ক্যাবের থেকে লাগেজ নামিয়ে কোনক্রমে তো এয়ারপোর্টে ঢুকলাম। পাঁচ বছরের ডোমেস্টিকে ট্র্যাভেল করার ভিত্তিতে জানি মূলত তিনটি স্টেপ রয়েছে। ১। প্রথমেই চেক-ইন লাগেজ স্ক্যান করাও। ২। বোর্ডিং পাস নাও। ৩। নিজের সিকিউরিটি চেক করাও (সাথে কেবিন লাগেজ থাকলে, সেটিও)। ইন্টারন্যাশনালের ক্ষেত্রে জানি এক্সট্রা একটা পয়েন্টঃ ইমিগ্রেশন। আমার বান্ধবী মধুরিমা (যার কাছে কিনা যাচ্ছি ন্যু জার্সিতে), সে তো আমায় ছোট থেকেই চেনে। তাই আমার কাণ্ড কেরামতি যে কতদূর হতে পারে, সব জানে। ও আমায় কলকাতা মেট্রোতে চাপা শিখিয়েছিল। এই ক্ষেত্রেও পাখি পড়ার মত করে সব শিখিয়ে দিয়েছিল। কাউন্টারে গিয়ে ঠিক কী কী বলতে হবে, কোথায় কখন কী চাইতে পারে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার যে বন্ধুরা ফেব্রুয়ারিতে স্যান ফ্র্যানসিস্কো গিয়েছিল, তাদের থেকে খুব বেশি উপদেশ পাইনি। তাও সব মিলিয়ে আমি তো ভিতরে ঢুকে পয়েন্ট ১ থেকে খোঁজা শুরু করছি। হন্যে হয়ে এদিক সেদিক করছি। কোথাও তো লাগেজ স্ক্যানের কিছুই দেখিনা। তারপর লজ্জা টজ্জা কাটিয়ে এক এয়ারপোর্ট কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করলাম, "আন্না এয়ার ইন্ডিয়ার লাগেজ স্ক্যানিং কোথায় হবে?" উনি একটু অবাক হয়ে বললেন যে সেসব নেই। ডাইরেক্ট লাগেজ চেক-ইন করে দিতে হবে। ভাবলাম কে জানে, ইন্টারন্যাশনাল, ব্যাপার স্যাপার আলাদা। পরে জেনেছিলাম যে এই নিয়ম চেন্নাই এয়ারপোর্টে হালফিলেই হয়েছে কারণ ফেব্রুয়ারিতে ওদের কিন্তু স্ক্যান হয়েছিল।
খুঁজে টুজে কাউন্টারে গেলাম। কয়েকজনের পরেই লাইন। পাসপোর্ট ধরালাম। সাথে টিকিটের এক কপিও। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, কিছুদিন যাবত আমি আমার দুটো ফ্লাইটই (চেন্নাই থেকে বম্বে এবং বম্বে থেকে নেওয়ার্ক) ট্র্যাক করার ফলে দেখেছি যে প্রথমটি মাঝে মধ্যেই বেশ দেরি করছে। সম্ভবত বম্বের বৃষ্টির জন্য। আর তাই দ্বিতীয়টি ডিলেইড হচ্ছে। আমার ক্ষেত্রেও তাই হতে পারে, তেমন হলে দৌড়তে হতে পারে ভেবে ডোমেস্টিক ফ্লাইটে একদম প্রথম সারিতে (মানে ইকোনমির প্রথমে) সিট নিয়েছিলাম। আমি অল্প হলেও ক্লস্ট্রোফোবিক। উইন্ডো সিট নিইনি তাই। কাউন্টারের ভদ্রলোককে যখন টিকিটটা দিলাম, মিষ্টি করে হেসে বললাম, "ক্যান আই হ্যাভ অ্যান আইল সিট ফ্রম দ্য মিডল ব্লক প্লিজ ফর মাই ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট?" উনি কিছু বললেন না। খানিক কম্প্যুটারে কী চালিয়ে টালিয়ে তারপর হাতে ধরালেন বোর্ডিং পাস। ওহ, আমি এর মধ্যে মধুরিমার শেখানো অনুযায়ী বলে দিয়েছি যে লাগেজ কিন্তু নেওয়ার্ক পৌঁছেই নেব। উনি আমায় লাগেজ ট্যাগটা দেখালেন। MAA EWR লেখা। আশ্বস্ত করলেন যে আমার কথা অনুযায়ী ঠিকঠাক জায়গাতেই যাবে। তারপর একবার পিঠের ব্যাগটার ওজন করলেন। ব্যস। ছাড়পত্র পেয়ে গেলাম। এবার গন্তব্য ইমিগ্রেশন। আবার একটু হাবাগোবার মত এদিক সেদিক দেখেশুনে পৌঁছলাম ঠিক জায়গায়। সেখানে এক প্রস্থ লাইন। দাঁড়ালাম। সময়মত কাউন্টারেও পৌঁছলাম। প্রথম প্রশ্ন, "ইঙ্গে পোনা?" ভাবলাম অ্যাঁ, পোনা মাছের কী বলছে? সিঙ্গি পোনা কীসব। ক্ষণিকের ভ্যাবাচ্যাকা কাটিয়ে ততক্ষণে যদিও বুঝে গিয়েছি তামিল ভাষায় জিগ্যেস করছেন কোথায় যাচ্ছি, কিন্তু ইতিমধ্যে আমার মুখে এক বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন (আজকাল আমি একদম মনের ভাব মুখে প্রকাশ না করে থাকতেই পারিনা, খুব মুস্কিলের ব্যাপার)। উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, এইবার ইংরেজিতে। কোথায় যাচ্ছি। বললাম। পাসপোর্ট দেখলেন। যেই ঠিকানায় কলকাতা লেখা দেখেছেন, অমনি "আ, বেঙ্গলিয়া? কতায় যাচ্ছে?" ওই যে বাঙ্গালি দেখলে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলার এই আদেখলাপনা, সত্যি বলছি, বিরক্ত লেগে যায়। যাই হোক, ডিপারচারের আগে বাধ্যতামূলক ছবি তুললেন, তারপর স্ট্যাম্প মেরে দিলেন। অর্থাৎ, ব্যস। দেশ থেকে এই বের করে দিলেন আমায়।
ইমিগ্রেশন পর্ব মিটিয়ে তারপরে লাইন দিলাম সিকিউরিটি চেকিংএ। লম্বা লাইন খুব একটা না। মিনিট পনেরো পর সব মিটিয়ে টিটিয়ে একটু থিতু হয়ে বসলাম। বাড়িতে ফোন টোন সারলাম। ইতিমধ্যে দেখাচ্ছে ফ্লাইট আরও ডিলেইড। দশটার আগে ছাড়বেনা। আমি ওয়েটিং এরিয়াতে পৌঁছে একটা চারজিং পয়েন্টে ফোনটা লাগিয়ে (আমি আবার এই বিষয়ে অত্যাধিক বাতিকগ্রস্ত। ফোনে সবসময় চেষ্টা করি ১০০ শতাংশ চার্জ রাখতে। নইলে কেমন প্যাল্পিটেশন হয়। অথচ সাথে কিন্তু ফুললি চারজড পাওয়ার ব্যাঙ্ক রয়েছে, তাও) পরপর বন্ধুবান্ধবদের, কিছু নিকট আত্মীয়দের ফোন করলাম। এত কিছুর পরেও দেখি সবে আটটা পনেরো। অত্যন্ত বোর্ড হচ্ছিলাম। তবে ত্রাতা হয়ে তখন এক বন্ধু এলো ওয়াটসঅ্যাপে এবং তারপর ফোনে। তার সাথে প্রায় রাত্তির সাড়ে দশটা অবধি গল্প করলাম, নানান বিষয়ে। প্রচুর ইনপুট পেলাম লেখালিখি নিয়ে। এর মধ্যে জেনে গিয়েছি, ফ্লাইট এগারোটার আগে ছাড়বেনা। একটু চিন্তা হল। পৌছতে দুই ঘণ্টা। পরেরটা রাত দেড়টায় রাইট টাইম। ছোটাছুটি করতে হবে। খিদেও পেয়ে গিয়েছিল। সাথে আবার ঘুমও। আমি সাধারণত এগারোটার দিকে শুয়ে পড়ি। অথচ সেদিন একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি। একদিকে হাই উঠছে সমানে, অন্যদিকে চরম উত্তেজনা। অবশেষে সাড়ে দশটার পর বোর্ডিং শুরু হল। সেখানেও সেই লাইন। আবার প্রতীক্ষা। যখন সবকিছু মিটিয়ে প্লেনটা চেন্নাইয়ের আকাশে উড়ল, রাত সোয়া এগারোটা বেজে গিয়েছে। আমার জেথুর মেসেজ ততক্ষণে ফোনে ঢুকেছে। "এয়ারহোস্টেসকে বলবি পরের ফ্লাইটের কথা।"
লাগেজ নিয়ে দৌড়তে হবে ভেবেই আমি ব্যাকপ্যাক আর পোস্টারটা পায়ের সামনে রেখেছিলাম। কিন্তু স্ট্যুয়ারড এসে বললেন যে নিয়ম নেই। আমাদের মাথার ওপরের র্যাক তখন ভরে গিয়েছে। আমি আবার হাইটের দিক থেকেও চ্যালেঞ্জড। উনি তাই আমার মালপত্র বিজনেস ক্লাসের কেবিনে তুলে দিলেন। যথাসময়ে ডিনার এলো। জিরা রাইস গোছের কিছু আর সাথে দুই রকম তরকারি থাকার কথা। আমার কপাল এমন, দুইদিকে দেখলাম একই তরকারি। যাক গে, পনির ছিল। তাই কিছু বলিনি। প্লাস তখন চোখে ঘুম। চকোলেটটা ব্যাগে পুরে কফি না খেয়ে কোনমতে একটু দুই চোখের পাতা এক করলাম। ঘন্টাখানেক পর চোখ মেলে দেখি প্রায় পৌনে একটা। এয়ার হোস্টেসকে ডেকে জানালাম পরের ফ্লাইটের কথা। তিনি ঘড়ি দেখে বললেন, "যদিও আমাদের শিডিউল অনুযায়ী সোয়া একটায় বম্বেতে ল্যান্ড করার কথা, কিন্তু আমি অ্যাশিউরেন্স সিচ্ছি। আমরা পারব না। চক্কর কাটতেই থাকে প্লেন। তাও আমি পাইলটকে বলছি এটার কথা। তবে আপনি চিন্তা করবেন না। কানেক্টিং ফ্লাইট, কিছু একটা ব্যবস্থা হবে।" ভাবুন তখন আমার অবস্থাটা। জানি কানেক্টিং ফ্লাইট ইত্যাদি, কিন্তু প্ল্যানের সব চৌপাট হয়ে যাবে যে। ল্যান্ডিঙের একটু আগে হোস্টেস ঘোষণা করলেন। নেওয়ার্ক যাওয়ার প্লেনটি আমাদের জন্য অপেক্ষামান। তাই আমাদের সবার আগে ডিপ্লেন করানো হবে। প্লেনটা মাটি ছুঁতেই কোনমতে এর তার সাহায্য নিয়ে কেবিন থেকে লাগেজ নামালাম (ঠ্যাকায় পড়লে মানুষ যে কত হাইট স্কেল করতে পারে, আমায় দেখেই বোঝা যায়!)। লাইন দিয়ে আমরা জনা বারো দাঁড়িয়ে। এদিকে এয়ার ইন্ডিয়ার বাসের কোন দেখা নেই। তখন প্রতি মুহূর্ত অমূল্য। পাঁচ সাত মিনিটের অপেক্ষার পর বাস এলো। বাইরে তখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। ভাবলাম যেহেতু ইমিগ্রেশন হয়ে গিয়েছে, বুঝি ডাইরেক্ট প্লেনে নিয়ে যাবে। ও মা। সে গুঁড়ে বালি। আমাদের নিয়ে গেল আবার টার্মিনালে। সেখানে জায়গায় জায়গায় এয়ার ইন্ডিয়ার স্টাফ রয়েছেন, আমাদের তাড়া দিচ্ছেন। রীতিমত দৌড়ে দৌড়ে পৌঁছলাম সিকিউরিটি চেকে। সেখানে এক প্রস্থ ঝঞ্ঝাট। জেটের কলোম্বোর ফ্লাইট রাত দুটোয়, ডিলেড। ওদের প্যাসেঞ্জারদের চেক আগে হবে না আমাদের। জেট প্রাইভেট কোম্পানি, স্টাফের গলার জোর বেশি। এয়ার ইন্ডিয়ার ভদ্রলোক শান্তশিষ্ট। শেষমেশ আমরা প্যাসেঞ্জাররা প্রায় গায়ের জোরে ঠ্যালাঠেলি করে নিজেদের চেকিং করালাম। তারপর আবার শুরু দৌড়। এ যেন বিরাট ম্যারাথন। উফ। বম্বের এয়ারপোর্ট এত সুন্দর, অথচ সেইসব দেখতেই পাচ্ছিনা। সময় নেই। মনে মনে প্ল্যান করছি, ফেরার পথে দেখব সব। যখন ভাবলাম এই বুঝি গেটে পৌঁছলাম, দেখি ধুর, আবার সিকিউরিটি। এখানে আবার আরো কড়াকড়ি। জুতো খুলিয়ে তাও স্ক্যান করতে হবে। নিজের চেক করে আবার ব্যাগ জুতো নিয়ে দৌড়তে শুরু করেছি (মনে মনে গুনে নিচ্ছি যে ও, ট্রে থেকে এই কটা জিনিস নামাতে হবে), আমার সাথে একজন ভদ্রমহিলা ছিলেন একই ফ্লাইটের, বললেন "আরে তুমি তো তোমার পোস্টার ফেলে যাচ্ছ"। আবার ফিরলাম। ভাবুন শুধু। যার জন্য এত কিছু, তাই ফেলে যাচ্ছিলাম (অবশ্য ব্যাক আপ প্ল্যান ছিলই)। সবকিছু নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়তে দৌড়তে উঠলাম সেই ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটে। বেচারা বাকি যাত্রীরা কখন থেকে বসে আছে। আদ্ধেক তো ঘুমিয়েই পড়েছে। খুঁজে খুঁজে গেলাম নিজের সিটে। তারপরে স্বস্তির নিঃশ্বাস। বাবাকে ফোন করে জানালাম। বেচারা ওঁরাও জেগে বসে আছেন আমার জন্য। ধীরেসুস্থে সেটল হয়ে মাথার ওপর কেবিনে ব্যাকপ্যাক ভরে আর পাশের ব্লকের কেবিনে ওই ভদ্রমহিলার সাহায্যে পোস্টারটি রাখলাম। মনে মনে নোট করে নিলাম, নামার সময় সব নিয়ে নামতে হবে। গলায় শুধু স্লিং ব্যাগটি। ওতে রয়েছে পাসপোর্ট আর পার্স। সিটবেল্ট বেঁধে শান্ত হয়ে বসলাম। বোর্ডিং কমপ্লিট হল। প্লেন ছাড়ল ঠিক রাত দুটো পনেরোয়। মধুরিমাকে মেসেজ করে দিলাম। ও যদিও ট্র্যাক করছিলই। ওকে যে এয়ারপোর্টে আসতে হবে আমায় রিসিভ করতে। সুজাতাকেও জানালাম। আসছি, ফাইনালি!
(ওরে বাবা, বড্ড হাঁপ ধরে গিয়েছে। কালকে বিরাম।)
No comments:
Post a Comment