Monday, August 27, 2018

প্রাত্যহিকী

গত সাতদিন এক নাগাড়ে বৃষ্টির পর আজ সকাল থেকে ঝকঝকে নীল শরতের আকাশ।  পারুল খুব খুশি, জামাকাপড়গুলো ছাদে মেলতে পারবে। সোমনাথ সরকার অবশ্য এইসব দেখেন না, কী বৃষ্টি, কী রোদ, তেমনভাবে কিছুই যায় আসেনা। রিটায়ার করেছেন দশ বছর হতে চলল। গত দশ বছর ধরে প্রতিদিন সকাল ছটায় বিছানা ছেড়ে  বেডরুম লাগোয়া এই ছোট্ট ব্যাল্কনিতে ইজিচেয়ার পেতে বসেন, সাথে থাকে কোন না কোন বই, নিজের বিরাট সংগ্রহ থেকে। পাশে টেবিলে রয়েছে একটি আদ্যিকালের পুরনো কালো রেডিওসেট। ১০৭ ও ১০০.২ মেগাহার্টজ, এর মধ্যেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চলে সংবাদ আর গান। পারুল সময়ে সময়ে এসে চায়ের জোগান দিয়ে যায়। এগারোটার দিকে সোমনাথ স্নানের জন্য ওঠেন। তারপর চটজলদি দুপুরের খাবার খেয়ে আবার ব্যাল্কনিতে ফেরত।। বই পড়তে পড়তে মাঝেসাঝে ঝিমিয়েও নেন। সন্ধ্যের মুখে সামনের পার্কে বাচ্চাগুলো হই হুল্লোড় হুটোপাটি করে, ভারি আমোদ পান ওদের দেখতে, নাতির কথা মনে হয় তখন। স্ত্রী সরলাদেবী গত হয়েছেন দুই বছর হল। পারুল ঘরের কাজ আর টিভি সিরিয়াল নিয়ে থাকে। সোমনাথ একলা মানুষ। সারাদিন তাই এইভাবেই নিজের মতোই সময় কাটিয়ে দেন।

ছেলে সম্বুদ্ধ চাকরিসূত্রে দশ বছর ধরে লন্ডনে থাকে, স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে। পারুলের থেকে নিয়মিত সোমনাথের খোঁজ খবর নেয়। ইদানীং সোমনাথের বয়সের কারণে মাঝে মাঝেই খুচখাচ অসুস্থতা তাদের চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। তাই তড়িঘড়ি সম্বুদ্ধ এসে এবার ওর সাথে সোমনাথকে বিলেত নিয়ে গেল। অন্তত কিছু মাস যাতে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে। একমাত্র ছেলে, দায়িত্ব বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। পারুল খুব কাঁদছিল সোমনাথ চলে যাচ্ছেন বলে। ওর সাথে নিয়মিত ভিডিও কলে যোগাযোগ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সোমনাথ সাথে কিছু খুব শখের বইপত্তর নিয়ে রওনা দিলেন অধীর আগ্রহে। নাতিবাবুর সাথে দেখা হবে অবশেষে। এইবার থেকে ওর সাথেই খেলে গল্প শুনিয়ে দিব্যি সময় কেটে যাবে।

তিন মাস হল সোমনাথ লন্ডনে এসেছেন। ছেলে বৌমা খুব যত্ন করে। আলাদা ঘর, তার লাগোয়া ছোট্ট ব্যাল্কনি। ব্যাল্কনিতে পাতা আরামকেদারা। পাশে কফি টেবিল। টেবিলের ওপর রাখা হালফিলের রেডিও সেট, বিলেতের স্টেশন থেকে সেখানে বাংলায় গান চলে সারাদিন। সোমনাথ এখনও সেই সকাল ছটায় ওঠেন। সারাদিন বই পড়ে কাটান। তবে এ বই কাগজের না, এ ট্যাবে। বৌমা অফিস যাওয়ার আগে খাবার গুছিয়ে রেখে যায়, সারাদিন ছেলে বৌমা অফিস আর নাতি প্লে স্কুল আর ক্রেশেই কাটিয়ে দেয়। বিকেল হলে সামনের পার্কের বাচ্চাগুলো খেলে। মাঝে মাঝে বেলার দিকে পারুলকে ভিডিও কল করে খোঁজখবর নেন। দিব্যি সোমনাথের সময় এখানেও কেটে যায়।


শুধু মাঝে মাঝে মনে হয়, সত্যি, কীই বা কলকাতা, কীই বা লন্ডন। একাকীত্বর বুঝি দেশ কাল সীমানা হয়না।

No comments:

Post a Comment