মা
স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে বাইরে চোখ রেখে উমা দেখল, বৃষ্টিটা একটুও কমছেনা, ইশ। এত বেজে গেল, পাঁচটার ট্রেনটা মিস হয়ে গিয়েছে এর মধ্যেই। সোয়া ছটার ট্রেনটাও না মিস যায়, আকাশের যা অবস্থা। ব্যাগের ভিতর থেকে মোবাইলটা বের করে একবার শম্পাদিকে ফোনে জানিয়ে রাখল উমা। গুঞ্জা স্কুল থেকে ফিরলে যেন ঠিক করে খেয়ে নেয়, ওর ফিরতে দেরি হবে, রাত্রের জন্য কী রান্না হবে, ইত্যাদি। একবার আশে পাশে চোখ বুলিয়ে নিল উমা। ইতিমধ্যেই জল জমে গিয়েছে অনেকটা, প্রায় হাঁটু অবধি। ছাউনির তলায় ও ছাড়াও রয়েছে ওদের স্কুলের ইউনিফর্ম পরা দুটি মেয়ে, স্কুলের বয়স্ক ক্লার্ক, শ্যামাপদ বাবু। প্রত্যেকেই বৃষ্টিটা ধরার অপেক্ষায়। বার বার সকলেই কব্জি উল্টে ঘড়িতে সময় দেখছে আর মুখে বিরক্তিসূচক শব্দ করছে। এছাড়াও একটি কালো রঙের নেড়ি একটা কোণায় শুয়ে রয়েছে, ওর গায়ের ওপর পরম নিশ্চিন্তে শুয়ে তিনটি সদ্যোজাত ছানা।
"বুঝলেন দিদি, এর থামার কোন চান্স নেই। আমি এই বেলা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যাই। পরে আরো জল জমে গেলে আমি পারবো না। আপনাকে এগিয়ে দেবো?" ব্যাগ থেকে ছাতা বের করতে করতে জিজ্ঞেস করেন শ্যামাদা।
"না দাদা, আপনি এগোন। আমি বরং আরো একটু অপেক্ষা করি। ট্রেনেও অনেকটা রাস্তা। ভিজে গেলে জ্বর বাবাজী আসবেই আসবে। সামনে টার্মিনাল পরীক্ষা, গুঞ্জাটারও পরীক্ষা এসে গেল। এখন আমার অসুস্থ হওয়ার কোন অবকাশ নেই," উত্তর দিল উমা।
"ভালো বলেছেন দিদি। অবকাশ নেই। সত্যি, মা হয়েছেন বলে নিজের জীবনের ওপরই যেন নিজের কন্ট্রোল নেই। সবই আশেপাশের ওপর নির্ভর করবে। এর তার ওপর আপানার অবসর। যাই হোক, আমি আসি। কাল দেখা হবে।" এই বলে শ্যামাপদ বাবু কালো ছাতাটা বাঁ হাতে ধরে, ডান হাত সাইকেলের হ্যান্ডেলে রেখে এগিয়ে গেলেন। ফেলে গেলেন উমাকে এক রাশ স্মৃতির ভিড়ে।
সত্যিই তো, গুঞ্জাই তো ওর জন্য সব কিছু। সাত বছর আগে অরণ্যর আকস্মিক মৃত্যুর পর যখন উমা সাঙ্ঘাতিকভাবে অবসাদে ভুগছে, ঠিক তখনই দুর্ভাগ্যবশত ওর মিসক্যারেজও হল। জীবনের থেকে সমস্ত আশা বা চাওয়া পাওয়া হারিয়ে এক গভীর হতাশায় ওর দিন কাটত। এমন কী এই অবসাদের কারণে কাজে মন দিতে না পেরে নামী আইটি কোম্পানির চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিল উমা। সারাক্ষণ ঘরের কোণে অন্ধকারে বসে চুপচাপ আনমনে থাকা, মাঝে মধ্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদা। মা বাবা তাদের একমাত্র মেয়ের এই অবস্থায় ভয়ানক চিন্তিত হয়ে শেষমেশ এক কাউন্সেলরের কাছে নিয়ে যান উমাকে। ভাগ্যিস তারা তুলনামূলকভাবে প্রগতিশীল ছিলেন। আর তাই পাঁচজনে কে কী বলবে, মেয়েকে পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছে, মানেই মাথার ব্যারাম, এসবের তোয়াক্কা করেননি। ডাক্তার সান্যালের অসীম ধৈর্য ও দক্ষতার জেরে বছর খানেকের কঠিন লড়াইয়ের পর ক্রমে উমা অবসাদের কালো জাল থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে। তারপর চিকিৎসকের ও পরিবার পরিজনের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যাডপশন এজেন্সি থেকে গুঞ্জাকে বাড়ি আনে। গুঞ্জা তখন পাঁচ বছরের শিশু, এক গরীব মাদকাসক্ত পরিবারের ভয়ানক অন্ধকার পরিস্থিতিতে থেকে শৈশব হারাতে বসেছিল ওর। কপাল জোরে এনজিওর কর্মীরা গুঞ্জাকে সেখান থেকে বাঁচিয়ে এনেছিল পুলিশের সাহায্যে। সেই নরক থেকে সবে বেরিয়ে গুঞ্জারও যেমন তখন দরকার ছিল উমাকে, উমাও গুঞ্জাকে পেয়ে যেন অনেকটা নিজের প্রাণের জ্বালা জুড়োতে পেরেছিল। তারপর এই সরকারি স্কুলের চাকরি ওর জীবনকে পূর্ণতা এনে দিল। সারাদিন এই মেয়েগুলোর সাথে কাটানো আর তারপর দিনের শেষে বাড়ি ফিরে গুঞ্জা। এই নিয়েই দিব্যি চলে যাচ্ছে উমার। ভাগ্যের দোষে ও অনেক কিছু হারিয়েছে আগে। কিন্তু এখনের প্রাপ্তিগুলো ও আর কিছুতেই হারাতে চায় না। এই বাচ্চাগুলো আর গুঞ্জাই ওর জীবন। বা বলা চলে, উমার জীবন এদের কেন্দ্র করে চলে। মাতৃত্ব এনে দিয়েছে দুজনের জীবনেই পূর্ণতা।
শ্যামাপদ বাবু ঠিকই বলেছেন। মা তো, অনেক কিছু তাই বদলেছে ওর জীবনে। তবে ভাগ্যক্রমে সমস্তই ভালোর দিকে।
"হ্যাঁ মা। বৃষ্টিটা একটু কমছে এবারে। আমি আর মঞ্জরী একসাথেই আছি। বেরবো। উমাদিও আছেন এখানে। তুমি চিন্তা করোনা।" ছাত্রীদের একজন ফোনে তার মাকে আশ্বস্ত করছিল, অপরদিকেও আরেক মা, প্রচণ্ড চিন্তিত, স্বাভাবিকভাবেই। "বৃষ্টিটা একটু কমেছে। চলো স্টেশনের দিকে যাওয়া যাক।" উমা দুই ছাত্রীকে ডেকে ছাতা হাতে নামল স্ট্যান্ড থেকে।
কুকুর ছানাগুলো ততক্ষণে জেগে গিয়েছে। মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছে হামলে পড়ে। তাদের মা পরম মমতায় চেটে আদর করছে ওদের।
মাতৃত্ব যে সার্বজনীন, সার্বভৌমিক।
বিঃ দ্রঃ আজ world suicide prevention day, জানি বলা সোজা করার চেয়ে, তবুও বার বার বলবো। কোন দুঃখই এত বেশি কি যে ভাগ করে নেওয়া যায় না? বা সমাধান হয় না? মনে হয় না কিন্তু। তাই আরো একবার বলি। কখনও মন বিচলিত হলে প্লিজ কারুর সাথে ভাগ করে নিন। একা লড়ার চেয়ে কারুর সাহায্য নিলে যুদ্ধটা সহজ হয়। চেনা অচেনা যেই হোক না কেন। দেখবেন, ভালো থাকবেন।
No comments:
Post a Comment