ন্যু জার্সিতে গ্রেহাউন্ডের বাস টার্মিনালের বাইরে পিসি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। বেশ কিছু বছর পরে দেখা হল আমার বুচু পিসির সাথে। বুচু পিসি ওখানে একটি কলেজের প্রফেসর। প্রায় তিরিশ বছর অ্যামেরিকায় রয়েছে। এখন ব্লুমফিল্ড, ন্যু জার্সিতে থাকে। একটা লালচে খয়েরি রঙের এস ইয়ু ভি গাড়ি চেপে আমরা আধ ঘণ্টার কম সময়ে পৌঁছে গেলাম বাড়ি। এই নিয়ে দ্বিতীয় বার এলাম। প্রথমবারে অনেক বেশি কৌতূহল, উৎসাহ ছিল। তখন সবকিছুই নতুন, গোগ্রাসে গিলছিলাম দৃশ্যগুলি। এইবারে এক সপ্তাহ রীতিমত চষে বেরিয়ে সব সয়ে গিয়েছিল। তখন বরং পিসির সাথে গল্প করতে ব্যস্ত। গাড়িতে হিন্দি বাংলা গান চলছে, আর সাথে আমাদের আড্ডা।
পিসির বাড়িটা দোতলা। একতলায় লিভিং রুম আর ওপেন কিচেন। দারুণ সুন্দর সাজিয়ে রাখা। বড় বড় কাঁচের জানলা। পিছনে ওই সরু একটা ক্যানাল মতো বয়ে যাচ্ছে। সবুজালি। নানান পাখি। দোতলায় দুটো বেদরুমের একটায় আমাদের লাগেজ রেখে হাত মুখ ঢুয়ে নিচে চলে এলাম। পছন্দসই ইয়া বড় অমলেট আর ক্রোসা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম। সাথে কফি। সাথে চলতে লাগল আমাদের পরের দুদিনের প্ল্যান প্রোগ্রাম। কোন কোন জায়গা দেখবো, কী কী শপিং করবো, সব। আর সব কিছুকে একোমোডেট করে একটা প্ল্যান বানানো, এরই মধ্যে মাথায় এলো, আরে রবিবার দুপুরে ফাইনাল রয়েছে। সেইটা কোনভাবেই মিস করা যাবেনা। যাই হোক, মোটামুটি ঠিক হল পরের দিন হপ অন হপ অফ নেবো ন্যু ইয়র্কে। যতটা সম্ভব ঘুরব। রবিবার সেন্ট্রাল পার্ক অঞ্চলে যাওয়ার কথা কাকার বাড়ি (পরে অবশ্য যাওয়া হয়নি), সেই সময়ে ওইদিকটা ঘুরে নেবো। আর আজ বিকেলে যাবো শপিং করতে। এই প্ল্যানে পৌঁছতে প্রচুর অপটিমাইজেশন করতে হয়েছে। আর তার ফলে যেটা হল, ওই অত ব্রেকফাস্ট করেও খিদে পেয়ে গেল দেড়টার মধ্যে। ভাত আলু পটল ঝিঙে পোস্ত পমফ্রেটের ঝাল আর রুই মাছের পাতলা ঝোল দিয়ে লাঞ্চ সারলাম। আহ। কী শান্তি। ওয়াশিং মেশিনে ইতিমধ্যে ছাড়া জামাকাপড় দিয়ে রেখেছিলাম (পুরো নিজের বাড়ির মতো আচরণ করে গিয়েছি তিনদিন), লাঞ্চ সেরে সুজাতা ওগুলোকে ড্রায়ারে দিয়ে দিল। আমরা ভাতঘুম দিলাম যতক্ষণে, ততক্ষণ পিসি নিজের কাজকর্ম সেরে ফেলল।
বিকেল, বা বলা চলে সন্ধ্যেবেলা বেশ ভালো মতো রেস্ট টেস্ট নিয়ে বেরোলাম শপিং করতে। ক্লিফটন শপিং এরিয়াতে প্রচুর দোকান। বারলিংটন, টার্গেট, চার্মিং চার্লি ইত্যাদি ইত্যাদি দোকান ঘুরে ঘুরে প্রচুর কেনাকাটি করলাম। মূলত ওই দেওয়া থোয়ার জন্য। চকোলেট, পারফ্যুম, একটু জামাকাপড় ইত্যাদি। এতই ঘুরেছি, শেষে দোকান বন্ধ হওয়ার সময়ে এসে গিয়েছে, এদিকে আমাদের কেনা আর শেষ হয় না! বাড়ি ফিরলাম প্রায় দশটার পর। পাতলা মাটন কারি আর চিকেন কোফতা দিয়ে ভাত খেয়ে শুরু হল সেকেন্ড রাউন্ড আড্ডা। সুজাতার ঘুম পেয়ে গিয়েছিল, ও ওপরে চলে গেল। আমি আর পিসি প্রায় রাত একটা দেড়টা অবধি সুখ দুঃখের গল্প চালালাম।
পরেরদিন সকাল সকাল উঠে রেডি হয়ে বেরোতে হবে। পিসি আমাদের টাইমস স্কোয়ার অবধি পৌঁছে দিয়ে আসবে। কী কী ঘোরাবে হপ অন হফে, দাম কত, সেইসবও দেখতে হবে।
ন্যু জার্সি থেকে ন্যু ইয়র্ক পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগল না গাড়িতে। পথে
দূর থেকে ন্যু ইয়র্কের বিখ্যাত স্কাইলাইন দেখতে পেলেও ছবি তোলার অবকাশ ছিল
না। গতকাল শপিং করতে যাওয়ার সময় সূর্যাস্ত হচ্ছিল। কমলা আকাশের ব্যাকড্রপে
ছাই রঙা বিশাল বিশাল বাড়ি। বড় সুন্দর সে দৃশ্য। যথাসময়ে টাইমস স্কোয়ারে
পৌঁছে আমরা গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। লোকজন পিলপিল করছে। রাস্তায় লোক উপচে
পড়ছে। সে ভিড় শুধুই ট্যুরিস্টের। ন্যু ইয়র্ক অন্যতম পপ্যুলার অ্যামেরিকার,
কাজেই এই ভিড় যে হবেই, বলাই বাহুল্য। এবং পদে পদে বিভিন্ন হপ অন হপ অফ
কোম্পানির লোকজন হাতে ব্রোশার হাতে দাঁড়িয়ে। তাদের কাছে বিভিন্ন ট্যুর
প্যাকেজের লোভনীয় ও আকর্ষণীয় ডিলস। পিসির সাথে ফোনে কনসাল্ট করে আমরা সিটি
ট্যুরসের একটা প্যাকেজ নিলাম। ম্যানহয়াটানের বিশিষ্ট জায়গাগুলি মূলত এতে
আমরা ঘুরতে পারব। খানিক লাইনে থাকার পর একটা টুকটুকে লাল রঙের বাস এলো।
টপাটপ বাসের ছাদে উঠে গেলাম। ইয়ারফোন দেওয়া রয়েছে, সামনে থেকে গাইড লাইভ
কমেন্ট্রি করে যাবেন, শোনার জন্য। ইংরেজিতে শুনলে লাইভ, বাকি আরোবারোটি
ভাষা যেমন স্প্যানিশ, চাইনিজ, ইত্যাদিতে শুনতে পাওয়া যাবে বোতাম টিপে, তবে
অবশ্যই সেগুলি প্রি-রেকরডেড। হপ অন হপ অফের বৈশিষ্ট্য হল একটাই টিকিটে
সারাদিনে জোতবার খুশি বাস থেকে ওঠা নামা করতে পারব। বিভিন্ন স্পটে ইচ্ছে
হলে নামতে পারি, নয়ত না। নামলে হেঁটে ঘুরে আবার পরের বাসে উঠে অন্য জায়গায়
যেতে পারি।
আমাদের প্ল্যান হল প্রথমে বাসে চক্কর কাটব। তারপর আবার
যেখানে যেখানে ইচ্ছে হবে নামতে, সেখানে নেমে পড়ব। আসলে ভীষণ বেশি রোদ ছিল।
বাড়াবাড়ি রকমের ঘোরাঘুরি করলে মাথা ধরে যাবে আমার, সেই জন্যই খুব রিস্ক
নিতে চাইনি। হাতে প্রায় ছয় ঘণ্টা মতো সময় ছিল।
টাইমস স্কোয়ারের মধ্যে
দিয়ে বাস চলতে লাগল। রাস্তার দুইধারে বিশাল বিশাল বাড়ি এবং তার ওপর নানান
বিজ্ঞাপনের বোর্ড। ভীষণই রঙিন। আর লোকের ভিড়। এটাই দেখার। সন্ধ্যেবেলা
বিজ্ঞাপনের আলো ঝলমল আলাদা সৌন্দর্য আনে। ফেরার পথে সেটাও দেখেছিলাম সেদিন।
গাইড তো পরপর বলেই যাচ্ছেন কিছু না কিছু। কিছু কথা শুনছি, কিছু শুনছি না।
একটা কথা যেটা কানে এলো, ন্যু ইয়র্কের সাথে বম্বে আর সাংঘাইয়ের তুলনা
করলেন। এই টিনটি শহর নাকি ভীষণভাবে একইরকম, তিনটিই নিজের দেশের ফিন্যান্স
ক্যাপিটাল। বম্বে গিয়েছি, বলতে পারি যে হ্যাঁ, খুব ভুল বলেননি। রাস্তায়
বড্ড ট্র্যাফিক জ্যাম। ভর্তি গাড়ি। আর বিখ্যাত হলুদ ট্যাক্সি। এই
ট্যাক্সিচালকদের মধ্যে অনেকেই ভারতীয় বা পাকিস্তানি বা বাংলাদেশ। বাস চলতে চলতে আমরা ডানদিকে দেখলাম বিখ্যাত ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন। এটি অত্যন্ত বিখ্যাত ইন্ডোর এরিনা। প্রচুর কন্সার্ট এবং স্পোর্টিং ইভেন্ট হয়েছে, হয়। তারপর পড়ল পোস্ট অফিস। কী বিশাল। আমাদের জি পি ও গোছেরই। সেখানে মোট লেখা, ঝড় জল হলেও ডাক ঠিক সময় মতো পৌঁছে যাবে। ধবধবে সাদা বিরাট জায়গা জুড়ে কলোনিয়াল আর্কিটেকচার। বাঁ দিকে তারপর পড়ল মেসিস ব্র্যান্ডের সবচেয়ে বড় বিল্ডিং। পৃথিবীর অন্যতম বড় রিটেল আউটলেট, অনেক অনেক তলা, অনেক অনেক স্কয়ের ফিট জুড়ে এই দোকান। পয়সা নেই। সময় নেই। নামলাম না। এরপর পৌঁছলাম এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং। একটি পোল অনুযায়ী এইটি অ্যামেরিকার সবচেয়ে প্রিয় স্থাপত্য। ১০৩ তলা এই বিল্ডিঙের ওপরে একটি অবসারভেটরি রয়েছে। তবে প্রচুর দাম এবং ভীষণ ভিড়। সেই জন্য এইটিও বাইরে থেকেই দেখে নিলাম। সন্ধ্যের সময়ে দুর্দান্ত আলোকসজ্জা এটিকে অন্যতম দর্শনীয় করে তোলে। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা সেই ভিউ পাইনি। এরপর বাইরে থেকে দেখলাম ফ্ল্যাটিরন বিল্ডিং। চ্যাপ্টা, তিনকোণা উঁচু বাড়ি। দেখার মতোই, তবে ওই বিস্ময় ভরে, বাইরে থেকেই। এরপরে পথে পড়ল ইউনিয়ন স্কোয়ের। পার্ক মতো। প্রচুর দোকান বাজার। ভিড়। জর্জ ওয়াশিংটনের ঘোড়ায় চাপা বিখ্যাত স্ট্যাচ্যু রয়েছে। বাসের ওপর থেকেই দেখলাম। বাস ওই ভিড় রাস্তা ঠেলে এগোতে লাগল। চায়না টাউন আর লিটিল ইটালি পড়ে এর পরেই। ক্যানাল স্ট্রিটের স্টপে নেমে গেলাম। ততক্ষণে আসলে লাঞ্চ করার সময় হয়েছে, খিদেও পেয়েছে। সামনেই ছিল একটা ম্যাক ডনাল্ড। যদিও দেশে এক দুইবার খেয়েছি, তবুও অ্যামেরিকায় এসে ম্যাক ডি খাবো না, কেমন একটা লাগছিল। তাই গেলাম। এক ডলারে চারটে চিকেন স্ট্রিপ ফ্রাইজ আর আরো সোয়া এক ডলারে একটা বিশাল গ্লাসে কোল্ড ড্রিঙ্ক পেলাম। সেইসব খেয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করলাম। পথে পড়ল বিখ্যাত "আই লাভ ন্যু ইয়র্ক" চেইনের একটা দোকান। বাংলাদেশি মালিক, তাই অনেক কর্মচারীই বাংলায় কথা বলছিলেন। বেশ ভালো লাগল। স্যুভেনির কিনলাম। হাঁটার পথে ওয়াল স্ট্রিট পড়েছিল। ন্যু ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের বিখ্যাত বুল দেখলাম। এত ভিড়, বাবা রে। অনেক কশতে পোজ দিয়ে ছবি তুললাম। খাবার হজম হয়ে যেতে চায়না টাউনের দিকে হাঁটা লাগালাম। চারিদিকে চাইনিজ ভাষায় লেখা সাইনবোর্ড, বস্টনেরটার চেয়ে বড়। নিউ ইয়র্কে একাধিক চায়না টাউন রয়েছে। আমরা যেটায় ঘুরলাম, মোটামুটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বিভিন্ন নাম না জানা মাছ আর শাক সবজির স্টল রাস্তা জুড়ে। জামাকাপড়ের দোকান, জুতোর দোকান। আমরা সবই দেখতে দেখতেঅনেক খুঁজে একটাঠিকঠাক দেখতে রেস্টুরেন্টে গেলাম। চারটে বাজল খাওয়া শেষ করতে। খেলাম আমাদের দুজনেরই পছন্দের ডামপ্লিং আর নুডলস।
ইতিমধ্যে বুচু পিসি জানিয়ে দিয়েছে যে ছটা, সাতটা আর পৌনে আটটায় তিনটে বাস আছে ন্যু জার্সি যাওয়ার। আমরা তাতে উঠলে আমাদের বাস স্টপ থেকে পিক-আপ করে নেবে। তাই আমাদের একটু সময় বুঝে এবারে চলতে হবে। হেঁটে পৌঁছলাম ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেনটার। ৯/১১ এর পড়ে গ্রাউন্ড জিরোতে একটা মেমোরিয়াল বানানো। আগে যেখানে WTC ছিল, সেখানে বিশাল খালি জায়গায় জল পড়ছে সমানে। আর সেটা বাঁধানো কালো পাথরে। সেই পাথরে ওই ভয়ানক দুঃখের দিনে প্রাণ হারিয়েছেন যতজন, প্রত্যেকের নাম লেখা। খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল দেখে। কত দেশের কত ধরমের কত মানুষ। একটা নাম দেখে নাড়া খেয়েছিলাম। "unborn child"।
সেদিন এরপরে আমরা হপ অন বাসে উঠে পড়লাম। ভিড়ের ঠ্যালায় আর কোন কারণে কে জানে, বাসটা আর কোথাও থামছিল না। এদিকে আমাদের যেতে হবে সেই পোর্ট অথরিটি বাস টারমিনাসে। ঘড়ির কাঁটা দৌড়চ্ছে। সাথে আমাদের টেনশন। প্রথম দুটো বাস তো মিস করলাম। শেষটা যেন না করি। টেনশনের চোটে ইউনাইটেড নেশন্স বিল্ডিং বা ট্রাম্প টাওয়ার দেখেও কোন হেলদেল হলোনা। ছবি তুললাম বটে, তবে ওই। এমন কী রকাফেলার প্লাজা এসেও হেলদোল নেই। বরং তখন দৌড়ে দৌড়ে ক্যাবে উঠে বাস স্ট্যান্ড এলাম। সন্ধ্যের টাইমস স্কোয়ের দেখলাম। আলোয় সজ্জিত। ভালোই লাগল, তাও কেমন তখন প্রাণ আনচান। হাঁপাতে হাঁপাতে এঁকে তাকে জিজ্ঞেস করে অবশেষে বাস টারমিনাসে এলাম। আবার ছুট ছুট। ঠিক ঠিক গেটের সামনে গেলাম। লম্বা লাইন। বাসটা ছাড়ল দেরিতে। আলো কমে আসছে। কাউন্টারে টাকা (ও, টাকা তো না। ডলার) দিয়ে টিকিট কেটে রেখেছিলাম, ড্রাইভারকে বললাম আমাদের ঠিক স্টপেজে নামাতে।
No comments:
Post a Comment