এই প্রথম আমার কোন এয়ার বিএনবিতে থাকার অভিজ্ঞতা হল। কনসেপ্টটা এরকম যে কারুর বাড়ি, কখনো গোটাটা বা কখনো কোন একটা ঘর (কখনো তো শুনেছি শুধু একটা কাউচও) ভাড়া দেওয়া হয়। আইডিয়ালি বিএনবি অর্থাৎ বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট। হোটেলে থাকার চেয়ে তুলনামুলকভাবে সস্তা হয়। আমরা ছিলাম আলেকজান্দ্রিয়ার বাড়ি। একটা ডাবল বেডরুম আমাদের বুক করা ছিল। এ ছাড়া লিভিং রুম, ওয়াশরুম এবং কিচেনে যাওয়ার অনুমতি ছিল। সুজাতা একদম ভোরবেলা পৌঁছে গিয়েছিল। ও আলেকজান্দ্রিয়ার থেকে চাবি নিয়ে রেখেছিল। হোটেলের তুলনায় এয়ারবিএনবির আরো একটা সুবিধে হল, চেক ইন চেক আউটের সময় নিয়ে বেশ ফ্লেক্সিবল। তাই ঘর খালি ছিল বলে ওকে দুপুরের আগেই ঢুকতে দিয়েছিল। আমরা যখন স্টেশন থেকে এলাম, দেখলাম বাড়ি ফাঁকা। প্রসঙ্গত আগামী তিনদিন আলেকজান্দ্রিয়া বাড়ি আসেনি। গোটা বাড়ির স্বাধীনতা ছিল আমাদের। লাগেজ রেখে ফ্রেশ হয়ে ঠিক হল কিছু খেতে হবে। দুপুরবেলা। আর সাথে কিছু বাজার করতে হবে ব্রেকফাস্টের জন্য। আমরা অ্যাপ দেখে বেরোলাম। হাঁটা পথের মধ্যেই ছিল একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। ব্রিঘাম রোড চাইনিজ। ম্যাপ দেখছি। অথচ কিছুতেই দোকান খুঁজে পাচ্ছিনা। চর্কির মতো চক্কর কাটছি। একবার ভাবলাম তাহলে হয়তো ডিপারট্মেন্টাল স্টোরের মধ্যে রয়েছে। সেখানে খুঁজতে ঢুকলাম। দোকান পেলাম না বটে। কিন্তু স্টপ অ্যান্ড শপে হদিস পেয়ে গেলাম আমাদের ব্রেকফাস্টের জিনিসপত্র। প্রচুর ফল সবজি দুধ ডিম ব্রেড কেক রান্না করা প্যাকেজড খাবারের বিরাট সম্ভার। এ ছাড়াও সাধারণ ডিপারটমেন্টাল স্টোরের মতই সব কিছু রয়েছে। গুগল ম্যাপ ভুল বলবে, কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলনা। আবার বেরোলাম। অনেক কষ্টে খুঁজে পেলাম। মেনু কার্ড দেখে তেমন কিছু না বুঝে অর্ডার তো করলাম একটা লার্জ চিকেন ফ্রায়েড রাইস। বিল দেওয়ার সময় প্রথম জানলাম অ্যামেরিকার টিপিং কালচার। অন্তত ১০ থেকে ১৫ শতাংশ টিপ দেওয়াটা অলিখিত নিয়ম। দোকানটি সেলফ সার্ভিস। খাবার এলো একটা কাগজের বাক্সে, প্লেট নিয়ে আমরা খাওয়া শুরু করলাম। আমাদের কেরলের সিগনেচার মোটা চালের মতো চাল, আবার অনেক সয়া সস ঢালায় বেশ খয়েরি। ভর্তি চিকেনের টুকরো। কিন্তু বিশেষ স্বাদ নেই। কোনমতে আদ্ধেক খেয়ে বাকিটা প্যাঁক করে নিলাম। ডিনারে কিছু একটা ব্যবস্থা করা যাবে ভেবে।
এরপর আবার স্টপ অ্যান্ড শপ থেকে ডিম দুধ ফল আর আমার জন্য লেমোনেড নিলাম। সাথে লেমন টারট। খুব পছন্দের খাবার আমার। ডিম নিলাম কিন্তু টেট্রাপ্যাকে। কত কিছুই দেখবো! বেশ ডিম ভাঙ্গার চিন্তা নেই। ফ্যাটানোও সোজা। বাড়ি ফিরে সব ফ্রিজে চালান করে সটান বিছানায়। পর্দা টানা। ঘরে তাই আলো নেই। সেন্ট্রাল কুলিং। অ্যাডজাস্ট করার জন্য আবার আলেকজান্দ্রিয়াকে ফোন করতে হবে। ধুর, কম্বল লেপ আছে। গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ো। কিন্তু ঘুমবো বললে কি ঘুম হয়? এত বছর পরে দেখা। গল্পের স্টক যে উপচে পড়ছে। তার মধ্যেও প্রচণ্ড ক্লান্তির জেরে ঘন্টাখানেক ঘুমলাম। পাঁচটার পর উঠে ঠিক হল পরেরদিন যেখানে কনফারেন্স, সেইখানে একবার ঘুরে আসলে হয়। এমনিও পরেরদিনেই আমার পোস্টার প্রেজেন্টেশন, আজ টাঙ্গিয়ে আসতে পারব।
রেডি হয়ে বেরোলাম। সাড়ে পাঁচটা। ঝলমলে আলো। কে বলবে এই সময়। ঘড়ি না দেখলে খালি মনে হবে দুপুর দুটো হয়তো। আবার ম্যাপের শরণাপন্ন হলাম আমরা। দেখাচ্ছে হাঁটা পথে মিনিট কুড়ি পঁচিশ। পরে হাঁটতে গিয়ে বুঝেছিলাম যে ওইসব বুঝি মার্কিনী পায়ের মাপ অনুযায়ী। আমার এই এইটুকু (সত্যি বলছি। আমার জুতোর মাপ ২ থেকে ৩) পা ফেলে ফেলে পৌঁছলাম প্রায় চল্লিশ মিনিট পর। অবশ্য চারিদিকে রাস্তা দেখতে দেখতে। পথে পড়ল ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিট্যুট অফ ডিজাইনের বিল্ডিং। বেশ মডার্ন আর্ট মার্কা দেখতে। নর্থ ইস্টার্ন ইউনিভারসিটি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে। প্রচুর দোকান। বিশাল বিশাল বাড়ি। নীলচে রঙের না হলেও কাঁচের ওপর নীল আকাশের রিফ্লেকশন। আমাদের তুলনায় উল্টোদিক দিয়ে গাড়ি যায়।
প্রচুর গাড়ি। বাসও চলছে। বাসগুলোর নির্দিষ্ট স্টপেজ রয়েছে অবশ্যই। সুন্দর ছাউনি দিয়ে বানানো স্টপ। আবার রাস্তার মাঝখান দিয়ে টি-লাইন চলে গিয়েছে। মাঝে মাঝে ঘটাং ঘটাং করতে করতে ট্রেন যাচ্ছিল। ওই চারতে কম্পারটমেন্টের। আমরা যে রাস্তা ধরে যাচ্ছিলাম, হান্টিংটন অ্যাভেন্যু, সেটার ওপর দিয়ে টি-এর গ্রিন লাইন যায়। এছাড়াও ছিল অরেঞ্জ, রেড, ইত্যাদি। বাসে উঠে একজ্যাক্ট চেঞ্জ দিতে হয়। আর একবারের টিকিট কাটলে অনেক খরচ সাপেক্ষ হয়ে যায়। আমরা ভেবেছিলাম তাই যে চার্লি পাস কিনব। চার্লি পাস মানে ওই আমাদের মান্থলির ভাই। তবে মিনিমাম সাতদিনের জন্য কিনতে হত। দুজনের জন্য খরচ ৪২ ডলার। হিসেব করে দেখলাম, তিনদিনে মোটেই খরচ করতে পারব না। উসুল হবেনা। বরং অনেক খরচ। তার চেয়ে ভালো ওয়েদার, হাঁটা যাবে সহজেই। খুব অসুবিধে হলে উবার বা লিফট শেয়ার। অ্যামেরিকার রাস্তায় ট্রাফিক রুল খুব ভালো ভাবে ফলো হতে দেখেছি (অবশ্য ন্যু
ইয়র্কে পরে একটু অন্যথা দেখেছি বই কি!)। এবং পথচারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া
হয়। মানে ধরুন সিগনাল সবুজ, তাও আপনি রাস্তা ক্রস করতে নেমে গিয়েছেন, গাড়ি
কিন্তু থেমে আপনাকে জায়গা করে দেবে। একটুও না রেগে। আরো একটা ব্যাপার
দেখলাম। কিছু কিছু রাস্তায় সুইচ টিপে দিলে সাময়িকের জন্য লাল সিগনাল হয়ে
যায় যাতে পথচারী রাস্তা পেরোতে পারেন। বেশ অবাক করা ব্যাপার কিন্তু!
হাঁটতে হাঁটতে এদিক সেদিক খচাখচ ক্যামেরাতে ছবি তুলতে তুলতে অবশেষে পৌঁছলাম ম্যারিয়টে। আমাদের কনফারেন্সের ভেন্যু। বাবা রে, কী বিশাল। ভাগ্যিস আমাদের প্রোটিন সোসাইটির বোর্ড টাঙ্গানো ছিল জায়গায় জায়গায়। দেখে টেখে রেজিস্ট্রেশন ডেস্কে পৌঁছলাম। নাম রেজিস্টার করে এরপর গেলাম পোস্টার একজিবিশন হলে। সুজাতাই লাগিয়ে দিল আমার পোস্টারটি। একটু ছবি টবি তোলা হল। ব্যস। আজকের মতো কাজ শেষ। আবার টুকটুক করে হেঁটে হেঁটে ফিরলাম ট্রিমন্ট স্ট্রিটে আমাদের বাসস্থানে। এবারে দেখলাম কখন কে জানে আমরা একটা লেফট টার্ন মিস করেছি, কিন্তু তাতে দিব্যি সোজা রাস্তায় পৌঁছে গিয়েছি। অর্থাৎ, গুগল ম্যাপ সব সময় ঠিক বলেনা!
রাত্রে ফিরে ভীষণ টায়ার্ড দুজনেই। যে যার বাড়িতে ফোন করে, মোবাইল চার্জে বসিয়ে দিলাম। ডিনারে ওই দুপুরের লেফট ওভার ফ্রায়েড রাইস আর ডিম ভাজা খেয়ে পরেরদিন সকালের অ্যালার্ম সেট করে শুয়ে পড়লাম লেপের তলায়, অসম্ভব নরম বিছানায়। বস্টনে প্রথম দিন শেষ।
No comments:
Post a Comment