যখন আই আই টি ম্যাড্রাসে পি এইচ ডি করতে ঢুকি, কিছু মাসের মধ্যেই জানতে পেরে গিয়েছিলাম যে সরকারি খরচে একটি বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ থাকে পাঁচ বছরে একবার। সেই আনন্দে হোস্টেলে এক বছর পূর্ণ হতেই সঙ্গে সঙ্গে পাসপোর্টের জন্য দরখাস্ত করে ফেললাম। হাতেও পেয়ে গেলাম দিন চারেকের মধ্যে। তারপর সেই পাসপোর্ট নিয়ে অন্য গল্প আছে। কখনো বলব। তা যাক গে, ডিসেম্বর ২০১৪তে পাসপোর্ট করে রাখলেও ২০১৭র সেপ্টেম্বরের আগে সেই বইটি আলমারি থেকে বের হওয়ার সুযোগই পায়নি। ফেব্রুয়ারি ২০১৮তে অ্যামেরিকার পশ্চিমে কূলে অবস্থিত স্যান ফ্র্যানসিস্কো শহরে যাওয়ার একটি সুযোগ এলো। মনে আছে, ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যেবেলা বসে ভিসার অ্যাপ্লিকেশন করলাম। এই সময়টা আর আবার জুন জুলাই অগস্ট হল অ্যামেরিকা যাওয়া আসার সবচেয়ে পপ্যুলার সিজন। আর তাই স্বাভাবিকভাবেই ভিসার ইন্টারভ্যু ডেট পেলাম সেই ডিসেম্বরের এগারোতে।
অ্যামেরিকার ভিসা পাওয়া অন্যতম কঠিন একটা ব্যাপার। এইচ ১ বি নিয়ে সাম্প্রতিক বহু আলোচনায় সেইসব নিয়ে তো চর্চা অনেকেই নিশ্চয়ই পড়েছেন। তা যাই হোক, আমার ছিল কনফারেন্স। আর তাই আমার জন্য সঠিক ভিসা ছিল বি-১/বি-২। সোজা ভাষায় ট্যুরিস্ট/বিজনেস ভিসা। আমার আবার সব বিষয়ে হোমওয়ার্ক করার একটি বিশেষ প্রবণতা রয়েছে। আর তাই ভিসা ইন্টারভ্যু দিতে যাওয়ার আগে যে নেট ঘাঁটব না, তা তো নয়। প্রচুর লেখাপত্তর দেখলাম। সম্ভাব্য প্রশ্নাবলী, তার যথাযথ উত্তর, কী কী কাগজপত্র সাথে লাগতে পারে, ইত্যাদি ইত্যাদি। (এই বিষয়ে কারুর কোন প্রশ্ন থাকলে অবশ্যই ইনবক্সে জিজ্ঞেস করতে পারেন। ) বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা বললেন যে আমার নাকি ভিসা পাওয়া একদম জলভাত সমান। কোনরকম চিন্তার জেন কারণই নেই। তাও একটু নার্ভাস হয়ে প্রথমদিন গেলাম বায়োমেট্রিক ডিটেলস জমা করার জন্য। এইটি মূল কনসুলেট না। আলাদা একটি অফিস। তবুও এখানেও সিকিউরিটি নিয়ে কড়াকড়ি রয়েছে। ফোন নিয়ে যাওয়া বারণ। আমি নিয়ে যাইনি তাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পারশে পেনড্রাইভ ছিল, সেটা আবার নিচে লকারে পঞ্চাশ টাকা ভাড়া দিয়ে রেখে আসতে হয়। যাই হোক, বায়োমেট্রিক তো ভালোয় ভালোয় হল। অনেক টাকা অটো ভাড়া দিয়ে (কী করব, ফোন নেই সাথে, তাই অ্যাপ ক্যাবও নেই।)ফিরলাম হোস্টেলে। দুদিন পর ডি-ডে।
স্নান করে ঠাকুর নমস্কার করে সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে গেলাম। এটি চেন্নাই কনসুলেটে। জেমিনি ফ্লাইওভারের কাছে। গোটা ফুটপাথ জুড়ে শুধুই লোক আর লোক। বাবা রে, আম্রিকা যাওয়ার এত ক্রেজ, দক্ষিণে বোধহয় একটু বেশিই। (পড়ে জেনেছি হায়দ্রাবাদের কাছে নাকি ভিসা বালাজি বলে কোন মন্দির আছে। সেখানে বালাজির কাছে পুজো দিলে তাড়াতাড়ি ভিসা এসে যায়। হায় রে আমার ভারতবর্ষ!) আর তাছাড়া ব্যাঙ্গালোর, যেখান থেকে প্রচুর লোক অনসাইটের সৌজন্যে অ্যামেরিকা যায়, সেই ব্যাঙ্গালোরেই ইউ এস কনসুলেট নেই। তাই তাদেরও ভরসা চেন্নাই। ভারতে বোধহয় শুধুমাত্র কলকাতা দিল্লি বম্বে ম্যাড্রাস আর হায়দ্রাবাদে ইউ এস কনসুলেট আছে। আর তাই ভিড় হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
সাড়ে এগারোটার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। এগারোটার একটু আগে লাইনে দাঁড় করাল। হাতে পাসপোর্ট রাখতে হবে। আর বাকি সমস্ত কাগজপত্র প্লাস্টিকের প্যাকেটে বা ট্রান্সপ্যেরেন্ট ফাইলে। বেশ বাধ্য নাগরিকের মতই সকলে রইলাম লাইনে। সঠিক সময়ে আমাদের লাইনকে ছাড়া হল। অন্য কোন দেশের কনসুলেটে আমি যাইনি, তাই জানিনা সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন। তবে অ্যামেরিকান কনসুলেটে বাড়াবাড়ি রকমের সিকিউরিটি। হাতের ঘড়ি পর্যন্ত খুলে চেকিং করে লম্বা লম্বা লাইন ও করিডর পেরিয়ে পৌঁছলাম একটি বিল্ডিঙে। সেইখানে মূলত মার্কিনী স্টাফ। ভারতীয় স্টাফ থাকলেও সংখ্যায় ও ক্ষমতায় কম। আবার লাইন। একেকটি কাউন্টার খালি হচ্ছে আর সেখানে লোক পাঠাচ্ছে। কিছু কাউন্টার আবার স্পেশালাইজড ভিসার জন্য নির্দিষ্ট। আমি এক সময়ে সুযোগ পেলাম। পাসপোর্ট দিলাম। আবার বায়োমেট্রিক ইনপুট হল। ভেরিফিকেশনও বটে। পাসপোর্ট ফেরত নিয়ে গেলাম আরেক লাইনে। বলতে ভুলে গিয়েছি, এই বিল্ডিঙে সর্বত্র অ্যামেরিকার ট্যুরিস্ট স্পটের ছবি। স্যান ফ্র্যানসিস্কোতে গেলে কোথায় কোথায় যাবো, কী দেখব, সব ইতিমধ্যে মাথার মধ্যে দারুণভাবে রেডি। তাই ছবিগুলো চিনতে একটুও অসুবিধে হচ্ছিল না। আহা, গোল্ডেন গেট ব্রিজ, কুয়াশাচ্ছন্ন। রোমাঞ্চ জাগছিল মনে, আর মোটে দুই মাস। তারপরেই আমিও এর সামনে পোজ দেবো।
অপেক্ষা আর অপেক্ষা। আর তারপরে গেলাম কন্সুলার অফিসারের সামনে কাউন্টারে। খুব বেশি প্রশ্ন করেননি ভদ্রমহিলা। ওই সাধারণ কবে যাবো, কোথায় যাবো, কী করি ভারতে। তারপর আমার সিভি এবং যে কাজটি প্রেজেন্ট করতে যাচ্ছি তার অ্যাবস্ট্র্যাক্ট জমা নিলেন। সাথে পাসপোর্ট। এইবারে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। জানব যে আমার কপালে ভিসা আছে কি না।
একটু দুঃখী দুঃখী মুখ করে জানালেন যে এই মুহূর্তে ওঁর পক্ষে আমায় ভিসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। কিছু অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ প্রসেসিং দরকার। আমায় ধরিয়ে দিলেন একটি নীল রঙের কাগজ। সেখানে লেখা 221G, কেস নম্বর লিখে জানালেন ওদের ওয়েবসাইটে নিয়মিত চোখ রাখতে, স্ট্যাটাস জানতে। ২২১জি শুনেছিলাম খুবই কমন, অন্তত আমরা যারা বায়োসায়েন্স বা কেমিক্যাল সায়েন্স নিয়ে রিসার্চ করি তাদের জন্য। তায় আবার আমার কাজ এইচ আই ভি নিয়ে। আমার যে অত সহজে ভিসা আসবেনা, বোঝাই উচিত ছিল। তবুও, মনে আশা ছিল একটু হয়ত হয়ে যাবে। যাই হোক, হাতে দুই মাসের মত সময় আছে। সামনে বাড়ি যাওয়া, বেশি চিন্তা না করে ফিরলাম ক্যাম্পাসে।
No comments:
Post a Comment