Tuesday, August 14, 2018

আম্রিকা দর্শন পর্ব ১০

সামারে বাড়ি গিয়েছিলাম, এক সপ্তাহর জন্য। বেশ হেলতে দুলতেই কাটাচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই ফেরার দিন তিনেক আগে আমায় বাবা আর জেঠু এক সান্ধ্য চায়ের আসরে (মনে আছে, সাথে মায়ের গরম গরম ফিস চপ ছিল) জিজ্ঞেস করে, "হ্যাঁ রে। তোর গোটা ট্রিপের মোট কটা ডিটেল্ড প্ল্যান বল তো? একটু ঝালিয়ে নে।" ব্যস। শেষ। আমি তোতলে থতকে একাকার। জেরায় জেরায় জেরবার। ওদের নিদান এলো, এ মেয়েকে যে ছাড়া বেশ রিস্কি। সঙ্গে সঙ্গে গল্পের বই (শরদিন্দু অমনিবাস পঞ্চম খণ্ড রিভাইজ করছিলাম তখন) কেড়ে নেওয়া হল। রেডিও বন্ধ করে দিল। হাতের কাছে একটা ছোট্ট রাইটিং প্যাড আর একটা কলম এলো। আদেশ। আগামী দুইদিনের মধ্যে পুরো প্ল্যান চাই। সলিড প্ল্যান। অগত্যা, ট্রিপঅ্যাডভাইসরের সাহায্য। আমট্র্যাকের ওয়েবসাইট। গ্রেহাউন্ডের সাইট। নানান এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার, লগ সিরিজ ই সিরিজ পারম্যুটেশন কম্বিনেশন করে প্ল্যান করলাম। সেই প্ল্যানের তেমন ভাবে কিছুই বস্টনে কাজ করেনি ঠিকই, তবে স্কেলিটনটা বজায় ছিল। অন্তত জানি এই দিন অমুক সময় তমুক জায়গা থেকে বাস ধরতে হবে। অগত্যা টিকিট কাটা জরুরি। সেই মতো সুজাতা গ্রেহাউন্ডের টিকিট কেটে রেখেছিল বস্টন থেকে নায়াগ্রা। ও যখন পি ডি এফে টিকিটটা আমায় মেল করে, আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। বলে কী। আট পাতা দুজনের টিকিট। এবং যা বুঝলাম দেখেশুনে, আমাদের চারটে চেঞ্জের ব্যাপার আছে। বস্টন থেকে আল্বানি, তারপর সেরাক্যুজ, বাফেলো আর সব শেষে নায়াগ্রা। গ্রেহাউন্ড সম্পর্কে ধারণা বলতে আত্মপ্রকাশেই রোশনিদির পুরনো লেখা আর আরো আগে পড়া নবনীতা দেব সেনের কিছু লেখাপত্তর। প্রচুর ইন্টারনেট ঘেঁটে টেটেও কিছুই বুঝলাম না কী হবে না হবে, ভগবানের হাতে আর বাকিটা যা হবে দেখা যাবে গোছের হাবভাব নিয়ে বেরোলাম।
গ্রেহাউন্ডে সিট নম্বর দেয়না। লাইন করে উঠতে হবে বাসে। তারপর যে যেমন পারো, জায়গা নিয়ে বসো। সাড়ে সাতটায় বাস ছিল। আমরা পৌনে সাতটার মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছিলাম বাস স্টেশনে। বিশাল বাড়ি, প্রচুর কাউন্টার। বহু বাস কোম্পানি, তাদের কাউন্টার। কিছু দোকানপাট। আর একগাদা সাইনবোর্ড। নিজের গন্তব্য খুঁজে পেতে খুব অসুবিধে হওয়ার কথা না। বোর্ড দেখেশুনে আমরা পৌঁছলাম গ্রেহাউন্ডের নির্দিষ্ট গেটে। একদম এয়ারপোর্ট গেটের মতোই ব্যবস্থা। লাইন করে থাকো, সময় হলে একজন টিকিট পরীক্ষা করে গেট খুলে দেবেন, বাসে উঠে পড়ো। মধুরিমার কাছে শুনেছিলাম ওর গ্রেহাউন্ডে খুব একটা ভালো অভিজ্ঞতা না। মানে সহযাত্রীরা অনেক সময়েই খুব পছন্দসই হয়না। কিছু করার নেই। আমাদের ট্যাঁকের কন্সট্রেইন্ট ছিল। আর সময়েরও। তাই যা হোক, এতেই যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। আমাদের লাইনে পিছনদিকেই একটি ভারতীয় ছেলেকেও দেখলাম। হিন্দিতে কারুর সাথে কথা বলছিল, নিজের প্ল্যান জানাচ্ছিল। বুঝলাম কোন কারণে কলেজ ছুটি, তাই একদিনে নায়াগ্রা ঘুরে আসবে। আমাদের মতই। কেন জানিনা, ওই বিদেশ বিভূঁইয়ে স্বদেশের একজন আরো আছে ভেবেই আশ্বস্ত লাগল।
যদিও টিকিটে পরিষ্কার লেখা ছিল আধ ঘণ্টা আগে বোর্ডিং হবে, তাও প্রায় সাতটা কুড়ির পর তবেই চালু হল। টিকিট কাটার সময় যদিও দেখেছিলাম লাগেজ রেস্ট্রিকশনের ব্যাপারে, সুজাতা দেখেছিল অ্যাডিশানাল লাগেজের জন্য পনেরো (নাকি পঁচিশ) ডলার বাড়তি চার্জ। আমাদের ধারণা ছিল আমাদের ব্যাগ স্যুটকেস ছোটর দিকেই, কাজেইবাসের কেবিনে এঁটে যাবে। আর বাসের পেটের ভিতরে লোকজন ব্যাগ রাখছে মানেই নির্ঘাত ওটার জন্য ওই এক্সট্রা খরচ। এইসব ভেবে টেবে তো মালপত্র নিয়ে বাসে উঠে পড়লাম। দ্বিতীয় রোতে বসার জায়গাও পেয়ে গেলাম। কিন্তু এইবারে বাঁধ সাধল লাগেজ। ওভারহেড কেবিন যে এতটুকু হতে পারে, এক্কেবারে কল্পনাতীত। এবং সবচেয়ে খারাপ, ইলাস্টিকের যেই পারটিশান করা, সেটিও যারপরনাই লুজ। যার ফলে পিঠের ব্যাকপ্যাকটুকুও আঁটছেনা। ওই ভারতীয় ছেলেটি আমাদের স্ট্রাগল করতে দেখে এগিয়ে এলো সাহায্য করতে। সুজাতা আর আমি দুজনেই প্রায় সমান হাইটের তো, দুজনেরই এক অবস্থা। কোনমতে সিটের সামনে ওর স্ট্রলিটা রাখার পর তার উপরে আমারটা রাখলে আর বসার জায়গা নেই। কেলেঙ্কারি কাণ্ড। এদিকে পরপর লোক উঠছে বাসে। আইল ব্লক করে রাখাও যাচ্ছেনা। আমরা ভাবলাম বেশ, সবাই থিতু হোক, তারপর দেখা যাবে কী করা যায়। সেই ওয়ান ওয়ে ট্র্যাফিককে জায়গা দিতে আমি সামনের সিটে বসলাম। আমার গলায় তখনও পরম মূল্যবান স্লিং ব্যাগটি ঝুলছে। এক বেশ ভারি চেহারার ভদ্রমহিলা তখন পিছনদিকে যাচ্ছিলেন। এমন হ্যাঁচকা একখানা টান মারলেন যেতে গিয়ে, আমার গলা থেকে ব্যাগটি ছিঁড়ে পড়ে গেল। ল্যাজে গোবরে অবস্থা যাকে বলে তখন। এক তো মালপত্র নিয়ে টেনশন, তার উপর এই ব্যাগটি গেল। এবার কী হবে। ইতিমধ্যে বাসের ড্রাইভার উঠে সব দেখে টেখে এক বিদঘুটে অ্যাক্সেন্টে বলে গেলেন। কেবিনে না আঁটলে, বাসের পেটের ভিতর দিতে হবে। রাস্তা ব্লক করা চলবে না। যেহেতু সুজাতা জানলার ধারের সিটে রীতিমত ট্র্যাপড, আমিই সাহস টাহস করে নামলাম। সাহস বললাম এই জন্য যে ইংরেজিতে মন্দ না হলেও এই দেশের বিভিন্ন মানুষের অ্যাক্সেন্টে একটু সমস্যা হচ্ছিল। তাই মুখচোরা মোড অন ছিল আমার। যে মহিলা লাগেজ হ্যান্ডল করছিলেন, তাকে বললাম। আমাদের দুটো সুইটকেস ভরতে হবে। উনি যে কী বুঝলেন বললেন, কিছুই বুঝলাম না। অদ্ভুত মুখ করে তাকিয়ে রইলাম দুজনেই। কথাবার্তা কোনভাবেই এগোচ্ছেনা দেখে আমার স্ট্রলিটা নিয়ে নামলাম। দেখাই যাক কী হয়। দেখলাম বেশ কিছু না বলেই দিব্যি নিয়ে নিলেন। তখন সাহস বেড়ে গিয়েছে। সুজাতারটাও নিয়ে সাবধানে বাসের পেটের ভিতর চালান করে নিশ্চিন্ত হয়ে বসলাম বাসে। উফ। এইটা যে করা যায়, জানলে আগেই করতাম। এইসব ফালতু ঝামেলা হত না। মাঝখান থেকে আমার ব্যাগটা গেল। কপালে থাকলে যা হয় আর কী। মধুরিমার কোথায়, ফাঁড়াটা ব্যাগের ওপর দিয়ে কেটে গেল!
ড্রাইভার এরপর উঠে সবাইকে বাসে স্বাগত জানালেন এবং রুট ম্যাপ বললেন। এও বললেন যে চারটে হল্ট আছে। যা বুঝলাম আল্বানি বা সেরাক্যুজে আমাদের বাস পাল্টাতে হবেনা। এক্কেবারে বাফেলোতে গিয়ে যা হওয়ার। বেশ। বাফেলো পৌঁছতে ভোরবেলা। রাতটা ঘুমনো যাবে। যেহেতু নাইট জার্নি, বাসের ভিতরটা অন্ধকার রইল। এবং সকলে চুপচাপ থাকার নির্দেশ দিলেন।  বাড়িতে জানিয়ে দিলাম আপডেট। বাস চলতে শুরু করলো বস্টন শহরের মধ্যে দিয়ে। তখনও বাইরে আলো হাল্কা।
আল্বানি পৌঁছলাম পৌনে বারোটার দিকে। আধ ঘণ্টার হল্ট। বাস স্টেশনটি ছোট। ওয়াশরুম ব্যবহারযোগ্য। খিদেও পেয়ে গিয়েছিল আমার। পাঁচ ডলার দিয়ে ভেন্ডিং মেশিন থেকে (ক্রেডিট কার্ডে!) চিকেন বার্গার নিলাম। একটা কথা এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা ভালো। চীজ বার্গার মানে কিন্তু শুধু চীজ না। অবধারিতভাবে বীফ আছে ওতে। বার্গার খেয়ে সাময়িক স্বস্তি। যদিও সাথে বিস্কুট, সেই চীজকেক, ফল সবই আছে, তাও কেন জানিনা জার্নি করার সময়ে বেশিই কিনে কিনে খেতে ইচ্ছে করে।সেশ্মেশ কিন্তু ওই সাথের খাবারগুলো বাফেলো পৌঁছনর আগেই ট্র্যাশ করেছিলাম। বাসের মধ্যে বেশ বেশ ঠাণ্ডা। ব্যাকপ্যাকের মধ্যে মায়ের কুলু শালটা ছিল। ওটা সুজাতাকে দিলাম। আমি সুইটকেস থেকে wind cheater আর মাফলার বের করে বেশ চাপাচুপি দিয়ে বসলাম। উত্তর পচিম অ্যামেরিকার রাস্তা দিয়ে গভীর অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে বাস চলতে লাগল। সেরাক্যুজে নামিনি। লোক উঠছে নামছে। বস্টন থেকেই এক মাতাল লোক উঠেছিল বাসে। ভাগ্যিস আল্বানিতেই নেমে গেল।
বাফেলো পৌঁছলাম সক্কাল  পৌনে ছটার দিকে। এখানে আমাদের বাস পালটাবে। এরপর দেবে ট্রেলওয়েজের বাস। কিন্তু সেটা এক ঘণ্টা পর। ততক্ষণে দুজনেই ওভারনাইট জার্নি করে বিধ্বস্ত। বাবার সাথে ফোনে কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ল, ফেরার বাস টিকিট কাটিনি তো। ওটা অনলাইন ছিল না। গ্রেহাউন্ডের কাউন্টারে আবার সেই টিকিট কাটা হল। টাইমিং প্ল্যান করা ছিল। নায়াগ্রা থেকে বাফেলো একটা বাসে, তারপর বাফেলো থেকে ন্যু জার্সি। আমাদের নায়াগ্রা যাওয়ার বাসটি পেলাম সাড়ে ছটার দিকে। এইবারের ড্রাইভার বেশ হাসিখুশি। উনি সেদিন রাত্রে ন্যু ইয়র্ক ফিরবেন বাড়িতে, সেই আনন্দে যাকে পারছেন, তাকেই বলছেন। লেক ইরির ধার দিয়ে বেশ খানিকটা পথ চলে প্রায় ঘন্টাখানেক পর আমরা পৌঁছলাম নায়াগ্রা। ও মা, এ যে দেখি কোন বাস স্টেশনই না। প্লেন একটা হোটেলের সামনে ড্রপ। বাসটা আমাদের নামিয়ে আর রিটার্ন ট্রিপের যাত্রীদের নিয়ে ফেরত চলে গেল। ওই ড্রাইভার আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, কিছু সাহায্য লাগবে কী না। আমাদের তো বুকিং করা আছে, তাই না বললাম। এদিকে বুকিঙে চেক-ইন বিকেলে। খুব অসুবিধে হলে এগারোটার পর। প্ল্যান ছিল বাস স্টেশনেই ফ্রেশ হয়ে লাগেজ নিয়েই ঘুরতে চলে যাবো নায়াগ্রা ফলস। এদিকে যে এই কাণ্ড? অগত্যা?

No comments:

Post a Comment