"কীরে, পুজোয় কটা নতুন জামা হলো? জুতো কিনেছিস?"
"মা, পূজার মতো একটা ফ্রিলের ড্রেস আমারও চাই।"
"শুনছো, বাবুই আর বুবানের শার্ট কিনতে যেতে হবে। ওরা কিন্তু ভালো জিন্স কিনবে বলেছে।"
পুজোর মাসখানেক বা আজকাল হয়তো আরো আগে থেকে, মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরে ঘরে এ যেন বহু পরিচিত ও বহুশ্রুত সংলাপ। মনে পড়ে যায় না সেই পুজোর এক দুই মাস আগে থেকে মায়ের সব ম্যাগাজিনের পাতায় পাতায় "এবারে পুজোর রঙ কী" বা "পুজোয় কোন শাড়ি হিট", এই ধরণের হেডলাইনের ভিড়? চকচকে পাতায় কত রঙিন পোশাক আর সাজগোজ করা মডেলদের ছবি। সেইসব দেখতে দেখতে চোখে এক রাশ রুপোলি স্বপ্ন। আসলে বাঙালির কাছে দুর্গা পুজো তো শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি বরং বলা চলে, বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব। আর এই উৎসবের সূচনা শুরু হয়ে যায় অনেক মূল তিথির বেশ অনেকদিন আগে থেকেই। মাঠে বাঁশ পোঁতার দিন থেকেই মনে মনে চলতে থাকে নানান পরিকল্পনা। কোথায় ঘোরা হবে, কোন থিমের প্যান্ডেল যাওয়া হবে, ইত্যাদি। তবে এই সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়ে যে চিন্তাটা মনের মধ্যে সারাক্ষণ উঁকি ঝুকি মারে, তা হল, পুজোর ফ্যাশন আর বাজার। যদিও এখন সারা বছরই দোকানপাট করা হয়, বা অনেক সময়েই অনলাইনে কেনাকাটিতে আমরা অভ্যস্ত, তবুও এই কটাদিনের জন্য বুঝি পায়ে হেঁটে ঘুরে বেরিয়ে কেনাকাটি করায় আলাদা আকর্ষণ। আমি কলকাতার মেয়ে, তাই আমার কাছে পুজো মারকেটিং মানেই গড়িয়াহাট, হাতিবাগান, নিউ মার্কেট আর দক্ষিণাপন। চলুন, আজ বরং একটু গড়িয়াহাট অঞ্চলে বাজারহাট করি গিয়ে। কী বলেন?
বেলঘড়িয়াগামী ২৩৪ বাস থেকে নেমে পড়ুন তো গড়িয়াহাট মোড়ে। না না, এইখানে না। ব্রিজে ওঠার নামতে হবেনা। এই বাসটা তো ব্রিজের তলা দিয়ে যায়। একদম আনন্দমেলার মোড়ে নামবেন। বেশিরভাগ সময়েই সিগনাল লালই থাকবে। অসুবিধে হবেনা। সাবধানে নামুন। বা দিক দেখে নামবেন। পাশ থেকে অটো বা বাইক এসে যেতে পারে। হ্যাঁ, এইবারে বা দিকে চেপে চলুন। মোড় থেকে ফুটপাথে উঠে পড়ুন। হুম, জানি, জায়গা কম। কিন্তু ওরই মধ্যে ম্যানেজ করতে হবে যে। পুজোর বাজার করবেন, তাও গড়িয়াহাটে। একটু ভিড় তো হবেই। এইখানে এখন মোবাইলের কেস, সস্তা ইয়ারফোন এসব পাবেন, এখুনি এদিকে তাকিয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে চলুন আরেকটু এগনো যাক। শুনুন, একটা টিপ দিই। কোন দোকানের সামনেই কিন্তু প্রথমেই দাঁড়িয়ে পড়ে কিনে ফেলবেন না। আগে এক রাউন্ড মারুন, দাম বুঝুন, তারপর দরদাম করবেন। ঠিক? চলুন যাই।
"দিদি এদিকে এদিকে। একশো করে। খালি একশো খালি একশো।" ঘাড়টা ঠিক ঘুরিয়েছেন। বেশ বিভিন্ন প্রিন্টের সুন্দর সুন্দর হাফ প্যান্ট। ছেলেদেরও, মেয়েদেরও। হ্যাঁ, দেখতে পারেন। মন্দ হয়না। আরো চলুন। পরপর এবার "খালি দেড়শো" "দুশো করে দুশো করে" শুনবেন। দু তিনটেতে দাঁড়িয়ে যান। নিশ্চয়ই গোটা তিনেক কুর্তি পছন্দ হবেই হবে। স্মল থেকে ডবল এক্সেল, সব সাইজে নানান রঙে ভিন্ন প্রিন্টে সুন্দর সুন্দর কুর্তির যা কালেকশন, হলফ করে বলতে পারি, এই জিনিস অনলাইন শপিং না করলে পাবেনই না। তবে অনলাইনে দাম বেশি। ঘুরে ঘুরে স্পর্শ করে কেনার অনুভূতি পাবেন না।
চলুন, এগুলো তো হল ওই কমের ওপর। এগুলো তা বলে সপ্তমীর সকাল থেকে পড়া যায়না। এগুলো ওই পঞ্চমী ষষ্ঠী অবধি অফিসে কলেজে বা টিউশানে পরলে চলে যায়। পুজোর আসল দিনগুলোর জন্য কী নেবেন? শাড়ি নাকি সালোয়ার? শার্ট না পাঞ্জাবি? বা দিক দিয়ে সারি সারি দোকান। পাঁচতলা মল থেকে শুরু করে ছোট্ট দোকান। হরেক রকম স্টক। একদম হালফিলের। সিরিয়াল সিনেমার নায়ক নায়িকাদের ফ্যাশনের। আনন্দপ্লাসে ঠিক যেই রঙ আর যেই কাট লিখেছিল, সব পাবেন। হবে নাকি কয়েকটা?
এই রে। ঘড়িটা দেখেছেন? ঘুরতে ঘুরতে আড়াই ঘণ্টা হয়ে গিয়েছে কিন্তু। তাই ভাবি, পেটের মধ্যে একটু খিদে খিদে ভাব আসছে না? কী খাবেন? ফুলুরি নাকি ফুচকা? চলুন রাস্তা পেরোই। ওই ফুটে পেয়ে যাবো দুটোই। তারপর জামার সাথে ম্যাচ করে জুতো আর ব্যাগ কিনতে হবে তো। ট্রেডারসের সামনে ভালো ভালো স্টক রয়েছে।
"দাদা ওই পিঙ্কটা দেখান না। কত এটা?”
"না না, পাঁচশো কী? তিনশোর এক টাকাও বেশি দেবোনা।"
"তিনশো দশ।"
"আচ্ছা ঠিক আছে। এই নিন তিনশো পঁচিশ।"
ব্যস, পছন্দের ব্যাগ পকেটে। এবার জুতো। ভালো করে দেখে নেবেন। ফিটিং আর আরাম, দুইই। পরে অনেক হাঁটাহাঁটি করতে হবে তো সপ্তমী থেকেই। হোল নাইট আছে তো এবারে প্ল্যানে?
এই রে, চলুন চলুন, আকাশের অবস্থা ভালো না। যে কোন সময়ে নামবে বৃষ্টি। ঝটপট বাকি কেনাকাটি করে নেবেন আসুন। টুক করে রাস্তা পার হয়ে নিন। আনন্দমেলার সামনে দিয়ে বিজন সেতুর দিকে মুখ করে চলুন। পরপর ক্লিপ কানের দুলের দোকান। বিভিন্ন দামে পাবেন। চটপট কিনে নিন। নিয়েছেন তো? আর কস্মেটিক্স লাগবে? মার্কেটের ভিতরেও দোকান আছে। আচ্ছা, তখন তো ফুলুরি খেলেন, এবার একটু ফুচকাটা খেয়ে ফেলি? পেট্রোল পাম্পের সামনে যেটা আছে, ওটা থেকে খাই, আসুন। দারুণ বানায়। ঝাল লেগে গেলে কাছেই মিষ্টির দোকান আছে। খাওয়াটা বেশ ভালোই হল, বলুন?
চলুন এবার ফেরা যাক বাস স্টপে। পাঁচটা বাজতে যায়। বাসে কিন্তু এবারে ভিড় হবে। স্কুল ফেরত বাচ্চারা, তাদের অফিস ফেরতা মায়েরা, বাবারা। এতগুলো প্যাকেট নিয়ে আবার বাসে জায়গা না পেলে বেশ অসুবিধে হবে।
জানি পুজোর বাজার কমপ্লিট হলোনা, আবার ফিরতেই হবে কোন একদিন গড়িয়াহাটার মোড়ে, নইলে হাতিবাগানে। বা নিউ মার্কেটে। পুজোর শপিংটা যে ঠিক মলগুলিতে হয় না। তাই না?
No comments:
Post a Comment