গাড়িতে উঠেই প্রথম কাজ। বাড়িতে জানানো। মধুরিমা ওর ফোনটা দিলও।
ওয়াটসঅ্যাপ কল করতে গিয়ে দেখি মায়ের প্যানিক করে পাঠানো এত্ত এত্ত মেসেজ।
মাকে ফোন করতে সে প্রায় কেঁদেই ফেলল। এতক্ষণ কেন কোন খবর দিইনি, ইত্যাদি।
আমি যে আস্ত এক পিসেই রয়েছই এবং সেফ হ্যান্ডসে রয়েছই, সেইসব নিয়ে আশ্বস্ত
করতে এমারজেন্সি অবস্থা কাটল। এইবারে মধুরিমার আনা মাফিনে আপাতত না বলে
চারিদিকে চোখ বোলাতে লাগলাম। প্রথম পার্থক্যই যেটা চোখে পড়ল, গাড়ি চলছে
ভারতের তুলনায় রাস্তার উল্টোদিক দিয়ে, আর তাই ড্রাইভারের সিটটিও উল্টোদিকে।
এক্কেবারে ফাঁকা রাস্তা। একটা দুটো গাড়ি মাঝে মাঝে পাশ দিয়ে হুহু করে
বেরিয়ে যাচ্ছে। শুনলাম শনিবারের সকাল, তাই এই। উইকডেজে নাকি জ্যাম পর্যন্ত
হয়ে যায়। অবশ্য ন্যু ইয়র্ক ন্যু জার্সির জ্যামের গল্প আমি আগে থেকেই শুনে
এসেছি বেশ কয়েকজনের কাছ থেকেই।
ন্যু জার্সি স্টেটকে বলে গার্ডেন
স্টেট। এবং সত্যি সত্যিই সেই নামকে সার্থক করে চারিদিকে সবুজালি। রাস্তার
দুধারে বিশাল বিশাল সবুজ গাছের সারি। কোথাও কোথাও কিছু নেবারহুডের নাম দিয়ে
ডিরেকশন দেওয়া। হিলসবরো, ব্লুমফিল্ড, ইত্যাদি। মধুরিমাদের বাড়ি
অ্যানানডেলে, পাম্পকিন ফার্ম কোর্টে (না, কোন কুমড়োর ক্ষেত টেত চোখে
পড়েনি)। এয়ারপোর্ট থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের জার্নি। যথাসময়ে পৌঁছে
গেলাম। ওদের বাড়িটা একটা হাউজিং কমপ্লেক্সের মত জায়গায়। তবে কোন বাউন্ডারি
ওয়াল নেই। পরপর প্ল্যান মাফিক দোতলা বাড়ি। খয়েরি রঙের। রাস্তাঘাট উঁচু
নিচু, ঢাল। আবারও সেই শুনশান। মেজানাইন ফ্লোরে ড্রইং রুম। দোতলায় বেডরুম।
মধুরিমা আর অরিন আমার লাগেজ টেনে ওপরে নিয়ে গেল। হাত মুখ ধুয়ে গরম কফি আর
মাফিন খেলাম। ততক্ষণে বেশ শীতে ধরে গিয়েছে। বলছে সামার, এদিকে বাইরে ১৬ ১৭
ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। আমি বাপু চেন্নাইবাসী, আমাদের বোধহয় উইন্টারেও
তাপমাত্রা কুড়ির নিচে নামেনা। কাজেই ঠকঠক করে যে কাঁপব, এতে আর নতুন কী
আছে। একটু শরীর গরম করে ঠিক করলাম স্নান করে নিতে হবে। এবং সেখানে গিয়েই
প্রথম ধাক্কা।
এ যে ওয়াটারলেস সিস্টেম। নেই কোন জেট স্প্রে। নেই কোন
মগ বালতি। কি সর্বনেশে ব্যাপার। বাথটাবে ছাড়া স্নান করা যাবেনা। প্রচুর চাপ
টাপ খেয়ে গেলেও কোনমোটে ম্যানেজ করলাম। প্লেনে ভালোই ঘুমিয়ে নিয়েছিলাম বলে
তখনো ঘুম তুম পায়নি। মধুরিমা বারবার জিজ্ঞেস করলও সেই কথা। স্নান সেরে
আমরা বসলাম আড্ডা মারতে। যদিও নিয়মিত মেসেজ মেলে কথা হয়, তবুও ফেস টু ফেসের
আলাদা মাধুর্য। টপিকেরও অভাব নেই। সময়ও অফুরন্ত। মাঝে অরিন লাইব্রেরি গেল,
আমাদের জিজ্ঞেস করলো যাবো কি না। ততক্ষণে আড্ডা জমে গিয়েছে। ওইসব ছেড়ে
আবার কে বেরোয়। ও ফিরতে আমরা লাঞ্চ সারলাম। চিকেন বিরিয়ানি, মিট বল, রায়তা ও
ফ্রুট জ্যুস। একটা ব্যাকগ্রাউন্ড ইনফরমেশন নিয়ে গিয়েছিলাম যেটা, সেটা হল
যে ওখানে কলের জলই পানীয় জল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে মধুরিমাদের বাড়ির
কাছাকাছি কোন পাওয়ার প্লান্ট থাকায় ওরা ওখানে সবাই প্যাকেজড জল খায়। তাই
অ্যামেরিকান কালচারের এই দিকটির সাথে তখনো পরিচয় হলনা।
খাওয়ার পর
অল্প অল্প ঘুম আসছিল, কিন্তু আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম যে না, ঠিক রাত হলে
তবেই শোবো। নইলে সেই জেটল্যাগ হ্যানল্যাগ ত্যানল্যাগ হবে। আর ওইসব হলেই শেষ
সব। ঘোরাঘুরি মাটি। তাই দাঁতে দাঁত চিপে জেগে রইলাম। মধুরিমার সাথে বাড়ির
বাইরে আশেপাশেটা ঘুরে দেখব বলে বায়না করলাম। ওর একটা জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে
আমরা এরপর রাস্তায় বেরোলাম। ওর বাড়িটা এমন সুন্দর জায়গায়, পিছনেই উঁচু হয়ে
উঠে গিয়েছে সবুজ ঘন জঙ্গল। উঁচু নিচু রাস্তা। মনে হচ্ছিল বুঝি কোন হিল
স্টেশনে গিয়েছি। আমাদের কোদাইকানাল বা মুন্নার (প্লিজ ক্ষমা করবেন, পাঁচ
বছর সাউথে থেকে এই দুটোই প্রথমে মাথায় এলো। দার্জিলিং না লিখে।) রোদ
চরচরে। বেশ একটা শীতের দুপুর। মাঠে শতরিঞ্চি পেতে মিঠেকড়া রোদে পিঠ এলিয়ে
কমলালেবু নিয়ে বসে পিকনিক করার মত আয়োজন। খানিক হাঁটাহাঁটি করলাম। বিটলসের
মতো পোজ দিয়ে একটা জেব্রা ক্রসিঙে ছবিও তুললাম। ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়েছি।
খচাখচ আরো কিছু ছবি তুললাম। মধুরিমা তাড়া দিচ্ছিল ঘরে ঢোকার, কারণ ওর দুই
পাশের দুই বাড়ির পোষা কুকুরগুলোর তখন হাঁটতে বেরোনোর সময়। আর মধুরিমা এমনই
মেয়ে যে ক্লাস সিক্সে পাশের বাড়িতে কুকুর ডাকছিল বলে লাফ মেরে প্রায়
ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল টিফিন টাইমে। আমি বললাম আহা একটু থাকি,
মার্কিনী কুকুরদের দেখি। আদর করি। ও মা। তা নাকি হবে না। লোকজনের ওখানে বড়ই
প্রাইভেসি নিয়ে সমস্যা। ভারতবর্ষে যেমন রাস্তায় ঘাটে আমরা যার তার বাচ্চা,
কুকুর ইত্যাদি ইত্যাদিকে আদর টাদর করে দিই, ওখানে এইসব করতে গেলেই পুলিশ
টুলিশ ডেকে দেবে। বাপ রে। দরকার নেই। ওই দুর থেকেই দেখে কুকুর ও তার
মালিকদের দিকে ছোট্ট হাসি ছুঁড়ে দিলাম। হাঁটাচলা করে ঘরে এসে দেখি তখনও
চারটে বাজেনি। অবশ্য বাইরের রোদ দেখে বোঝার উপায় নেই। এই সময়ে নর্থ ইস্ট
অ্যামেরিকাতে রাত্তির সাড়ে আটটার আগে প্রায় সূর্যাস্ত হয়ই না। অথচ সকাল
সকাল দিব্যি টাইমে সূর্যোদয় হয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে বস্টোনে পৌঁছে আরো বলবো।
চলল
আমাদের গল্প। পি এন পি সি। এরপরে কবে কোথায় যাচ্ছি, কীভাবে কী করব তার
প্ল্যানিং, পরের দিন কখন বেরবো সেইসবের ডিটেল্ড আলোচনা। মধুরিমা আর অরিন
প্রচুর ঘুরে বেরায়। ওদের দেওয়ালে একটা ওয়ার্ল্ড ম্যাপ লাগানো। কোথায় কোথায়
ঘুরেছে এর মধ্যে, পিন লাগানো তাতে। অবাক হয়ে দেখলাম। কত দেশ। কত শহর। ওদের
তাই অনেক অভিজ্ঞতা। অতি বিচক্ষণ। ওদের সাথে বসে পুরো প্ল্যান ঝালিয়ে নিলাম।
পরেরদিন আমার ট্রেন। একা প্রায় ছয় ঘণ্টার জার্নি। আবার ওদের এবং আমারও
টেনশনের ব্যাপার। সেই জন্যই এই প্ল্যানিং খুব দরকার ছিল।
আমার
ততক্ষণে ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মধুরিমা বারবার বলছিল, খেয়ে নে। ঘুমিয়ে
পড়। কিন্তু আমি ওই অনড়। বাইরে আলো ঝলমল করছে। এতে কী খেয়ে শুয়ে পড়ব? তবে
কুড়ি ঘণ্টা প্লেন জার্নি করে সারাদিন না ঘুমিয়ে অবস্থা প্রায় শোচনীয়।
বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে ভেবে অল্প দই চিড়ে খেয়ে নিলাম (খিদে খুব একটা ছিল না)।
আমার হজমের সমস্যা হয় ইদানীং, সেই শুনে মধুরিমা এইসবেরও ব্যবস্থা রেখেছিল!
খাওয়া সেরে মাথায় এলো ফোন চার্জ করতে হবে। সাথে নিয়ে এসেছিলাম ট্র্যাভেল
অ্যাড্যাপটার। ইউ এসে ১১০ ভোল্ট চলে, ভারতে ২২০। তাই ওখানে প্লাগ পয়েন্টে
আমাদের চারজার লাগবেনা। অ্যাড্যাপটার সহ চার্জে বসাতে গিয়ে আরেক বিপত্তি।
ওইটি এত ভারি, কিছুতেই দেওয়ালে লাগছেনা। খালি খুলে যায়। সাময়িক ব্যবস্থা হল
অরিনের অফিসে, মাল্টি প্লাগ এক্সটেনশন বোর্ড দিয়ে। কিন্তু বাকি ট্রিপ?
সুজাতাকে মেসেজ করলাম। ওর ওইদিন রাত্রের ফ্লাইট সিয়াটল থেকে। ওর কাছে যদি
থাকে, যেন নিয়ে আসে। ও বললও ওর কাছে তো নেই, কিন্তু কিনে নেবে কারণ ওরও
দেশে এসে লাগবে। বেশ। সমস্যার আশা করি সমাধান যতক্ষণে হল আর মধুরিমাও ডিনার
সেরে ঘরে এলো, বাইরে অন্ধকার। নটা বেজে গিয়েছে। আর আমার ঘুমোতে যাওয়া নিয়ে
অসুবিধে নেই। পরেরদিন সাড়ে পাঁচটার অ্যালার্ম লাগিয়ে শুলাম। দুই বন্ধু
মিলে গল্প করতে করতে যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, কে জানে।
No comments:
Post a Comment