Tuesday, August 7, 2018
জয়ী
"জানিস, মুক্তাদি আর নেই। আজ সকালেই খবরটা পেলাম।" পল্লবীর পাঠানো এই ওয়াটসঅ্যাপ মেসেজে ওদের স্কুল গ্রুপের সকলের মধ্যেই একটা বেশ সারা পড়ে গেল। ওরা অর্থাৎ বছর তিরিশের জনা পঁচিশ, একদা সুধাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। প্রত্যেকেই এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। কেউ করছে বড় চাকরি, কেউ বা চালাচ্ছে নিজের বুটিক। কেউ বা স্কুল কলেজের টিচার তো কেউ সরকারি আমলা। গ্রুপের মধ্যে সর্বক্ষণই চলতে থাকে আলাপ আলোচনা। বিষয় বিবিধ। ঝাঁ চকচকে শপিং মলে মার্কেটিং, বিদেশ ভ্রমণ, ছেলে মেয়েদের নামী দামী স্কুল ও ট্যুশন টিচার, নতুন খোলা রেস্টুরেন্ট, শাশুড়ির চিকিৎসা, নন্দাইয়ের এক্সট্রা ম্যারিটাল, অফিস পলিটিক্স, ইত্যাদি ইত্যাদি। ওদের এই গ্রুপের মধ্যে এক্কেবারে বেমানান প্রেয়সী। প্রেয়সী মফস্বলের একটি আধা সরকারি স্কুলের অঙ্কের দিদিমণি। স্কুলের কাছেই ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে একা। স্বামী সংসারের ঝুটঝামেলায় জড়ায়নি। সকাল থেকে স্কুলের বাচ্চাগুলোর পিছনে দৌড়য় চক পেন্সিল হাতে। কঠিন অঙ্ককে ভালবাসতে শেখানোই যেন ওর জীবনের মূল উদ্দেশ্য। একদিন এ বি টি এর মিটিঙে দেখা কাকলির সাথে। কাকলি ওরই ক্লাসমেট ছিল সুধাময়ীতে। বর্তমানে কলকাতার এক স্কুলের হেড মিস্ট্রেস। আর কী, ফোন নম্বর চেয়ে ওকে যোগ করে দিয়েছিল গ্রুপে।
প্রেয়সী গ্রুপে নামেই আছে। সব খবর পড়ে। কিন্তু কোনদিনও কোন কথার উত্তর দেয়না। শুরুর দিকে বাকিরা ওকে সাধলে ওই হ্যাঁ না দিয়ে কাটিয়ে দিত। কোনদিনও কোন গেটটুগেদারেও যায়নি বাকিদের সাথে। গ্রুপে আসা সেই মিটের ছবিতে মন্তব্যও করেনি। মুক্তাদি ওর খুব প্রিয় দিদিমণিদের একজন ছিলেন। ওঁর চলে যাওয়ার খবরটা পেয়ে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারল না। পল্লবীকে জিজ্ঞেস করলো, "আচ্ছা সুমি, মানে দিদির মেয়েটার কী খবর? ওর এবার কী হবে? কে দেখছে ওকে?"
সুমির বয়স ওই কুড়ির কাছাকাছি। ওরা যখন ক্লাস সিক্স, সুমি জন্মায়। কিছু বছরের মধ্যেই ডাউন সিন্ড্রোম ধরা পড়ে ওর। দায়িত্ব নিতে না চেয়ে মুক্তাদির স্বামী ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করে। বাড়ির অমতে বিয়েটা ছিল বলে বাপের বাড়ির দিক থেকেও কোনরকম সম্পর্ক বা সাহায্য ছিলনা। স্কুলের চাকরি ও কিছু ট্যুশানি সম্বল করেই দিদির দিন কাটত। প্রেয়সীদের ব্যাচের অনেকেই দিদির কাছে ট্যুশন পড়তে যেত। আর তখনই সুমির সাথে ওদের আলাপ। ওইটুকু মেয়ে, কী প্রাণশক্তিতে ভর্তি। মুক্তাদি মাঝে মাঝেই পড়াতে পড়াতে আক্ষেপ করতেন। ওঁর অবর্তমানে সুমিকে কে দেখবে, কী হবে ওর। প্রেয়সীরা তখন ছোট। কীই বা বলবে। কলেজে পড়াকালীন বার দুই তিনেক ও মুক্তাদির সাথে দেখা করেছে। তারপর এই চাকরিটা পেয়ে চলে আসায় যাতায়াত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রথম কয়েক বছর ফোনে যোগাযোগ থাকলেও শেষে আর কোনরকম খবরই নেওয়া হয়নি।
বড্ড অপরাধ বোধ কাজ করছে ওর আজ। বারবার দিদির মুখটা আর সুমির ওই নির্মল হাসিখানি মনে পড়ছে। ক্লাস নিতে নিতে মাঝে মাঝেই চোখ চলে যাচ্ছিল ফোনে। পল্লবী কোন মেসেজ করলো? না। কেউই কিছুই লেখেনি। রাত্রের দিকে কাকলি আর অদিতির মেসেজ এলো। সাধারণ হু হ্যাঁ। আক্ষেপ। কিছু পুরনো স্মৃতি। ব্যস। শম্পা একবার জিজ্ঞেস করলো ওরা কেউ যাবে কি না দিদির বাড়ি। কারুরই আর সময় বের হল না ব্যস্ত জীবনে। ওয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ কদিন একটু শান্ত থেকে ফিরল আবার চেনা ছন্দে। সামনে পুজো। কোন দোকানে কত ছাড়, কোথায় কী ডিজাইন। প্লেনের টিকিট। হোটেল বুকিং। রাঁধুনির বোনাস। বৃষ্টি জল কাদা। ফ্রেন্ডশিপ ডেতে গ্রুপ ভর্তি শুধুই জিফ আর ফরওয়ার্ড। বন্ধুত্ব নিয়ে কয়েক কলি। পুরনো স্কুলের দিনগুলোর গল্প।
কাকলি আর পল্লবী কাছাকাছি থাকে। ওরা এক রবিবার সন্ধ্যেয় প্ল্যান করে দেখা করলো সাউথ সিটি মলে। উদ্দেশ্য সিনেমা দেখে ডিনার সারবে। ফুড কোর্টে বসে খাবারের অপেক্ষার মধ্যে চলছে পি এন পি সি। "প্রেয়সীটা সেই একই রয়ে গেল দেখ। উড়নচণ্ডীর মতো থাকে। কোন শ্রী নেই চেহারায়।"
"থাকবেই বা কী করে। দেখছিস না কেমন ধ্যারধেরে গোবিন্দপুরে পড়ে আছে।"
"সত্যি। কোন অ্যাম্বিশন নেই। কোথায় ম্যুচুয়াল নিয়ে শহরে ফিরবি, তা না।"
"হ্যাঁ। আমি তো সেদিন মিটিঙে বললাম। ইউনিয়নকে ধর, ঠিক পেয়ে যাবি। ও মা, আমার কথাতে পাত্তাই দিলো না কোন।"
"ও বরাবরই ওরকম। নিজেকে সব সময় আমাদের থেকে আলাদা প্রমাণ করার ইচ্ছে। দেখলি না। মানস যখন ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিল, শুধুমাত্র চাকরির দোহাই দিয়ে নাকচ করে দিল। আরে বাবা মানসের মত অমন ব্রাইট ছেলে। লন্ডন যাচ্ছে হায়ার স্টাডিজে। তুই কোথায় সঙ্গে যাবি, তা না। নিজের এই আধা সরকারি চাকরি আঁকড়ে পড়ে থাকলি। কী মোক্ষ লাভ হল? এত বছরের সম্পর্কের কোন মূল্য নেই?"
"যা বলেছিস। এই দাঁড়া দেখি, এবার কে মেসেজ করলো। ও মা, পল্লবী দেখ দেখ। শিগগির দেখ। প্রেয়সী মেসেজ পাঠিয়েছে। দেখি কী ছবি। ডাউনলোড করি।"
কাকলির ফোনের নেট স্লো হলেও পল্লবীর ইতিমধ্যে অটো ডাউনলোড হয়ে গিয়েছে। বড় স্ক্রিন খুলে কাকলিকে দেখাল ও ছবি। হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে প্রেয়সী। পাশে বছর কুড়ি পঁচিশের একটি মেয়ে। নীচে লেখা "এই দেখ। আজ মুক্তাদির বাড়ি গিয়েছিলাম। সুমিকে ওর প্রতিবেশীরা কোনমতে দেখছিল এই কদিন, কিন্তু লঙ টার্মে দায়িত্ব নিতে অক্ষম। আমি তাই ওকে নিয়ে এলাম আমার কাছে। এবার থেকে ওর সব দায়িত্ব আমার। তোরা সকলে মিলে কখনো পারলে আসিস। ও জানিস তো আমাদের সকলকে মনে রেখেছে। আমার কাছে তোদের সবার খবর নিচ্ছিল। আজ আমার খুব মনটা হাল্কা লাগছে রে। তাই তোদের মেসেজটা পাঠালাম।"
প্রেয়সীকে যেন আজ ওদের সকলের চেয়ে বেশি সুন্দর লাগছে। মুখে একটা পরম পরিতৃপ্তির হাসি। আর সুমি? ওর খুশি যেন ধরেনা। গ্রুপের চরিত্র অনুযায়ীই গ্রুপ ভরে গেল পরপর সকলের মেসেজে, সব্বাই প্রেয়সীকে সাধুবাদ জানাচ্ছে এমন একটা দুর্দান্ত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। কাকলিই বা বাদ যায় কী করে। পটাপট টাইপ করলো, "তুইই সেরা প্রেয়সী।" ইতিমধ্যে পল্লবীরও মেসেজ ঢুকেছে। "তুই আমাদের গর্ব।"
ব্যস। কাজ শেষ। আবার চিকেনের পিসে মনোনিবেশ করাই যায়। আলোচ্য টপিকের অভাব তো নেই।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment