Monday, September 24, 2018

বিজয়া


সকাল এগারোটা। সোমবার। ভাদ্রের আকাশে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘ। একদম যাকে বলে "পুজোর আকাশ"। দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত সরকারি হাউজিং কমপ্লেক্সে সুবোধ সান্যাল ও ওঁর স্ত্রী শ্রীময়ী সান্যালের নিস্তরঙ্গ জীবন। তিনতলার রান্নাঘর থেকে টুকটাক রান্নার ছ্যাঁক ছোক আর বাসনকোসনের অল্প আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সাথে মাঝে মাঝে চুরির টুংটাং। বাড়ির সামনে মাঠে পুজোর প্যান্ডেলের কাজ চলছে। মধ্যে মধ্যে বাঁশ পড়া আর পেরেক ঠোকার শব্দ, মিস্ত্রীদের হাঁকডাক।


"শুনছো, টিকিটগুলো কেটেছ?" বছর ষাটের শ্রীময়ী রান্নাঘরে সকালের দ্বিতীয় দফার চায়ের জল চাপিয়ে প্রশ্ন করলেন। সুবোধবাবু তখন আনন্দবাজারের শব্দজব্দ নিয়ে বসেছেন, গভীর মনোযোগ দিয়ে অভিধান দেখে, কাটাকুটি করে সমাধান করতে এখনও দেরি। প্রতিদিনের অভ্যেস। রিটায়ার্ড মানুষ। এইসব নিয়েই দিন কাটে। পেন্সিল হাতে একবার মুখ তুলে উত্তর দিলেন, "হ্যাঁ। কাল রাত্তিরেই করেছি।"

" কোথায় যাচ্ছি এইবারে আমরা? " শ্রীময়ীর পাল্টা প্রশ্ন এলো।

" এন জে পির টিকিট কেটেছি। তারপর দেখা যাবে। "

" গত বছরও ওইদিকেই গেলাম। এবারে সমুদ্র গেলে হতো না? " দুই হাতে দুটো চায়ের কাপ এনে সামনে বেতের টেবিলে রাখতে রাখতে শ্রীময়ী বললেন।


সুবোধবাবু একবার তাকালেন স্ত্রীর দিকে। হাত বাড়িয়ে কাপটা নিলেন। কিচ্ছু না বলে আবার ফিরলেন শব্দের জগতে।


"কী গো? কথার উত্তর দিলে না?"


"আমরা কি এই সময়ে বেড়াতে যাই শ্রী যে অত বাছবিচার করব? যেখানের টিকিট পাবো, সেখানেই যাবো। মোট কথা, এই চত্বরে পুজোর কটাদিন থাকবো না না না।" একটু কড়া স্বরেই কথাগুলো বললেন সুবোধবাবু। এবং বলেই বুঝলেন, এরকম বলা ঠিক হয়নি। সামনে বসে থাকা শ্রীময়ী হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলেন।


সাময়িক বিহ্বলতা কাটিয়ে স্ত্রীর কপালে মাথায় হাত বুলিয়ে সুবোধবাবু বললেন, "সরি। আমার এরকম বলা উচিত হয়নি।"

শ্রীময়ী কিছু বললেন না। আস্তে আস্তে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের কোণ মুছে চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় চলে গেলেন। সুবোধ দেখলেন, শ্রীময়ী অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন মাঠের দিকে। জগৎ জননীর আগমনীর অপেক্ষায়।


আট বছর আগে এমনই এক আগমনীর বিদায়বেলায় এই জননীর কোল খালি করে বিজয়া দশমীর দিন চলে গিয়েছিল ওঁদের একমাত্র ছেলে, শুভজিৎ। পাড়ার পুজোর ভাসানে গিয়ে আর ফেরেনি। প্রতিমা বাহক ট্রলারের পিছনের চাকায় পিষ্ট হয়ে চিরতরে চলে গিয়েছিল সে।


সেই থেকে সান্যাল দম্পতি পুজোর চার পাঁচদিন চলে যান দূরে, অনেক দূরে। এই কটাদিন এলে যেন সেই পরম বিভীষিকাময় রাত্রিটা গলা চেপে ধরে ওঁদের। আর তাই এই আনন্দোৎসব থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ওঁরা। এখনও।

সমাপ্ত

(অত্যন্ত মর্মান্তিক একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা।)

No comments:

Post a Comment