বাস থেকে তো নেমে পড়েছি। বাসও ফেরত চলে গিয়েছে। সামনে একটা হোটেল। চারিদিকে প্রায় জনমানবহীন কেমন গণ্ডগ্রাম গোছের জায়গা। কিছু ট্যুরিস্ট এদিক ওদিক দেখছি। কিন্তু এবার? হোটেলটির নিচে দেখলাম একটা রেস্টুরেন্ট কাম বার। নাম বলিউড লাউঞ্জ। বিজ্ঞাপন দেওয়া, পনেরো ডলারে আনলিমিটেড ভারতীয় লাঞ্চ ও ডিনার। সে তো না হয় বুঝলাম। কিন্তু ব্রেকফাস্ট? এখানে কী কিছু পাব? মালপত্র নিয়ে কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকলাম। দেখলাম কিছু লোকজন বসে খাচ্ছে। জানালর ধারে একটা টেবিলে আমাদের জিনিসপত্র রেখে কাউন্টারে গেলাম। জানতে পারলাম, ব্রেকফাস্টও আনলিমিটেড, এবং দাম সেই পনেরো ডলার। কিছু করার নেই। ওই খেতে হবে। সুজাতা কার্ডে পে করে দিল। আমরা খাবার লাইনে গেলাম। প্লাস্টিকের ডিস্পোজেবল প্লেট ও কাটলারি। সারি দিয়ে রয়েছে বিভিন্ন খাবারের আইটেম। ব্রেড, অমলেট, হ্যাম, সসেজ, বেকন, পটেটো ফ্রাইজ, কর্ণ ফ্লেক্স, ম্যুস্লি, দুধ, চা, কফি, জুস ইত্যাদি। মধ্যবিত্ত বাঙালি মানসিকতা (নাকি গরীব পি এইচ ডি স্কলারের মানসিকতা, কে জানে?)। দুজনেই ঠিক করলাম, প্রচুর খাব। পারলে যাতে লাঞ্চ না করতে হয়, বা হলেও অল্পের ওপর দিয়ে যায়। দুই তিন রাউন্ড খেলাম। আমার হ্যাম জিনিসটা খুব পছন্দ হয়েছিল। বেকন স্ট্রিপ্স ভালো লাগেনি। বড্ড বেশি নুন। এই প্রসঙ্গে একটা খুব মজার ঘটনা বলি। যখন দেখলাম হ্যাম নিয়ে এসেছে বেশ গরম গরম ভেজে টেজে, আমি তো তখনও জানিনা ওটা কী। বেশ তেল চপচপ করছে। দুর থেকে দারুণ চকচকে। ইন্ডিয়ান দোকান। ভাবলাম , আহা, রসে চোবানো গোল গোল মালপোয়া মনে হয়। ব্যস, জমে যাবে। যে মেয়েটি খাবারটা ঢালছিল, ওকে বললাম (বেশ কনফিডেন্টলি), "এক্সকিউজ মি, ইস দ্যাট মালপুয়া?" মেয়েটি খানিকক্ষণ আমার দিকে "এ কোথাকার কোন গাধা এসেছে, কিছুই জানেনা" লুক দিয়ে বলল যে না, ওইটি হ্যাম। শূকরের মাংস। আমার মধ্যেকার ভানু ব্যানারজী প্রচন্ডভাবে দুঃখ পেয়ে মাংসে মন দিল। দ্বিতীয় রাউন্ড খেতে খেতে আমাদের এয়ারবিএনবি হোস্টকে ফোন করা হল। সে বলল যে না, এখন তো চেক-ইন করা যাবেনা। আগেরদিনের গেস্টের এগারোটায় চেক-আউট। আবার ফোন করা হল জানতে যে লাগেজ ড্রপ করতে পারি কি না। বলল, হ্যাঁ, বেশ, তা করতে পারি। আমরা খাওয়ারের পাট চুকিয়ে ক্যাব ডেকে সাড়ে নটার পর পৌঁছলাম এয়ারবিএনবিতে। অরচারড পার্কওয়ে নাম জায়গাটার। ভীষণ সুন্দর গাছপালায় ভর্তি। রাস্তার দুই দিকেই লম্বা গাছ। বাড়িগুলো মোটামুটি একই প্যাটার্নের। দোতলা। ইন্সট্রাকশান অনুযায়ী আমরা তালা খুলে বাড়ির মধ্যে ঢুকলাম। চারিদিকে নোটিস লাগান। এদিকে যাবেনা, ওদিকে না। ইত্যাদি। একতলাতে একটা লিভিং রুম, কিচেন আর তিনটে বেডরুম আর স্টাডি। একটা বেডরুমে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। সানফ্লাওার রুম লেখা। ছবি দেখেছিলাম ওয়েবসাইটে। দেখলাম কোন গেস্ট নেই। যিনি হোস্ট, ক্রিস্টিন, ওর ঘর বন্ধ। নক করার ইচ্ছে হল না। ঘুমোচ্ছে কি কে জানে। ইতিমধ্যে ওর তিনটে পোষা বিড়ালের দেখা পেলাম, দুটো বড়, লোমশ, সাদা কালো। অসম্ভব মিষ্টি তুলোর বলের মতো। আরেকটা ছোট্ট। দুটো আমাদের সাথে খেলল। সুজাতা আর আমি দুজনেই বিড়াল কুকুর ভীষণ ভালোবাসি। সুজাতার সিএটলে একটা বিড়াল আছেও। আমদের বেশ সময় কাটছিল। তবে এত ক্লান্ত ছিলাম, কখন কে জানে খেলতে খেলতে কার্পেটের ওপর শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছি!
এগারোটার পর ক্রিস্টিন আমাদের ঘর রেডি করে দিল। খুব বেশি কথা বলেনা, তবে বিড়াল ভালোবাসি বলে একটু খুশি হল দেখলাম। স্নান টান সেরে বেরোলাম প্রায় বারোটার পর। ক্যাব নিয়ে নায়াগ্রা স্টেট পার্ক।
অবশেষে। টুকটুক করে হেঁটে হেঁটে এগোলাম। একদিকে দেখলাম সাইনবোর্ড লেখা। ক্যানাডা যাওয়ার রাস্তা। ওইখানেই ইমিগ্রেশনের অফিস রয়েছে দেখলাম। নায়াগ্রা ফলসের এদিকে অ্যামেরিকার নিউ ইয়র্ক স্টেট আর ওইদিকে ক্যানাডার অন্টারিও। যাদের দুই দেশের ভিসা/পাসপোর্ট আছে, তারা সহজেই রেনবো ব্রিজ টপকে এদিক ওদিক করতে পারে। আমাদের ইচ্ছে ছিল নায়াগ্রা সিনিক ট্রলি বলে একধরনের ওই টয় ট্রেন গোছের ট্রেনে ওঠার। সবুজ রঙের, মাঝে হদুদ বর্ডার। তিন ডলারের বিনিময়ে সারাদিনে যতবার খুশি ওঠা নামা করা যায়। মোটামুটি গোটা পার্ক ঘুরিয়ে দেয়। কিন্তু সকাল সকাল প্ল্যান পরিবর্তন হওয়ায় সেটা আর সম্ভব হল না। নায়াগ্রার মূল আকর্ষণ, মেইড অফ দি মিস্ট রাইডটা নিতেই হবে। পার্ক না হয় পরে ঘুরে নেওয়া যাবে যতটা সম্ভব। হাঁটা লাগালাম ডিরেকশন দেখে। একটু এগোতেই দূর থেকে সেই বহু কাঙ্ক্ষিত নায়াগ্রার দর্শনও পেলাম। বিশাল জলরাশির খানিকটা হলেও তো দেখলাম। আহ। যাক।
মেইড অফ দি মিস্ট হল একটি বোট রাইড। ফলসের সামনে দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। নায়াগ্রা ফলসের ওই বিশাল উচ্চতা (পঞ্চাশ মিটার) ও অত চওড়া জলপ্রপাতের সামনে সারাক্ষণই একটা কুয়াশার মতো থাকে। সেটা কিছুই না। ওই জলের কণাগুলিই পড়ে আবার উঠে ভাসে। সেই জন্যই ওই "মিস্ট"। এবং স্বাভাবিকভাবেই যখন বোটটি সামনে দিয়ে যায়, জামাকাপড় ভিজে যাবেই। তাই মেইড অফ দি মিস্টের টিকিট কাটার সময়ই তার সাথে দাম ধার্য করে নেওয়া হয় ওয়াটারপ্রুফ জামার। কিছুই না। নীল রঙের প্লাস্টিকের রেইনকোট গোছের। প্রায় কুড়ি ডলারের কাছাকাছি টিকিটের দাম। হয়ত অনেক, তবুও কিছু কিছু জিনিস হাতছাড়া করা যায় না, উচিতও না। আমরা টিকিট কেটে লাইন দিয়ে অবশেষে পৌঁছলাম বোটে। নামেই বোট, আসলে বিশাল স্টিমার গোছের। পিলপিল করছে লোক। অ্যামেরিকার সাইড থেকে এই ক্রুজটাকে বলে মেইড অফ মিস্ট, আর ক্যানাডার দিকে যেটা হয়, সেটা হরনব্লোয়ার ক্রুজ। ওইদিকের ওয়াটারপ্রুফের রঙ লাল। একেকটা স্টিমারে বেশ কয়েকশো লোক এঁটে যায়। মিনিট কুড়ির রাইড। গাইডের কথা প্রায় শোনাই যায়না লোকের আহা উহুতে। তবে দরকারও নেই। ফলসের ইতিহাস পড়ার জন্য বা জানার জন্য উইকিপিডিয়া রয়েছে। রয়েছে হাজার হাজার বই। কিন্তু ওই যে চাক্ষুস দেখা, অনুভব করা। ওই অভিজ্ঞতা অবর্ণনীয়। গায়ে সমানে জলের ফোঁটা ছিটকে আসছে। ক্যামেরাটাকে কোনমতে বাঁচাচ্ছি প্লাস্টিকে মুরে। ফোন দিয়ে খানিক ছবি তোলা। তারপর ভাবা, ধুর, ক্যামেরা গেলে যাবে। পরে দেখা যাবে। ছবি তো তুলি।
অ্যামেরিকান ফলস, ব্রাইডাল ভেল আর হর্স শু ফলস। এই তিনটি নিয়ে নায়াগ্রা। এই তিনটের মিলিত জলরাশি উত্তর অ্যামেরিকার সর্ব বৃহৎ। হর্স শু ফলসটা অ্যামেরিকা ওর ক্যানাডার বর্ডারে। ব্রাইডাল ভেল আর অ্যামেরিকান ফলস অ্যামেরিকার সাইডে। ব্রাইডাল ফলসটা অ্যামেরিকান ফসলের পাশেই, সরু। আর হর্সশুটা আরো চওড়া। যখন বোট সামনে দিয়ে যাচ্ছিল জলপ্রপাতের, সামনে একটা সাদা জলের বিরাট দেওয়াল রয়েছে মনে হচ্ছিল। ক্রমাগত ওই উচ্চতা থেকে আছড়ে পড়ছে বিরাট জলপ্রপাত। সাদা জল, মাঝে মাঝে নীলচে সবুজ, তার ওপর রোদের ঝিকমিক। স্বর্গীয় অনুভূতি। অপূর্ব। অসামান্য। আরো পঁচিশ ডলার জনপ্রতি খরচ করলে আরেকটা রাইড নেওয়া যায়, কেভ অফ দি উইন্ড। সেটা এক্কেবারে ফলসের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যায়। আমাদের অতটা অ্যাডভেঞ্চারের সাহস ছিল না। মেইড অফ দি মিস্ট করে আমরা পার্কে ফেরত এলাম। তখনও একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছই। কী দেখলাম, কী অসামান্য, ভয়ঙ্কর সুন্দর। এসব কোন কিছু দিয়েই বোঝানো যাবে না আমাদের সেই মুহূর্তের অনুভূতি। মাঝে রাস্তায় ভিউ পয়েন্ট থেকে বাড়িতে ও বন্ধুদের ফোনকরে লাইভ ফলস দেখালাম। ছবি তোলা পর্ব চলল। খানিকক্ষণ তারপর পার্কের ঘাসে গা এলিয়ে ফলস দেখতে দেখতে রেস্ট নিলাম। অল্প খিদে পাচ্ছিল। ফুড স্টলগুলি থেকে আমি হ্যামবার্গার আর সুজাতা চিকেন বার্গার খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে (ম্যাপ দেখে) এয়ারবিএনবিতে ফিরলাম। গোটা অঞ্চলে সেরকমভাবে দোকান বাজার কিছু তেমন নেই, তবে যেটুকু যা দেখলাম, বেশিরভাগই ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট, ইন্ডিয়ান স্টোর, ইত্যাদি। হয়ত প্রচুর ভারতীয় ট্যুরিস্টের যাতায়াত বলে।
বিকেলে লাগেজপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য ফলসের ইলুমিনেটেড চেহারা দেখব। রাত্তির সাড়ে দশটায় বাস। আমরা সাড়ে সাতটার মধ্যে স্টেট পার্কে পৌঁছে গেলাম। সাথে মালপত্র আছে বলে উঁচুতে ভিউ পয়েন্টে উঠলাম না। একটু নিচের দিকে অথচ ফলসকে সুন্দর দেখা যাবে এমন জায়গায় রইলাম অপেক্ষায়। পৌনে নটায় ইলুমিনেশন শুরু হওয়ার কথা। ক্যানাডা আর অ্যামেরিকা, দুই দিক থেকেই ফলসের গায়ে নানান রঙের ফ্লাডলাইট দিয়ে আলো ফেলার ফলে অপূর্ব সিনিক ভিউ হয়। ছবি দেখেছিলাম অনেক। তবে ওই যে আগের এক পর্বে বলেছিলাম, নটার আগে অন্ধকার হয় না। তাই একটু সন্দিগ্ধ ছিলাম। দেখতে পাব তো? মধুরিমা তো বারবার বলেছিল, চান্স খুব কম। পৌনে নটা বাজতে আলো ফেলা শুরু হল। কিন্তু বাইরে তখনও হাল্কা দিনের আলো। তাই তেমনভাবে বোঝা যাচ্ছিল না। সাদার ওপর হাল্কা গোলাপি আভা। আলো আলোর মতো পড়তে লাগল। বর্ডারের ওপারে ক্যানাডার শহরে বাড়িগুলো রাস্তাঘাট বরং বেশি আলো ঝলমলে লাগছিল। জুম লেন্স দিয়ে দেখছিলাম। যেন হাতের মুঠোয় ক্যানাডা। ঠিক নটার একটু পরেই ঝুপ করেই অন্ধকার নামল। তারপর প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে দেখলাম রঙের খেলা। লাল নীল বেগুনি গোলাপি কমলা হলুদ। সে যে কী অপূর্ব রঙের ছটা। অসাধারণ ভিউ। ইচ্ছেই করছিল না ওখান থেকে সরে আসতে। এদিকে বাসের জন্য আসতেই হবে। ডিনারও কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা এই অবিশ্বাস্য সুন্দর নায়াগ্রাকে বিদায় জানিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছেছি সবে, শব্দ পেলাম বাজি ফাটার। তার মানে এই এখন শুরু হল ফলসে ফায়ারওয়ার্কস। দশটার পর থেকে রাত দুটো অবধি টানা চলে। আমাদের কপাল খারাপ। মিস করলাম সেই দৃশ্য। থাক, সব পেলে তো আর আবার ফিরবার টান থাকবেনা, তাই না? না হয় পরের বার এই দৃশ্য দেখবো। একটা ইন্ডিয়ান ফুড ট্রাক থেকে ল্যাম্ব আর চিকেন রোল দিয়ে আমাদের ডিনার হল। সাত ডলার করে জনপ্রতি। এইবারে আমাদের ট্রেলওয়েজের বাস। অনেক বেশি ভালো গ্রেহাউন্ডের চেয়ে। বেশি লেগ স্পেস, কেবিন সুন্দর। মসৃণ। এইবারে আর ভুল নেই। বাসের পেটে সুটকেস। আমরা ভিতরে। পৌঁছলাম বাফেলো। আবার রাত সাড়ে বারোটায় পরের বাস। ন্যু জার্সি যাওয়ার। সেটিও ট্রেলওয়েজের। এই বাসের ড্রাইভার আমাদের সকালের জন। আমাদের দেখে চিনতে পেরে খুব খুশি। আমরাও চেনা মানুষ দেখে নিশ্চিন্ত। বাফেলোর বাস স্ট্যান্ডে সেই ভারতীয় ছেলেটিকেও দেখেছিলাম। ও ফিরে গেল বস্টন। বাস ছুটল গভীর রাতে নর্থ ইস্ট অ্যামেরিকার হাইওয়ে দিয়ে। পথে পড়ল সেরাক্যুজ, আল্বানি। হল্টগুলিতে নামলাম। নামলাম না। একদম ভোরের আলো ফুটতে পৌঁছলাম ন্যু ইয়র্ক। পোর্ট অথরিটির বাস টারমিনাস। বিশাল বাড়ি। সাতশো গেট। একেকটা গেট দিয়ে একেকটা জায়গার বাস। একেক কোম্পানির। ঘুম চোখে কোনমতে ঠিকঠাক গেটে গিয়ে ন্যু জার্সির বাস ধরলাম। পিসিকে জানিয়ে দিলাম। নেওয়ার্ক বাস স্টেশনে নামবো। সেখানে পিসি এসে আমাদের পিক-আপ করবে। এখান থেকে এবার পিসির জিম্মায়।
No comments:
Post a Comment