কুইনসি মার্কেট নাকি বস্টনের অন্যতম দেখার জায়গা। চেন্নাই থেকেই জেনে গিয়েছিলাম। শপিং করা যাবে। লিফট থেকে নামলাম যখন, সুজাতার মেসেজ এলো যে ও পৌঁছে গিয়েছে। এবং অবধারিতভাবে দুজনে দুই জায়গায়। ওর ফোনের চার্জ প্রায় শেষ। তাই আমিই গুগল ম্যাপ খুলে পৌঁছলাম ওর কাছে। দাঁড়িয়ে ছিল হার্ড রক ক্যাফের সামনে। প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। সন্ধ্যে হবো হবো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমরা ঢুকলাম কুইনসি মার্কেটে। আসলে কিছুই না, একটা বড় মার্কেট কমপ্লেক্স গোছের। কোথায় গিয়ে যেনও আমাদের হগ মার্কেটকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল। চারিদিকে দেয়ালে গাছে টুনি বাল্ব দিয়ে সাজানো। মনে হবে যেন ক্রিসমাস এসে গিয়েছে আগে আগে। তবে দোকান পাট দেখে হতাশ হলাম। খুব বেশি দাম। সাধ্যের বাইরে। বাইরে কিছু ঠ্যালাগাড়ি মতো দোকান ছিল। সেখান থেকে খুচখাচ যেটা না কিনলেই না, এমন স্যুভেনির কিনলাম। ওই ফ্রিজ ম্যাগনেট, চাবির রিং।
আমার তো ওই ফিশ ট্যাকো খেয়ে তখনও বেশ পেট ভর্তি। শুধু বড্ড জল টান হয়েছিল। তাই আইস কোল্ড ফ্যানটা কিনে ঢকঢক করে ৬০০এম এলের এক বোতল পুরোটা একসাথে খেলাম। আমার এক জেঠু বলে দিয়েছিল বস্টনে ক্ল্যাম চাউডার নাকি খুব বিখ্যাত। অবশ্যই যেন খাই। কুইনসি থেকে বেরিয়ে এলাম ফেনুইল হল চত্ত্বরে। তার উল্টোদিকেই বিল্ডিং একটা। সেখানে সারি সারি খাবারের দোকান। অনেক দোকানেই বস্টন চাউডার বিক্রি হচ্ছে। আমরা দেখে শুনে একটায় গেলাম। বেশ ভিড় ছিল। আমি শুধু টেস্ট করব, তাই সুজাতা একটাই নিলো। চাউডার মনে ওই থকথকে স্যুপ গোছের। আর ক্ল্যাম এক ধরণের সামুদ্রিক প্রাণী। চিংড়ি জাতীয়। গোটা বস্তুটা মন্দ লাগেনি। হয়তো খিদে থাকলে আরো ভালো লাগতো। ফেনুইল হল হলো বস্টন ফ্রিডম ট্রেলের অন্যতম পয়েন্ট। আমেরিকার সিভিল যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত। মহৎ জায়গা। ফ্রিডম ট্রেল আড়াই কিলোমিটার মতো হাঁটা পথ। জায়গায় জায়গায় সেখানে সিভিল ওয়ারের চিহ্ন। আমরা কেউই ইতিহাস নিয়ে অত উৎসাহী নয়। আর হাতে সময়ও কম। তাই ফ্রিডম ট্রেল বাদ। তবুও কপাল জোরে এই চত্বরটা দেখা হলো। সামনেই একটা এট্রিয়াম মত। দুইজন ছেলে গিটার বাজিয়ে লাইভ শো করছিল। খেতে খেতে শুনতে মন্দ লাগছিলো না। অনেকেই ওদের রাখা বাক্সে সাধ্যমতো ডলার বিল রাখছিল। শিল্পের কদর করি কিন্তু পকেটের টান। তাই ইচ্ছে থাকলেও এক ডলারের চেয়ে বেশি রাখতে পারিনি। খাওয়ার পাট মিটিয়ে আবার গাড়ি ডেকে বাড়ি ফেরা।
পরেরদিন আমাদের বস্টন ছাড়ার কথা। এয়ার বিএনবির চেকাউট টাইম দুপুর বারোটা। এদিকে আমাদের সন্ধ্যেবেলা বাস সাড়ে সাতটায়। এতক্ষন কী করব? আলেকজান্দ্রিয়াকে ফোন করে আমরা বললাম আমাদের অবস্থা। ও বললো কোনো অসুবিধে নেই। লিভিং রুমে লাগেজ রেখে বেরিয়ে যেও। বিকেলে নিয়ে নিও। আমরাও খুব খুশি হয়ে গেলাম। সেই আনন্দে ঝটপট ব্রেকফাস্ট আমিই বানালাম সেদিন। একই মেনু। সাথে আপেল। ইতিমধ্যে আমি মার্কিনি কায়দার গ্যাস ওভেন ব্যবহার শিখে মজা পেয়ে গিয়েছি। বাড়িতে ফোন করে ভিডিও চ্যাট করতে করতে রান্না করা আর তারপরে ওয়াটসএপ কলের মাধ্যমেই রেডিও মির্চি কলকাতা শোনা। চেন্নাইতে থাকতে মিরের কণ্ঠে ঘুম কাটাতাম। ওখানে টাইম জোনের দৌলতে অগ্নির হৈচৈ ক্যাফে শুনতে শুনতে একই কাজ হয়ে যেত। সত্যি, প্রযুক্তি আমাদের কোথায় নিয়ে গিয়েছে, না?
সুজাতার ইচ্ছে ছিল বেশ কয়েকটা টক শুনবে। আমার মতলব ছিল ঝিমনোর। তবে লাঞ্চ সেশন অবধি টক শুনে ও হল ও হাল দুইই ছেড়ে দিলো। টার্কি স্যান্ডউইচ দিয়ে লাঞ্চ সেরে আমরা ম্যারিওটের লবিতে বসে ভাবতে লাগলাম, কোথায় যাওয়া যায়। বস্টনের ডাক ট্যুরস বিখ্যাত। বিশ্বযুদ্ধের সময়ের কিছু গাড়িকে রং চং করে সাজিয়ে গুছিয়ে ট্যুরিস্টদের ঘোরানো হয়। বস্টনের মূল কিছু দর্শনীয় স্থান দেখায়। আর তারপর সেই একই গাড়ি জলে নেমে যায় স্কাইলাইন দেখাতে। ওই জন্যই নাম ডাক ট্যুরস। হাঁসের মতো জলে ও স্থলে উভয়েই চলে বলে। আমাদের শখ হয়েছিল। কিন্তু অস্বাভাবিক দাম। দেড় ঘন্টা ঘোরাবে, তাতে মাথাপিছু পঁয়তাল্লিশ ডলার। এছাড়া আবার টিপস থাকবে। লবিতে বিভিন্ন ট্র্যাভেল এজেন্সির হপ অন হপ অফ ট্যুরের ব্রোশ্যার দেখলাম। কিছুই ট্যাঁক ফ্রেন্ডলি হচ্ছিল না। আসলে শহরটার দেখার জায়গা খুব বেশি নেই। তাই ওই অত দাম ঠিক জাস্টিফাই করতে মন চাইছিল না। কী করা যায় ভাবতে গিয়ে ঠিক করলাম বেশ একবার না হয় চার্লস নদীর ধারে যাই। তারপর ভাবা যাবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ক্যাব বুক করে রওনা দিলাম আমরা লঙ ওয়ারফ ওয়াটারফ্রন্টে। পথে অন্য যাত্রীকে নামবে বলে আমরা চায়না টাউন দেখে ফেললাম। বস্টনের বুকে এক টুকরো চায়না। দোকান বাজার ব্যাংক অফিস। সর্বত্র চাইনিজ ভাষায় লেখা। প্রচুর চাইনিজ লোকজন। দেখার মতোই জায়গা। স্রেফ কপাল করে আমরা দেখে ফেললাম, প্ল্যানে না থাকলেও। পায়ে হেঁটে ঘুরলে এর চেয়ে বেশি কিছু হতো বলে মনে হয় না।
ওয়াটারফ্রন্ট পৌঁছে দেখি এলাহী কান্ডকারখানা। একটা বিরাট ইয়াচ দাঁড়িয়ে। ওয়েল ওয়াচিং করায়। এক পিঠ আটাত্তর ডলার। আঁতকে উঠলাম। সর্বনাশ। পঁয়তাল্লিশএর ধাক্কা এড়াতে এসে আটাত্তর। নাহ, এও গেল। তাহলে? সামনেই ছিল নিউ ইংল্যান্ড অ্যাকওয়ারিয়াম। বেশ পকেট ফ্রেন্ডলি। তিরিশ ডলারের মধ্যেই হয়ে যাচ্ছে। সময়ের অভাবে আমরা থ্রি ডি মুভি শো মিস করলাম। ঢোকার আগে আবার বাইরে দাঁড়ানো স্টল থেকে আরেক প্রস্ত স্যুভেনির শপিং করলাম দুজনেই। এক ভারতীয় গ্রুপের সাথে দেখা হলো। দুই প্রবীণ দম্পতি। ছেলে মেয়েরা এখানে থাকে। ঘুরতে এসেছেন এখানে। মূলত ওদের উৎসাহে অ্যাকওয়ারিয়ামের টিকিট কেটেছিলাম। খানিকক্ষণ বাইরেটা দেখলাম। কত লোক। সব নদীর ধারে ছোট ছোট ক্যাফেতে বসে খাচ্ছে আর প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করছে। অনেকে ক্রুজের অপেক্ষায়। এক দল লোক ফিরলো ক্রুজ থেকে। মুখে হাসি। হয়তো দারুন কিছু দেখেছে।
অ্যাকওয়ারিয়ামের ভিতরে ঢুকে প্রথমেই গেলাম সি লায়ন দেখতে। ফার সিল ও সি লায়ন দুইই একই এনক্লোজারে রাখা। অতীব মিষ্টি প্রাণীগুলো। দিব্যি জলের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ পাথরে শুয়ে আলসেমি করছে। তারপর গেলাম মূল অ্যাকওয়ারিয়ামে। সেখানে শুরুতেই রয়েছে আফ্রিকান পেঙ্গুইনের দল। বেঁটে খাটো সাদা কালো এই প্রাণীগুলো গুটিগুটি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। জলে লাফাচ্ছে। খাচ্ছে। দেখতে ভারি মজা লাগলো। খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের দেখলাম। ছবিও তুললাম। তারপর এগোলাম অন্য দিকে। গোটা জায়গাটা একটু আলো আঁধারী মতো। নীল হালকা একটা আলোর মৃদু আভা। অনেকটা কোনো থিমের পুজোর প্যান্ডেল যেন। একটা ওয়েলের বিরাট কঙ্কাল সাজিয়ে রাখা। এরপর ramp বরাবর পরপর বিভিন্ন ইকো সিস্টেমের মিনিয়চার। বহু বহু প্রজাতির মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক স্পিসিজ। যেমন কোরাল স্টারফিশ জেলিফিশ ইল কচ্ছপ ইত্যাদি। একটা জায়গায় সাপ (আমি দেখেই পালিয়েছি)। প্রত্যেকটা এনক্লোজারে বাইরে সেই প্রাণী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া। চারতলা সমান জলের ট্যাঙ্কে ডুবুরিরা নেমে মাছেদের ও অন্যান্য পশুদের খাবার দিচ্ছে, দেখলাম। অন্ধকারের জন্য ভালো ছবি না উঠলেও চাক্ষুস দেখার অভিজ্ঞতা বেশ বেশ ভালো। মনে হলো স্কাইলাইন বা ওয়েল ক্রুজ না করে খুব ভুল করিনি। এটা মোটামুটি পয়সা উসুল। সব দেখে টেখে বেরোতে বেরোতে প্রায় চারটে। গত দুদিন সূর্যের আলো দেখে সময় বুঝতে গিয়ে খুব ঠকান ঠকেছি। আজ তাই কব্জি ঘুরিয়ে সময় দেখা। সন্ধ্যের বাস। মিস করলে মুশকিল। বস্টনের ঘোরাঘুরিকে আপাতত বিদায় জানিয়ে এরপর ফিরলাম বাড়ি। ফ্রিজ থেকে আমাদের ফলমূল ও চীজকেক বের করলাম। প্যাক করে নিতে হবে। ফোনেও চার্জ চাই। আর ঘন্টাখানেক সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে রেস্ট।
ছটা নাগাদ মালপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গ্রে হাউন্ড বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। পরের গন্তব্য নায়াগ্রা।
No comments:
Post a Comment