VI
বেরিয়ে ফেরার প্রায় মাসখানেক পর, জাহ্নবী তিনটি ইমেল পাঠিয়েছিল। শুভঙ্কর, অভি আর আঙ্কেলকে।
প্রিয় শুভ
জানি তুমি হয়তো আমার ব্যবহার ও আচরণে খুব অবাক হয়েছ। ফিরে এসে অবধি আমি তোমার কোন ফোনের উত্তর দিইনি, মেসেজ পড়ে রেখে দিয়েছি। জবাব পাঠাইনি। রাগ করেছ নিশ্চয়ই? করারই কথা। আসলে বাড়ি ফেরার পর থেকে একটা অদ্ভুত বাজে রকমের পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছি এ কদিন। না না চিন্তা করো না। আমি ভালো আছি। মাও ভালো আছে। শুধু কিছু ব্যাপার ঘটে গিয়েছে, যা আমায় মানসিকভাবে বিহ্বল করে তুলেছিল। তবে এখন সব শান্ত। আমি ভালো আছি। তবে সেসব কথা তোমায় ফোনে বা ইমেলে জানাবো না। দেখা করে সামনাসামনি বলবো।
তুমি কি এর মধ্যে দিল্লী আসবে? এসো না। তাহলে দেখা করবো। তুমি আমাদের বাড়িতেই থেকো। মায়ের খুব ইচ্ছে তোমার সাথে আলাপ করার। ভালো লাগবে তুমি এলে। মন খুলে কথা বলবো তোমার সাথে। প্রমিস। এসো কিন্তু।
জানিয়ো কবে আসবে।
ইতি
জাহ্নবী
প্রিয় অভি
দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে যে একটা আস্ত ভাই পেয়ে যাবো, ভাবতেই পারিনি। বন্ধু তো পেয়েইছি, সাথে পেয়ে গেলাম একটা ভাই। আজ থেকে, আমায় দিদি বলে ডাকবি। ঠিক আছে? কী? সব ঘেঁটে যাচ্ছে? কিচ্ছু বুঝছিস না তো? তাহলে সোজাসাপ্টা বলি। আমার বাবা হলো তোড় বাবা। মিস্টার অর্জুন রাঠোড়। কাজেই, আমরা ভাই বোন।
অবাক হচ্ছিস? কী করে এসব কী বলছি? ওই যে সেদিন আঙ্কেল বলছিলেন না? ছোট বয়সে কাউকে পছন্দ হয়ে গিয়েছিল? আর আমায় দেখে বারবার তার কথা মনে হচ্ছিলো... হবেই তো, কারণ সে যে আমার মা। সত্যি বলছি, আমিও দিল্লী ফেরার আগে অবধি জানতেই পারিনি। আমি এমনই গাধা, অর্জুন আঙ্কেলের নাম শোনার পরেও মাথায় স্ট্রাইক করেনি কিছু। শেষ রাত্রে মাকে আমাদের ছবি পাঠাতে মা চিনতে পারে তার এতগুলো বছর আগের ফেলে আসা কাছের মানুষটিকে। যাকে নানান কারণে সেই সময়ে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। আমি দিল্লী ফেরার পর মা আমায় বলে সে কথা। তবে কারণ, এখনও জানি না। এইটুকু জানি, দুজনের মান অভিমান বোধহয় এখনও রয়েছে। বলছি, একটা কমপ্লিট পরিবার চাই তো তোর? তাহলে আমায় সাহায্য করিস। মা আর আঙ্কেলের ভাব করাতেই হবে। আমি ক্রমশ তোকে সব জানাবো। তোর সাহায্য নেব। ঠিক আছে?
আর ওদের মিলমিশ না হলেও, আমরা কিন্তু ভাই বোন হয়ে গেলাম। আগাম নেমন্তন্ন করে দিলাম রাখীর দিন। দিল্লী। চলে আসবি। ঠিক আছে?
ইতি
তোর দিদি
শেষ চিঠিটা লিখতে যে জাহ্নবীকে কতবার ব্যাকস্পেস প্রেস করতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। তবু, শেষমেশ এই দাঁড়িয়েছে।
প্রিয় অর্জুন আঙ্কেল
আশা করি ভালো আছেন। প্রথমেই জানাই, আমি খুবই দুঃখিত একদিন আপনাকে মেল করিনি বলে। আসলে বাড়ি ফিরে এসে একটা অদ্ভুত রকমের অনুভূতির মধ্যে দিয়ে চলছিলাম। খুলেই বলি তবে।
আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে, দার্জিলিং শহরে আপনার আলাপ হয়েছিল একটি বাঙালি পরিবারের সাথে। মনে আছে? দাদা বৌদি আর ওদের ছোট বোন। মেয়েটি তখন সবে গ্র্যাজুয়েশন পাশ করেছে। আপনার সাথে দেখা হতো প্রায় প্রতিদিন, ম্যালে। সকাল সন্ধ্যে। খুব জমাটি আলাপ আড্ডা চলত। তারপর একদিন সবাই মিলে বেড়াতে গেলেন লোকাল সাইটসিয়িং করতে। দিব্যি চলছিল। এর মধ্যে একদিন ঠিক হলো সবাই মিলে গাড়ি করে ধারেকাছে বেড়াতে যাবেন। কিন্তু দিনের দিন দাদা বৌদি যেতে পারলেন না। বৌদির তখন হঠাৎ ধুম জ্বর। বোনটিকে নিয়ে আপনি গেলেন ঘুরতে। ততদিনে অবশ্য দুই পক্ষেরই মন দেওয়া নেওয়া হয়ে গিয়েছে। তারপর আর কী, ক্ষণিকের অসাবধানতা। দুদিন পর ওরা ফিরে এলো। মেয়েটি এক মাস পর বুঝলো, ও আপনার সন্তানের মা হতে চলেছে। বাড়িতে জানানোর প্রশ্নই নেই। ভয়ানক রক্ষণশীল পরিবার। মেরেই ফেলতো হয়তো। আপনার সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু আপনি তখন দিশেহারা হয়ে যান। আশ্বস্ত করতে পারেন না। মেয়েটির আবার প্রবল আত্মসম্মান। একবার না শুনে আর চেষ্টা করেনি। সরকারী চাকরীর পরীক্ষা দিচ্ছিলোই। পেয়েও গেলো ভাগ্য ভালো। পোস্টিং দেরাদুন। চলে গেলো। আর সেখানেই কিছু মাস পর, আমার জন্ম।
আমার মা কোনদিনও আপনার সাথে, আপনার পরিবার বা মায়ের পরিবারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেনি। কেন? হয়তো অভিমান। একা হাতে আমায় বড় করেছে। আমি মানুষ হয়েছি। মা আর আমার এখন দুজনের সুখের সংসার।
আপনাকে লেপচাজগতে খুব ভালো লেগেছিল। মনে মনে ভেবেছিলাম (না চিনেই) যে আপনার সাথে মাকে ভালো মানাবে। সেই জন্যই মাকে জানাই সে কথা। ছবিও পাঠাই। মা আপনার ছবি দেখেই চিনতে পারে। তবে আমায় বারবার বারণ করে আপনাকে জানাতে। এই প্রথম আমি মায়ের কথা রাখছি না। আপনাকে লুকিয়ে চিঠি লিখছি। সবটা জানালাম আপনাকে। এদিকে মান অভিমান চুড়ান্ত পর্যায়ে আছে। বল এইবার আপনার কোর্টে। আপনি এবার যা ভালো বোঝেন।
ভালো থাকবেন। আঙ্কেল হিসেবেই শ্রদ্ধা করে যাবো চিরদিন।
ইতি
জাহ্নবী
তিনটে ইমেল পাঠিয়ে দিয়ে জাহ্নবী খানিক নিশ্চিন্ত। অনেক হাল্কা লাগছে। মাকে এখন এইসব কিচ্ছু বলা যাবে না বটে। দেখাই যাক, জীবন কী রেখেছে ওদের জন্য। কিছু হোক না হোক, একটা বন্ধু আর একটা ভাই তো পেলো। পিতৃপরিচয় জানলো, স্নেহ... সেও কপালে থাকলে জুটেই যাবে। অত আর ভাববে না। ডক্টর আস্থানা বলেছেন, "লিভ লাইফ ওয়ান ডে অ্যাট আ টাইম।" সত্যিই, সেই ভালো।
(শেষ)
my thoughts
Monday, March 30, 2020
Sunday, March 29, 2020
রঙ রুট (১৯)
সুচেতনা
অনেক রাত করে শুলেও, জাহ্নবীর ঘুম ঠিক সাড়ে ছটার মধ্যে ভেঙে গেল। ততক্ষণে অবশ্য সূর্যোদয় হয়ে গিয়েছে। পর্দার আড়ালে দুধ সাদা কাঞ্চনজঙ্ঘা রাজকীয়ভাবে বিদ্যমান। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। শুভকে দেখতে পেলো একটু দূরে, রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে। অভির দেখা নেই। জাহ্নবী এগিয়ে গেলো শুভর দিকে। "সুপ্রভাত", বললো ও।
শুভ হাসিমুখে ওকেও অভিবাদন জানালো। তারপর বলল, "তাহলে, কাল রাত্রে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা হলো?"
জাহ্নবী কপট রাগতস্বরে বললো, "আপনাদের দুই বন্ধুর পেটের ভিতরে কথা আর থাকে না। সত্যি।"
"কী করব, বেস্ট ফ্রেন্ডস।"
"আমার জানো আজ অবধি কখনো খুব ভালো বন্ধু হয়নি। কোনো বন্ধুত্বই খুব গভীরে যায়নি। তোমাদের দুজনের এই বন্ধুত্ব ভারী ভালো লাগে আমার। মনে হয়, আমারও যদি এমন বন্ধু হতো।"
"রইলাম তো। শুভ অভি জাহ্নবী। ত্রিমূর্তি। এই বন্ধুত্ব কোনো অবস্থাতেই ভাঙবে না। দেখো। কথা দিলাম।"
জাহ্নবী মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলে, "এই স্নিগ্ধ পরিবেশে এমন অঙ্গীকার নিলে। এই প্রমিস কিন্তু কোনো অংশেই অগ্নিসাক্ষীর কম নয়। খেয়াল রেখো..."
ওদের কথার মধ্যেই দূর রাস্তা থেকে গাড়ির শব্দ শুনতে পায়। এত সকাল সকাল এদিকে কে এলো?
"আঙ্কেল বোধহয়।" শুভ বলে।
অল্প সময়ের মধ্যেই একটা সিলভার রঙের বোলেরো গাড়ি এসে থামে। ভিতর থেকে নেমে আসেন বছর পঞ্চান্নর এক সুপুরুষ ব্যক্তি। লম্বা, দীর্ঘদেহী ঋজু চেহারা। কাঁচা পাকা চুল। পুরু মোটা গোঁফ। সেই গোঁফের আড়াল থেকেই বেরিয়ে আসে এক চওড়া হাসি। শুভ ওঁকে দেখে এগিয়ে গিয়ে ঢিপ করে একটা প্রণাম সেরে ফেলে। ভদ্রলোক শুভকে জড়িয়ে ধরে বলেন, "ইয়ং ম্যান। এ কী, গলে মিলো। ইয়ে সব প্রণাম শনাম কিউ?"
"কেমন আছো আঙ্কেল? অনেক দিন পর দেখা হলো।"
"বেটা, খুব ভালো আছি। তুমি বলো। কাম ওয়াম সব ঠিক?"
"হ্যাঁ আঙ্কেল।" তারপর হঠাৎই শুভর মনে পড়লো জাহ্নবীর কথা। জাহ্নবী একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে ওদের। শুভ ওকে ইশারায় ডেকে নিয়ে বললো, "আঙ্কেল, মিট হার। শি ইজ জাহ্নবী। দিল্লীতে থাকে। চাকরি করে। জাহ্নবী, দিস ইজ অর্জুন আঙ্কেল। অভির বাবা।"
জাহ্নবী ভদ্রলোককে প্রণাম করেন। উনি ব্যস্ত হয়ে জাহ্নবীকে বাধা দিতে যান। "আরে আরে, করো কী? বেটিরা বাড়ির লক্ষ্মী। তারা কখনো আমাদের পায়ে হাত দেয়না। বুঝলে মা? এসো, ভিতরে চলো। শুভ, চলো। অভি আমায় বলেছে ওর কথা। আমি জানি। চলো বাকি গল্প চা খেতে খেতে।"
ইতিমধ্যে বেয়ারা এসে পড়েছে। সে আঙ্কেলের মালপত্র নিয়ে এগিয়ে যায়। ভদ্রলোক ওকে ডেকে বলেন, "ছোটবাবুকে ডেকে দাও। আর আমাদের জন্য চা পাঠাও।"
"তারপর, বলো। দার্জিলিং কেমন লাগলো তোমাদের?"
জাহ্নবী উত্তর দিলো, "ভালো। খুবই ভালো। তবে ওয়েদার ভালো ছিলো না। তাই একটু কম এনজয় করেছি। টাইগার হিল যাওয়া হয়নি।"
"হুম। দার্জিলংএর ওয়েদার নিয়ে একটা ব্যাপার আছে। ভেরি আনপ্রেডিক্টেবল।"
"আঙ্কেল আপনার ট্রিপ কেমন হলো?"
"ভালো রে শুভ। খুব ভালো। ওখানে একটা কাজেই গিয়েছিলাম। সেটা সেরে এলাম।"
"আরেকটা হোটেল কিনলে?"
"হ্যাঁ রে। ওই গৌহাটির আউটস্কার্টে। ওটাকে একটা ইকো রিসোর্টে কনভার্ট করতে হবে। এরকমই ইচ্ছে।"
"গ্রেট। ঐটা রেডি হয়ে গেলে নেক্সট টাইম চলে এসো। জাহ্নবী, তুমিও এসো। ইনভাইট করে রাখলাম।"
"হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। মাকে নিয়ে আসবো। মার খুব কামাখ্যা যাওয়ার ইচ্ছে। অনেক দিনের।"
"খুব ভালো। শিয়র। উই উইল বি গুড হোস্টস। কী বলিস অভি?" ইতিমধ্যে অভি এসে গিয়েছে ওদের মধ্যে। ঘুম ঘুম চেহারা এখনো।
"বাবা, শোনো না। তুমি কি টায়ার্ড নাকি আমাদের সাথে বেরোবে?"
"কোথায় যাবি?"
"ভাবছিলাম গাড়ি নিয়ে তিনচুলে ঘুরে আসবো।"
"আমি ড্রাইভ করতে পারবো না। তোরা কেউ করলে আমি রাজি।"
"আমি চালাবো আঙ্কেল?" জাহ্নবী প্রশ্ন করে।
"তুমি হিল ড্রাইভিং জানো?" আঙ্কেল একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন।
"হ্যাঁ! এই তো, লাস্ট ইয়ার সামারে মাকে নিয়ে আমি শিমলা থেকে ঘুরে এলাম। নিজেই ড্রাইভ করে।"
"গ্রেট, গ্রেট ইয়ং লেডি। খুব ভালো লাগে এইসব বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলো কী সুন্দর স্মার্ট। আমাদের ছোটবেলায় এরকম ছিলই না। ফ্রি মিক্সিং ও ছিল না। থিংজ হ্যাভ চেঞ্জড।"
অভি এইবারে একটু বাবার পিছনে লাগতে গেল। বললো, "তা ফ্রি মিক্সিং থাকলে কী হতো? কাউকে পছন্দ ছিল নাকি?"
আঙ্কেল হাহা করে গলা ছেড়ে হেসে বললেন, "সে তো ছিল। তবে দ্যাট লেডি ওয়াজ অলসো ভেরি মডার্ন। ভেরি স্মার্ট। একদম এই জাহ্নবীর মতো। ইন ফ্যাক্ট জাহ্নবী সো রিমাইন্ডস মি অফ হার।"
"আচ্ছা? তাই? বেশ বেশ। আমার কাজ তাহলে একটু ইজিই হলো।" জাহ্নবী মুচকি হেসে বলে। ওর অঙ্কেলকে খুব পছন্দ হয়েছে। মায়েরও যদি হয়...
"কী ব্যাপার?" কৌতূহলী হয়েই জিজ্ঞেস করেন আঙ্কেল। জাহ্নবী ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বলে, "এখন না। পরে ঠিক সময় হলে।"
"এই আজকালের বাচ্চাগুলো না..." এই বলতে বলতে আঙ্কেল নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যান। স্নান সেরে তৈরি হতে হবে।
পথেই লাঞ্চ করে নেবে, এই মর্মে ব্রেকফাস্ট শেষ করে ওরা চারজন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। দেড় ঘন্টার যাত্রাপথ গানে গল্পে দুর্দান্ত জমাটি হয়েছিল। তিনচুলে গিয়েও খুবই ভালো সময় কেটেছে। অসাধারণ সেই ভিউপয়েন্ট। সবুজালি। বরফ ঢাকা পাহাড়। গরম স্যুপ। মোমো। ছবির পর ছবি। সেলফি। হইহই করে সারাদিন যে কীভাবে কেটে গেল, টেরই পায়না ওর। তারপর ফেরার পালা। এমনিও খুব দেরি করলে চলবে না। কাল জাহ্নবীর ফেরার ফ্লাইট। ওকেও এসে লাগেজের ফাইনাল প্যাকিং করতে হবে। ফেরার পথে গাড়ি চালালো শুভ। পাঁচটার মধ্যে ওরা এসে পৌঁছল কটেজে।
জাহ্নবী ঘরে ফিরে মাকে ফোন করে গল্প করলো সারাদিনের। ফিরিস্তি দিলো। তারপর কথাটা কিন্তু কিন্তু করে পেড়েই ফেললো। বললো, "মা, আঙ্কেলকে কিন্তু আমার খুব পছন্দ হয়েছে। হি ইজ এ গ্রেট জেন্টিলম্যান। তোমারও ওঁকে খুব ভালো লাগবে। দেখো। দাঁড়াও ছবি পাঠাই।"
এই বলে জাহ্নবী সুভদ্রাকে ওর আর আঙ্কেলের একটা সেলফি পাঠায়। খুব প্রিয় এই ছবিটা। দুজনের চোখে মুখে হাসি।
মাকে ছবি পাঠিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে সুভদ্রার ফোনের। তবে কোনো ফোন আসে না। তাহলে হয়তো সিগনালের প্রব্লেম, জাহ্নবী ভাবে। ও ফোন করার চেষ্টা করে। লাইন লাগে না। ও ফিরে যায় লিভিং রুমে। গল্পের আসর বসেছে সেখানে। আঙ্কেল রসিয়ে রসিয়ে শুভ আর অভির ছোটবেলার নানান মজার কীর্তি বলে যাচ্ছেন। কথায় কথায় নিজের বিভিন্ন দেশভ্রমণের গল্পও বলেন। কত দেশ ঘুরেছেন আঙ্কেল। শখে। ব্লগ লিখতেন এক সময়। আঙ্কেল কথা বলেন ভারী ভালো। মুগ্ধ হয়েই শুনতে থাকে ওরা।
ডিনারের পর জাহ্নবী রুমে ফিরে আসে। মোবাইলে এখনো টাওয়ার নেই। তাই ফোন বা মেসেজ কোনো নোটিফিকেশনই নেই।
জাহ্নবীর মনটা একটু কেমন কেমন করে। এসেছিল এক অদ্ভুত মানসিক অবস্থায়। এখন যেন এখানে এসে অভি আর শুভর মতো এমন ভালো বন্ধু পেলো। বেড়ানো হলো ভালোই। তারপর শেষ পাতে আঙ্কেলের মতো মানুষের সাথে পরিচয়। পিতৃহীন জীবনে আঙ্কেল যেন কিছুটা হলেও সেইখানে স্নেহের স্পর্শ বুলিয়ে দিয়েছেন ইতিমধ্যেই। জাহ্নবী মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, এদের সকলের সাথে যোগাযোগটা বজায় ও রাখবেই। হয়তো একটু একটু করে হলেও, এইভাবেই ও একটা সুস্থ জীবনে ফিরতে পারবে। অনেকটা কৃতজ্ঞতা ও মন ভালো করা অনুভূতি নিয়ে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোল। রঙের সন্ধানে এলেও, এই রুটটা কোনোভাবেই, "wrong" বোধহয় হয়নি ওর।
পরেরদিন সকালে শুভ, অভি আর আঙ্কেল তিনজনে মিলে ওকে বাগডোগরা অবধি পৌঁছে দিয়ে এলো। মাঝে সিগনাল পাওয়ায় মেসেজ ঢুকলো। মায়ের মেসেজ। গতকাল রাতে পাঠানো। এইটুকুই। "তুই কোনো কথা বলবি না আর এই নিয়ে। আই ওয়ার্ন ইউ। বাড়ি আয় সাবধানে। আমি এয়ারপোর্ট যাবো।" মায়ের এই মেসেজে অবাক হয় জাহ্নবী। ও তো মায়ের সাথে একটু মজাই করছিল। অবশ্যই মায়ের অনুমতি না নিয়ে ও কিছুই করতো না। তাও, কে জানে। গাড়িতে অবশিষ্ট সময়টা আর এই নিয়ে মাথা ঘামায়নি জাহ্নবী। সবার সাথে আড্ডা দিয়েই কাটানোটা বেশি দরকারি মনে করল। মায়ের সাথে সামনাসামনি কথা বললেই সব সমস্যা ভুল বোঝাবুঝি মিটে যাবে। ও নিশ্চিত। কিন্তু এই তিনজনকে খুব শিগগিরই তো আর একসাথে পাবে না।
দুটো নাগাদ ওরা পৌঁছে গেল। এয়ারপোর্টের কাছে একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁয় ওরা একসাথে লাঞ্চ সারলো। আঙ্কেল কিছুতেই টাকা দিতে দিলেন না। জাহ্নবীর ফেয়ারওয়েল লাঞ্চ।
এত স্নেহ, এত ভালোবাসা। সত্যিই, জাহ্নবী অভিভূত। এক বুক ভালোবাসা, আবার দেখা হওয়ার ও যোগাযোগ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জাহ্নবী ঢুকে যায় এয়ারপোর্ট টার্মিনালে।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
বি: দ্র: রিলিফ ফান্ডে টাকা দিলেন? বই নিলেন? আরো পাঁচজনকে জানালেন সেটার কথা?
সুচেতনা
অনেক রাত করে শুলেও, জাহ্নবীর ঘুম ঠিক সাড়ে ছটার মধ্যে ভেঙে গেল। ততক্ষণে অবশ্য সূর্যোদয় হয়ে গিয়েছে। পর্দার আড়ালে দুধ সাদা কাঞ্চনজঙ্ঘা রাজকীয়ভাবে বিদ্যমান। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। শুভকে দেখতে পেলো একটু দূরে, রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে। অভির দেখা নেই। জাহ্নবী এগিয়ে গেলো শুভর দিকে। "সুপ্রভাত", বললো ও।
শুভ হাসিমুখে ওকেও অভিবাদন জানালো। তারপর বলল, "তাহলে, কাল রাত্রে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা হলো?"
জাহ্নবী কপট রাগতস্বরে বললো, "আপনাদের দুই বন্ধুর পেটের ভিতরে কথা আর থাকে না। সত্যি।"
"কী করব, বেস্ট ফ্রেন্ডস।"
"আমার জানো আজ অবধি কখনো খুব ভালো বন্ধু হয়নি। কোনো বন্ধুত্বই খুব গভীরে যায়নি। তোমাদের দুজনের এই বন্ধুত্ব ভারী ভালো লাগে আমার। মনে হয়, আমারও যদি এমন বন্ধু হতো।"
"রইলাম তো। শুভ অভি জাহ্নবী। ত্রিমূর্তি। এই বন্ধুত্ব কোনো অবস্থাতেই ভাঙবে না। দেখো। কথা দিলাম।"
জাহ্নবী মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলে, "এই স্নিগ্ধ পরিবেশে এমন অঙ্গীকার নিলে। এই প্রমিস কিন্তু কোনো অংশেই অগ্নিসাক্ষীর কম নয়। খেয়াল রেখো..."
ওদের কথার মধ্যেই দূর রাস্তা থেকে গাড়ির শব্দ শুনতে পায়। এত সকাল সকাল এদিকে কে এলো?
"আঙ্কেল বোধহয়।" শুভ বলে।
অল্প সময়ের মধ্যেই একটা সিলভার রঙের বোলেরো গাড়ি এসে থামে। ভিতর থেকে নেমে আসেন বছর পঞ্চান্নর এক সুপুরুষ ব্যক্তি। লম্বা, দীর্ঘদেহী ঋজু চেহারা। কাঁচা পাকা চুল। পুরু মোটা গোঁফ। সেই গোঁফের আড়াল থেকেই বেরিয়ে আসে এক চওড়া হাসি। শুভ ওঁকে দেখে এগিয়ে গিয়ে ঢিপ করে একটা প্রণাম সেরে ফেলে। ভদ্রলোক শুভকে জড়িয়ে ধরে বলেন, "ইয়ং ম্যান। এ কী, গলে মিলো। ইয়ে সব প্রণাম শনাম কিউ?"
"কেমন আছো আঙ্কেল? অনেক দিন পর দেখা হলো।"
"বেটা, খুব ভালো আছি। তুমি বলো। কাম ওয়াম সব ঠিক?"
"হ্যাঁ আঙ্কেল।" তারপর হঠাৎই শুভর মনে পড়লো জাহ্নবীর কথা। জাহ্নবী একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে ওদের। শুভ ওকে ইশারায় ডেকে নিয়ে বললো, "আঙ্কেল, মিট হার। শি ইজ জাহ্নবী। দিল্লীতে থাকে। চাকরি করে। জাহ্নবী, দিস ইজ অর্জুন আঙ্কেল। অভির বাবা।"
জাহ্নবী ভদ্রলোককে প্রণাম করেন। উনি ব্যস্ত হয়ে জাহ্নবীকে বাধা দিতে যান। "আরে আরে, করো কী? বেটিরা বাড়ির লক্ষ্মী। তারা কখনো আমাদের পায়ে হাত দেয়না। বুঝলে মা? এসো, ভিতরে চলো। শুভ, চলো। অভি আমায় বলেছে ওর কথা। আমি জানি। চলো বাকি গল্প চা খেতে খেতে।"
ইতিমধ্যে বেয়ারা এসে পড়েছে। সে আঙ্কেলের মালপত্র নিয়ে এগিয়ে যায়। ভদ্রলোক ওকে ডেকে বলেন, "ছোটবাবুকে ডেকে দাও। আর আমাদের জন্য চা পাঠাও।"
"তারপর, বলো। দার্জিলিং কেমন লাগলো তোমাদের?"
জাহ্নবী উত্তর দিলো, "ভালো। খুবই ভালো। তবে ওয়েদার ভালো ছিলো না। তাই একটু কম এনজয় করেছি। টাইগার হিল যাওয়া হয়নি।"
"হুম। দার্জিলংএর ওয়েদার নিয়ে একটা ব্যাপার আছে। ভেরি আনপ্রেডিক্টেবল।"
"আঙ্কেল আপনার ট্রিপ কেমন হলো?"
"ভালো রে শুভ। খুব ভালো। ওখানে একটা কাজেই গিয়েছিলাম। সেটা সেরে এলাম।"
"আরেকটা হোটেল কিনলে?"
"হ্যাঁ রে। ওই গৌহাটির আউটস্কার্টে। ওটাকে একটা ইকো রিসোর্টে কনভার্ট করতে হবে। এরকমই ইচ্ছে।"
"গ্রেট। ঐটা রেডি হয়ে গেলে নেক্সট টাইম চলে এসো। জাহ্নবী, তুমিও এসো। ইনভাইট করে রাখলাম।"
"হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। মাকে নিয়ে আসবো। মার খুব কামাখ্যা যাওয়ার ইচ্ছে। অনেক দিনের।"
"খুব ভালো। শিয়র। উই উইল বি গুড হোস্টস। কী বলিস অভি?" ইতিমধ্যে অভি এসে গিয়েছে ওদের মধ্যে। ঘুম ঘুম চেহারা এখনো।
"বাবা, শোনো না। তুমি কি টায়ার্ড নাকি আমাদের সাথে বেরোবে?"
"কোথায় যাবি?"
"ভাবছিলাম গাড়ি নিয়ে তিনচুলে ঘুরে আসবো।"
"আমি ড্রাইভ করতে পারবো না। তোরা কেউ করলে আমি রাজি।"
"আমি চালাবো আঙ্কেল?" জাহ্নবী প্রশ্ন করে।
"তুমি হিল ড্রাইভিং জানো?" আঙ্কেল একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন।
"হ্যাঁ! এই তো, লাস্ট ইয়ার সামারে মাকে নিয়ে আমি শিমলা থেকে ঘুরে এলাম। নিজেই ড্রাইভ করে।"
"গ্রেট, গ্রেট ইয়ং লেডি। খুব ভালো লাগে এইসব বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলো কী সুন্দর স্মার্ট। আমাদের ছোটবেলায় এরকম ছিলই না। ফ্রি মিক্সিং ও ছিল না। থিংজ হ্যাভ চেঞ্জড।"
অভি এইবারে একটু বাবার পিছনে লাগতে গেল। বললো, "তা ফ্রি মিক্সিং থাকলে কী হতো? কাউকে পছন্দ ছিল নাকি?"
আঙ্কেল হাহা করে গলা ছেড়ে হেসে বললেন, "সে তো ছিল। তবে দ্যাট লেডি ওয়াজ অলসো ভেরি মডার্ন। ভেরি স্মার্ট। একদম এই জাহ্নবীর মতো। ইন ফ্যাক্ট জাহ্নবী সো রিমাইন্ডস মি অফ হার।"
"আচ্ছা? তাই? বেশ বেশ। আমার কাজ তাহলে একটু ইজিই হলো।" জাহ্নবী মুচকি হেসে বলে। ওর অঙ্কেলকে খুব পছন্দ হয়েছে। মায়েরও যদি হয়...
"কী ব্যাপার?" কৌতূহলী হয়েই জিজ্ঞেস করেন আঙ্কেল। জাহ্নবী ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বলে, "এখন না। পরে ঠিক সময় হলে।"
"এই আজকালের বাচ্চাগুলো না..." এই বলতে বলতে আঙ্কেল নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যান। স্নান সেরে তৈরি হতে হবে।
পথেই লাঞ্চ করে নেবে, এই মর্মে ব্রেকফাস্ট শেষ করে ওরা চারজন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। দেড় ঘন্টার যাত্রাপথ গানে গল্পে দুর্দান্ত জমাটি হয়েছিল। তিনচুলে গিয়েও খুবই ভালো সময় কেটেছে। অসাধারণ সেই ভিউপয়েন্ট। সবুজালি। বরফ ঢাকা পাহাড়। গরম স্যুপ। মোমো। ছবির পর ছবি। সেলফি। হইহই করে সারাদিন যে কীভাবে কেটে গেল, টেরই পায়না ওর। তারপর ফেরার পালা। এমনিও খুব দেরি করলে চলবে না। কাল জাহ্নবীর ফেরার ফ্লাইট। ওকেও এসে লাগেজের ফাইনাল প্যাকিং করতে হবে। ফেরার পথে গাড়ি চালালো শুভ। পাঁচটার মধ্যে ওরা এসে পৌঁছল কটেজে।
জাহ্নবী ঘরে ফিরে মাকে ফোন করে গল্প করলো সারাদিনের। ফিরিস্তি দিলো। তারপর কথাটা কিন্তু কিন্তু করে পেড়েই ফেললো। বললো, "মা, আঙ্কেলকে কিন্তু আমার খুব পছন্দ হয়েছে। হি ইজ এ গ্রেট জেন্টিলম্যান। তোমারও ওঁকে খুব ভালো লাগবে। দেখো। দাঁড়াও ছবি পাঠাই।"
এই বলে জাহ্নবী সুভদ্রাকে ওর আর আঙ্কেলের একটা সেলফি পাঠায়। খুব প্রিয় এই ছবিটা। দুজনের চোখে মুখে হাসি।
মাকে ছবি পাঠিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে সুভদ্রার ফোনের। তবে কোনো ফোন আসে না। তাহলে হয়তো সিগনালের প্রব্লেম, জাহ্নবী ভাবে। ও ফোন করার চেষ্টা করে। লাইন লাগে না। ও ফিরে যায় লিভিং রুমে। গল্পের আসর বসেছে সেখানে। আঙ্কেল রসিয়ে রসিয়ে শুভ আর অভির ছোটবেলার নানান মজার কীর্তি বলে যাচ্ছেন। কথায় কথায় নিজের বিভিন্ন দেশভ্রমণের গল্পও বলেন। কত দেশ ঘুরেছেন আঙ্কেল। শখে। ব্লগ লিখতেন এক সময়। আঙ্কেল কথা বলেন ভারী ভালো। মুগ্ধ হয়েই শুনতে থাকে ওরা।
ডিনারের পর জাহ্নবী রুমে ফিরে আসে। মোবাইলে এখনো টাওয়ার নেই। তাই ফোন বা মেসেজ কোনো নোটিফিকেশনই নেই।
জাহ্নবীর মনটা একটু কেমন কেমন করে। এসেছিল এক অদ্ভুত মানসিক অবস্থায়। এখন যেন এখানে এসে অভি আর শুভর মতো এমন ভালো বন্ধু পেলো। বেড়ানো হলো ভালোই। তারপর শেষ পাতে আঙ্কেলের মতো মানুষের সাথে পরিচয়। পিতৃহীন জীবনে আঙ্কেল যেন কিছুটা হলেও সেইখানে স্নেহের স্পর্শ বুলিয়ে দিয়েছেন ইতিমধ্যেই। জাহ্নবী মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, এদের সকলের সাথে যোগাযোগটা বজায় ও রাখবেই। হয়তো একটু একটু করে হলেও, এইভাবেই ও একটা সুস্থ জীবনে ফিরতে পারবে। অনেকটা কৃতজ্ঞতা ও মন ভালো করা অনুভূতি নিয়ে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোল। রঙের সন্ধানে এলেও, এই রুটটা কোনোভাবেই, "wrong" বোধহয় হয়নি ওর।
পরেরদিন সকালে শুভ, অভি আর আঙ্কেল তিনজনে মিলে ওকে বাগডোগরা অবধি পৌঁছে দিয়ে এলো। মাঝে সিগনাল পাওয়ায় মেসেজ ঢুকলো। মায়ের মেসেজ। গতকাল রাতে পাঠানো। এইটুকুই। "তুই কোনো কথা বলবি না আর এই নিয়ে। আই ওয়ার্ন ইউ। বাড়ি আয় সাবধানে। আমি এয়ারপোর্ট যাবো।" মায়ের এই মেসেজে অবাক হয় জাহ্নবী। ও তো মায়ের সাথে একটু মজাই করছিল। অবশ্যই মায়ের অনুমতি না নিয়ে ও কিছুই করতো না। তাও, কে জানে। গাড়িতে অবশিষ্ট সময়টা আর এই নিয়ে মাথা ঘামায়নি জাহ্নবী। সবার সাথে আড্ডা দিয়েই কাটানোটা বেশি দরকারি মনে করল। মায়ের সাথে সামনাসামনি কথা বললেই সব সমস্যা ভুল বোঝাবুঝি মিটে যাবে। ও নিশ্চিত। কিন্তু এই তিনজনকে খুব শিগগিরই তো আর একসাথে পাবে না।
দুটো নাগাদ ওরা পৌঁছে গেল। এয়ারপোর্টের কাছে একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁয় ওরা একসাথে লাঞ্চ সারলো। আঙ্কেল কিছুতেই টাকা দিতে দিলেন না। জাহ্নবীর ফেয়ারওয়েল লাঞ্চ।
এত স্নেহ, এত ভালোবাসা। সত্যিই, জাহ্নবী অভিভূত। এক বুক ভালোবাসা, আবার দেখা হওয়ার ও যোগাযোগ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জাহ্নবী ঢুকে যায় এয়ারপোর্ট টার্মিনালে।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
বি: দ্র: রিলিফ ফান্ডে টাকা দিলেন? বই নিলেন? আরো পাঁচজনকে জানালেন সেটার কথা?
রঙ রুট (১৮)
সুচেতনা
গভীর রাতে জাহ্নবীর ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎই। কিছু কি শব্দ কানে এলো? কী হলো? ও লেপের তলা থেকে হাত বের করে বেডসাইড টেবিলে রাখা মোবাইলে সময় দেখলো। আড়াইতে। ঢাকা দেওয়া জলের গ্লাসটা থেকে এক ঢোক জল খেলো। তারপর কী মনে হতে উঠে জানলার ধারে গেল। ভারী পর্দাটা সরাতেই চোখের সামনে যেন ম্যাজিকের মতো দৃশ্য। সে দৃশ্য না দেখলে কল্পনা করা যায় না। দুধ সাদা বিরাট কাঞ্চনজঙ্ঘা। তার ওপর চাঁদের জ্যোৎস্না ভেসে যাচ্ছে। সে এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্য। অবশেষে তাহলে মেঘ কাটলো। দেখা মিলল তার। গায়ে শালটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে জাহ্নবী একটু সাহস করেই দরজার বাইরে বেরোলো। আরো একটু ভালো করে যাতে দেখতে পারে। ক্যামেরাটা সাথে নিলো না। কিছু দৃশ্য মনের ক্যামেরায় বন্দী থাকাই ভালো বোধহয়।
দু চোখ ভরে দেখতে দেখতে কখন জানি গুনগুন করে গান শুরু করেছিল জাহ্নবী।
"সেই রাতে রাত ছিল পূর্ণিমা
রঙ ছিল ফাল্গুনী হাওয়াতে..."
"সত্যিই, আপনার গানের গলা কিন্তু অসামান্য। নিয়মিত চর্চা করেন?" অভির কথা শুনে চমকে যায় জাহ্নবী।
"ও মা, আপনি? কখন এলেন?"
অভি গেয়ে উঠলো, "যখন এসেছিলে, অন্ধকারে চাঁদ উঠেনি, সিন্ধুপারে চাঁদ উঠেনি।"
"আপনি তো অবাঙালি হয়েও বেশ ভালোই বাংলা গানের স্টক মেন্টেন করেন!"
"আসলে বেস্ট ফ্রেন্ড বাঙালি। তার ওপর আমার বাবা বাংলা ভালোবাসে। ছোট থেকেই শুনে এসেছি। বাঙালিরাই আসল ঐতিহ্য বজায় রেখেছে। তাই আর কী..."
জাহ্নবী কিছু বলে না আর। দু চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে সামনে। খানিক পর একটু গলা খাকরি দিয়ে অভি বলে, "একটা কথা ছিল।"
"বলুন?"
"বলছি যে এই দুদিন আমার ব্যবহারে নিশ্চয়ই আপনার খুব খারাপ লেগেছে।"
"কেন? খারাপ লাগবে কেন?"
"না মানে এটা খুবই অনভিপ্রেত। আপনার সামনে এরকম কথা কাটাকাটি, ঝগড়া। উচিত হয়নি।"
"সে বন্ধুদের মধ্যে ঝগড়া করা কখনোই উচিত না। আমার সামনেই হোক কি আড়ালে। তাই না?"
"হুম। আরো একটা কথা ছিল।"
"বলুন না।"
"আপনাকে আমি খুবই শ্রদ্ধা করি। আপনি ভীষণ লজিকাল। এবং ভালো মনের মানুষ।"
"ব্যস ব্যস। আর না। এত প্রশংসা আমার হজম হবে না।"
"না সত্যি বলছি। আপনি..."
"থাক না অভি। কিছু কথা, না বলাই থাকুক। তাই না?"
"থাকবে বলছেন?"
"হ্যাঁ। সেই ভালো।"
"আমারে না হয় না জানো..." (সুর করে)
"আমার ব্যাকুল নয়নও নেই, নেই উতল আঁচল বা এলোথেলো চুল।"
"সে ভাবনা ভাবতে হবে না। সেসবের আমার ব্যবস্থা অন্য। এই রে, আপনিও কি শুভর মতো ভাবলেন নাকি যে আমি আপনার প্রেমে পড়েছি?"
"পড়েননি?"
"উঁহু। আপনাকে ভালো বন্ধু মনে করেছি। ব্যস। আসলে আমাদের দেশে এইটাই সমস্যা। ছেলে মেয়ের বন্ধুত্ব যেন হতেই পারে না।"
"আপনি বাঁচালেন আমায়। নইলে ভীষণ অস্বস্তি হতো। খারাপ লাগতো। আসলে, আমি এখনো কাউকেই ভালোবাসতে, সেই অর্থে, বা কোনো সম্পর্কে জড়ানোর মতো মেন্টাল স্টেটে নেই। চাইনি কোনো কমপ্লিকেশন।"
"শুভ জানে?"
"কী?"
"এই যে, সম্পর্কে জড়াবেন না।"
"সবটা জানাতেই হবে? আমি তো বলিনি যে জড়াবো। বন্ধু হিসেবেই তো থাকতে পারি। সেই কথা জানে।"
"হুম। ভালো তবে।"
"অনেক রাত হলো। এবার ঘুমোতে যাই। আপনিও শুয়ে পড়ুন।"
"হুম। কাল কিন্তু একটা দারুণ সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাবো। ওয়েদার ভালো হয়ে গিয়েছে। কাজেই ভিউ পয়েন্ট থেকে খুব সুন্দর দেখতে পাবেন। তিনজনেই যাবো।"
"আর আঙ্কেল?"
"যদি বাবা আমাদের বেরোনোর আগেই ফিরে আসে, তাহলে বলবো জয়েন করতে।"
"বেশ বেশ। আলাপ করতে আগ্রহী।"
"গুড নাইট।"
"গুড নাইট।"
(ক্রমশ)
বি: দ্র: আর হয়তো দুটো পর্ব। তারপর শেষ।
করোনা রিলিফ ফান্ডের জন্য বই নিলেন? বন্ধুমহলে জানালেন?
সুচেতনা
গভীর রাতে জাহ্নবীর ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎই। কিছু কি শব্দ কানে এলো? কী হলো? ও লেপের তলা থেকে হাত বের করে বেডসাইড টেবিলে রাখা মোবাইলে সময় দেখলো। আড়াইতে। ঢাকা দেওয়া জলের গ্লাসটা থেকে এক ঢোক জল খেলো। তারপর কী মনে হতে উঠে জানলার ধারে গেল। ভারী পর্দাটা সরাতেই চোখের সামনে যেন ম্যাজিকের মতো দৃশ্য। সে দৃশ্য না দেখলে কল্পনা করা যায় না। দুধ সাদা বিরাট কাঞ্চনজঙ্ঘা। তার ওপর চাঁদের জ্যোৎস্না ভেসে যাচ্ছে। সে এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্য। অবশেষে তাহলে মেঘ কাটলো। দেখা মিলল তার। গায়ে শালটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে জাহ্নবী একটু সাহস করেই দরজার বাইরে বেরোলো। আরো একটু ভালো করে যাতে দেখতে পারে। ক্যামেরাটা সাথে নিলো না। কিছু দৃশ্য মনের ক্যামেরায় বন্দী থাকাই ভালো বোধহয়।
দু চোখ ভরে দেখতে দেখতে কখন জানি গুনগুন করে গান শুরু করেছিল জাহ্নবী।
"সেই রাতে রাত ছিল পূর্ণিমা
রঙ ছিল ফাল্গুনী হাওয়াতে..."
"সত্যিই, আপনার গানের গলা কিন্তু অসামান্য। নিয়মিত চর্চা করেন?" অভির কথা শুনে চমকে যায় জাহ্নবী।
"ও মা, আপনি? কখন এলেন?"
অভি গেয়ে উঠলো, "যখন এসেছিলে, অন্ধকারে চাঁদ উঠেনি, সিন্ধুপারে চাঁদ উঠেনি।"
"আপনি তো অবাঙালি হয়েও বেশ ভালোই বাংলা গানের স্টক মেন্টেন করেন!"
"আসলে বেস্ট ফ্রেন্ড বাঙালি। তার ওপর আমার বাবা বাংলা ভালোবাসে। ছোট থেকেই শুনে এসেছি। বাঙালিরাই আসল ঐতিহ্য বজায় রেখেছে। তাই আর কী..."
জাহ্নবী কিছু বলে না আর। দু চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে সামনে। খানিক পর একটু গলা খাকরি দিয়ে অভি বলে, "একটা কথা ছিল।"
"বলুন?"
"বলছি যে এই দুদিন আমার ব্যবহারে নিশ্চয়ই আপনার খুব খারাপ লেগেছে।"
"কেন? খারাপ লাগবে কেন?"
"না মানে এটা খুবই অনভিপ্রেত। আপনার সামনে এরকম কথা কাটাকাটি, ঝগড়া। উচিত হয়নি।"
"সে বন্ধুদের মধ্যে ঝগড়া করা কখনোই উচিত না। আমার সামনেই হোক কি আড়ালে। তাই না?"
"হুম। আরো একটা কথা ছিল।"
"বলুন না।"
"আপনাকে আমি খুবই শ্রদ্ধা করি। আপনি ভীষণ লজিকাল। এবং ভালো মনের মানুষ।"
"ব্যস ব্যস। আর না। এত প্রশংসা আমার হজম হবে না।"
"না সত্যি বলছি। আপনি..."
"থাক না অভি। কিছু কথা, না বলাই থাকুক। তাই না?"
"থাকবে বলছেন?"
"হ্যাঁ। সেই ভালো।"
"আমারে না হয় না জানো..." (সুর করে)
"আমার ব্যাকুল নয়নও নেই, নেই উতল আঁচল বা এলোথেলো চুল।"
"সে ভাবনা ভাবতে হবে না। সেসবের আমার ব্যবস্থা অন্য। এই রে, আপনিও কি শুভর মতো ভাবলেন নাকি যে আমি আপনার প্রেমে পড়েছি?"
"পড়েননি?"
"উঁহু। আপনাকে ভালো বন্ধু মনে করেছি। ব্যস। আসলে আমাদের দেশে এইটাই সমস্যা। ছেলে মেয়ের বন্ধুত্ব যেন হতেই পারে না।"
"আপনি বাঁচালেন আমায়। নইলে ভীষণ অস্বস্তি হতো। খারাপ লাগতো। আসলে, আমি এখনো কাউকেই ভালোবাসতে, সেই অর্থে, বা কোনো সম্পর্কে জড়ানোর মতো মেন্টাল স্টেটে নেই। চাইনি কোনো কমপ্লিকেশন।"
"শুভ জানে?"
"কী?"
"এই যে, সম্পর্কে জড়াবেন না।"
"সবটা জানাতেই হবে? আমি তো বলিনি যে জড়াবো। বন্ধু হিসেবেই তো থাকতে পারি। সেই কথা জানে।"
"হুম। ভালো তবে।"
"অনেক রাত হলো। এবার ঘুমোতে যাই। আপনিও শুয়ে পড়ুন।"
"হুম। কাল কিন্তু একটা দারুণ সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাবো। ওয়েদার ভালো হয়ে গিয়েছে। কাজেই ভিউ পয়েন্ট থেকে খুব সুন্দর দেখতে পাবেন। তিনজনেই যাবো।"
"আর আঙ্কেল?"
"যদি বাবা আমাদের বেরোনোর আগেই ফিরে আসে, তাহলে বলবো জয়েন করতে।"
"বেশ বেশ। আলাপ করতে আগ্রহী।"
"গুড নাইট।"
"গুড নাইট।"
(ক্রমশ)
বি: দ্র: আর হয়তো দুটো পর্ব। তারপর শেষ।
করোনা রিলিফ ফান্ডের জন্য বই নিলেন? বন্ধুমহলে জানালেন?
Friday, March 27, 2020
রঙ রুট (১৭)
সুচেতনা
জাহ্নবী আর শুভঙ্কর ফিরে আসে প্রায় পাঁচটা নাগাদ। এসে দেখে অভি নিজের ঘরে। দরজা বন্ধ করে রয়েছে। বেয়ারা জানালো, ও ঘুমোচ্ছে। ওকে যেন কেউ না ডাকে। বিরক্ত না করে। এই মর্মে নির্দেশ দিয়ে রেখেছে। শুভ আর জাহ্নবী একটু মুখ চাওয়াচাওয়ি করে যে যার নিজের ঘরে ফিরে গেল। অনেক হাঁটাহাঁটি হয়েছে। দুজনেই ক্লান্ত। বেয়ারা জিজ্ঞেস করলো, চা পাঠাবে কি না। শুভ পাঠাতে বললো। জাহ্নবী বললো ও পরে খাবে। ঘরে ফিরে ও সুভদ্রাকে ফোন করলো। সারাদিন পর মেয়ের গলা শুনে মায়ের একটু স্বস্তি। জমিয়ে রোডোডেনড্রোন দেখার কথা বললো। সুভদ্রা বললেন, "যাক। তোর এই যে রঙের খেলা দেখতে আসার ইচ্ছে, তাহলে সেটি পূর্ণ হলো। বল?"
"হ্যাঁ মা। খুব ভালো লাগলো। জানো তো, আই হ্যাড গুড কম্পানি। শুভঙ্কর। প্রবাসী বাঙালি। বম্বেতে থাকে। এখানকার যে মালিক, অভিমন্যু, ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। ওরই গেস্ট হয়ে এসেছে। ওদের দুই বন্ধুতে ঝগড়া হয়েছে। মান অভিমান পর্ব চলছে। তাই অভি আমাদের সাথে যায়নি।"
"কী নাম বললি?"
"শুভঙ্কর। এই রে পদবীটা কখনো জিজ্ঞেস করিনি।"
"না না। অন্য ছেলেটি। কী নাম ওর?"
"অভিমন্যু। ও ওর বাবার পালিত পুত্র। ও ও সিঙ্গল পেরেন্টের ছেলে জানো। তাই আমার সাথে খুব ভালো আলাপ হয়েছে। মিলমিশ খুব ভালো। বেসিকালি আমরা তিনজন দারুণ বন্ধু। দাঁড়াও, তোমায় ছবি পাঠাই।"
সুভদ্রা খানিকক্ষণ কিছুই বলেন না।
জাহ্নবী আবার বলতে থাকে, "কী গো মা? দেখলে?ছবি পাঠালাম।"
সুভদ্রা উত্তর দিলো, "হ্যাঁ। ওই লাল সোয়েটার ছেলেটি?"
"না। ওটা শুভ। অন্যজন অভি।"
"বাঃ। দুজনকেই কী ভালো দেখতে।"
"হ্যাঁ। শুনেছি ওর বাবা নাকি দারুণ হ্যান্ডসাম। সিঙ্গলও। কাল আসবেন। দেখা হবে। আলাপ করবো। শুভ তো ওর আঙ্কেল বলতে অজ্ঞান। সারাক্ষণ আঙ্কেল এই করেছে, আঙ্কেল এই বলে, এই করতেই থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয়, বাপ রে, এত ভালোও কেউ হয় নাকি? আচ্ছা মা, একটা আইডিয়া এলো। এই আঙ্কেল তো সিঙ্গল। তোমার সাথে প্যাচ আপ করাবো নাকি? কী? বলো বলো।"
সুভদ্রা রেগে গিয়ে বলেন, "চুপ চুপ। যত ফাজলামি ইয়ার্কি, না? কোথায় নিজের বিয়ে করার বয়স হচ্ছে, তা না। এখন তিনি মায়ের বিয়ে দিয়ে হেডলাইন হবেন। হুহ।"
"কেন মা? অসুবিধে কী? আমি বড় হয়ে গিয়েছি। আমার নিজস্ব জগৎ আছে। তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছ। ব্যস। এবার ঝাড়া হাত পা। নিজেকে এটেনশন দাও।"
"তুই থামবি?"
"আহা আহা, রেগে যাও কেন?"
"তুই চুপ কর।"
"আচ্ছা বেশ। কাল আঙ্কেলের সাথে দেখা হোক। ছবি তুলে পাঠাবো তোমায়। দেখো পছন্দ হয় কি না। অবশ্য আমায়ও দেখতে হবে। এলিজিবল কি না। তোমার জন্য অবভিয়াসলি।"
সুভদ্রা আর কোনো কথা না বলে ফোনটা কেটে দেয়। অদ্ভুত লাগে জাহ্নবীর। ওর মা যে কেন এতটা ক্ষেপে গেল, বুঝতে পারেনা। এমন নয় যে মায়ের বিয়ে দেবে বলে ও আগে কথা তোলেনি। মা রেগে যাননি। বরং মজায় যোগ দিয়েছেন। কে জানে।
ফোনটা চার্জে বসিয়ে জাহ্নবী ঘরে তালা দিয়ে বেরোয়। চা তেষ্টা পেয়েছে। পাশের বাড়ি যেতে গিয়ে হৈচৈ খোসগল্পের শব্দ কানে আসে। একটু থমকে দাঁড়ায়। শুনতে পায় অভি আর শুভর গলা। অভির ঘর থেকে। দরজা বন্ধ। গতকালের পর থেকে ওদের দুজনের এই বন্ধ ঘরের আলাপ ভাবলেই ভয় লাগে। তবে এখন তো মনে হচ্ছে সব ঠিকঠাক। হাসির রোল ভেসে আসছে দমকে দমকে। জাহ্নবী ভাবলো, থাক। পুরোনো বন্ধু। নিজেদের ঝামেলা নিজেরাই মিটিয়ে নেবে। ও বরং এর মধ্যে আর ঢুকবে না। বেয়ারকে এক কাপ চা দিতে বলে সোফায় বসলো।
চায়ের কাপে প্রথম চুমুকটা দিয়েছে, এমন সময়ে কানে এলো গীটারের টুংটাং। শোনা গেল শুভর কণ্ঠে
"কিছুদিন মনে মনে
কিছুদিন মনে মনে শ্যামের পিরিত রাখ গোপনে।
ইশারায় কইবি কথা গোঠে মাঠে..."
আঃ। এইটা তো মায়ের কাছে শেখা। প্রিয় গান। জাহ্নবী আর থামাতে পারলো না নিজেকে। দরজায় ঠ্যালা দিয়ে ঢুকে পড়ল ওদের আসরে।
বিছানার ওপরে দুজনে বসে। অভির হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। হাঁটুতে অন্য হাত দিয়ে তাল দিচ্ছে। শুভ বিভোর হয়ে গান গাইছে। জাহ্নবী তার সাথে ধরে ফেলল গান।
"শ্যামকে যখন পড়বে মনে
চাইবি কালো মেঘের পানে..."
শুভ অবাক হয়ে গান থামিয়ে তাকালো। জাহ্নবী ইশারায় ওকে গেয়ে যেতে বললো। ব্যস। তারপর সারা সন্ধ্যে চললো একের পর এক গান। কখনো অভি, কখনো শুভ। জাহ্নবীও গেয়েছে। বনফায়ার বার্বিকিউ প্ল্যান সব মুলতুবি। বেয়ারা এসে মাঝে মাঝে হুইস্কি আর পকড়া দিয়ে যাচ্ছিল। উষ্ণ পানীয়ে গলা ভিজে গান আরো খোলতাই।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যে নেমে রাত হয়ে আসে। ডিনারের তাড়া আসতে থাকে কিচেন থেকে। ওরা খেলে তবে বাবুর্চি বেয়ারা কাজ মিটিয়ে শুতে পারবে। জাহ্নবীরাও তাই দেরি করতে পারেনা আর। ডিনার টেবিলে গরম গরম ফ্রায়েড রাইস আর চিলি পনির। সাথে স্যালাড। আড্ডাও জমে ভালোই। জাহ্নবী খুব খুশি। অভি আর শুভর মনোমালিন্য যে কেটে গিয়েছে, এতেই আনন্দ। ও বলেও ফেলে সে কথা। শুনে দুই বন্ধু হো হো করে হেসে উঠে বলে, "আরে, আমরা এরকমই। সেই চাড্ডি আমলের বন্ধু। ঝগড়া ভাব, লোগেই থাকে। We fight like crazy and make up easier!"
"হলেই ভালো", জানায় জাহ্নবী।
খাওয়া দাওয়া মিটিয়ে এবার ওরা নিজেদের ঘরে ফেরার উদ্যোগ করে। সারাদিনের পরিশ্রমে দুজনেরই চোখে ঘুম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একবার আকাশের দিকে তাকালো শুভ। মেঘ একটু কাটবো কাটবো করছে। তারাও দেখা যাচ্ছে অল্প। শুভঙ্কর বললো, "দেখছো আকাশটা? মনে হয় রাত্রে ক্লিয়ার হতে পারে। আর তাহলেই কাঞ্চনজঙ্ঘা।
জাহ্নবী মাথা নেড়ে বলে, "দেখা যাক। আমার সাধনার ফল কী দাঁড়ায়..."
(ক্রমশ)
বি: দ্র: আপনাদের থেকে সাড়া পেয়েছি ত্রাণ তহবিলের জন্য। অপেক্ষায় আছি আরো স্বতঃস্ফূর্ত সাড়ার। আপনারা বার্তাটি ছড়িয়ে দিন পরিচিত মহলে। এমার্জেন্সী ফান্ডে টাকাটা দ্রুত পৌঁছে যাওয়া খুব খুব দরকার এখন। বিস্তারিত জানতে আমার সকালের পোস্টটি দেখুন।
সুচেতনা
জাহ্নবী আর শুভঙ্কর ফিরে আসে প্রায় পাঁচটা নাগাদ। এসে দেখে অভি নিজের ঘরে। দরজা বন্ধ করে রয়েছে। বেয়ারা জানালো, ও ঘুমোচ্ছে। ওকে যেন কেউ না ডাকে। বিরক্ত না করে। এই মর্মে নির্দেশ দিয়ে রেখেছে। শুভ আর জাহ্নবী একটু মুখ চাওয়াচাওয়ি করে যে যার নিজের ঘরে ফিরে গেল। অনেক হাঁটাহাঁটি হয়েছে। দুজনেই ক্লান্ত। বেয়ারা জিজ্ঞেস করলো, চা পাঠাবে কি না। শুভ পাঠাতে বললো। জাহ্নবী বললো ও পরে খাবে। ঘরে ফিরে ও সুভদ্রাকে ফোন করলো। সারাদিন পর মেয়ের গলা শুনে মায়ের একটু স্বস্তি। জমিয়ে রোডোডেনড্রোন দেখার কথা বললো। সুভদ্রা বললেন, "যাক। তোর এই যে রঙের খেলা দেখতে আসার ইচ্ছে, তাহলে সেটি পূর্ণ হলো। বল?"
"হ্যাঁ মা। খুব ভালো লাগলো। জানো তো, আই হ্যাড গুড কম্পানি। শুভঙ্কর। প্রবাসী বাঙালি। বম্বেতে থাকে। এখানকার যে মালিক, অভিমন্যু, ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। ওরই গেস্ট হয়ে এসেছে। ওদের দুই বন্ধুতে ঝগড়া হয়েছে। মান অভিমান পর্ব চলছে। তাই অভি আমাদের সাথে যায়নি।"
"কী নাম বললি?"
"শুভঙ্কর। এই রে পদবীটা কখনো জিজ্ঞেস করিনি।"
"না না। অন্য ছেলেটি। কী নাম ওর?"
"অভিমন্যু। ও ওর বাবার পালিত পুত্র। ও ও সিঙ্গল পেরেন্টের ছেলে জানো। তাই আমার সাথে খুব ভালো আলাপ হয়েছে। মিলমিশ খুব ভালো। বেসিকালি আমরা তিনজন দারুণ বন্ধু। দাঁড়াও, তোমায় ছবি পাঠাই।"
সুভদ্রা খানিকক্ষণ কিছুই বলেন না।
জাহ্নবী আবার বলতে থাকে, "কী গো মা? দেখলে?ছবি পাঠালাম।"
সুভদ্রা উত্তর দিলো, "হ্যাঁ। ওই লাল সোয়েটার ছেলেটি?"
"না। ওটা শুভ। অন্যজন অভি।"
"বাঃ। দুজনকেই কী ভালো দেখতে।"
"হ্যাঁ। শুনেছি ওর বাবা নাকি দারুণ হ্যান্ডসাম। সিঙ্গলও। কাল আসবেন। দেখা হবে। আলাপ করবো। শুভ তো ওর আঙ্কেল বলতে অজ্ঞান। সারাক্ষণ আঙ্কেল এই করেছে, আঙ্কেল এই বলে, এই করতেই থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয়, বাপ রে, এত ভালোও কেউ হয় নাকি? আচ্ছা মা, একটা আইডিয়া এলো। এই আঙ্কেল তো সিঙ্গল। তোমার সাথে প্যাচ আপ করাবো নাকি? কী? বলো বলো।"
সুভদ্রা রেগে গিয়ে বলেন, "চুপ চুপ। যত ফাজলামি ইয়ার্কি, না? কোথায় নিজের বিয়ে করার বয়স হচ্ছে, তা না। এখন তিনি মায়ের বিয়ে দিয়ে হেডলাইন হবেন। হুহ।"
"কেন মা? অসুবিধে কী? আমি বড় হয়ে গিয়েছি। আমার নিজস্ব জগৎ আছে। তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছ। ব্যস। এবার ঝাড়া হাত পা। নিজেকে এটেনশন দাও।"
"তুই থামবি?"
"আহা আহা, রেগে যাও কেন?"
"তুই চুপ কর।"
"আচ্ছা বেশ। কাল আঙ্কেলের সাথে দেখা হোক। ছবি তুলে পাঠাবো তোমায়। দেখো পছন্দ হয় কি না। অবশ্য আমায়ও দেখতে হবে। এলিজিবল কি না। তোমার জন্য অবভিয়াসলি।"
সুভদ্রা আর কোনো কথা না বলে ফোনটা কেটে দেয়। অদ্ভুত লাগে জাহ্নবীর। ওর মা যে কেন এতটা ক্ষেপে গেল, বুঝতে পারেনা। এমন নয় যে মায়ের বিয়ে দেবে বলে ও আগে কথা তোলেনি। মা রেগে যাননি। বরং মজায় যোগ দিয়েছেন। কে জানে।
ফোনটা চার্জে বসিয়ে জাহ্নবী ঘরে তালা দিয়ে বেরোয়। চা তেষ্টা পেয়েছে। পাশের বাড়ি যেতে গিয়ে হৈচৈ খোসগল্পের শব্দ কানে আসে। একটু থমকে দাঁড়ায়। শুনতে পায় অভি আর শুভর গলা। অভির ঘর থেকে। দরজা বন্ধ। গতকালের পর থেকে ওদের দুজনের এই বন্ধ ঘরের আলাপ ভাবলেই ভয় লাগে। তবে এখন তো মনে হচ্ছে সব ঠিকঠাক। হাসির রোল ভেসে আসছে দমকে দমকে। জাহ্নবী ভাবলো, থাক। পুরোনো বন্ধু। নিজেদের ঝামেলা নিজেরাই মিটিয়ে নেবে। ও বরং এর মধ্যে আর ঢুকবে না। বেয়ারকে এক কাপ চা দিতে বলে সোফায় বসলো।
চায়ের কাপে প্রথম চুমুকটা দিয়েছে, এমন সময়ে কানে এলো গীটারের টুংটাং। শোনা গেল শুভর কণ্ঠে
"কিছুদিন মনে মনে
কিছুদিন মনে মনে শ্যামের পিরিত রাখ গোপনে।
ইশারায় কইবি কথা গোঠে মাঠে..."
আঃ। এইটা তো মায়ের কাছে শেখা। প্রিয় গান। জাহ্নবী আর থামাতে পারলো না নিজেকে। দরজায় ঠ্যালা দিয়ে ঢুকে পড়ল ওদের আসরে।
বিছানার ওপরে দুজনে বসে। অভির হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। হাঁটুতে অন্য হাত দিয়ে তাল দিচ্ছে। শুভ বিভোর হয়ে গান গাইছে। জাহ্নবী তার সাথে ধরে ফেলল গান।
"শ্যামকে যখন পড়বে মনে
চাইবি কালো মেঘের পানে..."
শুভ অবাক হয়ে গান থামিয়ে তাকালো। জাহ্নবী ইশারায় ওকে গেয়ে যেতে বললো। ব্যস। তারপর সারা সন্ধ্যে চললো একের পর এক গান। কখনো অভি, কখনো শুভ। জাহ্নবীও গেয়েছে। বনফায়ার বার্বিকিউ প্ল্যান সব মুলতুবি। বেয়ারা এসে মাঝে মাঝে হুইস্কি আর পকড়া দিয়ে যাচ্ছিল। উষ্ণ পানীয়ে গলা ভিজে গান আরো খোলতাই।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যে নেমে রাত হয়ে আসে। ডিনারের তাড়া আসতে থাকে কিচেন থেকে। ওরা খেলে তবে বাবুর্চি বেয়ারা কাজ মিটিয়ে শুতে পারবে। জাহ্নবীরাও তাই দেরি করতে পারেনা আর। ডিনার টেবিলে গরম গরম ফ্রায়েড রাইস আর চিলি পনির। সাথে স্যালাড। আড্ডাও জমে ভালোই। জাহ্নবী খুব খুশি। অভি আর শুভর মনোমালিন্য যে কেটে গিয়েছে, এতেই আনন্দ। ও বলেও ফেলে সে কথা। শুনে দুই বন্ধু হো হো করে হেসে উঠে বলে, "আরে, আমরা এরকমই। সেই চাড্ডি আমলের বন্ধু। ঝগড়া ভাব, লোগেই থাকে। We fight like crazy and make up easier!"
"হলেই ভালো", জানায় জাহ্নবী।
খাওয়া দাওয়া মিটিয়ে এবার ওরা নিজেদের ঘরে ফেরার উদ্যোগ করে। সারাদিনের পরিশ্রমে দুজনেরই চোখে ঘুম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একবার আকাশের দিকে তাকালো শুভ। মেঘ একটু কাটবো কাটবো করছে। তারাও দেখা যাচ্ছে অল্প। শুভঙ্কর বললো, "দেখছো আকাশটা? মনে হয় রাত্রে ক্লিয়ার হতে পারে। আর তাহলেই কাঞ্চনজঙ্ঘা।
জাহ্নবী মাথা নেড়ে বলে, "দেখা যাক। আমার সাধনার ফল কী দাঁড়ায়..."
(ক্রমশ)
বি: দ্র: আপনাদের থেকে সাড়া পেয়েছি ত্রাণ তহবিলের জন্য। অপেক্ষায় আছি আরো স্বতঃস্ফূর্ত সাড়ার। আপনারা বার্তাটি ছড়িয়ে দিন পরিচিত মহলে। এমার্জেন্সী ফান্ডে টাকাটা দ্রুত পৌঁছে যাওয়া খুব খুব দরকার এখন। বিস্তারিত জানতে আমার সকালের পোস্টটি দেখুন।
রঙ রুট (১৬)
সুচেতনা
লেপচাজগতের হোমস্টেটা আরো সুন্দর। একদম জঙ্গলের মধ্যে। দুটো একতলা কাঠের বাংলো পাশাপাশি। একটাতে অভি থাকে ওর বাবার সাথে। সেখানেই কিচেন, ডাইনিং রুম আর ছোট অফিস। অফিসঘরেই থাকে বাবুর্চি আর বেয়ারা। পাশের বাড়িতে তিনটে ঘর। সেখানেই দুটোতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে জাহ্নবী আর শুভর। অভি থাকবে নিজের বাড়িতেই। ওর বাবা কাল সকালে এসে পৌঁছবেন গৌহাটি থেকে। আজ এখন ব্রেকফাস্ট সেরে ওদের রোডোডেনড্রোন দেখতে যাওয়ার কথা। অভি ওদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসছিল, এমন সময়ে শুভ ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, "অভি, আমরা তাহলে কখন বেরোচ্ছি? লাঞ্চের আগে না পরে?" অভি একবার তাকালো শুভর দিকে। তারপর জাহ্নবীর দিকে। তারপর ঠান্ডা গলায় কেটে কেটে শুভর দিকে ফিরে বললো, "আমি যাব না। তোরা দুজনে বরং যা। সাথে যদি অরিজিৎকে লাগে, ও যাবে। তোরা একাও যেতে পারিস। সোজা রাস্তা। কোনো অসুবিধে হবে না। ইন ফ্যাক্ট, সুবিধেই হবে। তোরা প্রাইভেসি পাবি।" এই বলে অভি বেরিয়ে গেল, গটগট করে।
জাহ্নবী বিহ্বল। শুভর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো, "ব্যাপারটা কী হলো?" শুভ ওকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে বললো, "চাপ নিয়ো না। অভিটা ওরকম। চিরকাল। হি উইল বি ফাইন।" জাহ্নবী বুঝে ওঠেনা এদের ব্যাপার। শুভ আর অভি, দুজনেই দুজনের সম্পর্কে ঠিক এক কথা বলে। আসলে ওরা দুজন দুজনের ভীষণ ভালো বন্ধু। তাই হয়তো এই মান অভিমান, এবং তার পরে যে সব ঠিক হয়ে যাবে, তার নিশ্চয়তা।
কিচেন থেকে স্যান্ডউইচ, কফি আর স্যালাড প্যাক করে দেয় বাবুর্চি। শুভ আর জাহ্নবী সেই ফুড হ্যাম্পার সাথে নিয়ে এগিয়ে চলে রঙের উদ্দেশ্যে। রঙ রুটে। সবুজ পাইনের জঙ্গল। টাটকা বাতাস। বুক ভরা নিঃশ্বাস। হালকা মেঘ। রোদের তেজও কম। পথে চলতে বেশ আরাম। জাহ্নবীর গলায় ঝুলছে ওর ভারী ক্যামেরাটা। চলতে চলতে মাঝে মাঝে এদিক ওদিকের ছবি তুলে চলছে। টের পাচ্ছে গুনগুন করে গান করতে করতে শুভর মোবাইলের লেন্স মাঝে মাঝেই ওর দিকে তাক হচ্ছে। মৃদু প্রতিবাদ করায় শুভ সুন্দর যুক্তি দিয়ে বলে দিলো, "তুমি তো সারাক্ষণ অন্যদের ছবি তুলছো। তোমার ছবিও তো কাউকে তুলতে হবে। মাকে পাঠাবে না নাকি?" এরপরে আর কিছু বলার থাকে না জাহ্নবীর। মোক্ষম জায়গায় শুভ মোচড়টা দিয়েছে।
এইবার ক্রমশ হাঁটার পথের দুই দিকের দৃশ্য বদলাতে থাকে। ঘন সবুজের মাঝে মাঝে কয়েক ঝলক লাল। থোকা হয়ে ফুটে আছে রোডোডেনড্রোন। আরো খানিকটা হাঁটতে থাকে ওরা। পথ একটু চড়াই। অল্প হাঁপ ধরছেও বটে। একটু বসলে হয়। জাহ্নবী সে কথা বলে শুভঙ্করকে। শুভ হাতের কব্জি ঘুরিয়ে সময় দেখে বলে, "আড়াইটে বাজতে যায়। বরং এর একটু এগিয়ে ঐখানে যাই। ফাঁকা ফাঁকা আছে। বসে লাঞ্চ সেরে আবার ফিরি। নইলে অন্ধকার হয়ে যাবে। এইসব জায়গায় ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে। এই জঙ্গলে আবার লেপার্ড টেপার্ড আছে কি না কে জানে।" জাহ্নবী শুভর কথায় সম্মতি জানিয়ে এগিয়ে চলে। মিনিট দশেক পর ওরা পৌঁছয় একটা খোলা জায়গায়। একটু সমতল গোছের। দুধারে গাছের সংখ্যা কম। চারিদিকে রোডোডেনড্রোন গাছের সারি। হ্যাম্পার থেকে খাবার বের করে ওরা খেতে থাকে। চলতে থাকে গল্প।
জাহ্নবী হঠাৎ সামনের পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে, "আচ্ছা শুভ, কাল রাতে অভিমন্যুকে তুমি কী বেশ একটা গ্রাজ নিয়ে বলছিলে, সেটা কী?"
শুভ খাওয়া থামিয়ে জাহ্নবীর মুখের দিকে তাকায়। জাহ্নবী নিষ্পলক দৃষ্টিতেই তাকিয়ে থাকে, যেমন ছিল। শুভর উত্তরের অপেক্ষায়। শুভ একটু ইতস্তত করে বলে, "ও বেশ পুরোনো কাসুন্দি। না ঘাটলেই ভালো। দরকার কী?"
"দরকার আছে শুভ। বলো।"
"ওয়েল, শুনতে যদি চাওই তো শোনো। নাথিং এক্সট্রা অর্ডিনারি। আমরা কলেজে দুজনেই বিশাখাকে ভালোবাসতাম। আমি আগে। তারপর অভি। ইন ফ্যাক্ট, বিশাখা আমায় ডিচ করে। তারপর অভি সিনে আসে। ন্যাচারালি আই ওয়াজ শকড। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমারই এক্স গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঘুরছে। ওই সময়ে আমাদের খুব ঝামেলা হয়। কথা বন্ধ হয়েছিল অনেক মাস। খুবই অকওর্ড সিচ্যূএশন। তারপর ইয়ারের শেষের দিকে বিশাখা অভিকেও ডিচ করে। অভি অনেকদিন অবধি ভেবে এসেছে এর জন্য আমি দায়ী। আংকেল, মানে ওর বাবা, সব জেনে শুনে আমাদের দুজনকে একসাথে বসিয়ে অনেক বোঝান। উই মেড পিস। অর সো আই থট। এখন দেখছি, উই ডিড নট। কাল আঙ্কেল আসবেন। মে বি উই উইল নিড হিম টু পুট সাম সেন্স ইন্টু আস।"
জাহ্নবী আলতো করে চেপে ধরে শুভর হাত। ওর কাঁধে মাথা দিয়ে বলে, "দেখো, ইট উইল বি ইজি। অভিও রিপেন্ট করছে কালকের ঝগড়া। আই কুড সি ইট ইন হিজ আইজ। আর তুমিও যথেষ্ট আগ্রহী টু সর্ট থিংজ। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর আমার দিকে থেকে একটা কথা বলতে পারি, তুমি আর অভি, দুজনেই আমার খুব ভালো বন্ধু। আশা করি সেটা বজায় থাকবে।"
পড়ন্ত দুপুরের সোনালী আলো এসে পড়ে ওদের মুখে। খানিকক্ষণ শান্ত হয়ে বসে উপভোগ করে নিস্তব্ধতা। তারপর ফিরতে হবে, নইলে অন্ধকার, এই চিন্তায় হাঁটা লাগায়।
(ক্রমশ)
Thursday, March 26, 2020
রঙ রুট ১৫
সুচেতনা
V
মেঘ এখনো কাটেনি। দার্জিলিংয়ে থাকার মেয়াদ আজ সকালেই শেষ হলো। জাহ্নবীর কপালে কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন, মেলেনি। মা বোধহয় ঠিকই বলেছে, সবার জন্য নয়। সাধনা করতে হয়। আর জাহ্নবীর সাধনা বুঝি যথেষ্ট হয়নি। আজ লেপচাজগৎ যাচ্ছে ওরা। সন্দীপের ওখানে ব্রেকফাস্টের পর রেজিস্টারে প্রয়োজনীয় সই সাবুদ মিটিয়ে রওনা দিয়েছে, অরিজিতের গাড়িতেই। দার্জিলিংয়ের আবহাওয়া ভালো না থাকায় টাইগার হিল ওরা যায়নি। মূলত পায়ে হেঁটেই যা ঘুরে বেরিয়েছে। তবে গতকাল একবার ঘুম আর বাতাসিয়া লুপ ঘুরে এসেছে।
লেপচাজগৎ মোটে এক ঘন্টার পথ। আড্ডার ছলে গাড়িতে উঠতে না উঠতেই প্রায় পৌঁছে যাওয়া। দুই ধারে সারি সারি পাইনের রাজি, সবুজ। টাটকা তাজা বাতাস। হ্যাপি হিল হোম স্টের সামনে গাড়ি থেকে নেমে বুক ভরে টাটকা বাতাসে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিলো জাহ্নবী। আহা, কী পরিষ্কার এই বাতাস। কোনো দূষণের জায়গাই নেই। শুভঙ্করকে ডেকে বললো, "কী অদ্ভুত সুন্দর না জায়গাটা? দেখো শুভ, কী শান্ত, নিস্তব্ধ। একটু কান পাতলেই কত রকমের পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। শোনো।" শুভ মাথা নেড়ে সায় দেয়। জাহ্নবীর সাথে যাবতীয় মান অভিমান পর্ব মিটে গিয়েছে ওর। দার্জিলিংয়েই। সেদিন অভি আর জাহ্নবী ম্যাল থেকে তারপর জলাপাহার রোডের দিকটা অবধি দেখে এসেছিল। শুভর দেখা মেলেনি। তবে ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে শুভ হাজির। ও নাকি কোনো এক ছোট্ট তিব্বতি দোকানে বসে কয়েক কাপ চা আর ম্যাগি সহ স্থানীয়দের সাথে এমনই কথা বলতে ব্যস্ত ছিল যে ম্যালে এসে ওদের সাথে দেখা করার সুযোগ পায়নি। "বলো ভুলে গিয়েছিলে।" জাহ্নবীর অভিযোগ অবশ্য সরাসরি না করে উড়িয়েই দিয়েছিল। সন্ধ্যের বনফায়ার, বার্বিকিউ সব সময়ই একটা চোরা চাপা টেনশন, জাহ্নবী আর অভি ভালোই বুঝতে পারছিল। শেষমেশ ওরা আর নিজেদের দমিয়ে রাখতে পারেনি।
রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে জাহ্নবী বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। মন খারাপ। মন অস্থির। এমন সময় দূরে অভির ঘর থেকে কথা কাটাকাটির শব্দ ভেসে আসছিল। নির্জন, নিরিবিলি। তাই মোটামুটি কথা বোঝাই যাচ্ছিল। শুভঙ্কর একটু মাত্রাতিরিক্ত মদ খেয়ে বসেছিল। আর মদ পেটে পড়তেই বীর বাঙালির মতোই কথার ফুলঝুরি শুরু।
"শুভ তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস।"
"বাড়াবাড়ি? আমি করছি না তুই?"
"তুই।"
"সেই তো, সেই তো। সারা বিকেল জাহ্নবীর সাথে ম্যালে বসে সোহাগ কে করেছিল রে? আমি? না তুই?"
"আস্তে শুভ, আস্তে। নিরিবিলি। সবাই শুনতে পাবে।"
"শুনুক। লোকের জানা উচিত। ভদ্রতার মুখোশের আড়ালে আসল অভিমন্যুকে।"
"আসল অভিমন্যুর কী হয়েছে?"
"এই যে যেই দেখলি, যেই বুঝলি, মেয়েটাকে আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে, ইউ হ্যাড টু কাম ইন বিটুইন আস। তুই এখনো বিশাখার সাথে তোর ঝামেলার জন্য আমায় দায়ী করিস। তোদের ব্রেক আপের দায় আমার নয় অভি। ফর গডস সেক। আন্ডারস্ট্যান্ড, বিশাখা ব্রোক আপ বিকজ অফ হার ওন রিজনস। আই হ্যাড নাথিং টু ডু দ্যেয়ার। প্লিজ তুই সেই গ্রাজটা আমার আর জাহ্নবীর মধ্যে এনে ফেলিস না। প্লিজ। বিন এ লং টাইম সিন্স আই গট দ্য কারেজ টু লাভ। জাহ্নবীকে আমি ভালোবাসি। ওকে আমি ভালো করে চিনতে চাই। ডোন্ট কাম ইন বিটুইন আস। প্লিজ অভি।"
জাহ্নবী স্তব্ধ হয়ে শুনে গিয়েছে কথাগুলো। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। টুঁ শব্দটি না করে দুই চোখ দিয়ে গরম নোনতা কান্না নেমে চলেছে। কাঁদতে কাঁদতে জাহ্নবী কখন জানি ধপ করে পড়ে গিয়েছে বারান্দায়। টাল রাখতে না পেরে। সেই সময়ে কাঠের টেবিলটা উল্টে পড়ে। তারই শব্দে চমকে বারান্দায় এসে ওকে এই অবস্থায় দেখে অভি আর শুভ। ছুটতে ছুটতে আসে ওরা দুজন। ওর ঘরের দরজা ভাগ্যিস ভ্যাজানো ছিল। জাহ্নবীকে সযত্নে, পরম মমতায় দুই হাতে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয় শুভঙ্কর। অভি জলের ছিটে দেয়। সেই স্পর্শে জাহ্নবীর জ্ঞান ফিরলেও ডুকরে কেঁদে ওঠে আবার। শুভঙ্কর সারা রাত থেকে যায় ওই ঘরে। জাহ্নবীর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে ও। চুলে বিলি কেটে দেয়। ওর কোলে মাথা কখন জানি জাহ্নবী নিশ্চিন্তে ঘুমের ঘোরে পৌঁছে যায়। শুভ তবু ওঠে না। কষ্ট হলেও, নড়ে না। পাছে জাহ্নবীর কষ্ট হয়। অভি খানিক চেয়ে থাকে ওদের দিকে। তারপর ফিরে যায় নিজের ঘরে। শুভটা আজ অনেকগুলো পুরোনো ক্ষত চাগাড় দিয়ে দিয়েছে। সারাতে হবে। প্রলেপ, সেই আদি অকৃত্রিম বৃদ্ধ, বৃদ্ধ সন্ন্যাসী।
(ক্রমশ)
সুচেতনা
V
মেঘ এখনো কাটেনি। দার্জিলিংয়ে থাকার মেয়াদ আজ সকালেই শেষ হলো। জাহ্নবীর কপালে কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন, মেলেনি। মা বোধহয় ঠিকই বলেছে, সবার জন্য নয়। সাধনা করতে হয়। আর জাহ্নবীর সাধনা বুঝি যথেষ্ট হয়নি। আজ লেপচাজগৎ যাচ্ছে ওরা। সন্দীপের ওখানে ব্রেকফাস্টের পর রেজিস্টারে প্রয়োজনীয় সই সাবুদ মিটিয়ে রওনা দিয়েছে, অরিজিতের গাড়িতেই। দার্জিলিংয়ের আবহাওয়া ভালো না থাকায় টাইগার হিল ওরা যায়নি। মূলত পায়ে হেঁটেই যা ঘুরে বেরিয়েছে। তবে গতকাল একবার ঘুম আর বাতাসিয়া লুপ ঘুরে এসেছে।
লেপচাজগৎ মোটে এক ঘন্টার পথ। আড্ডার ছলে গাড়িতে উঠতে না উঠতেই প্রায় পৌঁছে যাওয়া। দুই ধারে সারি সারি পাইনের রাজি, সবুজ। টাটকা তাজা বাতাস। হ্যাপি হিল হোম স্টের সামনে গাড়ি থেকে নেমে বুক ভরে টাটকা বাতাসে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিলো জাহ্নবী। আহা, কী পরিষ্কার এই বাতাস। কোনো দূষণের জায়গাই নেই। শুভঙ্করকে ডেকে বললো, "কী অদ্ভুত সুন্দর না জায়গাটা? দেখো শুভ, কী শান্ত, নিস্তব্ধ। একটু কান পাতলেই কত রকমের পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। শোনো।" শুভ মাথা নেড়ে সায় দেয়। জাহ্নবীর সাথে যাবতীয় মান অভিমান পর্ব মিটে গিয়েছে ওর। দার্জিলিংয়েই। সেদিন অভি আর জাহ্নবী ম্যাল থেকে তারপর জলাপাহার রোডের দিকটা অবধি দেখে এসেছিল। শুভর দেখা মেলেনি। তবে ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে শুভ হাজির। ও নাকি কোনো এক ছোট্ট তিব্বতি দোকানে বসে কয়েক কাপ চা আর ম্যাগি সহ স্থানীয়দের সাথে এমনই কথা বলতে ব্যস্ত ছিল যে ম্যালে এসে ওদের সাথে দেখা করার সুযোগ পায়নি। "বলো ভুলে গিয়েছিলে।" জাহ্নবীর অভিযোগ অবশ্য সরাসরি না করে উড়িয়েই দিয়েছিল। সন্ধ্যের বনফায়ার, বার্বিকিউ সব সময়ই একটা চোরা চাপা টেনশন, জাহ্নবী আর অভি ভালোই বুঝতে পারছিল। শেষমেশ ওরা আর নিজেদের দমিয়ে রাখতে পারেনি।
রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে জাহ্নবী বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। মন খারাপ। মন অস্থির। এমন সময় দূরে অভির ঘর থেকে কথা কাটাকাটির শব্দ ভেসে আসছিল। নির্জন, নিরিবিলি। তাই মোটামুটি কথা বোঝাই যাচ্ছিল। শুভঙ্কর একটু মাত্রাতিরিক্ত মদ খেয়ে বসেছিল। আর মদ পেটে পড়তেই বীর বাঙালির মতোই কথার ফুলঝুরি শুরু।
"শুভ তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস।"
"বাড়াবাড়ি? আমি করছি না তুই?"
"তুই।"
"সেই তো, সেই তো। সারা বিকেল জাহ্নবীর সাথে ম্যালে বসে সোহাগ কে করেছিল রে? আমি? না তুই?"
"আস্তে শুভ, আস্তে। নিরিবিলি। সবাই শুনতে পাবে।"
"শুনুক। লোকের জানা উচিত। ভদ্রতার মুখোশের আড়ালে আসল অভিমন্যুকে।"
"আসল অভিমন্যুর কী হয়েছে?"
"এই যে যেই দেখলি, যেই বুঝলি, মেয়েটাকে আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে, ইউ হ্যাড টু কাম ইন বিটুইন আস। তুই এখনো বিশাখার সাথে তোর ঝামেলার জন্য আমায় দায়ী করিস। তোদের ব্রেক আপের দায় আমার নয় অভি। ফর গডস সেক। আন্ডারস্ট্যান্ড, বিশাখা ব্রোক আপ বিকজ অফ হার ওন রিজনস। আই হ্যাড নাথিং টু ডু দ্যেয়ার। প্লিজ তুই সেই গ্রাজটা আমার আর জাহ্নবীর মধ্যে এনে ফেলিস না। প্লিজ। বিন এ লং টাইম সিন্স আই গট দ্য কারেজ টু লাভ। জাহ্নবীকে আমি ভালোবাসি। ওকে আমি ভালো করে চিনতে চাই। ডোন্ট কাম ইন বিটুইন আস। প্লিজ অভি।"
জাহ্নবী স্তব্ধ হয়ে শুনে গিয়েছে কথাগুলো। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। টুঁ শব্দটি না করে দুই চোখ দিয়ে গরম নোনতা কান্না নেমে চলেছে। কাঁদতে কাঁদতে জাহ্নবী কখন জানি ধপ করে পড়ে গিয়েছে বারান্দায়। টাল রাখতে না পেরে। সেই সময়ে কাঠের টেবিলটা উল্টে পড়ে। তারই শব্দে চমকে বারান্দায় এসে ওকে এই অবস্থায় দেখে অভি আর শুভ। ছুটতে ছুটতে আসে ওরা দুজন। ওর ঘরের দরজা ভাগ্যিস ভ্যাজানো ছিল। জাহ্নবীকে সযত্নে, পরম মমতায় দুই হাতে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয় শুভঙ্কর। অভি জলের ছিটে দেয়। সেই স্পর্শে জাহ্নবীর জ্ঞান ফিরলেও ডুকরে কেঁদে ওঠে আবার। শুভঙ্কর সারা রাত থেকে যায় ওই ঘরে। জাহ্নবীর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে ও। চুলে বিলি কেটে দেয়। ওর কোলে মাথা কখন জানি জাহ্নবী নিশ্চিন্তে ঘুমের ঘোরে পৌঁছে যায়। শুভ তবু ওঠে না। কষ্ট হলেও, নড়ে না। পাছে জাহ্নবীর কষ্ট হয়। অভি খানিক চেয়ে থাকে ওদের দিকে। তারপর ফিরে যায় নিজের ঘরে। শুভটা আজ অনেকগুলো পুরোনো ক্ষত চাগাড় দিয়ে দিয়েছে। সারাতে হবে। প্রলেপ, সেই আদি অকৃত্রিম বৃদ্ধ, বৃদ্ধ সন্ন্যাসী।
(ক্রমশ)
Wednesday, March 25, 2020
রঙ রুট ১৪
চা খেয়ে জাহ্নবী আর অভি ম্যালের দিকে হাঁটা লাগালো। যেতে যেতেই দুজনের মধ্যে টুকরো গল্প চলতে লাগলো। ম্যালে পৌঁছে অবশ্য এদিক ওদিক খুঁজেও শুভর দেখা মিলল না। অভি জাহ্নবীকে আশ্বস্ত করে বলল, "ঠিক আছে। শুভ হয়তো এগিয়ে গিয়েছে, এদিক ওদিকে ঘুরছে। কোন অসুবিধে নেই। ম্যাপ দেখে দেখে ঠিক চিনে ফিরে আসবে, দেখা না হলেও। আসুন, আমরা এইদিকটা বসি।" জাহ্নবী সায় দিল। অভির সাথে গল্প করতে খুব ভালো লাগছে। মিশুকে ছেলে। এবং বেশ মজার মজার কথা বলে। জাহ্নবী বেশিরভাগ সময়ই চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। কথায় কথায় অভি জানালো, ও সিঙ্গল পেরেন্টের কাছে মানুষ। বাবার কাছে। ছোট থেকে বড় হওয়া, পুরোটাই হোস্টেলে কাটিয়েছে। বাবার সাথে সময় কাটানো বলতে ওই স্কুলের ছুটিগুলোতে। খুবই আনন্দের ছিল সেসব দিন। কিন্তু বাবা ব্যস্ত ব্যবসা নিয়ে। আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। তাই ছোট্ট অভিকে হোস্টেলেই থাকতে হয়েছে। হোস্টেলের বন্ধুরাই কখন জানি বন্ধুর গন্ডি টপকে হয়ে গিয়েছে পরিবার। শুভঙ্করও তেমন। একদম স্কুল জীবনের বন্ধু। এখনো যোগাযোগটা সমানভাবে বজায় রয়েছে। অভির কথা শুনতে শুনতে জাহ্নবীর বারবার মনে হচ্ছিল, এ যেন ও নিজের কথা শুনছে। অভির শুধু বাবা আছে। ওর আছে মা। আর এই যে বন্ধুরা, পরিবারের চেয়ে কোনো অংশে কম না। এইটাও তো একদম বর্ণে বর্ণে সত্যি। জাহ্নবী বললো, "আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি অভি। আমারও জীবনের গল্প ডিটো।" অভি ওর দিকে তাকিয়ে বলল, "তাই ভাবি। এত মিল লাগছে কেন। আপনিও তার মানে এক ধাতুতেই গড়া। ও আরেকটা কথা, আপনাকে সকাল থেকে দেখেই খুব চেনা চেনা লাগছিলো। মনে হচ্ছিল যেন কোথায় দেখেছি এই মুখ। এখন বুঝছি। এটা বোধহয় আমাদের মতোদের চেহারার বৈশিষ্ট্য। আমরা ইন্ডিপেন্ডেন্ট, আমরা একটু আলাদা। তাই না?" জাহ্নবী একটু থেমে উত্তরে বলে, "আলাদা কি না জানি না। তবে হ্যাঁ, মানুষ হয়েছি আলাদা ভাবে। অন্যদের তুলনায়। ছোট থেকে সব সময় দেখে এসেছি বন্ধুরা সবাই পেরেন্ট টিচার্স মিটিংয়ে বাবা মা সহ এসেছে। আই হ্যাড ওনলি মাই মাদার। ফেস্টিভ্যালসে, জন্মদিনে, ভেকেশনে, সব্বাই মা বাবা নিয়ে আনন্দ করেছে। কিন্তু আমি? শুধু মা। এমন কী, আই ডিড নট ইভেন হ্যাভ আ সেট অফ গ্র্যান্ডপেরেন্টস।" অভি মাথা নাড়লো, তারপর জিজ্ঞেস করলো, "ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, হোয়াট এবাউট ইয়োর ড্যাড?"
"লেফ্ট। মাকে ছেড়ে চলে যায়, আমার জন্মের আগে।"
"আই সি। আর তোমার, আয়াম সরি, আপনার মায়ের রিলেটিভস? তারা?"
"তুমিটাই বরং থাকুক বুঝলে? ঐটাই বেস্ট। আমারও অসুবিধাই হচ্ছিল আপনিতে। জানি না। তোমায় কেন সব কথা বলছি। ইউজ্যুয়ালি আমি বলিনা কাউকে। অনেকেই শুনলে ভাবে আমি সিমপ্যাথি গ্যাদার করার চেষ্টা করছি। কিন্তু না। আই হ্যাড এ ডিফিকাল্ট চাইল্ডহুড। আমার মায়ের রিলেটিভসরাও মাকে ডিচ করেছিল। অল বিকজ শি chose টু হ্যাভ মি as an unmarried লেডি। আই হ্যাভ অলওয়েজ হ্যাড দিস সেন্স অফ ইনকমপ্লিটনেস। এই জন্য, ছোট থেকে অনেক কষ্ট পেয়েছি। ভুগেছি। মেন্টালি। আমার লেখাপড়া হ্যাম্পার্ড হয়েছে। থ্যাংকফুলি আমি এখন প্রফেশনাল হেল্প নিচ্ছি। তাই অনেক ভালো আছি। মাঝে মধ্যে মুড সুইংস হয়। থেরাপিস্টের সাহায্যে আমি নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছি।"
অভি কয়েক পলক তাকায় জাহ্নবীর দিকে। তারপর "এক মিনিট, আসছি" বলে এগিয়ে যায় আইসক্রিম বিক্রেতার দিকে। তারপর দু হাতে দুটো সফটি কিনে নিয়ে এসে বসে বেঞ্চে, জাহ্নবীর পাশে। ওর দিকে একটা কোন এগিয়ে দিয়ে বলে, "এই নাও। ধরো। বাবা বলে, দেয়ার ইজ নো স্যাডনেস দ্যাট এন আইসক্রিম ক্যান নট সল্ভ। এটা খাও। ভালো লাগবে। আর রাত্রে ভালো ভালো গান গেয়ে আমরা দারুণ টাইম স্পেন্ড করবো। ঠিক আছে? সন্দীপকে বলে দিই, বার্বিকিউ এর ব্যবস্থা রাখতে। গুড ফুড, গুড মিউজিক। সব মন খারাপ সেরে যাবে।" জাহ্নবী মাথা নেড়ে যোগ দেয়, "গুড কম্পানি টু।"
অভি বলে, "দেখো, তোমার সাথে আমি এমপাথাইজ করতে পারছি। অনেকটা একইরকম আমাদের অবস্থা। আরো শুনবে? আমি আবার হলাম গিয়ে, adopted। কাজেই বুঝতে পারছ। তবে হ্যাঁ, আমার বাবা কোনোদিনও আমায় সেটা ফিল করতে দেয়নি। বাবা আমায় খুব ভালোবাসে। বাবা ইজ মাই লাইফ। আমার বাবা খুব ভালো। খুব মিশুকে। খুব ফ্রেন্ডলি। আই থিংক ইউ উইল লাভ হিম। এই তো, আমরা পরশু লেপচাজগৎ যাবো। বাবা ওখানে থাকবে। রোডডেনড্রোন ট্রেইলে বাবা আমাদের গাইড করবে। মিট হিম। ইউ উইল ফিল হ্যাপি।"
জাহ্নবী সম্মতি জানায়। অভির মধ্যে একটা বন্ধু খুঁজে পেয়ে ভালো লাগে ওর। অনেক হালকা লাগে কথা বলে।
(ক্রমশ)
"লেফ্ট। মাকে ছেড়ে চলে যায়, আমার জন্মের আগে।"
"আই সি। আর তোমার, আয়াম সরি, আপনার মায়ের রিলেটিভস? তারা?"
"তুমিটাই বরং থাকুক বুঝলে? ঐটাই বেস্ট। আমারও অসুবিধাই হচ্ছিল আপনিতে। জানি না। তোমায় কেন সব কথা বলছি। ইউজ্যুয়ালি আমি বলিনা কাউকে। অনেকেই শুনলে ভাবে আমি সিমপ্যাথি গ্যাদার করার চেষ্টা করছি। কিন্তু না। আই হ্যাড এ ডিফিকাল্ট চাইল্ডহুড। আমার মায়ের রিলেটিভসরাও মাকে ডিচ করেছিল। অল বিকজ শি chose টু হ্যাভ মি as an unmarried লেডি। আই হ্যাভ অলওয়েজ হ্যাড দিস সেন্স অফ ইনকমপ্লিটনেস। এই জন্য, ছোট থেকে অনেক কষ্ট পেয়েছি। ভুগেছি। মেন্টালি। আমার লেখাপড়া হ্যাম্পার্ড হয়েছে। থ্যাংকফুলি আমি এখন প্রফেশনাল হেল্প নিচ্ছি। তাই অনেক ভালো আছি। মাঝে মধ্যে মুড সুইংস হয়। থেরাপিস্টের সাহায্যে আমি নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছি।"
অভি কয়েক পলক তাকায় জাহ্নবীর দিকে। তারপর "এক মিনিট, আসছি" বলে এগিয়ে যায় আইসক্রিম বিক্রেতার দিকে। তারপর দু হাতে দুটো সফটি কিনে নিয়ে এসে বসে বেঞ্চে, জাহ্নবীর পাশে। ওর দিকে একটা কোন এগিয়ে দিয়ে বলে, "এই নাও। ধরো। বাবা বলে, দেয়ার ইজ নো স্যাডনেস দ্যাট এন আইসক্রিম ক্যান নট সল্ভ। এটা খাও। ভালো লাগবে। আর রাত্রে ভালো ভালো গান গেয়ে আমরা দারুণ টাইম স্পেন্ড করবো। ঠিক আছে? সন্দীপকে বলে দিই, বার্বিকিউ এর ব্যবস্থা রাখতে। গুড ফুড, গুড মিউজিক। সব মন খারাপ সেরে যাবে।" জাহ্নবী মাথা নেড়ে যোগ দেয়, "গুড কম্পানি টু।"
অভি বলে, "দেখো, তোমার সাথে আমি এমপাথাইজ করতে পারছি। অনেকটা একইরকম আমাদের অবস্থা। আরো শুনবে? আমি আবার হলাম গিয়ে, adopted। কাজেই বুঝতে পারছ। তবে হ্যাঁ, আমার বাবা কোনোদিনও আমায় সেটা ফিল করতে দেয়নি। বাবা আমায় খুব ভালোবাসে। বাবা ইজ মাই লাইফ। আমার বাবা খুব ভালো। খুব মিশুকে। খুব ফ্রেন্ডলি। আই থিংক ইউ উইল লাভ হিম। এই তো, আমরা পরশু লেপচাজগৎ যাবো। বাবা ওখানে থাকবে। রোডডেনড্রোন ট্রেইলে বাবা আমাদের গাইড করবে। মিট হিম। ইউ উইল ফিল হ্যাপি।"
জাহ্নবী সম্মতি জানায়। অভির মধ্যে একটা বন্ধু খুঁজে পেয়ে ভালো লাগে ওর। অনেক হালকা লাগে কথা বলে।
(ক্রমশ)
Subscribe to:
Posts (Atom)