প্রিয় নীলু
কী রে, সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে, আর তুই এখনও ঘরের আলো জ্বালাসনি। চুপ করে একটা কোণে বসে আছিস। ও মা, এ কী? কাঁদছিস...কেন? ও। বুঝেছি। দীপু তোর চেয়ে অনেক কম নম্বর পেয়েও শিকাগো স্টেটে অ্যাডমিশন পেয়ে গেল আর তুই অ্যারিজোনা স্টেটেও পেলি না, তাই? এইটাতে তুই পাবিই পাবি ভেবে রেখেছিলি, তাই না রে? ভাবছিস মল্লিকা আপসেট হবে। না? তাহলে? ও আচ্ছা। ক্যাটেও রেজাল্ট ভালো হয়নি। চাকরিটা ছাড়তে পারবি না, তাই তো?
তোকে কয়েকটা কথা বলি নীলু। আমি তো কম করেও বেশ কিছু বছরের বড় তোর থেকে, দুনিয়াটা একটু হলেও বেশি দেখেছি। তাই বলছি, শোন, কিছু বছর পরে দেখবি, এগুলো কিচ্ছু ম্যাটার করবে না। এই যে তুই ভাবছিস, সব বন্ধুরা বম্বে দিল্লি ব্যাঙ্গালোর অ্যামেরিকা ইংল্যান্ড চলে গেল, আর তুই পড়ে রইলি সেই কলকাতায়, দেখিস দশ বছর পর তোর জীবনেই আক্ষেপ অনেক কম হবে।
বিল্টু, দীপু এরা হয়তো বিশাল চাকরি করবে। কিন্তু সকলে দেশের বাইরে। কালেভদ্রে সকলের সাথে যখন তোর আবার কথা হবে, দেখিস, সব্বাই বলবে। "তুইই ভালো আছিস রে নীলু। কলকাতায় রয়ে গেলি। বেশ নিশ্চিন্তে। রাত দুপুরে ফোন বাজলে দেশ থেকে, কী হল, সব ঠিক আছে তো ভেবে হঠাৎ করে হার্টবিট মিস হয় না। সকাল সন্ধ্যে নিজের সংসারের সাথে বুড়ো বুড়ি দুটোর জন্য বাড়তি টেনশন নিতে হয় না।" নীলু তুই হয়তো তখন ওদের বলবি, "নদীর এপার ওপার কেস এটা।" হয়তো তাই। কিন্তু তুইই বল। বাবা মায়ের বয়স হচ্ছে। হাজারটা ডাক্তার বদ্যি চলছে। তবুও সর্বক্ষণ চোখের সামনে দেখতে পাবি ওঁদের। বা ধর, যখন সারাদিন অফিসে প্রচুর খাটুনির পর বাড়ি ফিরে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে রেডিওতে পছন্দের বাংলা গান শুনতে পাবি, সেই বেলা? অ্যামেরিকা বা হিল্লি দিল্লি কোথাও এই সুখটা পাবি?
যতই ভিড় ভাড় হোক, তাও, ট্র্যাফিক জ্যামের মধ্যে দিয়ে নিজের উপার্জনে কেনা চার চাকা চালাতে চালাতে যখন আশে পাশে বিলবোর্ডে বাংলায় বিজ্ঞাপন দেখবি, আশে পাশে সমস্ত মানুষকে দেখবি যাদের সাথে তুই নিজের অনেক মিল দেখবি... দেখিস, খুব ভালো লাগবে। ওঁরাও যেমন জীবনযাপনের জন্য লড়ছেন, তেমনই তুইও। সংগ্রামটা একই রে। অনেক একাত্ম বোধ করবি।
বর্ষার দিনে গড়িয়াহাট মোড়ে গাড়িটা যখন সিগনালে দাঁড়িয়ে, দেখতে পাবি তোর স্কুলের কিছু বাচ্চারা সেই নীল সাদা ইউনিফর্ম পরে জমা জলের ওপর দিয়ে লাফাচ্ছে, হাসছে, খেলছে, এক লহমায় তোর নিজের স্কুল লাইফের কথা মনে পড়ে যাবে। কত আনন্দই না করেছিস। সেদিন তুই ঠিক বাড়ি ফিরে পুপাইকে নিয়ে কাগজের নৌকো বানিয়ে বিল্ডিঙের সামনে জমা জলে ভাসাবিই। কত আনন্দ পাবি, বলে বোঝাতে পারবো না তোকে। তুই মিলিয়ে নিস শুধু।
হয়তো ঠিকই, কলকাতার বাইরে গেলে তুই অনেক বেশি টাকা রোজগার করতি। হয়তো বা তোর জীবনযাত্রা অনেক উন্নতমানের হত। কিন্তু আমি বলছি, এই কলকাতায় শান্তিতে বাঁচতে গেলে যেটুকু দরকার, তুই ঠিক পাবি। এখনের চাকরিটাতে টিকে গেলেও তোর দশ বছর বাদে যথেষ্ট থাকবে। আর চাকরি পালটালে তো কথাই নেই। এখানেও যা ইনক্রিমেন্ট পাবি, দিব্যি চলে যাবে। এত লো কস্ট অফ লিভিং আর একটা শহরে দেখা দেখি?
একটা কথা বলবো? জানিস এই একটু আগে সামনের রোয়ের বাড়িগুলো থেকে পুজোর চাঁদা তুলে এলাম। ওই বাড়িগুলোয় বেশির ভাগই এখন সিনিয়র সিটজেন। ছেলে মেয়েরা সব জীবীকার সন্ধানে দেশের বাইরে, বা অন্য রাজ্যে। বাবা মায়েরা ওপর ওপর "ভালো আছি" বলেন ঠিকই, কিন্তু সকলের মধ্যেই কেমন অবসাদ দেখলাম। একাকীত্ব। জীবনশক্তিটাই কত কমে গিয়েছে। সেই তুলনায় আমার মা বাবা সুগার কোলেস্টেরলে ভুগলেও, দিল খুলে হাসে এখনও, ছেলে মেয়ে বৌমা জামাই নাতি নাতনি নিয়ে মাঝে মাঝেই বেড়াতে বেরোয়। খেতে যায়। দিব্যি আছে। দিব্যি আছি।
অফিসের কাজ আছে। সেসব তো চলতেই থাকবে। তার সাথে এই যে এই সময় তিন চার মাস, জোর কদমে পুজোর কাজ কর্ম, ছোটাছুটি আর তারপর বিসর্জনের পর একটু স্বস্তি। প্রচুর খাটনি যায়। মাঝে মাঝে মনে হয়, ধুর ছেড়ে দেব। তাও, যখন প্যান্ডেলে লোকেদের ভিড় দেখি, অঞ্জলির লাইন, সেলফির হিড়িক, সেই সব যখন ফেসবুক লাইভে দিই, একদা এ পাড়ার দাদা দিদি ভাই বোন বন্ধুরা দেশ বিদেশ থেকে দেখে আর "মিস করছি" বলে, তখন নিজেকে রাজা মনে হয় রে। এই যে পরিতৃপ্তি, এর কোন তুলনা নেই। বলছিনা যে বাইরে থাকলে এগুলো উপভোগ করা যায় না, কিন্তু তাও, বাড়ি বাড়িই, নিজের শহর, নিজেরই। এই শহরও তো আরেকটা মা রে। এই তো একটু আগে ফেসবুকে দেখলাম রুমঝুমের বোনটা, যে চেন্নাইতে থাকে, ফেসবুকে স্টেটাস দিয়েছে, "বাবার কাছে শুনলাম নীলাঞ্জন দা চাঁদা নিয়ে গেল। এবারও কলকাতার পুজো মিস হল।" আমি যদি কলকাতায় না থাকতাম হয়তো এরকমই কিছু স্ট্যাটাস দিতাম। বি-ব্লক, সি এসের মাঠ, এই সব মিস করছি লিখে।
শোন, তোকে বলি, যা হয়েছে, ঠিক আছে। এটাকে নিয়েই এগিয়ে যাওয়া যায়। স্বচ্ছন্দে। আমি বলছি। অভিজ্ঞতা থেকে। বিদেশে বা অন্য শহরে থাকার যেমন প্রোস অ্যান্ড কন্স আছে, তেমনই কলকাতারও আছে। দেখবি, এই শহরে বসেই জীবনটা ভালোই কাটবে। বছরে দুবার বেড়াতে যাবি। দেশে বিদেশে। সারা বছর শান্তিতে থাকবি । জ্যাম জট মিটিং মিছিলের শহরেও ঠিক একটা জীবন চলে যায়।
এত চিন্তা করিস না। মন খারাপও না।
নে, এবার ঘরের বাইরে চল। দেখ, মলি এসেছে। মা আর ও ফুচকা বানাচ্ছে। খাবি তো?
ইতি
কয়েক গাছা বেশি চুল পাকা নীলু
No comments:
Post a Comment