বেশ কিছু বছর আগের বেড়াতে যাওয়া একটা জায়গার গল্প বলি তবে। পাহাড় তো আমায় ভীষণভাবে টানে, মাঝে মাঝেই তাই আমরা তখন পাহারে চলে যেতাম ঘুরতে। হাতে সময় বেশি থাকলে উত্তরাখণ্ড বা হিমাচল, আর সময় নিয়ে টানাটানি থাকলে হাতের কাছে সিকিম বা উত্তরবঙ্গ।
তখন আমি বি এস সি পড়ছি। পুজোর মাসখানেক আগে একদিন হঠাৎ আমি ভোরের দিকে স্বপ্নে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখলাম। তখন দিনকাল অন্যরকম ছিল, তাই বাবাকে স্বপ্নের কথা বলতেই বললেন, "চল তাহলে। ঘুরেই আসি।" কোথায় যাওয়া যায়, কোথায় যাওয়া যায় এই করতে করতেই কাটল গোটা দুই তিনদিন। আমরা একটু অফবিট জায়গা যেতেই ভালোবাসি। ভাবনাচিন্তার ফাঁকে মনে পড়ল, আরে, গত বছর রিঞ্চেনপং আর উত্তরেতে যাদের হোটেলে ছিলাম, ওঁদের তো অন্য একটা হোটেলও আছে। বোরং নাম জায়গাটার। গত বছরের অভিজ্ঞতা যখন ভালোই, তখন নিশ্চয়ই যাওয়াই যায়।
ব্যস, আর কীসের দেরি। সরকারি কলেজ, মহালয়া থেকে ছুটি পড়ে এক্কেবারে জগদ্ধাত্রী পুজোর পর খুলত। ঠিক হল ভাইফোঁটার পর তাহলে দিন পাঁচেকের জন্য ঘুরে আসা যাবে। আর তখন রীতিমত অফ-সীজন। তাই ট্রেনের টিকিট এমন শেষ মুহূর্তে খুঁজলেও পাওয়া যাবেই। যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ। পরেরদিন সক্কাল সক্কাল বাবা দার্জিলিং মেলের (নাকি উত্তরবঙ্গ, খেয়াল নেই) তিনটে টিকিট কেটে আনলেন। আমি আর মা গড়িয়াতে হোটেলের মালিকের বাড়ি গিয়ে টাকাপয়সা অ্যাডভানস দিয়ে বুকিং করে নিলাম। প্রস্তুতি চলতে লাগল আমাদের টুকটাক। পুজোর হই হুল্লোড় আর ভাইফোঁটার আচার অনুষ্ঠান, গেট টুগেদার সব কাটিয়ে উঠে তো পড়লাম ট্রেনে। যেহেতু বেশ কিছু বছর আগের ঘটনা, ডিটেলে মনে নেই জার্নির কথা। এইটুকু বলতে পারি, নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ট্রেন ঢোকার আগে, প্রতিবারের মতোই আকাশ পরিষ্কার পাওয়ায় কাঞ্চনবাবুকে এক ঝলক দেখতে পেয়েছিলাম, জীবন ধন্য ধন্য একটা ব্যাপার। গাড়ি বুক করে আমরা প্রথমে গিয়েছিলাম রাবাংলা। রাবাংলা অনেকেরই ভীষণভাবে পরিচিত একটি টুরিস্ট স্পট। সেই গল্পে জাচ্ছিনা তাই। মোট কথা ওখানে ওই পায়ে হেঁটে ঘুরে বেরিয়ে, মোনাস্টেরিতে গিয়ে, পাহাড়ে চড়ে ভালোই আনন্দ করেছিলাম। ওইখানে দুই দিন কাটিয়ে পৌঁছলাম বোরং।
বোরং পৌঁছেছিলাম দুপুরের দিকে। বাইরে তখন হাল্কা মেঘলা, মাঝে মাঝে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তাঘাট খুব ভালো না। তা ছাড়া আমাদের হোটেলটি যেখানে, সেখানে খুব একটা আশেপাশে আর কিছু নেই। তাই আমার মা যথারীতি টেনশন শুরু করে দিলেন। না জানি কোথায় এসে পড়লাম, কী করে থাকব, ইত্যাদি। তাও রাস্তায় যে গুটিকয়েক লোকজন দেখা যাচ্ছিল, তাদের জিজ্ঞেস করে আমরা তো অবশেষে এলাম আমাদের হোটেলে। রাস্তাতেই গাড়ি থেকে নেমে পড়তে হল। হোটেলের বয় এসে আমাদের মালপত্র নিয়ে এগিয়ে চলল রিসেপশনের দিকে।
কী জায়গা, চারিদিক নিস্তব্ধ, মাঝে মাঝে কিছু অজানা পাখির ডাক নৈঃশব্দ্য ভেঙ্গে চলেছে। একটা অদ্ভুত বুনো গন্ধ যেন হাল্কা ভেসে আসছে নাকে। এরকম জনমানবহীন স্থানে কী করে থাকব, মোটেই থাকতে রাজি নই, এইসব বলে তো আমি আমার স্বভাববিরুদ্ধ ঘ্যানঘ্যান শুরু করলাম। তখন বয়স অন্তত দশ বছর কম, সারাক্ষণ তাই জমজমাট ভিড় পছন্দ। কিন্তু যেহেতু টাকা দেওয়া হয়ে গিয়েছে, আর কিছু করার নেই। অগত্যা...
আমাদের থাকার জায়গা ছিল একটি কাঠের কটেজে। ইলেক্ট্রিসিটিরই তেমন অবস্থা ভালো না, কাজেই বাথরুমে যে গিজার থাকবে, এ আশা করা মোটেই ঠিক না। হোটেলের লোকজনকে বলতে ওরা একটু কাঠের আঁচে জল গরম করে এনে দিলো। আমরা হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হব। সেই জলে অদ্ভুত গন্ধ হলেও, বেশ আরাম লাগল। ক্লান্তি কাটলেই হল। খাবার জায়গাটি আরেকটি কটেজে। আমাদেরটা থেকে হেঁটে কয়েক মিনিটেরই পথ। রাত্রে হেঁটে যাওয়াটা কিন্তু ভয়ের হতে পারে, অন্ধকারে, "জঙ্গলের" মধ্যে দিয়ে। সেইসব ভাবতে ভাবতে পৌঁছলাম ডাইনিং হল। হোটেল পুরো ফাঁকা, তাই যেতেই বসার জায়গাও পেলাম। গরম গরম ভাত ডাল চিকেন কারি তৈরি। খেয়েদেয়ে একটু যেন স্বস্তি। এইবারে চারিদিকে দেখা যায়।
দেখলাম আমাদের কটেজটির মতোই আরো গোটা চারেক এমন কাঠের কটেজ। প্রত্যেকটির সামনে লাগোয়া এক টুকরো বারান্দা। বারান্দায় বেতের চেয়ার পাতা। আর কটেজের পিছনে লম্বালম্বি সরু এক ফালি বারান্দা। বারান্দায় বেঞ্চ পাতা। বুঝলাম মেঘ না থাকলে হিমালয় দেখা যাবে, তাই এই ভিউ নেওয়ার সুব্যবস্থা। কটেজগুলি প্রত্যেকটিই কোন না কোন গাছের নামে। যেমন, আমাদেরটা ছিল পাইন। পাশে ওক, ফার্ন ইত্যাদি। সামনে অনেকটাই বড় বাগান। সেখানে ফুটে রয়েছে বিভিন্ন রঙের গোলাপ,হলুদ ও কমলা গাঁদা, এছাড়াও আরো বিভিন্ন রঙ বেরঙের নাম না জানা বুনো ফুল। এইবারে বুঝলাম ওই অদ্ভুত বুনো গন্ধের রহস্য। একটা দোলনাও দেখলাম। ভিতরের শিশুটি জেগে উঠল, একটু হলেও। আমারও, মায়েরও।
মেঘ জমে আছে তখনও, হাল্কা শিরশিরানি ঠাণ্ডা। গায়ে চাদর বেশটি করে জড়িয়ে বারান্দায় বসলাম। তখনই ঘরের ভিতর যেতে ইচ্ছে করছিলোনা। এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চারপাশটা, বিশুদ্ধ বাতাস। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলাম খানিকক্ষণ। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি এসে গেল। আমরাও ঘরের মধ্যে এলাম। জঙ্গলের মধ্যে ঘর, প্রচুর পোকা থাকার কথা। ঝটপট ইনসেক্ট রিপেলেন্ট লাগিয়ে ফেললাম গায়ে হাতে পায়ে। দেওয়ালে ইতিমধ্যেই কয়েকটা বড় মথ দেখতে পাচ্ছি। গরম গরম চা আর পকোড়া সহযোগে নিজেদের মধ্যে গল্প করেই বেশ সময় কেটে যাচ্ছিল। হোটেলের বয় এসে ঘরেই ডিনার দিয়ে গেল। ভাগ্যিস। নইলে এই বৃষ্টিতে অন্ধকারে বেরোতে হলে মুস্কিল হতো ঠিকই। মায়ের নির্দেশমতো ঝুটঝামেলায় যেতে হবেনা বলে মরশুম অনুযায়ী ডিনারে খিচুরি আর পাঁপড়ভাজা। মনে আছে, সেই আমলেই এক প্লেটের দাম প্রায় ষাট টাকা ছিল। চমকে গিয়েছিলাম। এতই দুর্গম? কে জানে। ওদের কথামতো প্লেট বারান্দায় নামিয়ে রাখতে দরজা খুলতে দেখি একটি বিশাল কালো কুকুর শুয়ে। অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ দেখে চমকে গিয়েছিলাম অবশ্যই। তবে সে সাময়িক। তারপর তো তাকে প্রচুর আদর যত্ন করা হল।
রাত্রে খুব ভালো ঘুম হল। সকালে উঠে দেখি ঝকঝকে আকাশ। মেঘ কেটে গিয়েছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা এইখান থেকে দেখা যায়না, কিন্তু আশে পাশের বাকি অনেকটা রেঞ্জ দিব্যি দেখা যায়। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় বসে দেখতে খুব ভালো লাগছিল। ভোরের প্রথম আলো কালো সাদা পর্বতশ্রেণীর ওপর পড়ে সৃষ্টি করেছে এক অনন্য ক্যানভাস। মুগ্ধ দৃষ্টিতে বসে বসে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যে কত সময় কেটে যায়। ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা হোটেলের বাইরে বড় রাস্তায় খানিক হাঁটাহাঁটি করলাম। তেমনভাবে তো কোন কাজ নেই। আশেপাশেও সেরকমভাবে ঘুরে বেড়ানোর আলাদা কিছু নেই। যা আছে, তা ওই রাবাংলা, নামচি, যেগুলি আমরা ঘুরেছি বা পরে যাব। তাই শুধুমাত্র আরাম করা আর সাথে দেদার আলসেমি, এছাড়া কিচ্ছুটি করার নেই। খানিক ঘোরাঘুরির পর ফিরলাম হোটেলে। গুচ্ছ গুচ্ছ বুনোফুলের বাগানে পায়ে হেঁটে তো ঘুরলামই, সাথে দোলনায়ও বসলাম। প্রথম কিছু মুহূর্ত একটু ইতস্তত করলেও মাকে আরামে দোলনায় চেপে মজা পেতে দেখে আমিও দোল খেতে শুরু করলাম। বাবা বারান্দায় বসে সমানে ছবি তুলতে লাগলেন। আমি আর মা দোল খেতে খেতে কত গল্প করলাম, গান গাইলাম... তখনও স্মার্টফোনের দৌরাত্ম্য হয়নি, আর তাই প্রতি মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়াতে আপডেট দেওয়ার ব্যস্ততা নেই। নেই কোন অকারণ ব্যাঘাত। বোধহয় প্রাণভরে ছুটির মতো ছুটি কাটানো একেই বলে।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে এবার পালা গল্পের বই পড়ার। বাগানের কোলে চেয়ার পেতে পছন্দের বই। পাশে মোবাইলে বাজছে মৃদুস্বরে প্রিয় গান। বইয়ের পাতা থেকে মাঝে মাঝে মুখ তুলে ওপরে তাকালেই ম্যাজিক। হিমালয়ের অপরূপ বিস্তার। মাঝে মাঝে কালো কুকুরটা পাশে এসে বসছে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। আবার কখনও ক্যামেরা নিয়ে পটাপট কিছু ছবি তোলা। মা বাবা কখনও শুনতে পাচ্ছি ফোনে কথা বলছে। কী করে যে দিন কেটে গেল, বুঝলামই না। যে জায়গায় প্রথমদিন এসে ভাবলাম কী করে কাটবে সময়, সেইখানেই যে এত উপভোগ করবো, অভাবনীয়।
এই দুদিনে যতটা পেলাম, এত শান্তি বোধহয় কখনও আগে কোথাও পাইনি। লোকজনের থেকে দূরে এসে প্রকৃতির কোলে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সঁপে দেওয়ায় যে কত মাধুর্য থাকতে পারে, বোরং না এলে জানতেই পারতাম না। তৃতীয়দিন আমরা বোরং ছেড়ে রওনা দিলাম নামচির উদ্দেশ্যে। দক্ষিণ সিকিমের অন্যতম বড় জায়গা। পথে একটা দুর্ধর্ষ ভিউপয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সাথে সাক্ষাত হল। উঠতেই ইচ্ছে করছিলোনা, খালি ওখানেই বসে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই থাকি আর পরপর গান গেয়ে যাই, এমন মনে হচ্ছিল। ঝকঝকে নীল আকাশ, সবুজ গাছের সারি, ফাঁক দিয়ে বিশাল হিমালয় পর্বতশ্রেণী, মাঝে দীপ্যমান প্রাণের কাঞ্চনজঙ্ঘা। আহা।
" জীবন জুড়ে লাগুক পরশ
ভুবন ব্যেপে লাগুক হরষ
তোমার রূপে মরুক ডুবে আমার দুটি আঁখিতারা..." (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
পুনশ্চঃ বর্তমানে আমার এক বন্ধুর অ্যালবামের ছবি দেখে বুঝেছি বোরং এখন অনেকটাই বদলে গিয়েছে, আরো উন্নত হয়েছে সমস্তকিছু ওখানে। টুরিস্ট যাচ্ছেন বিপুল সংখ্যায়।
No comments:
Post a Comment