প্লেনে উঠে আমার প্রথম কাজ বলতে যেটা ছিল, সেটা হল আগেই দেখা যে সামনের সিটের পিছনে অর্থাৎ আমার চোখের সামনে লাগানো টিভিটা কাজ করে কি না। দেখলাম টাচ কাজ করছেনা। সহযাত্রী যিনি ছিলেন, উনি সাহায্য করলেন রিমোট দিয়ে সেটার সুরাহা করতে। মোবাইলের চারজিং পয়েন্টও আমারটায় কাজ করছিল না। ওনারটাই ব্যবহার করার পারমিশন দিলেন এবং আমি খুশি খুশি গোটা ট্রিপে ওটাই ব্যবহার করলাম। মোটামুটি সবকিছু নিয়ে সেটল করে এরপর আশপাশটা তাকিয়ে দেখলাম। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি, গোটা অ্যামেরিকা ভ্রমণেই যেটা পদে পদে বুঝেছি, আমার একটু ডাইমেনশন নিয়ে সমস্যা আছে। অর্থাৎ, ইন্টারন্যাশনাল প্লেন তো অবশ্যই ডোমেস্টিকের চেয়ে ঢের বড়। অথচ আমি বাইরে দাঁড়িয়ে সেটা বুঝিনি। হয়তো পাশাপাশি দুটোকে রাখলে বুঝতাম। তবে হ্যাঁ, প্লেনের ভিতরটা দেখে বুঝলাম, নাহ, এ সত্যিই বড়। ভিতরে ৩টে করে সীট, এমন তিনটে ব্লক। আমি ছিলাম মাঝখানে। আবার প্রতি পনেরোটা মতো সিটের পরে পরে আবার একটা করে প্যান্ট্রি গোছের জায়গা মাঝখানে আর দুইদিকে দুটো ওয়াশরুম। প্লেনের ভিতরটা গোটা যাত্রাপথেই অন্ধকার অন্ধকার ছিল। সবার জানলার ঝাপি নামানো। হাল্কা হলুদ নীল আলোয় বেশ একটা সুন্দর পরিস্থিতি। কম্বলটা প্যাকেট থেকে বের করে গায়ে জড়িয়ে ঘুমোতে যাব কি ভাবছি (প্লেনের ভিতরে বেশ ঠাণ্ডা ছিল) তখন খাবারের ট্রে নিয়ে এলো। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বড়া পাও (বম্বে থেকে খাবার উঠেছে, থাকবেই), ব্রেড আর কাটা ফল। সাথে চা কফি। সেসব ওই রাত তিনটেতে কে খায়। অল্প খুঁটে খুঁটে ফল খেয়ে ট্রে ফেরত দিয়ে কম্বল মুরি দিয়ে শুলাম। কানে হেডফোন (এয়ারলাইন্সেরটাই), কিছু পুরনো হিন্দি গান চালিয়ে, স্ক্রিন অফ করে। কব্জির ঘড়িতে তখনও ভারতীয় সময়ই চলছে। ঘুম আসেনা কিছুতেই। তন্দ্রা ভাব শুধু। তাও ওই মিনিট দশ পনেরোর ঘুম, তারপরে ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে, এই করতে করতে ঠিক করলাম একবার গোটা প্লেনটা চক্কর কাটি। কাটলামও। দেখলাম অন্ধকারে অনেকেই ঘুমোচ্ছেন। আবার কেউ কেউ বিশেষত বয়স্করা রীতিমতো মর্নিং (নাকি ইভনিং) ওয়াক করছেন।
এই হাঁটাহাঁটির ফলে যেটা লাভের লাভ হল, আমি এসে টানা তিন ঘন্টা জমিয়ে ঘুম দিলাম। আমার সহযাত্রী যিনি ব্যাঙ্গালোর থেকে এসেছিলেন, বেশ ভালো মানুষ। একবারও আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে বের হননি। তাই একদম একটানা ঘুম ঘুমিয়ে যখন ব্রেকফাস্ট করব বলে উঠলাম, রীতিমতো ঝরঝরে লাগছিল। চোখে মুঝে জল দিয়ে সিটে ফিরলাম। ইতিমধ্যে ব্রেকফাস্ট এসে গিয়েছে। বেশ ভারী একটা অমলেট, ব্রেড, বাটার, চা কফি, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর আবার কাটা ফল। এতক্ষণে খিদে খিদে পেয়েওছে। খেলাম ওপর ওপর।
তারপর, কী করা যায়, কী করা যায়? সিনেমা দেখব ঠিক করলাম। তেমনভাবে কিছুই পছন্দ হল না। অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে শেষমেশ ময়ূরাক্ষী দেখা শুরু করলাম। ঘন্টা দেড় দুই ওতেই কেটে গেল। এরপর? একটু আসতে আসতে কী করি আজ ভেবে না পাই ভাব আসছিল। তখন ঠিক করলাম যে না, বন্ধুটি যে হোমটাস্ক দিয়েছে (যাওয়ার দিন একটি গল্প পোস্ট করে গিয়েছিলাম মনে আছে? বাদল দিনের প্রথম কদম্ফুল... ওইটার একটা দ্বিতীয় পর্ব চাই। লেখার ইনপুট এয়ারপোর্টে বসেই পেয়েওছিলাম।) সেটি করা যেতে পারে। খুব বেশি আলো ছিল না। তাও তারই মধ্যে ব্যাগ থেকে রাইটিং প্যাড বের করে টুকুস টুকুস করে লিখতে লাগলাম। ইতিমধ্যে আবার ড্রিঙ্কস নিয়ে চলে এসেছে হোস্টেস। আমার ঠিক করাই ছিল, রেড ওয়াইন খাবো। নিলামও তাই। সাথে সল্টেড পিনাটস। বেশ একটা আয়েসের ব্যাপার। যাই হোক এইসব লেখালিখি ও পানীয় নিয়ে সময় কেটে গেল। ইতিমধ্যে বারোটা বাজতে যায়, দেখতে দেখতে এসে গেলো লাঞ্চ। সুন্দর হট মিল। জিরা রাইস, শ্রেডেড চিকেন, মিক্সড ভেজ, আবারও ব্রেড, চা কফি ইত্যাদি। মোটামুটি খেলাম। নড়াচড়া নেই। খিদেও তেমন নেই। খেতে খেতে আরেকটা সিনেমা দেখতে বসলাম। ততক্ষণে আবার এয়ারহোস্টেস এসে আমাদের সকলকে ধরালেন একটি করে কাস্টমস ফর্ম। এই ফরমটির বিষয়েও মধুরিমা সব শিখিয়ে দিয়েছিল। সিল্ড প্যাকেটে খাবার থাকলে ডিক্লেয়ার করার প্রয়োজন নেই, তেমনি দশ হাজার ডলারের নীচে ক্যাশ ক্যারি করলেও বলার দরকার নেই। বাকি সব দেখে শুনে ভরলাম। সহযাত্রীকে পেন ধার দিলাম। ঘড়ির কাটায় যখন বিকেল চারটে পেরিয়েছে, পাইলট বললেন যে এইবারে আমরা নামা শুরু করব। বাইরের তাপমাত্রা ও লোকাল সময় জানিয়ে দিলেন। ন্যু জার্সি ভারতীয় সময়ের থেকে সাড়ে নয় ঘন্টা পিছিয়ে। সেই মতো ঘড়ি অ্যাডজাস্ট করে ফেললাম। যখন প্লেন মাটি ছোঁব ছোঁব করছে, ফোনের ফ্লাইট মোড অফ করে দিয়েছি। পিকপিক করে এস এম এসের শব্দ পেলাম। যাক, বিরাট নিশ্চিন্তি। আমার ইন্টারন্যাশনাল রোমিং তাহলে কাজ করছে। জিও ফোনের রোমিং প্যাকটা সবচেয়ে কস্ট এফেক্টিভ লেগেছিল। যত জায়গায় ঘুরেছি, ভীষণ ভালো কাভারেজ পেয়েছি। এ টি & টি কোম্পানির টাওয়ার। ঝটপট ওয়াটসঅ্যাপে বাড়িতে জানালাম। মধুরিমাকেও।
প্লেন যথাসময়ে নামল। আমিও লটবহর নিয়ে নামলাম। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। এই এতক্ষণে তাহলে মার্কিন মুলুকে এলাম। দেশের ভিতরে যাওয়ার পারমিশন পাওয়া এখনো বাকি। কিন্তু অন্তত পৌঁছে তো গিয়েছি। বাইরে সকালের হাল্কা রোদ। অল্প অল্প ঠান্ডা। গলায় স্কার্ফটা ভালো করে এঁটে নিলাম। ফ্লাইটের বাকি যাত্রীদের ফলো করে খানিকটা হেঁটে পৌঁছলাম একটা জায়গায়। মধুরিমার পরামর্শে যদিও ইয়ুটিউব থেকে এয়ারপোর্টটা আর ইমিগ্রেশনের বিষয়ে অনেক ভিডিও দেখে রেখেছিলাম আগেই, তবুও সবকিছুই নতুন নতুনই লাগছিল। একজন সিকিউরিটি স্টাফ, বেশ অমিশুকে দেখতে ভদ্রমহিলা আমাদের সকলকে দেখে "ইন্ডিয়ান পাসপোর্ট দিস সাইড, অ্যামেরিকান পাসপোর্ট দেয়ের" বলে লাইনে ঢুকিয়ে দিলেন। ভয়ে তখন বুক দুরুদুরু। ব্যাকপ্যাক থেকে যাবতীয় ডকুমেন্টসের ফাইলটা বের করলাম। ছবি তুলব কি, ফোন ব্যবহারও বারণ। তাই ইমিগ্রেশন হচ্ছে যে, সেটাও মা বাবাকে জানাতে পারিনি। পরে জেনেছিলাম আমার মা এর মধ্যে মেয়ের কী হল এই টেনশনে বেশ কয়েকবার মধুরিমাকে মেসেজ টেসেজ করে একাকার। লাইন ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। বিরাট ঘর, পরপর অনেক কাউন্টার থাকলেও অনেকগুলিই বন্ধ। ওই গোটা দশেক কাউন্টারে স্টাফ আছে। আর তাই সময়ও লাগছে। এয়ারলাইন্সের ক্রুদের আলাদা কাউন্টার। ওরা যখন ইমিগ্রেশন পর্ব মিটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, খালি মনে হচ্ছিল ইশ, আমার আপন মানুষগুলো কোথায় চলে যাচ্ছে। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে একদম একা।
আর ঠিক তখনই আমার পিছনেই এক প্রৌঢ় দম্পতিকে দেখলাম। বাবা মায়ের বয়সী হবেন। ভদ্রমহিলার হাতে শাঁখা পলা দেখে নিশ্চিত হলাম, যাক, ঘরের লোক। ওনারাও আমায় দেখে বোধ করি একটু আস্বস্ত হলেন। আমায় জিজ্ঞেস করলেন, "আচ্ছা, এখানে শুধু হিন্দি আর ইংরেজি চলবে কাউন্টারে, না?" আমি বললাম, "হিন্দিও চলবে না হয়তো।" ওনাদের মুখ সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে গেল। ভদ্রলোক বললেন, "আচ্ছা, তুমি তাহলে একটু আমাদের সাথে সাথে থেকো। লাগেজ নেওয়া অবধি।" আমি বললাম, "বেশ। তবে লাগেজ নেওয়ার পরও আবার অফিসারের কাছে যেতে হবে।" অনুরোধ করলেন তখন অবধি থাকতে। কাউকে যতটুকু আমার ক্ষমতায় আছে, সাহায্য করা যায়, সচরাচর করি। এই ক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি। কাউন্টারের অফিসারের ওই অতি বিরক্ত, "কেন যে এরা আমাদের দেশে আসে" গোছের মুখ দেখে আবার প্যাল্পিটেশন বেড়ে গেল আমার। তার মধ্যেও যথাসাধ্য উত্তর দিলাম প্রশ্নের। সেই একই বুলি। কেন এসেছি, কোথায় যাব, কতদিন। কত টাকা সঙ্গে আছে। গুছিয়ে উত্তর দিলাম। বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন হল। এক মাসের থাকার অনুমতির স্ট্যাম্প পড়ল পাসপোর্টে। কাউন্টার ছেড়ে এগিয়ে গেলাম। ওই দম্পতি এলেন। কিছু অসুবিধে হচ্ছিল ওঁদের। আমায় ডাকলেন হাত নেড়ে। আমার সামনে তখন এক অফিসার, পকেটে বন্দুক। ওরে বাবা, যদি গুলি টুলি করে দেয়, ভরসা নেই। ওঁকে জিজ্ঞেস করলাম, সাহায্য করতে যেতে পারি কি না। অনুমতি পেয়ে গেলাম। আবার ওই গোমড়া মুখো খিটখিটে লোকটার প্রশ্নের ট্রান্সলেশন আর এঁদের উত্তরের পালটা ট্রান্সলেশন পর্ব চলল। সেখানেও পারলে এঁদের ভয় টয় দেখিয়ে দেন আর কি। তারপর এইসব মিটিয়ে লাগেজ নেওয়ার জায়গায়। দু দুটো বেল্টে আমাদের লাগেজ আসবে। খেয়েছে রে। একেই এই ফ্লাইটটার প্রচুর বদনাম। অনেক সময়ই লাগেজ পরে আসে। ওই ওজন বেড়ে গেলে তেল কম নেওয়া হবে, তাই। আমার তখন ফিঙ্গার ক্রসড কেস। যদিও ব্যাকপ্যাকে এক দুদিনের জিনিস রাখা আছে প্রয়োজনীয়, তবুও। ওই হয়রানিতে কে যায়। একটা বেল্টে খানিক্ষণ দেখলাম। না। আমার বেগুনি স্ট্রলির কোন দেখা নেই। অনেক বেগুনি আসছে বটে, কিন্তু আমার কমলা রঙের ফিতে বাঁধাটি আর নেই। একটু বিমর্ষ হয়ে পাশেরটাতে গেলাম। সেখানেও নেই। যাহ্, দুর্ভোগের শেষ নেই ভাবছি। এমন সময়ে ওই ভদ্রমহিলা এসে বললেন, "তোমার ব্যাগ পেয়েছ?" বললাম, "না।"
"কেমন দেখতে??"
""বেগুনি। কমলা ফিতে।"
"অনেকে ব্যাগ নামিয়ে রাখছে পাশে। দেখো তোমারটা আছে কি না। আমাদের একটা ওইভাবেই পেয়েছি।"
এই তো। এটা তো খেয়াল করিনি। একটা জায়গায় দেখলাম বেল্টের পাশে অনেকে ব্যাগ নামিয়ে রেখেছে। আরে এঁদের বুদ্ধি কবে হবে কে জানে। নিজের ব্যাগ না, ভুল করে নামিয়েছেন যখন, আবার বেল্টে তুলে দিতে কী হয়? যতসব। যাই হোক, সেখানে একটু এগোতেই দেখি আমারজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে। তাকে নিলাম। এঁদেরও ডেকে নিলাম। একসাথে এবার গন্তব্য কাস্টম অফিসারের কাছে। এই ভদ্রলোক বেশ হাসিখুশি। আমার এত কম লাগেজ দেখে নিতান্তই অবাক। ফর্মে কোন ডিক্লারেশন নেই। তাই ছাড়া পেয়ে গেলাম। ওঁদের কাউন্টারের ভদ্রলোক আমায় জিজ্ঞেস করলেন হিন্দি বলি কি না। বললাম যে হ্যাঁ, পারি। আমায় অনুরোধ করলেন দোভাষীর কাজ করতে ওঁদের জন্য। আমি দিব্যি বাংলায় বললাম। এই অফিসারটি নিপাট ভদ্র। আমায় খুব করে ধন্যবাদ জানালেন। ব্যস। এবার আমরা তিনজনে টুকটুক করে বেরোলাম। ওঁরা তখনও ভয়ে ভয়ে। "মনা, আর কিছু করতে হবে না?" "না না। ব্যস। এইবার আনন্দে ঘুরুন। মেয়ের সাথে দারুণ সময় কাটান।"
গেট দিয়ে বেরিয়েই ওঁরা ওঁদের মেয়ে জামাইকে দেখতে পেলেন। আমিও পেয়ে গেলাম মধুরিমা আর ওর বর অরিনকে। একটু সৌজন্য বিনিময়ের পর যে যার নিজের পথে।
মধুরিমাদের দেখলাম সেই পাঁচ বছর পর। এত আনন্দ হয়েছিল, বলে বোঝাতে পারব না। এতক্ষণে স্বস্তি, দুই পক্ষেরই। যাক, আই এম ইন সেফ হ্যান্ডস নাউ। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে চললাম পারকিং লটে।
(বন্ধুর সাথে একটু গল্প করে নিই? আবার ফিরছি তারপরে)
No comments:
Post a Comment