Tuesday, September 25, 2018

অভিমান

বর্ণগুলো সেদিন এদিক সেদিক এক্কা দোক্কা খেলছিল নিশ্চিন্তে।
হঠাৎ কী যে হল,
মাত্রারা সব মাত্রাতিরিক্তভাবে
এসে জড়ালো বর্ণরাজির সাথে।
তারপর...


তারপর কথার পিঠে জমল অনেক কথা। 


শব্দের পরে যোগ হল শত শব্দ।
সৃষ্টি হল ভারি ভারি সব গাঁথা।

কিন্তু হায়, ক্ষণজন্মা হল না যে তারা।
 
 
সেই ঊষাকালে জন্ম নিলো আরো এক নতুন অনুভূতি। 
 
আদর করে নাম দিলাম তারে "অভিমান"। 

Monday, September 24, 2018

বিজয়া


সকাল এগারোটা। সোমবার। ভাদ্রের আকাশে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘ। একদম যাকে বলে "পুজোর আকাশ"। দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত সরকারি হাউজিং কমপ্লেক্সে সুবোধ সান্যাল ও ওঁর স্ত্রী শ্রীময়ী সান্যালের নিস্তরঙ্গ জীবন। তিনতলার রান্নাঘর থেকে টুকটাক রান্নার ছ্যাঁক ছোক আর বাসনকোসনের অল্প আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সাথে মাঝে মাঝে চুরির টুংটাং। বাড়ির সামনে মাঠে পুজোর প্যান্ডেলের কাজ চলছে। মধ্যে মধ্যে বাঁশ পড়া আর পেরেক ঠোকার শব্দ, মিস্ত্রীদের হাঁকডাক।


"শুনছো, টিকিটগুলো কেটেছ?" বছর ষাটের শ্রীময়ী রান্নাঘরে সকালের দ্বিতীয় দফার চায়ের জল চাপিয়ে প্রশ্ন করলেন। সুবোধবাবু তখন আনন্দবাজারের শব্দজব্দ নিয়ে বসেছেন, গভীর মনোযোগ দিয়ে অভিধান দেখে, কাটাকুটি করে সমাধান করতে এখনও দেরি। প্রতিদিনের অভ্যেস। রিটায়ার্ড মানুষ। এইসব নিয়েই দিন কাটে। পেন্সিল হাতে একবার মুখ তুলে উত্তর দিলেন, "হ্যাঁ। কাল রাত্তিরেই করেছি।"

" কোথায় যাচ্ছি এইবারে আমরা? " শ্রীময়ীর পাল্টা প্রশ্ন এলো।

" এন জে পির টিকিট কেটেছি। তারপর দেখা যাবে। "

" গত বছরও ওইদিকেই গেলাম। এবারে সমুদ্র গেলে হতো না? " দুই হাতে দুটো চায়ের কাপ এনে সামনে বেতের টেবিলে রাখতে রাখতে শ্রীময়ী বললেন।


সুবোধবাবু একবার তাকালেন স্ত্রীর দিকে। হাত বাড়িয়ে কাপটা নিলেন। কিচ্ছু না বলে আবার ফিরলেন শব্দের জগতে।


"কী গো? কথার উত্তর দিলে না?"


"আমরা কি এই সময়ে বেড়াতে যাই শ্রী যে অত বাছবিচার করব? যেখানের টিকিট পাবো, সেখানেই যাবো। মোট কথা, এই চত্বরে পুজোর কটাদিন থাকবো না না না।" একটু কড়া স্বরেই কথাগুলো বললেন সুবোধবাবু। এবং বলেই বুঝলেন, এরকম বলা ঠিক হয়নি। সামনে বসে থাকা শ্রীময়ী হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলেন।


সাময়িক বিহ্বলতা কাটিয়ে স্ত্রীর কপালে মাথায় হাত বুলিয়ে সুবোধবাবু বললেন, "সরি। আমার এরকম বলা উচিত হয়নি।"

শ্রীময়ী কিছু বললেন না। আস্তে আস্তে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের কোণ মুছে চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় চলে গেলেন। সুবোধ দেখলেন, শ্রীময়ী অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন মাঠের দিকে। জগৎ জননীর আগমনীর অপেক্ষায়।


আট বছর আগে এমনই এক আগমনীর বিদায়বেলায় এই জননীর কোল খালি করে বিজয়া দশমীর দিন চলে গিয়েছিল ওঁদের একমাত্র ছেলে, শুভজিৎ। পাড়ার পুজোর ভাসানে গিয়ে আর ফেরেনি। প্রতিমা বাহক ট্রলারের পিছনের চাকায় পিষ্ট হয়ে চিরতরে চলে গিয়েছিল সে।


সেই থেকে সান্যাল দম্পতি পুজোর চার পাঁচদিন চলে যান দূরে, অনেক দূরে। এই কটাদিন এলে যেন সেই পরম বিভীষিকাময় রাত্রিটা গলা চেপে ধরে ওঁদের। আর তাই এই আনন্দোৎসব থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ওঁরা। এখনও।

সমাপ্ত

(অত্যন্ত মর্মান্তিক একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা।)
আমাদের মুস্কিল কী জানেন?
আমরা দুই আর দুই যোগে যে চার হতে পারে, অনেক সময়ে সেটা মানতে পারি না।
সম্পর্কগুলো আদপে খুব সহজ সরল।
অযথা নামের বোঝা চাপিয়ে ফেলি আমরাই। তারপর আর সেই ভার বইতে পারিনা।
যতবার তুমি আঘাত পেয়েছ, গর্জে উঠেছে কলম।
হে কবি,
গহীন গোপনে তোমার সৃজনী ব্যথার প্রলেপ পশম।।

Friday, September 21, 2018

লুচিকে চিঠি

প্রিয় লুচি
এই শোন, তোরা কী ভেবেছিস বল তো? আমায় কি এতটুকুও শান্তিতে থাকতে দিবি না? পুজো আসতে আর কটাদিন বাকি জানিস তো? এক মাসও না। আমায় না হাল ফ্যাশনের জামাকাপড় পরে ভুবনমোহিনী হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে... তার জন্য তো এই ফুটবলের আকৃতিটা ঝরাতে হবে, নাকি? এদিকে তোরা যদি সারাক্ষণ আমার চোখের সামনে ঘুরঘুর করিস, আমি কী করে সামলাই নিজেকে?
তুই নিজেই ভাব না। ধবধবে সাদা, তুলতুলে নরম, গাওয়া ঘিতে ভাজা গরম গরম ফুলকো লুচি যদি চোখের সামনে কড়াই থেকে নামতে দেখি, নিজের দুই হাত দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকলেও আমি হ্যারি হুডিনির চেয়ে বেশি ক্ষিপ্র হয়ে বাঁধনমুক্ত করব নিজেকে। আর তারপর, এই একটা ইয়া বড় হাঁ করে সটান মুখে। আর যদি ভিতরে একটু কড়াইশুঁটি বা ডালের পুর থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। এই অভাগাকে দেখে কে?
সবচেয়ে খারাপ জিনিস কী জানিস? তোরা তো আবার একা একা থাকিস না। সব সময় কাউকে না কাউকে ঠিক পটিয়ে নিস। সে কিসমিস নারকেল কুচি দেওয়া ঘিয়ের গন্ধে ভরপুর মাখোমাখো ছোলার ডাল হোক, বা বেশ আদা রসুন গরম মসলা হিং দিয়ে রসিয়ে কষিয়ে আলুর দম। মাঝে সাঝে তো আবার আরও এক কাঠি ওপরে যাস। এক্কেবারে অতি সুসিদ্ধ তুলতুলে নরম পাঁঠার মাংসের ঝোলের সাথে দেখা দিস। ইয়ার্কি পেয়েছিস নাকি?
ফের যদি পুজো শেষ হওয়ার আগে তোদের দেখা পাই না, লাল দইয়ের মাথার কসম খাচ্ছি, ঠেঙ্গিয়ে চ্যাপ্টা করে দেবো। চুপসে গিয়ে তখন ওই হতচ্ছাড়া পুরি আলু সব্জি হয়ে সারা জীবন কাটাতে হবে তোকে। মনে থাকে যেন?
আর শোন, আপাতত ছুটিতে যাচ্ছিস যা। যাওয়ার আগে এক হাঁড়ি ডায়েট রসগোল্লা রেখে যাবি। আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। জানি। দুনিয়ায় বারমুডা ট্রায়াঙ্গালের রহস্য পর্যন্ত সমাধান হয়ে যেতে পারবে। কিন্তু ডায়েট রসগোল্লা কখনোই আমার মুখে রুচবে না। ঠিক আছে। এমনিটাই আনিস। একদম স্ট্রেট ফ্রম দ্য গামলা। গরম গরম। রসে টইটুম্বুর। মিষ্টি খেলে মন ভালো হয়। তোদের সাথে সাময়িক ব্রেক-আপ করছি, সেই দুঃখটা ভুলতে হবে তো, নাকি?
আর ফিরবি যখন, বিজয়া করতে, তখন কিন্তু সরভাজা আর ছানার জিলিপি মাস্ট। ঠিক?
নে, বিদেয় হ। আমি একটু কোল্ড ড্রিঙ্ক খেয়ে প্রাণের জ্বালা জুড়োই।
ইতি
তোর খাদ্যরসিক টিপিকাল বাঙালি  

Wednesday, September 19, 2018

নিজেকে চিঠি

প্রিয় নীলু
কী রে, সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে, আর তুই এখনও ঘরের আলো জ্বালাসনি। চুপ করে একটা কোণে বসে আছিস। ও মা, এ কী? কাঁদছিস...কেন? ও। বুঝেছি। দীপু তোর চেয়ে অনেক কম নম্বর পেয়েও শিকাগো স্টেটে অ্যাডমিশন পেয়ে গেল আর তুই অ্যারিজোনা স্টেটেও পেলি না, তাই? এইটাতে তুই পাবিই পাবি ভেবে রেখেছিলি, তাই না রে? ভাবছিস মল্লিকা আপসেট হবে। না? তাহলে? ও আচ্ছা। ক্যাটেও রেজাল্ট ভালো হয়নি। চাকরিটা ছাড়তে পারবি না, তাই তো? 
তোকে কয়েকটা কথা বলি নীলু। আমি তো কম করেও বেশ কিছু বছরের বড় তোর থেকে, দুনিয়াটা একটু হলেও বেশি দেখেছি। তাই বলছি, শোন, কিছু বছর পরে দেখবি, এগুলো কিচ্ছু ম্যাটার করবে না। এই যে তুই ভাবছিস, সব বন্ধুরা বম্বে দিল্লি ব্যাঙ্গালোর অ্যামেরিকা ইংল্যান্ড চলে গেল, আর তুই পড়ে রইলি সেই কলকাতায়, দেখিস দশ বছর পর তোর জীবনেই আক্ষেপ অনেক কম হবে।
বিল্টু, দীপু এরা হয়তো বিশাল চাকরি করবে। কিন্তু সকলে দেশের বাইরে। কালেভদ্রে সকলের সাথে যখন তোর আবার কথা হবে, দেখিস, সব্বাই বলবে। "তুইই ভালো আছিস রে নীলু। কলকাতায় রয়ে গেলি। বেশ নিশ্চিন্তে। রাত দুপুরে ফোন বাজলে দেশ থেকে, কী হল, সব ঠিক আছে তো ভেবে হঠাৎ করে হার্টবিট মিস হয় না। সকাল সন্ধ্যে নিজের সংসারের সাথে বুড়ো বুড়ি দুটোর জন্য বাড়তি টেনশন নিতে হয় না।" নীলু তুই হয়তো তখন ওদের বলবি, "নদীর এপার ওপার কেস এটা।" হয়তো তাই। কিন্তু তুইই বল। বাবা মায়ের বয়স হচ্ছে। হাজারটা ডাক্তার বদ্যি চলছে। তবুও সর্বক্ষণ চোখের সামনে দেখতে পাবি ওঁদের। বা ধর, যখন সারাদিন অফিসে প্রচুর খাটুনির পর বাড়ি ফিরে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে রেডিওতে পছন্দের বাংলা গান শুনতে পাবি, সেই বেলা? অ্যামেরিকা বা হিল্লি দিল্লি কোথাও এই সুখটা পাবি?
যতই ভিড় ভাড় হোক, তাও, ট্র্যাফিক জ্যামের মধ্যে দিয়ে নিজের উপার্জনে কেনা চার চাকা চালাতে চালাতে যখন আশে পাশে বিলবোর্ডে বাংলায় বিজ্ঞাপন দেখবি, আশে পাশে সমস্ত মানুষকে দেখবি যাদের সাথে তুই নিজের অনেক মিল দেখবি... দেখিস, খুব ভালো লাগবে। ওঁরাও যেমন জীবনযাপনের জন্য লড়ছেন, তেমনই তুইও। সংগ্রামটা একই রে। অনেক একাত্ম বোধ করবি।
বর্ষার দিনে গড়িয়াহাট মোড়ে গাড়িটা যখন সিগনালে দাঁড়িয়ে, দেখতে পাবি তোর স্কুলের কিছু বাচ্চারা সেই নীল সাদা ইউনিফর্ম পরে জমা জলের ওপর দিয়ে লাফাচ্ছে, হাসছে, খেলছে, এক লহমায় তোর নিজের স্কুল লাইফের কথা মনে পড়ে যাবে। কত আনন্দই না করেছিস। সেদিন তুই ঠিক বাড়ি ফিরে পুপাইকে নিয়ে কাগজের নৌকো বানিয়ে বিল্ডিঙের সামনে জমা জলে ভাসাবিই। কত আনন্দ পাবি, বলে বোঝাতে পারবো না তোকে। তুই মিলিয়ে নিস শুধু।
হয়তো ঠিকই, কলকাতার বাইরে গেলে তুই অনেক বেশি টাকা রোজগার করতি। হয়তো বা তোর জীবনযাত্রা অনেক উন্নতমানের হত। কিন্তু আমি বলছি, এই কলকাতায় শান্তিতে বাঁচতে গেলে যেটুকু দরকার, তুই ঠিক পাবি। এখনের চাকরিটাতে টিকে গেলেও তোর দশ বছর বাদে যথেষ্ট থাকবে। আর চাকরি পালটালে তো কথাই নেই। এখানেও যা ইনক্রিমেন্ট পাবি, দিব্যি চলে যাবে। এত লো কস্ট অফ লিভিং আর একটা শহরে দেখা দেখি?
একটা কথা বলবো? জানিস এই একটু আগে সামনের রোয়ের বাড়িগুলো থেকে পুজোর চাঁদা তুলে এলাম। ওই বাড়িগুলোয় বেশির ভাগই এখন সিনিয়র সিটজেন। ছেলে মেয়েরা সব জীবীকার সন্ধানে দেশের বাইরে, বা অন্য রাজ্যে। বাবা মায়েরা ওপর ওপর "ভালো আছি" বলেন ঠিকই, কিন্তু সকলের মধ্যেই কেমন অবসাদ দেখলাম। একাকীত্ব। জীবনশক্তিটাই কত কমে গিয়েছে। সেই তুলনায় আমার মা বাবা সুগার কোলেস্টেরলে ভুগলেও, দিল খুলে হাসে এখনও, ছেলে মেয়ে বৌমা জামাই নাতি নাতনি নিয়ে মাঝে মাঝেই বেড়াতে বেরোয়। খেতে যায়। দিব্যি আছে। দিব্যি আছি।
অফিসের কাজ আছে। সেসব তো চলতেই থাকবে। তার সাথে এই যে এই সময় তিন চার মাস, জোর কদমে পুজোর কাজ কর্ম, ছোটাছুটি আর তারপর বিসর্জনের পর একটু স্বস্তি। প্রচুর খাটনি যায়। মাঝে মাঝে মনে হয়, ধুর ছেড়ে দেব। তাও, যখন প্যান্ডেলে লোকেদের ভিড় দেখি, অঞ্জলির লাইন, সেলফির হিড়িক, সেই সব যখন ফেসবুক লাইভে দিই, একদা এ পাড়ার দাদা দিদি ভাই বোন বন্ধুরা দেশ বিদেশ থেকে দেখে আর "মিস করছি" বলে, তখন নিজেকে রাজা মনে হয় রে। এই যে পরিতৃপ্তি, এর কোন তুলনা নেই। বলছিনা যে বাইরে থাকলে এগুলো উপভোগ করা যায় না, কিন্তু তাও, বাড়ি বাড়িই, নিজের শহর, নিজেরই। এই শহরও তো আরেকটা মা রে।  এই তো একটু আগে ফেসবুকে দেখলাম রুমঝুমের বোনটা, যে চেন্নাইতে থাকে, ফেসবুকে স্টেটাস দিয়েছে, "বাবার কাছে শুনলাম নীলাঞ্জন দা চাঁদা নিয়ে গেল। এবারও কলকাতার পুজো মিস হল।" আমি যদি কলকাতায় না থাকতাম হয়তো এরকমই কিছু স্ট্যাটাস দিতাম। বি-ব্লক, সি এসের মাঠ, এই সব মিস করছি লিখে।
শোন, তোকে বলি, যা হয়েছে, ঠিক আছে। এটাকে নিয়েই এগিয়ে যাওয়া যায়। স্বচ্ছন্দে। আমি বলছি। অভিজ্ঞতা থেকে। বিদেশে বা অন্য শহরে থাকার যেমন প্রোস অ্যান্ড কন্স আছে, তেমনই কলকাতারও আছে। দেখবি, এই শহরে বসেই জীবনটা ভালোই কাটবে। বছরে দুবার বেড়াতে যাবি। দেশে বিদেশে। সারা বছর শান্তিতে থাকবি । জ্যাম জট মিটিং মিছিলের শহরেও ঠিক একটা জীবন চলে যায়।
এত চিন্তা করিস না। মন খারাপও না।
নে, এবার ঘরের বাইরে চল। দেখ, মলি এসেছে। মা আর ও ফুচকা বানাচ্ছে। খাবি তো?
ইতি
কয়েক গাছা বেশি চুল পাকা নীলু 

Sunday, September 16, 2018

আহা রে মন


কাঠের আলমারিটার সামনে চাবির গোছা হাতে দাঁড়িয়ে এখনও ইতস্তত করছে রঙ্গনা। দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাশুড়ি কুমুদিনী মারা গিয়েছেন মাস খানেক হয়ে গিয়েছে। এই ঘর ও আলমারি তাঁরই। উল্টোদিকের দেওয়ালে ওঁর সদ্য বাধানো ছবিটার ছায়া আলমারির দরজায় লাগানো আয়নায় জ্বলজ্বল করছে। তিরিশ বছর ধরে রঙ্গনা এই বাড়িতে আছে, কিন্তু কোনদিনও কুমুদিনী ছাড়া কাউকে এই আলমারি খুলতে দেখেনি। এক আধবার তো স্বামী মানবকে ঠাট্টার ছলে এ কথাও বলেছে, "হ্যাঁ গো, কী এমন গুপ্তধন আছে গো মায়ের আলমারিতে যে আমাদের ধারে কাছে আসতে দেন না?"
"কে জানে? ছোট থেকেই দেখে আসছি। মায়ের আলমারি ঘাঁটা বারণ আমার। আগে ভাবতাম বোধহয় হজমি আচার লুকিয়ে রাখে মা। পাছে বেশি খেয়ে নিই, তাই। তারপর খেয়াল করলাম, বড় হয়ে যাওয়ার পরও ওই আলমারিতে হাত দেওয়া বারণ। একবার জানো, মায়ের ধুম জ্বর। তখন আমি কলেজে পড়ি। মাইনে দিতে হবে। মা বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না। আমি বললাম, মা, আমায় চাবিটা দাও, আমি নিয়ে নেবো। তোমায় কষ্ট করে উঠতে হবেনা। ও মা, মা কিছুতেই শুনলো না। সেই দুর্বল শরীরে আমায় ঘর থেকে বের করে নিজে আলমারি খুলে আমায় টাকা দিলো।"
এই তো অবস্থা, নেহাত মানব সেদিন বলছিল এইবারে মায়ের জিনিসগুলোর সদ্গতি করতে। তার চেয়েও বড় কথা, ব্যাঙ্ক, এল আই সির জন্য যে কাগজপত্র লাগবে, সবই ওই আলমারিতেই আছে। সেই জন্যই আজ রঙ্গনা তোষকের তলা থেকে চাবির গোছাটা বের করে আলমারির সামনে দাঁড়িয়েছে। নাহ, কাজটা যখন করতেই হবে, তাহলে আর দেরি করে লাভ নেই। কাঁপা কাঁপা হাতে রঙ্গনা চাবিটা দরজার গায়ে ঘোরালো। একটা ক্যাঁচ করে আওয়াজ করে দরজাটা খুলে গেল।
এক ঝাঁক পুরনো স্মৃতির সাথে এক সুমিষ্ট সুঘ্রাণ। রঙ্গনার মনে পড়ে গেল, সত্যিই তো, মা তো কেউ কোথাও গেলেই এই ছোট ছোট সুগন্ধীর পাউচগুলো আনাতেন। কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে রাখবেন বলে। ন্যাপথালিনে অ্যালার্জি ছিল মায়ের। শীতের শুরুতে ওরা উলের পোশাক বের করে বারান্দার রোদে দিলে মা সেই কদিন ওই মুখোই হতেন না।
কী সুন্দর তাকে গুছিয়ে রাখা শাড়িগুলি। তাঁতের শাড়ির সংখ্যায় বেশি। তাই দুটো তাক জুড়ে শুধুই তাই তাঁত। বত্রিশে স্বামীহারা হন কুমুদিনী, ওই বয়স থেকেই সাদা ছাড়া অন্য কোন রঙই কুমুদিনী জীবনে আসতেই দেননি। বয়সের সাথে সাথে পাড়ের দৈর্ঘ্যও কমতে থেকেছে। সিল্কের সারিতে রঙ্গনা দেখল ওর বিয়ের নমস্কারির কাতান সিল্কটা রাখা। ঘি রঙা জমির ওপর ময়ূরকণ্ঠী নীল পাড় আঁচল। এই শাড়িটা কুমুদিনীকে কোনোদিনও পরতেই দেখেনি রঙ্গনা। হয়তো ওঁর জন্য বেশিই রঙিন হয়ে গিয়েছিল। আর তাই বিয়ের পর প্রথম পুজোয় তত্ত্ব কেনার সময় মায়ের সাথে গিয়ে নিজের হাতে শাশুড়ি মায়ের জন্য শাড়ি পছন্দ করেছিল ও। সাদা সিল্কের ওপর সবুজ পাড়, আঁচলেও ন্যুনতম কাজ। ওইটি কুমুদিনীর পছন্দ হয়েছিল। কুমুদিনীকে কোনদিনও গয়না পরে সাজতেও দেখেনি কেউ। মানব যখন পিতৃহারা হয়, তখন নিতান্তই ছোট। মোটে আট। ওরও মনে নেই মাকে সেজেগুজে রঙ্গীন পোশাকে দেখেছে বলে।
শাড়িগুলো এদিক ওদিক ওলট পালট করতে গিয়ে রঙ্গনার নজর গেল নীচের তাকে। অখানে যত্ন করে একটা কোণে রাখা কুমুদিনী আর ওঁর স্বামীর সমস্ত রেজাল্ট। পাতাগুলো হলুদ হয়ে গিয়েছে, অস্পষ্ট সব অক্ষরও। আবছা কিছু নম্বর, স্কুলের নাম ঠিকানা, কিছু তারিখ। শ্বশুরমশাইকে রঙ্গনা দেখেনি, তাই ওঁর কাগজপত্র দেখে আলাদা করে কিছু মনে না হলেও কুমুদিনীর মার্কশিটগুলো দেখতে দেখতে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল। উনিও যে সাদা শাড়ি আর খোঁপার আগে রঙ্গীন শাড়ি, লাল ফিতে বাঁধা দুই বেণী ছিলেন, মনেই হয়নি কখনও। উনিও হয়তো সকালবেলা স্কুল, তারপর বিকেলে বাড়ি ফিরে ব্যাগ ফেলে ছুটতেন পিছনের মাঠে, অনেক সময়ে মায়ের কান মলা খেয়ে তবে ফিরতেন পড়তে বসতে।
কী সুন্দর গুছিয়ে রাখা জিনিসপত্র আলমারিতে। আবার সমস্ত কিছু যথাস্থানে রেখে রঙ্গনা এবার খুঁজতে লাগল ব্যাঙ্ক ইন্সিয়োরেন্সের কাগজ। ওর চোখে পড়ল শালের সম্ভারের পিছনে একটা গোলাপি রঙের ফাইল। দরকারি কোন কাগজ নাকি? ফাইলটা টেনে বের করল রঙ্গনা। স্বচ্ছ্ব প্লাস্টিকের ফাইল কাভার। ভিতরে অনেক পুরনো কাগজ। খয়েরি হয়ে যাওয়া। সযত্নে না ধরলে চুরচুর করে ভেঙ্গে পড়বে, এমনই ভঙ্গুর অবস্থা।
রঙ্গনা সাবধানে কাগজগুলি বের করে একে একে দেখতে লাগল। বাড়ির দলিল একটা। সেখানে অক্ষর অস্পষ্ট। কষ্ট করে পড়ে রঙ্গনা বুঝল, বাংলাদেশের খুলনা শহরের কোন বাড়ির দলিল। সই করেছেন শ্রী নারায়ণদেব গঙ্গোপাধ্যায়। মানে কুমুদিনীর দাদা শ্বশুর। বাবা, কত পুরনো। কত মূল্যবান। যদিও দেশ ভাগের পরে সেই সব আর কিছুই পড়ে নেই, তাও। পরের কাগজটা একটা চিঠি। অমূল্য মুখোপাধ্যায়ের লেখা। শ্রী আদিত্যনারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় কে জানিয়েছেন যে অমূল্য বাবুর কন্যা একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছেন, ৭ই বৈশাখ, মুঙ্গেরের সদর হাসপাতালে। আদিত্যনারায়ণ কুমুদিনীর শ্বশুরমশাইয়ের নাম। এই চিঠিটি তার মানে রঙ্গনার শ্বশুর মশাইয়ের জন্মের সংবাদ বাহক। সেই চিঠি এত বছর ধরে এমন যত্নে রেখে দিয়েছিলেন কুমুদিনী। আরো কিছু চিঠি দেখতে পেল রঙ্গনা। মূলত শ্বশুর মশাই শশাঙ্কদেবের লেখা। বিভিন্ন সময়ে। বিভিন্ন দরকারে, অদরকারে। তার মধ্যে মানবের জন্মের চিঠিও রয়েছে। আরো কত কিছু। কিছু সাদা কালো ছবি, যা এখন স্মৃতির ভারে খয়েরি হয়ে গিয়েছে। কোন কোন জায়গায় আবার ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। কালো কাগজের ওপর সাটিয়ে রাখা, এত বছর পর কোণগুলি উঠে আসছে। ছবিগুলোয় পুরুষেরা সকলে ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত, কারুর মুখে হাসি নেই। মেয়েরাও গম্ভীর মুখে। ছাপা শাড়ি পরে, বড় হাতা ব্লাউজ। সেই আমলের এই ফ্যাশন। কাউকেই চিনতে পারল না রঙ্গনা। কেবলমাত্র একটা ছবি বাদে। কুমুদিনী ও তাঁর স্বামীর ছবি। বিয়ের পরে পরেই তোলা হয়তো। কুমুদিনীর চোখে মুখে নববধূর লাজ। ঘোমটা মাথায়, মুখ নিচু, আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে। পাশে হাসিমুখে রঙ্গনার শ্বশুর মশাই শশাঙ্কদেব। কুমুদিনীর মতো অমন দাপুটে ভদ্রমহিলা, যাকে বিয়ের তিরিশ বছর পরেও রঙ্গনা ভয় পেত, মুখ তুলে কথার পিঠে কথা বলতে পারত না, সেই ভদ্রমহিলা যে এক কালে এমন লাজুক ও শান্ত ছিলেন, অভাবনীয়। সত্যি, এই আলমারি গোছাতে গিয়ে কত নতুন ভাবেই না রঙ্গনা চিনছে ওর মৃতা শাশুড়িকে।
কাগজগুলো তুলে রাখল রঙ্গনা। আলমারিতে তালা লাগাতে গিয়ে চোখে পড়ল খাটের কোণে মেঝেতে একটা কাগজ পড়ে রয়েছে। কোনো চিঠি হয়তো। নিচু হয়ে তুলল কাগজটি। এটিও একটি চিঠিই। বাকিগুলোর চেয়ে কম পুরনো। একটু কৌতূহল হল রঙ্গনার। কার চিঠি? কী লেখা? তারিখ লেখা ১৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫। মুক্তোর মতো হাতের লেখায় নীল কালিতে লেখাঃ
প্রিয় কুমুদিনী
আজ তোমাদের বাড়ি গিয়েই কথাগুলো তোমায় সামনাসামনি বলব ভেবেছিলাম। কিন্তু শশাঙ্কদার মা বাবা থাকায় সেই সুযোগ পেলাম না। অবশ্য তুমি রাজি থাকলে আমি নিশ্চয়ই ওনাদের এবং তোমার মা বাবার সাথে কথা বলবো এবং অনুমতি নেব। কিন্তু তার আগে সবচেয়ে জরুরি জানা তোমার মতামতটি।
তোমাকে আমি বহুবার বলেছি। ভালোবাসি তোমায়। ভালোবাসি তোমার কথা বলা। তোমার ভঙ্গিমা। তোমার হাসি। তোমার সবটুকু। সাধারণের মধ্যেও অসাধারণ তুমি। রোজের একঘেয়েমিতেও তুমি অনন্যা। বাবুকে যখন বকো বা ধোপাকে যখন যত্ন করে জামাকাপড় বুঝিয়ে দাও, বা ধরো তমাদের বাসায় গেলে আমার পছন্দ অনুযায়ী ঠিক বেশি চিনি দিয়ে চা দাও, তোমার শরীর খারাপ হলে ওষুধ খেতে বললে আমায় পাত্তা দাও না - সব, সব। তোমায় তুমি রূপে ভালোবাসি কুমুদ। লক্ষ্মীটি, আমায় বিয়ে করো।
জানি আমার দেওয়া বিয়ের প্রস্তাব শুনে হয়তো তুমি অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়বে। কিন্তু আমার সমস্ত ইষ্ট দেবতার শপথ নিয়ে বলছি। আমার অন্তরের যত স্নেহ ও ভালোবাসা আছে, সমস্ত দিয়ে তোমায় আর বাবুকে ভরিয়ে রাখবো। একবারের জন্যও তোমায় বা মানবকে শশাঙ্কদার অভাব বুঝতেই দেব না।
কুমুদ এই যে আমি সময়ে অসময়ে তোমাদের বাসায় আসি, এ কি শুধুই এক প্রাক্তন সহকর্মী ও তাঁর পরিবারের প্রতি কর্তব্যবোধে? তুমি কি একবারও বোঝোনি যে এটা অন্য টান? আর যদি বা বুঝেও তুমি অস্বীকার করে থাকো, বা আমায় গ্রহণ করতে না চাও, তাহলেও আমার কোনো খেদ নেই। আমি চিরকাল মন প্রাণ দিয়ে তোমাকে একইভাবে ভালোবেসে যাবো। সম্মান করে যাবো। এবার তুমি যা ভালো বোঝো। তোমার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।
ইতি
তোমার প্রিয়তোষ দা
রঙ্গনা স্তব্ধ। প্রিয়তোষ কাকু? ওদের পরিবারের সদস্য বললেও কম বলা হয়। নিকটাত্মীয়ের চেয়ে কোনো অংশে কম যেতেন না। মানবের পিতৃতুল্য। যেই মানুষটা বটবৃক্ষের মতো না আগলে থাকলে নাকি মানব আর কুমুদিনীর জীবন লন্ডভন্ড হয়ে যেত, সেই প্রিয়তোষ কাকু? মাকে এত ভালোবাসতেন? আর মা? উনিও কি? নিশ্চয়ই তাই, নইলে এত বছর ধরে এমন যত্ন করে চিঠিটা থাকতো না...তাহলে কি সমাজ ও লোকলজ্জার ভয়ে সাড়া দিতে পারেননি? এতগুলো বছর কাউকে জানতেই দিলেন না? চিঠিটা পেযে কি মাও বিচলিত হয়েছিলেন? ভয়? হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল? উত্তর কি মুখে দিয়েছিলেন? না চিঠিতে? কী ছিল তার বয়ান?
প্রিয়তোষ কাকু গত বছর পুজোর ঠিক পরে পরেই দীর্ঘ রোগভোগের পর চলে গিয়েছেন। মানব মা কে সেই সংবাদ যখন দেয়, কুমুদিনী নিরুত্তাপ, নির্বাক। খানিকক্ষণ ওরকম দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করেছিলেন। রঙ্গনার সব ছবির মতো স্পষ্ট মনে আছে। কুমুদিনী সেই রাতে খাননি। পরদিন সকালে মানবকে ডেকে বলেন, " বাবু উনি তোর পিতৃতুল্য ছিলেন। তুই ঠাকুরমশাইকে ডেকে বিধান না। আমি চাই তুই ওনার কাজ করিস। আর রঙ্গনা, আগামী কয়েকদিন আমাদের বাড়িতে অশৌচ পালন হবে। খেয়াল রেখো।"
রঙ্গনা সেদিন কিচ্ছু না বুঝে অবাক হলেও আজ সব জলের মতো পরিষ্কার। পঞ্চাশ বছরের ওপর চলতে থাকা এই নীরব প্রেমের গল্প, এ যে এক অন্য কুমুদিনীর কাহিনী। এই কুমুদিনী শাসন ছাড়াও ছিলেন এক রক্ত মাংসের মানুষ। এই কুমুদিনীরও একটা হৃদয় ছিল। ছিল সযত্নে সভয়ে চেপে রাখা আবেগ। ভালোবাসা। এতগুলো বছর পর আজ কুমুদিনী ও তার প্রিয়তোষদা সমস্ত লোকলজ্জার ভয় কাটিয়ে হয়তো অবশেষে এক হয়েছেন, চির অসীমের ওপারে।
পড়ন্ত সূর্যের রশ্মির ছটায় পশ্চিমের ঘরটা আলোকিত। কুমুদিনীর ছবিটাও সেই দ্যুতিতে বড্ড জীবন্ত। আজ প্রথমবার সেইদিকে তাকিয়ে রঙ্গনার দুই চোখ চাপিয়ে জল এলো।


Thursday, September 13, 2018

আগন্তুক ১৫

১৫।

অ্যানা বাড়ি ঢুকে সটান নিজের ঘরে চলে গেল। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে রইল সারাদিন। ভয়ানক অসুস্থ বোধ করছিল ও। সন্ধ্যের দিকে একবার পিটার এসেছিল ওর সাথে দেখা করতে, কিন্তু ও তখনও বিছানায়।
"ঠিক আছে। আমি কাল এসে অ্যানার সাথে দেখা করে যাবো।" অ্যানার মাকে এই বলে পিটার চলে গেল।
অ্যানা সেই রাত্রে ঘুমোতে পারল না।
সারারাত জ্বরে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল ও। পরেরদিন, অর্থাৎ ৩১শে অক্টোবর, অ্যানার মা ডাক্তার ডাকলেন মেয়ের জন্য।
ডাক্তার রুগীকে দেখে বড়ই চিন্তিত বোধ করলেন।
"আমি ভালো বুঝছিনা অ্যানার কী হয়েছে। কিছুই ঠাহর করতে পারছিনা। আমি বরং আবার বিকেলে আসবো।" এই বলে ডাক্তার চলে যান।
বিকেলে কথামতো আবার পিটার এলো অ্যানার সাথে দেখা করতে। বেচারি অ্যানা তখন বড়ই অসুস্থ, কথা বলার ক্ষমতাটুকুও নেই। পিটার শান্ত হয়ে অ্যানার বিছানার পাশে বসে রইল, ওর হাতে হাত রেখে।
সন্ধ্যে সাতটার দিকে রাস্তায় একটা হইহট্টগোল শোনা গেল। পিটার জানলার ধারে গিয়ে দেখল লোকজন ছোটাছুটি করছে, দৌড়চ্ছে। ও অ্যানাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামল।
"আগুন! আগুন! দ্য কর্নার শপে বড় আগুন লেগেছে।" লোকের গলা পেল ও।
দোকানের কাছাকাছি গিয়ে দেখল বিশাল বিশাল আগুনের শিখা দ্য কর্নার শপকে গ্রাস করছে। লেলিহান শিখায় প্রায় আর কিছুই দেখা যাচ্ছেনা।
"ডেভ কোথায়? ওই তো ডেভের গাড়ি বাইরে রয়েছে। তার মানে ডেভ ভিতরে আছে।" কেউ মন্তব্য করলেন।

আর তারপর তাঁরা সকলে ডেভকে দেখলেন। ডেভ জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
"লাফ দাও ডেভ। নিজেকে বাঁচাও।" সকলে বলতে লাগলেন।
কিন্তু ডেভের কোন হেলদোল নেই। উনি জানলার ধারে হাসিমুখে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন।
কিছু মহিলারা চিৎকার করতে থাকলেন।
মিস্টার হার্ট দোকানের দিকে ছুটতে গেলে বাকিরা ওঁকে আটকান। দোকানে তখন আগুনের শিখা আরো বড় আকার নিয়েছে। উডএন্ড বাসীরা দেখল ডেভ স্লাটিন দাঁড়িয়েই রয়েছেন, অনড়, অচল। সেই শেষ দেখা। আর কখনও ডেভ স্লাটিনকে কেউ দেখেননি।

পিটার ফিরে গেল অ্যানার বাড়ি। ডাক্তার তখন অ্যানার মায়ের সাথে নিচে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত, চিন্তিত।
ওপরতলা থেকে এক বিকট চিৎকারে সবাই চমকে উঠল। ওরা ওপরে দৌড়ে পৌঁছল অ্যানার ঘরে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। অ্যানা আর নেই।

আগন্তুক ১৪

১৪।

"হীরের আংটিগুলো কই"? ডেভের ঠাণ্ডা কণ্ঠস্বরে প্রশ্নটা কানে এলো অ্যানার।
অট্টহাস্যে ফেটে পড়েছেন ডেভ। অ্যানার ভীষণ ভয় করছে।

"আমি ইচ্ছে করেই আজ দরজায় তালা দিয়ে যাইনি। আমি চেয়েছিলাম তুমি আজ এই ঘরে আসো অ্যানা। আমার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে দেখে আমি খুব খুশি।"

অ্যানা চেষ্টা করলো মুখে চোখে ভয়, বিস্ময় প্রকাশ না করতে।
"তুমি হীরের আংটিগুলো পাওনি তো?" ডেভ আবার জিজ্ঞেস করলেন।

অ্যানার মনে পড়ল, সত্যিই তো, আংটিগুলো তো ও দেখেনি। কোথায় সেগুলি?

ডেভ ঘরের ভিতরে এলেন। অদূরে রাখা একটি ছোট বাক্স খুলে সেখান থেকে আংটিগুলো বের করে টেবিলের ওপর ফেললেন।
"ওগুলো আপনার না। ওগুলো মিস গ্রেটা গরডনের।" অ্যানা বলল।
"এগুলি এখন আমার।" ডেভ নিষ্ঠুর হাসি হেসে বললেন, "গ্রেটা গরডন এগুলো আমায় দিয়েছেন।"
"কিন্তু কেন? আর টাকাগুলো? সেগুলো কে দিল?"
"আমার স্পেশালঅর্ডার কাস্টোমাররা এগুলো দিয়েছেন সব আমায়।"
"এই টাকাগুলো তাহলে মাইক বেলি আর আর্থার রাইজম্যান দিয়েছেন?"
"ওরা বটে। সাথে আরো অনেকেই। তুমি সকলকে দেখোনি।"
"কিন্তু ওরা সকলে কেন দেন এই টাকা আপনাকে? কীসের বিনিময়ে?"
"কারণ আমি ওদের কাজে সাহায্য করি। সেই সাহায্যের পারিশ্রমিক এই টাকা ও ধন সম্পত্তি।।"
"কী কাজ?"
ডেভ ভাঙ্গা হাতওয়ালা পুতুলটা ধরে অ্যানার মুখের সামনে ধরে ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বললেন, "মিস জোনা লি কে মনে পড়ে?"
অ্যানা ফ্যাকাসে গলায় উত্তর দেয়, "মিস লি? হ্যাঁ। ওই তো অভিনেত্রী। ওঁর হাত ভাঙল। গ্রেটা গরডন তাই ফিল্মে পার্ট পেলেন।"
"ঠিক বলেছ।" ডেভের চোখমুখ ক্রমশ হিংস্র হয়ে যাচ্ছে।   
"এই যে দেখছ? এই যে এই পুতুলটা? এটি মিস জোনা লি।"
অ্যানা ভয়ে কাঁপছে। ডেভ স্লাটিন কি পাগল? কীরকম মানুষ ডেভ? এসব কী বলছে?
ডেভ এরপর একটি ছেঁড়া ছবির দিকে হাত বাড়ালেন। অ্যানার দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করে বললেন, "এটি বলো তো কে?"
অ্যানা তো স্পষ্ট চেনে এই মানুষটিকে। সেদিনের ফুটবল ম্যাচে, আহত হল। মাইক বেলির মারা বলের আঘাতে। মাইক বেলির দল জিতে গেল।
"ব্রায়ান টমাস। গোলকিপার।" অ্যানার স্বর এখন প্রায় অস্পষ্ট।
"গোলকিপার ছিল। এখন আর নেই।"
ডেভ ক্রমশ অ্যানার দিকে এগিয়ে আসছেন। অ্যানার বুক ভয়ে দুরুদুরু, কপাল থেকে ঘামের বিন্দুগুলো টপটপ করে গড়াচ্ছে।  ডেভ স্লাটিনের চোখে শয়তানের দৃষ্টি। ভাঙ্গা এরোপ্লেনটি তুলে অ্যানার সামনে ধরে বললেন, "বলো দেখি এটা কী?"
অ্যানা জানে। কিন্তু ভয়ে আর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না।
ডেভ হঠাৎ করে অ্যানার হাত চেপে ধরে এবার বলে উঠলেন, "আমায় বিয়ে করো অ্যানা। আমি তোমায় খুব খুশি রাখব। তোমার যা ইচ্ছে, সব পাবে। সব দেবো আমি তোমায় অ্যানা। আমায় বিয়ে করো। পিটারকে ছেড়ে দাও।"
"না না না। এ হয় না। আপনি আমায় ছাড়ুন।" অ্যানা বৃথা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলো। ডেভের শক্ত হাতের থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলো না।
"তুমি বুঝছ না অ্যানা। আমার তোমাকে দরকার।"
"প্লিজ, আমায় ছেড়ে দিন।" অ্যানা কাকুতি মিনতি করলেও ডেভ মুক্তি দিলেন না।
"অ্যানা আমার মধ্যে বিশেষ ক্ষমতা আছে। আমি তোমায় সবকিছু দিতে পারি। আমাদের সন্তানেরাও এই বিশেষ ক্ষমতা পাবে। প্লিজ অ্যানা। আমায় বিয়ে করো। তুমি আমার সন্তান ধারণ করবে। পরিবর্তে আমি তোমায় রাজরানী করে রাখব। ঐশ্বর্যে ভরিয়ে রাখব।"
অ্যানা প্রাণের দায়ে নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে সজোরে লাথি মারল ডেভকে। ডেভ যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেলেন। অ্যানার হাত ছেড়ে দিলেন। অ্যানা রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ল। স্পেশাল অর্ডার রুম থেকে। দোকান থেকে। ছুটতে ছুটতে পৌঁছল নিজের বাড়ি। ও হাঁপাচ্ছে।




আগন্তুক ১৩

১৩।

অ্যানার সেদিন উডএন্ড ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় দশটা বেজে গিয়েছিল। ফিরেই রেডিও চালিয়ে খবর শুনতে বসল ও। শুনল যে আর্থার রাইজম্যান কোম্পানির নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
সেই রাত্রে অ্যানা ভয়ে ঘুমোতে পারল না। ডেভ স্লাটিন কে? কী করছে ওই দোকানের পিছনের ঘরে? কী ক্ষমতা ওর? স্পেশাল অর্ডারগুলোই বা কী?
পরেরদিন সকালে অ্যানা দ্য কর্নার শপে ফেরত গেল। ডেভ ছিলেন সেখানে এবং স্বাভাবিকভাবেই বেশ রেগে ছিলেন ওর ওপর। কিন্তু একটাও কথা বললেন না। এগারোটার দিকে গাড়ি নিয়ে ডেভ বেরিয়ে গেলেন। অ্যানা দোকানের পিছনে গেল, স্পেশাল অর্ডার ঘরে। ও অবাক। গত এক বছরে যা হয়নি, আজ তাই হয়েছে।  ঘরের তালা খোলা। ডেভ তালা লাগিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছেন।
এই সুযোগ। অ্যানা দরজা ঠেলে ঢুকল ভিতরে। ঘরটি ছোট্ট। অন্ধকার। ভ্যাপসা। দেওয়াল হাতড়ে সুইচ টিপে ও আলো জ্বালালো, তবে আলোর জোর খুবই কম। চারিদিকে তাকিয়ে অ্যানা দেখল ঘরের মধ্যে রয়েছে একটি ছোট টেবিল, তার দুপাশে দুটি চেয়ার আর ঘর ভর্তি অনেক ছোট বড় মাঝারি মাপের বাক্স। অ্যানা অবাক। না আছে কোন পেন না কোন কাগজ। না কোন পেন্সিল। এই তাহলে সেই স্পেশাল অর্ডার ঘর? কাজ হয় কী করে এখানে?

ও হেঁটে চলে এদিক ওদিক দেখতে লাগল। বাক্সগুলি বাঁচিয়ে চলাফেরা করা খুব সোজা না। অ্যানা একটা বাক্সের ঢাকনা খুলল। ভিতরে অনেক অনেক পুরনো কাগজ, ছেঁড়া বই। পুরনো জামা। সেসব ঘাঁটতে গিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখল, টাকা। অনেক টাকা। বিভিন্ন দেশের টাকা। অ্যামেরিকা, জার্মানি, ফ্রান্স, আরও কত দেশের। সব দেশের নামও জানেনা অ্যানা। অ্যানা অবাক হয়ে দেখতে লাগল। ও কোনদিনও এত টাকা চোখেই দেখেনি।
আরো এদিক ওদিক দেখতে দেখতে চোখে পড়ল মাইক বেলির ব্রিফকেস। সেটি খালি। আরেকটু দেখতে গিয়ে চোখে পড়ল আরো একটা বাক্স। এটি তো আর্থার রাইজম্যানের ব্রিফকেস। এটিও খালি। কিচ্ছু নেই।

ও এবারে একটি বড় বাক্সের ঢাকনা খুলল। ভিতরে অনেক পুতুল। নানান মাপের। কিন্তু প্রত্যেকটিরই হাত বা পা ভাঙ্গা। একটি পুতুল ভীষণভাবে নজর কাড়ল অ্যানার। সেই পুতুলটি ভারি সুন্দর দেখতে। কিন্তু সেটিরও একটি হাত ভাঙ্গা। অ্যানা পুতুলটাকে টেবিলের ওপর রাখল।

অ্যানা তারপর দেখল আরো একটি  ফুটবল বিষয়ক বই। কিন্তু সেখানে সব ফুটবল প্লেয়ারদের ছবি ছিঁড়ে ফেলা।  ও বইটাকেও টেবিলের ওপর রাখল।
বাক্সের ভিতর ছিল আরও ভাঙ্গাচোড়া খেলনা গাড়ি। সেইসবের মধ্যে থেকে অ্যানা দেখল একটি ভাঙ্গা উড়োজাহাজের মডেল।

অ্যানা সমস্ত জিনিস টেবিলের ওপর রাখল। কী অদ্ভুত সংগ্রহ। এত টাকা, ভাঙ্গা খেলনা, ছেঁড়া বই। এসব কী? কেন? ডেভ স্লাটিন কেন এইসব জমিয়ে রাখেন? কোন কাজে লাগে?

দরজায় আওয়াজ পেয়ে অ্যানা চমকে উঠল। দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আগন্তুক ১২

১২।

এরপর থেকে অ্যানা মিস্টার রাইজম্যান সঙ্ক্রান্ত কোন খবরের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল। ওর পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে, যখনই কোন স্পেশাল অর্ডার ক্রেতা এসেছেন ডেভের কাছে, এবং কিছু রেখে গিয়েছেন এখানে, দিন কয়েকের মধ্যেই তিনি সংবাদে এসেছেন। আর্থার রাইজম্যানের বিষয়ে যে কোন খবর ও শিগগির পাবেই, সেই ব্যাপারে অ্যানা নিশ্চিত। ও এই তিন স্পেশাল অর্ডার ক্রেতাদের সম্পর্কে জানতে উদগ্রীব। আর্থার রাইজম্যানের ব্রিফকেসে লেখা দেখেছিল A.R. I.C.S, A.R. আর্থার রাইজম্যান, কিন্তু বাকিটা? হয়তো এটি ওঁর কোম্পানির নাম? উনি হয়তো ব্যবসায়ী? কে জানে। অ্যানা মন দিয়ে খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন পড়তে লাগল। কিন্তু কোথাও এই বিষয়ে কিছু চোখে পড়ল না, কানেও এলো না। তারপর একদিন ঠিক করল, ও লন্ডন যাবে।
শুক্রবার সকাল সকাল ও ডেভের জন্য নোট রেখে গেল, "ডেভ, আমি লিডনি যাচ্ছি। বিয়ের জন্য কিছু কেনাকাটি করার আছে। আজ তাই আমি দোকানে আসতে পারছি না।" চিঠিতে অ্যানা সত্যি কথা লেখেনি পুরো, তবুও, ওর কিছু যায় আসল না।
অ্যানা বাসে করে লিডনি, তারপর সেখান থেকে ট্রেনে চেপে লন্ডন পৌঁছল। প্যাডিংটন স্টেশনে যখন ও নামে, তখন বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে। একটা টেলিফোন বুথের জন্য ওর দুই চোখ আনচান করছে।
হ্যাঁ, ওই তো। অ্যানার চোখে পড়ল একটি টেলিফোন বুথ। স্টেশনের ঠিক বাইরেই। কিন্তু ভিড়। অপেক্ষা করতে করতে অ্যানার চোখে পড়ল একটা বিশাল বড় অ্যাডভারটাইসমেন্ট বোর্ড। লেখা, I.C.S, International Computer Services! ওই তো, মিস্টার রাইজম্যানের কোম্পানি তাহলে নিশ্চয়ই এটা।
অ্যানা একটা বুথ ফাঁকা পেতে সেখানে গেল আর ভয়ে ভয়ে বোর্ডে দেখে রাখা নম্বর ২২২৮৯৫৯ ডায়াল করলো। কয়েকটা রিং হওয়ার পর অপর প্রান্ত থেকে এক সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরে শুনল, "হেলো, I.C.S., কীভাবে আপনার সাহায্য করতে পারি?"
অ্যানা একটু থমকে বলল, "আমি কি মিস্টার রাইজম্যানের সাথে কথা বলতে পারি? আর্থার রাইজম্যান। আমার ধারণা উনি এই কোম্পানিতে চাকরি করেন।"
ভদ্রমহিলা হেসে বললেন, "চাকরি করেন? হ্যাঁ। উনি এই কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান। দাঁড়ান। আমি ওঁর সেক্রেটারিকে লাইনটা দিই।"
এবারে এক অন্য নারীকন্ঠ ফোনে বললেন, " মিস্টার রাইজম্যানের সেক্রেটারি বলছি। বলুন?"
" আমি মিস্টার রাইজম্যানের সাথে কথা বলতে চাই।"
"কে বলছেন?"
"উনি আমার নাম জানেন না।"
"আপনার কি ওঁকে এখন ফোন করার কথা ছিল?"
"না।"
"দুঃখিত। উনি একটি মিটিঙে রয়েছেন। এক ঘণ্টার মধ্যে ওঁর সুইজারল্যান্ডের ফ্লাইট। এখন তো কথা বলতে পারবেন না।"
"কিন্তু আমার যে খুব দরকার। কয়েক মিনিট মাত্র।"
বিরক্ত হয়ে সেক্রেটারি বললেন, "দুঃখিত। সম্ভব না। কোন মেসেজ দেওয়ার থাকলে বলতে পারেন।"
"না ঠিক আছে। আমি সামনের সপ্তাহে ফোন করব। উনি ফিরে আসবেন তো?"
"হ্যাঁ। ঠিক আছে। গুডবাই।" ঝনাৎ করে ফোন রাখার শব্দ পেল অ্যানা।

অ্যানা খুব খুশি। যদিও মিস্টার রাইজম্যানের সাথে কথা হয়নি, অন্তত ওঁর কোম্পানির নাম জেনেছে ও। ও একা একা সেইদিন  লন্ডনে ঘুরে বেরাল। একটি ক্যাফেতে বসে চা খেলো। সিনেমা দেখল। সারা দিন লন্ডনে নিজের মতো কাটিয়ে অ্যানা সাড়ে ছটা নাগাদ সন্ধ্যের ট্রেন ধরতে প্যাডিংটন স্টেশনে ফেরত এলো। একটা সান্ধ্য সংবাদপত্র কিনে সিটে বসে গুছিয়ে নিলো নিজেকে। অ্যানা ক্লান্ত। কিন্তু খবরের কাগজে কিছু একটা দেখবে, এই ভরসায় ও কাগজটি খুলল। এবং সেখানে বড় করে লেখা দেখল,
"খানিক আগে একটি প্রাইভেট প্লেন ক্র্যাশ করেছে লন্ডনের কাছে। ছয় যাত্রীই মৃত। প্রত্যেকেই I.C.S.এর কর্মী। প্লেনটি সুইজারল্যান্ড যাচ্ছিল। মৃতদের মধ্যে ছিলেন মিস্টার ICSএর চেয়ারম্যান, মিস্টার অ্যালফ্রেড গ্লুক।
এই বিষয়ে আমাদের করেস্পন্ডেন্টকে ICS এর ভাইস চেয়ারম্যান মিস্টার আর্থার রাইজম্যান জানিয়েছেন "খুব সৌভাগ্য যে আমি বেঁচে আছি। আমারও ওই প্লেনেই যাওয়ার কথা ছিল। নেহাত আমার মিটিঙটি দেরিতে শেষ হয়। তাই ফ্লাইট মিস করি।"
মিস্টার রাইজম্যান সম্ভবত কোম্পানির পরবর্তী চেয়ারম্যান হতে চলেছেন।"



Wednesday, September 12, 2018

আগন্তুক ১১

১১।

দেখতে দেখতে আরেকটা অক্টোবর মাস এসে গেল। বাইরে আবহাওয়া স্যাঁতস্যাঁতে, ঠাণ্ডা। মধ্যে মধ্যেই বৃষ্টি পড়ছে। মন মেজাজ শরীর কোনটাই আজকাল ভালো যাচ্ছেনা অ্যানার। আগের সেই প্রাণশক্তিটাই যেন কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছে। সর্বক্ষণ ওর মনের মধ্যে অস্থিরতা, অবসাদ। অসুস্থ থাকে বেশিরভাগ সময়েই। আর তাই তেমন বেরোয়ও না বাইরে।
উডএন্ডের সকলেই প্রায় জানেন অ্যানা আর পিটারের ঝগড়ার কথা। তাঁরা এও জানেন ঝগড়ার কারণ। অ্যানা যে ডেভের সাথে লন্ডন গিয়েছিল, সে খবর কারুর কাছে অজানা নয়। অ্যানা অসুখী। কিন্তু তাঁরা কেউ ওর সাহায্য করতে পারেননা চাইলেও। কারণ অ্যানা কারুর সাথে তেমন কথা বলেনা। অ্যানা নিয়ম করে দ্য কর্নার শপে যায়। অপেক্ষা করে থাকে আরো এক স্পেশাল অর্ডারের।

অ্যানাকে স্পেশাল অর্ডারের জন্য বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। মাসের মাঝামাঝি একদিন দুপুরে অ্যানা একা দোকানে কাজ করছিল। এমন সময়ে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক এলেন দোকানে। ভারিক্কি চেহারা, দামী বেশভূষা। নাকের নিচে মোটা গোঁফ। হাতে একটা বড় ব্রিফকেস।
"সুপ্রভাত মিস।" উনি হেসে বললেন অ্যানাকে।
"সুপ্রভাত স্যার।" অ্যানাও নম্রভাবে উত্তর দিল। ইনি কে? সেই বিষয়ে ওর বিস্তর কৌতূহল।
"আমি মিস্টার ডেভ স্লাটিনকে খুঁজছি।"
অ্যানা হেসে উত্তর দিল, "আপনি কি কিছু বিক্রি করতে এসেছেন?"
"হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন," জবাব এলো।
অ্যানার কথাটা বিশ্বাসযোগ্য লাগল না। ও জানে, এই ভদ্রলোক কিছুতেই সেলসম্যান হতেই পারেন না। কিন্তু ওর অসীম কৌতূহল, তাই কথা চালিয়ে যেতে হবে যে কোন ভাবেই।  অ্যানা বলল, "আচ্ছা, তা সাধারণত এই দোকানের জন্য আমিই সেলসের লোকজনের সাথে কথা বলে থাকি। আপনি আমায় নির্দ্বিধায় বলতেই পারেন।"
কথা বলতে বলতে অ্যানা খেয়াল করলো ব্রিফকেসে লেখা "A.R.I.C.S"।
"ধন্যবাদ, কিন্তু আমার ওঁর সাথে বিশেষ দরকার আছে। প্রাইভেটে। আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেই এসেছি। সেই লন্ডন থেকে এসেছি। দয়া করে ওঁকে ডেকে দিন।"
"ক্ষমা করবেন। উনি এই মুহূর্তে ভীষণ ব্যস্ত। আমি ওঁকে জানাচ্ছি আপনার কথা। কী নাম বলবো?" অ্যানা প্রশ্ন করলো।
ভদ্রলোক একটু হেসে বললেন, "বলুন আর্থার রবারটস।"
অ্যানা ওঁকে বসতে বলে দোকানের পিছনে চলে গেল। সিঁড়ির মুখে দেখল ডেভ নিচে নামছেন।
"আপনার কাছে একজন এসেছেন। দোকানে বসিয়েছি।"
"থ্যাঙ্ক ইউ। আমি দেখছি।" এই বলে ডেভ এগিয়ে গেলেন।
"আসুন মিস্টার রাইজম্যান। দেখা হয়ে ভালো লাগছে।"

রাইজম্যান? তবে যে বললেন রবারটস? কী মিথ্যেবাদী, অ্যানা ভাবল।
ভদ্রলোক অ্যানার দিকে তাকালেনই না আর। "আমারও ভালো লাগছে।" বললেন ডেভকে। তারপর ডেভের পিছু পিছু স্পেশাল অর্ডার ঘরে চলে গেলেন।
আবার একটা স্পেশাল অর্ডার কাস্টমার। অ্যানার কৌতূহল তুঙ্গে। ও দোকানেই রয়ে গেল।
A.R.I.C.S এ A.R. হল তার মানে আর্থার রবারটস। কিন্তু বাকিটা?

দেড়টা নাগাদ অ্যানা দোকানের পিছন থেকে কথা বলার শব্দ শুনতে পেল। তাকিয়ে দেখল আর্থার আর ডেভ বেরোচ্ছেন ঘর থেকে।
"আপনি আমার অনেক উপকার করলেন ডেভ। অশেষ ধন্যবাদ।"
" ঠিক আছে। আমার সহকারী দোকানে নেই। তবে আপনি নিজেই দরজা খুলে যেতে পারবেন। আসুন।" এই বলে ডেভ চলে গেলেন ওপরে। আর্থার দোকানের সামনে এসে দেখলেন অ্যানা একটা কোণে চুপ করে বসে আছে। দুজনের চোখাচুখি হল। সেই দৃষ্টিতে একে অপরের প্রতি ছিল চরম বিরক্তি।
"ও আপনি এখানে? আমি ভাবলাম আপনি নেই। চলে গিয়েছেন।"
"না, আমি আজ দোকানেই লাঞ্চ করবো।"
খানিক ইতস্ততার পর অ্যানা বলল, "মিস্টার রবারটস, দোকানে খুব ভালো ব্রেড আছে। নেবেন?"
"রাইজম্যান। আমার নাম রাইজম্যান।" আর্থার চেঁচিয়ে বললেন।
"দুঃখিত। মিস্টার রাইজম্যান, আপনি কি ব্রেড কিনবেন? বাড়ির বানানো।"
"ঠিক আছে। দিন। আমার স্ত্রীর ভালো লাগবে।" গলার স্বর একটু নামিয়ে আর্থার রাইজম্যান জবাব দিলেন। 
"এই নিন। আপনার ব্রিফকেসে ভরে নিন। ও, আপনার ব্রিফকেস কই? আপনি বোধহয় ফেলে এসেছেন।" অ্যানা বলল।
"ব্রিফকেস? আমার কোন ব্রিফকেস নেই।" অবাক হয়ে মিস্টার রাইজম্যান বললেন কথাটা।
"না না আপনি আনলেন তো। দাঁড়ান, আমি নিয়ে আসছি। সম্ভবত ভিতরের ঘরে রেখে এসেছেন। "
আর্থার অ্যানার হাত চেপে ধরলেন। রাগতস্বরে কেটে কেটে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, "আমার কোন ব্রিফকেস নেই। আমি কিছু ফেলে যাচ্ছিনা।"
অ্যানা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। "ঠিক আছে। প্লিজ আমার হাত ছাড়ুন। লাগছে।" প্রবল আকুতিতে আর্থার ওর হাত ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। এই তাড়াহুড়োয় উনি ব্রেড নিতে ভুলে গেলেন।
অ্যানা দেখল ওঁকে গাড়ি করে বেরিয়ে যেতে। পাঁচ মিনিট পরও ওর হাত যন্ত্রণায় কাঁপছে। 






Tuesday, September 11, 2018

Komal Ni

"I'm afraid you are definitely not getting the notes right my dear."

"You are faltering at the high notes...It is Ma Pa Dha Ni. You are mising the Ni.."

"There is a reason that the note is Komal Ni. Singing the Shuddh version will not do. Why don't you understand?"


"Bhawani Ji, what is this? You know I am so busy right now. Yet you insisted that I come and supervise this recording. You claimed that she is nothing less than a Koyel. Is this how low the standard of Melody Records has fallen that any random person with an okayish voice and absolutely no hold over swaras and raagas get the chance to sing for an erstwhile prestigious label? I am disappointed Ji. I did not cancel my prior appointments to come and train your protege, did I?" A visibly angry Shruti left the studio leaving the young girl in tears. This was Sohini's first day at the recording studio. Although she had been performing in stage shows for quite some time for her music school, the cold recording studio gave her chills. Her nervousness was visible in her trembling voice. Being repeatedly reprimanded by the stalwart singer, Sohini's confidence had hit an all time low. She excused herself from Bhawani Prasad and left for the day.

Shruti was an award winning classical singer and had many best selling records to her name. Getting her appointment was no easy task. But Bhawani Prasad, the owner of Melody Records and Studio, utilised the old connection of the famous singer with his studio to get her time. He wanted her to supervise Sohini's recording. Bhawani Prasad had discovered Sohini at a stage show in his neighbourhood and was awestruck by her melodious voice. Being in the business for long he had realised that this voice, with a few more "taalims" would one day be the voice of the nation. Hence he had invited Shruti to help the girl. Unfortunately, it did not work out that way.

Shruti reached home and went to her riyaz room. She started playing the taanpura and singing a bandish in Raag Bhairavi. The first two lines of the bandish did not sound too well to her.  Shruti had a habit of recording her practice sessions so that she could improvise. She replayed the session and found that the komal ni was not right. She decided to retry. Strangely, even after ten attempts, she was just not satisfied. She was unable to hit Komal Ni despite trying her best. This had never been the case. She has always had the best hold over the swaras and the notes played at ease in her rich and toned voice. Then what was happening to her today? Why was she not able to hit the note right? Why was she, the mistress of notes faltering like that silly girl at the studio? What was her name? Sohini... right.. musical name yet bad with notes. No matter how much she tried, she was singing the Komal Ni in the Shuddh form. But why? Shruti was perplexed. She started sweating despite the cooling of the air conditioner in the room.  She decided to try for one more time and took up the taanpura. The sound of sargam was broken by the shrill ringing of her cell phone.

Shruti picked it up. It was Bhawani Ji. He called to inform that Sohini had died in a car accident. Although it looks like an accident, but the police are not ruling out suicide too. So they may come over to her place for questioning as she was present at the studio during her recording. Shruti must stay at home.

Shruti hung up and sat down on the floor with a thud. Her face was ashen. She looked at her reflection on the mirror in front. She could see Sohini's shadow behind her. Her hair looked disheveled. Yet she had a calm smile on her face.
"Madam, let me teach you how to get the Komal Ni right. Come...", she said.

Monday, September 10, 2018

মা

মা

স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে বাইরে চোখ রেখে উমা দেখল, বৃষ্টিটা একটুও কমছেনা, ইশ। এত বেজে গেল, পাঁচটার ট্রেনটা মিস হয়ে গিয়েছে এর মধ্যেই। সোয়া ছটার ট্রেনটাও না মিস যায়, আকাশের যা অবস্থা। ব্যাগের ভিতর থেকে মোবাইলটা বের করে একবার শম্পাদিকে ফোনে জানিয়ে রাখল উমা। গুঞ্জা স্কুল থেকে ফিরলে যেন ঠিক করে খেয়ে নেয়, ওর ফিরতে দেরি হবে, রাত্রের জন্য কী রান্না হবে, ইত্যাদি। একবার আশে পাশে চোখ বুলিয়ে নিল উমা। ইতিমধ্যেই জল জমে গিয়েছে অনেকটা, প্রায় হাঁটু অবধি। ছাউনির তলায় ও ছাড়াও রয়েছে ওদের স্কুলের ইউনিফর্ম পরা দুটি মেয়ে, স্কুলের বয়স্ক ক্লার্ক, শ্যামাপদ বাবু। প্রত্যেকেই বৃষ্টিটা ধরার অপেক্ষায়। বার বার সকলেই কব্জি উল্টে ঘড়িতে সময় দেখছে আর মুখে বিরক্তিসূচক শব্দ করছে। এছাড়াও একটি কালো রঙের নেড়ি একটা কোণায় শুয়ে রয়েছে, ওর গায়ের ওপর পরম নিশ্চিন্তে শুয়ে তিনটি সদ্যোজাত ছানা।

"বুঝলেন দিদি, এর থামার কোন চান্স নেই। আমি এই বেলা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যাই। পরে আরো জল জমে গেলে আমি পারবো না। আপনাকে এগিয়ে দেবো?" ব্যাগ থেকে ছাতা বের করতে করতে জিজ্ঞেস করেন শ্যামাদা।

"না দাদা, আপনি এগোন। আমি বরং আরো একটু অপেক্ষা করি। ট্রেনেও অনেকটা রাস্তা। ভিজে গেলে জ্বর বাবাজী আসবেই আসবে। সামনে টার্মিনাল পরীক্ষা, গুঞ্জাটারও পরীক্ষা এসে গেল। এখন আমার অসুস্থ হওয়ার কোন অবকাশ নেই," উত্তর দিল উমা।

"ভালো বলেছেন দিদি। অবকাশ নেই। সত্যি, মা হয়েছেন বলে নিজের জীবনের ওপরই যেন নিজের কন্ট্রোল নেই। সবই আশেপাশের ওপর নির্ভর করবে। এর তার ওপর আপানার অবসর। যাই হোক, আমি আসি। কাল দেখা হবে।" এই বলে শ্যামাপদ বাবু কালো ছাতাটা বাঁ হাতে ধরে, ডান হাত সাইকেলের হ্যান্ডেলে রেখে এগিয়ে গেলেন। ফেলে গেলেন উমাকে এক রাশ স্মৃতির ভিড়ে।

সত্যিই তো, গুঞ্জাই তো ওর জন্য সব কিছু। সাত বছর আগে অরণ্যর আকস্মিক মৃত্যুর পর যখন উমা সাঙ্ঘাতিকভাবে অবসাদে ভুগছে, ঠিক তখনই দুর্ভাগ্যবশত ওর মিসক্যারেজও হল। জীবনের থেকে সমস্ত আশা বা চাওয়া পাওয়া হারিয়ে এক গভীর হতাশায় ওর দিন কাটত। এমন কী এই অবসাদের কারণে কাজে মন দিতে না পেরে নামী আইটি কোম্পানির চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিল উমা। সারাক্ষণ ঘরের কোণে অন্ধকারে বসে চুপচাপ আনমনে থাকা, মাঝে মধ্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদা। মা বাবা তাদের একমাত্র মেয়ের এই অবস্থায় ভয়ানক চিন্তিত হয়ে শেষমেশ এক কাউন্সেলরের কাছে নিয়ে যান উমাকে। ভাগ্যিস তারা তুলনামূলকভাবে প্রগতিশীল ছিলেন। আর তাই পাঁচজনে কে কী বলবে, মেয়েকে পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছে, মানেই মাথার ব্যারাম, এসবের তোয়াক্কা করেননি। ডাক্তার সান্যালের অসীম ধৈর্য ও দক্ষতার জেরে বছর খানেকের কঠিন লড়াইয়ের পর ক্রমে উমা অবসাদের কালো জাল থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে। তারপর চিকিৎসকের ও পরিবার পরিজনের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যাডপশন এজেন্সি থেকে গুঞ্জাকে বাড়ি আনে। গুঞ্জা তখন পাঁচ বছরের শিশু, এক গরীব মাদকাসক্ত পরিবারের ভয়ানক অন্ধকার পরিস্থিতিতে থেকে শৈশব হারাতে বসেছিল ওর। কপাল জোরে এনজিওর কর্মীরা গুঞ্জাকে সেখান থেকে বাঁচিয়ে এনেছিল পুলিশের সাহায্যে। সেই নরক থেকে সবে বেরিয়ে গুঞ্জারও যেমন তখন দরকার ছিল উমাকে, উমাও গুঞ্জাকে পেয়ে যেন অনেকটা নিজের প্রাণের জ্বালা জুড়োতে পেরেছিল। তারপর এই সরকারি স্কুলের চাকরি ওর জীবনকে পূর্ণতা এনে দিল। সারাদিন এই মেয়েগুলোর সাথে কাটানো আর তারপর দিনের শেষে বাড়ি ফিরে গুঞ্জা। এই নিয়েই দিব্যি চলে যাচ্ছে উমার। ভাগ্যের দোষে ও অনেক কিছু হারিয়েছে আগে। কিন্তু এখনের প্রাপ্তিগুলো ও আর কিছুতেই হারাতে চায় না। এই বাচ্চাগুলো আর গুঞ্জাই ওর জীবন। বা বলা চলে, উমার জীবন এদের কেন্দ্র করে চলে। মাতৃত্ব এনে দিয়েছে দুজনের জীবনেই পূর্ণতা।

শ্যামাপদ বাবু ঠিকই বলেছেন। মা তো, অনেক কিছু তাই বদলেছে ওর জীবনে। তবে ভাগ্যক্রমে সমস্তই ভালোর দিকে।


"হ্যাঁ মা। বৃষ্টিটা একটু কমছে এবারে। আমি আর মঞ্জরী একসাথেই আছি। বেরবো। উমাদিও আছেন এখানে। তুমি চিন্তা করোনা।" ছাত্রীদের একজন ফোনে তার মাকে আশ্বস্ত করছিল, অপরদিকেও আরেক মা, প্রচণ্ড চিন্তিত, স্বাভাবিকভাবেই। "বৃষ্টিটা একটু কমেছে। চলো স্টেশনের দিকে যাওয়া যাক।" উমা দুই ছাত্রীকে ডেকে ছাতা হাতে নামল স্ট্যান্ড থেকে।

কুকুর ছানাগুলো ততক্ষণে জেগে গিয়েছে। মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছে হামলে পড়ে। তাদের মা পরম মমতায় চেটে আদর করছে ওদের।


মাতৃত্ব যে সার্বজনীন, সার্বভৌমিক।

বিঃ দ্রঃ আজ world suicide prevention day, জানি বলা সোজা করার চেয়ে, তবুও বার বার বলবো। কোন দুঃখই এত বেশি কি যে ভাগ করে নেওয়া যায় না? বা সমাধান হয় না? মনে হয় না কিন্তু। তাই আরো একবার বলি। কখনও মন বিচলিত হলে প্লিজ কারুর সাথে ভাগ করে নিন। একা লড়ার চেয়ে কারুর সাহায্য নিলে যুদ্ধটা সহজ হয়। চেনা অচেনা যেই হোক না কেন। দেখবেন, ভালো থাকবেন।

আগন্তুক ১০

১০।

অ্যানার উইকেন্ড খুব আনন্দে কেটেছে। শুক্রবার রাত্রে ওরা লন্ডন পৌঁছয়। ডেভ ওদের জন্য একটা বিলাসবহুল হোটেলে ঘর ঠিক করে রেখেছিলেন। শনিবার সকালে ওরা দোকানপাট ঘুরে অনেক কেনাকাটি করে। তারপর সন্ধ্যেবেলা সিনেমাও দেখে। রবিবার সারাদিন এক মনোরম পার্কে সময় কাটিয়ে সন্ধ্যের দিকে ডেভ আর অ্যানা উডএন্ডে ফেরে।
পরদিন ছিল সেপ্টেম্বরের প্রথম সোমবার। বাইরে ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। দোকানে ভিড় নেই। সন্ধ্যেবেলা পিটার এসেছে অ্যানার সাথে দেখা করতে দোকানে।
"বলো পিটার? শনিবারের খেলা কেমন হল? তোমরা জিতেছ?" অ্যানা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে।
"না অ্যানা, আমরা জিতিনি। আমি খেলিওনি।" পিটার রুক্ষভাবে উত্তর দিল।
পিটারের এই আচরণে অ্যানা অবাক। সে বলে, "সে কী? কেন? কী হয়েছে পিটার?"
"আমি সারা উইকেন্ড উডএন্ডেই ছিলাম। শনিবার সকালে শরীর ভালো লাগছিল না।"
কথাটা শুনেই অ্যানার মুখ মুহূর্তে লজ্জায় ও ভয়ে রাঙা হয়ে উঠল। খুব মৃদুস্বরে ও পিটারকে জিজ্ঞেস করলো, "তুমি এখন কেমন আছ?"
"একটুও ভালো নেই অ্যানা। আর তুমি জানো তার কারণ।"
অ্যানা অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো, "আমি? আমি কীভাবে জানব পিটার? কী হয়েছে বলবে তো।"
"অ্যানা তুমি জানবে না তো কে জানবে? তুমি আর ডেভ স্লাটিন। তোমাদের মধ্যে কিছু একটা চলছে অ্যানা।"
"এসব কী বলছ পিটার?" অ্যানা বলে ওঠে।
"কিছু তো ভুল বলছি না। তোমাদের শুক্রবার রাত্রে উডএন্ড থেকে বেরোতে দেখেছে লোকজন।"
"আরে ও কিছু না। আমি তোমায় বলছি পিটার। কিছু না। আমরা তো..." অ্যানার স্তোকবাক্য শুনে পিটার আরও রেগে যায়।
"থাক, আমায় কিছু বোঝাতে হবেনা। আমি যা বুঝবার, সব বুঝে গিয়েছি।"
"পিটার..."
"থাক। আমি জানি আমি ডেভের মতো বড়লোক নই। আমার অত টাকা নেই তোমায় নিত্যনতুন ড্রেস, গয়না কিনে দেওয়ার জন্য। আমার সামর্থ্য খুবই কম। আমি ওর মতো বড় শহরের বড় মানুষও নই। কিন্তু অ্যানা, তোমায় ঠিক করতে হবে তুমি কী ও কাকে চাও। দুজনকে তো তা বলে পেতে পারো না।"
"আমি জানি পিটার। আমি তোমাদের দুজনকে একসাথে চাইও না। কিন্তু আমার কিছু কথা বলার আছে তোমাকে পিটার। ডেভের ব্যাপারে। শুনবে?" অ্যানার আকুল আর্তিতে পিটার তো গলল না, উল্টে আরও উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে উঠল, "ডেভ ডেভ ডেভ। সারাক্ষণ ওই একটিই নাম জপে যাও তুমি অ্যানা। আমি আর ওই নাম শুনতে চাই না।" রেগে পিটার অ্যানার বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গেল।

অ্যানা এখন সম্পূর্ণ একা। দুঃখিনী অ্যানা পিটারকে ডেভ ও তার স্পেশাল অর্ডার ক্রেতাদের কথা বলতে উদগ্রীব, কিন্তু পিটার ওকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছে। অ্যানা মনমরা হয়ে ঘরে রয়ে গেল। 

Sunday, September 9, 2018

আগন্তুক ৯

৯।

অ্যানার মন ভালো নেই। সতেরো বছরের তরুণীর মতো কোন উচ্ছ্বাস বা আনন্দ নেই ওর জীবনে। সর্বক্ষণ একটা চিন্তা ওকে গ্রাস করে রেখেছে। ডেভ স্লাটিনের কাছে ওর গ্রেটা গরডন আর মাইক বেলির ব্যাপারে কথা বলতে ও  জানতে খুব ইচ্ছে হয়। কিন্তু সাহসে কুলোয় না। তবু, ও বুঝতে পারে, কোথাও কিছু একটা ব্যাপার হচ্ছে। ও সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকে। এবং অদ্ভুতভাবে সুযোগ পেয়েও যায় খুব শিগগিরই।
গ্রীষ্ম শেষ। উডএন্ডে পর্যটক আসা কমে গিয়েছে। দ্য কর্নার শপের ক্রেতা বলতে এখন কেবলমাত্র গ্রামবাসীরা। তাই দোকানে ভিড় তুলনামূলকভাবে কম। একদিন ডেভ আর অ্যানা দোকানে একা ছিল। ডেভ অ্যানাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, " পিটার কেমন আছে?"
অ্যানা স্মিত হেসে জানালো, "ভালো।"
"ও নিয়মিত খেলছে এখন?"
"হ্যাঁ, প্রতি উইকেন্ডে ওর ম্যাচ থাকে।"
"ও, তাহলে তো তোমার ওর সাথে তেমন ভাবে দেখা হয়না, না?"
অ্যানা উত্তর দেয়, "না না। সপ্তাহে তিন চারদিন আমরা দেখা করি।"
"তোমাদের বিয়ে কবে অ্যানা?" ডেভ পালটা প্রশ্ন করেন।
"সামনের বছর। দিনক্ষণ ঠিক হয়নি যদিও।"
"ও, অনেক দেরি।" ডেভ হাসেন।
অ্যানা কেন কে জানে এই কথোপকথনের সময়ে নিজের মধ্যে একটা অদ্ভুত ভালো লাগা আর সাথে উত্তেজনা বোধ করে।
ডেভ আবার বলে ওঠেন, "তুমি উইকেন্ডগুলিতে কী করো? কোন কাজ তেমন না থাকলে আমায় বলতে পারো। আমরা একসাথে লন্ডন যেতে পারি।"
অ্যানা কোনদিনও লন্ডন যায়নি। এমন প্রস্তাবে তাই স্বাভাবিকভাবেই ও উত্তেজিত বোধ করে। কিন্তু সাথে পিটারের চিন্তাও তক্ষুনি মাথায় আসে। পিটার নিশ্চয়ই ব্যাপারটা ভালোভাবে নেবেনা। অপছন্দও করতে পারে। ডেভকে সে কথা জানালে ডেভ বলেন, "পিটারকে নিয়ে ভেবো না। ও তো খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। জানতেই পারবে না কিছু। চলো এই উইকেন্ডে আমরা লন্ডন যাই। তোমায় খাসা জায়গায় খাওয়াব, দারুণ সিনেমা দেখাবো। তোমার ভালো লাগবে খুব।"
অ্যানা চুপ থাকে। কিছুই বলেনা। হঠাৎ ওর মাথায় একটা ফন্দি আসে। ও বলে ওঠে, "ঠিক আছে। আমি যেতে পারি। কিন্তু বিনিময়ে আপনাকে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।"
"বেশ, বলো কী জানতে চাও।"
"স্পেশাল অর্ডারের বিষয়ে জানতে চাই।"
অ্যানা লক্ষ্য করলো ডেভের মুখে অন্ধকার নেমে এলো। ব্যঙ্গ করে তিনি বললেন, "তুমি তো বেশ চতুর। গ্রামের মেয়েরা আজকাল বেশ চালাক চতুর হয় দেখছি।"
"গ্রামের মেয়েরা বোকা কেন হতে যাবে ডেভ? যাই হোক, আপনি আমায় বলুন, আমার প্রশ্নের জবাব দিন। তবেই আমি আপনার সাথে লন্ডন যাব। নইলে না।"
ডেভ রাগতস্বরে বললেন, "ঠিক আছে। কিন্তু ঠিক একটাই প্রশ্ন করতে পারবে।"
"আপনার কাছে স্পেশাল অর্ডারের জন্য যারা আসেন, কী নেন তাঁরা? তাঁরা..."
"একটাই প্রশ্ন। বলেছি না? একটা।" ডেভ ভীষণভাবে উত্তেজিত হয়ে উত্তর দিলেন।
"ঠিক আছে ডেভ। আপনি চিৎকার করবেন না। বলুন আমায়, তাঁরা আপনার কাছে কেন আসেন?"
ডেভ স্লাটিন খানিক চুপ করে থাকলেন। তারপর অনেক ভেবে মেপে মেপে উত্তর দিলেন, "তাঁরা প্রত্যেকেই কোন না কোনভাবে আমার সাহায্য চান। আমি তাদের সাহায্য করি, সাহায্য বিক্রি করি আমি ওঁদের।"
"কী ধরণের সাহায্য?" অ্যানা না বুঝতে পেরে প্রশ্ন করলে ডেভ আবারও চিৎকার করে বলেন, "বলেছি না? একটাই প্রশ্ন। তুমি করেছো, আমি তার উত্তর দিয়েছি। আর একটাও কথা না।"

অ্যানা আর একটা কথাও বলতে পারলও না। চুক্তি অনুযায়ী ও ডেভকে একটা প্রশ্ন করে, ডেভ তার উত্তর দেন। ডেভ ওকে এই উইকেন্ডে লন্ডন যেতে আমন্ত্রণ করলে অ্যানাও তাই সাথে যায়।



আগন্তুক ৮

৮।

পরের দিন অ্যানা ও পিটার গেল মিস্টার হার্টের বাড়ি, ফুটবল ম্যাচ দেখতে। সব মিলিয়ে জনা দশেক অতিথি নিমন্ত্রিত ছিলেন। অ্যানা খেলা দেখে না, তাই ও টিভির ঘরে না থেকে মিসেস হার্টকে রান্নাঘরে সাহায্য করছিল। ওরা যখন চা বানাচ্ছিল, পিটার মাঝে মাঝে এসে অ্যানাকে খেলা দেখতে ডেকে যাচ্ছিল। প্রতিবারই অ্যানা না করছিল। ওর তো খেলায় তেমন উৎসাহ নেই।
"এসে খেলাটা দেখতে পারতে অ্যানা, সবাই খুব উপভোগ করছে। দারুণ ম্যাচ চলছে।" পিটার বলল হাফ টাইমের সময়ে।
"না না ঠিক আছি আমি এখানে। মিসেস হার্টকে সাহায্য করি একটু। তুমি একটু সকলের চা টা নিয়ে যাবে পিটার?" অ্যানা জিজ্ঞেস করল।
চায়ের ট্রে হাতে নিতে নিতে পিটার বলল, "ঠিক আছে, যা বোঝো। এদিকে কিন্তু মাইক বেলি খুব ভালো খেলছে। ইতিমধ্যেই একটা গোল করেছে। মনে হয় ওর দলই জিতবে আজ।"
দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরু হল। মাইক বেলি আরো একটি গোল করল। দল ২-০তে এগিয়ে রয়েছে। সকলে দারুণ উত্তেজিত। এর মধ্যে অপর দল আবার পরপর দুটো খুব দ্রুত গোল করে ফেলল। সমর্থকরা স্তম্ভিত। এবারে ম্যাচে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। খেলা শেষ হতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। সকলেই প্রচন্ড উত্তেজিত।
"চলো মাইইইইইইইইইইক, গোল করো।" পিটার উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করল। আর হলোও তাই। ঠিক খেলা শেষ হওয়ার আগে মাইক করল ম্যাচে ওর তৃতীয় গোলটি। কিন্তু অবাক কাণ্ড, এই গোলের চোটে প্রতিপক্ষের গোলকিপার আহত হলেন। গলায় বল জোরে লেগে তার ঘাড় ভেঙ্গে গিয়েছে। বেলি গোলপোস্টের খুব কাছে ছিল আর বলটা মেরেওছিল সজোরে। মিস্টার হার্টের ঘরে উপস্থিত সকলে "এই রে, কী কাণ্ড দেখো" বলে চেঁচিয়ে উঠলেন।
"কী হল? কী হল?" বলে মিসেস হার্ট আর অ্যানা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল।
"ম্যাচটা তিন গোলে মাইকের দল জিতেছে। কিন্তু অন্য দলের গোলকিপার গুরুতর আহত।" মিস্টার হার্ট জবাবে জানালেন।

ম্যাচ শেষের পর টিভি স্টুডিও থেকে সম্প্রচার শুরু হল। অ্যানাউন্সার মাইকের ইন্টারভ্যু নেওয়ার চেষ্টা করলেন। বার বার মাইককে তৃতীয় গোলটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। মাইক বেলি বিধ্বস্ত। স্তম্ভিত। স্তব্ধ। ওর মারা বল থেকে যে এরকম একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবে, অভাবনীয়। টিভির স্ক্রিনে বারবার ওই গোলটিই দেখিয়ে যাচ্ছিল।

ইন্টারভ্যু শেষ হতে মিস্টার হার্ট টিভি বন্ধ করলেন। এর মধ্যে কেউ খেয়ালই করেননি কখন যে অ্যানা ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। মাইক বেলিকে টিভির পর্দায় ভীষণ ভীত লাগছিল। পর্দার এপারে অ্যানাও ভীত, সন্ত্রস্ত। মাইক বেলিকে ও চেনে। ওর সাথে অ্যানার পরিচয় ঘটেছে সম্প্রতি। গতকাল, দ্য কর্নার শপে।

Saturday, September 8, 2018

আগন্তুক ৭

৭।

দিন যায়। দ্য কর্নার শপের রমরমা দিনদিন বাড়তে থাকে। এমনও সপ্তাহ যায় যখন ডেভ রবিবারেও দোকান খোলা রাখেন। অ্যানারও তখন বাড়তি উপার্জন হয়। সকলে ভাবে অ্যানা বুঝি খুব সুখী।
কিন্তু আসলে তা না। অ্যানা এক অদ্ভুত দোলাচলের মধ্যে দিয়ে যায়। সে ডেভকেও ভালোবাসে, আবার এদিকে ও পিটারের বাগদত্তা। ডেভ সুপুরুষ, বয়সে বড়। বিত্তশালী। অ্যানাকে বহু উপহারে ভরিয়ে রাখেন। দিনেরবেলাটা অ্যানার ডেভের সাথেই কাটে। পিটারের বয়সও কম, সামর্থ্যও। ও অ্যানাকে মূল্যবান উপহার এনে দেয়না। এমন কি, ডেভের মত কোথাও বেড়াতেও নিয়ে যায় না। পিটারের শুধুই খেলা নিয়ে উৎসাহ। এদিকে অ্যানা খেলা ভালোবাসেনা।

সেপ্টেম্বর মাস, খেলার সীজন। টিভিটে এক শনিবার দুই বড় দলের মধ্যে ফুটবল খেলা দেখানোর কথা। উডএন্ডে মিস্টার হার্টের বাড়িতে সবচেয়ে বড় টিভি স্ক্রিনটি উপস্থিত। তিনি খেলার দিন কিছু পরিচিতদের ওনার বাড়ি নিমন্ত্রণ জানালেন, খেলা দেখতে। অ্যানা আর পিটারেরও ডাক পড়েছিল।
খেলার আগেরদিন, শুক্রবার, বিকেল যখন প্রায় পাঁচটা, দোকান বন্ধ করতে যাবে অ্যানা, এমন সময়ে একটি গাড়ি থেকে এক অল্পবয়সী যুবক নামলেন। হাতে একটি ব্রিফকেস। পরনে সুট। হন্তদন্ত হয়ে এসে তিনি দোকানের বেল বাজালেন। অ্যানা হেসে দরজা খুলে জিজ্ঞেস করল, "হেলো, আমি কি আপনার কোন সাহায্য করতে পারি?" 
যুবকটি উত্তর দিলেন, "আশা করি। মিস্টার ডেভ স্লাটিন আছেন?"
"আপনি দয়া করে আগামীকাল আসুন। দোকান তো এখন বন্ধ।"
"কিন্তু আমার আজই ওঁর সাথে দেখা করার কথা। আপনি দয়া করে ওঁকে ডেকে দিন।"
তখনই পিছন থেকে ডেভের কণ্ঠস্বর শুনে অ্যানা চমকে গেল, "হ্যাঁ, আপনার আজ আসার কথা বইকি। কিন্তু আপনি নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরি করেছেন। আমি অনেকক্ষণ ধরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।"
"আমি দুঃখিত, আসলে..."
"থাক। চলুন চলুন।" ডেভের গলায় স্পষ্টই রাগ। ডেভ স্লাটিনকে এমন রাগতস্বরে কথা বলতে শুনে তো অ্যানা অবাক। যুবকের মুখেও ক্ষণিকের দুশ্চিন্তা।
"আর দেরি না করে আমার সাথে চলুন আপনি।"
"অ্যানা, পাঁচটা বেজে গিয়েছে। তুমি বরং চলে যাও।" অ্যানার উদ্দেশ্যে ডেভ নির্দেশ দিলেন।
"আমার দেরি হবে না ডেভ। অসুবিধে নেই কোন।" অ্যানা বলল।
"আমি বললাম তো তোমায় চলে যেতে, কথা কানে যায়না?" কাঠ কাঠ ভাবে কথাগুলি বললেন মিস্টার স্লাটিন।  ডেভ মনে হয় খুব রেগে গিয়েছেন, অ্যানা বুঝল। আর কথা বাড়াল না। যদিও ভিতরে ভিতরে কৌতূহল অপরিসীম। আর এর কারণ এই যে  যুবকটি ডেভ স্লাটিনের পিছু পিছু স্পেশাল অর্ডার রুমে ঢুকলেন। তার মানে ইনিও আরেক বিশেষ ক্রেতা। অ্যানার উত্তেজনা তুঙ্গে।
সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল। অ্যানা আর অপেক্ষা করল না। সশব্দে দরজা বন্ধ করে ও দোকান থেকে বেরিয়ে দোকানের পিছনে একটু আড়ালে বসল। এখান থেকে দোকানের সামনের দরজা বেশ ভালই দেখা যায়।
খানিক পরেই অ্যানা একটা শব্দ পেল দরজা খোলার। আর তারপর পায়ের শব্দ। ওই তো, ডেভ আর যুবকটি বেরিয়েছেন। ওদের কথা শোনা যাচ্ছে।
"আপনি একদম নিশ্চিত তো মিস্টার স্লাটিন?" যুবকটি দ্বিধা করে প্রশ্ন করলেন।
"কী বলতে চাইছেন?" ডেভের উত্তর এল।
"এইটা ছাড়া কি আর অন্য কোন উপায় নেই?"
"না নেই। আপনি চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আসুন আপনি।"

অ্যানা দেখল ডেভ স্লাটিন দোকানের ভিতরে চলে গেলেন। যুবক নিজের গাড়ির দিকে যাচ্ছেন। অ্যানা এক ছুটে সামনে গিয়ে পৌঁছল। ও দেখল যুবকের হাত ফাঁকা। সুটকেসটি নেই, নিজেকে সামলাতে না পেরে ও তখন বলেই বসল, "এক্সকিউজ মি। আপনি মনে হয় কিছু ফেলে গেলেন দোকানে।"
যুবকটি যখন পিছন ফিরে ওর দিকে তাকালেন, ওঁর মুখ ফ্যাকাশে। ভয়ার্ত স্বরে আমতা আমতা করে বললেন, " আমার কাছে আসবেন না। আমায় ছেড়ে দিন, যেতে দিন আমায়।" এই বলে তিনি দ্রুত পায়ে নিজের গাড়িতে উঠে গাড়ি চালিয়ে চলে গেলেন।

আবারও একটা স্পেশাল অর্ডার, আবার ডেভের কাছে সুটকেস ফেলে যাওয়া। এবারেও ক্রেতার অদ্ভুত আচরণ। কী ব্যাপার? অ্যানা বেশ অবাক, চিন্তিতও। কেন এসেছিলেন যুবকটি?






আগন্তুক ৬

৬।

সেই বছর গ্রীষ্মে বড় সুন্দর আবহাওয়া ছিল আর তাই উডএন্ডে অনেক পর্যটকের ভিড় হয়েছিল। দ্য কর্নার শপও রমরমিয়ে চলছিল।  তবুও অ্যানার মনে সুখ নেই। ওর মনে গ্রেটা গরডনকে নিয়ে ছিল অনেক প্রশ্ন। কেন উনি এসেছিলেন ডেভের সাথে দেখা করতে? সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, হীরের আংটিগুলো কোথায় গেল?
এইসব ছাড়াও আরো একটি কারণে অ্যানার মন ভালো ছিল না। ও পড়েছিল এক অদ্ভুত দোটানায়। যদিও ও পিটারের বাগদত্তা, তবুও ও ডেভকে মনে মনে ভালবাসতে শুরু করেছিল। উডএন্ডের অনেক মহিলাই ডেভের প্রেমে টইটুম্বুর হলেও, অ্যানাও যে তা হবে, ও ভাবেনি। তাছাড়া দিনের বেশিরভাগ সময়েই ও ডেভের সান্নিধ্যে কাটায়।  সকালে ডেভের সাথে আর সন্ধ্যেয় পিটারের সাথে, এইভাবেই চলছিল অ্যানার। একই মানুষ যেন দুটি পৃথক জীবনযাপন করছিল।

এক শুক্রবার ডেভ অ্যানাকে চমকে দিয়ে বললেন, " কাল তোমার কী প্ল্যান সারাদিনের? আমার সাথে দিনটা কাটাবে? আমার গাড়ি করে আমরা লিডনি যেতে পারি। বা তুমি যেখানে যেতে চাইবে, সেইখানেই যাব।"
হতবাক অ্যানা মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, "কিন্তু পিটার পছন্দ করবে না এটা ডেভ। আমি আপনার সাথে গেলে ও ক্ষুণ্ণ হতে পারে।"
"না না। কী যে বলো না তুমি অ্যানা? আমরা তো অনেক দূরে কোথাও যাচ্ছিনা। পিটার কেন কিছু মনে করতে যাবে? লাঞ্চের পর আমরা দোকান বন্ধ করে বেরবো।"
অ্যানার মনে ইচ্ছেও রয়েছে, এদিকে পিটারের অসন্তোষের কথা ভেবে একটু দোনামনা করছিল। ডেভ ওর অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, "আরে, পিটার তো শনিবার করে খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তুমি ভেবোনা।"
"বেশ তাহলে আমায় সবচেয়ে ভালো রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে হবে। আর আমার পছন্দের সিনেমা দেখাতে হবে। তবেই আমি যাবো।" অ্যানা হেসে বলল।
ডেভ অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন, বললেন, "তাই হবে। তুমি চলো।"
পরেরদিন দুপুরে দোকান বন্ধ করে ওরা ডেভের গাড়ি করে লিডনি গেল। ডেভ অ্যানাকে একটি দামী পোশাক কিনে দিলেন। তারপর ওরা একটি সিনেমা দেখল অ্যানার পছন্দসই। এরপর ওরা রেস্টুরেন্টেও গেল। পিটার কিছুই জানতে পারল না। ও ওইদিন অন্য এক গ্রামে ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিল। ফিরতে অনেক রাত্তির হয়ে যায়। ডেভ আর অ্যানাও অনেক রাত্রে ফেরে। সারা দিন ভীষণ ভালো কাটিয়ে রাতে ডেভ অ্যানাকে দ্য কর্নার শপের সামনে যখন নামায়, বাইরে মনোরম পরিবেশ। অ্যানা গাড়ি থেকে নামার আগে ডেভকে বলে, "থ্যাঙ্ক ইউ ডেভ। আজ আপনার জন্য দিনটা খুব ভালো কাটল।"
"আমারও।" ডেভ প্রত্যুত্তরে বললেন। তারপর হঠাৎ অ্যানাকে জাপ্টে ধরে ঠোঁটে চুম্বন করলেন।
চুম্বনের আকস্মিকতা অ্যানাকে চকিত করলেও মুহূর্তের ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হলো ও।

Thursday, September 6, 2018

আগন্তুক ৫

৫।

ডেভ কোনদিনও তারপর গ্রেটা গরডনকে নিয়ে একটা কথাও বলেননি। একদিন অ্যানা কৌতূহলী হয়ে আর থাকতে না পেরে ডেভকে জিজ্ঞেস করে, "ডেভ, আপনি গ্রেটাকে কী করে চিনলেন? উনি কি আপনার বন্ধু?"
"অ্যানা, উনি আমাদের স্পেশাল কাস্টোমার ছিলেন। ব্যস। আর এই বিষয়ে আমি কোন কথা বলতে চাইনা। দয়া করে ভবিষ্যতে আমায় জিজ্ঞেস করো না। "
বলার ভঙ্গি শুনে ও স্তব্ধ। অ্যানা আর তাই দ্বিতীয়বার ডেভকে এই নিয়ে কোন প্রশ্ন করেনি। মিস গরডনের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতিও ও রক্ষা করেছিল।  শত ইচ্ছে হলেও কাউকে ও মিস গ্রেটা গরডনের আকস্মিক আগমন ও অদ্ভুত ব্যবহারের কথা বলেনি।
শীত পেরিয়ে বসন্ত এলো। উডএন্ডের বাগান ফুলে ভরে গেল। মিস্টার হার্ট নানা রঙের ফুলের সম্ভার আনলেন দোকানে। অ্যানা হাসি মুখে সেগুলি পর্যটকদের কাছে বিক্রি করতে থাকলো। প্রচুর পর্যটকও এসেছিলেন ওই বছর।
মে মাসের এক বিকেলে পিটার অ্যানাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। অ্যানা আর পিটার একে অপরকে খুব ভালোবাসে। আর তাই ও খুব খুশি হয়েই পিটারের প্রস্তাবে হ্যাঁ বলল। পিটারের দেওয়া আংটি পরে ওদের বাগদান পর্বও মিটে গেল। ওরা ঠিক করল, আগামী বছর বিয়ে করবে। এই এক বছর তাই প্রচুর খেটে ওরা অনেক টাকা জমাবে যাতে আগামী দিনগুলো আরামের হয়।
শনিবার করে পিটার ফুটবল বা ক্রিকেট নিয়ে মশগুল থাকত আর অ্যানা লিডনি যেত সিনেমা দেখতে। অ্যানা যে সিনেমা দেখতে খুব ভালোবাসে।
এমনই একদিন অ্যানার হাতে এলো একটি ফিল্ম ম্যাগাজিন। পাতা ওলটাতে গিয়ে ও দেখল গ্রেটা গরডনের ছবি। আকৃষ্ট হয়ে অ্যানা খবর পড়তে লাগল। "বিউটিফুল ওম্যান" সিনেমায় গ্রেটা নায়িকা হবে। আগে এই ছবিটিতে মিস জোনা লির অভিনয় করার কথা কথা হলেও দুর্ভাগ্যবশত মিস লি ঘরে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙ্গে ফেলেন নিজের। আর তাই গ্রেটাও নিজের বহু আকাঙ্ক্ষিত এই রোলটি পেয়ে যান। এই হঠাৎ পাওয়া সুযোগে মিস গরডন যারপরনাই খুশি। এই খবরটি পড়ে অ্যানা বেশ আনন্দিত হলেও মিস গরডনের উডএন্ড আসার কথা পিটারকেও বলতে পারল না।
একমাত্র ডেভকে এই খবরটা জানানো যায় ভেবে অ্যানা একদিন মিস্টার স্লাটিনকে ম্যাগাজিনটি দেখিয়ে বলল, "ডেভ, এই দেখুন, গ্রেটা গরডনের বড় ছবি বেরিয়েছে ম্যাগাজিনে।"
"গ্রেটা গরডন বুঝি বড় অভিনেত্রী?" ডেভ সরলভাবে জিজ্ঞেস করলেন।
"বড় মানে বড়? ও এখন স্টার, একটা দারুণ অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছে।" অ্যানা বলল।
"ভালো। খুশি থাকুন উনি।" ডেভ নির্লিপ্ত উত্তর দিলেন। আর কথা বাড়ল না।

আগন্তুক ৪

৪।

বেশ শান্ত ও নিস্তরঙ্গ ভাবেই তিন মাস কেটে গেল। দ্য কর্নার শপের বিক্রিও ভাল মতোই হতে লাগল। এপ্রিল মাসের এক বেলায়, দোকানে এলেন এক অপরূপা সুন্দরী রমণী। পরনে দামী কেতাদুরস্ত পোশাক। উনি একটি বিরাট বড় বিলাসবহুল গাড়ি থেকে নেমে সোজা চলে এলেন দোকানের ভিতর। এমন ক্রেতা আজ পর্যন্ত কখনও অ্যানা এই দোকানে দেখেইনি। ও ভীষণ অবাক। ভদ্রমহিলা একটু অপ্রস্তুতভাবে এদিক ওদিক দেখলেন, তারপর অ্যানার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, "এইটাই কি দ্য কর্নার শপ?" অ্যানা অতি উৎসাহ সহকারে বলল, "হ্যাঁ, এটিই দ্য কর্নার শপ। আমাদের গ্রামে এই একটিই দোকান। বলুন কীভাবে সাহায্য করতে পারি?" ভদ্রমহিলা একটু ইতস্তত করে বললেন, "আমি মিস্টার ডেভ স্লাটিনকে খুঁজছি। উনি বোধহয় এই দোকানের মালিক।"
"ও, হ্যাঁ। উনি ওপরে আছেন। আমি ডেকে দিচ্ছি। উনি কি আপনার নাম জানেন? কী নাম বলবো?" অ্যানা উত্তর দিল।
 "হ্যাঁ, মিস্টার স্লাটিন আমার নাম জানেন । বলুন... বলুন মিস গ্রেটা গরডন এসেছেন। দেখা করতে চান।"
"আপনিই গ্রেটা গরডন? অভিনেত্রী গ্রেটা গরডন?" আন্যার চোখে মুখে ও কণ্ঠস্বরে উচ্ছ্বাস প্রবলভাবে ফুটে উঠল। মিস গরডন সামান্য হেসে উত্তর দিলেন, " হ্যাঁ।"
"আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি এক্ষুনি ডেভকে ডাকছি।" এই বলে অ্যানা ছুটল সিঁড়ির তলায়। গলা চড়িয়ে হাঁক দিল, "ডেভ, আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছেন।"
ওপর থেকে মিস্টার স্লাটিনের উত্তর শোনা গেল, "কে এসেছেন?"
"মিস গ্রেটা গরডন, অভিনেত্রী গ্রেটা গরডন।"
"আমি আসছি।"
মুহূর্তের মধ্যেই ডেভ নিচে এলেন। গ্রেটার দিকে তাকিয়ে, "সুপ্রভাত। আমিই ডেভ" বলে করমর্দন করলেন। অ্যানা লক্ষ্য করলো, মিস গ্রেটা গরডনের হাতগুলি, বিশেষ করে আঙ্গুলগুলি কী সুন্দর, লম্বা। ফর্সা। আর তাতে কতগুলো হীরের আংটি। অ্যানা কোনোদিনও এত হীরের আংটি একই হাতে দেখেইনি। মিস গ্রেটা গরডন এদিক ওদিক দেখছিলেন ইতিউতি। খানিক পর ডেভ স্লাটিনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, "আপনি বুঝি এখানেই কাজ করেন মিস্টার স্লাটিন?"
"হ্যাঁ। জায়গাটি তেমন বড় না হলেও আমার কাজ চলে যায়। আপনি আমার সাথে আসুন মিস গরডন।"
অ্যানা খেয়াল করলো, ডেভ গ্রেটাকে নাম ধরে না ডেকে মিস গরডন বলে সম্বোধন করছিলেন। অর্থাৎ একে অপরের পরিচিত না। দেখে মনে হচ্ছিল মিস্টার স্লাটিন যেন একটু তাড়ায় ছিলেন, আর গ্রেটা অল্প বিচলিত।

অ্যানা দেখল ডেভ ও তাঁর পিছু মিস গরডন দোকানের পিছনে গেলেন এবং তারপর আশ্চর্যের ব্যাপার, সোজা "স্পেশাল অর্ডার" ঘরটিতে ঢুকলেন। ও, এই ব্যাপার? তার মানে গ্রেটা গরডন বিশেষ ক্রেতা।
অ্যানা সিনেমার পোকা। ওর খুব ইচ্ছে করছিল কারুর কাছে গল্প করে গ্রেটার আগমন নিয়ে। ওর ঠিক তক্ষুনি পিটারের কাছে এই বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলার জন্য মন চঞ্চল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অ্যানার পক্ষে এই মুহূর্তে দোকান ছেড়ে যাওয়ার কোন উপায়ই নেই।
মিনিট দশেক পর অ্যানা দেখল ঘর থেকে ওঁরা দুজনে বেরোলেন। ডেভ কোন কথা না বলে ওপরে চলে গেলেন। গ্রেটা গরডন দোকানের মধ্যে দিয়ে যখন যাচ্ছিলেন, অ্যানা খেয়াল করলো, ভদ্রমহিলার অবস্থা আশ্চর্যজনকভাবে বেশ বিদ্ধ্বস্ত। মুখ ফ্যাকাসে, চোখে জল।
"কী হয়েছে মিস গরডন? কিছু সাহায্য লাগবে?" অ্যানা উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলে মিস গরডন নিচুস্বরে উত্তর দেন, "না। আমি ঠিক আছি।"
"আমি আপনাকে একটা চেয়ার এনে দিচ্ছি। আপনি বরং খানিক বসুন।"
অ্যানার এনে দেওয়া চেয়ারে বসে গ্রেটা সাময়িক নিজেকে সামলে নিলেন। আর তারপর বললেন, "শোন, আমি যে এখানে এসেছিলাম, দয়া করে এই কথাটি পাঁচ কান করো না। আমায় কথা দাও।"
কথাগুলো অ্যানার ভালো লাগল না। ও যে বন্ধুদের বলবে বলে উশখুশ করছিল, তাহলে?
"দেখো, আমি তোমায় একটা জিনিস দিতে চাই। এই নাও। আমার অটোগ্রাফ করা ছবি। এটা তুমি রাখো। কিন্তু দয়া করে কাউকে জানিয়ো  না আমার আজকের এই আসার কথা। প্লিজ।"
"ঠিক আছে। আমি কাউকে বলবো না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।"
অ্যানার কথায় আশ্বস্ত হয়ে গ্রেটা অ্যানার গালে হাল্কা ঠোঁট ছুঁইয়ে ওর দুই হাত নিজের হাতে নিলেন। অ্যানা আবারও মুগ্ধ হয়ে ওই সুন্দর আঙ্গুলগুলি দেখতে লাগল। কিন্তু কী আশ্চর্য, হীরের আংটিগুলি কই?

Wednesday, September 5, 2018

আগন্তুক ৩

৩।

দ্য কর্নার শপ দিব্যি চলতে থাকলে। ডেভের দেওয়া কথামতো সস্তায় অনেক জিনিস বিক্রিও হতে লাগল। উডএন্ডের বাসিন্দারা অবাক, "মিস্টার স্লাটিন এত সস্তায় কীভাবে জিনিস বিক্রি করেন" । মিসেস হ্যারিসন হতবাক, "এই শীতেও এতরকমের ফল ও সব্জির পসরা। অভাবনীয়। তাও এত স্বপ্ল মূল্যে। আমায় তো আজকাল আর লিডনি যেতেই হয়না। " গ্রামের লোকজন সকলেই সহমত হন। তাঁরা প্রত্যেকেই খুশি। দ্য কর্নার শপের সাফল্যের দরুন ডেভও নিতান্তই আনন্দিত। অ্যানাও ভালো মাইনে পেয়ে সন্তুষ্ট। কাজের চাপ বেশি থাকলে কখনও অ্যানার বন্ধু পিটার মাঝে মাঝে এসে সাহায্য করে দিত। বিনিময়ে ডেভ তাকেও টাকা দিতেন। মধ্যে মধ্যেই ডেভ খবরের কাগজে দ্য কর্নার শপ ও সেখানে বিক্রির পণ্যের বিজ্ঞাপন দিতেন। আর তাই দোকানটিতে বিক্রি ভালোই হত। এমন কী, লিডনি থেকেও অনেক ক্রেতা আসতেন উডএন্ডে, শুধুমাত্র এই দোকান থেকে স্বপ্লমূল্যে ভালো পণ্য কিনতে। ক্রমে উডএন্ড বেশ জমজমাট জায়গায় পরিণত হতে লাগল। গ্রামবাসীরা অবাক হলেও নিতান্তই খুশি, ওঁদেরও যে ভালোই রোজগার হচ্ছিল এই দোকান থেকে।

ডেভ স্লাটিন এই দোকানের ওপরতলায় একটি ফ্ল্যাটে একা থাকতেন। যদিও ডেভ উডএন্ডে বেশ জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন ইতিমধ্যে, তবুও কেউ কোনদিনও ওঁর বাড়িতে যাননি। সকলেই দ্য কর্নার শপ অবধিই বিচরণ করতেন। আর তাই বাড়ির ভিতরে কী আছে, কেমন সাজানো, এইসবের খবর কারুর কাছেই ছিল না। এমনকি, অ্যানার কাছেও না।

সিঁড়ির নিচে দুটো দরজা। তাদের একটির পিছনে থাকতো দোকানে বিক্রির জিনিস। স্টোর রুম গোছের। কিন্তু অন্য দরজার গায়ে লাগানো থাকত একটি নোটিস। "স্পেশাল অর্ডারঃ বাকিরা, দূরে থাকুন"। অ্যানা কোনদিনও এই দরজাটিকে তালা খোলা অবস্থায় দেখেনি। কয়েকবার কৌতূহলী হয়ে ডেভকে প্রশ্ন করেছে ঘরটির বিষয়ে, এই গ্রামে কে এমন কী বিশেষ অর্ডার নিয়ে আসবেন? কী আছে ওখানে? কেন সব সময় তালা দেওয়া থাকে? ডেভ কোনদিনও উত্তর দেননি। হয়তো এই বিষয়ে কথা বলতে অনুৎসাহী ছিলেন।


Tuesday, September 4, 2018

আগন্তুক ২



গ্রামবাসীরা তো সকলেই যারপরনাই অবাক। তাদের উডএন্ডের মতো ছোট গ্রামে একটা নতুন দোকান? লোকের মুখে মুখে এই কথাটা ঘুরতে লাগল। অবশ্য বহু বছর আগে গ্রামে একটি দোকান ছিল বটে, কিন্তু কুড়ি বছর আগে নানা কারণে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। তবে বর্তমানে কিছু মানুষ যেমন এই দোকানটি চাইছিলেন, ঠিক তেমনই কিছুজন এর বিরোধিতাও করছিলেন। সকলে ঠিক করলেন গণতান্ত্রিকভাবে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন। তাই সন্ধ্যেবেলা গ্রামের সমস্ত মানুষ উপস্থিত হলেন গ্রামের হলে। সেখানে "দোকান হওয়া খুব দরকার। গ্রামে একটা দোকান থাকলে আমাদের আর বারবার লিডনি যেতে হবেনা।" কেউ বলে উঠলেন ভিড়ের মধ্যে থেকে। মিসেস হ্যারিসন, যিনি কিনা ডেভকে পছন্দ করতেন, এই মতে সায় দিলেন। "হ্যাঁ, আমাদের উডএন্ড বড্ড চুপচাপ, শান্ত আর নিস্তরঙ্গ। এখানে একটা দোকান হলে মন্দ হয়না। কর্নার শপ চলুক এখানে।" গ্রামের স্কুলের দিদিমণি, মিস ব্রাউন পালটা উত্তর দিলেন, "কোন প্রয়োজনই নেই উডএন্ডে নতুন দোকানের। লিডনিতে অনেক অনেক দোকান। সবকিছু পাওয়া যায়। আর তাছাড়া, লিডনি এমনকিছু দূরে তো না। দিব্যি ঘুরে আসা যায়। তাহলে আমরা এখানে দ্য কর্নার শপকে কেন নেবো? না না। এর কোন দরকারই নেই আমাদের।" আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ, যুক্তি তর্কের ভিড়ে হলে তখন শুধুই হই হট্টগোল। কারুর কথাই আর অন্যের শব্দে শোনা যাচ্ছেনা। এমন পরিস্থিতে গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তি, মিস্টার হার্ট তাঁর বাজখাই গলায় বলে উঠলেন, "বন্ধুরা শান্ত হোন। আমাদের গ্রামে এর আগে কিন্তু আমরা কখনও কোন বিষয়ে এরকম তর্ক বিতর্ক করি নিই। তাহলে আজ কেন? দিব্যি নিজেদের মধ্যে সুখে শান্তিতে ছিলাম। এখন দেখছি যত অশান্তির মূলে দেখছি এই দোকানটি।"
"মিস্টার স্লাটিনকে কথা বলতে দিন না? দোকানটা যখন ওঁর। ওঁকেই বলতে দিন।" ভিড়ের মধ্যে একজন অবশেষে সুবুদ্ধি দিলেন।
"বন্ধুরা, নমস্কার। আমি ডেভ। আপনাদের গ্রামে নতুন এসেছি। বুঝতে পারছি আমার দোকানের জন্য অনেক অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। আমায় মার্জনা করবেন। আসলে, আমি আপনাদের খুব ভালোবেসে ফেলেছি এবং আপনাদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে চাই। আপানদের মধ্যে একজন হয়ে এখানে থাকা আমার উদ্দেশ্য।" ইতিমধ্যে ঘরের মধ্যে উপস্থিত বহু মানুষ মুগ্ধ, করতালিতে ঘর ভরে গেল। মিস্টার স্লাটিন বলে চললেন, "দ্য কর্নার শপে সমস্ত জিনিস সস্তায় পাবেন। আমি কথা দিচ্ছি। ঘর গৃহস্থালীর জন্য যাবতীয় যা যা লাগে, প্রতিটি জিনিস আপনি এখানে পেয়ে যাবেন।" শ্রোতারা এক মনে শুনে চলেছেন ওঁর কথা। "আমার মাথায় আরো একটি ফন্দি এসেছে। আমি এখানে গ্রামের মানুষের তৈরি সমস্ত জিনিস বিক্রি করব।" মিস ব্রাউন বললেন, "গ্রামের তৈরি জিনিস বলতে?"
মিস্টার স্লাটিন বললেন, " আমি বোঝাচ্ছি। ধরুন, এই যে আপনি এত সুন্দর কেক আর ব্রেড বানান।" মিস ব্রাউন নিজের বেকিংএর প্রশংসা শুনে খুশিই হলেন। অনেকেই হ্যাঁতে হ্যাঁ বললেন। তাঁরাও যে ওঁর কেক খেয়েছেন এর মধ্যে বহুবার। "আর আপনি, মিস্টার হার্ট, আপনি কত সুন্দর ফুল ফোটান বাগানে। আমি দেখেছি।" এইবারে মিস্টার হার্টের খুশি হওয়ার পালা। এত পরিশ্রম করে সারা বছর ফুল ফোটান বাগানে, নানা রঙের, নানা গন্ধের, তার স্বীকৃতি তো ভালো লাগবেই।
"মিস্টার এভারেট খুব ভালো মাটির জিনিস বানান।"
"মিসেস ডেভিসের পুতুলগুলো দেখার মতো।"
"আর আমি কখনও ছবিও আঁকি," বললেন মিস লুসি গ্রে।
"হ্যাঁ, আপনারা সকলেই অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং দক্ষ। আপনাদের বানানো নানান জিনিস আমি দ্য কর্নার শপে বিক্রি করতে চাই। গ্রীষ্মে যখন পর্যটকে ভরে যায় আমাদের গ্রাম, তখন বিক্রিবাট্টা ভালো হবে।" ডেভ বললেন। "আমরা অনেক টাকা রোজগার করতে পারব এইভাবে।"
শ্রোতাদের মধ্যে থেকে একজন জিজ্ঞেস করলেন, "সবই তো বুঝলাম। কিন্তু আমরা টাকা পাবো কী করে?"
ডেভ উত্তর দিলেন, "খুব সোজা। লাভের কিছু অংশ আমি রাখব। বাকিটা আপানদের হাতে তুলে দেব।"
সকলে সাধু সাধু বলে মিস্টার স্লাটিনের এই পরিকল্পনায় সহমত জানালেন। প্রত্যেকেই খুব খুশি।
সোমবার, ৪ঠা জানুয়ারি ১৯৬৫ সালে, আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হল "দ্য কর্নার শপ"। দ্রুতই দোকানের বিক্রি বাড়তে লাগল। একা ডেভ পেরে উঠছিলেন না। তাই জানুয়ারির শেষের দিকে অ্যানাকে নিয়োগ করলেন সহকারী হিসেবে।

আগন্তুক ১



১।

গল্পের পটভূমি ইংল্যান্ডের এক শান্ত নিরিবিলি গ্রাম, উডএন্ড। ৩১শে অক্টোবর ১৯৬৪, শনিবার। গ্রামের হলে গ্রামবাসীরা হ্যালোউইন পার্টি পালন করে যে যার গৃহে ফিরে গিয়েছেন। এমন সময়ে ওই গ্রামে এসে উপস্থিত হন বছর তিরিশ বত্রিশের এক ব্যক্তি। অত রাতে গ্রামে এসে তিনি আকুল হয়ে রাত কাটানর জন্য তখন একটি বাসস্থান খুঁজছেন। সামনে দেখলেন একটি একতলা বাড়ি, তখনও আলো জ্বলছে ঘরে। টোকা মারলেন। এক মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা দরজা খুলে দেখেন এক সুপুরুষ ব্যক্তি। মাথার চুল ঘন কালো, চোখ দুটি সবুজ। উনি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, "হেলো, কী চাই?" ভদ্রলোক একটু কিন্তু কিন্তু করে উত্তর দিলেন, "নমস্কার। মার্জনা করবেন এত রাতে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য। আসলে আমি এই গ্রামে প্রথম এলাম। রাত্রিযাপনের জন্য একটি থাকার জায়গা খুঁজছি। আপনি কি আমায় কোন হোটেলের সন্ধান দিতে পারেন?"

ভদ্রমহিলা বেশ হেসে বললেন, "হোটেল? এই গ্রামে? না মশাই, আপনি সেইসব কিচ্ছু পাবেন না উডএন্ডে।"

ভদ্রলোক রীতিমতো বিমর্ষ হয়ে বললেন, "আমারই দুর্ভাগ্য। আমি আপনাদের এই মনোরম গ্রামটি কাল ঘুরে দেখবো ভাবছিলাম।"

ওঁর ভদ্র ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে ভদ্রমহিলা বললেন, "মিসেস হ্যারিসনের বাড়িতে ঘর খালি আছে। উনি হয়তো আপনাকে রাত কাটাতে দিতে পারেন। একটু অপেক্ষা করুন, আমি কোটটা গায়ে দিয়ে আসি। আপনাকে আমিই না হয় মিসেস হ্যারিসনের কাছে নিয়ে যাবো।"

সৌভাগ্যবশত মিসেস হ্যারিসন নিজের বাড়িতে থাকতে দিলেন এই ভদ্রলোককে। উনিও নিশ্চিন্ত হলেন। অক্টোবরের শেষ দিন, বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা। রাস্তায় রাস্তায় এই ঠাণ্ডায় ঘুরে না বেরিয়ে বরং এখন দিব্যি আরাম করে নরম বিছানায় রাত কাটাতে পারবেন।

পরেরদিন রবিবার এই ব্যক্তি পায়ে হেঁটে গ্রামে ঘুরে বেড়ালেন। উডএন্ড গ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে উনি বিশেষভাবে কৌতূহলী ছিলেন। একে তাকে জিজ্ঞেস করে গ্রামের সম্পর্কে অনেক কথাই জানলেন। কিছু গ্রামবাসীদের সাথে পরিচয়ও হল। তাঁরা এই সুপুরুষ ব্যক্তিটিকে খুবই পছন্দ করে ফেলেছিলেন ইতিমধ্যে, বিশেষত মহিলারা।

উডএন্ড গ্রামের গির্জাটি অপূর্ব সুন্দর। গ্রীষ্মের ছুটিতে অনেক মানুষ আসেন শুধুমাত্র এই গির্জাটিকে দেখবেন বলে। কিন্তু অবাকের বিষয়, এই ভদ্রলোকটি গির্জায় প্রবেশই করলেননা। গ্রামের বাসিন্দারা রবিবারের প্রার্থনা সেরে বাইরে এসে দেখেন, উনি চলে গিয়েছেন। ওঁরা নিজেদের মধ্যে খানিক জল্পনা কল্পনা করে যে যার শান্ত নিজস্ব জীবনযাত্রায় ফিরে গেলেন।

কিছু সপ্তাহ পর ডিসেম্বরের প্রথম রবিবারে উডএন্ড গ্রামের বাসিন্দারা সকালের প্রার্থনা সেরে গির্জা থেকে বেরিয়ে দেখেন সেই সুপুরুষ ভদ্রলোক বাইরে দাঁড়িয়ে। ওঁদের সকলকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে হাত নেড়ে চেঁচিয়ে বললেন, "ভালো আছেন তো সবাই? আমি আবার ফিরে এলাম এই গ্রামে। বড় ভালো লেগেছিল আমার আপানদের সকলকে। আমি এখানেই থাকব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমায় এই গ্রামে একটা বাড়ি কিনতে কেউ সাহায্য করতে পারেন দয়া করে?" ওঁর কথা শুনে উপস্থিত সকলেই অবাক হয়ে গেলেন। যেখানে গ্রামের বেশিরভাগ যুবক কাজের অভাবে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়, সেখানে এমন বহিরাগত এক ব্যক্তি, তাও এই কম বয়সে, এই গ্রামে এসে থাকবেন বলছেন, বেশ অভাবনীয়। সকলেই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন। "কিন্তু এখানে কেন? এখানে তো কোন চাকরি নেই। গ্রামের ছেলেরা সবাই লিডনি চলে যায়। আর আপনি এখানে নতুন করে এই অল্প বয়সেই থাকবেন?" গ্রামের এক বয়স্ক ব্যক্তি আর থাকতে না পেরে প্রশ্নটা করেই ফেললেন। "চিন্তা করবেন না। আমি ঠিক কিছু না কিছু জোগাড় করেই নেবো। তেমন হলে লিডনিতে গিয়েও কাজ করতে পারি। কিন্ত আমি এই গ্রামেই থাকতে চাই। আপনারা কি কেউ কোন বাড়ির সন্ধান দিতে পারেন?" ভিড়ের মধ্যে থেকে এক ভদ্রলোক বললেন, "আপনি মিস্টার স্মিথের বাড়িটি দেখতে পারেন। চার্চ লেন আর মেন স্ট্রিটের চৌমাথায় বাড়িটি। ভদ্রলোক কিছু মাস আগে মারা গিয়েছেন। ফাঁকাই পড়ে আছে। ওই বাড়িটি যদি বিক্রি হয়।"

"অনেক ধন্যবাদ। আমি তাহলে আগামীকালই বাড়িটির খোঁজ নেবো।" এই বলে উনি চলে গেলেন। সকলে দেখলেন, আজ উনি এসেছিলেন নিজের গাড়িতে। গাড়িটি বেশ বড়, দেখেই বোঝা যায়, পয়সাওয়ালা মালিকের গাড়ি। সুসজ্জিত, বিলাসবহুল। ভদ্রলোক নিজে নির্ঘাত বিত্তশালী।

কিছুদিনের মধ্যে মিস্টার স্মিথের বাড়িটি বিক্রি হয়ে গেল। ভদ্রলোক পুরনো বাড়িটিকে মেরামত করে ও বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে দিব্যি বসবাসযোগ্য করে ফেললেন অল্পদিনের মধ্যেই। তবে গ্রামবাসীদের জন্য অপেক্ষা করেছিল একটি বড় চমক।

২১শে ডিসেম্বর, সোমবার, বাড়ির সামনে সকালে তাঁরা দেখলেন একটি বিরাট সাইনবোর্ড। তাতে বড় অক্ষরে লেখা, "দ্য কর্নার শপ। প্রপ্রাইটর ডেভ স্লাটিন।"

Sunday, September 2, 2018

পুজো স্পেশাল


"এই প্রাণ ঢালা উৎসবে বারবার
alo asha bhalobasha mishe ekakar
ei shoroto topone pranero swopone chirosathi shalimar..."

টিভিতে এই বিজ্ঞাপন দেখা শুরু হয়ে গিয়েছে নিশ্চয়ই? ব্যস, পুজো তো তাহলে এসেই গেল। কাপড় মেলতে গিয়ে বারান্দায় বা ছাদে দাঁড়িয়ে যতই কালো মেঘ দেখুন না কেন, শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসুক কি না ভাসুক, রাস্তায় ঘাটে এখন থেকেই বাঁশ পোঁতা শুরু হয়ে যাক কি না, আনন্দবাজারের ভিতরের পাতা জুড়ে জুতোর বিজ্ঞাপন চোখে পড়ুক কি না, বছরের পর বছর ধরে এই একটি বিজ্ঞাপন আপামর বাঙালির কাছে "পুজো আসছে" অনুভূতি নিয়ে আসে।

তারপর আশ্বিনের এক শারদপ্রাতে সেই চিরপরিচিত ব্যারিটোন যেন আনুষ্ঠানিকভাবে পুজোর সূচনা করে দেয়। (আশ্বিনের শারদপ্রাতে plays in background. Followed by বাজল তোমার আলো বেণু) নিউ মার্কেট, গড়িয়াহাট, হাতিবাগানের সাথে তাল মিলিয়ে শপিং মলগুলিও উপচে পড়ে ভিড়ে। যদিও এখন অনলাইন কেনাকাটার যুগ, তবুও এই চারদিনের প্রস্তুতি যেন অসম্পূর্ণ থাকে পায়ে হেঁটে কেনাকাটি না করলে। সপ্তমীতে কুর্তি জিনস তো অষ্টমী সকালে ঢাকাই শাড়ি। বিকেলে অবশ্যই সিল্ক। নবমীতে চুড়িদার কামিজ, রাত্রে আনারকলি। ম্যাচিং দুল লিপস্টিক কাজলের কেনাকাটির পর দু হাত ভর্তি প্যাকেট নিয়ে অটোতে বসে বা ভিড় মিনিবাসে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে যখন রেডিওতে পুজোর বিজ্ঞাপনগুলি বাজে, কোথায় যেন মনটা উড়ে যায় নিমেষে। এক ছুট্টে সেই ছোটবেলায়। দূরদর্শনের পর্দায় ছুটি ছুটিতে, বছরের পর বছর যেখানে গুপী বাঘার সাথে পরিচয় যেমন হত, তেমনি বেরিয়ে পড়তাম ফেলুদা আর তোপসের সাথে। বা কালার টিভির যুগে টিভিতে "সপ্তমীতে প্রথম দেখা, অষ্টমীতে হাসি, নবমীতে বলতে চাওয়া তোমায় ভালোবাসি। দশমীতে হঠাৎ কেন আকুল হল প্রাণ, প্রাণ প্রতিমা তুমি এবার যাবে কি ভাসান" উফ, কত উত্তেজনা। কী রোমাঞ্চকরই না লাগত তখন সেজেগুজে প্যান্ডেলে যেতে। সারাক্ষণ উৎসুক চোখে এদিক ওদিক দেখে নেওয়া, কেউ দেখছে? কেউ হাসলো?

একটা সময় ছিল যখন পুজোর বেশ কিছু সপ্তাহ আগে থেকে নিয়ম করে প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা কোন না কোন কাকিমা বা দিদির বাড়ি যেতাম। চলতো হয় নাটকের মহড়া বা  তবলা ঘুঙ্গুর আর হারমোনিয়াম সহযোগে নাচ গানের প্র্যাক্টিস। প্রিয় গানগুলির মধ্যে থাকতো মম চিত্তে নিতি নৃত্যে বা শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি।"

কলেজ, চাকরি বা সংসারের চাপে এখন আর আগের মতো "শরত তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি..."তে নাচা হয়না পাড়ার পুজো মণ্ডপের অনুষ্ঠানে। সন্ধিপুজো কী, অনেক সময় তো অষ্টমীর অঞ্জলিটা পর্যন্ত কোনমতে দিয়ে ফিরতে হয় অফিসের কাজে। অঞ্জলি দেওয়ার পর লাইন দিয়ে প্রসাদী ফল আর নারকেল নাড়ু যে কবে শেষ খেয়েছি, মনেই পড়েনা। নবমীতে গোটা পাড়ার সাথে বসে খিচুরি বেগুনি খাওয়া হয়নি কত বছর। মায়ের বকা খেয়ে আনন্দমেলা ফেলে অষ্টমীর ভোগ আনা হয়না আজকাল আর। শারদীয়াগুলোও এখন কেমন অচেনা লাগে। নেই কাকাবাবু, নেই মিতিন মাসি। কলাবতীও কবে বড় হয়ে গিয়েছে। সাথে আমরাও...

তবুও বছরের এই চারটে দিন, যেখানেই থাকি না কেন,

"মন পবনের নাও এই বাংলার তীরে
আগমনী আলো জাগে মানুষের ভিড়ে।
বুকের ভিতরে পুজো এলো ফিরে..."