ঠাকুমা বললে যে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, আমার উম্মিকে দেখলে কিন্তু কক্ষনোই সেটা মনে হতোনা। অযথা প্রশ্রয় বা দুষ্টুমি করলে মায়ের কাছে বকা খেলে বা মার খেলে কখনই উম্মি আমায় বাঁচাতে আসত না। হয়তো নিজে স্কুলের টিচার ছিল বলে শাসন ও তার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভীষণভাবে ওয়াকিবহাল ছিল।
উম্মি বলতেই যে ছবিটা মনে পড়ে তা হল পাঁচ ফুট দুইয়ের এক নরমসরম মানুষ। একটা সাদা ঢলঢলে ব্লাউজ গায়ে, সাথে সাদা শাড়ি, সবুজ বেগুনি নেভি ব্লু বা কালো সরু পার। হাতে একটা রুপোর বালা। বড়ি খোঁপা। আর কোথাও বেরোলে আলমারি থেকে বের করে পুজোয় বা পয়লা বৈশাখে আমার বাবা বা জ্যাঠার থেকে পাওয়া ঘিয়ে রঙের মুর্শিদাবাদ সিল্কের ওপর সবুজ পার আঁচল শাড়ি। হাতে সোনার বালা। ব্যস। আর কোন সাজ নেই।
আমি যখন সবে দুই, সেই বছরই উম্মি রিটায়ার করে চাকরি থেকে। দেশবন্ধু বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিল। সেইসবের স্মৃতি নেই কোন, শুধু ছবিতে দেখেছি। আমার মনে পড়ে, লোয়ার কেজিতে পড়ার সময় স্কুল বাস আমায় ক্রেশে না নামিয়ে এগিয়ে চলে যাচ্ছিল। আর দুর থেকে সেটা দেখতে পেয়ে উম্মি এক সাইকেল আরোহীকে বাসের পিছনে তাড়া লাগিয়ে বাস থামায়। তারপর ক্রেশে নিয়ে গিয়ে বড় আনটিকে এমন বকা বকে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য, ওই দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী বড় আনটি পর্দার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।
ছোটবেলায় আমাদের টিভিতে কেবল কানেকশন ছিলনা। উম্মিরটায় ছিল। আমি স্কুল থেকে ফিরতাম পৌনে চারটের মধ্যে। ছুটতে ছুটতে ওপরে যেতাম। পাইলোকার নামে চোখের ড্রপ দিতাম উম্মিকে। আর সেই সুবাদে বসে বসে চলত একতা কপূরের বস্তাপচা সিরিয়ালে হাতেখড়ি। এমনও হয়েছে কোন প্রিয় দেশের খেলা হচ্ছে, সিরিয়াল দেখতে দিতাম না। কম দৌরাত্ম্য করিনি উম্মির সাথে।
সন্ধ্যে সাটায় দূরদর্শনের বাংলা সংবাদ নিয়ম করে শুনত। খবর শেষ হলে টুকটুক করে নিচে নামত, ডিনার সারতে। পায়ের আওয়াজ পেলেই আমি সিঁড়ির লাইট জ্বালিয়ে দিতাম আর এক ছুট্টে গিয়ে হাতটা ধরতাম। তারপর হাত ধরে খাবার টেবিল অবধি পৌঁছে দিতাম। দুটো রুটি তরকারি আর আম বা দুধ। এই ছিল রাতের খাবার। সারা বছর এক মেনু। শুধু অম্বুবাচির সময় লুচি আম ম্যাঙ্গো মিল্কশেক পেঠা ডালমুট আর একাদশীতে সাবুর খিচুরি।
সকালবেলা ফুলের সাজি হাতে বাগানের গাছ থেকে জবাফুল তোলা, গাছের ফুল নিয়ে সপ্তমী থেকে নবমী স্নান করে নতুন কাপড় পরে আমার হাত ধরে বাড়ির পিছনের প্যান্ডেলে অঞ্জলি দেওয়া, নীল বা শিবরাত্রিতে মা জেঠির সাথে শিবের মাথায় জল ঢালা, জামাইষষ্ঠীর দিন ভিজে হাতপাখা দিয়ে আমাদের হাওয়া করা।
গরমের ছুটি, পুজোর ছুটি বা শীতের ছুটিতে বা সাপ্তাহিক বৃহস্পতিবার স্কুল ছুটি থাকলে আমি দিদি আর উম্মি থাকতাম সারাদিন বাড়ি। বারোটা বাজতেই উম্মি নিচে নেমে আলু ভাজত, বা কোনদিন ভেন্ডি। দুটোই চিনি মাখিয়ে, ক্যারামেলাইজড টেস্ট আসত। আজও আমি এই দুটো ভাজা অন্য কোনভাবে খেতে পারিনা। মনে পড়ে শীতকালে টমেটো মটরশুঁটি চিনি মাখিয়ে ভাত দিয়ে মেখে খেত। আমি একদম ভালবাসতাম না। কিন্তু কোনদিনও তার জন্য বকেনি আমায়।
জাগরণী পাঠাগার থেকে একসাথে মা বাবা উম্মি আর আমার জন্য বই আসত নিয়ম করে। ছুটির দুপুরগুলো দুজনে দিব্যি বই পড়ে কাটাতাম। কোনদিনও যদিও গল্প শোনায়নি আমায় অন্যদের ঠাকুমা দিদিমাদের মতো। হয়তো পঁয়ত্রিশে স্বামীহারা হওয়ায় দুই ছেলে মানুষ করার অসম্ভব দায়িত্বে বেশিরভাগ আবেগ চলে গিয়েছিল। ওই যুগে বি এড পড়ে স্কুলে চাকরি করে দুই ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করা, চারটিখানি কথা না। এবং চিরকাল নিজের পায়ে দাঁড়ানো। এমনকি, বাড়ি পর্যন্ত নিজের জমানো টাকায় কেনা। কোনদিনও ছেলেদের কাছে কিছু চায়নি। অসুস্থতার সময়েও না।
টুকরো টুকরো অনেক কথাই মনে পড়ে যায় আজকাল। তবে সবচেয়ে বেশি আক্ষেপ হয়, মাধ্যমিকের রেজাল্টের কথায়। বাবার চাকরিসূত্রে অফিশিয়ালি রেজাল্ট বেরনোর আগের রাত্রে (প্রায় এগারোটা সাড়ে এগারোটা) আমার মার্কস জানতে পারি। সকলকে জানিয়েছিলাম, উম্মি ছাড়া। উম্মি তখন খুব অসুস্থ। কড়া কড়া ওষুধের ফলে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, জাগাইনি। পরেরদিন সকালে যখন বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল, আমি দেখা করে বললাম, আমায় বলেছিল, "তুই কাল আমায় রাত্তিরে জানাসনি কেন? আমি খুব দুঃখ পেয়েছি তুতুল।"
তুমি চলে গিয়েছ আজ চৌদ্দ বছর হয়ে গিয়েছে। সেই রাত্তিরটা যেমন এখনও মনে পড়ে, বাড়ির কাজের মাসি আমায় ওই মাঝরাত্রে "বনু, ওঠো, ওপরে এসো" বলে, তখনই বুঝেছিলাম। তুমি নেই আর। তবু বেশি আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খায় তোমার বলা ওই কথাগুলো। তোমার অভিমান। "আমি খুব দুঃখ পেয়েছি তুতুল।" সরি উম্মি।
No comments:
Post a Comment