছাতা তো কোন জন্মেই ব্যবহার করিনা (বৃষ্টি ছাড়া), এখন যেন তার প্রয়োজনটুকুও হয় না। ফাটা ঠোঁটে পড়ছে অরিফ্লেমের স্নিগ্ধ পরশ। খুব ঘন ঘনই। সকালে স্নানের সময়ে গরম জলের কলেই প্রায়দিন কাজ চলে যাচ্ছে। সন্ধ্যের দিকে পাতলা চাদরে কান মাথা ভালো করে মুড়ি না দিলে হচ্ছে না। অবশ্য নিন্দুকেরা বলবে চেন্নাইয়ে পাঁচ বছরের ওপর থেকে আমি নাকি স্থানীয়দের মতোই হয়ে গিয়েছি। অল্পেই ঠাণ্ডায় কাতর। তবে সত্যি বলছি, ঠাণ্ডা কিন্তু পড়েছে। হতেই পারে, কলকাতার মতো না। তবুও, রাত্রে গায়ে একটা হাল্কা চাপা দিতেই হচ্ছে।
সেইসব ভাবতে ভাবতে আজ এই গানটা বেশ কয়েকবার শুনতে লাগলাম। কেন জানি না,
এইটাকে আমার শীতের অ্যান্থেম বলে মনে হয়। মনে আছে, ২০১৩ সালে যখন বেরিয়েছিল
দ্বিতীয় পুরুষ অ্যালবামটি, অনুপম রায়ের সই করা সিডি কিনি আমি। কী আনন্দ
তাতে। সারাদিন ধরে শুনে যেতাম। মোবাইলে ট্রান্সফারও করে নিয়েছিলাম। তখন
আমার সেই সিম্বিয়ান অপারেটিং সিস্টেমের নোকিয়া এক্স টু। জিওও আসেনি।
ইন্টারনেটে মিউজিক স্ট্রিমিং হয় না তেমন। ওই গোটা অ্যালবামে এটা আমার
সবচেয়ে পছন্দের গান ছিল। ২০১৩র ডিসেম্বর। চেন্নাইয়ে প্রথম শীত। দুপুরে
হোস্টেলে খেয়ে ল্যাবে ফিরতাম। বেশ অনেকটা রাস্তা। তখনও সাইকেল কিনিনি।
বাসের অপেক্ষা না করে গাছ গাছালির ছায়া দিয়ে মিঠে রোদ পোহাতে পোহাতে কানে
ইয়ারফোন গুঁজে এই গানটাই লুপে ফেলে হাঁটতাম।
আজ আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে সেইসব দিনগুলিতে। ওই রাস্তায়। ওই অনুভুতিগুলোয়... খুব।।
আজ আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে সেইসব দিনগুলিতে। ওই রাস্তায়। ওই অনুভুতিগুলোয়... খুব।।
Friday, December 7, 2018
ব্যথা
ওরে বাবা রে, মা রে, ঘাড়ে কী ব্যথা, কী ব্যথা। বলে বোঝাতে পারবো না। সে
রাত্রে শুতে পারিনা, সমানে এপাশ ওপাশ করে যাই। তাতেও বড় ব্যথা করে। এ ও
বলল, বালিশ তোশক রোদ্দুরে দিতে। তাও দিলাম। কিন্তু ব্যথা যে আর মরেনা।
কাজকর্ম করতে পারিনা ব্যথার চোটে। এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে গেলেও বড়
কষ্ট হচ্ছে। ডাক্তার বদ্যিতে ওষুধ দিল কিছু। ওই একদিন ব্যথা মরল। তারপর
আবার যে কে সেই। শীতকাল পড়েছে। ব্যথা বাড়বে বলছে সকলে। কে জানে বাবা, বুড়ো
হার। বারবার এমনি হয়। তবে হ্যাঁ, এই অসুখ আমার নতুন নয়। প্রতি বছর হয়। কটাদিন, কয়েকটা সপ্তাহ একটু মুখ বুজে সহ্য করতে হবে।
ব্যস, তারপর একদিন সকালে উঠে দেখব, ব্যথা ভ্যানিশ। একটু একটু করে কমতে কমতে পুরোপুরি সে চলে গেল? নাকি অভ্যেস হয়ে গেল সয়ে নেওয়ার, তা অবশ্য আমি জানিনা। তবে হ্যাঁ, আর কষ্টটা হয়না।
ব্যস, তারপর একদিন সকালে উঠে দেখব, ব্যথা ভ্যানিশ। একটু একটু করে কমতে কমতে পুরোপুরি সে চলে গেল? নাকি অভ্যেস হয়ে গেল সয়ে নেওয়ার, তা অবশ্য আমি জানিনা। তবে হ্যাঁ, আর কষ্টটা হয়না।
ওই দিদিটাও তো তাইই বলেছিল। ওর নাকি প্রতিবার যখন প্রেম ভেঙ্গে যায়, কষ্ট
পেতে থাকে। তারপর অবশ্য ঠিক এইভাবেই একদিন ব্যথার সাথে বন্ধুত্ব করে অভ্যেস
করে নেয়। কিংবা, সত্যিই হয়তো, ব্যথাটা কমে যায়। কে জানে...
মেয়েমানুষের জান হে। আমাদের সইবার শক্তি যে অনেক।
মেয়েমানুষের জান হে। আমাদের সইবার শক্তি যে অনেক।
Tuesday, December 4, 2018
"সৃজন ছন্দে"
দেয়াসিনীর জন্ম, বড় হয়ে ওঠা সমস্তই পলাশপুর গ্রামের বনেদি বড়লোক বাড়িতে। মিত্র বাড়ি এমনই এক বাড়ি, যেখানে ঐশ্বর্য ও বৈভবের কোন অভাব না থাকলেও, পরিবারের কিছু কিছু সদস্যদের জন্য সব সময়ই অনেক কিছুই থেকেছে না পাওয়ার তালিকায়। সেই বিশেষ সদস্যরা সকলেই নারী। পরিবারের রক্ষণশীল তথাকথিত পুরুষসিংহেরা কেউই চাইতেন না তাঁদের পরিবারের মেয়েরা কোন স্বপ্ন দেখুক। বা নিদেনপক্ষে মুক্ত হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিক। দেয়াসিনী ও ওর বাকি জেঠতুতো খুড়তুতো দিদি ও বোনেরা এটাকেই স্বাভাবিক, এটাই ভবিতব্য মেনেই নিয়েছিল। দিব্যি চলছিলও জীবন। এক এক করে স্কুলের গণ্ডী পার করেই বসে যেত বিয়ের পিঁড়িতে। তারপর মা কাকীমাদের মতোই অন্যের সংসারের ঘানি টানা।
এমন সময়ে এই বাড়ির বড়কর্তা দিব্যকান্তি মিত্র, অর্থাৎ দেয়াসিনীর সবচেয়ে বড় জ্যাঠার নামে এলো একটি চিঠি। বাড়ির মেয়ে, চন্দ্রিমা, যিনি পঁচিশ বছর আগে পরিবারের "মুখ কালো" করে এক ভিন্ন জাতের ছেলেকে ভালোবেসে তার সাথে পালিয়ে বিয়ে করায় ত্যাজ্য কন্যা হন, সম্প্রতি দীর্ঘ রোগভোগের পর মারা গিয়েছেন। ওঁর একমাত্র ছেলে দেবদূত গ্রামের বাড়িতে এসে সকলের সাথে দেখা করতে চায়। চন্দ্রিমা দেবীর ঘটনাটি ঘটে ওঁর বাবা, রামকৃষ্ণ মিত্রের নির্দেশে। পাঁচ ভাইয়ের পর প্রথম বোন চন্দ্রিমা ছিল দাদাদের বড় আদরের। বাবার কথা অমান্য করার "শিক্ষা" কেউই পাননি বলে তাঁরা তখন এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেতে পারেননি। তবে আজ যখন সমস্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিব্যকান্তির হাতে, তিনি দুইবার ভাবলেন না। ভাগ্নেকে সত্বর আসতে বললেন। বাকি সদস্য সদস্যারা অবাক হলেন বটে। তবে স্নেহের টানকে যে উপেক্ষা করা যায় না, এটা ভেবে সবটা মেনে দেবদূতের আগমনের আয়োজন শুরু হল।
এক সপ্তাহ পর দেবদূত এলো পলাশপুর। মামার বাড়ি এসে সে যে খুব বেশি খাতির যত্ন পাবে না, এমনটা জানত। তবুও, ওকে আনতে যে স্টেশনে মামারা লোক পাঠাবেন গাড়ি নিয়ে, সেটা ভাবতেই পারেনি। মায়ের কাছে এই বাড়ির কত গল্প শুনেছে। ছোট থেকে যখন বন্ধুরা ছুটিতে মামাবাড়ি যাওয়ার গল্প করত, মুখ চুন করে থাকত ও। আজ এতগুলো বছর পর যে সেই মামাবাড়িতে আসছে, আলাদাই অনুভূতি। শুধু যদি মা এই দিনটা দেখে যেতে পারত।
দেয়াসিনীর খুব ভালো লেগেছে এই দাদাটিকে। কী শান্ত, শোভন, ভদ্র। ওর চেনা পরিচিত এই বয়সী ছেলেদের চেয়ে অনেক ভালো, অনেক আলাদা। যদিও দেয়ার থেকে দেবদূত প্রায় বছর আটেকে বড়, তবুও দুজনের আলাপটা ভালোই জমেছে। লেখাপড়া, দেশ বিদেশের গল্প শুনতে খুব ভালো লাগে দেয়ার। আর এই দাদাটিও বড় ভালো গল্প করতে পারে। একেবারে মাতিয়ে রাখে।
দেয়াসিনী ওর অন্যান্য ভাই বোনেদের থেকে একটু হলেও আলাদা। বয়স সুলভ কোন প্রগল্ভতা নেই। শান্ত, স্নিগ্ধ। পরিবারের একেবারে "আদর্শ মেয়ে"। একদিন দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর দেয়াসিনী ছাদে বসে চড়াই পাখিদের চাল খাওয়াচ্ছে, এমন সময় পায়ের শব্দে চমকে উঠল। এই সময়ে সচরাচর কেউ এদিকে আসে না। এটা ওর এক্কেবারে নিজস্ব জগত। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে দেবদূত। গলায় ক্যামেরা ঝোলানো। ঠিক বাবাই দাদার ওই বন্ধুটার মতো, যে গতবারে পুজোয় কলকাতা থেকে এসেছিল।
"কী করছ?" হাসি মুখেই জিজ্ঞেস করলো দেবদূত।
দেয়া একটু লজ্জা লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে বলল, "তেমন কিছু না। ওই একটু চড়াইগুলোকে খেতে দিচ্ছি। রোজ এই সময়ে ওদের খেতে দিই। না দিলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলে নেবে।"
দেবদূত বলল, "পাখী ভালোবাসো?"
দেয়া মাথা নাড়ল।
"আর কী কী ভালো লাগে তোমার?" দেবদূত আবার প্রশ্ন করলো।
"আর কী? কিছু না।" দেয়া উত্তর দিল।
দেবদূত নাছোড়বান্দা। আবার প্রশ্ন করলো, "তা তো হয় না দেয়া রাণী। ক্লাস টেনের মেয়ে, শখ আহ্লাদ নেই নাকি? কোন হবি নেই?"
"ওই একটু আধটু মাঝে মাঝে বাড়িতে কেউ না থাকলে বা এমনি দুপুরে ছাদে এসে টুকটাক নাচ করি। দিদিভাই বা বোনুর মতো গানও গাইতে পারি না। আবৃত্তিও পারি না। ওই একটু টিভি দেখে বা স্কুলে যেটুকু বন্ধুদের দেখি, অল্প নাচ পারি।" কথাগুলো বলেই দেয়া জিভ কাটল। বেশ ভয় ভয়েই বলল, "দেবদা, তুমি কিন্তু এই কথাটা বাড়ির কাউকে বলো না প্লিজ। ওরা জানতে পারলে কেলেঙ্কারি হবে।"
"কেলেঙ্কারি? কেন? কীসের কেলেঙ্কারি?" দেবদূত অবাক।
"তুমি জানো না দাদা। নাচ নাকি আমাদের মতো ভদ্রও বাড়ির মেয়েরা করে না। এসব নাকি ধিঙ্গিপনা। দুই বছর আগে স্কুলের ফাংশানে আমায় নাচ করতে ডেকেছিল। সেই নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড। বুড়ি দিদা মানে বাবাদের পিসি, তখন জীবিত ছিলেন। সে কী চিৎকার চেঁচামিচি।" দেয়াসিনী বলল।
"আচ্ছা, তুমি কী নাচ ভালোবাসো? ক্লাসিকাল? নাকি ফিল্ম?" দেবদূত জানতে চাইল।
"আমি সব পারি দাদা। তবে রবীন্দ্রসঙ্গীত আর নজরুলগীতির সাথে বেশি ভালো লাগে।" দেবদূত লক্ষ্য করলো, দেয়ার মুখ চোখে কী অপরিসীম আনন্দ যখন ও নাচের গল্প করছিল। কোন কোন গানের সাথে ও কীভাবে স্টেপ শিখেছে, সব গল্প করতে করতে এ যেন এক অন্য দেয়া। শান্ত নির্জীব মেয়েটির মধ্যেও যে এত প্রাণখোলা ব্যাপার আছে, ওকে আজ না দেখলেই জানতেই পারত না দেবদূত।
কলকাতায় বান্ধবী প্রিয়স্মিতাকে ফোন করে সবটা বলল। প্রিয়স্মিতা নিজেও নাচ করে। রীতিমত স্টেজে প্রচুর মানুষের সামনে শো হয় ওর। ভারতনাট্যম। দেবদূত ওকে বলল, "প্রিয়া, আমার এই বোনটার জন্য কিছু কি করা যায় না?"
প্রিয়স্মিতা খানিক ভেবে বলল, "একটা কাজ করবি? আমায় একটা স্যাম্পেল পাঠাতে পারবি ওর নাচের? দেখি?"
দেবদূত খানিক ভেবে বলল, "দেখ ক্যামেরা সাথেই আছে। দেখি দেয়াকে রাজি করাতে পারি কি না।"
"ওই মিনিট দুই তিনেকের করলেই হবে। তুই দেখ। পাঠা আমায়। দেখছি কী করা যায়।" প্রিয়স্মিতা জানালো।
সেদিন বিকেলে চায়ের আসরের গল্প গুজবের এক ফাঁকে দেবদূত দেয়াকে ডেকে বলল, "শোন, আমার এক বান্ধবী খুব ভালো নাচ করে। আমি ওকে বলেছি তোমার কথা। ও খুব আগ্রহী তোমার নাচ দেখতে। তুমি আমায় তোমার নাচের ভিডিও শুট করতে দেবে প্লিজ?"
দেয়ার তো শুনেই মুখ চোখ ফ্যাকাসে হওয়ার জোগাড়। কোনমতে ফিসফিস করে বলল, "সে কী দেবদা? তা আবার হয় নাকি? বাড়ির লোকজন জানতে পারলে কেলেঙ্কারি।"
"জানবে কী করে? তুমি যেমন ছাদে এসে মাঝে মাঝে নিজের মনে নাচ করো, সেরকম করবে। আমি ভিডিও করে নেবো। কেউ জানতেও পারবে না।" দেবদূত আশ্বস্ত করলো দেয়াকে। দেয়া কথা দিল না।
দেবদূতের বাড়ি ফেরার সময় হয়ে আসছে। দেয়াসিনী এখনও দ্বন্দ্বে। কী করবে? নাচতে তো ও ভালোবাসেই। নাচের ভিডিও দাদাকে করতে দেবে? যদি বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায়? যদি বকা খায়? গেলবারে যা বকুনি দিয়েছিল জেঠু। বাবাও বাঁচাতে পারেনি। বাবা তাও ওর শখ আহ্লাদ নিয়ে ভাবে। কিন্তু জেঠুর সামনে তেমন বলতেও তো পারে না কিছু।
গল্প করে, এদিক ওদিক ঘুরে বেরিয়ে, খাওয়া দাওয়া করে কীভাবে যে দিনগুলো কেটে যায়, খেয়ালই থাকেনা। কাল দেবদূত চলে যাবে। আজ শেষবারের মতো সুযোগ। বারবার বলেছে ও দেয়াকে। দেয়া ছাদের এক কোণে চুপ করে বসে আছে। মন খারাপ। একদিকে মনে হচ্ছে নাচটা করেই ফেলে, আবার আরেকদিকে ভয়। লোক জানাজানির।
হঠাৎ টের পেল, কখন জানি পাশে এসে বসেছে বাবা। আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেবদূত।
"কী ভাবছিস রে দেয়া?" বাবা সস্নেহে জিজ্ঞেস করলেন।
"কই, কিছু না তো।" দেয়া মাথা না তুলেই উত্তর দিল।
"বললেই হল? আমি পরিষ্কার দেখছি আমার দেয়া রাণীর চোখে মুখে চিন্তা। কী হয়েছে আমায় বল?" বাবা বললেন।
"একটা কনফ্লিক্ট চলছে বাবা মনের মধ্যে।" দেয়া আস্তে আস্তে উত্তর দিল।
"দেবদূত আমায় সব বলেছে। নাচ করতে ভালবাসিস যখন, দাদা নাচ করতে বলছে, কর না। কিচ্ছু অসুবিধে হবে না। আর শোন, কেউ কিছু বললে, আমি আছি তোর সাথে।" বাবার কথায় যেন দেয়া অনেকটা ভরসা পেল।
"ঠিক আছে দেবদা, তুমি ক্যামেরা আনো। আমি নাচ করব। এই এইদিকটায় করি? আলোটা ভালো পাবে। ব্যাকগ্রাউন্ডে ফুলগুলোও দিব্যি মানাবে। বলো?" দেবদূত বোনের উচ্ছ্বাস দেখে অবাক। কে বলবে এই মেয়েটাই অন্য সময় এমন গুটিয়ে থাকে। "বেশ। তাই হবে। তুমি এসো।"
ক্যামেরা তাক করে আলো দেখে সেটিং ঠিকঠাক করল।
দেয়াসিনী ওর মোবাইল থেকে "সৃজন ছন্দে আনন্দে" গানটি চালিয়ে শুরু করল ওর নাচ। দেয়ার বাবা মেয়ের এই অপূর্ব নাচ দেখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইলেন। দেবদূতও মুহূর্তগুলি ক্যামেরা বন্দী করতে করতে মুগ্ধ। প্রিয়স্মিতা যদি মেয়েটির এই প্রতিভার জন্য কিছু করতে পারে, তাহলে খুবই ভালো হয়। ভিডিও তুলে দেবদূত খুব সন্তুষ্ট। অনেকদিন পর।
পরেরদিন ওর ফেরার পালা। ভাই বোন মামা মামীদের ছেড়ে যেতে মন খারাপ লাগবেই। শিগগিরই আবার ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তবে ও গেল। সামনে অনেক কাজ। বোনের জন্য কিছু একটা করতে হবে।
দেবদূত চলে যাওয়ার পর প্রায় মাস খানেক কেটে গিয়েছে। এখন বাড়ির লোকেদের আলোচনার মধ্যে ওর প্রসঙ্গ আসাও প্রায় কমেই গিয়েছে। তবে সকলের সাথে ও নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছে, বিশেষ করে ভাই বোনদের সাথে।
ওদেরকে কলকাতায় ওর বাড়িতে আসার জন্য বারবার বলেছে। ওরা শুধু দিনক্ষণ খুঁজছে। এমন সময় বেশ অপ্রত্যাশিতভাবেই একটা সুযোগ এসে গেল। দেয়াসিনীর নাচের ভিডিওটা প্রিয়স্মিতা ওর নাচের গুরুকে দেখিয়েছিল। গুরুমার সেটা বেশ পছন্দ হয়েছিল। উনি এবারে একটা গ্রুমিং ওয়ার্কশপ আয়োজন করবেন ঠিক করেছেন। সপ্তাহব্যাপী। সেখানে যাতে প্রিয়স্মিতা এই মেয়েটিকে আনতে পারে, উনি বারবার করে বলেছেন। দেবদূত জানে, মামাবাড়িতে সবাই ওকে খুব ভালবাসলেও ওর এই প্রস্তাবে রাজি হবে না কিছুতেই। তাই ঠিক করেছে ভাই বোনেদের কলকাতা ঘোরাবার নাম করে পলাশপুর থেকে যে নিয়ে আসবে, সেটা এই ওয়ার্কশপের সময়েই। সেজো মামা, মানে দেয়ার বাবার সাথে আলাদা করে এই নিয়ে কথাও বলে রেখেছে ও। উনিই আসবেন ওদের সাথে অভিভাবক হয়ে।
আজ সক্কাল সক্কাল ভাই বোনেরা দেয়ার বাবার সাথে রওনা দিল কলকাতার উদ্দেশ্যে। গতকাল রাত্রে যখন প্রায় শুতে যাবে দেয়া, বাবা ঘরে এসে ওকে একটা নতুন কিনে আনা ঘুঙুর দিতে দিতে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "দেয়া রাণী, দুনিয়া জয় করে আয়। আমার সোনা মা।" সারা রাত উত্তেজনায় দেয়ার ঘুম হয়নি। কী আনন্দ। ও নাচ করবে। নাচের প্রশিক্ষণ পাবে। ওর স্বপ্ন সফল হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, বাবার আশীর্বাদ রয়েছে ওর সাথে।
এমন সময়ে এই বাড়ির বড়কর্তা দিব্যকান্তি মিত্র, অর্থাৎ দেয়াসিনীর সবচেয়ে বড় জ্যাঠার নামে এলো একটি চিঠি। বাড়ির মেয়ে, চন্দ্রিমা, যিনি পঁচিশ বছর আগে পরিবারের "মুখ কালো" করে এক ভিন্ন জাতের ছেলেকে ভালোবেসে তার সাথে পালিয়ে বিয়ে করায় ত্যাজ্য কন্যা হন, সম্প্রতি দীর্ঘ রোগভোগের পর মারা গিয়েছেন। ওঁর একমাত্র ছেলে দেবদূত গ্রামের বাড়িতে এসে সকলের সাথে দেখা করতে চায়। চন্দ্রিমা দেবীর ঘটনাটি ঘটে ওঁর বাবা, রামকৃষ্ণ মিত্রের নির্দেশে। পাঁচ ভাইয়ের পর প্রথম বোন চন্দ্রিমা ছিল দাদাদের বড় আদরের। বাবার কথা অমান্য করার "শিক্ষা" কেউই পাননি বলে তাঁরা তখন এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেতে পারেননি। তবে আজ যখন সমস্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিব্যকান্তির হাতে, তিনি দুইবার ভাবলেন না। ভাগ্নেকে সত্বর আসতে বললেন। বাকি সদস্য সদস্যারা অবাক হলেন বটে। তবে স্নেহের টানকে যে উপেক্ষা করা যায় না, এটা ভেবে সবটা মেনে দেবদূতের আগমনের আয়োজন শুরু হল।
এক সপ্তাহ পর দেবদূত এলো পলাশপুর। মামার বাড়ি এসে সে যে খুব বেশি খাতির যত্ন পাবে না, এমনটা জানত। তবুও, ওকে আনতে যে স্টেশনে মামারা লোক পাঠাবেন গাড়ি নিয়ে, সেটা ভাবতেই পারেনি। মায়ের কাছে এই বাড়ির কত গল্প শুনেছে। ছোট থেকে যখন বন্ধুরা ছুটিতে মামাবাড়ি যাওয়ার গল্প করত, মুখ চুন করে থাকত ও। আজ এতগুলো বছর পর যে সেই মামাবাড়িতে আসছে, আলাদাই অনুভূতি। শুধু যদি মা এই দিনটা দেখে যেতে পারত।
দেয়াসিনীর খুব ভালো লেগেছে এই দাদাটিকে। কী শান্ত, শোভন, ভদ্র। ওর চেনা পরিচিত এই বয়সী ছেলেদের চেয়ে অনেক ভালো, অনেক আলাদা। যদিও দেয়ার থেকে দেবদূত প্রায় বছর আটেকে বড়, তবুও দুজনের আলাপটা ভালোই জমেছে। লেখাপড়া, দেশ বিদেশের গল্প শুনতে খুব ভালো লাগে দেয়ার। আর এই দাদাটিও বড় ভালো গল্প করতে পারে। একেবারে মাতিয়ে রাখে।
দেয়াসিনী ওর অন্যান্য ভাই বোনেদের থেকে একটু হলেও আলাদা। বয়স সুলভ কোন প্রগল্ভতা নেই। শান্ত, স্নিগ্ধ। পরিবারের একেবারে "আদর্শ মেয়ে"। একদিন দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর দেয়াসিনী ছাদে বসে চড়াই পাখিদের চাল খাওয়াচ্ছে, এমন সময় পায়ের শব্দে চমকে উঠল। এই সময়ে সচরাচর কেউ এদিকে আসে না। এটা ওর এক্কেবারে নিজস্ব জগত। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে দেবদূত। গলায় ক্যামেরা ঝোলানো। ঠিক বাবাই দাদার ওই বন্ধুটার মতো, যে গতবারে পুজোয় কলকাতা থেকে এসেছিল।
"কী করছ?" হাসি মুখেই জিজ্ঞেস করলো দেবদূত।
দেয়া একটু লজ্জা লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে বলল, "তেমন কিছু না। ওই একটু চড়াইগুলোকে খেতে দিচ্ছি। রোজ এই সময়ে ওদের খেতে দিই। না দিলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলে নেবে।"
দেবদূত বলল, "পাখী ভালোবাসো?"
দেয়া মাথা নাড়ল।
"আর কী কী ভালো লাগে তোমার?" দেবদূত আবার প্রশ্ন করলো।
"আর কী? কিছু না।" দেয়া উত্তর দিল।
দেবদূত নাছোড়বান্দা। আবার প্রশ্ন করলো, "তা তো হয় না দেয়া রাণী। ক্লাস টেনের মেয়ে, শখ আহ্লাদ নেই নাকি? কোন হবি নেই?"
"ওই একটু আধটু মাঝে মাঝে বাড়িতে কেউ না থাকলে বা এমনি দুপুরে ছাদে এসে টুকটাক নাচ করি। দিদিভাই বা বোনুর মতো গানও গাইতে পারি না। আবৃত্তিও পারি না। ওই একটু টিভি দেখে বা স্কুলে যেটুকু বন্ধুদের দেখি, অল্প নাচ পারি।" কথাগুলো বলেই দেয়া জিভ কাটল। বেশ ভয় ভয়েই বলল, "দেবদা, তুমি কিন্তু এই কথাটা বাড়ির কাউকে বলো না প্লিজ। ওরা জানতে পারলে কেলেঙ্কারি হবে।"
"কেলেঙ্কারি? কেন? কীসের কেলেঙ্কারি?" দেবদূত অবাক।
"তুমি জানো না দাদা। নাচ নাকি আমাদের মতো ভদ্রও বাড়ির মেয়েরা করে না। এসব নাকি ধিঙ্গিপনা। দুই বছর আগে স্কুলের ফাংশানে আমায় নাচ করতে ডেকেছিল। সেই নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড। বুড়ি দিদা মানে বাবাদের পিসি, তখন জীবিত ছিলেন। সে কী চিৎকার চেঁচামিচি।" দেয়াসিনী বলল।
"আচ্ছা, তুমি কী নাচ ভালোবাসো? ক্লাসিকাল? নাকি ফিল্ম?" দেবদূত জানতে চাইল।
"আমি সব পারি দাদা। তবে রবীন্দ্রসঙ্গীত আর নজরুলগীতির সাথে বেশি ভালো লাগে।" দেবদূত লক্ষ্য করলো, দেয়ার মুখ চোখে কী অপরিসীম আনন্দ যখন ও নাচের গল্প করছিল। কোন কোন গানের সাথে ও কীভাবে স্টেপ শিখেছে, সব গল্প করতে করতে এ যেন এক অন্য দেয়া। শান্ত নির্জীব মেয়েটির মধ্যেও যে এত প্রাণখোলা ব্যাপার আছে, ওকে আজ না দেখলেই জানতেই পারত না দেবদূত।
কলকাতায় বান্ধবী প্রিয়স্মিতাকে ফোন করে সবটা বলল। প্রিয়স্মিতা নিজেও নাচ করে। রীতিমত স্টেজে প্রচুর মানুষের সামনে শো হয় ওর। ভারতনাট্যম। দেবদূত ওকে বলল, "প্রিয়া, আমার এই বোনটার জন্য কিছু কি করা যায় না?"
প্রিয়স্মিতা খানিক ভেবে বলল, "একটা কাজ করবি? আমায় একটা স্যাম্পেল পাঠাতে পারবি ওর নাচের? দেখি?"
দেবদূত খানিক ভেবে বলল, "দেখ ক্যামেরা সাথেই আছে। দেখি দেয়াকে রাজি করাতে পারি কি না।"
"ওই মিনিট দুই তিনেকের করলেই হবে। তুই দেখ। পাঠা আমায়। দেখছি কী করা যায়।" প্রিয়স্মিতা জানালো।
সেদিন বিকেলে চায়ের আসরের গল্প গুজবের এক ফাঁকে দেবদূত দেয়াকে ডেকে বলল, "শোন, আমার এক বান্ধবী খুব ভালো নাচ করে। আমি ওকে বলেছি তোমার কথা। ও খুব আগ্রহী তোমার নাচ দেখতে। তুমি আমায় তোমার নাচের ভিডিও শুট করতে দেবে প্লিজ?"
দেয়ার তো শুনেই মুখ চোখ ফ্যাকাসে হওয়ার জোগাড়। কোনমতে ফিসফিস করে বলল, "সে কী দেবদা? তা আবার হয় নাকি? বাড়ির লোকজন জানতে পারলে কেলেঙ্কারি।"
"জানবে কী করে? তুমি যেমন ছাদে এসে মাঝে মাঝে নিজের মনে নাচ করো, সেরকম করবে। আমি ভিডিও করে নেবো। কেউ জানতেও পারবে না।" দেবদূত আশ্বস্ত করলো দেয়াকে। দেয়া কথা দিল না।
দেবদূতের বাড়ি ফেরার সময় হয়ে আসছে। দেয়াসিনী এখনও দ্বন্দ্বে। কী করবে? নাচতে তো ও ভালোবাসেই। নাচের ভিডিও দাদাকে করতে দেবে? যদি বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায়? যদি বকা খায়? গেলবারে যা বকুনি দিয়েছিল জেঠু। বাবাও বাঁচাতে পারেনি। বাবা তাও ওর শখ আহ্লাদ নিয়ে ভাবে। কিন্তু জেঠুর সামনে তেমন বলতেও তো পারে না কিছু।
গল্প করে, এদিক ওদিক ঘুরে বেরিয়ে, খাওয়া দাওয়া করে কীভাবে যে দিনগুলো কেটে যায়, খেয়ালই থাকেনা। কাল দেবদূত চলে যাবে। আজ শেষবারের মতো সুযোগ। বারবার বলেছে ও দেয়াকে। দেয়া ছাদের এক কোণে চুপ করে বসে আছে। মন খারাপ। একদিকে মনে হচ্ছে নাচটা করেই ফেলে, আবার আরেকদিকে ভয়। লোক জানাজানির।
হঠাৎ টের পেল, কখন জানি পাশে এসে বসেছে বাবা। আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেবদূত।
"কী ভাবছিস রে দেয়া?" বাবা সস্নেহে জিজ্ঞেস করলেন।
"কই, কিছু না তো।" দেয়া মাথা না তুলেই উত্তর দিল।
"বললেই হল? আমি পরিষ্কার দেখছি আমার দেয়া রাণীর চোখে মুখে চিন্তা। কী হয়েছে আমায় বল?" বাবা বললেন।
"একটা কনফ্লিক্ট চলছে বাবা মনের মধ্যে।" দেয়া আস্তে আস্তে উত্তর দিল।
"দেবদূত আমায় সব বলেছে। নাচ করতে ভালবাসিস যখন, দাদা নাচ করতে বলছে, কর না। কিচ্ছু অসুবিধে হবে না। আর শোন, কেউ কিছু বললে, আমি আছি তোর সাথে।" বাবার কথায় যেন দেয়া অনেকটা ভরসা পেল।
"ঠিক আছে দেবদা, তুমি ক্যামেরা আনো। আমি নাচ করব। এই এইদিকটায় করি? আলোটা ভালো পাবে। ব্যাকগ্রাউন্ডে ফুলগুলোও দিব্যি মানাবে। বলো?" দেবদূত বোনের উচ্ছ্বাস দেখে অবাক। কে বলবে এই মেয়েটাই অন্য সময় এমন গুটিয়ে থাকে। "বেশ। তাই হবে। তুমি এসো।"
ক্যামেরা তাক করে আলো দেখে সেটিং ঠিকঠাক করল।
দেয়াসিনী ওর মোবাইল থেকে "সৃজন ছন্দে আনন্দে" গানটি চালিয়ে শুরু করল ওর নাচ। দেয়ার বাবা মেয়ের এই অপূর্ব নাচ দেখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইলেন। দেবদূতও মুহূর্তগুলি ক্যামেরা বন্দী করতে করতে মুগ্ধ। প্রিয়স্মিতা যদি মেয়েটির এই প্রতিভার জন্য কিছু করতে পারে, তাহলে খুবই ভালো হয়। ভিডিও তুলে দেবদূত খুব সন্তুষ্ট। অনেকদিন পর।
পরেরদিন ওর ফেরার পালা। ভাই বোন মামা মামীদের ছেড়ে যেতে মন খারাপ লাগবেই। শিগগিরই আবার ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তবে ও গেল। সামনে অনেক কাজ। বোনের জন্য কিছু একটা করতে হবে।
দেবদূত চলে যাওয়ার পর প্রায় মাস খানেক কেটে গিয়েছে। এখন বাড়ির লোকেদের আলোচনার মধ্যে ওর প্রসঙ্গ আসাও প্রায় কমেই গিয়েছে। তবে সকলের সাথে ও নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছে, বিশেষ করে ভাই বোনদের সাথে।
ওদেরকে কলকাতায় ওর বাড়িতে আসার জন্য বারবার বলেছে। ওরা শুধু দিনক্ষণ খুঁজছে। এমন সময় বেশ অপ্রত্যাশিতভাবেই একটা সুযোগ এসে গেল। দেয়াসিনীর নাচের ভিডিওটা প্রিয়স্মিতা ওর নাচের গুরুকে দেখিয়েছিল। গুরুমার সেটা বেশ পছন্দ হয়েছিল। উনি এবারে একটা গ্রুমিং ওয়ার্কশপ আয়োজন করবেন ঠিক করেছেন। সপ্তাহব্যাপী। সেখানে যাতে প্রিয়স্মিতা এই মেয়েটিকে আনতে পারে, উনি বারবার করে বলেছেন। দেবদূত জানে, মামাবাড়িতে সবাই ওকে খুব ভালবাসলেও ওর এই প্রস্তাবে রাজি হবে না কিছুতেই। তাই ঠিক করেছে ভাই বোনেদের কলকাতা ঘোরাবার নাম করে পলাশপুর থেকে যে নিয়ে আসবে, সেটা এই ওয়ার্কশপের সময়েই। সেজো মামা, মানে দেয়ার বাবার সাথে আলাদা করে এই নিয়ে কথাও বলে রেখেছে ও। উনিই আসবেন ওদের সাথে অভিভাবক হয়ে।
আজ সক্কাল সক্কাল ভাই বোনেরা দেয়ার বাবার সাথে রওনা দিল কলকাতার উদ্দেশ্যে। গতকাল রাত্রে যখন প্রায় শুতে যাবে দেয়া, বাবা ঘরে এসে ওকে একটা নতুন কিনে আনা ঘুঙুর দিতে দিতে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "দেয়া রাণী, দুনিয়া জয় করে আয়। আমার সোনা মা।" সারা রাত উত্তেজনায় দেয়ার ঘুম হয়নি। কী আনন্দ। ও নাচ করবে। নাচের প্রশিক্ষণ পাবে। ওর স্বপ্ন সফল হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, বাবার আশীর্বাদ রয়েছে ওর সাথে।
Friday, November 23, 2018
সিরিয়ালঃ সিরিয়াসলি নেবেন না (লাস্ট)
#সিরিয়ালঃসিরিয়াসলি_নেবেন_না
ইয়ে মানে ইচ্ছে ছিল বেশ জমাটি একটা কমপ্লিকেটেড স্ক্রিপ্ট লিখব। খানিকটা এরকমঃ
সুপর্ণা শ্রীপর্ণার মধ্যে ঝামেলা টামেলা হবে কে রণিতকে নিজের জামাই বানাবে বলে। এই সব করতে গিয়ে শ্রীপর্ণা আবার আদিত্যর সাথে এক্সট্রা মারিটাল করবে।
রণিতের "দিভ্যা" এদিকে হঠাৎ কী করে অসুস্থ হবে। (সে বাই দি ওয়ে রণিতের বাগদত্তা) আই সি ইউ তে থাকবে। হসপিটালে। সেই হসপিটালের রিসেপশনিস্ট আবার ওই দ্বিতীয় পর্বের "অনামিকা" (আচ্ছা বেশ, ওর নামই না হয় অনামিকা হোক)। অনামিকা দেখবে রণিত দিভ্যাকে কত ভালোবাসে। সেবা যত্ন করে (আই সি ইউ তে পেশেন্ট পার্টি এমন ২৪ ঘণ্টা থাকে কি? কে জানে?)। মুগ্ধ হয়ে যাবে। রণিতকে সাপোর্ট করতে যাবে ইমোশনালি। সেই করতে গিয়ে এখন রণিতের প্রেমে হাবুডুবু খাবে।
প্রচুর যোগা খিচুরি। (অত লেখার ধৈর্য নেই। সত্যি বলছি।)
তারপর হঠাৎ "দশ বছর পর, মেগা এপিসোড"।
সেখানে দেখা যাবে
১। বুবাইয়ের সাথে রণিতের সেই আই সি ইউ বান্ধবী দিভ্যার বিয়ে হয়ে আছে। ওদের যমজ বাচ্চা আছে দুটো।
২। বিট্টুর সাথে সেই ডেলিভারি বয়ের এনগেজমেন্ট হচ্ছে। সে ছোকরা এখন আমাজনে টেকনিকাল স্পেশালিষ্ট। পড়ার খরচ চালাতে ডেলিভারির কাজ করত।
৩। বুবাইয়ের লিভিং পার্টনার অনামিকা।
৪। আদিত্য আর সুপর্ণা একসাথেই থাকে। সপ্তাহে পাঁচদিন। উইকেন্ড কাটাতে অবশ্য শ্রীপর্ণা ওদের জয়েন করে। ওর মেয়ে মুন্নি (নাকি মুনিয়া, কী নাম ছিল জানি?) আসলে জানা যাবে আদিত্যর মেয়ে। তাই শ্রীপর্ণা মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য বাপকে দায়িত্ব নিতে বলবে।
এরা সবাই ফ্যামিলি ভেকেশনে মালয়শিয়া এসেছে (এয়ার এশিয়ায় সস্তায় টিকিট পেয়েছিল, কী করবে) । একটা রিসোর্টে একসাথে খানা পিনা চলছে।
ম্যানেজার আসবে কিছু জিজ্ঞেস করতে আদিত্যকে। সুপুরুষ, স্মার্ট, ইয়োং।
তার কথা থামিয়ে আদিত্য ওকে বলবে, "ইয়ং ম্যান, আর ইউ ম্যারিড?"
সে অবাক হয়ে বলবে, "নো স্যর।"
আদিত্যঃ বেশ। তুমি তাহলে আমার জামাই হবে। সি দ্যাট প্রিটি লেডি ইন পিঙ্ক? (মুন্নির দিকে পয়েন্ট করবে। মুন্নি কেন কে জানে পুলের ধারে পিঙ্ক লেহেঙ্গা পরে বসে আছে।) ম্যারি হার।
শ্রীপর্ণা আনন্দে ঢলে পড়বে আদিত্যর গায়ে। সুপর্ণাকে দেখা যাবে চেক-আউট করছে পাশের টেবিলে একটা সল্ট অ্যান্ড পেপার হেয়ার, দারুণ দেখতে, মাঝ বয়সী ভদ্রলোকের দিকে।
And they all lived happily ever after...(শিগগিরই টিভির পর্দায় অন্য কোন সিরিয়ালে আবার এদের সাথে দেখা হবে।)
ইয়ে মানে ইচ্ছে ছিল বেশ জমাটি একটা কমপ্লিকেটেড স্ক্রিপ্ট লিখব। খানিকটা এরকমঃ
সুপর্ণা শ্রীপর্ণার মধ্যে ঝামেলা টামেলা হবে কে রণিতকে নিজের জামাই বানাবে বলে। এই সব করতে গিয়ে শ্রীপর্ণা আবার আদিত্যর সাথে এক্সট্রা মারিটাল করবে।
রণিতের "দিভ্যা" এদিকে হঠাৎ কী করে অসুস্থ হবে। (সে বাই দি ওয়ে রণিতের বাগদত্তা) আই সি ইউ তে থাকবে। হসপিটালে। সেই হসপিটালের রিসেপশনিস্ট আবার ওই দ্বিতীয় পর্বের "অনামিকা" (আচ্ছা বেশ, ওর নামই না হয় অনামিকা হোক)। অনামিকা দেখবে রণিত দিভ্যাকে কত ভালোবাসে। সেবা যত্ন করে (আই সি ইউ তে পেশেন্ট পার্টি এমন ২৪ ঘণ্টা থাকে কি? কে জানে?)। মুগ্ধ হয়ে যাবে। রণিতকে সাপোর্ট করতে যাবে ইমোশনালি। সেই করতে গিয়ে এখন রণিতের প্রেমে হাবুডুবু খাবে।
প্রচুর যোগা খিচুরি। (অত লেখার ধৈর্য নেই। সত্যি বলছি।)
তারপর হঠাৎ "দশ বছর পর, মেগা এপিসোড"।
সেখানে দেখা যাবে
১। বুবাইয়ের সাথে রণিতের সেই আই সি ইউ বান্ধবী দিভ্যার বিয়ে হয়ে আছে। ওদের যমজ বাচ্চা আছে দুটো।
২। বিট্টুর সাথে সেই ডেলিভারি বয়ের এনগেজমেন্ট হচ্ছে। সে ছোকরা এখন আমাজনে টেকনিকাল স্পেশালিষ্ট। পড়ার খরচ চালাতে ডেলিভারির কাজ করত।
৩। বুবাইয়ের লিভিং পার্টনার অনামিকা।
৪। আদিত্য আর সুপর্ণা একসাথেই থাকে। সপ্তাহে পাঁচদিন। উইকেন্ড কাটাতে অবশ্য শ্রীপর্ণা ওদের জয়েন করে। ওর মেয়ে মুন্নি (নাকি মুনিয়া, কী নাম ছিল জানি?) আসলে জানা যাবে আদিত্যর মেয়ে। তাই শ্রীপর্ণা মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য বাপকে দায়িত্ব নিতে বলবে।
এরা সবাই ফ্যামিলি ভেকেশনে মালয়শিয়া এসেছে (এয়ার এশিয়ায় সস্তায় টিকিট পেয়েছিল, কী করবে) । একটা রিসোর্টে একসাথে খানা পিনা চলছে।
ম্যানেজার আসবে কিছু জিজ্ঞেস করতে আদিত্যকে। সুপুরুষ, স্মার্ট, ইয়োং।
তার কথা থামিয়ে আদিত্য ওকে বলবে, "ইয়ং ম্যান, আর ইউ ম্যারিড?"
সে অবাক হয়ে বলবে, "নো স্যর।"
আদিত্যঃ বেশ। তুমি তাহলে আমার জামাই হবে। সি দ্যাট প্রিটি লেডি ইন পিঙ্ক? (মুন্নির দিকে পয়েন্ট করবে। মুন্নি কেন কে জানে পুলের ধারে পিঙ্ক লেহেঙ্গা পরে বসে আছে।) ম্যারি হার।
শ্রীপর্ণা আনন্দে ঢলে পড়বে আদিত্যর গায়ে। সুপর্ণাকে দেখা যাবে চেক-আউট করছে পাশের টেবিলে একটা সল্ট অ্যান্ড পেপার হেয়ার, দারুণ দেখতে, মাঝ বয়সী ভদ্রলোকের দিকে।
And they all lived happily ever after...(শিগগিরই টিভির পর্দায় অন্য কোন সিরিয়ালে আবার এদের সাথে দেখা হবে।)
সিরিয়াল সিরিয়াসলি নেবেন না ৩
৩।
কলিং বেল শুনে বিট্টু দৌড়ে গেল দরজা খুলতে।
"কে এলো রে? গেস্ট লিস্ট থেকে তো আর কারুর বাকি নেই আসার?" একটু অবাক হয়েই ইনিয়ে বিনিয়ে সুপর্ণা মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো। রাত্তির দশটা বাজে। ড্রয়িং রুমের ঘড়িতে বেশ একটা অ্যান্টিক গ্র্যান্ডফাদার ক্লকে ক্যামেরা ফোকাস করবে, ঢং ঢং করে আওয়াজ হবে।
"নির্ঘাত ক্যাটারিং এর ছেলেটা। দাঁড়াও না, ফোন করলে রিসিভ করবে না, বড্ড বেশি বাড় বেড়েছে এদের। আমায় চটিয়ে পার পেয়ে যাওয়া সহজ না। ওর ব্যবসা বন্ধ করে দেবো আমি। Just wait and watch... (বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে পজ দিতে দিতে এরই মধ্যে পঞ্চাশ বার আঁচল ঠিক করতে করতে বিট্টু বলবে)।
"বিট্টু মাথা গরম করিস না মাম্মা, এত নিমন্ত্রিত লোকজন বাড়িতে, এখনই একটা সিন ক্রিয়েট না করলেই নয়? প্লিজ সোনা..." সুপর্ণা মেয়ের কাঁধে হাত রেখে মেয়ের মেজাজ ঠাণ্ডা করতে চেয়ে বলে।
বিট্টু দরজার দিকে এগোয়। যাওয়ার পথে usual party scene cross করে। অনেক মহিলারা ওর দিকে তাকিয়ে হাসলও (অবশ্যই ঈর্ষান্বিত হাসি)। এই এরাই আগামী কিছুদিনের মধ্যেই কিটি পার্টিতে বিট্টুর সাহসী পোশাকের ব্যাপারে মুখরোচক গল্প করবে।
বেল বাজল দ্বিতীয়বার।
খুব বিরক্ত মুখ করে বিট্টু এগিয়ে চলবে।
"আরে আসছি।" চিৎকার করে বলবে ও।
দরজা খুলেই আবার চিৎকার। "নিজেরা এত্ত লেট করে আসার বেলায় কিছু না, আর এখন এরকম অসভ্যদের মতো বারবার বেল বাজাচ্ছেন যে?"
দরজার ওপারে দেখা যাবে রণিতকে। বেশ একটা হকচকিয়ে গিয়েছে। ওর পিছনে ডেলিভারি বয় গোছের কেউ। রোগা পটকা, চুল উসকো খুস্কো, হাতে পায়ে কাদা মাখামাখি প্রায়। জামাতেও ওরকমই কিছু। দুজএন্র হাত ভর্তি বড় বড় প্যাকেট/বাসন...
রণিতঃ ম্যাডাম আপনি যা ভাবছেন তা না।
বিট্টুঃ চুপ করুন। একদম মুখে মুখে তর্ক করতে আসবেন না (আঙ্গুল তুলে, বেশ চোখ টোখ পাকিয়ে)। রাত্তির দশটা বেজে গিয়েছে। অর্ডার ডেলিভারির সময় কটা ছিল, খেয়াল আছে?
রণিতঃও ম্যাডাম, শুনুন না। বলছি যে...
বিট্টূঃ চুপ। একদম চুপ। (বেশ জমকালো কান ঝালাপালা করা মিউজিক চাই) আপনার সুপারভাইজারের সাথে কথা বলে নেবো আমি। আপনার মতো দু পয়সার এমপ্লয়ীর সাথে কথা বলা না, আমার ইমেজের সাথে যায় না। বুঝেছেন? যতসব ইনএফিশিয়েন্ট ইউজলেস ডেলিভারি বয় পাঠায়।
ইতিমধ্যে "কে রে মা? কী হয়েছে?" বলতে বলতে আদিত্য বাবু চলে আসেন। বিট্টূ ন্যাকা/রাগী মুখ করে প্রচুর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, "বাবা দেখো না, কেটারিং এর লোকগুলো দেরি করে এসেছে। এদিকে এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন কী না কী।"
আদিত্যঃ কই দেখি?
রণিতঃ আঙ্কল, অ্যাকচুয়ালি আমি কেটারিং এর স্টাফ নই। সেটা ও। (পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে দেখায় আঙ্গুল দিয়ে)
আদিত্যঃ তুমি কেটারিং এর না?
রণিতঃ না।
আদিত্যঃ তাহলে তোমার হাতে এই এত্ত এত্ত প্যাকেট কীসের?
রণিতঃ সেটাই তো তখন তো বলতে চাইছই। ম্যাডাম কথাটা কমপ্লিট করতে দিলে তো?
বিট্টূঃ বাবা why are you wasting your time on him?
আদিত্যঃ আরে দাঁড়া না, বুঝতে ডে আমায় ব্যাপারটা। পুরোটা শুনতে ডে। হ্যাঁ তা বাবা, বলো তো কী বলছিলে? (রণিতের দিকে তাকিয়ে)
বিট্টূ বেশ বিরক্ত মুখ করে "যতসব ন্যাকামি" বলে চলে গেল একটু দূরে।
রণিতঃ আঙ্কল, আমার নাম রণিত। রণিত গাঙ্গুলি। আমি একজন অন্ত্রেপ্রেনিউর। কিছু মাস হল ইউ এস থেকে ইন্ডিয়া ফিরেছি (ইতিমধ্যে আশে পাশে শ্রীপর্ণা সুপর্ণা দুজনেই হাজির। ইউ ফেরত শুনে দুজনেরই চোখ চকচক করছে। দুজনেরই যে বিবাহযোগ্যা কন্যা আছে) আমি এক জায়গায় যাচ্ছিলাম ড্রাইভ করে। তখন এই ছেলেটির সাথে দেখা হল। রাদার, ওর বাইক স্কিড করে এক্কেবারে আমার গাড়ির সামনে এসে পড়ল। he was panicking, and yeah, so was I (বেশ নার্ভাস হাসি হেসে বলল)... ও বলল ওর কোথায় খাবার পৌঁছনর কথা। দেরি হয়ে যাওয়ায় স্পিডে বাইক চালাতে গিয়েই এই বিপত্তি। আমি ওকে আস্তে আস্তে টেনে তুললাম। বাইকটা চালানোর মতো কন্ডিশনে ছিল না। সাইড করে ওকে গাড়িতে নিয়ে আমি ফার্স্ট এড দিইয়ে তারপর এখানে এলাম।
আদিত্যঃ ওহো। এই রে। খুব খারাপ খুব খারাপ। (ছেলেটির দিকে তাকিয়ে) বাবা তোমার তো বেশ ইনজুরি দেখছি। শোনো, (ওয়ালেট বের করে, সেখান থেকে এক তাড়া নোট বের করে) এই টাকাটা ধরো। চিকিৎসা করিয়ো। ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি যেয়ো।
আদিত্য বাবু ভিতর দিকে মুখ ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে বললঃ এই বুবাই? বিট্টূ? এদিকে এসে খাবার গুলও নিয়ে যা প্লিজ।
রণিতের দিকে মুখ ঘুরিয়ে এবার বললেন, "বাবা রণিত, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।তোমার সাথে আলাপ করতে হবে গুছিয়ে। এসো না। we are having a aprty tonight, to celebrate my anniversary. Why don't you join us for dinner?"
রণিতঃ It's okay uncle. Happy anniversary uncle aunty.. But some other time..আমি একটা অন্য পার্টিতে যাচ্ছিলাম। ওখানে সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সো...
আদিত্যঃ তা হয় নাকি?
রণিতঃ না আঙ্কল, আমি সত্যিই পারবো না আজ।
বিট্টূ পাশ থেকে এসে বিরক্ত মুখ করে তাকাবে রণিতের দিকে। যদিও এমন সুপুরুষের প্রতি একটু কৌতূহলও হবে। কে এ?
আদিত্যঃ বেশ। কাল তাহলে আমাদের সাথে লাঞ্চ করো? ফ্রি আছো?
রণিতঃ সামনের সপ্তাহে কোন এক দিন হোক?
আদিত্যঃ শিয়োর।
রণিতের পিঠ চাপড়ে আদিত্য ওকে বিদায় জানালেন। রণিতের মুখে হাসি। বিট্টু অবাক।
শ্রীপর্ণা আর সুপর্ণা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।
"কে রে দিদি? কী হ্যান্ডসাম... (মনে মনে ভাবছে, "আমার মুনিয়ার সাথে দারুণ মানাবে।")
সুপর্ণাঃ হুম। খোঁজ নিতে হবে (মনে মনে ভাববে, "দারুণ শাঁসালো মনে হচ্ছে। বিট্টুর সাথে তো এমন জন কেই মানায়।")
(অদ্ভুত ভ্যাম্প মিউকিজ বাজবে ব্যাকগ্রাউন্ডে। আস্তে আস্তে জুম আউট করবে ক্যামেরা। লাইটস বোকে এফেক্ট হবে। তারপর স্ক্রিন ফ্রিজ)
কলিং বেল শুনে বিট্টু দৌড়ে গেল দরজা খুলতে।
"কে এলো রে? গেস্ট লিস্ট থেকে তো আর কারুর বাকি নেই আসার?" একটু অবাক হয়েই ইনিয়ে বিনিয়ে সুপর্ণা মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো। রাত্তির দশটা বাজে। ড্রয়িং রুমের ঘড়িতে বেশ একটা অ্যান্টিক গ্র্যান্ডফাদার ক্লকে ক্যামেরা ফোকাস করবে, ঢং ঢং করে আওয়াজ হবে।
"নির্ঘাত ক্যাটারিং এর ছেলেটা। দাঁড়াও না, ফোন করলে রিসিভ করবে না, বড্ড বেশি বাড় বেড়েছে এদের। আমায় চটিয়ে পার পেয়ে যাওয়া সহজ না। ওর ব্যবসা বন্ধ করে দেবো আমি। Just wait and watch... (বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে পজ দিতে দিতে এরই মধ্যে পঞ্চাশ বার আঁচল ঠিক করতে করতে বিট্টু বলবে)।
"বিট্টু মাথা গরম করিস না মাম্মা, এত নিমন্ত্রিত লোকজন বাড়িতে, এখনই একটা সিন ক্রিয়েট না করলেই নয়? প্লিজ সোনা..." সুপর্ণা মেয়ের কাঁধে হাত রেখে মেয়ের মেজাজ ঠাণ্ডা করতে চেয়ে বলে।
বিট্টু দরজার দিকে এগোয়। যাওয়ার পথে usual party scene cross করে। অনেক মহিলারা ওর দিকে তাকিয়ে হাসলও (অবশ্যই ঈর্ষান্বিত হাসি)। এই এরাই আগামী কিছুদিনের মধ্যেই কিটি পার্টিতে বিট্টুর সাহসী পোশাকের ব্যাপারে মুখরোচক গল্প করবে।
বেল বাজল দ্বিতীয়বার।
খুব বিরক্ত মুখ করে বিট্টু এগিয়ে চলবে।
"আরে আসছি।" চিৎকার করে বলবে ও।
দরজা খুলেই আবার চিৎকার। "নিজেরা এত্ত লেট করে আসার বেলায় কিছু না, আর এখন এরকম অসভ্যদের মতো বারবার বেল বাজাচ্ছেন যে?"
দরজার ওপারে দেখা যাবে রণিতকে। বেশ একটা হকচকিয়ে গিয়েছে। ওর পিছনে ডেলিভারি বয় গোছের কেউ। রোগা পটকা, চুল উসকো খুস্কো, হাতে পায়ে কাদা মাখামাখি প্রায়। জামাতেও ওরকমই কিছু। দুজএন্র হাত ভর্তি বড় বড় প্যাকেট/বাসন...
রণিতঃ ম্যাডাম আপনি যা ভাবছেন তা না।
বিট্টুঃ চুপ করুন। একদম মুখে মুখে তর্ক করতে আসবেন না (আঙ্গুল তুলে, বেশ চোখ টোখ পাকিয়ে)। রাত্তির দশটা বেজে গিয়েছে। অর্ডার ডেলিভারির সময় কটা ছিল, খেয়াল আছে?
রণিতঃও ম্যাডাম, শুনুন না। বলছি যে...
বিট্টূঃ চুপ। একদম চুপ। (বেশ জমকালো কান ঝালাপালা করা মিউজিক চাই) আপনার সুপারভাইজারের সাথে কথা বলে নেবো আমি। আপনার মতো দু পয়সার এমপ্লয়ীর সাথে কথা বলা না, আমার ইমেজের সাথে যায় না। বুঝেছেন? যতসব ইনএফিশিয়েন্ট ইউজলেস ডেলিভারি বয় পাঠায়।
ইতিমধ্যে "কে রে মা? কী হয়েছে?" বলতে বলতে আদিত্য বাবু চলে আসেন। বিট্টূ ন্যাকা/রাগী মুখ করে প্রচুর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, "বাবা দেখো না, কেটারিং এর লোকগুলো দেরি করে এসেছে। এদিকে এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন কী না কী।"
আদিত্যঃ কই দেখি?
রণিতঃ আঙ্কল, অ্যাকচুয়ালি আমি কেটারিং এর স্টাফ নই। সেটা ও। (পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে দেখায় আঙ্গুল দিয়ে)
আদিত্যঃ তুমি কেটারিং এর না?
রণিতঃ না।
আদিত্যঃ তাহলে তোমার হাতে এই এত্ত এত্ত প্যাকেট কীসের?
রণিতঃ সেটাই তো তখন তো বলতে চাইছই। ম্যাডাম কথাটা কমপ্লিট করতে দিলে তো?
বিট্টূঃ বাবা why are you wasting your time on him?
আদিত্যঃ আরে দাঁড়া না, বুঝতে ডে আমায় ব্যাপারটা। পুরোটা শুনতে ডে। হ্যাঁ তা বাবা, বলো তো কী বলছিলে? (রণিতের দিকে তাকিয়ে)
বিট্টূ বেশ বিরক্ত মুখ করে "যতসব ন্যাকামি" বলে চলে গেল একটু দূরে।
রণিতঃ আঙ্কল, আমার নাম রণিত। রণিত গাঙ্গুলি। আমি একজন অন্ত্রেপ্রেনিউর। কিছু মাস হল ইউ এস থেকে ইন্ডিয়া ফিরেছি (ইতিমধ্যে আশে পাশে শ্রীপর্ণা সুপর্ণা দুজনেই হাজির। ইউ ফেরত শুনে দুজনেরই চোখ চকচক করছে। দুজনেরই যে বিবাহযোগ্যা কন্যা আছে) আমি এক জায়গায় যাচ্ছিলাম ড্রাইভ করে। তখন এই ছেলেটির সাথে দেখা হল। রাদার, ওর বাইক স্কিড করে এক্কেবারে আমার গাড়ির সামনে এসে পড়ল। he was panicking, and yeah, so was I (বেশ নার্ভাস হাসি হেসে বলল)... ও বলল ওর কোথায় খাবার পৌঁছনর কথা। দেরি হয়ে যাওয়ায় স্পিডে বাইক চালাতে গিয়েই এই বিপত্তি। আমি ওকে আস্তে আস্তে টেনে তুললাম। বাইকটা চালানোর মতো কন্ডিশনে ছিল না। সাইড করে ওকে গাড়িতে নিয়ে আমি ফার্স্ট এড দিইয়ে তারপর এখানে এলাম।
আদিত্যঃ ওহো। এই রে। খুব খারাপ খুব খারাপ। (ছেলেটির দিকে তাকিয়ে) বাবা তোমার তো বেশ ইনজুরি দেখছি। শোনো, (ওয়ালেট বের করে, সেখান থেকে এক তাড়া নোট বের করে) এই টাকাটা ধরো। চিকিৎসা করিয়ো। ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি যেয়ো।
আদিত্য বাবু ভিতর দিকে মুখ ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে বললঃ এই বুবাই? বিট্টূ? এদিকে এসে খাবার গুলও নিয়ে যা প্লিজ।
রণিতের দিকে মুখ ঘুরিয়ে এবার বললেন, "বাবা রণিত, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।তোমার সাথে আলাপ করতে হবে গুছিয়ে। এসো না। we are having a aprty tonight, to celebrate my anniversary. Why don't you join us for dinner?"
রণিতঃ It's okay uncle. Happy anniversary uncle aunty.. But some other time..আমি একটা অন্য পার্টিতে যাচ্ছিলাম। ওখানে সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সো...
আদিত্যঃ তা হয় নাকি?
রণিতঃ না আঙ্কল, আমি সত্যিই পারবো না আজ।
বিট্টূ পাশ থেকে এসে বিরক্ত মুখ করে তাকাবে রণিতের দিকে। যদিও এমন সুপুরুষের প্রতি একটু কৌতূহলও হবে। কে এ?
আদিত্যঃ বেশ। কাল তাহলে আমাদের সাথে লাঞ্চ করো? ফ্রি আছো?
রণিতঃ সামনের সপ্তাহে কোন এক দিন হোক?
আদিত্যঃ শিয়োর।
রণিতের পিঠ চাপড়ে আদিত্য ওকে বিদায় জানালেন। রণিতের মুখে হাসি। বিট্টু অবাক।
শ্রীপর্ণা আর সুপর্ণা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।
"কে রে দিদি? কী হ্যান্ডসাম... (মনে মনে ভাবছে, "আমার মুনিয়ার সাথে দারুণ মানাবে।")
সুপর্ণাঃ হুম। খোঁজ নিতে হবে (মনে মনে ভাববে, "দারুণ শাঁসালো মনে হচ্ছে। বিট্টুর সাথে তো এমন জন কেই মানায়।")
(অদ্ভুত ভ্যাম্প মিউকিজ বাজবে ব্যাকগ্রাউন্ডে। আস্তে আস্তে জুম আউট করবে ক্যামেরা। লাইটস বোকে এফেক্ট হবে। তারপর স্ক্রিন ফ্রিজ)
Thursday, November 22, 2018
সিরিয়ালঃ সিরিয়াসলি নেবেন না ২
২।
শহরের কোন ব্যস্ত রাস্তা। বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। বেশ দামী একটা গাড়ি চালাচ্ছে বছর সাতাশ আঠাশের এক সুপুরুষ যুবা। পরনে দামী সুট। টিপটাপ, ফিটফাট। বোঝাই যাচ্ছে এবশ ভালোই উপভোগ করছে ড্রাইভটা। মুখে চোখে এতটুকুও বিরক্তি নেই। বরং মাঝে মাঝেই মুখ হাসি হাসি হচ্ছে। গাড়িতে রেডিওতে চলছে কিছু পপুলার বাংলা রোমান্টিক গান। (মাঝে মাঝে এক মোহময়ী নারী কণ্ঠের আরজের গলা শোনা যাচ্ছে। keywords শোনা যাচ্ছে "প্রেম", "বৃষ্টি", "ট্রাফিক জ্যাম" ইত্যাদি।) গুনগুন করে গলা মেলাতেও দেখা যাচ্ছে ছেলেটিকে। পাশে বসে এক যুবতী। পরনে সাধারণ সিন্থেটিক শাড়ি। কোন গয়নার দোকান বা আধুনিক বেসরকারি হসপিটালের ইউনিফর্মের মতো। চেহারা (ওই মেক আপ আর কী) দেখেই বোঝা যায় মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। হাতে একটা ঢাউস খয়েরি ব্যাগ। অনেকক্ষণ ধরেই গাড়ির জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে। এমন সময়ে একটা সিগনালে গাড়িটা এসে থমকালো।
"কী ভালো weather, না?" সহযাত্রীর দিকে তাকিয়ে যুবকটি বলল।
যুবতী মুখ ফেরালো। স্মিত হাসি হাসল। আবার মুখ ঘুরিয়ে বলল, "আপনাদের যাদের লাক্সারি করার সুযোগ আছে, ঝড় বৃষ্টির মধ্যে কাদা জল জমার মধ্যে দিয়ে হেঁটে দিনের পর দিন চলাফেরা করে বা ভিড় বাসে চিঁরে চ্যাপ্টা হয়ে কাজে যাওয়া আসা করতে হয় না, তাঁদের জন্য তো এমন ওয়েদার খুব ভালো। কী সুন্দর কাব্য করতে পারেন, গান গাইতে পারেন। কফি কাপ হাতে জানালর ধারে বসে ব্যাঙের ডাক শুনতে পারেন..."
যুবকটি কিছু একটা বলতে গিয়েও খানিক থেমে গেল। মাথাটা একটা "বড্ড স্টিরিওটাইপ করো" গোছের মুখ করে বলল, " আপনি এত সিনিকাল কেন বলুন তো?"
যুবতী এবার যুবকের চোখে চোখ রেখে বলল, "আপনি বুঝবেন না। অভিজ্ঞতা নেই তো, তাই। তবে আপনার দোষ নেই। যে যেমন কপাল নিয়ে জন্মায়।"
যুবকঃ তা যা বলেছেন। সবই ফেট, সবই ডেস্টিনি।
যুবতীঃ হ্যাঁ। একদিন এমন বর্ষার মধ্যে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে গোটা দিন যাতায়াত করুন, বুঝে যাবেন আমরা যারা মিডল ক্লাস, কীভাবে দিন যাপন করি। রোজদিন বা সকলের তো এমন সৌভাগ্য হয় না যে আপানর কাছ থেকে লিফট পাবে।"
যুবক বলতে লাগল, "মে বি... আসলে দশ বছর পর আমি ইন্ডিয়ায় ফিরেছি এই কিছু সপ্তাহ আগে। (ছেলেটির ইংরেজি, বিশেষ করে উচ্চারণ অত্যন্ত ঝরঝরে হওয়া উচিত। প্রয়োজনে অ্যাক্সেন্ট থাকা উচিত। অথচ অভিনেতার ইংরেজিতে পরিষ্কার বাংলার টান বোঝা যাবে আহা,কী মাটির মানুষ!!) তার আগেস্কুল ট্যুশন যাতায়াত গাড়িতেই করেছি। সো মে বি।। এনিওয়ে...
"ওই সামনের মোড়ে আমায় নামিয়ে দেবেন প্লিজ। পরের সিগনালটার আগে..." যুবতী কথা থামিয়ে দিয়ে বলল।
যুবকটি একটু অবাক মুখ করে বলল, "সে কী? রাগ করলেন নাকি?"
"আরে না না। ও মা, সে কী কথা। আমার বাড়ি ওইদিকে। একটু টুকটাক বাজার করে ঢুকব। বাবার জ্বর হয়েছে। ভাইয়ের ফিরতে দেরিয়া ছে। আমি এখন বাজার না করে এলে মা রাঁধতে পারবে না। তাই..." বলল যুবতী।
যুবকটি একটা অদ্ভুত ভ্যাবাচ্যাকা গোছের মুখ করে বলল, "বেশ"।
গাড়িটা চলছে। পাশ দিয়ে অন্য গাড়ি বাইক ইত্যাদি সব চলছে। রেডিওতে গান বেজেই চলেছে। আলাদা করে আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দরকার নেই। খানিক দূর যাওয়ার পর গাড়িটাকে রাস্তার বাঁ দিক করে থামাল যুবক।
যুবতী সিট বেল্ট খুলতে খুলতে বলল, "আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ জানাবো? আমার অনেক উপকার করলেন। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে বাস অটো কিচ্ছু পাচ্ছিলাম না। বড্ড মুস্কিলে পড়ে গিয়েছিলাম।"
যুবকঃ দ্যাটস ওকে।
যুবতী (হেসে): আসি।
যুবকঃ ভালো থাকবেন। নমস্কার।
যুবতী গাড়ি থেকে নেমে গেল। দরজা বন্ধ করছিল, যুবকটি একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলল, " ও বাই দি ওয়ে, আমার নাম রণিত। রণিত গাঙ্গুলি।"
যুবতী হাসল। হাসলে খুব সুন্দর টোল পড়ে বাঁ গালে। তারপর পিছন ফিরে চলে গেল। রণিত একটু বোকা বোকা হাসি হেসে মাথার চুল ঠিক করতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে মোবাইল ফোন বেজে উঠল (খেয়াল রাখতে হবে, স্পেসিফিকালি, আইফোনের রিং টোন)। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে, "Mom calling"। হাসি হাসি মুখেই মাথাটা একটু সবজান্তা বেড়ে পাকা অথচ ক্যাবলা মার্কা মাথা নেড়ে ফোন রিসিভ করেই বলল, "ইয়েস মম, অন মাই ওয়ে, আসছি। পার্টি জমে গিয়েছে তো?"
ওপর প্রান্ত থেকে একটা চাপা গলার স্বর শোনা যাবে। কোন তরুণীর। "হু মম? রণিত, দিস ইজ দিভ্যা (খেয়াল রাখবেন উচ্চারণে। দি-vi-য়া)। আমি নেহাত auntyর থেকে ফোনটা নিয়ে কল করলাম। আমার ফোনের চার্জ শেষ। তুই কতদূর রণিত? কাম সুন।"
রণিতঃ আসছি দিভ্যা, ভেরি সুন...অলমোস্ট দেয়ের।
ফোন ডিসকানেক্ট করে রণিত গাড়ি চালানোয় মন দেয়। ফাঁকা রাস্তা। হু হু করে স্পীড তোলে। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। রাস্তা পিছল। হঠাৎ ক্যাচ করে ব্রেক মারার শব্দ। তিন চারবার এই শব্দ শোনা যাবে। ততক্ষণে তিন চারটে অ্যাঙ্গেল দিয়ে রণিতের মুখে ফোকাস হবে ক্যামেরা। স্পষ্টতই ভীত মুখ। সামনে দেখা যাবে একটা বাইক উল্টে পড়ে আছে। পাশে উপুড় হয়ে পড়েছে হেলমেট পরা একটি ছেলে। বেশ আবার ধুম তানা নানা মিউজিক চলছে। ক্যামেরা আস্তে আস্তে বারবার ছেলেটি ও রণিতের মুখে ফোকাস করতে করতে রণিতের মুখে সেটল করে ফ্রিজ করে যাবে।
(আবার কাল)
শহরের কোন ব্যস্ত রাস্তা। বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। বেশ দামী একটা গাড়ি চালাচ্ছে বছর সাতাশ আঠাশের এক সুপুরুষ যুবা। পরনে দামী সুট। টিপটাপ, ফিটফাট। বোঝাই যাচ্ছে এবশ ভালোই উপভোগ করছে ড্রাইভটা। মুখে চোখে এতটুকুও বিরক্তি নেই। বরং মাঝে মাঝেই মুখ হাসি হাসি হচ্ছে। গাড়িতে রেডিওতে চলছে কিছু পপুলার বাংলা রোমান্টিক গান। (মাঝে মাঝে এক মোহময়ী নারী কণ্ঠের আরজের গলা শোনা যাচ্ছে। keywords শোনা যাচ্ছে "প্রেম", "বৃষ্টি", "ট্রাফিক জ্যাম" ইত্যাদি।) গুনগুন করে গলা মেলাতেও দেখা যাচ্ছে ছেলেটিকে। পাশে বসে এক যুবতী। পরনে সাধারণ সিন্থেটিক শাড়ি। কোন গয়নার দোকান বা আধুনিক বেসরকারি হসপিটালের ইউনিফর্মের মতো। চেহারা (ওই মেক আপ আর কী) দেখেই বোঝা যায় মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। হাতে একটা ঢাউস খয়েরি ব্যাগ। অনেকক্ষণ ধরেই গাড়ির জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে। এমন সময়ে একটা সিগনালে গাড়িটা এসে থমকালো।
"কী ভালো weather, না?" সহযাত্রীর দিকে তাকিয়ে যুবকটি বলল।
যুবতী মুখ ফেরালো। স্মিত হাসি হাসল। আবার মুখ ঘুরিয়ে বলল, "আপনাদের যাদের লাক্সারি করার সুযোগ আছে, ঝড় বৃষ্টির মধ্যে কাদা জল জমার মধ্যে দিয়ে হেঁটে দিনের পর দিন চলাফেরা করে বা ভিড় বাসে চিঁরে চ্যাপ্টা হয়ে কাজে যাওয়া আসা করতে হয় না, তাঁদের জন্য তো এমন ওয়েদার খুব ভালো। কী সুন্দর কাব্য করতে পারেন, গান গাইতে পারেন। কফি কাপ হাতে জানালর ধারে বসে ব্যাঙের ডাক শুনতে পারেন..."
যুবকটি কিছু একটা বলতে গিয়েও খানিক থেমে গেল। মাথাটা একটা "বড্ড স্টিরিওটাইপ করো" গোছের মুখ করে বলল, " আপনি এত সিনিকাল কেন বলুন তো?"
যুবতী এবার যুবকের চোখে চোখ রেখে বলল, "আপনি বুঝবেন না। অভিজ্ঞতা নেই তো, তাই। তবে আপনার দোষ নেই। যে যেমন কপাল নিয়ে জন্মায়।"
যুবকঃ তা যা বলেছেন। সবই ফেট, সবই ডেস্টিনি।
যুবতীঃ হ্যাঁ। একদিন এমন বর্ষার মধ্যে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে গোটা দিন যাতায়াত করুন, বুঝে যাবেন আমরা যারা মিডল ক্লাস, কীভাবে দিন যাপন করি। রোজদিন বা সকলের তো এমন সৌভাগ্য হয় না যে আপানর কাছ থেকে লিফট পাবে।"
যুবক বলতে লাগল, "মে বি... আসলে দশ বছর পর আমি ইন্ডিয়ায় ফিরেছি এই কিছু সপ্তাহ আগে। (ছেলেটির ইংরেজি, বিশেষ করে উচ্চারণ অত্যন্ত ঝরঝরে হওয়া উচিত। প্রয়োজনে অ্যাক্সেন্ট থাকা উচিত। অথচ অভিনেতার ইংরেজিতে পরিষ্কার বাংলার টান বোঝা যাবে আহা,কী মাটির মানুষ!!) তার আগেস্কুল ট্যুশন যাতায়াত গাড়িতেই করেছি। সো মে বি।। এনিওয়ে...
"ওই সামনের মোড়ে আমায় নামিয়ে দেবেন প্লিজ। পরের সিগনালটার আগে..." যুবতী কথা থামিয়ে দিয়ে বলল।
যুবকটি একটু অবাক মুখ করে বলল, "সে কী? রাগ করলেন নাকি?"
"আরে না না। ও মা, সে কী কথা। আমার বাড়ি ওইদিকে। একটু টুকটাক বাজার করে ঢুকব। বাবার জ্বর হয়েছে। ভাইয়ের ফিরতে দেরিয়া ছে। আমি এখন বাজার না করে এলে মা রাঁধতে পারবে না। তাই..." বলল যুবতী।
যুবকটি একটা অদ্ভুত ভ্যাবাচ্যাকা গোছের মুখ করে বলল, "বেশ"।
গাড়িটা চলছে। পাশ দিয়ে অন্য গাড়ি বাইক ইত্যাদি সব চলছে। রেডিওতে গান বেজেই চলেছে। আলাদা করে আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দরকার নেই। খানিক দূর যাওয়ার পর গাড়িটাকে রাস্তার বাঁ দিক করে থামাল যুবক।
যুবতী সিট বেল্ট খুলতে খুলতে বলল, "আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ জানাবো? আমার অনেক উপকার করলেন। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে বাস অটো কিচ্ছু পাচ্ছিলাম না। বড্ড মুস্কিলে পড়ে গিয়েছিলাম।"
যুবকঃ দ্যাটস ওকে।
যুবতী (হেসে): আসি।
যুবকঃ ভালো থাকবেন। নমস্কার।
যুবতী গাড়ি থেকে নেমে গেল। দরজা বন্ধ করছিল, যুবকটি একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলল, " ও বাই দি ওয়ে, আমার নাম রণিত। রণিত গাঙ্গুলি।"
যুবতী হাসল। হাসলে খুব সুন্দর টোল পড়ে বাঁ গালে। তারপর পিছন ফিরে চলে গেল। রণিত একটু বোকা বোকা হাসি হেসে মাথার চুল ঠিক করতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে মোবাইল ফোন বেজে উঠল (খেয়াল রাখতে হবে, স্পেসিফিকালি, আইফোনের রিং টোন)। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে, "Mom calling"। হাসি হাসি মুখেই মাথাটা একটু সবজান্তা বেড়ে পাকা অথচ ক্যাবলা মার্কা মাথা নেড়ে ফোন রিসিভ করেই বলল, "ইয়েস মম, অন মাই ওয়ে, আসছি। পার্টি জমে গিয়েছে তো?"
ওপর প্রান্ত থেকে একটা চাপা গলার স্বর শোনা যাবে। কোন তরুণীর। "হু মম? রণিত, দিস ইজ দিভ্যা (খেয়াল রাখবেন উচ্চারণে। দি-vi-য়া)। আমি নেহাত auntyর থেকে ফোনটা নিয়ে কল করলাম। আমার ফোনের চার্জ শেষ। তুই কতদূর রণিত? কাম সুন।"
রণিতঃ আসছি দিভ্যা, ভেরি সুন...অলমোস্ট দেয়ের।
ফোন ডিসকানেক্ট করে রণিত গাড়ি চালানোয় মন দেয়। ফাঁকা রাস্তা। হু হু করে স্পীড তোলে। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। রাস্তা পিছল। হঠাৎ ক্যাচ করে ব্রেক মারার শব্দ। তিন চারবার এই শব্দ শোনা যাবে। ততক্ষণে তিন চারটে অ্যাঙ্গেল দিয়ে রণিতের মুখে ফোকাস হবে ক্যামেরা। স্পষ্টতই ভীত মুখ। সামনে দেখা যাবে একটা বাইক উল্টে পড়ে আছে। পাশে উপুড় হয়ে পড়েছে হেলমেট পরা একটি ছেলে। বেশ আবার ধুম তানা নানা মিউজিক চলছে। ক্যামেরা আস্তে আস্তে বারবার ছেলেটি ও রণিতের মুখে ফোকাস করতে করতে রণিতের মুখে সেটল করে ফ্রিজ করে যাবে।
(আবার কাল)
Wednesday, November 21, 2018
#সিরিয়ালঃসিরিয়াসলি_নেবেন_না
#সিরিয়ালঃসিরিয়াসলি_নেবেন_না
পর্ব ১
স্থানঃ একটু রুচিশীল সুসজ্জিত ফ্ল্যাটের বসবার ঘর। আবছা হলুদ আলো জ্বলছে টিউবলাইটের পরিবর্তে (প্রমাণ যে এটি এক ধনী পরিবারের বাড়ি)।
কোন এক কারণে জনসমাবেশ হয়েছে এই ঘরে (এই মুহূর্তে ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা)। প্রত্যেকেই বেশ দামী পোশাকে। পুরুষদের পরনে হয় পাজামা পাঞ্জাবী নয় সুট (শুধু শার্ট প্যান্ট বা টিশার্ট না), মহিলারা দামী দামী সিল্কের শাড়ি পরে, গায়ে এত গয়না, মনে হবে যেন গয়নার দোকানের মডেল। চড়া মেক আপ। কারুর কারুর মাথায় দামী অর্কিড, রজনীগন্ধা খবরদার না। টু মিডল ক্লাস। টেবিলে রাশি রাশি খাবারের আয়োজন। পানীয়ও রয়েছে। হার্ড সফট দুইই। গল্প টল্প চলছে। হাসির রোল উঠছে মাঝে মাঝে। (স্ক্রিনে উঠবে লেখা "মদ্যপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক"।)
বছর পঞ্চাশ পঞ্চান্নর এক প্রৌঢ়, পরনে সিল্কের সাদা পাঞ্জাবী (গলায় মোটা সোনার চেন এবং পোশাকে সোনার বোতাম লাগানো), কাঁধে কাশ্মীরী চাদর, হঠাৎ সোনালী পানীয়ের গ্লাস হাতে উঠে দাঁড়ালেন আর বললেন, "বুঝলে গিন্নি, দেখতে দেখতে কেমন পঁচিশটা বছর কাটিয়ে ফেললাম বলো? কোন আফসোস নেই আমার। তোমার আছে?" (অতি নাটকীয় ভাবে, টেনে টেনে বলতে হবে কথা। ব্যাকগ্রাউন্ডে হাল্কা কোন মিউজিক বাজবে।)
আটচল্লিশ (দেখে মনে হবে আরো কম) বছরের এক "যুবতী", পরনে রানী কালারের সিল্কের শাড়ী (প্রচুর জরি দেওয়া। মনে হয় কাঞ্জিভরম।), মাথার চুল (আসলে উইগ) ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বেশ কায়দা করে খোঁপা করা, খোঁপায় ম্যাচিং রঙের অর্কিড লাগানো, ঠোঁটে উজ্জ্বল গোলাপি লিপস্টিক, মুখ ভর্তি মেক আপ, গা ভর্তি সোনার ভারী গয়না, একটু ন্যাকা ন্যাকা মুখ করে ভদ্রলোকের দিকে তাকাবে। সলজ্জ হাসি হাসবে। তারপর বলবে, "আমি তো সব সময় সকলকে বলি। গত জন্মে নিশ্চয়ই কোন পুণ্য করেছিলাম, নইলে তোমার মতো এমন এক জীবনসঙ্গী পাই?"
উপস্থিত সকলে আহা উহু বাহ বাহ ইত্যাদি করবে। ক্যামেরা জ্যুম করবে অনেকেরই মুখে। তাদের কারুর মুখে আলাদা করে কোন বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাবেন না। মোটামুটি সব ক্লোন বলেই ধরতে পারেন।
"আরে আদিত্যদা, একটা গান ধরো দিদির জন্য?" প্রায় গায়ে ঢলে পড়ে এক ওই অতি সুসজ্জিতা ভদ্রমহিলা এই ভদ্রলোকটিকে বলবে।
(যাক, নাম জানা গেল। আদিত্য। পুরো নাম আদিত্য শঙ্কর মুখোপাধ্যায়। স্ত্রীর নামটা বলেই দিই। সুপর্ণা মুখোপাধ্যায়)
"বলছ?" আদিত্য একই রকম ন্যাকামি করে শালির দিকে তাকিয়ে বলবে।
শালিও ন্যাকামিতে কোনরকম কমতি না করেই বলবে "হ্যাঁ দাদা প্লিজ ধরো না।"
আদিত্য (এক্সট্রা ন্যাকামি ঢলানি ইত্যাদি সহকারে) : ধরতে বলছ যখন, ধরিই। জানি না আজ ভালো লাগবে কি না সুপর্ণার। তবে বিট্টু বুবাইয়ের ছোটবেলা অবধি কত গান শুনিয়েছি।
জনৈকা অতিথিঃ এই সুপর্ণা, আদিত্যদাকে গান গাইতে বল না। আমরাও শুনি। বেশ মেহফিল জমে যাবে।
সুপর্ণা (একটু মেকি বিরক্তি মুখ করে) বলবে, "আমি বারণ করেছি নাকি। গাক না। এই তো শ্রীপর্ণা বলল। গাইবে নিশ্চয়ই। (আচ্ছা বোঝা গেল শালি আপন শালি। নইলে এমন সুপর্ণা শ্রীপর্ণা ম্যাচ করে নাম হয়? কে জানে) "
আদিত্য (হাত থেকে উইস্কির গ্লাস নামিয়ে): বেশ, সকলের অনুরোধ যখন এত, নিশ্চয়ই গাইব। এই গানটা আজকের দিনে আমি ডেডিকেট করছি আমার সুপুকে। সুপু, দীঘায় যেবার প্রথম গিয়েছিলাম বিয়ের পরে পরে, মনে আছে, বীচের ধার দিয়ে এই গানটা গাইতে গাইতে আমরা হাঁটতাম (দীঘায় হানিমুন? হুম। তার মানে নিশ্চয়ই কোন স্ট্রাগল স্টোরি আছে।)। তুমিও গুনগুন করতে।
সুপর্ণাকে দেখা যাবে লাজে একেবারে নতুন বউয়ের মতো ব্লাশ করছে।
উপস্থিত অতিথিবৃন্দ একটু উসখুস করবে। বিট্টূ আর বুবাই (বিট্টু মেয়ে, বুবাই ছেলে) কে দেখা যাবে একে অপরের দিকে তাকিয়ে একটা "উফ এরা পারেও বটে" গছের লুক দেবে। বিট্টু বুবাইকে বলবে, "শোন বুবাই, মা আর বাবার এই রোম্যান্স চলছে চলুক। আমি একবার কেটারিং এর লোকগুলোকে ফোন করি। শুধু স্টারটার পাঠালো। তাও রিফিল করার কথা। দেয়নি। মেন কোর্সই বা কোথায়? সাড়ে নটা বাজে। ডিনার করবে তো লোকে। ওদের ওপর না চেঁচালে হবে না। সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে না, আঙ্গুল বেঁকাতে হয়। বুঝলি?" স্পষ্টতই বিট্টু বড়লোক বাপ মায়ের আদরে বাঁদর হওয়া মেয়ে। পরনে বেশ সাহসী ব্যাকলেস কেতাদুরস্ত মেরুন ব্লাউজের সাথে ম্যাচিং মেরুন সিল্কের শাড়ি, (আঁচল মাঝে মাঝেই সরে যাবে, আর ও ঠিক করবে)সরু জরি বর্ডার। গয়না হীরের। বুবাইয়ের পরনে সিল্কের পাঞ্জাবী। জিন্স। হাতে দামী ঘড়ি। মাথার চুল একটু বড়োর দিকে। নির্ঘাত ব্যান্ডে গান বাজনা কিছু করে। কানে হীরের স্টাড।
সুপর্ণার কণ্ঠস্বর শোনা যাবে, "বুবাই, গিটারটা নিয়ে আয়। তোর বাবা গান গাইবে।"
বিরক্ত মুখ করে বুবাই ঘর থেকে গিটার নিয়ে আসবে। ভগবান জানে কী না কী কর্ড ধরে টুং টাং করবে। এদিকে ব্যাকগ্রাউন্ডে ফুল ক্যারিওকে বাজতে থাকবে। কোন সারেগামাপা বা ওই ধরণের কম্পিটিশনের প্রথম দশের শেষের দিকের বা তারপরের কোন শিল্পী গান শুরু করবে।
"এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো?"
আদিত্য আর সুপর্ণা লিপ দেবে। গোটা গান চলাকালীন র্যান্ডম লোকজনের ক্লোজ আপ শট নেবে। এমন অপূর্ব গান। কেউ কেউ চোখ বন্ধ করে শুনবে। কেউ কেউ নিজের বর/বউ/পরকীয়া পারটনার/প্রেমিক/প্রেমিকার দিকে সলজ্জভাবে তাকাবে। কেউ তাল দেবে হাতে।
গান প্রায় শেষের দিকে। কলিং বেল বাজবে। সব্বাই পিন ড্রপ সাইলেন্ট হয়ে যাবে।
অনেকজনের (র্যান্ডম) ক্লোজ আপ নেওয়া হবে। সবাই অবাক। কে এলো। এখন কে আসতে পারে। কী ঘটতে চলেছে? পার্টির ছন্দপতন ঘটবে? ব্যাকগ্রাউন্ডে প্রচুর ধুম তানা নানা বাজনা। তারপর আদিত্যর মুখে ক্যামেরা জুম করে ফ্রিজ হয়ে যাবে।
serial
ইদানীং ধৈর্য ধরে দুটি বাংলা সিরিয়াল দেখতে দেখতে মনে হল যে আমিও মনে হয় স্ক্রিপ্ট লিখে ফেলতে পারব। দুটো সম্ভাবনা মাথায় আছে।
১। কোন একজন ব্যক্তির দুইজন স্ত্রী। প্রথমজন হয় গরীব (যদি এই ব্যক্তি বড়লোক হন) নয় খুব বড়লোক (লোকটি এই ক্ষেত্রে গরীব। তবে এই সম্ভাবনা কম, স্ট্যাটিস্টিক্স তাই বলে।)। দুই পক্ষেই ছেলে মেয়ে আছে। বছর কুড়ি পঁচিশ পর এই দুই পক্ষের ছেলে মেয়ের দেখা সাক্ষাত হবে। সময়টা যদি বসন্তকাল হয়, তাহলে ভ্যালেন্টাইন্স ডে উপলক্ষে এদের দুজনের মধ্যে ভাব ভালোবাসা হবে। আর যদি ওই পুজোর সময় হয়, তাহলে ভাইফোঁটায় একজন আরেকজনকে ফোঁটা দেবে। মোদ্দা কথা, পুনর্মিলন হবে। সেই করতে গিয়ে দেখা যাবে প্রথম বিয়েটা ভাঙ্গার জন্য যে চক্রান্ত করেছিল, সে আবার ফিরে এসেছে। দু তিনটে এপিসোড অন্ধকার ঘরে শুধু তাকে সাইড ফেসে দেখানো হবে। হঠাৎ একদিন সামনে দেখাবে মুখ। তখন বোঝা যাবে আরে, এ তো অমুক মাসী, যাকে সবচেয়ে গোবেচারা লাগত, সে। এরপর ইনিয়ে বিনিয়ে এগোবে, ডিপেন্ডিং অন কারেন্ট টপিকস।
২। একটি ছেলে আর একটি মেয়ের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। বেশ ভালোই চলছে সব। দুই বাড়ি থেকেই খুব খুশি মনে মেনে নিয়েছে। বিয়ে টিয়েও বোধহয় ঠিক। হঠাৎ একদিন ছেলেটা রাস্তায় যেতে যেতে হিরোইনকে দেখবে। অসহায় অবলা নারী টাইপ। গুণ্ডা বদমাইশ এদের হাত থেকে বাঁচাবে। এদিকে নিজেও আহত হবে। মাথায় লাঠির বাড়ি খেয়ে স্মৃতি চলে যাবে। হিরোইন সেবা যত্ন করে ভালো করবে। ইতিমধ্যে বাগদত্তার কথা ভুলে যাবে। এই মেয়েটির সাথেই প্রেম করবে। শুধু রাত্রে মাঝে মাঝে ফ্ল্যাশের মতো স্বপ্নে বাগদত্তা আসবে। কিন্তু হিরো বুঝবে না। তারপর কোন একদিন হঠাৎ যখন বর্তমান মেয়েটির সাথে বিয়ে টিয়ে করে হানিমুনে যাবে (জিজ্ঞেস করবেন না পরিবার কোথায় ছিল ছেলেটির যখন বিয়ে হল), প্রথমজন ভ্যাম্পের মতো এন্ট্রি নেবে। উগ্র সাজে সেজে। একটা টিপিকাল থিম ম্যুজিক ট্যুজিক থাকবে। তারপর আবার যে কে সেই, ইনিয়ে বিনিয়ে চলবে।
দুর্গা পুজো, কালী পুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো, লক্ষ্মী পুজো, দোল, রথযাত্রা, ঝুলন, গুরু পূর্ণিমা, ইতু, মনসা পুজো, রান্না পুজো, পৌষ পার্বণ, সরস্বতী পুজো সব পালন করবে এরা। কিছু উৎসব মিস করে গেলে বলবেন। যোগ করে দেবো।
মাঝে সাঝে রবীন্দ্রসঙ্গীত, অরিজিত সিং ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজবে।
আমি জানি, অত্যন্ত জঘন্য হল ব্যাপারটা, তবে যা দেখি/বুঝি, এইগুলোই রমরম করে চলে। আমার আপানর বাড়িতে। প্রতিদিন সন্ধ্যে ৬টা সাড়ে ৬টা থেকে এক্কেবারে ১১টা অবধি। তবে কিছু ভালো সিরিয়াল যে হয়না বা হয়নি, তা বলবো না।
১। কোন একজন ব্যক্তির দুইজন স্ত্রী। প্রথমজন হয় গরীব (যদি এই ব্যক্তি বড়লোক হন) নয় খুব বড়লোক (লোকটি এই ক্ষেত্রে গরীব। তবে এই সম্ভাবনা কম, স্ট্যাটিস্টিক্স তাই বলে।)। দুই পক্ষেই ছেলে মেয়ে আছে। বছর কুড়ি পঁচিশ পর এই দুই পক্ষের ছেলে মেয়ের দেখা সাক্ষাত হবে। সময়টা যদি বসন্তকাল হয়, তাহলে ভ্যালেন্টাইন্স ডে উপলক্ষে এদের দুজনের মধ্যে ভাব ভালোবাসা হবে। আর যদি ওই পুজোর সময় হয়, তাহলে ভাইফোঁটায় একজন আরেকজনকে ফোঁটা দেবে। মোদ্দা কথা, পুনর্মিলন হবে। সেই করতে গিয়ে দেখা যাবে প্রথম বিয়েটা ভাঙ্গার জন্য যে চক্রান্ত করেছিল, সে আবার ফিরে এসেছে। দু তিনটে এপিসোড অন্ধকার ঘরে শুধু তাকে সাইড ফেসে দেখানো হবে। হঠাৎ একদিন সামনে দেখাবে মুখ। তখন বোঝা যাবে আরে, এ তো অমুক মাসী, যাকে সবচেয়ে গোবেচারা লাগত, সে। এরপর ইনিয়ে বিনিয়ে এগোবে, ডিপেন্ডিং অন কারেন্ট টপিকস।
২। একটি ছেলে আর একটি মেয়ের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। বেশ ভালোই চলছে সব। দুই বাড়ি থেকেই খুব খুশি মনে মেনে নিয়েছে। বিয়ে টিয়েও বোধহয় ঠিক। হঠাৎ একদিন ছেলেটা রাস্তায় যেতে যেতে হিরোইনকে দেখবে। অসহায় অবলা নারী টাইপ। গুণ্ডা বদমাইশ এদের হাত থেকে বাঁচাবে। এদিকে নিজেও আহত হবে। মাথায় লাঠির বাড়ি খেয়ে স্মৃতি চলে যাবে। হিরোইন সেবা যত্ন করে ভালো করবে। ইতিমধ্যে বাগদত্তার কথা ভুলে যাবে। এই মেয়েটির সাথেই প্রেম করবে। শুধু রাত্রে মাঝে মাঝে ফ্ল্যাশের মতো স্বপ্নে বাগদত্তা আসবে। কিন্তু হিরো বুঝবে না। তারপর কোন একদিন হঠাৎ যখন বর্তমান মেয়েটির সাথে বিয়ে টিয়ে করে হানিমুনে যাবে (জিজ্ঞেস করবেন না পরিবার কোথায় ছিল ছেলেটির যখন বিয়ে হল), প্রথমজন ভ্যাম্পের মতো এন্ট্রি নেবে। উগ্র সাজে সেজে। একটা টিপিকাল থিম ম্যুজিক ট্যুজিক থাকবে। তারপর আবার যে কে সেই, ইনিয়ে বিনিয়ে চলবে।
দুর্গা পুজো, কালী পুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো, লক্ষ্মী পুজো, দোল, রথযাত্রা, ঝুলন, গুরু পূর্ণিমা, ইতু, মনসা পুজো, রান্না পুজো, পৌষ পার্বণ, সরস্বতী পুজো সব পালন করবে এরা। কিছু উৎসব মিস করে গেলে বলবেন। যোগ করে দেবো।
মাঝে সাঝে রবীন্দ্রসঙ্গীত, অরিজিত সিং ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজবে।
আমি জানি, অত্যন্ত জঘন্য হল ব্যাপারটা, তবে যা দেখি/বুঝি, এইগুলোই রমরম করে চলে। আমার আপানর বাড়িতে। প্রতিদিন সন্ধ্যে ৬টা সাড়ে ৬টা থেকে এক্কেবারে ১১টা অবধি। তবে কিছু ভালো সিরিয়াল যে হয়না বা হয়নি, তা বলবো না।
Monday, November 19, 2018
men's day
আজ পৃথিবীর বহু দেশে পালিত হচ্ছে "মেন'স ডে"। ৮ই মার্চ নারী দিবস নিয়ে
যতটা উদযাপন হয় সর্বত্র, আজকের দিনটা যেন তুলনামূলকভাবে কম লোকে জানেন।
তবুও সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ক্রমশ আজকের দিনটি সম্পর্কেও সচেতনতা বাড়ছে।
খুবই ভালো দিক এইটি। ইন্টারনেট ঘেঁটে যেটুকু জানলাম আজকের দিন সম্পর্কে,
সেই তথ্য নিয়ে এলাম।
মূলত পুরুষমানুষদের মানসিক সুস্বাস্থ্যের কথা ভেবে আজকের দিনটি পালন করা হয়। ষাটের দশক থেকেই এমন একটি দিনের জন্য কথা উঠলেও, ১৯৯১ এ এই দিনটির কথা ভাবা হয়। তবে ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ তেই প্রথম পুরুষ দিবস পালন করা হয়। উদ্যোক্তা ছিলেন টমাস ওয়েস্টার। সাময়িক বিরতির পর ১৯৯৯ সালে পুরুষ দিবসের পুনরুত্থান ঘটে। এইবার এটি হয় ট্রিনিডাড ও টোব্যাগো দ্বীপের এক ডাক্তার জেরোম টীলাক্সিং এর উদ্যোগে। উনি নিজের বাবার জন্মদিনের দিনে অর্থাৎ ১৯শে নভেম্বর এই দিনটিকে বেছে নেন উদযাপনের জন্য। ভারতে এই দিনটির উদযাপন শুরু হয় ২০০৭ সালে।
সাম্প্রতিক কালেই নয়, বহু বছর ধরেই সমাজে নারী পুরুষের মধ্যে ব্যবধান একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। এ ছাড়া কিছু পুরুষের অত্যন্ত ঘৃণ্য আচার আচরণের জন্যও পুরুষ জাতের ওপর একটা বিতৃষ্ণা বা খারাপ লাগা অনেকের মধ্যেই ছিল। পুরুষ দিবস দিনটি উদযাপন করা হয় এই "স্টিগ্মা"কে দূর করতে। পরিসংখ্যান বলছে সারা বিশ্বে আত্মহত্যা, অসুস্থতা, হিংসা, একই অন্যায় করে কারাযাপন, এই সবে পুরুষদের সংখ্যা নারীর তুলনায় অনেকটাইবেশি। আজকের দিনের উদ্দেশ্যই হল সমাজে নারী পুরুষের মধ্যে ব্যবধান কমানো, "জেন্ডার ইক্যুয়াল" সমাজ কাম্য। পুরুষেরাও যে বহু সময়েই নানান অন্যায় ও অবিচারের শিকার হন, সেই বিষয়ে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। আজকের দিনে পুরুষের স্বাস্থ্য (বিশেষ করে মানসিক স্বাস্থ্য) ও সমাজে তাঁদের অবস্থান নিয়ে আলোচনা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে করা হয়।
প্রতি বছর এই দিনটি পালনের জন্য একেকটি "থিম" বেছে নেওয়া হয়। যেমন ২০১১তে ছিল ""giving men the best possible start to their lives", ২০১২তে ছিল "Helping men and boys live longer happier and healthier lives" ইত্যাদি। এই বছরের "থিম" হল "Male role models"। IMD বা ইন্টারন্যাশনাল মেন'স ডের ওয়েবসাইট থেকে বলতে গেলে, " International Men's Day is a time to promote positive aspects of male identity based on the premise that 'males of all ages respond more energetically to positive role models than they do to negative gender stereotyping'."
আসুন আজকের দিনে আমাদের জীবনের সমস্ত প্রিয় পুরুষ মানুষদের শুভেচ্ছাবার্তা জানাই।
মূলত পুরুষমানুষদের মানসিক সুস্বাস্থ্যের কথা ভেবে আজকের দিনটি পালন করা হয়। ষাটের দশক থেকেই এমন একটি দিনের জন্য কথা উঠলেও, ১৯৯১ এ এই দিনটির কথা ভাবা হয়। তবে ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ তেই প্রথম পুরুষ দিবস পালন করা হয়। উদ্যোক্তা ছিলেন টমাস ওয়েস্টার। সাময়িক বিরতির পর ১৯৯৯ সালে পুরুষ দিবসের পুনরুত্থান ঘটে। এইবার এটি হয় ট্রিনিডাড ও টোব্যাগো দ্বীপের এক ডাক্তার জেরোম টীলাক্সিং এর উদ্যোগে। উনি নিজের বাবার জন্মদিনের দিনে অর্থাৎ ১৯শে নভেম্বর এই দিনটিকে বেছে নেন উদযাপনের জন্য। ভারতে এই দিনটির উদযাপন শুরু হয় ২০০৭ সালে।
সাম্প্রতিক কালেই নয়, বহু বছর ধরেই সমাজে নারী পুরুষের মধ্যে ব্যবধান একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। এ ছাড়া কিছু পুরুষের অত্যন্ত ঘৃণ্য আচার আচরণের জন্যও পুরুষ জাতের ওপর একটা বিতৃষ্ণা বা খারাপ লাগা অনেকের মধ্যেই ছিল। পুরুষ দিবস দিনটি উদযাপন করা হয় এই "স্টিগ্মা"কে দূর করতে। পরিসংখ্যান বলছে সারা বিশ্বে আত্মহত্যা, অসুস্থতা, হিংসা, একই অন্যায় করে কারাযাপন, এই সবে পুরুষদের সংখ্যা নারীর তুলনায় অনেকটাইবেশি। আজকের দিনের উদ্দেশ্যই হল সমাজে নারী পুরুষের মধ্যে ব্যবধান কমানো, "জেন্ডার ইক্যুয়াল" সমাজ কাম্য। পুরুষেরাও যে বহু সময়েই নানান অন্যায় ও অবিচারের শিকার হন, সেই বিষয়ে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। আজকের দিনে পুরুষের স্বাস্থ্য (বিশেষ করে মানসিক স্বাস্থ্য) ও সমাজে তাঁদের অবস্থান নিয়ে আলোচনা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে করা হয়।
প্রতি বছর এই দিনটি পালনের জন্য একেকটি "থিম" বেছে নেওয়া হয়। যেমন ২০১১তে ছিল ""giving men the best possible start to their lives", ২০১২তে ছিল "Helping men and boys live longer happier and healthier lives" ইত্যাদি। এই বছরের "থিম" হল "Male role models"। IMD বা ইন্টারন্যাশনাল মেন'স ডের ওয়েবসাইট থেকে বলতে গেলে, " International Men's Day is a time to promote positive aspects of male identity based on the premise that 'males of all ages respond more energetically to positive role models than they do to negative gender stereotyping'."
আসুন আজকের দিনে আমাদের জীবনের সমস্ত প্রিয় পুরুষ মানুষদের শুভেচ্ছাবার্তা জানাই।
Monday, November 12, 2018
হঠাৎ দেখা
১।
দেরাদুনের জলি গ্রান্ট এয়ারপোর্টে প্লেনটা যখন নামল, ঘড়িতে সকাল সাড়ে এগারোটা। হ্যান্ড লাগেজ ছাড়া আর অন্য কোন কিছু নেওয়ার ছিল না, তাই প্লেন থেকে নেমেই একেবারে বাইরে চলে এলাম। আমি, সম্রাজ্ঞী দাশগুপ্ত, বর্তমানে দিল্লীতে এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করি। দেরাদুন এসেছি, বা বলা চলে, মুসোউরি যাচ্ছি আমার খুব কাছের এক বান্ধবীর বিয়ে উপলক্ষে। মেঘা, আমার ক্লাসমেট কাম রুমমেট। একসাথে এম বি এ পড়েছি আমেদাবাদে। ওই দুই বছরের কঠিন দিনগুলো অনেকাংশেই কম কষ্টের কাটত শুধুমাত্র এই সদা হাসি খুশি পাহাড়ি মেয়েটির জন্য। মেঘা আমার কাছে বন্ধুর চেয়েও অনেক বেশি কিছু। আর তাই ও যখন আমায় ওর বিয়ের তারিখ ঠিক হওয়ার কথা জানালো দশ মাস আগে, আমি তক্ষুনি ছুটির আবেদন করে ফেলেছিলাম। মেঘার বিয়ে উপলক্ষ্যে আমাদের ব্যাচের অনেকেই আসবে। রুশা, সিম্মি, প্রিয়াঙ্কা, গৌরব, নেহাল, চঞ্চল, পারুল, বিবেক, আকাশ, সুমিত। সবার সাথে দেখা হবে, ভেবে এমনিতেই মন ভালো। তার ওপর এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়েই পাহাড় দেখে আর একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার আমেজ আমায় মুহূর্তেই খুশি করে দিল। দিল্লীতেও ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। তবে এই শুদ্ধ পরিবেশের বড্ড অভাব। মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে। মেঘার মেসেজ পেয়েছি, এয়ারপোর্টের সামনেই ওর পাঠানো গাড়ি আছে। গাড়ির নম্বর জানিয়ে রেখেছে। আমি ড্রাইভার সাহেবকে ফোন করে এগোতে লাগলাম।
একটা কালো রঙের ইনোভা গাড়ি। দরজার বাইরেই এক বছর পঁচিশ তিরিশের যুবক দাঁড়িয়ে। বুঝলাম ইনিই চালক। আমার হাত থেকে ট্রলি ব্যাগটা নিয়ে বললেন, "মেমসাব, একটু অপেক্ষা করতে হবে। এর পরের ফ্লাইটে আর এক সাবজী আসছেন। মেঘা ম্যাডাম বলেছেন আপনাদের দুজনকে একসাথে নিয়ে আসতে। এই তো বারোটা পনেরোর দিকেই ল্যান্ড করবে। আপনি গাড়ির ভিতরে বসুন।"
আমি অবাক হয়ে গেলাম একটু। কই, মেঘা তো আমায় কিছু বলেনি। কে আসছে? আমাদের ব্যাচের কেউ? ওয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে কেউ কিছু তো লিখল না। আমার ধারণা ছিল বাকিরা বম্বে হয়ে আসছে। বিকেলে পৌঁছবে। কে জানে। থাক, একটু রোদ পোহাই, আর বাড়িতেও ফোন করে দিই। মা বাবা চিন্তা করছে নিশ্চয়ই। হ্যান্ডব্যাগটা গাড়িতে রেখে আমি বাইরেই দাঁড়ালাম। বাড়িতে কথাবার্তা সারলাম। ঘড়িতে বাজে বারোটা পঁয়ত্রিশ। ইতিমধ্যেই ভৈঁরো সিং, মানে আমাদের ইনোভার চালকের ফোনে আমার সহযাত্রীর কল এসে গিয়েছে। উনি কনভেয়ার বেল্ট থেকে লাগেজ নিয়েই আসছেন। আমি ভৈঁরোর সাথে খানিক খেজুরে গল্প করলাম। মুসৌরির আবহাওয়া, বিয়ের তোরজোড় ইত্যাদি নিয়ে।
"ওই তো, সাব এসে গিয়েছেন।" ভৈঁরোর কোথায় সম্বিত ফিরল। ফোন থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম যাকে, মুহূর্তে আমার হৃৎপিণ্ড দু তিনটে বিট মিস করলোই করল। ঠিক আগের মতোই। নীল জিন্স, লাল কালো চেক শার্ট আর চোখে কেতাদুরস্ত সানগ্লাস পরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে সম্রাট। সম্রাট চট্টোপাধ্যায়। একদা আমাদের এম বি এ ক্লাসের ক্লাসমেট। তার চেয়েও বড় কথা, আমার প্রাক্তন প্রেমিক।
২।
সালটা ২০১১। তখন সবে যাদবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে এম বি এ পড়তে ঢুকেছি। প্রথম বাড়ির বাইরে থাকা। হোস্টেল জীবন। পড়ার চাপ। র্যাগিং। সব মিলিয়ে মন খারাপ করেই অবসর কাটত। অবশ্য লেখাপড়ার এত চাপ থাকত, রোজ রোজ একেকটা অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করা, ক্লাসের পড়া রেডি করা, হঠাৎ হঠাৎ সারপ্রাইজ কুইজ, সব মিলিয়ে নাজেহাল। বরাবর স্কুল আর কলেজ টপার আমি। তাতেও হিমশিম খেতাম এম বি এর কারিকুলামে। ব্যাচের সকলের সাথেও আলাপ হয়নি সেরকমভাবে, কিছু বন্ধু বান্ধব হয়েছিল সেকশনে, ওইটুকুই। এরই মধ্যে একদিন আমাদের ব্যাচের থেকে কিছু লোকজন ঠিক করল, সব সেকশন মিলে মিড সেমেস্টারে একটা উইকেন্ডে বেড়াতে যাওয়া হবে। উদয়পুর। এই উপায়ে সকলের সাথে সকলের বেশ পরিচিতি হবে। বেড়াতে আমি ভালোইবাসি। আর রাজস্থান বেড়াতে যাওয়ার শখ অনেকদিন ধরেই। তাই না করিনি। কে জানত, এই ট্রিপই আমূল বদলে দেবে আমার জীবন। এনে দেবে এই নিস্তরঙ্গ জীবনে ঝঞ্ঝা।
বৃহস্পতিবার বিকেলে আমাদের ১০০ জনের দল চারটে বড় বাস নিয়ে রওনা দিলাম। যেহেতু এই ট্রিপের মূল কারণ বা লক্ষ্যই ছিল একে অপরের সাথে মেলামেশা হওয়া, পরিচিতি বাড়া, তাই সিটিং এরেঞ্জমেন্টও ছিল বেশ অভিনব। লটারিতে ঠিক হবে এই পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা কে কার সাথে বসবে। উদয়পুর পৌঁছনর আগে আবার বাসে লটারি হয়েছিল কে কার রুমমেট হবে। আমি যে চিরকুট দুটি তুলেছিলাম, তাতে আমার বাস সঙ্গী ছিল সম্রাট। আর রুমমেট পারুল। সম্রাটের পাশে বসবে সম্রাজ্ঞী, ব্যাচের যে কজন বাঙালি ছিল, তারা দায়িত্ব নিয়ে এই জোড়ির গল্প গোটা ব্যাচকে বুঝিয়ে দিল। আর কী, সারা রাস্তা আমাদের দুজনকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা হইহই হল। সুমন থেকে থেকেই রব নে বনা দি জোড়ির টাইটেল ট্র্যাক গাইতে লাগল। সম্রাটের সাথে আমার আলাপ ছিল না আগে। ও ছিল সেকশন এ তে। আর আমি, সেকশন বি। বরাবরের প্রগল্ভ আমি, লোকজনের উৎপাত থেকে কোনক্রমে নিজেকে বাঁচিয়ে নিজেই যেচে আলাপ করলাম। শুনলাম, ও প্রবাসী বাঙালি। জন্ম থেকেই নাগপুরে থাকে। ওর বাবা ওখানের এক কলেজের প্রফেসর। হিন্দি ফিল্ম আর কান্ট্রি ফোকের পোকা। আমারও মোটামুটি পছন্দের বিষয় এগুলিই। পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা এই নিয়ে আলোচনা করতে করতে কখন যে কেটে গেল, খেয়ালই নেই। মনে আছে, ওর বাংলা ফোক সং নিয়ে তেমন ধারণা নেই শুনে আমি বেশ কয়েকটা গান গেয়ে শুনিয়েছিলাম। আমার গানের গলার প্রশংসা পেলাম উপহারে। তবে সবচেয়ে বড় উপহার, বা বলা যায়, স্মরণীয় উপহার পেলাম, তা ছিল সম্রাটের বন্ধুত্ব। আগামী তিনদিন এত ভালো কেটেছিল, ঠিক যেন স্বপ্ন। উদয়পুর লেকে সূর্যাস্ত দেখা, নৌকাভ্রমণ, সিটি প্যালেসের ঐশ্বর্য্য জৌলুসে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া...প্রতি মুহূর্ত বন্ধুদের সাথে, বিশেষ করে সম্রাটের সাথে ঘুরে ভীষণ উপভোগ করেছিলাম। ফেরার পথে আর আমাদের সিটিং নিয়ে কিছু আলাদা ব্যবস্থা ছিল না। যে যার পাশে বসা যাবে। অদ্ভুতভাবে আমার পাশের জায়গায় ঠিক সম্রাট এসে বসেছিল।
দেখতে দেখতে দিন গেল। সম্রাটের সাথে আমার বন্ধুত্ব আরো নিবিড় হতে থাকল। সময় সুযোগ থাকলেই লাইব্রেরি গিয়ে পড়াশোনা করা, এক সাথে এসাইনমেন্ট সল্ভ করা, পড়তে পড়তে মাথা জ্যাম হয়ে গেলে রাস্তার ওপারে চায়ের দোকানে গিয়ে একটু বিরাম নেওয়া... একদিন হঠাৎ বুঝলাম, কবে যেন আমরা শুধুই ভালো বন্ধুর গণ্ডি পেরিয়ে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছি পরের ধাপে। হাসি মজার মধ্যে দিয়েই লেখাপড়া, ঘুরে বেড়ানো, দেখতে দেখতে কোর্স শেষ হলো। প্লেসমেন্টে দুজনে দুই জায়গায় চাকরি পেলাম। আমি দিল্লি। সম্রাট চেন্নাই। অবশ্যই মাঝে মাঝেই একে অপরের কাছে চলে আসব, দেখা করব, এই সমস্ত কথা দেয়া নেওয়া চলল।
প্রথম এক বছর মোটামুটি তেমনভাবে চললও। লং উইকেন্ড পেলেই হয় আমি চেন্নাই নয় সম্রাট দিল্লি এসে যেত। ছুতোয় নাতায় কাজ নিয়ে চলে যেতাম চেন্নাই। বা ও আসত বোম্বে। আমি ছুটি ম্যানেজ করে সেখানে চলে যেতাম। দুই পক্ষের বাড়িতেই আমাদের কথা জানত। এক আধ বার আমরা কবে বিয়ে করেছি, এই মর্মে কথাবার্তা উঠেছে। দুজনেই কেরিয়ারে আরো উন্নতি করব, তারপর গাঁটছড়া বাঁধব, এই বলে সাময়িকভাবে কথা এড়াতাম। তবে মনে মনে বিয়ে নিয়ে যে অল্প বিস্তর স্বপ্ন দেখতাম, স্বীকার করতে লজ্জা নেই। সম্রাটকে বলেওছিলাম। তবে ও পাত্তা দিত না। ক্রমে কাজকর্মের দোহাই দিয়ে আমাদের মধ্যে আসতে শুরু করল দূরত্ব। দিনে দুই তিনবার ফোন কলের বদলে সপ্তাহে দুদিন ভিডিও কল, তারপর তাও কমতে কমতে মাসে এক দুই দিন। এক সাথে কোথাও যাওয়া নেই। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো আমার ট্রান্সফার হয়ে গেল স্কটল্যান্ডের অপরূপ সুন্দর শহর, গ্লাসগো। দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে চেষ্টা করেছিলাম দেখা করার সম্রাটের সাথে। কিন্তু ও সময় দিতে পারেনি। মন খারাপ নিয়েই গেলাম গ্লাসগো।
ওখান থেকে কয়েকবার কথা হয়েছে, অন্য টাইমজোন হয়ে দাঁড়িয়েছে পথের কাঁটা। তারপর আর তাও না। বুঝতাম সম্রাট আমায় এড়িয়ে যাচ্ছে। মেসেজের উত্তর নেই। আমার জন্মদিনে পর্যন্ত যোগাযোগ নেই। আমি বোকা মেয়ে। ভেবেছিলাম হয়তো আমায় সারপ্রাইজ দিতে গ্লাসগো আসবে। সারাদিন অফিস করতে করতে এই চিন্তাই মাথার মধ্যে খেলছিল আমার। দুদিন পরে ফেসবুকে দেখলাম আমার জন্মদিনের দিন সম্রাট ছিল অফিস পার্টিতে। ঝকঝকে পার্টি। হাসি খুশি মানুষজন। খাদ্য আর পানীয়ের অফুরান ব্যবস্থা। নতুন পরিবেশ। নতুন লোক। সম্রাটকে দেখে মনেই হলো না আমায় মিস করে বলে।
ফেসবুকের থেকেই তারপর একদিন জানতে পারলাম সম্রাট সিডনি ট্রান্সফার হচ্ছে। একবার ভেবেওছিলাম শুভেচ্ছা জানাই। কে জানে কী হলো, জানালাম না। "গাট ফিলিং" হয়তো একেই বলে। ভাগ্যিস জানাইনি। কারণ তিন সপ্তাহ পর দেখলাম সম্রাটের নতুন আপডেট। "ইন এ রিলেশনশিপ উইথ স্বপ্না মেরহোত্রা"। স্টক করে দেখলাম স্বপ্না ওর কলিগ। ব্যাঙ্গালোর অফিস থেকে সিডনি গিয়েছে। কলেজের গ্রুপের বন্ধুদের সাথে তেমন আর বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। শুধু মেঘার সাথে নিয়মিত কথা হতো। ও জানতো আমার আর সম্রাটের সম্পর্কের কথা। মেঘার তৎকালীন বয়ফ্রেন্ড, বর্তমানে হবু বর স্বাধীনের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল সম্রাট। মেঘা আর স্বাধীন খুব আঘাত পেয়েছিল এই ঘটনাটির পর। একদিন স্কাইপ কলে আমি আর মেঘা দুইজনে অনেক অনেক কান্নাকাটি করলাম। তারপর "এগিয়ে চলতে হবে, যে আমার সাথে এমন করতে পারল, তার মতো খারাপ কেউ হতেই পারেনা। তার জন্য কান্নাকাটি করতে যাওয়া মানে নিজেকে অপমান করা।" এই সব ভেবে আমি এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। হ্যাঁ, চেষ্টা। আজও যখন তিন বছর কোনোরকম যোগাযোগ না রেখেও ওকে দেখে এরকম বুকের মধ্যে আনচান করে ওঠা... সত্যি কি আমি "মুভ অন" করতে পেরেছি? এতই কি সহজ?
৩।
প্রাথমিক ভ্যাবাচ্যাকা কাটিয়ে দুজনেই দুজনকে দেখে হাসলাম।
"কেমন আছিস, আই মিন, কেমন আছেন?" থমকে গিয়ে বললাম আমি।
"ভালো আছি। চলছে এক রকম। তুই? আর হ্যাঁ, প্লিজ আপনি আজ্ঞে করিস না। অদ্ভুত লাগে।" করমর্দন করতে করতে সম্রাট বললো। প্রয়োজনের চেয়ে কি একটু বেশিই সময় আমরা একে অপরের হাত ধরেছিলাম? কে জানে।
ভৈঁরো সিং এর ডাকে আমরা গাড়ির ভিতর ঢুকলাম। দুজনের লাগেজ পিছনে চালান হয়ে গিয়েছে। মাঝের সিটে দুই জানলার ধারে আমরা দুজন। আমার হ্যান্ডব্যাগটা দুজনের মধ্যের যেন এক প্রাচীর সৃষ্টি করেছে। গাড়ি চলছে মুসৌরির দিকে। জানলার কাঁচ নামানো ছিল আমার দিকে অল্প। ঠান্ডা হাওয়া মুখের ওপর পড়ায় খুব আরাম লাগছিলো। একবার বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সম্রাট মাফলার বের করেছে নিজের ব্যাকপ্যাক থেকে। আঁটোসাঁটো করে গলায় জড়িয়ে নিচ্ছে।
"জানলার কাঁচ তুলে দেব?" জিজ্ঞেস করলাম।
ও বললো, "না থাক।"
"খবর কী তোর, বল। অফিস কোথায় এখন?"
"এই তো। আপাতত কোম্পানি ইস্টার্ন জোনে এক্সপ্যান্ড করছে। তাই কলকাতায় হেডকোয়ার্টার সামলাচ্ছি।" হাসল সম্রাট।
"ফাইনালি তাহলে কলকাতা গেলি। কেমন লাগছে শহরটা?"
"উম, মন্দ না। এক সময় এত গল্প শুনেছি।"
সেই। কত গল্পই না করেছি আমি। শহরটাকে আমি বড্ড ভালোবাসি। আর তাই তার প্রতিটি আনাচে কানাচে ঘুরিয়েছিলাম সম্রাটকে আমার কথার মাধ্যমে। ভিক্টরিয়া হোক কি ময়দান, কলেজ স্ট্রিট বা গড়িয়াহাট, সল্ট লেক হোক কি বেহালা, পুরো কলকাতা আমার নখদর্পনে। কলকাতার গল্প করতে এত ভালোবাসতাম। কেন কে জানে?
বুঝলাম সম্রাটও সেই একই কথাই ভাবছে। আর তাই অপ্রস্তুতও বোধ করছে। কথায় কথা বাড়ে। আমি কিছু বললাম না। আবার জানলার বাইরে তাকিয়ে রইলাম। দুইবপাশে ঘন সবুজ রাশি। আকাশ পরিষ্কার। এমন নীল আকাশ কতদিন দেখিনা... নৈসর্গিক শোভা বড়ই অপূর্ব। মেঘার কাছে ছবি দেখেছি। আজ চাক্ষুস দেখে যেন আরো মোহাচ্ছন্ন লাগছিলো আমার।
মাঝে একটা জায়গায় আমরা গাড়ি থামালাম। দাঁড়িয়ে গরম গরম চা খেলাম। দেখলাম সম্রাট এখনও বেশি গরম কাপ ধরতে পারে না। কলেজ জীবনে আমার দুপাট্টা জড়িয়ে চায়ের গ্লাস ধরত। আজ দেখলাম স্বাবলম্বী হয়েছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে ধরল। পটাপট কিছু ছবি তুলে ওয়াটসঅ্যাপে দিলাম। মেঘার বিয়ে উপলক্ষ্যে বানানো গ্রুপে। কেউ কেউ রিপ্লাই দিল। ওরা আসছে সন্ধ্যেয়। সবার সাথে দেখা হবে পাঁচ বছর পর। কত গল্প বাকি। আমরা গাড়িতে উঠলাম। ভৈঁরো নিজের পছন্দের নেপালি লোকসংগীত চালিয়ে রেখেছে। কথা যেটুকু বুঝলাম, মনে হলো ভালোবাসার গান। ও নিজেও বেশ ফুরফুরে মেজাজে গুনগুন করছিল। মুখে স্মিত হাসি। দেখে ভালো লাগছিলো আমার।
দু ঘন্টার একটু পর আমরা প্রায় যখন মুসৌরি শহরে ঢুকছি, মেঘার ফোন এলো আমার মোবাইলে। কতদূর এসেছি জানতে চাইলো। বললাম।
"শোন না, তুই কিন্তু প্লিজ আমার ওপর রাগ করিস না সম্রাজ্ঞী। সম্রাটকে কিন্তু আমি ইচ্ছে করে তোর গাড়িতে আনাইনি। ওকে আনতে যে গাড়ির যাওয়ার ছিল, আজ সকালে ওর ড্রাইভার ক্যানসেল করল। আমার আর কোনো উপায় ছিল না। বিশ্বাস কর। সো সরি।" মেঘার কথা শুনে আমি অল্প হাসলাম। "আরে না না। কোনো ব্যাপার না। অসুবিধে হয়নি। তুই চিন্তা করিস না। এই এখনই পৌঁছবো। গিয়ে দেখা হচ্ছে। কান্ট ওয়েট টু সি ইউ উড বি ব্রাইড!"
"আর কতক্ষণ ভৈঁরো?" আমি জিজ্ঞেস করলাম।
"মেমসব, আর পনেরো বিশ মিনিট। জ্যাম নেই ভাগ্যিস আজ।"
বাইরে হাওয়াটা ভালোই বইছে। সবে বেলা আড়াইটা পেরিয়েছে, এরই মধ্যে রোদের তেজ কমতে শুরু করেছে। একটু একটু কুয়াশার চাদর সবে জড়াতে শুরু করেছে পথঘাটকে। আমি হ্যান্ডব্যাগ থেকে স্টোলটা বের করে গায়ে জড়িয়ে নিলাম। দেখলাম সম্রাট আমার দিকে তাকিয়ে। কিছু কি বলবে? আমি কোনো কথা বললাম না। মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।
আমাদের গাড়িটা একটা বাড়ির সামনে এসে থামল। বিরাট বাড়ি। গেটে ফুল দিয়ে সাজানো হচ্ছে। লম্বা করে টুনি বাল্ব লাগানো। বুঝলাম এটাই মেঘার বাড়ি। সাজগোজ দেখেই বোঝা যায় যে এটি একটি উৎসবের বাড়ি।
এইবার নামতে হবে। ভৈঁরো সিং নেমে লাগেজ নামাতে গেল। আমিও নামতে যাচ্ছিলামই, এমন সময় সম্রাট আমার হাতটা চেপে আটকালো। আমি অবাক হয়েই তাকালাম ওর দিকে।
"সম্রাজ্ঞী, আই এম ভেরি সরি ফর এভরিথিং। তুই প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দিস পারলে। আই নো আই হ্যাভ রংড ইউ।"
আমি তাকিয়েই রইলাম ওর দিকে। তারপর কিচ্ছু না বলে হাতটা ছাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে এলাম। মুখে চওড়া হাসি। মেঘাও এর মধ্যে এসে গিয়েছে গেটে। এতদিন পর প্রাণের বন্ধুকে পেয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরলাম। পুরোনো কথা নিয়ে ভাবার এখন সময় নেই। আগামী কটাদিন হোক সুন্দর। সেই আশাতেই থাকবো আমি। আর সবচেয়ে বড় কথা। টের পেলাম, সম্রাটের কথায় বা আচরণে আমি আর একটুও বিচলিত হলাম না। হয়তো এই দু ঘন্টার যাত্রাপথটা খুব প্রয়োজন ছিল, আমাদের ক্লোজারের জন্য। কে জানে... ভালো থাকে ভালোবাসা।
দেরাদুনের জলি গ্রান্ট এয়ারপোর্টে প্লেনটা যখন নামল, ঘড়িতে সকাল সাড়ে এগারোটা। হ্যান্ড লাগেজ ছাড়া আর অন্য কোন কিছু নেওয়ার ছিল না, তাই প্লেন থেকে নেমেই একেবারে বাইরে চলে এলাম। আমি, সম্রাজ্ঞী দাশগুপ্ত, বর্তমানে দিল্লীতে এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করি। দেরাদুন এসেছি, বা বলা চলে, মুসোউরি যাচ্ছি আমার খুব কাছের এক বান্ধবীর বিয়ে উপলক্ষে। মেঘা, আমার ক্লাসমেট কাম রুমমেট। একসাথে এম বি এ পড়েছি আমেদাবাদে। ওই দুই বছরের কঠিন দিনগুলো অনেকাংশেই কম কষ্টের কাটত শুধুমাত্র এই সদা হাসি খুশি পাহাড়ি মেয়েটির জন্য। মেঘা আমার কাছে বন্ধুর চেয়েও অনেক বেশি কিছু। আর তাই ও যখন আমায় ওর বিয়ের তারিখ ঠিক হওয়ার কথা জানালো দশ মাস আগে, আমি তক্ষুনি ছুটির আবেদন করে ফেলেছিলাম। মেঘার বিয়ে উপলক্ষ্যে আমাদের ব্যাচের অনেকেই আসবে। রুশা, সিম্মি, প্রিয়াঙ্কা, গৌরব, নেহাল, চঞ্চল, পারুল, বিবেক, আকাশ, সুমিত। সবার সাথে দেখা হবে, ভেবে এমনিতেই মন ভালো। তার ওপর এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়েই পাহাড় দেখে আর একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার আমেজ আমায় মুহূর্তেই খুশি করে দিল। দিল্লীতেও ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। তবে এই শুদ্ধ পরিবেশের বড্ড অভাব। মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে। মেঘার মেসেজ পেয়েছি, এয়ারপোর্টের সামনেই ওর পাঠানো গাড়ি আছে। গাড়ির নম্বর জানিয়ে রেখেছে। আমি ড্রাইভার সাহেবকে ফোন করে এগোতে লাগলাম।
একটা কালো রঙের ইনোভা গাড়ি। দরজার বাইরেই এক বছর পঁচিশ তিরিশের যুবক দাঁড়িয়ে। বুঝলাম ইনিই চালক। আমার হাত থেকে ট্রলি ব্যাগটা নিয়ে বললেন, "মেমসাব, একটু অপেক্ষা করতে হবে। এর পরের ফ্লাইটে আর এক সাবজী আসছেন। মেঘা ম্যাডাম বলেছেন আপনাদের দুজনকে একসাথে নিয়ে আসতে। এই তো বারোটা পনেরোর দিকেই ল্যান্ড করবে। আপনি গাড়ির ভিতরে বসুন।"
আমি অবাক হয়ে গেলাম একটু। কই, মেঘা তো আমায় কিছু বলেনি। কে আসছে? আমাদের ব্যাচের কেউ? ওয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে কেউ কিছু তো লিখল না। আমার ধারণা ছিল বাকিরা বম্বে হয়ে আসছে। বিকেলে পৌঁছবে। কে জানে। থাক, একটু রোদ পোহাই, আর বাড়িতেও ফোন করে দিই। মা বাবা চিন্তা করছে নিশ্চয়ই। হ্যান্ডব্যাগটা গাড়িতে রেখে আমি বাইরেই দাঁড়ালাম। বাড়িতে কথাবার্তা সারলাম। ঘড়িতে বাজে বারোটা পঁয়ত্রিশ। ইতিমধ্যেই ভৈঁরো সিং, মানে আমাদের ইনোভার চালকের ফোনে আমার সহযাত্রীর কল এসে গিয়েছে। উনি কনভেয়ার বেল্ট থেকে লাগেজ নিয়েই আসছেন। আমি ভৈঁরোর সাথে খানিক খেজুরে গল্প করলাম। মুসৌরির আবহাওয়া, বিয়ের তোরজোড় ইত্যাদি নিয়ে।
"ওই তো, সাব এসে গিয়েছেন।" ভৈঁরোর কোথায় সম্বিত ফিরল। ফোন থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম যাকে, মুহূর্তে আমার হৃৎপিণ্ড দু তিনটে বিট মিস করলোই করল। ঠিক আগের মতোই। নীল জিন্স, লাল কালো চেক শার্ট আর চোখে কেতাদুরস্ত সানগ্লাস পরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে সম্রাট। সম্রাট চট্টোপাধ্যায়। একদা আমাদের এম বি এ ক্লাসের ক্লাসমেট। তার চেয়েও বড় কথা, আমার প্রাক্তন প্রেমিক।
২।
সালটা ২০১১। তখন সবে যাদবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে এম বি এ পড়তে ঢুকেছি। প্রথম বাড়ির বাইরে থাকা। হোস্টেল জীবন। পড়ার চাপ। র্যাগিং। সব মিলিয়ে মন খারাপ করেই অবসর কাটত। অবশ্য লেখাপড়ার এত চাপ থাকত, রোজ রোজ একেকটা অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করা, ক্লাসের পড়া রেডি করা, হঠাৎ হঠাৎ সারপ্রাইজ কুইজ, সব মিলিয়ে নাজেহাল। বরাবর স্কুল আর কলেজ টপার আমি। তাতেও হিমশিম খেতাম এম বি এর কারিকুলামে। ব্যাচের সকলের সাথেও আলাপ হয়নি সেরকমভাবে, কিছু বন্ধু বান্ধব হয়েছিল সেকশনে, ওইটুকুই। এরই মধ্যে একদিন আমাদের ব্যাচের থেকে কিছু লোকজন ঠিক করল, সব সেকশন মিলে মিড সেমেস্টারে একটা উইকেন্ডে বেড়াতে যাওয়া হবে। উদয়পুর। এই উপায়ে সকলের সাথে সকলের বেশ পরিচিতি হবে। বেড়াতে আমি ভালোইবাসি। আর রাজস্থান বেড়াতে যাওয়ার শখ অনেকদিন ধরেই। তাই না করিনি। কে জানত, এই ট্রিপই আমূল বদলে দেবে আমার জীবন। এনে দেবে এই নিস্তরঙ্গ জীবনে ঝঞ্ঝা।
বৃহস্পতিবার বিকেলে আমাদের ১০০ জনের দল চারটে বড় বাস নিয়ে রওনা দিলাম। যেহেতু এই ট্রিপের মূল কারণ বা লক্ষ্যই ছিল একে অপরের সাথে মেলামেশা হওয়া, পরিচিতি বাড়া, তাই সিটিং এরেঞ্জমেন্টও ছিল বেশ অভিনব। লটারিতে ঠিক হবে এই পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা কে কার সাথে বসবে। উদয়পুর পৌঁছনর আগে আবার বাসে লটারি হয়েছিল কে কার রুমমেট হবে। আমি যে চিরকুট দুটি তুলেছিলাম, তাতে আমার বাস সঙ্গী ছিল সম্রাট। আর রুমমেট পারুল। সম্রাটের পাশে বসবে সম্রাজ্ঞী, ব্যাচের যে কজন বাঙালি ছিল, তারা দায়িত্ব নিয়ে এই জোড়ির গল্প গোটা ব্যাচকে বুঝিয়ে দিল। আর কী, সারা রাস্তা আমাদের দুজনকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা হইহই হল। সুমন থেকে থেকেই রব নে বনা দি জোড়ির টাইটেল ট্র্যাক গাইতে লাগল। সম্রাটের সাথে আমার আলাপ ছিল না আগে। ও ছিল সেকশন এ তে। আর আমি, সেকশন বি। বরাবরের প্রগল্ভ আমি, লোকজনের উৎপাত থেকে কোনক্রমে নিজেকে বাঁচিয়ে নিজেই যেচে আলাপ করলাম। শুনলাম, ও প্রবাসী বাঙালি। জন্ম থেকেই নাগপুরে থাকে। ওর বাবা ওখানের এক কলেজের প্রফেসর। হিন্দি ফিল্ম আর কান্ট্রি ফোকের পোকা। আমারও মোটামুটি পছন্দের বিষয় এগুলিই। পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা এই নিয়ে আলোচনা করতে করতে কখন যে কেটে গেল, খেয়ালই নেই। মনে আছে, ওর বাংলা ফোক সং নিয়ে তেমন ধারণা নেই শুনে আমি বেশ কয়েকটা গান গেয়ে শুনিয়েছিলাম। আমার গানের গলার প্রশংসা পেলাম উপহারে। তবে সবচেয়ে বড় উপহার, বা বলা যায়, স্মরণীয় উপহার পেলাম, তা ছিল সম্রাটের বন্ধুত্ব। আগামী তিনদিন এত ভালো কেটেছিল, ঠিক যেন স্বপ্ন। উদয়পুর লেকে সূর্যাস্ত দেখা, নৌকাভ্রমণ, সিটি প্যালেসের ঐশ্বর্য্য জৌলুসে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া...প্রতি মুহূর্ত বন্ধুদের সাথে, বিশেষ করে সম্রাটের সাথে ঘুরে ভীষণ উপভোগ করেছিলাম। ফেরার পথে আর আমাদের সিটিং নিয়ে কিছু আলাদা ব্যবস্থা ছিল না। যে যার পাশে বসা যাবে। অদ্ভুতভাবে আমার পাশের জায়গায় ঠিক সম্রাট এসে বসেছিল।
দেখতে দেখতে দিন গেল। সম্রাটের সাথে আমার বন্ধুত্ব আরো নিবিড় হতে থাকল। সময় সুযোগ থাকলেই লাইব্রেরি গিয়ে পড়াশোনা করা, এক সাথে এসাইনমেন্ট সল্ভ করা, পড়তে পড়তে মাথা জ্যাম হয়ে গেলে রাস্তার ওপারে চায়ের দোকানে গিয়ে একটু বিরাম নেওয়া... একদিন হঠাৎ বুঝলাম, কবে যেন আমরা শুধুই ভালো বন্ধুর গণ্ডি পেরিয়ে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছি পরের ধাপে। হাসি মজার মধ্যে দিয়েই লেখাপড়া, ঘুরে বেড়ানো, দেখতে দেখতে কোর্স শেষ হলো। প্লেসমেন্টে দুজনে দুই জায়গায় চাকরি পেলাম। আমি দিল্লি। সম্রাট চেন্নাই। অবশ্যই মাঝে মাঝেই একে অপরের কাছে চলে আসব, দেখা করব, এই সমস্ত কথা দেয়া নেওয়া চলল।
প্রথম এক বছর মোটামুটি তেমনভাবে চললও। লং উইকেন্ড পেলেই হয় আমি চেন্নাই নয় সম্রাট দিল্লি এসে যেত। ছুতোয় নাতায় কাজ নিয়ে চলে যেতাম চেন্নাই। বা ও আসত বোম্বে। আমি ছুটি ম্যানেজ করে সেখানে চলে যেতাম। দুই পক্ষের বাড়িতেই আমাদের কথা জানত। এক আধ বার আমরা কবে বিয়ে করেছি, এই মর্মে কথাবার্তা উঠেছে। দুজনেই কেরিয়ারে আরো উন্নতি করব, তারপর গাঁটছড়া বাঁধব, এই বলে সাময়িকভাবে কথা এড়াতাম। তবে মনে মনে বিয়ে নিয়ে যে অল্প বিস্তর স্বপ্ন দেখতাম, স্বীকার করতে লজ্জা নেই। সম্রাটকে বলেওছিলাম। তবে ও পাত্তা দিত না। ক্রমে কাজকর্মের দোহাই দিয়ে আমাদের মধ্যে আসতে শুরু করল দূরত্ব। দিনে দুই তিনবার ফোন কলের বদলে সপ্তাহে দুদিন ভিডিও কল, তারপর তাও কমতে কমতে মাসে এক দুই দিন। এক সাথে কোথাও যাওয়া নেই। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো আমার ট্রান্সফার হয়ে গেল স্কটল্যান্ডের অপরূপ সুন্দর শহর, গ্লাসগো। দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে চেষ্টা করেছিলাম দেখা করার সম্রাটের সাথে। কিন্তু ও সময় দিতে পারেনি। মন খারাপ নিয়েই গেলাম গ্লাসগো।
ওখান থেকে কয়েকবার কথা হয়েছে, অন্য টাইমজোন হয়ে দাঁড়িয়েছে পথের কাঁটা। তারপর আর তাও না। বুঝতাম সম্রাট আমায় এড়িয়ে যাচ্ছে। মেসেজের উত্তর নেই। আমার জন্মদিনে পর্যন্ত যোগাযোগ নেই। আমি বোকা মেয়ে। ভেবেছিলাম হয়তো আমায় সারপ্রাইজ দিতে গ্লাসগো আসবে। সারাদিন অফিস করতে করতে এই চিন্তাই মাথার মধ্যে খেলছিল আমার। দুদিন পরে ফেসবুকে দেখলাম আমার জন্মদিনের দিন সম্রাট ছিল অফিস পার্টিতে। ঝকঝকে পার্টি। হাসি খুশি মানুষজন। খাদ্য আর পানীয়ের অফুরান ব্যবস্থা। নতুন পরিবেশ। নতুন লোক। সম্রাটকে দেখে মনেই হলো না আমায় মিস করে বলে।
ফেসবুকের থেকেই তারপর একদিন জানতে পারলাম সম্রাট সিডনি ট্রান্সফার হচ্ছে। একবার ভেবেওছিলাম শুভেচ্ছা জানাই। কে জানে কী হলো, জানালাম না। "গাট ফিলিং" হয়তো একেই বলে। ভাগ্যিস জানাইনি। কারণ তিন সপ্তাহ পর দেখলাম সম্রাটের নতুন আপডেট। "ইন এ রিলেশনশিপ উইথ স্বপ্না মেরহোত্রা"। স্টক করে দেখলাম স্বপ্না ওর কলিগ। ব্যাঙ্গালোর অফিস থেকে সিডনি গিয়েছে। কলেজের গ্রুপের বন্ধুদের সাথে তেমন আর বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। শুধু মেঘার সাথে নিয়মিত কথা হতো। ও জানতো আমার আর সম্রাটের সম্পর্কের কথা। মেঘার তৎকালীন বয়ফ্রেন্ড, বর্তমানে হবু বর স্বাধীনের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল সম্রাট। মেঘা আর স্বাধীন খুব আঘাত পেয়েছিল এই ঘটনাটির পর। একদিন স্কাইপ কলে আমি আর মেঘা দুইজনে অনেক অনেক কান্নাকাটি করলাম। তারপর "এগিয়ে চলতে হবে, যে আমার সাথে এমন করতে পারল, তার মতো খারাপ কেউ হতেই পারেনা। তার জন্য কান্নাকাটি করতে যাওয়া মানে নিজেকে অপমান করা।" এই সব ভেবে আমি এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। হ্যাঁ, চেষ্টা। আজও যখন তিন বছর কোনোরকম যোগাযোগ না রেখেও ওকে দেখে এরকম বুকের মধ্যে আনচান করে ওঠা... সত্যি কি আমি "মুভ অন" করতে পেরেছি? এতই কি সহজ?
৩।
প্রাথমিক ভ্যাবাচ্যাকা কাটিয়ে দুজনেই দুজনকে দেখে হাসলাম।
"কেমন আছিস, আই মিন, কেমন আছেন?" থমকে গিয়ে বললাম আমি।
"ভালো আছি। চলছে এক রকম। তুই? আর হ্যাঁ, প্লিজ আপনি আজ্ঞে করিস না। অদ্ভুত লাগে।" করমর্দন করতে করতে সম্রাট বললো। প্রয়োজনের চেয়ে কি একটু বেশিই সময় আমরা একে অপরের হাত ধরেছিলাম? কে জানে।
ভৈঁরো সিং এর ডাকে আমরা গাড়ির ভিতর ঢুকলাম। দুজনের লাগেজ পিছনে চালান হয়ে গিয়েছে। মাঝের সিটে দুই জানলার ধারে আমরা দুজন। আমার হ্যান্ডব্যাগটা দুজনের মধ্যের যেন এক প্রাচীর সৃষ্টি করেছে। গাড়ি চলছে মুসৌরির দিকে। জানলার কাঁচ নামানো ছিল আমার দিকে অল্প। ঠান্ডা হাওয়া মুখের ওপর পড়ায় খুব আরাম লাগছিলো। একবার বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সম্রাট মাফলার বের করেছে নিজের ব্যাকপ্যাক থেকে। আঁটোসাঁটো করে গলায় জড়িয়ে নিচ্ছে।
"জানলার কাঁচ তুলে দেব?" জিজ্ঞেস করলাম।
ও বললো, "না থাক।"
"খবর কী তোর, বল। অফিস কোথায় এখন?"
"এই তো। আপাতত কোম্পানি ইস্টার্ন জোনে এক্সপ্যান্ড করছে। তাই কলকাতায় হেডকোয়ার্টার সামলাচ্ছি।" হাসল সম্রাট।
"ফাইনালি তাহলে কলকাতা গেলি। কেমন লাগছে শহরটা?"
"উম, মন্দ না। এক সময় এত গল্প শুনেছি।"
সেই। কত গল্পই না করেছি আমি। শহরটাকে আমি বড্ড ভালোবাসি। আর তাই তার প্রতিটি আনাচে কানাচে ঘুরিয়েছিলাম সম্রাটকে আমার কথার মাধ্যমে। ভিক্টরিয়া হোক কি ময়দান, কলেজ স্ট্রিট বা গড়িয়াহাট, সল্ট লেক হোক কি বেহালা, পুরো কলকাতা আমার নখদর্পনে। কলকাতার গল্প করতে এত ভালোবাসতাম। কেন কে জানে?
বুঝলাম সম্রাটও সেই একই কথাই ভাবছে। আর তাই অপ্রস্তুতও বোধ করছে। কথায় কথা বাড়ে। আমি কিছু বললাম না। আবার জানলার বাইরে তাকিয়ে রইলাম। দুইবপাশে ঘন সবুজ রাশি। আকাশ পরিষ্কার। এমন নীল আকাশ কতদিন দেখিনা... নৈসর্গিক শোভা বড়ই অপূর্ব। মেঘার কাছে ছবি দেখেছি। আজ চাক্ষুস দেখে যেন আরো মোহাচ্ছন্ন লাগছিলো আমার।
মাঝে একটা জায়গায় আমরা গাড়ি থামালাম। দাঁড়িয়ে গরম গরম চা খেলাম। দেখলাম সম্রাট এখনও বেশি গরম কাপ ধরতে পারে না। কলেজ জীবনে আমার দুপাট্টা জড়িয়ে চায়ের গ্লাস ধরত। আজ দেখলাম স্বাবলম্বী হয়েছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে ধরল। পটাপট কিছু ছবি তুলে ওয়াটসঅ্যাপে দিলাম। মেঘার বিয়ে উপলক্ষ্যে বানানো গ্রুপে। কেউ কেউ রিপ্লাই দিল। ওরা আসছে সন্ধ্যেয়। সবার সাথে দেখা হবে পাঁচ বছর পর। কত গল্প বাকি। আমরা গাড়িতে উঠলাম। ভৈঁরো নিজের পছন্দের নেপালি লোকসংগীত চালিয়ে রেখেছে। কথা যেটুকু বুঝলাম, মনে হলো ভালোবাসার গান। ও নিজেও বেশ ফুরফুরে মেজাজে গুনগুন করছিল। মুখে স্মিত হাসি। দেখে ভালো লাগছিলো আমার।
দু ঘন্টার একটু পর আমরা প্রায় যখন মুসৌরি শহরে ঢুকছি, মেঘার ফোন এলো আমার মোবাইলে। কতদূর এসেছি জানতে চাইলো। বললাম।
"শোন না, তুই কিন্তু প্লিজ আমার ওপর রাগ করিস না সম্রাজ্ঞী। সম্রাটকে কিন্তু আমি ইচ্ছে করে তোর গাড়িতে আনাইনি। ওকে আনতে যে গাড়ির যাওয়ার ছিল, আজ সকালে ওর ড্রাইভার ক্যানসেল করল। আমার আর কোনো উপায় ছিল না। বিশ্বাস কর। সো সরি।" মেঘার কথা শুনে আমি অল্প হাসলাম। "আরে না না। কোনো ব্যাপার না। অসুবিধে হয়নি। তুই চিন্তা করিস না। এই এখনই পৌঁছবো। গিয়ে দেখা হচ্ছে। কান্ট ওয়েট টু সি ইউ উড বি ব্রাইড!"
"আর কতক্ষণ ভৈঁরো?" আমি জিজ্ঞেস করলাম।
"মেমসব, আর পনেরো বিশ মিনিট। জ্যাম নেই ভাগ্যিস আজ।"
বাইরে হাওয়াটা ভালোই বইছে। সবে বেলা আড়াইটা পেরিয়েছে, এরই মধ্যে রোদের তেজ কমতে শুরু করেছে। একটু একটু কুয়াশার চাদর সবে জড়াতে শুরু করেছে পথঘাটকে। আমি হ্যান্ডব্যাগ থেকে স্টোলটা বের করে গায়ে জড়িয়ে নিলাম। দেখলাম সম্রাট আমার দিকে তাকিয়ে। কিছু কি বলবে? আমি কোনো কথা বললাম না। মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।
আমাদের গাড়িটা একটা বাড়ির সামনে এসে থামল। বিরাট বাড়ি। গেটে ফুল দিয়ে সাজানো হচ্ছে। লম্বা করে টুনি বাল্ব লাগানো। বুঝলাম এটাই মেঘার বাড়ি। সাজগোজ দেখেই বোঝা যায় যে এটি একটি উৎসবের বাড়ি।
এইবার নামতে হবে। ভৈঁরো সিং নেমে লাগেজ নামাতে গেল। আমিও নামতে যাচ্ছিলামই, এমন সময় সম্রাট আমার হাতটা চেপে আটকালো। আমি অবাক হয়েই তাকালাম ওর দিকে।
"সম্রাজ্ঞী, আই এম ভেরি সরি ফর এভরিথিং। তুই প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দিস পারলে। আই নো আই হ্যাভ রংড ইউ।"
আমি তাকিয়েই রইলাম ওর দিকে। তারপর কিচ্ছু না বলে হাতটা ছাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে এলাম। মুখে চওড়া হাসি। মেঘাও এর মধ্যে এসে গিয়েছে গেটে। এতদিন পর প্রাণের বন্ধুকে পেয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরলাম। পুরোনো কথা নিয়ে ভাবার এখন সময় নেই। আগামী কটাদিন হোক সুন্দর। সেই আশাতেই থাকবো আমি। আর সবচেয়ে বড় কথা। টের পেলাম, সম্রাটের কথায় বা আচরণে আমি আর একটুও বিচলিত হলাম না। হয়তো এই দু ঘন্টার যাত্রাপথটা খুব প্রয়োজন ছিল, আমাদের ক্লোজারের জন্য। কে জানে... ভালো থাকে ভালোবাসা।
Friday, November 9, 2018
ভাইফোঁটা
ছোটবেলা থেকে আজকের দিনটা নিয়ে প্রচণ্ড উৎসাহ থাকত। সপ্তাহখানেক আগে থেকে মা আর আমি বসতাম মেনু ঠিক করতে। ভাত হবে না পি-পোলাউ, নিরামিষে ভাজা মুগ ডাল নাকি মাছের মাথা দিয়ে হবে, এই নিয়ে বিস্তর আলোচনা পর্ব চলত। তবে কিছু আইটেম একেবারে বাঁধাধরা ছিল। ভেটকি মাছের ফিলে দিয়ে ফিস ফ্রাই, মাটন আর জলপাইয়ের চাটনি। দাদাভাই আর মামার আবার মাছের পছন্দ আলাদা। তাই দুই তিন রকমের মাছের ব্যবস্থাও করতে হবে। প্রচুর আলাপ আলোচনার পর মা ফর্দ ধরিয়ে দিত বাবার হাতে। বাবা দুদিন আগে অফিস ফেরতা লেক মার্কেট থেকে মাছ কিনে আনত। আর মা যাদবপুরের একটা নির্দিষ্ট দোকান থেকে পাঁঠার মাংস কিনে আনত।
তখন কত ছোট। মাসে একশো টাকা করে পকেট মানি পাই। সারা বছর ওই জমানো টাকা দিয়ে একে তাকে গিফট কিনে দিই। সেই টাকা দিয়েই দাদাভাইয়ের জন্যও ভাইফোঁটার উপহার নিতে হবে। কী দেওয়া যায়, কী দেওয়া যায়। সেই আবার মা আর আমার ব্রেনস্টরমিং সেশন চলত। তারপর কোন বছর সুতোর কাজ করা পাঞ্জাবি তো কোন বছর অরিফ্লেমের পারফ্যুম। বা কখনও মানি ব্যাগ। যে বছর যেমন সাধয়ে কুলতো। আমার আবার প্রচণ্ড আত্মাভিমান এইসব বিষয়ে। এমনকি ভাইফোঁটার মিষ্টি যেটা দাদাভাইয়ের জন্য কিনব, সেটাও নিজের ট্যাঁক থেকে।
প্রতিপদের দিন বিকেল বিকেল মা আর আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম লর্ডসের মোড়ে কল্পনায়। কী উপচে পড়া ভিড়। তার মধ্যে থেকে বাছাই করে দাদাভাই আর আমআমর জন্য সাত রকমের মিষ্টি আর নোন্তা কিনতাম। তার মধ্যে ভাইফোঁটা লেখা সন্দেশ আর খাজা মাস্ট! এছাড়াও দুপুরের খাবারের পর লাল দই আর রসগোল্লা সকলের জন্য নেওয়া হত।
ভাইফোঁটার দিন সকাল সকাল উঠে স্নান সেরে নতুন জামা পরে ঠাকুরঘর থেকে চন্দন কাঠ এনে বেটে রেডি রাখতাম। আসন বের করে গুছিয়ে রাখা। বাগান থেকে দুব্বো তোলাটা মা করত, আমার দ্বারা ওইটি হয় না। না খেয়ে ফোঁটা দেবো। এদিকে দাদাভাই এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে সবার কাছ থেকে ফোঁটা নিয়ে শেষমেশ আমাদের বাড়িতে আসবে। আমি বারবার ঘর বারান্দা করছি। মোবাইলের যুগে ফোন করে বারবার তাড়া দিচ্ছি। খিদেয় পেট চুঁইচুঁই। প্রতিজ্ঞা করছি, এত কষ্ট পোষায় না। সামনের বছর থেকে প্রতিপদে ফোঁটা দেবো (বরিশালের বাঙ্গাল, আমাদের আসলে প্রতিপদেই ফোঁটা)।
তারপর প্রায় বারোটা নাগাদ মামা মামী ঢুকল, মাসী এসে গিয়েছে আগেই। দাদাভাইও আসছে। শঙ্খধ্বনি, উলু দিয়ে গিফট এক্সচেঞ্জ করে ঝটপট ফোঁটা পর্ব মিটত। ইতিমধ্যে জেঠু আর বাবা পিসির বাড়ি থেকে ফোঁটা নিয়ে গিফট নিয়ে ফিরে এসেছে। বসত একটা জমাটি আড্ডা। দেড়টা দুটোর মধ্যে খেতে বসা। ব্যাচ করে। হাতে হাতে মাকে সাহায্য করা। খাবার শেষে মামা ঠিক বেরিয়ে স্পেশাল মিঠে পান নিয়ে আসত। পান চিবোতে চিবোতে চলত আরেক প্রস্থ গল্প। যাদের যাদের ঘুম পেতো, একেকটা ঘরে বিছানা দখল করে ঘুম। চারটের দিকে স্প্রাইট বা থাম্বস আপ। সাড়ে পাঁচটার দিকে চা আর রসগোল্লা।
শীত আসবো আসবো তখন। সাড়ে পাঁচটায়ই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসত। একে একে মামা মামী, মামণি (মাসী) আর দাদা সবার ফেরার পালা। কোন কোন বছর মামা বাজি নিয়ে আসত। সেই বছরগুলো দাদা আর আমি ওই ফুলঝুরি, তুবড়ি চর্কি জ্বালাতাম। বাড়তি আনন্দ। উপরি পাওনা।
পরেরদিন থেকে স্কুল অফিস সকলের। উৎসব শেষ। মন খারাপের রেশ।
এই বছরেরটা নিয়ে ছয় বছর হল এই ভাইফোঁটায় দাদাভাইকে ফোঁটা দিতে পারলাম না। ওই ওয়াটসআপে শুধু শুকনো মেসেজ করেছি বটে, কিন্তু এই অনুভূতিগুলো আসেই না। সকাল থেকেই তাই ভীষণ মন খারাপ।
তখন কত ছোট। মাসে একশো টাকা করে পকেট মানি পাই। সারা বছর ওই জমানো টাকা দিয়ে একে তাকে গিফট কিনে দিই। সেই টাকা দিয়েই দাদাভাইয়ের জন্যও ভাইফোঁটার উপহার নিতে হবে। কী দেওয়া যায়, কী দেওয়া যায়। সেই আবার মা আর আমার ব্রেনস্টরমিং সেশন চলত। তারপর কোন বছর সুতোর কাজ করা পাঞ্জাবি তো কোন বছর অরিফ্লেমের পারফ্যুম। বা কখনও মানি ব্যাগ। যে বছর যেমন সাধয়ে কুলতো। আমার আবার প্রচণ্ড আত্মাভিমান এইসব বিষয়ে। এমনকি ভাইফোঁটার মিষ্টি যেটা দাদাভাইয়ের জন্য কিনব, সেটাও নিজের ট্যাঁক থেকে।
প্রতিপদের দিন বিকেল বিকেল মা আর আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম লর্ডসের মোড়ে কল্পনায়। কী উপচে পড়া ভিড়। তার মধ্যে থেকে বাছাই করে দাদাভাই আর আমআমর জন্য সাত রকমের মিষ্টি আর নোন্তা কিনতাম। তার মধ্যে ভাইফোঁটা লেখা সন্দেশ আর খাজা মাস্ট! এছাড়াও দুপুরের খাবারের পর লাল দই আর রসগোল্লা সকলের জন্য নেওয়া হত।
ভাইফোঁটার দিন সকাল সকাল উঠে স্নান সেরে নতুন জামা পরে ঠাকুরঘর থেকে চন্দন কাঠ এনে বেটে রেডি রাখতাম। আসন বের করে গুছিয়ে রাখা। বাগান থেকে দুব্বো তোলাটা মা করত, আমার দ্বারা ওইটি হয় না। না খেয়ে ফোঁটা দেবো। এদিকে দাদাভাই এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে সবার কাছ থেকে ফোঁটা নিয়ে শেষমেশ আমাদের বাড়িতে আসবে। আমি বারবার ঘর বারান্দা করছি। মোবাইলের যুগে ফোন করে বারবার তাড়া দিচ্ছি। খিদেয় পেট চুঁইচুঁই। প্রতিজ্ঞা করছি, এত কষ্ট পোষায় না। সামনের বছর থেকে প্রতিপদে ফোঁটা দেবো (বরিশালের বাঙ্গাল, আমাদের আসলে প্রতিপদেই ফোঁটা)।
তারপর প্রায় বারোটা নাগাদ মামা মামী ঢুকল, মাসী এসে গিয়েছে আগেই। দাদাভাইও আসছে। শঙ্খধ্বনি, উলু দিয়ে গিফট এক্সচেঞ্জ করে ঝটপট ফোঁটা পর্ব মিটত। ইতিমধ্যে জেঠু আর বাবা পিসির বাড়ি থেকে ফোঁটা নিয়ে গিফট নিয়ে ফিরে এসেছে। বসত একটা জমাটি আড্ডা। দেড়টা দুটোর মধ্যে খেতে বসা। ব্যাচ করে। হাতে হাতে মাকে সাহায্য করা। খাবার শেষে মামা ঠিক বেরিয়ে স্পেশাল মিঠে পান নিয়ে আসত। পান চিবোতে চিবোতে চলত আরেক প্রস্থ গল্প। যাদের যাদের ঘুম পেতো, একেকটা ঘরে বিছানা দখল করে ঘুম। চারটের দিকে স্প্রাইট বা থাম্বস আপ। সাড়ে পাঁচটার দিকে চা আর রসগোল্লা।
শীত আসবো আসবো তখন। সাড়ে পাঁচটায়ই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসত। একে একে মামা মামী, মামণি (মাসী) আর দাদা সবার ফেরার পালা। কোন কোন বছর মামা বাজি নিয়ে আসত। সেই বছরগুলো দাদা আর আমি ওই ফুলঝুরি, তুবড়ি চর্কি জ্বালাতাম। বাড়তি আনন্দ। উপরি পাওনা।
পরেরদিন থেকে স্কুল অফিস সকলের। উৎসব শেষ। মন খারাপের রেশ।
এই বছরেরটা নিয়ে ছয় বছর হল এই ভাইফোঁটায় দাদাভাইকে ফোঁটা দিতে পারলাম না। ওই ওয়াটসআপে শুধু শুকনো মেসেজ করেছি বটে, কিন্তু এই অনুভূতিগুলো আসেই না। সকাল থেকেই তাই ভীষণ মন খারাপ।
Thursday, November 8, 2018
sad ভাইফোঁটা
ভাইফোঁটার দিনে ভাই বোনের ঝগড়া করাটা যেন একটা ট্র্যাডিশন হয়ে গিয়েছে। পাঁচ থ্বেকে পনেরো ছিল সকালে ভাইফোঁটা সন্দেশ আর খাজা নিয়ে কাড়াকাড়ি আর তারপর দুপুরে খেতে বসে মাটনের পিস আর ফিস ফ্রাই খাওয়া নিয়ে কম্পিটিশন।
দিন বদলায়। বছরের পর বছর কেটে যায়। ঝগড়া থামে না। শুধু পাল্টে যায় কারণ।
মধ্যবয়স্ক দুই ভাই বোন আজও ঝগড়া করে। মায়ের মান্তাসা চন্দ্রহার কে ভাগে পাবে, এই নিয়ে...
দিন বদলায়। বছরের পর বছর কেটে যায়। ঝগড়া থামে না। শুধু পাল্টে যায় কারণ।
মধ্যবয়স্ক দুই ভাই বোন আজও ঝগড়া করে। মায়ের মান্তাসা চন্দ্রহার কে ভাগে পাবে, এই নিয়ে...
ভাই-জোনড
তন্ময়, শুভ্র, আকাশ, দেবারুণ এক্কেবারে যাকে বলে সেই হাফ প্যান্টের বয়স থেকে বন্ধু। এক স্কুল এক পাড়া। সৌভাগ্যবশত কাজের সূত্রেও চারজনই এখনও কলকাতায় আর তাই নিয়মিত আড্ডা বসে ওদের পাড়ার মোড়ের পান সিগারেটের দোকানে। সেরকমই এক আসর আজও বসেছে। কালীপূজো দেওয়ালি শেষ। পরশু থেকে আবার সব অফিস। সকলেই প্রায় মনমরা। ব্যতিক্রম দেবারুণ। বাকিরা দেখছে দেবা সেই আসা ইস্তক ফুরফুরে মেজাজে আছে। মন মেজাজ দিব্যি ভালো। এতটাই ভালো যে কিপ্টে বলে বদনাম যার, সেই দেবাই আজ বাকিদের লেমন সোডাও খাওয়াল। শুভ্র তন্ময় আর আকাশ একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। বলি হল টা কী ওদের বন্ধুর?
শেষমেশ শুভ্র আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, "দেবা ব্যাপার কী রে? আজ এত উড়ছিস? কী কেস? ঝুম্পা গ্রিন সিগনাল দিল নাকি?" ঝুম্পা দেবারুণের কলিগ। এই সুন্দরী মেয়েটিকে বেশ কিছু মাস ধরেই পটানোর চেষ্টা করছে দেবা। বন্ধুরা নিয়মিত আপডেট পায় অবশ্য। এখনও অবধি তেমন আশার কিছু দেখেনি।
দেবা একটু লাজুক মুখ করে হেসে বলল, " হ্যাঁ মানে মনে তো হচ্ছে তাই।"
"আরেএএএএ ভাই ভাই ভাই..." বাকি তিনজন পিঠ চাপড়ে "কী ব্যাপার, কী হল, কী করে হল" ইত্যাদি প্রশ্নবাণ হানল দেবারুণের দিকে।
দেবা সেই একইরকম লাজুক লাজুক মুখ করে বলল, "সেদিন আমি ওর টিফিনের মাংস টেস্ট করে এত প্রশংসা করেছিলাম, ও বলেছিল একদিন বাড়িতে নেমন্তন্ন করে খাওয়াবে। তা একটু আগে মেসেজ করলো, বলল কাল ও নাকি অনেক রান্নাবান্না করবে। আমায় যেতে বলল ওর বাড়ি। খাওয়াবে।"
শুভ্র আকাশের দিকে, আকাশ তন্ময়ের দিকে আর তন্ময় শুভ্রর দিকে তাকাল। বেশ সিরিয়াস মুখ করেই। তারপর রীতিমত একই সাথে তিনজনে বলল, "ভাই তুই তো গেলি।"
দেবারুণ অবাক হয়ে বলল, "মানে? কী কেস?"
"ভাই, বুঝছিস না। কাল ভাইফোঁটা রে।"
"তো?"
"আরে এত রেঁধে বেড়ে তোকে ভাইফোঁটার দিনে বাড়িতে ডাকছে। বুঝছিস না? ভাই, তুই তো গেলি..."বলতে বলতে প্রবল অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়ল ওরা তিনজন। আর দেবারুণ? ওর মুখটা যেন ঠিক চুপসানো ফানুস একটা।
শেষমেশ শুভ্র আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, "দেবা ব্যাপার কী রে? আজ এত উড়ছিস? কী কেস? ঝুম্পা গ্রিন সিগনাল দিল নাকি?" ঝুম্পা দেবারুণের কলিগ। এই সুন্দরী মেয়েটিকে বেশ কিছু মাস ধরেই পটানোর চেষ্টা করছে দেবা। বন্ধুরা নিয়মিত আপডেট পায় অবশ্য। এখনও অবধি তেমন আশার কিছু দেখেনি।
দেবা একটু লাজুক মুখ করে হেসে বলল, " হ্যাঁ মানে মনে তো হচ্ছে তাই।"
"আরেএএএএ ভাই ভাই ভাই..." বাকি তিনজন পিঠ চাপড়ে "কী ব্যাপার, কী হল, কী করে হল" ইত্যাদি প্রশ্নবাণ হানল দেবারুণের দিকে।
দেবা সেই একইরকম লাজুক লাজুক মুখ করে বলল, "সেদিন আমি ওর টিফিনের মাংস টেস্ট করে এত প্রশংসা করেছিলাম, ও বলেছিল একদিন বাড়িতে নেমন্তন্ন করে খাওয়াবে। তা একটু আগে মেসেজ করলো, বলল কাল ও নাকি অনেক রান্নাবান্না করবে। আমায় যেতে বলল ওর বাড়ি। খাওয়াবে।"
শুভ্র আকাশের দিকে, আকাশ তন্ময়ের দিকে আর তন্ময় শুভ্রর দিকে তাকাল। বেশ সিরিয়াস মুখ করেই। তারপর রীতিমত একই সাথে তিনজনে বলল, "ভাই তুই তো গেলি।"
দেবারুণ অবাক হয়ে বলল, "মানে? কী কেস?"
"ভাই, বুঝছিস না। কাল ভাইফোঁটা রে।"
"তো?"
"আরে এত রেঁধে বেড়ে তোকে ভাইফোঁটার দিনে বাড়িতে ডাকছে। বুঝছিস না? ভাই, তুই তো গেলি..."বলতে বলতে প্রবল অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়ল ওরা তিনজন। আর দেবারুণ? ওর মুখটা যেন ঠিক চুপসানো ফানুস একটা।
Monday, November 5, 2018
দীপ্তি
রাত্তির প্রায় আটটা। প্লেনটা গত দশ মিনিট ধরে কলকাতা এয়ারপোর্টের ওপর চক্কর কাটছিল। এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটের উইন্ডো সিট থেকে তিলোত্তমা শহরটিকে দেখে গুঞ্জার মনে হচ্ছিল যেন একটা দামী নেকলেস। ঠিক যেরকম দেখেছিল ও মা, আশাবরীর কর্মস্থলে। কালীপুজোর আগে কয়েকদিন দোকানে খুব ভিড় থাকত, মায়ের ফিরতে অনেক দেরি হত। দিদিমার কাছে বসে স্কুলের পড়া শেষ করে বারান্দায় বসে গল্প শুনত, যতক্ষণ না মা ফিরছে। রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে ছোট্ট গুঞ্জা পৌঁছে যেত সব পেয়েছির দেশে। ওর বাস্তবের সাথে দেখানে অনেক অমিল।
আশাবরীর সাথে আবীরের প্রেমজ বিয়ে হয়। মধ্যবিত্ত ঘরের সুশ্রী তন্বী আশার সাথে আবীরের পরিচয় একটি জন্মদিনের পার্টিতে। আবীরের ভাগ্নির জন্মদিন। আশাবরী ছিল ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির লোক। আবীরের পরিবার মধ্যবিত্ত ঘরের শ্যামলা মেয়েকে প্রথমে মানতে নারাজ হলেও পরে ছেলের জোরাজুরিতে বাধ্য হয় বিয়েতে মত দিতে। বছর খানেকের পর যখন আশার কোল জুড়ে গুঞ্জা আসে, শ্বশুরবাড়ির লোকজন রীতিমতো ছি ছি করেছিল। একেই মেয়ে, তার ওপর মায়ের মতোই শ্যামলা। এক বস্ত্রে সদ্যোজাত মেয়েকে নিয়ে আশা বেরিয়ে আসে সেদিন। আশ্রয় পায় নিজের মায়ের কাছে।
একা হাতে চাকরি করে সংসার চালাত আশাবরী। কোনদিনও মেয়ের লেখাপড়ায় কোন কমতি করেনি। যথাসাধ্য শখ আহ্লাদ পূর্ণ করেছে। তবে গুঞ্জা বুঝত মায়ের দুঃখ। মায়ের সংগ্রাম। আর তাই ছোট্টবেলা থেকেই গুঞ্জার তেমন আবদার ফরমায়েশ ছিল না। বছরের পর বছর ধন্তেরসের দিন মা গল্প করত সেদিন দোকানের বিক্রির কথা। সামর্থ্যের মধ্যে হয়তো কোন বছর জুটত রূপোর দুল। কখনও হয়তো এক কুচি সোনার ফুল।
গুঞ্জা এখন সুপারমডেল। একের পর এক মঞ্চ কাঁপিয়ে বেড়ায়। দেশে বিদেশে। বর্তমানে দেশের এক জনপ্রিয় গয়নার দোকানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। শহরের আনাচে কানাচে ওর ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন। বিভিন্ন গয়না পরে, বিভিন্ন পোশাকে, বিভিন্ন ভঙ্গিতে।
আজ ধন্তেরস। গুঞ্জা আজ মায়ের জন্য ওর বিজ্ঞাপনে পরা সবচেয়ে পছন্দের সেটটি কিনে এনেছে। মায়ের গলায় পরিয়ে তবে শুরু হবে ওর আলোর উৎসব। মায়ের চোখে মুখে যে দীপ্তি দেখবে ও, সেটাই ওর পরম প্রাপ্তি।
আশাবরীর সাথে আবীরের প্রেমজ বিয়ে হয়। মধ্যবিত্ত ঘরের সুশ্রী তন্বী আশার সাথে আবীরের পরিচয় একটি জন্মদিনের পার্টিতে। আবীরের ভাগ্নির জন্মদিন। আশাবরী ছিল ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির লোক। আবীরের পরিবার মধ্যবিত্ত ঘরের শ্যামলা মেয়েকে প্রথমে মানতে নারাজ হলেও পরে ছেলের জোরাজুরিতে বাধ্য হয় বিয়েতে মত দিতে। বছর খানেকের পর যখন আশার কোল জুড়ে গুঞ্জা আসে, শ্বশুরবাড়ির লোকজন রীতিমতো ছি ছি করেছিল। একেই মেয়ে, তার ওপর মায়ের মতোই শ্যামলা। এক বস্ত্রে সদ্যোজাত মেয়েকে নিয়ে আশা বেরিয়ে আসে সেদিন। আশ্রয় পায় নিজের মায়ের কাছে।
একা হাতে চাকরি করে সংসার চালাত আশাবরী। কোনদিনও মেয়ের লেখাপড়ায় কোন কমতি করেনি। যথাসাধ্য শখ আহ্লাদ পূর্ণ করেছে। তবে গুঞ্জা বুঝত মায়ের দুঃখ। মায়ের সংগ্রাম। আর তাই ছোট্টবেলা থেকেই গুঞ্জার তেমন আবদার ফরমায়েশ ছিল না। বছরের পর বছর ধন্তেরসের দিন মা গল্প করত সেদিন দোকানের বিক্রির কথা। সামর্থ্যের মধ্যে হয়তো কোন বছর জুটত রূপোর দুল। কখনও হয়তো এক কুচি সোনার ফুল।
গুঞ্জা এখন সুপারমডেল। একের পর এক মঞ্চ কাঁপিয়ে বেড়ায়। দেশে বিদেশে। বর্তমানে দেশের এক জনপ্রিয় গয়নার দোকানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। শহরের আনাচে কানাচে ওর ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন। বিভিন্ন গয়না পরে, বিভিন্ন পোশাকে, বিভিন্ন ভঙ্গিতে।
আজ ধন্তেরস। গুঞ্জা আজ মায়ের জন্য ওর বিজ্ঞাপনে পরা সবচেয়ে পছন্দের সেটটি কিনে এনেছে। মায়ের গলায় পরিয়ে তবে শুরু হবে ওর আলোর উৎসব। মায়ের চোখে মুখে যে দীপ্তি দেখবে ও, সেটাই ওর পরম প্রাপ্তি।
Friday, November 2, 2018
SRK and me
একদম ছোটবেলায় যখন প্রথম "জাদু তেরি নজর" শুনি/দেখি, তখন থেকেই লাভ (মানে ওইটুকু বয়সে আদৌ লাভ কী, বোঝা যায় না কি?) অ্যাট ফার্স্ট সাইট। নিজেকে তখন ওঁর হিরোয়িন ভাবতাম। সবাইকে বলতাম, আমার নাম জুহি চাওলা গুপ্ত!!
বাড়িতে কেবিল টিভি ছিল না। তাই রবিবারগুলো হাওড়ায় মাসির বাড়ি যাওয়ার হলেই মুখিয়ে থাকতাম। দুপুর দুটোয় লোকাল কেবিলে তখন সদ্য রিলিজ হওয়া সিনেমাগুলো দিত। মনে আছে একবার পরদেশ সিনেমাটি দেখি। যদিও ওই মারামারি রক্তারক্তি একদম দেখতে পারি না, তবুও ওই "দো দিল মিল রহে হ্যায়" শুনলে বা দেখলেই কেমন ভেবলে যেতাম।
স্কুলে বন্ধুদের দৌলতে তার পরে পরেই কুছ কুছ হোতা হ্যায়, কভি খুশি কভি ঘম এই সিনেমাগুলির কথা শুনলাম। তখন রেডিওতে ওই সিনেমার গান আর নিউজপেপার ম্যাগাজিনে হাঁ করে ছবি গিলে গিয়েছি। আনন্দলোকের পূজাবার্ষিকীগুলোতে গল্প উপন্যাসের চেয়ে গ্লসি কাগজে এস আর কের ছবিগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতে থাকতাম।
ক্লাস ইলেভেন পড়াকালীন স্কুল এক্সকারশানে ভাইজাগ গিয়েছিলাম। সেদিন রাত্রে আমাদের ক্যাম্প ফায়ার গোছের কিছু হওয়ার কথা ডিনারের পর। কেউ একজন হোটেলের ঘরে টিভি চালিয়ে দেখেছে ম্যায় হু না হচ্ছে। ব্যস। ঘরে ঘরে খবর পৌঁছে গেল। আমি যত তাড়াতাড়ি পেরেছি ঘরে এসে সিনেমা দেখেছি। একেই শাহরুখ, বাড়তি পাওনা দার্জিলিং।
প্রথম ডেস্কটপ কম্পিউটার আসে হায়ার সেকন্ডারির পর। হ্যাপি কোইন্সিডেন্স, যিনি অ্যাসেম্বল করেছিলেন, মিউজিক ফোল্ডারে চলতে চলতে সিনেমার সব গান দিয়েছিলেন। তখন সদ্য ইন্টারনেটে অভ্যস্ত হচ্ছি। ওয়েবসাইট থেকে গান ডাউনলোড করছি আর ফোনে ট্রান্সফার করছি। তখনও স্মার্টফোন আসেনি, সিম্বিয়ানে চলে। বলা বাহুল্য, সবই ভদ্রলোকের সিনেমার।
কী বা করি আর? ওই যে স্বদেশের মোহন ভারগব হোক বা চক দে ইন্ডিয়ার কবীর খান, কুছ কুছ হোতা হ্যায় হোক বা চেন্নাই এক্সপ্রেস... হাল্কা হেসে গালে টোল পড়া আর ওই ultimate romantic চাউনি... loveriaর শিকার না হয়ে থাকা যায়?
অন্তত একবার আমার দিকে ওরকম ভাবে তাকাক... জিন্দেগি আপনে আপ হসীন হয়ে যাবে...
SRK
১।
ক্লাস এইটের টিনার আজ বেশ মন খারাপ। আবার স্কুল খুলেছে পুজোর পর। এই এক মাস বাড়ি বসে দিব্যি শাহরুখ খানের সিনেমা দেখত। এখন আবার ওই টাইম অ্যান্ড ডিস্টেন্স আর কারেন্টস অফ দি প্যাসিফিক ওশেনের বোরিং ক্লাস। প্লেলিস্টে এস আর কের গান চালিয়ে ইয়ারফোন কানে ক্লাসরুমে নিজের পছন্দের ফ্রন্ট রো সিটে ব্যাগটা রাখতে গিয়ে দেখল একটি ছেলে বসে রয়েছে। নতুন স্টুডেন্ট নাকি? একে তো কখনও দেখে নি?
টিনা কিছু বলল না। ইয়ারফোনটা খুলে ব্যাগটা নিয়ে অন্য বেঞ্চের দিকে যাচ্ছিলই, ঠিক তখন ওর হাতটা ধরে আটকাল ছেলেটি। টিনা পিছন ফিরে তাকালো। হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে এটা কে? সেই একইরকম টোল গালে, চুলটা হাল্কা উসকো খুস্কো।
বন্ধুত্বের হাতটা এগিয়ে বলল, "I'm Rahul...নাম তো সুনা হোগা!"
মুহূর্তেই টিনা শুনতে পেল সেই বিখ্যাত ম্যান্ডোলিনের টুং টাং।
২।
বছর তেইশের রাজীব থাপা আর পাঁচটা নেপালী ছেলের মতোই। স্কুলের গণ্ডী পেড়িয়ে এখন মা আর মাসীর সাথে ক্ষেতি করেই দিন চলে। গান পাগল ছেলেটি রাত্রে খাওয়ার পর খোলা আকাশের নিচে প্রিয় গিটার হাতে বলিউডের গান গায় গলা ছেড়ে। ওদের পাশের বাড়ির কাকীমারা নিজেদের বাড়িটাকে ইদানীং হোমস্টে হিসেবে ভাড়া দিচ্ছে। সেখানেরই কিছু বাবুরা রাজীবের গান শুনে এক্কেবারে মুগ্ধ। ওদের নাকি কলকাতায় হোটেল আছে। বলেছে ওকে হোটেলে গান গাইবার সুযোগ দেবে। নিয়মিত টাকা আসবে।
দার্জিলিং মেল থেকে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পা রাখল রাজীব। সাদা ফুল শার্ট, কালো কোট আর কালো প্যান্ট পরে। মধ্যে মধ্যে ওর মা ওর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে। সাধের "রাজু বন গয়া gentleman!"
৩।
চায়ের দোকানের পল্টু ভারি হাসি খুশি ছেলে। বয়স ওই বারো তেরো। সকালবেলা মিউনিসিপ্যালিটির স্কুলে পড়াশোনা করে। দুপুর থেকে বাবার দোকানে হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দেয়। একটা আদ্যিকালের কালো রেডিয়োতে সারাক্ষণ বেজে চলেছে হিন্দি বাংলা গান। শুনে শুনে পল্টুর সব মুখস্থ। শারুখ খানের গানগুলো ওর হেব্বি লাগে। রেডিওর অফিসটা আবার ওদের দোকানের পিছনেই। কতবার ওই দাদা দিদিগুলোকে ও চা পৌঁছে দিয়ে এসেছে। কী রংচঙে আপিস। সবাই কী হাসিখুশি। পল্টু এক দুবার কাঁচের দরজার এপার থেকে দেখেছে কেমনভাবে মাইকের সামনে দাদা দিদিগুলো কথা বলে।ও যদি এমন সুযোগ পেতো...
শিশু দিবস উপলক্ষ্যে এই রেডিওর দিদি দাদাগুলো নাকি পল্টুর মতো ছেলে মেয়েদের সেই সুযোগ দেবে। ওরা মানে যারা লেখাপড়ার সাথে সাথে কাজকর্মওকরে, তাদের নিয়ে নাকি অনুষ্ঠান হবে। পল্টু বেজায় খুশি। ওকেও শোনা যাবে রেডিওতে।
বেশ ফিটফাট হয়ে পল্টু রেডিওর আপিসে গিয়েছে আজ। নিচে ওর বাবা রেডিওর একদম সামনে বসে আছে। অধীর অপেক্ষা। যে কোন মুহূর্তে ওর গলা শোনা যাবে। শুনতে পেল এক দিদির গলা, "তোমার নামটা বলো?"
আর তারপরেই বহু প্রতীক্ষিত সেই কণ্ঠ।
"আমায় সবাই পল্টু বলেই চেনে। কিন্তু আমার একটা ভালো নাম আছে। রাহুল। নাম তো সুনা হোগা?"
৪।
ইশ, কী কুক্ষণে যে ফোনটা চার্জ করতে ভুলে গিয়েছিল, চারজারটাও কাজ করছে না। ট্রেনের ভিতরে বসে টেনশন করতে লাগল সিমি। ইউরেল চেপে জুরিখ যাচ্ছে। অ্যানা থাকে। তবে হঠাৎ প্ল্যান বদল করে একদিন আগেই সিমি পৌঁছে যাচ্ছে। অ্যানাকে জানানো হয়নি। তাড়াহুড়োয় ভেবেছিল ট্রেনে উঠে জানিয়ে দেবে। এখন এই বিপত্তি। কী করে কী করবে ও জুরিখে? বড্ড চিন্তা হচ্ছে। ওর কামরাটাও একদম ফাঁকা। কারুর থেকে যে ফোন বা চারজার চাইবে, সেই উপায়ও নেই। এক্কেবারে কাঁদো কাঁদো অবস্থা ওর।
ট্রেন ছুটছে সুইজারল্যান্ডের ভিতর দিয়ে। অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভা। এদিকে সিমির সেদিকে চোখ নেই। সানেন স্টেশনে এক যুবক উঠল ওর কামরায়। দেখে তো ভারতীয়ই মনে হল। চোখে কালো চশমা, সাদা শার্টের ওপর গাঢ় নীল জ্যাকেট, স্কাউ ব্লু জিন্স, পিঠে ব্যাকপ্যাক।
ওর উল্টোদিকের সিটে জানলার ধারে বসল। সিমির দিকে তাকিয়ে একবার হাসল।
"এক্সকিউজ মি, ডু ইউ হ্যাভ আ মোবাইল চারজার? মাইন ইস নট ওয়ার্কিং। অ্যান্ড আই নিড টু মেক আ ভেরি ইম্পরট্যান্ট কল টু মাই ফ্রেন্ড ইন জুরিখ। মাই ফোন ইস ডেড", বলল সিমি।
"koi baat nahin senorita.. bade bade desho mein aisi chhoto chhoti baatein hoti rehti hain..."
৫।
প্রাইমারি স্কুলের খেলার মাঠ। টিফিন পিরিয়ডে ছেলেরা দৌড়ঝাঁপ করছে। আজও গাবলু ছোঁওয়াছুঁই খেলায় অক্রমের নাগাল পেল না। উফ, কী জোরে ছুটতে পারে ছেলেটা। কী দম।
"ঠিক আছে। থাম অক্রম। আমি আর ছুটতে পারবো না।"
"দেখলি তো, আজও ধরতে পারলি না আমায়?"
গাবলু একটু হেসে বলল, "জানি তো। ডন কো পকড়না মুশকিল হই নহি, না মুমকিন হ্যায়!"
ক্লাস এইটের টিনার আজ বেশ মন খারাপ। আবার স্কুল খুলেছে পুজোর পর। এই এক মাস বাড়ি বসে দিব্যি শাহরুখ খানের সিনেমা দেখত। এখন আবার ওই টাইম অ্যান্ড ডিস্টেন্স আর কারেন্টস অফ দি প্যাসিফিক ওশেনের বোরিং ক্লাস। প্লেলিস্টে এস আর কের গান চালিয়ে ইয়ারফোন কানে ক্লাসরুমে নিজের পছন্দের ফ্রন্ট রো সিটে ব্যাগটা রাখতে গিয়ে দেখল একটি ছেলে বসে রয়েছে। নতুন স্টুডেন্ট নাকি? একে তো কখনও দেখে নি?
টিনা কিছু বলল না। ইয়ারফোনটা খুলে ব্যাগটা নিয়ে অন্য বেঞ্চের দিকে যাচ্ছিলই, ঠিক তখন ওর হাতটা ধরে আটকাল ছেলেটি। টিনা পিছন ফিরে তাকালো। হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে এটা কে? সেই একইরকম টোল গালে, চুলটা হাল্কা উসকো খুস্কো।
বন্ধুত্বের হাতটা এগিয়ে বলল, "I'm Rahul...নাম তো সুনা হোগা!"
মুহূর্তেই টিনা শুনতে পেল সেই বিখ্যাত ম্যান্ডোলিনের টুং টাং।
২।
বছর তেইশের রাজীব থাপা আর পাঁচটা নেপালী ছেলের মতোই। স্কুলের গণ্ডী পেড়িয়ে এখন মা আর মাসীর সাথে ক্ষেতি করেই দিন চলে। গান পাগল ছেলেটি রাত্রে খাওয়ার পর খোলা আকাশের নিচে প্রিয় গিটার হাতে বলিউডের গান গায় গলা ছেড়ে। ওদের পাশের বাড়ির কাকীমারা নিজেদের বাড়িটাকে ইদানীং হোমস্টে হিসেবে ভাড়া দিচ্ছে। সেখানেরই কিছু বাবুরা রাজীবের গান শুনে এক্কেবারে মুগ্ধ। ওদের নাকি কলকাতায় হোটেল আছে। বলেছে ওকে হোটেলে গান গাইবার সুযোগ দেবে। নিয়মিত টাকা আসবে।
দার্জিলিং মেল থেকে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পা রাখল রাজীব। সাদা ফুল শার্ট, কালো কোট আর কালো প্যান্ট পরে। মধ্যে মধ্যে ওর মা ওর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে। সাধের "রাজু বন গয়া gentleman!"
৩।
চায়ের দোকানের পল্টু ভারি হাসি খুশি ছেলে। বয়স ওই বারো তেরো। সকালবেলা মিউনিসিপ্যালিটির স্কুলে পড়াশোনা করে। দুপুর থেকে বাবার দোকানে হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দেয়। একটা আদ্যিকালের কালো রেডিয়োতে সারাক্ষণ বেজে চলেছে হিন্দি বাংলা গান। শুনে শুনে পল্টুর সব মুখস্থ। শারুখ খানের গানগুলো ওর হেব্বি লাগে। রেডিওর অফিসটা আবার ওদের দোকানের পিছনেই। কতবার ওই দাদা দিদিগুলোকে ও চা পৌঁছে দিয়ে এসেছে। কী রংচঙে আপিস। সবাই কী হাসিখুশি। পল্টু এক দুবার কাঁচের দরজার এপার থেকে দেখেছে কেমনভাবে মাইকের সামনে দাদা দিদিগুলো কথা বলে।ও যদি এমন সুযোগ পেতো...
শিশু দিবস উপলক্ষ্যে এই রেডিওর দিদি দাদাগুলো নাকি পল্টুর মতো ছেলে মেয়েদের সেই সুযোগ দেবে। ওরা মানে যারা লেখাপড়ার সাথে সাথে কাজকর্মওকরে, তাদের নিয়ে নাকি অনুষ্ঠান হবে। পল্টু বেজায় খুশি। ওকেও শোনা যাবে রেডিওতে।
বেশ ফিটফাট হয়ে পল্টু রেডিওর আপিসে গিয়েছে আজ। নিচে ওর বাবা রেডিওর একদম সামনে বসে আছে। অধীর অপেক্ষা। যে কোন মুহূর্তে ওর গলা শোনা যাবে। শুনতে পেল এক দিদির গলা, "তোমার নামটা বলো?"
আর তারপরেই বহু প্রতীক্ষিত সেই কণ্ঠ।
"আমায় সবাই পল্টু বলেই চেনে। কিন্তু আমার একটা ভালো নাম আছে। রাহুল। নাম তো সুনা হোগা?"
৪।
ইশ, কী কুক্ষণে যে ফোনটা চার্জ করতে ভুলে গিয়েছিল, চারজারটাও কাজ করছে না। ট্রেনের ভিতরে বসে টেনশন করতে লাগল সিমি। ইউরেল চেপে জুরিখ যাচ্ছে। অ্যানা থাকে। তবে হঠাৎ প্ল্যান বদল করে একদিন আগেই সিমি পৌঁছে যাচ্ছে। অ্যানাকে জানানো হয়নি। তাড়াহুড়োয় ভেবেছিল ট্রেনে উঠে জানিয়ে দেবে। এখন এই বিপত্তি। কী করে কী করবে ও জুরিখে? বড্ড চিন্তা হচ্ছে। ওর কামরাটাও একদম ফাঁকা। কারুর থেকে যে ফোন বা চারজার চাইবে, সেই উপায়ও নেই। এক্কেবারে কাঁদো কাঁদো অবস্থা ওর।
ট্রেন ছুটছে সুইজারল্যান্ডের ভিতর দিয়ে। অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভা। এদিকে সিমির সেদিকে চোখ নেই। সানেন স্টেশনে এক যুবক উঠল ওর কামরায়। দেখে তো ভারতীয়ই মনে হল। চোখে কালো চশমা, সাদা শার্টের ওপর গাঢ় নীল জ্যাকেট, স্কাউ ব্লু জিন্স, পিঠে ব্যাকপ্যাক।
ওর উল্টোদিকের সিটে জানলার ধারে বসল। সিমির দিকে তাকিয়ে একবার হাসল।
"এক্সকিউজ মি, ডু ইউ হ্যাভ আ মোবাইল চারজার? মাইন ইস নট ওয়ার্কিং। অ্যান্ড আই নিড টু মেক আ ভেরি ইম্পরট্যান্ট কল টু মাই ফ্রেন্ড ইন জুরিখ। মাই ফোন ইস ডেড", বলল সিমি।
"koi baat nahin senorita.. bade bade desho mein aisi chhoto chhoti baatein hoti rehti hain..."
৫।
প্রাইমারি স্কুলের খেলার মাঠ। টিফিন পিরিয়ডে ছেলেরা দৌড়ঝাঁপ করছে। আজও গাবলু ছোঁওয়াছুঁই খেলায় অক্রমের নাগাল পেল না। উফ, কী জোরে ছুটতে পারে ছেলেটা। কী দম।
"ঠিক আছে। থাম অক্রম। আমি আর ছুটতে পারবো না।"
"দেখলি তো, আজও ধরতে পারলি না আমায়?"
গাবলু একটু হেসে বলল, "জানি তো। ডন কো পকড়না মুশকিল হই নহি, না মুমকিন হ্যায়!"
Tuesday, October 30, 2018
pujo
এইবারের পুজোটাও চেন্নাইতেই কাটালাম। গত বছর এখানে দুর্গাপুজো কাটানোয় জানতাম যে বাড়ির থেকে দূরে থাকলেও, আনন্দ কম হবে না। আসলে এই গত পাঁচ বছরের ওপর এখানে রয়েছি, এত মানুষজনের সাথে আলাপ পরিচয় হয়েছে, চেন্নাই শহরটা এখন দিব্যি লাগে!
পুজো বলতে আমি পূজাবার্ষিকী বুঝি। সাম্পানের পূজাবার্ষিকী নিয়ে বেশ কিছুদিন টানা খাটাখাটুনির পর পুজো পুজো ভাব আনতে কিনে ফেললাম শারদীয়া দেশ আর বিচিত্রপত্র। এক দিদির থেকে আনন্দমেলাও পেয়ে গেলাম। আমার পুজো দিব্যি শুরু হয়ে গেল। ইতিমধ্যে অবশ্য ওয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ তৈরি হয়ে গিয়েছে। পুজোর সময় কে কবে কোন প্যান্ডেলে যাবে, কোথায় কোথায় যাওয়া হবে, সেই সব আলোচনা করতে। সেখান থেকেই একে একে ছবি পাচ্ছি, ঠাকুর আসছে বিভিন্ন প্যান্ডেলে। আলপনা দেওয়া চলছে। পুজো প্রাঙ্গণ সাজছে। তৈরি হচ্ছে আগামী কদিনের কর্মযজ্ঞের জন্য।
ষষ্ঠীর দিন থেকেই নতুন জামা পরতে লাগলাম। এমনই অভ্যেস, বরাবরের। বেশ সাজুগুজু করে ছবিটবি তুলব, ওয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে দেবো। এতেই আনন্দ। সারাদিন নতুন জামা পরে ল্যাবে কাজকর্ম করে সন্ধ্যেবেলা ঠাকুর দেখতে বেরোলাম। আমাদের চেন্নাইয়ে বেশ কয়েকটা পুজো হয়। প্রায় ১০-১২টা তো বটেই। তবে বড় ও জনপ্রিয় ওই হাতে গোনা কয়েকটিই। তার মধ্যে সবচেয়ে কাছে পড়ে ক্যাম্পাস থেকে, বেসন্ত নগরের সাউথ মাদ্রাস কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের পুজো। ষষ্ঠীতে তাই ওখানেই গেলাম। ঠাকুর প্রতিমা একদম সাবেকি। রঙিন ঝলমলে শাড়ি গয়নায় মাকে সাজানো।
ঠাকুর নমস্কার করে এসে মূল কাজে মন দিলাম। পেট পুজো। পুজো মানেই চুটিয়ে খাওয়া দাওয়া করা আর আড্ডা মারা। সত্যি বলতে কী, প্যান্ডেলে গিয়ে কতবার ঠাকুর নমস্কার করি, মাঝে মাঝে খেয়ালই পড়ে না! বেসন্ত নগরের পুজো চত্বরে দারুণ দারুণ খাবারের স্টল থাকে। রোল বিরিয়ানি চপ ফ্রাই চাউমিন সিঙ্গারা লুচি পরোটা সব। এ ছাড়া মিষ্টি তো আছেই। ঘুরে ঘুরে সব দেখে শুনে প্রথম দিনের পেট পুজোটা সারলাম বিরিয়ানি আর এগ রোল সাঁটিয়ে। চেনা পরিচিত লোকজনের সাথে দেখা হয়েই যায় এখানে, হলও তাই। ফিরলাম হোস্টেল।
ইচ্ছে ছিল পরেরদিন, অর্থাৎ সপ্তমী থেকে দশমী ল্যাবে যাবো না। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। কিছু পেন্ডিং কাজ পড়ে যায়, সপ্তমী দুপুরটায় ল্যাবে থাকতেই হল। অবশ্য তার আগে সকাল সকাল মাইলাপুরে রামকৃষ্ণ মিশনের মন্দিরে সপ্তমীর পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে নিয়েছি। দুপুরে ভোগ প্রসাদের ছবি আসছে ওয়াটসঅ্যাপে। এদিকে আমি কম্পিটারের সামনে বসে চরম মাথা ব্যাথা নিয়েও গ্রাফের পর গ্রাফ প্লট করে চলেছি। আজ কাজটা শেষ করতেই হবে। নইলে কাল আবার বসতে হবে এই নিয়ে। পেটে ছুঁচো ডন বৈঠক দিচ্ছে। উহু। এরকম করে তো চলবে না। অনলাইন খাবার অর্ডার করে ফেললাম। সরু চালের ভাত, ডাল আর গারলিক ফিশ। এনার্জি পেয়ে কাজ শেষ করে হোস্টেলে এসে হাল্কা বিউটি ন্যাপ দিয়ে আবার সন্ধ্যেয় বেরোলাম বেসন্ত নগর। এবার সদলবলে। সঙ্গে ক্যামেরা। প্রচুর ছবি তুললাম। খেলামও অনেক। পুজোর ভোগের খিচুরি তরকারি তো ছিলই, এ ছাড়া মাছ ভাজা থেকে শুরু করে বিরিয়ানি, শেষ পাতে ইয়া বড় বড় কমলাভোগ। আড্ডা টাড্ডাও মারলাম। তারপর আর কী, ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন। পরেরদিন অষ্টমী। অঞ্জলি দিতে হবে। রেস্ট দরকার।
অষ্টমীর অঞ্জলি দিলাম টি নগর বেঙ্গলি এসোসিয়েশনের পুজোয়। এবারে বোধহয় ওদের ৮০ না ৮৫তম পুজো ছিল। এসোসিয়েশনের নিজস্ব বিল্ডিঙে হয়। পুজোর জায়গাটা একটু ছোট। আর খুব ভিড়। তার মধ্যেও জায়গা করে নিলাম। ঠাকুরের প্রতিমা সাবেকি। আসলে চেন্নাইয়ে এখনও থিম পুজোর উপদ্রব শুরু হয়নি তো, তাই সব জায়গায় ঠাকুরের রূপ অসামান্য লাগে। কেমন একটা মোহময়ী স্নিগ্ধ মাতৃরূপ। অঞ্জলি দিলাম। সন্ধিপুজো দেখলাম। তারপর পেট পুজো। অতি লোভনীয় লুচি ছোলার ডাল আর রসগোল্লা। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। কাছাকাছির মধ্যে কালীবাড়ি, সেখানে যাওয়া গেল না তাই। আবারও আড্ডা মেরে ভোগ খেতে বসলাম। সাবেকি ভোগ। খিচুরি লাবড়া বেগুনি চাটনি পায়েস। কী অপূর্ব স্বাদ। আহা। সন্ধ্যেয় আবার বেসন্ত নগর। আবারও প্রচুর চেনা লোক। আড্ডা। গল্প। আমার স্কুলের এক বান্ধবীর সাথে দীর্ঘ ষোল বছর পর দেখা হল। আরাত্রিকা। বেশ ভালোই লাগল। ছবি টবি তুললাম। খেলাম দেলাম। পুজোও মাঝামাঝি পর্যায়ে। ক্লান্তি আসছে অল্প করে। একেই পুজো কাটিয়েছি অসহ্য মাথা ব্যথায়। তবুও আনন্দ করব বলে দাঁতে দাঁত চিপে ওষুধ খেয়ে খেয়ে ঘুরেছি এই কটাদিন। বই পড়াও হচ্ছেনা। সব মিলিয়ে বিধ্বস্ত।
তাই নবমীর অঞ্জলি দেওয়া হল না। লাঞ্চের আগে আগে বেসন্ত নগর পৌঁছে গেলাম। আজও সদলবলে। তবে অন্য দল। বলে রাখা ভালো। আমার প্রচুর সার্কেল এখানে। সকলের সাথে মিলে মিশে প্ল্যান করে দেখা সাক্ষাত করতে হয়েছে পুজোয়। আজও ভালো মতনই খ্যাঁটন হল। পোলাও মাংস মাছ ভাজা মিষ্টি তো ছিলই, (ভোগ বাই ডিফল্ট ছিল) সাথে যোগ হল ফুচকা। হ্যাঁ জানি ভাবছেন বাবা, এ মেয়ে কত খায়। হ্যাঁ। ওজন বেড়ে যে কোথায় পৌঁছেছে, লজ্জার মাথা খেয়ে আর মাপিনি!
যাই হোক, নবমীর দুপুরে সব একে তাকে একসাথে নিয়ে আমাদের পরিক্রমায় বেরোনোর কথা ছিল। দেখা গেল লেট হচ্ছে। আমি ধ্রুব দা অপর্ণা দি আর ওদের ছেলে ময়ূখ বেরিয়ে পড়লাম ওলা নিয়ে। রামকৃষ্ণ মিশন পৌঁছতে পৌঁছতে দেখি সুজয়দারা বিরাট টেম্পো ত্র্যাভেলার নিয়ে চলে এসেছে। আর সৈকতদারাও গাড়ি নিয়ে এসে গিয়েছে। ব্যস। আর কী, পুরো গ্রুপ রেডি। এরপর শুধুই ঘোরা। এ গাড়ি থেকে ওই গাড়িতে ফোন করে ডিরেকশন নেওয়া। ছবি তোলা। সিঙ্গল। কাপল। গ্রুপ। সেলফি। মানে যত রকমের কম্বিনেশন হয়। মাঝে চায়ের ব্রেক নেওয়া হল আন্না নগর দক্ষিনী সোসাইটির পুজোয়। বৃষ্টি হয়ে রাস্তায় কাদা। ভিড়। সব মিলিয়ে কালীবাড়ি হয়ে টি নগরে এলাম যখন, ভেবেছিলাম ডিনার প্যাক করে হোস্টেলে ফিরব। ওরে বাবা, ওখানে এত ভিড়, তিলধারণের জায়গা নেই বলা যায়। শুনলাম এগারোটার আগে ডিনার পাওয়াই যাবে না। অগত্যা আবার বেসন্ত নগর। ওলা ছেড়ে দিয়েছি। গাড়ি আর পাওয়া যায় না। এত লোকের ঢল রাস্তায়। সত্যি বলছি, মনে হচ্ছিল, এ কলকাতা নাকি? শেষ মেশ অটো করে বেসন্ত নগর এলাম। মোগলাই পরোটা আর ফিস ফ্রাই প্যাক করে ফিরলাম হোস্টেল।
আর এনার্জি নেই। পরেরদিন তাই আর প্যান্ডেলে যাইনি। পি এইচ ডি স্কলার মানুষ। ফিরলাম ল্যাবে। কাগজে কলমে পুজো শেষ হল। তবে আমার পুজো এখনও চলছে। পরপর বন্ধুরা বাড়ি থেকে ফিরছে। মিষ্টির পর মিষ্টি খাচ্ছি। শারদীয়াগুলো পড়ছি। এছাড়াও আরো অনেক বই কেনা রয়েছে (দুটো তো সপ্তমীর দিন পেলাম)। সেগুলি পড়ছি এক এক করে। পুজোর এই রেশ থাকবে কিছুদিন! অন্তত কালীপূজো অবধি।
পুজো বলতে আমি পূজাবার্ষিকী বুঝি। সাম্পানের পূজাবার্ষিকী নিয়ে বেশ কিছুদিন টানা খাটাখাটুনির পর পুজো পুজো ভাব আনতে কিনে ফেললাম শারদীয়া দেশ আর বিচিত্রপত্র। এক দিদির থেকে আনন্দমেলাও পেয়ে গেলাম। আমার পুজো দিব্যি শুরু হয়ে গেল। ইতিমধ্যে অবশ্য ওয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ তৈরি হয়ে গিয়েছে। পুজোর সময় কে কবে কোন প্যান্ডেলে যাবে, কোথায় কোথায় যাওয়া হবে, সেই সব আলোচনা করতে। সেখান থেকেই একে একে ছবি পাচ্ছি, ঠাকুর আসছে বিভিন্ন প্যান্ডেলে। আলপনা দেওয়া চলছে। পুজো প্রাঙ্গণ সাজছে। তৈরি হচ্ছে আগামী কদিনের কর্মযজ্ঞের জন্য।
ষষ্ঠীর দিন থেকেই নতুন জামা পরতে লাগলাম। এমনই অভ্যেস, বরাবরের। বেশ সাজুগুজু করে ছবিটবি তুলব, ওয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে দেবো। এতেই আনন্দ। সারাদিন নতুন জামা পরে ল্যাবে কাজকর্ম করে সন্ধ্যেবেলা ঠাকুর দেখতে বেরোলাম। আমাদের চেন্নাইয়ে বেশ কয়েকটা পুজো হয়। প্রায় ১০-১২টা তো বটেই। তবে বড় ও জনপ্রিয় ওই হাতে গোনা কয়েকটিই। তার মধ্যে সবচেয়ে কাছে পড়ে ক্যাম্পাস থেকে, বেসন্ত নগরের সাউথ মাদ্রাস কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের পুজো। ষষ্ঠীতে তাই ওখানেই গেলাম। ঠাকুর প্রতিমা একদম সাবেকি। রঙিন ঝলমলে শাড়ি গয়নায় মাকে সাজানো।
ঠাকুর নমস্কার করে এসে মূল কাজে মন দিলাম। পেট পুজো। পুজো মানেই চুটিয়ে খাওয়া দাওয়া করা আর আড্ডা মারা। সত্যি বলতে কী, প্যান্ডেলে গিয়ে কতবার ঠাকুর নমস্কার করি, মাঝে মাঝে খেয়ালই পড়ে না! বেসন্ত নগরের পুজো চত্বরে দারুণ দারুণ খাবারের স্টল থাকে। রোল বিরিয়ানি চপ ফ্রাই চাউমিন সিঙ্গারা লুচি পরোটা সব। এ ছাড়া মিষ্টি তো আছেই। ঘুরে ঘুরে সব দেখে শুনে প্রথম দিনের পেট পুজোটা সারলাম বিরিয়ানি আর এগ রোল সাঁটিয়ে। চেনা পরিচিত লোকজনের সাথে দেখা হয়েই যায় এখানে, হলও তাই। ফিরলাম হোস্টেল।
ইচ্ছে ছিল পরেরদিন, অর্থাৎ সপ্তমী থেকে দশমী ল্যাবে যাবো না। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। কিছু পেন্ডিং কাজ পড়ে যায়, সপ্তমী দুপুরটায় ল্যাবে থাকতেই হল। অবশ্য তার আগে সকাল সকাল মাইলাপুরে রামকৃষ্ণ মিশনের মন্দিরে সপ্তমীর পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে নিয়েছি। দুপুরে ভোগ প্রসাদের ছবি আসছে ওয়াটসঅ্যাপে। এদিকে আমি কম্পিটারের সামনে বসে চরম মাথা ব্যাথা নিয়েও গ্রাফের পর গ্রাফ প্লট করে চলেছি। আজ কাজটা শেষ করতেই হবে। নইলে কাল আবার বসতে হবে এই নিয়ে। পেটে ছুঁচো ডন বৈঠক দিচ্ছে। উহু। এরকম করে তো চলবে না। অনলাইন খাবার অর্ডার করে ফেললাম। সরু চালের ভাত, ডাল আর গারলিক ফিশ। এনার্জি পেয়ে কাজ শেষ করে হোস্টেলে এসে হাল্কা বিউটি ন্যাপ দিয়ে আবার সন্ধ্যেয় বেরোলাম বেসন্ত নগর। এবার সদলবলে। সঙ্গে ক্যামেরা। প্রচুর ছবি তুললাম। খেলামও অনেক। পুজোর ভোগের খিচুরি তরকারি তো ছিলই, এ ছাড়া মাছ ভাজা থেকে শুরু করে বিরিয়ানি, শেষ পাতে ইয়া বড় বড় কমলাভোগ। আড্ডা টাড্ডাও মারলাম। তারপর আর কী, ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন। পরেরদিন অষ্টমী। অঞ্জলি দিতে হবে। রেস্ট দরকার।
অষ্টমীর অঞ্জলি দিলাম টি নগর বেঙ্গলি এসোসিয়েশনের পুজোয়। এবারে বোধহয় ওদের ৮০ না ৮৫তম পুজো ছিল। এসোসিয়েশনের নিজস্ব বিল্ডিঙে হয়। পুজোর জায়গাটা একটু ছোট। আর খুব ভিড়। তার মধ্যেও জায়গা করে নিলাম। ঠাকুরের প্রতিমা সাবেকি। আসলে চেন্নাইয়ে এখনও থিম পুজোর উপদ্রব শুরু হয়নি তো, তাই সব জায়গায় ঠাকুরের রূপ অসামান্য লাগে। কেমন একটা মোহময়ী স্নিগ্ধ মাতৃরূপ। অঞ্জলি দিলাম। সন্ধিপুজো দেখলাম। তারপর পেট পুজো। অতি লোভনীয় লুচি ছোলার ডাল আর রসগোল্লা। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। কাছাকাছির মধ্যে কালীবাড়ি, সেখানে যাওয়া গেল না তাই। আবারও আড্ডা মেরে ভোগ খেতে বসলাম। সাবেকি ভোগ। খিচুরি লাবড়া বেগুনি চাটনি পায়েস। কী অপূর্ব স্বাদ। আহা। সন্ধ্যেয় আবার বেসন্ত নগর। আবারও প্রচুর চেনা লোক। আড্ডা। গল্প। আমার স্কুলের এক বান্ধবীর সাথে দীর্ঘ ষোল বছর পর দেখা হল। আরাত্রিকা। বেশ ভালোই লাগল। ছবি টবি তুললাম। খেলাম দেলাম। পুজোও মাঝামাঝি পর্যায়ে। ক্লান্তি আসছে অল্প করে। একেই পুজো কাটিয়েছি অসহ্য মাথা ব্যথায়। তবুও আনন্দ করব বলে দাঁতে দাঁত চিপে ওষুধ খেয়ে খেয়ে ঘুরেছি এই কটাদিন। বই পড়াও হচ্ছেনা। সব মিলিয়ে বিধ্বস্ত।
তাই নবমীর অঞ্জলি দেওয়া হল না। লাঞ্চের আগে আগে বেসন্ত নগর পৌঁছে গেলাম। আজও সদলবলে। তবে অন্য দল। বলে রাখা ভালো। আমার প্রচুর সার্কেল এখানে। সকলের সাথে মিলে মিশে প্ল্যান করে দেখা সাক্ষাত করতে হয়েছে পুজোয়। আজও ভালো মতনই খ্যাঁটন হল। পোলাও মাংস মাছ ভাজা মিষ্টি তো ছিলই, (ভোগ বাই ডিফল্ট ছিল) সাথে যোগ হল ফুচকা। হ্যাঁ জানি ভাবছেন বাবা, এ মেয়ে কত খায়। হ্যাঁ। ওজন বেড়ে যে কোথায় পৌঁছেছে, লজ্জার মাথা খেয়ে আর মাপিনি!
যাই হোক, নবমীর দুপুরে সব একে তাকে একসাথে নিয়ে আমাদের পরিক্রমায় বেরোনোর কথা ছিল। দেখা গেল লেট হচ্ছে। আমি ধ্রুব দা অপর্ণা দি আর ওদের ছেলে ময়ূখ বেরিয়ে পড়লাম ওলা নিয়ে। রামকৃষ্ণ মিশন পৌঁছতে পৌঁছতে দেখি সুজয়দারা বিরাট টেম্পো ত্র্যাভেলার নিয়ে চলে এসেছে। আর সৈকতদারাও গাড়ি নিয়ে এসে গিয়েছে। ব্যস। আর কী, পুরো গ্রুপ রেডি। এরপর শুধুই ঘোরা। এ গাড়ি থেকে ওই গাড়িতে ফোন করে ডিরেকশন নেওয়া। ছবি তোলা। সিঙ্গল। কাপল। গ্রুপ। সেলফি। মানে যত রকমের কম্বিনেশন হয়। মাঝে চায়ের ব্রেক নেওয়া হল আন্না নগর দক্ষিনী সোসাইটির পুজোয়। বৃষ্টি হয়ে রাস্তায় কাদা। ভিড়। সব মিলিয়ে কালীবাড়ি হয়ে টি নগরে এলাম যখন, ভেবেছিলাম ডিনার প্যাক করে হোস্টেলে ফিরব। ওরে বাবা, ওখানে এত ভিড়, তিলধারণের জায়গা নেই বলা যায়। শুনলাম এগারোটার আগে ডিনার পাওয়াই যাবে না। অগত্যা আবার বেসন্ত নগর। ওলা ছেড়ে দিয়েছি। গাড়ি আর পাওয়া যায় না। এত লোকের ঢল রাস্তায়। সত্যি বলছি, মনে হচ্ছিল, এ কলকাতা নাকি? শেষ মেশ অটো করে বেসন্ত নগর এলাম। মোগলাই পরোটা আর ফিস ফ্রাই প্যাক করে ফিরলাম হোস্টেল।
আর এনার্জি নেই। পরেরদিন তাই আর প্যান্ডেলে যাইনি। পি এইচ ডি স্কলার মানুষ। ফিরলাম ল্যাবে। কাগজে কলমে পুজো শেষ হল। তবে আমার পুজো এখনও চলছে। পরপর বন্ধুরা বাড়ি থেকে ফিরছে। মিষ্টির পর মিষ্টি খাচ্ছি। শারদীয়াগুলো পড়ছি। এছাড়াও আরো অনেক বই কেনা রয়েছে (দুটো তো সপ্তমীর দিন পেলাম)। সেগুলি পড়ছি এক এক করে। পুজোর এই রেশ থাকবে কিছুদিন! অন্তত কালীপূজো অবধি।
Subscribe to:
Posts (Atom)