পৌঁছে গিয়েছি একদম শেষ পর্যায়ে। রবিবার। ১৫ই জুলাই।কাকার বাড়ি যাওয়ার প্ল্যানটা দুর্ভাগ্যবশত মেটিরিয়ালাইজ করলো না। অগত্যা আজ সুজাতা আর আমি আরো একটু ঘুরে নেবো। এই ঠিক হল। বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখে (পিসি কিংবা সুজাতা দুজনের কেউই মিস করতে চায়নি একদম। আমি একটু নিউট্রাল মানুষ। হ্যাঁ, দেখলে দেখবো, না হলে না। কোন ব্যাপার না।) লাঞ্চ সেরে দেড়টা নাগাদ বেরোলাম। নির্দিষ্ট স্টপে পৌঁছতে গেলে হয়তো বাসটা মিস করব। রবিবার। এমনিতেই বাস কম চলে। বুচু পিসির ল্যাপটপে শিডিউল খুলে রাখা। ঘড়ির কাঁটা এগোচ্ছে, সেই মতো আমাদের ডেসটিনেশন পালটাচ্ছে। ফাইনালি ঠিক হল আমরা এক স্টপেজ এগিয়ে যাবো। কপাল ভালো, বাস পেয়ে গেলাম। একদম পোর্ট অথরিটি টারমিনাসে গিয়ে নামলাম। বুচু পিসি সমস্ত শিখিয়ে পড়িয়েই দিয়েছিল। আমরা ওখান থেকে মেট্রো ধরলাম। ই লাইনের, WTC যায়, সেইটা। এই প্রসঙ্গে বলি, গোটা ট্রিপে প্রথম ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাই করলাম, সাথে অ্যামেরিকার ট্রেন (অ্যামট্র্যাক) চড়লাম, গ্রেহাউন্ডে লঙ ডিস্টেন্স গেলাম, রুটের বাসে চাপলাম এবং এই এখন আবার মেট্রোর অভিজ্ঞতাও হল। মেট্রো আমাদের কলকাতার এসই মেট্রোর মতোই। শুধু আরো একটু কম ভিড়। এই যা।
WTC স্টপে নেমে অল্প হেঁটে আমরা পৌঁছলাম ব্যাটারি পার্ক। পথে আবার গতকালের ওই সিটি ট্যুরসের হপ অন হপ অফের এক এজেন্ট আমাদের ধরল। মুর্গিও বানালো বলা যায়। খুব বেশি না বুঝে আমরা একটা ক্রুজের টিকিট কাটলাম। স্ট্যাচু অফ লিবার্টির যে ইতিহাস বা পাশেই এলিস আইল্যান্ডের ইতিহাস, অল্প জানলেও সেরকমভাবে কেন জানিনা টানেনি। আর দুটো জায়গাতেই তখন সাঙ্ঘাতিক রকমের ভিড়। কম করে দুঘণ্টা লাইনে থাকতে হবে। সেই জন্যই আমরা লিবার্টি ভিতরে বা এলিসে যাওয়ার ট্যুর না নিয়ে হাডসন রিভার ক্রুজটা নিলাম। অল্প করে ব্যাকগ্রাউন্ড দিয়ে রাখি এই দুই জায়গার। এলিস আইল্যান্ড হল সেইটি যেখানে প্রথম ইমিগ্রেন্টরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিল। সেই আমলের সমস্ত ইমিগ্রেন্টদের নাম নথিভুক্ত তো আছেই, তা ছাড়া ম্যুজিয়ামে তাদের ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্রও রাখা।
স্ট্যাচ্যু অফ লিবার্টি অবস্থিত লিবার্টি আইল্যান্ডে। তামার তৈরি এই বিশাল স্ট্যাচু প্রায় সকলেই আমরা ছবিতে দেখেছি। অ্যামেরিকান ইন্ডিপেন্ডেন্স উপলক্ষ্যে এটি নির্মাণ করা হয়। লিবারটাস, রোমের স্বাধীনতার দেবী, তার আদলে তৈরি এই তামার মূর্তিটি পৃথিবীর অন্যতম আইকন। বর্তমানে এর ভিতরে ম্যুজিয়ামে তো যাওয়া যায়ই, এ ছারাও ক্রাউন পর্যন্ত ওঠা যায়। তবে সেখানে যাওয়ার জন্য প্রায় মাস দুই আগে থেকে টিকিট কাটতে হয়।
আমাদের ক্রুজে প্রথমেই ম্যানহ্যাটান স্কাইলাইনটি দেখানো হল। সত্যি বলতে কী, কম্প্যুটারের মাদারবোর্ডের একটু ম্যাগ্নিফাইড ভারসান বলেই আমার মনে হয়। পটাপট ক্যামেরা বের করে ছবি তোলা শুরু করে দিলাম। একবার কিট লেন্স তো পরমুহুরতেই জুম লেন্স। দূরে দেখতে পাচ্ছি ব্রুকলিন ব্রিজ। স্ট্যাচু অফ লিবার্টি। ক্রুজ চলতে লাগল আস্তে আস্তে। মাথার ওপর দিয়ে মাঝে মাঝেই হেলিকপ্টার যাচ্ছে। অ্যামেরিকায় ভীষণ বেশি দেখলাম এটা।
একদিকে ন্যু ইয়র্কের ম্যানহ্যাটান স্কাইলাইন, অন্যদিকে ন্যু জার্সির স্কাইলাইন। দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছলাম লিবার্টি আইল্যান্ড। পিলপিল করছে লোক। দূর থেকেই ওই বিশাল সবুজ মূর্তিটিকে দেখলাম। সত্যিই বড়, কিন্তু কে জানে, মনে হয়েছিল বুঝি আরো বড় হবে। প্রচণ্ড চড়া রোদ। পরিষ্কার নীল আকাশ। তার ব্যাকড্রপে আইকনিক স্ট্যাচ্যু অফ লিবার্টি। ভুল করে হলেও লেবুতলা নাকি কলেজ স্কোয়েরের কোন এক বছরের প্যান্ডেলের কথা অবশ্য মনে পড়েছিল। স্ট্যাচু অফ লইবারটির সামনে দিয়ে খানিক ঘোরাঘুরি করলো আমাদের ক্রুজটা। পাশেই দেখলাম এলিস আইল্যান্ড। রবিবার দুপুর। তায় সুন্দর ওয়েদার (যদিও গতকাল রাত থেকে দুপুর অবধি ভালোই বৃষ্টি পড়েছে), ট্যুরিস্টে ঠাসা। ক্রুজ চলতে লাগল হাডসন নদীর ওপর দিয়ে। ব্রুকলিন ব্রিজের সামনে দিয়ে ঘুরিয়ে আনল। ওই ব্রিজে পায়ে হাঁটতে পারলে ভালো হত। বহু হলিউড সিনেমায় দেখা। যাই হোক। একটা সময় ক্রুজ শেষ হল। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ছিল। উপভোগ করলাম। সুন্দর সুন্দর ছবি তুললাম অনেক।
এরপরের গন্তব্য সেন্ট্রাল পার্ক। ন্যু ইয়র্কের বুকে অক্সিজেনের ভাণ্ডার। শেয়ার ক্যাব নিয়ে পৌঁছলাম সেন্ট্রাল পার্ক ওয়েস্ট এন্ড। বিরাট জায়গা জুড়ে এই পার্ক। বাইরে সাইকেল রিকশা রয়েছে অনেক। মিনিটে তিন থেক চার (কখনো পাঁচও) ডলার জনপ্রতি তার ভাড়া। আমরা ততক্ষণে বাইরে বেঞ্চে বসে ফুড ট্রাক থেকে কাবার আর ব্রেড খাচ্ছি। স্বাদ তেমন আহামরি লাগেনি। বেশ লোকজন হচ্ছে কিন্তু রিকশায়। আবার কিছু সাজানো গোছানো ঘোড়ার গাড়িও দেখলাম। খাওয়ার পাট চুকিয়ে আমরা হাঁটা শুরু করলাম। ম্যাপে রিজার্ভয়ের দিয়ে ডিরেকশন দেখে হাঁটতে লাগলাম। শুধুই সবুজ আর সবুজ। লোকে হাঁটছে, দৌড়চ্ছে, জগিং করছে। সাইকেল চালাচ্ছে। সাইকেলের আলাদা পথ। বেশিরভাগ জায়গাতেই চার চাকা নট আলাউড। পথে পড়ল একটা সুন্দর লেক। বোটিং করছে লোকে। লেকের ওই পারে একটা মনোরম ব্রিজ। লোকজন সেখানে পোজ দিয়ে ছবি তুলছে। লেকে হাঁস ভাসছে, মাছ আসছে। চারিদিকের শোভা বড়ই সুন্দর। চোখের আরাম।
সেন্ট্রাল পার্ক বিশাল বড়। পায়ে হেঁটে পুরোটা একদিনে ঘোরা অসম্ভব। তার উপর গত কয়েকদিন ঘুরে ঘুরে আমরা এখন প্রায় দুজনেই ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। তাও টুকটুক করে হেঁটে চললাম। পৌঁছলাম রিজার্ভয়েরে। তেমন কিছুই না। বিশাল জলাশয়। পাশ দিয়ে ম্যানহ্যাটানের উঁচু উঁচু বাড়ি দেখা যাচ্ছে। পার্কের ফাঁক দিয়ে দিয়েও মাঝে মাঝে সবুজের আড়াল ভেঙ্গে গ্রে ও খয়েরি। সেন্ট্রাল পার্কের বিখ্যাত জগিং ট্র্যাকের পাশ দিয়ে আমরা (ভুলবশত উল্টোদিক দিয়ে) হাঁটা লাগালাম। এই জগিং ট্র্যাকও অনেক হলিউড সিনেমায় দেখেছি। মেইড ইন ম্যানহ্যাটান সিনেমার কথা খুব মনে পড়ছিল বারবার এখানে এসে। আমাদের পার্কের সাউথ ইস্ট সাইডে বেরোতে হবে। বুচু পিসির ওইখানে অপেক্ষা করার কথা। ম্যাপ দেখে লাইভ লোকেশন পাঠিয়ে এদিক সেদিক করতে করতে অবশেষে বেরোলাম পার্ক থেকে। বুচু পিসি ও তার কলিগের সাথে দেখা হল। একসাথে ডিনার করব আমরা। বাইরে তখনও আলো ঝলমল। এদিকে ঘড়িতে আটটা। আমার জল তেষ্টা পেয়ে একাকার অবস্থা। তাই যেখানে হোক চল, আমার কোন চয়েস নেই জানিয়ে ওরা যেখানে নিয়ে যেতে চায়, রাজি হলাম। ভিয়েতনাম বলে একটি ভিয়েতনামী রেস্টুরেন্টে ডিনার সারলাম। শাক সবজি দিয়ে নূডল, ভাত, মাছের কারি। বেশ লাগল। খেতে খেতে প্রচুর গল্প হল। পেতে খাবার আর জল পড়ে আমি তখন ফুল ফর্মে আবার।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে ফেরার পালা। রাতের ন্যু ইয়র্ক শহরের বুক চিড়ে গাড়ি চলছে। চারিদিকে আলোর রোশনাই, ঝলমলে। সুন্দর লাগছিল। ব্রিজ পেরিয়ে ঢুকলাম ন্যু জার্সি। তারপর বুচু পিসির বাড়ি। পরেরদিন দুপুরে ফ্লাইট। জিনিসপত্র প্যাঁক করে নেওয়ার পালা। এ কদিনে এত মারাত্মক শপিং করেছি, নেহাত সুজাতা ভালো প্যাঁক করতে পারে, তাই ও আমার সুটকেস গুছিয়ে দিল। আমি হলে আঁটাতে পারতাম না। এয়ারপোর্টে মাপলাম যখন, দেখলাম সাত কেজি এক্সট্রা লাগেজ আসার সময়ের তুলনায়।
সোমবার সকাল সকাল স্নান টান সেরে ফেললাম। ব্রেকফাস্ট করে আর সাথে খিদে পেয়ে গেলে কী খাবে বলে পিসি কিছু মিষ্টি আর গ্র্যানোলা বার প্যাক করে দিল। এয়ারপোর্ট পৌঁছে বুচু পিসিকে বিদায় জানিয়ে আমরা ঢুকলাম সিকিউরিটি চেক ইত্যাদির জন্য। এইবারে সঙ্গে সুজাতা আছে। তাই আমি অনেক রিল্যাক্সড। ভালোয় ভালোয় মিটল সব। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, শপিং এর এত নেশা, আসার পথে গাড়ি থামিয়ে একটা ইলেক্ট্রনিক্স শপ (বেস্ট বাই, ভালো অফার চলছিল) থেকে স্যামসাং এর একটা ট্যাব কিনলাম। সেটা হাতে নিয়েই ঘুরছিলাম। ডিউটি ফ্রি শপ থেকেও লাস্ট মোমেন্টের টুকটাক স্যুভেনির কিনলাম। বাবার ক্রেডিট কার্ডে পেমেন্ট (পরে পাই টু পাই হিসেব করে ধার শোধ করে দিয়েছি কিন্তু) হচ্ছে। মা ফোন করে বলে, "তুই এখনও কী কিনছিস? এবার তো থাম"।
প্লেনে উঠলাম ঠিক সময়ে। মোটামুটি ফাঁকা প্লেন। সুজাতার আর আমার আলাদা জায়গায় সিট হলেও পরে ওর পাশের সিটগুলো খালি হওয়ায় আমি চলে এলাম ওর কাছে। দুজনে মিলে তিনটে সিট নিয়ে বসলাম। এরপরে শুধুই এয়ার ইন্ডিয়ার রাজকীয় খাওয়া, পানীয় আর সাথে সিনেমা। আর আমাদের গল্প। এই করতে করতে দিব্যি পনেরো ঘণ্টার ফ্লাইট কাটিয়ে ফেললাম। এইবারে ঘুম কম হয়েছিল। কিন্তু ও ঠিক আছে। ও ফিরছে বাড়ি, আমি হোস্টেল। ফেরত গিয়ে যত ইচ্ছে ঘুমনো যাবে। বম্বে এয়ারপোর্টে ওর ইমিগ্রেশন হল, আমার হবে চেন্নাইতে। তাই আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। শেষ বারের মতো গুডবাই হাগ মিস করলাম। অবশ্য একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে। বন্ধুকে ছেড়ে আসতে গেলে দুজনেই কান্নাকাটি করতাম। এর চেয়ে এই ভালো। আমার ফ্লাইট ছিল চার ঘণ্টা পরে, ওর ছয়। ওরটা মারাত্মক লেট করলো। বেচারির রাত দশটায় কলকাতায় ল্যান্ড করার কথা। পৌঁছল আড়াইটেয়। আমি সাড়ে আটটার মধ্যে নামলাম চেন্নাইতে। সমস্ত ফর্মালিটি করে লাগেজ নিয়ে সোয়া নটায় হোস্টেলে নিজের ঘরে। প্রচুর লাগেজ আনপ্যাক করতে হবে। অনেক কাজ বাকি। শুধু যে পার্থিব জিনিস নিয়েই ফিরলাম তা তো নয়। অনেক অনেক হ্যাপি মেমোরিজ, দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা, সবকিছু নিয়ে ঝুলি কানায় কানায় ভরে ফিরলাম।
No comments:
Post a Comment