কাঠের আলমারিটার সামনে চাবির গোছা হাতে দাঁড়িয়ে এখনও
ইতস্তত করছে রঙ্গনা। দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাশুড়ি কুমুদিনী মারা গিয়েছেন মাস
খানেক হয়ে গিয়েছে। এই ঘর ও আলমারি তাঁরই। উল্টোদিকের দেওয়ালে ওঁর সদ্য
বাধানো ছবিটার ছায়া আলমারির দরজায় লাগানো আয়নায় জ্বলজ্বল করছে। তিরিশ বছর
ধরে রঙ্গনা এই বাড়িতে আছে, কিন্তু কোনদিনও কুমুদিনী ছাড়া কাউকে এই আলমারি
খুলতে দেখেনি। এক আধবার তো স্বামী মানবকে ঠাট্টার ছলে এ কথাও বলেছে, "হ্যাঁ
গো, কী এমন গুপ্তধন আছে গো মায়ের আলমারিতে যে আমাদের ধারে কাছে আসতে দেন
না?"
"কে জানে? ছোট থেকেই দেখে আসছি। মায়ের আলমারি ঘাঁটা বারণ আমার।
আগে ভাবতাম বোধহয় হজমি আচার লুকিয়ে রাখে মা। পাছে বেশি খেয়ে নিই, তাই।
তারপর খেয়াল করলাম, বড় হয়ে যাওয়ার পরও ওই আলমারিতে হাত দেওয়া বারণ। একবার
জানো, মায়ের ধুম জ্বর। তখন আমি কলেজে পড়ি। মাইনে দিতে হবে। মা বিছানা ছেড়ে
উঠতে পারছে না। আমি বললাম, মা, আমায় চাবিটা দাও, আমি নিয়ে নেবো। তোমায় কষ্ট
করে উঠতে হবেনা। ও মা, মা কিছুতেই শুনলো না। সেই দুর্বল শরীরে আমায় ঘর
থেকে বের করে নিজে আলমারি খুলে আমায় টাকা দিলো।"
এই তো অবস্থা,
নেহাত মানব সেদিন বলছিল এইবারে মায়ের জিনিসগুলোর সদ্গতি করতে। তার চেয়েও বড়
কথা, ব্যাঙ্ক, এল আই সির জন্য যে কাগজপত্র লাগবে, সবই ওই আলমারিতেই আছে।
সেই জন্যই আজ রঙ্গনা তোষকের তলা থেকে চাবির গোছাটা বের করে আলমারির সামনে
দাঁড়িয়েছে। নাহ, কাজটা যখন করতেই হবে, তাহলে আর দেরি করে লাভ নেই। কাঁপা
কাঁপা হাতে রঙ্গনা চাবিটা দরজার গায়ে ঘোরালো। একটা ক্যাঁচ করে আওয়াজ করে
দরজাটা খুলে গেল।
এক ঝাঁক পুরনো স্মৃতির সাথে এক সুমিষ্ট সুঘ্রাণ।
রঙ্গনার মনে পড়ে গেল, সত্যিই তো, মা তো কেউ কোথাও গেলেই এই ছোট ছোট
সুগন্ধীর পাউচগুলো আনাতেন। কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে রাখবেন বলে। ন্যাপথালিনে
অ্যালার্জি ছিল মায়ের। শীতের শুরুতে ওরা উলের পোশাক বের করে বারান্দার রোদে
দিলে মা সেই কদিন ওই মুখোই হতেন না।
কী সুন্দর তাকে গুছিয়ে রাখা
শাড়িগুলি। তাঁতের শাড়ির সংখ্যায় বেশি। তাই দুটো তাক জুড়ে শুধুই তাই তাঁত।
বত্রিশে স্বামীহারা হন কুমুদিনী, ওই বয়স থেকেই সাদা ছাড়া অন্য কোন রঙই
কুমুদিনী জীবনে আসতেই দেননি। বয়সের সাথে সাথে পাড়ের দৈর্ঘ্যও কমতে থেকেছে।
সিল্কের সারিতে রঙ্গনা দেখল ওর বিয়ের নমস্কারির কাতান সিল্কটা রাখা। ঘি রঙা
জমির ওপর ময়ূরকণ্ঠী নীল পাড় আঁচল। এই শাড়িটা কুমুদিনীকে কোনোদিনও পরতেই
দেখেনি রঙ্গনা। হয়তো ওঁর জন্য বেশিই রঙিন হয়ে গিয়েছিল। আর তাই বিয়ের পর
প্রথম পুজোয় তত্ত্ব কেনার সময় মায়ের সাথে গিয়ে নিজের হাতে শাশুড়ি মায়ের
জন্য শাড়ি পছন্দ করেছিল ও। সাদা সিল্কের ওপর সবুজ পাড়, আঁচলেও ন্যুনতম কাজ।
ওইটি কুমুদিনীর পছন্দ হয়েছিল। কুমুদিনীকে কোনদিনও গয়না পরে সাজতেও দেখেনি
কেউ। মানব যখন পিতৃহারা হয়, তখন নিতান্তই ছোট। মোটে আট। ওরও মনে নেই মাকে
সেজেগুজে রঙ্গীন পোশাকে দেখেছে বলে।
শাড়িগুলো এদিক ওদিক ওলট পালট
করতে গিয়ে রঙ্গনার নজর গেল নীচের তাকে। অখানে যত্ন করে একটা কোণে রাখা
কুমুদিনী আর ওঁর স্বামীর সমস্ত রেজাল্ট। পাতাগুলো হলুদ হয়ে গিয়েছে, অস্পষ্ট
সব অক্ষরও। আবছা কিছু নম্বর, স্কুলের নাম ঠিকানা, কিছু তারিখ।
শ্বশুরমশাইকে রঙ্গনা দেখেনি, তাই ওঁর কাগজপত্র দেখে আলাদা করে কিছু মনে না
হলেও কুমুদিনীর মার্কশিটগুলো দেখতে দেখতে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল। উনিও যে
সাদা শাড়ি আর খোঁপার আগে রঙ্গীন শাড়ি, লাল ফিতে বাঁধা দুই বেণী ছিলেন, মনেই
হয়নি কখনও। উনিও হয়তো সকালবেলা স্কুল, তারপর বিকেলে বাড়ি ফিরে ব্যাগ ফেলে
ছুটতেন পিছনের মাঠে, অনেক সময়ে মায়ের কান মলা খেয়ে তবে ফিরতেন পড়তে বসতে।
কী সুন্দর গুছিয়ে রাখা জিনিসপত্র আলমারিতে। আবার সমস্ত কিছু যথাস্থানে
রেখে রঙ্গনা এবার খুঁজতে লাগল ব্যাঙ্ক ইন্সিয়োরেন্সের কাগজ। ওর চোখে পড়ল
শালের সম্ভারের পিছনে একটা গোলাপি রঙের ফাইল। দরকারি কোন কাগজ নাকি? ফাইলটা
টেনে বের করল রঙ্গনা। স্বচ্ছ্ব প্লাস্টিকের ফাইল কাভার। ভিতরে অনেক পুরনো
কাগজ। খয়েরি হয়ে যাওয়া। সযত্নে না ধরলে চুরচুর করে ভেঙ্গে পড়বে, এমনই
ভঙ্গুর অবস্থা।
রঙ্গনা সাবধানে কাগজগুলি বের করে একে একে দেখতে
লাগল। বাড়ির দলিল একটা। সেখানে অক্ষর অস্পষ্ট। কষ্ট করে পড়ে রঙ্গনা বুঝল,
বাংলাদেশের খুলনা শহরের কোন বাড়ির দলিল। সই করেছেন শ্রী নারায়ণদেব
গঙ্গোপাধ্যায়। মানে কুমুদিনীর দাদা শ্বশুর। বাবা, কত পুরনো। কত মূল্যবান।
যদিও দেশ ভাগের পরে সেই সব আর কিছুই পড়ে নেই, তাও। পরের কাগজটা একটা চিঠি।
অমূল্য মুখোপাধ্যায়ের লেখা। শ্রী আদিত্যনারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় কে জানিয়েছেন
যে অমূল্য বাবুর কন্যা একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছেন, ৭ই বৈশাখ,
মুঙ্গেরের সদর হাসপাতালে। আদিত্যনারায়ণ কুমুদিনীর শ্বশুরমশাইয়ের নাম। এই
চিঠিটি তার মানে রঙ্গনার শ্বশুর মশাইয়ের জন্মের সংবাদ বাহক। সেই চিঠি এত
বছর ধরে এমন যত্নে রেখে দিয়েছিলেন কুমুদিনী। আরো কিছু চিঠি দেখতে পেল
রঙ্গনা। মূলত শ্বশুর মশাই শশাঙ্কদেবের লেখা। বিভিন্ন সময়ে। বিভিন্ন দরকারে,
অদরকারে। তার মধ্যে মানবের জন্মের চিঠিও রয়েছে। আরো কত কিছু। কিছু সাদা
কালো ছবি, যা এখন স্মৃতির ভারে খয়েরি হয়ে গিয়েছে। কোন কোন জায়গায় আবার
ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। কালো কাগজের ওপর সাটিয়ে রাখা, এত বছর পর কোণগুলি উঠে
আসছে। ছবিগুলোয় পুরুষেরা সকলে ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত, কারুর মুখে হাসি নেই।
মেয়েরাও গম্ভীর মুখে। ছাপা শাড়ি পরে, বড় হাতা ব্লাউজ। সেই আমলের এই ফ্যাশন।
কাউকেই চিনতে পারল না রঙ্গনা। কেবলমাত্র একটা ছবি বাদে। কুমুদিনী ও তাঁর
স্বামীর ছবি। বিয়ের পরে পরেই তোলা হয়তো। কুমুদিনীর চোখে মুখে নববধূর লাজ।
ঘোমটা মাথায়, মুখ নিচু, আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে। পাশে হাসিমুখে রঙ্গনার শ্বশুর
মশাই শশাঙ্কদেব। কুমুদিনীর মতো অমন দাপুটে ভদ্রমহিলা, যাকে বিয়ের তিরিশ বছর
পরেও রঙ্গনা ভয় পেত, মুখ তুলে কথার পিঠে কথা বলতে পারত না, সেই ভদ্রমহিলা
যে এক কালে এমন লাজুক ও শান্ত ছিলেন, অভাবনীয়। সত্যি, এই আলমারি গোছাতে
গিয়ে কত নতুন ভাবেই না রঙ্গনা চিনছে ওর মৃতা শাশুড়িকে।
কাগজগুলো
তুলে রাখল রঙ্গনা। আলমারিতে তালা লাগাতে গিয়ে চোখে পড়ল খাটের কোণে মেঝেতে
একটা কাগজ পড়ে রয়েছে। কোনো চিঠি হয়তো। নিচু হয়ে তুলল কাগজটি। এটিও একটি
চিঠিই। বাকিগুলোর চেয়ে কম পুরনো। একটু কৌতূহল হল রঙ্গনার। কার চিঠি? কী
লেখা? তারিখ লেখা ১৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫। মুক্তোর মতো হাতের লেখায় নীল
কালিতে লেখাঃ
প্রিয় কুমুদিনী
আজ তোমাদের বাড়ি গিয়েই কথাগুলো
তোমায় সামনাসামনি বলব ভেবেছিলাম। কিন্তু শশাঙ্কদার মা বাবা থাকায় সেই সুযোগ
পেলাম না। অবশ্য তুমি রাজি থাকলে আমি নিশ্চয়ই ওনাদের এবং তোমার মা বাবার
সাথে কথা বলবো এবং অনুমতি নেব। কিন্তু তার আগে সবচেয়ে জরুরি জানা তোমার
মতামতটি।
তোমাকে আমি বহুবার বলেছি। ভালোবাসি তোমায়। ভালোবাসি তোমার
কথা বলা। তোমার ভঙ্গিমা। তোমার হাসি। তোমার সবটুকু। সাধারণের মধ্যেও
অসাধারণ তুমি। রোজের একঘেয়েমিতেও তুমি অনন্যা। বাবুকে যখন বকো বা ধোপাকে
যখন যত্ন করে জামাকাপড় বুঝিয়ে দাও, বা ধরো তমাদের বাসায় গেলে আমার পছন্দ
অনুযায়ী ঠিক বেশি চিনি দিয়ে চা দাও, তোমার শরীর খারাপ হলে ওষুধ খেতে বললে
আমায় পাত্তা দাও না - সব, সব। তোমায় তুমি রূপে ভালোবাসি কুমুদ। লক্ষ্মীটি,
আমায় বিয়ে করো।
জানি আমার দেওয়া বিয়ের প্রস্তাব শুনে হয়তো তুমি অনেক
দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়বে। কিন্তু আমার সমস্ত ইষ্ট দেবতার শপথ নিয়ে বলছি।
আমার অন্তরের যত স্নেহ ও ভালোবাসা আছে, সমস্ত দিয়ে তোমায় আর বাবুকে ভরিয়ে
রাখবো। একবারের জন্যও তোমায় বা মানবকে শশাঙ্কদার অভাব বুঝতেই দেব না।
কুমুদ এই যে আমি সময়ে অসময়ে তোমাদের বাসায় আসি, এ কি শুধুই এক প্রাক্তন
সহকর্মী ও তাঁর পরিবারের প্রতি কর্তব্যবোধে? তুমি কি একবারও বোঝোনি যে এটা
অন্য টান? আর যদি বা বুঝেও তুমি অস্বীকার করে থাকো, বা আমায় গ্রহণ করতে না
চাও, তাহলেও আমার কোনো খেদ নেই। আমি চিরকাল মন প্রাণ দিয়ে তোমাকে একইভাবে
ভালোবেসে যাবো। সম্মান করে যাবো। এবার তুমি যা ভালো বোঝো। তোমার উত্তরের
অপেক্ষায় রইলাম।
ইতি
তোমার প্রিয়তোষ দা
রঙ্গনা
স্তব্ধ। প্রিয়তোষ কাকু? ওদের পরিবারের সদস্য বললেও কম বলা হয়। নিকটাত্মীয়ের
চেয়ে কোনো অংশে কম যেতেন না। মানবের পিতৃতুল্য। যেই মানুষটা বটবৃক্ষের মতো
না আগলে থাকলে নাকি মানব আর কুমুদিনীর জীবন লন্ডভন্ড হয়ে যেত, সেই
প্রিয়তোষ কাকু? মাকে এত ভালোবাসতেন? আর মা? উনিও কি? নিশ্চয়ই তাই, নইলে এত
বছর ধরে এমন যত্ন করে চিঠিটা থাকতো না...তাহলে কি সমাজ ও লোকলজ্জার ভয়ে
সাড়া দিতে পারেননি? এতগুলো বছর কাউকে জানতেই দিলেন না? চিঠিটা পেযে কি মাও
বিচলিত হয়েছিলেন? ভয়? হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল? উত্তর কি মুখে দিয়েছিলেন?
না চিঠিতে? কী ছিল তার বয়ান?
প্রিয়তোষ কাকু গত বছর পুজোর ঠিক পরে
পরেই দীর্ঘ রোগভোগের পর চলে গিয়েছেন। মানব মা কে সেই সংবাদ যখন দেয়,
কুমুদিনী নিরুত্তাপ, নির্বাক। খানিকক্ষণ ওরকম দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঘরে গিয়ে
দরজা বন্ধ করেছিলেন। রঙ্গনার সব ছবির মতো স্পষ্ট মনে আছে। কুমুদিনী সেই
রাতে খাননি। পরদিন সকালে মানবকে ডেকে বলেন, " বাবু উনি তোর পিতৃতুল্য
ছিলেন। তুই ঠাকুরমশাইকে ডেকে বিধান না। আমি চাই তুই ওনার কাজ করিস। আর
রঙ্গনা, আগামী কয়েকদিন আমাদের বাড়িতে অশৌচ পালন হবে। খেয়াল রেখো।"
রঙ্গনা সেদিন কিচ্ছু না বুঝে অবাক হলেও আজ সব জলের মতো পরিষ্কার। পঞ্চাশ
বছরের ওপর চলতে থাকা এই নীরব প্রেমের গল্প, এ যে এক অন্য কুমুদিনীর কাহিনী।
এই কুমুদিনী শাসন ছাড়াও ছিলেন এক রক্ত মাংসের মানুষ। এই কুমুদিনীরও একটা
হৃদয় ছিল। ছিল সযত্নে সভয়ে চেপে রাখা আবেগ। ভালোবাসা। এতগুলো বছর পর আজ
কুমুদিনী ও তার প্রিয়তোষদা সমস্ত লোকলজ্জার ভয় কাটিয়ে হয়তো অবশেষে এক
হয়েছেন, চির অসীমের ওপারে।
পড়ন্ত সূর্যের রশ্মির ছটায় পশ্চিমের ঘরটা
আলোকিত। কুমুদিনীর ছবিটাও সেই দ্যুতিতে বড্ড জীবন্ত। আজ প্রথমবার সেইদিকে
তাকিয়ে রঙ্গনার দুই চোখ চাপিয়ে জল এলো।