Saturday, September 1, 2018

আকাশবাণী


শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় আমার অন্যতম প্রিয় লেখক। এই সেপ্টেম্বর মাসেই ওঁর মৃত্যুদিন (২২শে সেপ্টেম্বর)। ওঁর লেখা "আকাশবাণী" গল্পটি আমার খুব পছন্দের। ওঁর লেখাকে ট্রিবিউট জানানোর জন্যই কাছাকাছি ভাবনাচিন্তার, অবশ্যই আধুনিক জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে, লিখেছিলাম এই লেখাটি বছরখানেক আগে। নামও একই রেখেছি।

আকাশবাণী

এইমাত্র টিয়া চলে গেল। গত এক মাস বাড়ি ভর্তি লোকে লোকারণ্য ছিল। চল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবনের পর এই প্রথম এত বড় বাড়িতে একা থাকতে হবে কৌশিক বাবুকে। স্ত্রী মালিনী দীর্ঘ রোগভোগের পর মারা গিয়েছেন আজ ঠিক এক মাস হল। মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে সুদূর স্কটল্যান্ড থেকে তড়িঘড়ি চলে এসেছিল মেয়ে টিয়া। সাথে এসেছিল জামাই ও যমজ নাতি-নাতনি। ছেলে বৌমা নাতি উড়ে এসেছিল আমেদাবাদ থেকে। সকলে থাকায় মালিনীর অবর্তমানটা যেন ততটা বুঝতে পারছিলেন না কৌশিক। শ্রাদ্ধশান্তি মিটে যাওয়ার পরে ছেলে-বউমা-নাতি-নাতনিরা চলে যাওয়ার পর বাড়ি খালি হলেও টিয়া ছিল বলে সেই একাকীত্ব গ্রাস করতে পারেনি।
আজ যেন সদর দরজাটা বন্ধ করতে বর্তমান পরিস্থিতিটা ভালো করে বুঝতে পারলেন। বিহ্বল হয়ে খানিকক্ষণ সোফায় চুপ করে মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। গত ছয় মাস শয্যাশায়ী থাকলেও মালিনীর জ্ঞান ছিল একদম শেষ দিন পর্যন্ত। রোজ কৌশিকের জেগে থাকার সময়ের সিংহভাগ জুড়ে থাকত মালিনীর কাছে বসে দুনিয়ার গল্প করা। দিন শুরু হত খবরের কাগজ পড়ে শোনানো দিয়ে। তারপর বাজার থেকে কী কী আনতে হবে, সেই সমস্ত আলোচনা, বাজার করে ফিরে বাইরের জগতের খোঁজখবর – সব ভাগ করে নিতেন মালিনীর সাথে। নিজের হাতে খাইয়ে দেওয়া, জানলার ধারে খাটটাকে সরিয়ে বিকেলের চা খাওয়া, সন্ধ্যেবেলার বস্তাপচা বাংলা সিরিয়াল দেখা এবং রাত্রের খাবার খেয়ে একসাথে ঘুমানো – এই ছিল কৌশিক – মালিনীর নিত্যনৈমিত্তিক রুটিন।
এখন তিনি একা এত বড় বাড়িতে বসে একদম নিঃসঙ্গ বোধ করতে লাগলেন। স্ত্রীর সাথে কাটানো বহু সুখস্মৃতির কথা মনে পড়ে যেতে লাগল। পরিষ্কার দেখতে পারলেন গত শীতের ছুটিতে দুজনে রাজস্থান বেড়াতে গিয়ে কত আনন্দ করেছিলেন – উটের পিঠে চড়া থেকে সোনার কেল্লায় সেলফি তোলা – মালিনীর দৌলতে বয়সটা যেন কক্ষনো বাড়তে পারেনি ওনাদের দুজনের। তার আগেরবার পিকনিকে গিয়ে ডাম্বশ্যারাড খেলার ছলে কত মজাই না হয়েছিল। অত্যন্ত প্রাণবন্ত এক মানুষ ছিলেন মালিনী। Latest technology সম্বন্ধে সর্বদা ওয়াকিবহাল থাকতেন। ছেলেমেয়েদের সাথে Whatsapp, Facebook এ তো যোগাযোগ রাখতেনই, তেমনই একটি ব্লগও ছিল। কাল একবার সমস্ত account গুলিতে মালিনীর obituary লিখে account গুলো বন্ধ করে দিতে হবে।
ভাবনাচিন্তা করতে করতে কখন যে সন্ধ্যে নেমে গেছে, খেয়াল করেননি কৌশিক। ঘরের কোণে মালিনীর একটা সদ্যস্নাতা অপূর্ব সুন্দর ছবি বাঁধিয়ে রাখা ছিল। কৌশিকের তোলা, বছর পাঁচেক আগে, নৈনিতালে। যেদিন প্রথম ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট দেখলেন মালিনী, এক অদ্ভুত প্রশান্ত মুখে হার্ড ডিস্ক থেকে নিজের এই ছবিটা বের করে কৌশিক কে ডেকে বলেন, ‘ শোনো আমার শ্রাদ্ধে প্লীজ এই ছবিটা ব্যবহার কোরো। কোন দশ বারো বছর আগের ছবি টাঙিয়ে খুকি প্রতিপন্ন করতে যেও না আমায়। এই কেরালা কটন শাড়ীটা টিয়া প্রথম চাকরি পেয়ে আমায় দিয়েছিল। আমার খুব প্রিয় এটা। আর এই ছবিটা তুমি তুলেছিলে বাবলুর দেওয়া ক্যামেরাতে। সবদিক দিয়েই এটা আমার জন্য স্পেশাল। আর হ্যাঁ, আমি চলে গেলে রোজ আমার ছবির সামনে একটা করে ল্যাভেন্ডার ফ্রেগ্রেন্সের টি ক্যান্ডল জ্বালাবে। অ্যামাজনের লিঙ্কটা তোমায় মেল করে দেব। কোন বাহানা যেন না শুনি।‘
ভাবলেও কিরকম অদ্ভুত লাগে, নিজের মৃত্যু শমন হাতে পেয়েও কৌশিককে কেমন অবলীলাক্রমে এইসব নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন মালিনী। পেশায় ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার, মালিনী, নিজের বয়সী আর পাঁচজনের চেয়ে অনেক বেশী tech savvy ছিলেন। হাতে ধরে কৌশিককে স্মার্টফোন ব্যবহার করা শিখিয়েছিলেন। চোখে লাগে বইয়ের ছোট অক্ষর পড়তে, তাই Kindle ব্যবহারও ওনারই শেখানোয়। কৌশিক, স্ত্রীর কল্যাণে, ষাট বছর বয়েসে প্রথম video call করা শুরু করেছিলেন। খেলার ছলে স্বামী স্ত্রী একতলা দুইতলায় বসে Skype Whatsapp video call করতেন। মালিনীর কথামত ছবির সামনে মোমবাতি জ্বালিয়ে চেয়ার টেনে বসলেন। হাতে নিলেন নিজের মোবাইল ফোনটা। অনেকে কন্ডোলেন্স মেসেজ পাঠিয়েছেন, একে একে উত্তর দেবেন ঠিক করলেন।
হোম স্ক্রীনে দেখলেন ফোন আপডেটের কিছু নোটিফিকেশন, প্রত্যেকটাতেই ওকে দিলেন। স্কাইপের আইকনটা অভ্যেশবসত প্রেস করেই ফেললেন। একটু অবাকই হলেন। মালিনীর প্রোফাইল পিকচার তো এটা ছিলনা। টিয়ার মেয়ে রুমির সাথে গত শীতের সময়ে তোলা ছবিটার বদলে এই ঘরের টেবিলের কোণের দৃশ্য। মোমবাতির আলোয় মালিনীর চোখ চকচক করছে – তাহলে বোধকরি এটা টিয়ার কাজ। ও কদিন ওর মায়ের ফোনটা নিয়ে টুকটাক খুটখাট করছিল। ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাত স্ক্রিনে ভেসে উঠল, “ Malini Sengupta calling”। আঁতকে উঠলেন কৌশিক। দুই চোখ কচলে তাকিয়েই রইলেন, স্কাইপ কল রিসিভ করলেনই না। Unanswered call হয়ে গেল। ফোনের নোটিফিকেশনে দেখলেন, “You have one missed call from Malini Sengupta”। ভালো করে দেখলেন – তারিখ, সময় একদম ওই মুহূর্তের। বিহ্বলতা কাটিয়ে ওঠার আগেই দেখলেন আবার সেই এক , “ Malini Sengupta calling”। বার তিনেক এরকম হল। তিনি ফোনটা না ধরে অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। পঞ্চমবার অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে রিসিভ বাটন প্রেস করেই ফেললেন।
স্ক্রিন্টা অবশ্য ব্ল্যাংকই ছিল। একদম ঘুটঘুট্টে অন্ধকার স্ক্রিন, কেবলমাত্র একটা ক্ষীণ স্বর শুনতে পেলেন, এ তো তার বহুপরিচিত স্বর।
কী হল? কলটা আনসার করছিলেনা কেন?
মালিনী?
হ্যাঁ আমি মালিনীই তো। জানি অবাক হচ্ছ।
তুমি কোথায় মালিনী? আমি তোমায় দেখতে পাচ্ছি না কেন?
Out beyond the ideas of wrongdoing and rightdoing, there is a field – মনে কর আমি রুমির সেই ফিল্ডে। তুমি তো আমায় আর দেখতে পাবেনা। আমি যে আর আমি নেই পুরোপুরি।
আমি কিছুই বুঝছিনা যে।
সে পরে বোঝাব। তুমি কেমন আছ বল কৌশিক।
এখনো তো তোমায় নিয়েই ভেবে চলেছি মালিনী। তুমি না থাকলে আমি কি করে বাঁচব বল?
তাও তো ছেলে মেয়ের সাথে একমাস রইলে। আমার কথাটা ভাব। কত দূরে আমি একা পড়ে আছি। অপেক্ষা করছি কবে তুমি বাড়িতে একা থাকবে আর আমিও আসব।
কেন মালিনী? ছেলে মেয়েদের সামনে এলে না কেন? তুমি কীভাবে এলে? কোথা থেকেই বা এলে?
সব বলছি। আগে একটু দেখি তোমায়। ইশ, চোখের কোলে কালি পড়ে গেছে। জল কম খাচ্ছ?
মালিনী তুমি কেমন আছ?
আমি বড় একা কৌশিক। তোমায় প্রতি মুহূর্তে বড্ড মিস করি। তাই তো তোমার কাছে ছুটে এলাম।
তুমি থেকে যেতে পারনা?
তা হয়না কৌশিক। ওখানেরও কিছু নিয়ম আছে।
তবে তুমি কিভাবে এলে?
দেখো, Rules are meant to be broken। Existing rules এর কিছু tweak আর আমার engineering বিদ্যা কাজে লাগিয়েই এলাম। তবে কোনটাই সম্ভব হতনা তোমায় ছাড়া।
আমায়?
তুমি যদি অন্ধকার ঘরে বসে মোমবাতির আলোয় আমার ছবির দিকে তাকিয়ে না থাকতে বা তাকালেও এক মনে আমার কথা না ভাবতে, তাহলে আমি আসতে পারতাম না। তাও সহজে পারিনি। বহুবার নেটওয়ার্ক এরর আসার পরে আমি আসতে পারলাম।
তুমি রোজ আসবে? সারাদিন আসবে?
রোজ আসতেই পারি। তোমায় এক মনে প্ল্যানচেটের মত আমার কথা ভাবতে হবে। তবেই আমি আসতে পারব। তবে সারাদিন, জানিনা। ওখানেও সিগ্নাল উইক থাকে। কানেক্ট করা মুশকিল। তার ওপর, ওখানের কড়া নিয়ম। যার সাথে যোগাযোগ করব, সে ছাড়া আর কারুর উপস্থিতিতে আমি আসতে পারবনা।
বেশ। মাথায় থাকবে। খবরের হেডলাইন পড়ে শোনাব তোমায় মালিনী? ওখানে বলতে যেখানে বোঝাচ্ছ, সেখানে খবর পাও?
পাই বইকি, কিন্তু তোমার কাছে শুনে শুনে এমন অভ্যেস হয়ে গেছে – মাথায় ঢোকেনা কিছু।
আচ্ছা দাঁড়াও, আমি আনি।

সেইদিন আরো অনেকক্ষণ গল্পগাছা চলেছিল এই দম্পতির। বিজ্ঞান দিয়ে বিচার করতে গেলে এর কোনরকম ব্যাখ্যা নেই, তবু কাজ তো করে। একেই কি তবে বলে মনের টান? কে জানে। এরপর থেকে রোজ দিনে বেশ কয়েকবার কথা – দেখা হত কৌশিক মালিনীর। স্ত্রীর মৃত্যুর পর ছয় মাস হতে চলল। ছেলে – বৌমা আমেদাবাদ থেকে ডাকছে, মেয়ে জামাই বিলেতে ডাকছে। কিন্তু কৌশিকের কোথাও যেতে ইচ্ছে করেনা। গেলে যদি আর মালিনীর সাথে দেখা না হয়? নেশার মত হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে একদিন কাজের মেয়ের হাত থেকে পড়ে কৌশিকের ফোনটা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেল। স্ক্রিনটা কিছুতেই কিছু আর ডিসপ্লে করেনা। পুরো চার্জ করে, বারবার অফ-অন করেও কোন উপকার না পেয়ে তড়িঘড়ি Service centreএ নিয়ে গেলেন। Service centreএর প্রতিনিধির প্রায় দুই হাত ধরে কাকুতি-মিনতি করতে লাগলেন।
ভাই ফোন সেটটা আমার খুব দরকারি, প্লীজ এটা repair করে দাও। যত খরচা পড়বে, আমি দেব। কিন্তু ফোন যেন চালু হয়ে যায় দেখো।
মেসোমশাই দুই দিন observation রাখি, hardware এর গণ্ডগোল নাকি OS পালটাতে হবে, দেখে জানাব।
কৌশিক বেশ ভয়ে ভয়ে দোকান থেকে বেরোলেন, না জানি hardware কিছু গোলমাল হলে মালিনীর সাথে যোগাযোগটা রাখতে পারবেন কি না। গত ছয় মাসে যে প্রত্যেকদিন মালিনীর সাথে গল্প করতেন, এই ব্যাপারটা কেউ জানেইনা। ছেলে মেয়েদের বললে তারা বিশ্বাসই করতে চাইবেনা। কৌশিক নিজেই কি আর প্রথমে ব্যাপারটা ভাল বুঝেছিল নাকি? শরদিন্দু বাবুর গল্পের সাথে মিল খুঁজে পেলেও নিজের জীবনে এমনটা হবে, অভাবনীয় ছিল। তবুও দুই একদিন একটা ঘোরের মধ্যে থাকলেও আসতে আসতে গোটা ব্যাপারটা তার কাছে খুবই স্বাভাবিক হয়ে যায়, বলা চলে, সন্ধ্যে হলেই চায়ের কাপ হাতে, ফোনটা নিয়ে বসাটা রোজের নতুন অভ্যেসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। সারাদিনের সমস্ত গল্প মালিনীর সাথে শেয়ার করতে করতে যেন আর কিছুতেই কথা ফুরোতনা। শেষে মালিনীর দিক থেকেই প্রযুক্তিগত সমস্যা থাকায় কল কেটে দিতে হত। আবার অপেক্ষা পরের দিনের।
Service centre থেকে দ্বিতীয় দিন দুপুরে ফোনটা আসে। উদগ্রীব হয়ে কৌশিক তার নিজের ফোনের কথা জানতে চাইলেন। ছেলেটি জানালো ফোন ঠিক হয়ে গেছে,যেন বিকেলে এসে নিয়ে যান। কৌশিক পারলে তক্ষুনি ছুটে চলে যান। বিকেলবেলা ফোনটা নিয়ে এলেন। সন্ধ্যেবেলায় আগের মতই বসলেন মালিনীর ছবির সামনে। কিন্তু না, সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত, রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গেল। Full signal, WiFi দিব্যি চলছে, অথচ মালিনীর ফোন নেই। সাতদিন হয়ে গেলেও আর “Malini Sengupta calling” ভেসে উঠলনা কৌশিকের স্ক্রিনে।
দুঃখে খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ করার জোগাড়। কাজের লোক ও পাড়া-প্রতিবেশীর থেকে খবর পেয়ে ছেলে ছুটে এসে দেখে বাবার গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। এদিকে হাতে ফোন ধরে, স্কাইপ আইকনের দিকে চেয়ে আছেন একদৃষ্টে। ডাক্তার এসে তেমন কিছু সুবিধে করতে পারলেন না। অনেক রাতে ছেলের ঘুম ভাঙল বাবার গলার আওয়াজে। ধীর পায়ে কৌশিকের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উনি ফোনের দিকে তাকিয়ে বলছেন,
তুমি এসেছ? কোথায় ছিলে এতদিন?
বাবার বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে স্ক্রীন এ চোখ পড়তেই চমকে উঠল সে। অন্ধকার স্ক্রিনের ওপর লেখা “Malini Sengupta in call”।

No comments:

Post a Comment