আগেই বলেছিলাম যে স্যান ফ্র্যান্সিস্কো না যেতে পারায় আমার অনেক টাকা নষ্ট হয়েছিল। যার ফলে ইন্সটিটিউটের থেকে প্রাপ্য টাকা কমে গিয়েছিল। প্রতিনিয়ত আমায় তাই কস্ট কাটিং করতে হয়েছে। এরই এক নমুনা। আমি নেওয়ার্ক থেকে বস্টন ট্রেনে যাওয়া স্থির করেছিলাম। মধুরিমাদের বাড়ি থেকে ন্যু জার্সি পেন স্টেশনটি ওই মিনিট কুড়ি পঁচিশের মতো দূরে অবস্থিত। ওরা গাড়িতে আমায় স্টেশন পৌঁছে দিল। গোটা অ্যামেরিকা ট্রিপে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। ওখানে সকলে জি পি এস কে ভীষণভাবে ভরসা করে। মানে ধরুন আপনার বাড়ি পূর্ণ সিনেমার সামনে। আপনি যাবেন রাসবিহারী মোড়। সোজা রাস্তা। বছরের পর বছর গাড়ি চালাচ্ছেন। তবুও আপনি রোজ গাড়িতে উঠে জি পি এস অন্ করে ডেসটিনেশন দেবেন এবং যন্ত্রের নির্দেশেই গাড়ি চালাবেন। ঠিক এইরকম ওখানে। আর যন্ত্র তো যন্ত্র রে বাবা। ভুলভ্রান্তিও হয়। হলও তাই। একই রাস্তা দিয়ে কম করে পাঁচবার চক্কর কাটলাম আমরা। পারকিং লটে পৌঁছনর জন্য। এবং শেষমেশ ঠিকঠাক পেলামও না। অরিন গাড়িতে রইল। মধুরিমা আমাকে স্টেশনে নিয়ে গেল। এবং ভালো করে দেখিয়ে দিল যে কোনরকম কিছু সমস্যায় পড়লে হেল্পডেস্ক ঠিক কোথায়। বোর্ডে আমরা দেখে নিলাম আমার ট্রেনের নম্বর মিলিয়ে, কোন প্ল্যাটফর্মে আসবে। আমার ট্রেনটি ছিল নর্থ ইস্ট রিজিওনাল ১৬০। ও প্ল্যাটফর্মে আমায় দাঁড় করিয়ে চলে গেল, নইলে গাড়ির সমস্যা হত।
স্টেশনটা বিশেষ ভিড় নেই। ট্রিপঅ্যাডভাইসর বেশ ভয় টয় পাইয়ে দিয়েছিল। নাকি এত ভিড় হয় যে ট্রেনে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে, সিট পাওয়া যায় না ইত্যাদি। আমি সেই ফাঁকা প্ল্যাটফরম দেখে তাই একবার ভাবলাম, ঠিক জায়গায় আছি তো? দুবার তিনবার টিকিটের সাথে মিলিয়ে নিলাম বোর্ড। আটটা পনেরোয় ট্রেন ছিল। আটটার পর থেকে এক এক করে পাঁচ ছয়জন এলেন। নিশ্চিন্ত হলাম। পাশের লাইন দিয়ে অন্যান্য ট্রেন যাচ্ছে আসছে। আমার ট্রেনটি যথাসময়ে এলো। অ্যামট্র্যাকের ট্রেনে সিট নম্বর নির্দিষ্ট থাকেনা। শুধু রিজার্ভেশন দেয়। তাই যে কোন জায়গা থেকেই ওঠা যায়। উঠে পড়লাম সামনেই যে কামরা পেলাম, তাতে। ভিতরটা আমাদের দেশী দামী চেয়ার কারের মতো। অনেকটা চেন্নাই ব্যাঙ্গালোর শতাব্দীর একজিকিউটিভ ক্লাসের মতো। বড় কাঁচের জানলা। সবুজ গদি দেওয়া সিট। মাথার ওপর লাগেজ রাখার জায়গা। আমি উঠে তো জানলার ধার পেলাম না খুঁজে। অগত্যা ধারের সিটে বসলাম। এক ভদ্রলোকের সাহায্যে (দেখে ভারতীয় মনে হল। স্ত্রী ও মেয়ের সাথে ট্র্যাভেল করছিলেন) ওপরে স্যুটকেসটা রাখলাম। ইতিমধ্যে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। পরের স্টেশন ন্যু ইয়র্ক। সেইখানে অবশ্য জানলার ধার পেয়ে গেলাম। গুছিয়ে বসলাম। পাশের সিট ফাঁকা। উল্টোদিকে এক ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা। ওঁরা ন্যু ইয়র্ক থেকে উঠলেন। সৌজন্যমূলক হাসি বিনিময় হল। আমি দেখলাম আমার অ্যাড্যাপটার কাজ করছে এখানে। দিব্যি ফোন চার্জে বসিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে নিলাম। ট্রেনের ওয়াই ফাই বেশ ভালো থাকলেও ইয়ুটিউব চলছিল না। তাই নিজের স্টকের গানই ভরসা। বাড়িতে মাঝে মাঝে মেসেজ বা ওয়াটসঅ্যাপ কল করে কথাবার্তা চলছে। সাথে সাথে মধুরিমা আর সুজাতাকেও লাইভ আপডেট দিচ্ছি।
ন্যু ইয়র্ক ছাড়াল যখন ট্রেন, তখন ন্যু ইয়র্কের বিখ্যাত স্কাইলাইন চোখে পড়ল। এই প্রথম পশ্চিমের বিরাট বিরাট বাড়ি দেখলাম। আগেই একবার বলেছিলাম, আমার সাইজ নিয়ে সমস্যা আছে। পাশে আমাদের দেশী বিল্ডিং থাকলে হয়তো বেশি ভালো বুঝতাম এইগুলির মাহাত্ম্য। নইলে দেখে মনে হল, হ্যাঁ বড় বেশ। তবে ওই আর কী। এই ট্রেনের যাত্রাপথও আমার ইয়ুটিউবে দেখে নেওয়া। তবুও চাক্ষুস দেখা আর স্ক্রিনে দেখার মধ্যে বিস্তর ফারাক। ট্রেন ছুটছিল ভালোই স্পিডে। একের পর এক ছোট ছোট গ্রাম ও টাউনের ওপর দিয়ে। সবুজালির অভাব নেই। মাঝে মাঝে আবার পুকুরের মতো জলাশয়। লেক। ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্রেন ছুটছে। কোথায় যেন তখন ভারতীয় রেলের লঙ ডিস্টেন্স জার্নিগুলোর সাথে বড্ড মিল পাচ্ছিলাম। একটা স্টেশন পার হলাম। নিউ ইংল্যান্ড। পাশেই সুবৃহৎ অ্যাটল্যান্টিক ওশেন। অপূর্ব। ট্রেনের উল্টোদিকের জানলায় ছিলাম বলে ছবি তুলতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু অমন পিকচারেস্ক স্টেশন আর দুটো দেখিনি। পরপর প্রচুর স্টিমার যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ইয়াচ। আর রয়েছে লাক্সারি ক্রুস। যে যার সামর্থ্য ও প্রয়োজন মতো ব্যবহার করবেন এই জলপথ। আর সমুদ্রের ধার দিয়ে যে রাস্তা, ভর্তি শুধুই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাল নীল সাদা স্ট্রাইপস ও স্টারসের পতাকা। সেটা সদ্য ৪ঠা জুলাই, অর্থাৎ ওদের স্বাধীনতা দিবসের জন্য না এমনিই থাকে সব সময়, জানা নেই। পড়ে পিসির কাছে শুনেছিলাম যে এমনিই ওখানে লোকজন একটু বেশি দেশভক্ত। তাই ফ্ল্যাগ হামেশাই ঝোলান বাড়িতে গাড়িতে অফিসে স্কুলে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্টেশনে ট্রেনে লোকজন নিয়মিত উঠছেন নামছেন।
পরপর কী কী স্টেশন থাকবে, দেখে রেখেছিলাম। প্রভিডেন্স ও তারপরে রুট ১২৮। তারপরেই বস্টন ব্যাক বে স্টেশন। আমার গন্তব্য। টিকিট ইন্সপেক্টার মাঝে এসে টিকিট দেখে গিয়েছিলেন। প্রভিডেন্স আসার আগে এসে বলে গেলেন। সুজাতাকে জানিয়ে রাখলাম। ওর আসার কথা আময় রিসিভ করতে, স্টেশনে। যখন আমি রুট১২৮, ও ব্যাক বে পৌঁছে গিয়েছে। যাক, আমি নিশ্চিন্ত। অবশেষে দুপুর দেড়টার দিকে বস্টন ব্যাক বে স্টেশনে ট্রেন ঢুকল। এর পরেরটা শেষ স্টেশন, তাই ট্রেন প্রায় ফাঁকা। প্ল্যাটফরমটি দেখলাম বেশ অন্ধকার। আন্ডারগ্রাউন্ড বলেই মনে হল কারণ বেশ অন্ধকার। হলুদ আলো জ্বলছে। প্রায় আমাদের মেট্রো স্টেশনগুলির মতো। ট্রেনটা বেরিয়ে যেতে নিয়মমাফিক ফোন ও মেসেজ করে কিছু যাত্রীদের পিছন পিছন এগোলাম। প্ল্যাটফর্মের দেওয়ালে বস্টনের ম্যাপ আঁকা। আরো রয়েছে মেট্রো আর বাসের রুটের নক্সা। বস্টনের এই মেট্রো সিস্টেমকে টি বলে। বেশ ভালো করে গোটা শহরটাকে জুড়ে রেখেছে।
প্ল্যাটফরম থেকে তারপর এস্কালেটর চেপে ওপরে উঠতেই দেখি সুজাতা দাঁড়িয়ে রয়েছে। চার বছর পর আরেক প্রিয় বান্ধবীর সাথে অবশেষে দেখা। দুজনেরই মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত ক্লান্তি উধাও। গলা জড়াজড়ি করলাম। এইবারে যেন মনে হল, যাক। পৌঁছেছি ঠিক। ওর সাথে দেখা হয়ে গিয়েছে। আমার বাবা মা, মধুরিমা সকলেই এইবারে একদম নিশ্চিন্ত। আর কোথাও একা ট্র্যাভেল করার নেই, তাই নাকি চিন্তাও নেই তাদের কারুর। সব দায়িত্ব এবার সুজাতার।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে আমরা অ্যাপ ক্যাব ডাকলাম। ওখানে চলে লিফট আর উবার। লিফট আমি ইনস্টল করেই রেখেছিলাম। শেয়ার ক্যাব এসে পৌঁছনর আগে সেলফি তোলা হল। রাস্তাঘাটের ছবিও। কী ঝকঝকে নীল আকাশ। রোদ ঝলমল। বেশ সুন্দর।
গাড়ি এলো। বিরাট এস ইউ ভি। অ্যামেরিকায় বোধহয় ছোট গাড়ি কেউই ব্যবহার করেননা! উঠে পড়লাম লাগেজ নিয়ে। ডেসটিনেশন, আমাদের এয়ারবিএনবি। ট্রিমন্ট স্ট্রিটে। মিনিট পনেরোর মধ্যেই চোখে পড়ল একটা বড় চার্চ। সুজাতা রাস্তা চিনতে পেরেছে ততক্ষণে। বলল যে আমরা কাছাকাছি এসে গিয়েছি কারণ ও চার্চের ঘণ্টার শব্দ শুনতে পাচ্ছিল সকাল থেকে। রবিবার। আর একটু এগোতেই আমাদের গন্তব্য এসে গেল। নামলাম। ঠিক যেমন পড়ে এসেছিলাম, বাড়িটার নিচে একটা সাবওয়ের দোকান। পুরনো দিনের বাড়ি। কাঠের ভারি দরজা ঠেলে ঢুকলাম। ভিতরটা খুব অল্প আলো। একদম 'যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে'র বাড়ি গলিগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। একটা স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠলাম দোতলায়।
No comments:
Post a Comment