Friday, August 3, 2018

আম্রিকা দর্শন : পর্ব ২

কম্প্যুটার খুলে প্রথম কাজ যেটি করলাম, তা হল কনসুলেটের ওয়েবসাইটে স্ট্যাটাস দেখা। প্রথম ধাক্কা খেলাম সেখানেই। যেই কেস নম্বর লেখা আমার ফর্মে, সেটি দেখাল নন একজিস্টিং। অ্যাপ্লিকেশন  নম্বর দিয়ে এবারে দেখলাম। তারপরে যেই লাইনগুলি দেখলাম, তা মোটামুটি আমার মাথায় পুরোপুরি গেঁথে গিয়েছে। কারণ আমি পরবর্তী সত্তর দিন ওই একই লাইন কটি দেখেছি। Your visa is under administrative processing. It is usually resolved within 60 days, however, it may vary from case to case.
তখনো গা করিনি বিশেষ। দিব্যি বেড়াতে চলে গিয়েছি রাজস্থান। ইতিমিধ্যে আমার ল্যাবেরই আরও যেই তিনজনের যাওয়ার কথা ছিল আমার সাথে, ওদের ইন্টারভ্যু হয়ে গিয়েছিল। দুজন দিনে দিনে পেয়ে গেল। দশ বছরের ছাড়পত্র। আরেকজনের আমার মতোই অবস্থা। ইন্টারভ্যু দেওয়ার দশদিনের মাথায় যখন আমি পুষ্কর লেকের ধারে ঘুরছি, আমার কাছে কনসুলেট থেকে ফোন এলো। এবং দুর্ভাগ্যবশত ফোনের একটা কথাও শুনতে পারলাম না। এদিকে তারপর বার বার ওদের ফোন করার চেষ্টা করেও কোন কিছু হলনা। ইনকামিং হয়না বোধহয়। তারপর ইমেল করলাম। জানতে পারলাম পরেরদিন যে আরও কিছু ডকুমেন্টস ওদের লাগবে। সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি পাঠালাম। ব্যস। আর কোনরকম কোন আপডেট নেই। এরপরের পঞ্চাশদিন যে আমার কী বিচ্ছিরিভাবে কেটেছিল, সেটা বোধহয় আর লিখে বোঝাতে পারবনা। প্রতিনিয়ত কনসুলেটের ওয়েবসাইট ট্র্যাক করা, হেল্পডেস্কে মেল লেখা, ফোন করা, ফেসবুকে কনসুলেটে যোগাযোগের চেষ্টা - হেন জিনিস নেই যা করিনি। এমনকি আমার সুপারভাইজারের সাহায্যে স্যান ফ্র্যানসিস্কোতে ইন্ডিয়ান কনসুলেটের এক ভদ্রলোকের সাহায্যেও অ্যামেরিকান কনসুলেটে যোগাযোগের চেষ্টা করি। এমারজেন্সি হিসেবে যদি ধরে। কিন্তু না। আমার চল্লিশ হাজার টাকা জলাঞ্জলি দিয়ে হতভাগা ভিসাটি এলো ঠিক যেদিন আমার স্যান ফ্র্যানসিস্কো থেকে ফেরার কথা, সেইদিন সকালে। বাকিরা ইতিমধ্যে ঘুরে ফিরেও এসেছে। যে ভিসা পাওয়ার জন্য আমি তার আগে পর্যন্ত হন্যে হয়ে ঘুরেছি, পাগলের মত যে যেখানে যা সাজেশন দিয়েছে, পরায় সব উপায় খুঁজেছি, সেটা যেদিন জানতে পারলাম মেলে যে অ্যাপরুভ হয়েছে, একটা অদ্ভুত রকমের অনুভূতি হয়েছিল। এমনকি এতটাই নিরাসক্ত গোছের একটা ব্যাপার এসে গিয়েছিল যে পাসপোর্টটা পর্যন্ত নইতে যেতে ইচ্ছেই করছিল না। নেহাত বাবা মা খুব তাড়া দিচ্ছিলেন। তাই হাতে নিয়ে এলাম। সেই বহুকাঙ্খিত অ্যামেরিকান ভিসাসহ আমার ভারতীয় পাসপোর্ট।
ভিসার মেয়াদ আগামী ফেব্রুয়ারি অবধি। আরেকটি কনফারেন্সের কথা খুঁজে জানলাম। সেই কনফারেন্সটি বস্টোন শহরে হবে। ভিসাটির সদ্ব্যবহার করতে অ্যাপলাই করে দিলাম। এবং পেয়েও গেলাম। এইবারে গন্তব্য পূর্বদিক। কিন্তু না আঁচাতে বিশ্বাস নেই, এই অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছি ততদিনে। তাই বড় মুখ করে তেমনভাবে কাউকে বলতেও পারছিনা। স্যান ফ্র্যানসিস্কোর সমস্ত প্ল্যানিং তো ততদিনে আডিয়ার নদীর জল থেকে বিচিত্র নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্যাসিফিক ওশেনে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। তবুও সুযোগ পেলে ঘুরব না, এমন তো হতে পারেনা। আর তাই অল্প হলেও পরিকল্পনা শুরু করেছি। শুধু প্রতিবার একটাই চিন্তা। এবার যেন প্ল্যানগুলো অতলান্ত জলে না ডুবে যায়। আমার যা কপাল! এই কনফারেন্সে আমার অতি প্রিয় বান্ধবী সুজাতারও আসার কথা। ও থাকে সিয়াটেলে। ওখানেই পি এইচ ডি করছে। চার বছর পর দেখা হবে ওর সাথে। ভাবতেই পুলক জাগছে মনে। এদিকে ন্যু জার্সিতে আমার এক্কেবারে স্কুল লাইফের বেস্ট ফ্রেন্ডের বাড়ি। আবার পিসিরও বাড়ি। মানে যাকে বলে পুরো জমে ক্ষীর প্ল্যান। এখানে যাবো, সেখানে যাবো।
যত যাওয়ার দিন এগিয়ে আসে, ভিতরে ভিতরে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। ৬ই জুলাই রাত্রের প্লেন। সরকারি টাকায় যাওয়া, তাই এয়ার ইন্ডিয়া বাধ্যতামূলক। আমার রুটটি ছিল চেন্নাই থেকে বম্বে, তারপর বম্বে থেকে সিধে নেওয়ার্ক। নেওয়ার্ক হল ন্যু জার্সিতে আর ন্যু ইয়র্ক আর ন্যু জার্সি আবার আমাদের হাওড়া কলকাতার মতোই ব্যাপার। আমি তো মোটামুটি এক তারিখ থেকেই ঠকঠক করে কাঁপছি। এই না কিছু ভুলভাল করি, এই না আমায় বিদেশ বিভূঁইয়ে অ্যারেস্ট করে ফেলে। না জানি কী কেলোর কীর্তি করব (নিজের ওপর বিশেষ ভরসা নেই যে), ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেক লিস্টি বানিয়ে টানিয়ে শেষ মুহূর্ত অবধি দরকারি অদরকারি জিনিসপত্র কিনে টিনে অবশেষে ৬ তারিখ দুপুরবেলা যখন ল্যাব থেকে ফিরলাম, তখন হল গিয়ে আমার যাবতীয় প্যাকিং কমপ্লিট। সেদিনও সকাল সকাল বেরিয়ে থিক খুচখাচ জিনিসপত্র কিনেই চলেছি, বিশেষ করে ওষুধপত্র। আবার লাস্ট মোমেন্টে মনে পড়া ব্যাগের মেরামতিও করিয়েছি। শুধু ভাবছি, একবার প্লেনে উঠে পড়ি, ব্যস। চেইন কী শ্বাস নেব। কিন্তু বিধাতা যে একেকজনের একেক রকম পরিকল্পনা করে রাখেন, সে মনীষীরা যুগ যুগ ধরে বলে এলেও তেমন পাত্তা দিইনি। ইতিমধ্যে যেনে গিয়েছি যে আমার রাত্তির ৯টার ফ্লাইটটি এক ঘণ্টা ডিলেড হয়েছে।  কিন্তু যেহেতু অস্বাভাবিক দামের জন্য ওয়েব চেক-ইন করিনি (ইন্টারনেটের তথ্য অনুযায়ী ঠিক করাই ছিল। যদিও প্রথম ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট, তবুও জানলার ধার চাইনে আমার। আমার অবশ্য করেই আইল সিট চাই। এদিকে ওয়েব চেক-ইন করতে গেলে একেকটি আইল সিট দেখাচ্ছে হাজারের ওপর বাড়তি টাকা। একেই ইন্সটিট্যুটের বেঁধে দেওয়া টাকা রয়েছে, যত কমে সবকিছু করা যায় সেটাই দেখতে হচ্ছে প্রতি মুহূর্ত), তাই আমার পূর্ব নির্ধারিত সময়েই বের হওয়ার প্ল্যানটি বহাল রইল।
অ্যাপ ক্যাবের ওপর আমার খুব বিশ্বাস। খুব ভরসা। আর তাই হোস্টেল থেকে এয়ারপোর্ট যাওয়ার জন্য মহামান্য ওলাতে ক্যাব প্রি-বুক করলাম। আমার অভ্যেস কোথাও যাওয়ার হলে আগেভাগে পৌঁছে যাওয়া। হাতে বেশ অনেকটাই সময় নিয়েই প্রি-বুক করলেও শেষ মুহূর্তে মিনি প্যানিক অ্যাটাক দিয়ে আধ ঘণ্টায় ছ-ছটা গাড়ি ক্যান্সেল করল বুকিং। আমার প্ল্যান সন্ধ্যে ছটার মধ্যে এয়ারপোর্ট পৌঁছতেই হবে। এদিকে পৌনে ছটাতে আমি ফ্যালফ্যাল করে হোস্টেলের সামনে লটবহর নিয়ে রয়েছি। লটবহর বলতে বান্ধবীর পইপই করে বলে দেওয়ার ফলে একটি ব্যাকপ্যাক যার ওজন পরে মেপে জানলাম সাড়ে পাঁচ কেজি (তার মধ্যে দুই কেজি মিনিমাম হবেই আমার ক্যামেরাটি), একটি ট্রলি স্যুটকেস (আট কেজির আশেপাশে ওজন) গলায় একটি স্লিং ব্যাগ যার মধ্যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র রয়েছে এবং সবচেয়ে জরুরি জিনিসটি, অর্থাৎ আমার পোস্টারটি। সব কিছুরই একটা যথাযথ সময় আছে, আর তাই ঠিক আধ ঘণ্টার হয়রানির পর এক সদয় ওলা ড্রাইভার আমার রিকুয়েস্ট মেনে এলেন। বন্ধুদের যাদের আসার কথা ছিল আমায় ড্রপ করতে, তারা শেষ মুহূর্তে কাজে আটকে গেল। অগত্যা আমি একাই দুগগা দুগগা বলে রওনা দিলাম।  ততক্ষণে টেনশন করে এমন অবস্থা হয়ে গিয়েছে আমার যে ক্যাম্পাসের মেন গেটে গিয়ে ড্রাইভারকে বলছি, একটু গাড়ি থামাবেন? দেখব পোস্টারটি নিয়েছি কি না। ড্রাইভার মহাশয় ততক্ষণে আমার কাউন্সেলরের রোল নিয়ে নিয়েছেন। ইতিমধ্যেই ক্যাব ক্যান্সেল করা কিভাবে রুখতে হয়, সেই নিয়ে মিনি ট্যুটোরিয়াল দিয়ে দিয়েছেন। এবারে আশ্বস্ত করলেন যে পোস্টারটি তিনি নিজে ভরেছেন। আমি যেন টেনশন না করি। গাড়িতে যেতে যেতে বাড়িতে এবং এক বন্ধুর সাথে কথা বলে টলে অবশেষে পৌঁছলাম চেন্নাইয়ের আন্না ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যে ছটা তেতাল্লিশ (ওলার বিল মেলালাম)।

No comments:

Post a Comment