হিমাচল প্রদেশের ছোট্ট গ্রাম কসোল। পাহাড়ের কোলে এই গ্রাম। পাশ দিয়ে কুলকুল করে বয়ে চলেছে পার্বতী নদী, আপন মনে। কিছু বছর হলো পর্যটকদের অতি প্রিয় জায়গা হয়েছে কসোল। যার ফলে গ্রামবাসীরা অনেকেই তাই ট্যুরিজমকে করে নিয়েছে জীবিকা। অনেকেই এখন নিজেদের বাড়ির দু তিনটে ঘরকে সাজিয়ে গুছিয়ে হোম -স্টে হিসেবে ভাড়াও দিচ্ছে।
বিশ্বনাথ ভার্মা বয়স সত্তরের ওপর। এক কালে কুলুতে সরকারি হোটেলে ম্যানেজারি কাজ করেছেন। এখন অবসর জীবন কাটাতে গ্রামে ফিরে এসেছেন। স্ত্রী মারা গিয়েছেন বছর দশেক আগেই। এখন ছেলে বৌমা আর নয় বছরের নাতিকে নিয়েই সংসার। ছেলেও বাপের মতোই চাকরি করে, শিমলাতে। নামী হোটেলের খাস বাবুর্চি। নামডাক ভালোই। রোজগারপাতি মন্দ নয়। ছেলের পাঠানো টাকা, নিজের পেনশন এই দিয়েই দিব্যি সংসার চলে যায়। বৌমা লক্ষ্মী নামেও লক্ষ্মী, কাজেও তাই। নিজের হাতে সংসারটা যত্ন করে রেখেছে, গুছিয়ে ঘরকন্না করে। নাতি অর্জুন ঠাকুর্দার ন্যাওটা।
দোতলা কাঠের বাড়ির বারান্দায় এক চিলতে রোদ এসে পড়ে সকাল থেকেই। ঠান্ডা কাটাতে বিশ্বনাথ সকল হতেই সোয়েটার টুপি মোজাতে নিজেকে ভালো করে মুড়ে বসে থাকেন সেই রোদে। রোদের ওমটুকু শুষে নিতে। লক্ষ্মী ঠিক সময়মতো হয় নিজে নয় অর্জুনের হাত দিয়ে নাস্তা, কয়েক কাপ চা পাঠিয়ে দেয় ওপরে। পাশে রাখা পুরোনো টেবিলে ততোধিক পুরোনো রেডিওতে বিবিধ ভারতী চ্যানেলে হিন্দি গান চলতে থাকে। খবরের কাগজ, টুকটাক বই পড়া আর রাস্তা দিয়ে চেনাপরিচিত কেউ গেলে দুটো কথা বলা। এই করতেই সকালটা দিব্যি কেটে যায় বিশ্বনাথের।
আজ অবশ্য রুটিনে একটু ব্যাঘাত ঘটেছে। অন্যন্যদিন যখন ঠিক সকাল আটটার সমাচার প্রভাতী শুরু হয়, তখনই বৌমা দিনের প্রথম চায়ের কাপ এসে পৌঁছে যায় বিশ্বনাথের কাছে। আজ সমাচার শেষ। শুরু হয়ে গিয়েছে স্থানীয় সংবাদ। কিন্তু চায়ের দেখা নেই। অথচ বৌমা তো সেই কোন সকাল থেকে উঠে রান্নাঘরে কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে। টুকটাক টুংটাং শব্দ পেয়েছেন বিশ্বনাথ। অর্জুনেরও ঘুম কখন ভেঙে গিয়েছে। হুটোপুটি করছে। তাহলে, চাটা এলো না কেন এখনো? একবার হাঁক পাড়বেন? নাকি নিজেই নামবেন? ভাবতে থাকেন বিশ্বমনাথ। বেলা গড়ায়। শিউনাথ, হরকিষেন সবাই কাজেকর্মে বেরিয়ে পড়ে। রাস্তা থেকে বিশ্বনাথকে হাত জোড় করে প্রভাতী শুভেচ্ছা জানায়।
বিশ্বনাথ ভাবেন, কী হলো ব্যাপারটা, সরেজমিনে দেখতে হবে। লাঠি হাতে টুকটুক করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগলেন, ধীরে ধীরে। লাঠি ও পায়ের শব্দ শুনে অর্জুন আর লক্ষ্মী দৌড়ে এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে, "কী হলো বাবুজি, আপনি নীচে নামছেন কেন? কিছু সমস্যা?" অর্জুন এগিয়ে এসে দাদুর হাত ধরে ওঁকে নামতে সাহায্য করে। বিশ্বনাথ একটা চেয়ারের ওপর বসেন। একটু হাঁফ ছেড়ে বললেন, "লক্ষ্মী বেটি, আজ চা পাঠালি না? ব্যস্ত?" শুনেই লক্ষ্মী দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখে, ঘড়ির কাঁটা নটা ছাড়িয়ে গিয়েছে। বেশ লজ্জা পেয়ে জিভ কেটে লক্ষ্মী উত্তর দেয়, " মাফ করবেন বাবুজি। একদম খেয়াল করিনি। আমি এক্ষুণি চায় নাস্তা আনছি। আসলে রান্নাঘরে অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম..." বিশ্বনাথ বলেন, "আরে ঠিক আছে। এক আধ দিন হতেই পারে। তুই ধীরে সুস্থে নিজের সুবিধে মতো কর। কিন্তু বল, আজ রান্নাঘরে বিশেষ ব্যস্ততা কেন রে?" লক্ষ্মী মুচকি হেসে উত্তর দেয়, "আপনার মনে নেই বাবুজি? আজ কত তারিখ?" বিশ্বনাথ খানিক চুপ থাকেন। তারপর মনে পড়ে যায়। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, "আরে, আজ তো একত্রিশ। আজ তো বিষ্ণু বেটার আসার কথা। আমি ভুলেই গিয়েছি!" লক্ষ্মী হাসি হাসি মুখে বলে, "হ্যাঁ বাবুজি। ওই জন্যই একটু খাস নাস্তা বানাচ্ছি। ওর তো দশটার বাসে আসার কথা। এসে যাতে ওর সবচেয়ে পসন্দের খাবার পায়, তাই ক্ষীর, পুরি আর সব্জি করছি। আপনাকে গরম গরম ভেজে দিচ্ছি এক্ষুণি। একটু ততক্ষণ চায় বিস্কিট খান।" অর্জুন মাকে হাতে হাতে কাজে সাহায্য করে। ভালো ছেলে তৈরি হয়েছে ও। ও রান্নাঘরের তাক থেকে বিস্কুটের টিন নামিয়ে দাদুর জন্য কয়েকটা মিষ্টি বিস্কুট বের করে প্লেটে সাজায়। লক্ষ্মী চায়ের জল গরম বসায়। বিশ্বনাথ বলেন, "বেটা, তুই আমার জন্য তাড়াহুড়ো করিস না। এই তো চা খাবো। ওষুধটা খেয়ে নেব এরপরেই। তারপর বিষ্ণু এলে একসাথে বসে চারজনে নাস্তা করবো। কী বলিস অর্জুন বেটা?" বিশ্বনাথ হাসিমুখে নাতির পানে চেয়ে থাকেন। লক্ষ্মী "জী ঠিক আছে" বলে ঝটপট কাজে লেগে যায়।
বিশ্বনাথ চায়ের কাপ হাতে বসে থাকেন রান্নাঘরের সামনে দাওয়ায়। সকালের নরম রোদ এসে পড়ে গায়ে। বুড়ো হাড়ে ভালোই আরাম লাগে। আয়েশ করে দেখতে থাকেন সুখের সংসারে। ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জানান প্রতিনিয়ত। কামনা করেন পরিবারের সুস্বাস্থ্যের। এমন সময় রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে নাতি অর্জুন। হাতে ছোট্ট বাটিতে একটু ক্ষীর। দাদুর হাতে ধরিয়ে বলে, "মা বললো একটু চেখে দেখতে। মিঠা ঠিক আছে কি না বলো।" বিশ্বনাথ নাতির হাত থেকে বাটি নিয়ে বলেন, "তুমিই বলো দাদুভাই। তুমি খাও।" অর্জুন মাথা নেড়ে বলে, "নাঃ। তুমি খাও। জলদি জলদি খাও। তাহলে একটা সিক্রেট বলবো। বাবা বারণ করেছে বলতে। বলেছে তোমায় সারপ্রাইজ দেবে।" রান্নাঘর থেকে ছেলের কথা শুনতে পেয়ে দৌড়ে আসে লক্ষ্মী। ছেলেকে থামিয়ে দিয়ে বলে, "আরে আরে, বাবা বলেছে না সিক্রেট। তুই বলে দিলে আর সারপ্রাইজ কী করে হবে?" বিশ্বনাথ বেশ আমোদ পান এতে। হাসিখুশি মুখে বলেন, "কী সিক্রেট বেটি যা বলবি না আমায়?" লক্ষ্মী মাথা নিচু করে বলে, "ও আপনার ছেলে এসে বলবে বলেছে। আমরা বলে দিয়েছি জানলে রাগ করবে।" এই বলে লক্ষ্মী রান্নাঘরে ফেরত যায়। বিশ্বনাথ চামচ করে পায়েসের স্বাদ নেন। আঃ। যেন অমৃত। বৌমাকে রান্নার প্রশংসা জানান। অর্জুন বাটি নিয়ে চলে যায়। বিশ্বনাথ চোখ বুজে রোদের আরাম নেন। ভাবতে থাকেন, কী হতে পারে সারপ্রাইজ। নির্ঘাত ছেলে কোনো বড় চাকরি পেয়েছে। বাঃ। খুব ভালো হয় তাহলে। মাইনে বাড়বে। ইজ্জত বাড়বে। অর্জুন বড় হচ্ছে। খরচা বাড়ছে সংসারের। বিষ্ণু যদি এর মধ্যে ভালো চাকরি পায়, খুব আনন্দের। তবে একটাই আক্ষেপ। হয়তো আরো দূরে চলে যেতে হবে। এখন যেমন মাসে একবার আসে, তখন হয়তো সেটা কমে যাবে। মন কেমন করে বিশ্বনাথের। যত বয়স বাড়ছে, তত যেন বেশি করে পরিবারকে আঁকড়ে থাকতে ইচ্ছে করে। সব সময় মনে হয়, সব্বাই মিলে একসাথে থাকতে পারলে, কী ভালোই না হতো।
সোয়া দশটার দিকে হইহই করে বিষ্ণু বাড়ি ফেরে। অর্জুন তো বাবাকে দেখে যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে। এই ঘর ওই ঘর দৌড়াদৌড়ি করে বাড়ি মাত করে ফেলে ও মুহূর্তেই। লক্ষ্মীর চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক স্পষ্ট। হবেই তো। কত মাস পরে বাড়ি এলো বিষ্ণু। সেই পনেরই আগস্টের পর একবার এসেছিল। তারপর আর ছুটি পায়নি। এই সময়টা ঘোর টুরিস্টের মরসুম। হোটেলে মেলা কাজ। তাই ছুটিও বিরল। বিষ্ণু এসে তার বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে কুশলবার্তা জানতে চায়। বাবুজির পায়ের ব্যথা, হাঁপানি সব কেমন আছে, ওষুধে কাজ হচ্ছে কি না, সব। লক্ষ্মী তাড়া দেয় এর মধ্যে, "গরম জল করে দিয়েছি। আপনি হাত মুখ ধুয়ে আসুন শিগগিরই। একসাথে নাস্তা করবো সবাই। বাবুজি না খেয়ে বসে আছেন। আপনার অপেক্ষায়।" বিষ্ণু বাবাকে বলে, "কেন বাবুজি? তুমি খেয়ে নাওনি কেন? এতক্ষণ না খেয়ে থাকলে হয়?" বিশ্বনাথ ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলেন, "বেটা, এই তো একদিনই এরকম করছি। কতদিন পর দেখা হলো। একসাথে খাই। সব্বাই মিলে। ভালো লাগে।"
বিষ্ণু তড়িঘড়ি পোশাক পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে নীচে চলে আসে। লক্ষ্মী ইতিমধ্যে খাবার বেড়ে রেখেছে। অনেকদিন পর সপরিবারে একসাথে খেতে বসা। গরম গরম পুরি ক্ষীর পেয়ে বিষ্ণু খুব খুশি। অর্জুনও এতদিন পর বাবার সান্নিধ্য পেয়ে মহানন্দে। বিশ্বনাথ পুরির টুকরো মুখে পুরে বলেন, "হ্যাঁ রে অর্জুন। তুই যে বললি তোর বাপ কী সিক্রেট সারপ্রাইজ দেবে আমায়, কই, এখনো কিছু বুঝলাম না তো?" বিষ্ণু ক্ষীরের চামচ চেটে নামিয়ে বাবার দিকে তাকায়। বলে, "সত্যিই কিছু বোঝোনি?" বিশ্বনাথ অবাক হয়ে বলেন, "কই না তো। কী?" বিষ্ণু এইবার একবার লক্ষ্মী, একবার অর্জুনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। তারপর বাবার দিকে ফিরে বলে, "দেখলে না এই এত লটবহর নিয়ে ফিরলাম? সব মালপত্র নিয়ে চলে এলাম। বাবা, চাকরিটা ছেড়েই দিয়েছি। আর তোমাদের ছেড়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল না। পারছিলামও না।" হতভম্ব বিশ্বনাথ ভেবে পান না কী বলবেন। খানিক চুপ করে চেয়ে থাকেন ছেলের দিকে। তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে জিজ্ঞেস করেন, "তাহলে? এরপর?" বিষ্ণু উত্তর দেয়, "অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম। তোমার আমার যা অভিজ্ঞতা ট্যুরিজম নিয়ে, আর লক্ষ্মীর যা হাতযশ, কসোলের হোম-স্টে ব্যবসায় আমরাও নেমে পড়ি। নাকি?" বিশ্বনাথ বলেন, "কিন্তু তার জন্য তো অনেক ইনভেস্টমেন্ট লাগবে। পারমিশনের ব্যাপারও আছে। সেগুলো?" বিষ্ণু বলে, "এক মিনিট", উঠে হাত ধুয়ে ব্যাগ থেকে বের করে একটা গোলাপি ফাইল। ওপরে জ্বলজ্বল করছে লেখা, "ভার্মা এন্ড সন হোম-স্টে, কসোল"। বিশ্বনাথের হাতে ধরিয়ে বলে, "এই যে। সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। নতুন বছরে এটাই তোমাকে আমার গিফট। ঠিক যেমন তুমি আমায় দিতে, ছোট থেকে?"
বিশ্বনাথ আনন্দে বিহ্বল। কী বলবে, কিচ্ছু বোঝে না। আনন্দে আত্মহারা। দুই চোখ ছলছল করে আনন্দে। আজ উনি এক গর্বিত পিতা। সপরিবারে একসাথে থাকার এই যে পাকাপোক্ত ব্যবস্থা, এর চেয়ে ভালো নববর্ষের উপহার বুঝি আর কিচ্ছুটি হয় না। সত্যিই আজ "হ্যাপি নিউ ইয়ার।"
Sunday, December 29, 2019
Monday, December 23, 2019
মিউট জীবন।
অনেকদিন পর এত বেলা করে ঘুম ভাঙল রেবার। অথচ কী আশ্চর্য, কোনদিকে তেমনভাবে কোনো ব্যস্ততা, হুড়োহুড়ি কিচ্ছুটি টের পাচ্ছে না ও। হলো টা কি? অন্যদিন তো সকাল থেকে এমনিতেই এই স্নেহালয় এপার্টমেন্টে হয় হট্টগোল লেগেই থাকে। সাতটার মধ্যেই ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে কাজের লোকেরা চলে আসে। উঠোন ঝাঁট দেওয়ার ওই কর্কশ শব্দ, বাসনের ঝংকার, বাড়ির ছেলেদের "কই গো, বাজারের ফর্দ দাও", মায়েদের বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর ব্যস্ততা। দোতলার ফ্ল্যাটে বেডরুমে শুয়ে শুয়ে প্রতিদিন রেবার ঘুম ভেঙে যায় ওই শব্দে। এমনিতে রেবার সারা রাত ঘুম আসে না, ওষুধ খেয়েও। ভোরের দিকেই যা একটু চোখে ঘুম নেমে আসে, তবে প্রত্যেকদিন এই ভোরের আওয়াজ মেলায় বিচ্ছিরি ভাবে ঘুম ভাঙে ওর। আর ব্যস, সারাদিন মাথা ধরে থাকা। এই নিয়ে সারাদিন গজগজ গজগজ করতে থাকে রেবা। "ঈশ্বর, কালা করে দাও না আমায়। আর এই এত আওয়াজ, সহ্য করতে পারিনা।"
রেবা বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় গেলো। ব্যাপারটা কী, বুঝতে। দেখলো, বাহাদুর সিং এপার্টমেন্টের উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে, রাজু বিশ্বাসদের গাড়ি ধুচ্ছে। বাসন্তী হড়বড় করে গেট ঠেলে ঢুকলো এই মাত্র। কিন্তু কী আশ্চর্য, একটুও শব্দ নেই কেন? অন্যদিন এই গেটের আওয়াজের ঠ্যালায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যায়। জলের বালতি দুবার উল্টায়। আজকে যেন মনে হচ্ছে, টিভি দেখছে, মিউট করে। অবাক হয় রেবা। কানের কোনো সমস্যা হলো নাকি? বার কয়েক কান খোঁচায়, ইয়ার বাড বের করে। তাতেও কিছু উপকার হয়না। অদ্ভুত ব্যাপার।
দিন গড়াতে থাকে। রেবার অবস্থার কোনোই উন্নতি হয়না। ছেলে মেয়েরা বারবার ফোন করে করে সাড়া পায়না। হোয়াটসআপে মেসেজ পেয়ে তাদের শান্ত করে রেবা, কিন্তু ঘটনাটা কিচ্ছু জানায়না। আজ আবার বড়দিন। ডাক্তার বদ্যিও পাবেনা। কাল ই এন টি দেখাবে স্থির করে রেবা। সারাদিন নিজের মতো কাজ নিয়ে থাকে। মন্দ কাটেনা শব্দবিহীন। বেশ যেন স্তব্ধতা, শান্তি। বই পড়ে ঘরের কাজ করে দিন কাটে। শুধু একটাই আক্ষেপ, ক্রিসমাস ক্যারল শোনা হলো না ওর। ফোনেও গল্প হলো না। নাতি নাতনীদর মিষ্টি কলকাকলিও শোনা হয়না। রাত্রে শোয়ার আগে রেবা ভাবতে বসে, সারাদিন কেমন গেল। মন্দ নয়, কিন্তু এই কি ভালো? একটুও শব্দ নেই, পাখির গান নেই, রেডিওর বকবক নেই, রোজের জীবন যেন নীরস। নাঃ, ঘুম হয়তো ভালো হবে, বা হবে না। কিন্তু দিন মোটেই ভালো যায়নি। কে জানে, কাল ডাক্তার কী বলেন। ভাবতে ভাবতে রেবা শুয়ে পড়ে। রাত্রে স্বপ্নে স্যানটা বুড়ো হাজির। হাসিমুখে বলে, "কী? খুব তো শখ ছিল কালা হওয়ার, ভালো লাগেনি তো? কাল সকালে উঠে দেখবে সব আবার আগেরমত। আর হ্যাঁ, বুঝেশুনে উইশ করো। বুঝলে রেবারানী?"
রেবা বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় গেলো। ব্যাপারটা কী, বুঝতে। দেখলো, বাহাদুর সিং এপার্টমেন্টের উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে, রাজু বিশ্বাসদের গাড়ি ধুচ্ছে। বাসন্তী হড়বড় করে গেট ঠেলে ঢুকলো এই মাত্র। কিন্তু কী আশ্চর্য, একটুও শব্দ নেই কেন? অন্যদিন এই গেটের আওয়াজের ঠ্যালায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যায়। জলের বালতি দুবার উল্টায়। আজকে যেন মনে হচ্ছে, টিভি দেখছে, মিউট করে। অবাক হয় রেবা। কানের কোনো সমস্যা হলো নাকি? বার কয়েক কান খোঁচায়, ইয়ার বাড বের করে। তাতেও কিছু উপকার হয়না। অদ্ভুত ব্যাপার।
দিন গড়াতে থাকে। রেবার অবস্থার কোনোই উন্নতি হয়না। ছেলে মেয়েরা বারবার ফোন করে করে সাড়া পায়না। হোয়াটসআপে মেসেজ পেয়ে তাদের শান্ত করে রেবা, কিন্তু ঘটনাটা কিচ্ছু জানায়না। আজ আবার বড়দিন। ডাক্তার বদ্যিও পাবেনা। কাল ই এন টি দেখাবে স্থির করে রেবা। সারাদিন নিজের মতো কাজ নিয়ে থাকে। মন্দ কাটেনা শব্দবিহীন। বেশ যেন স্তব্ধতা, শান্তি। বই পড়ে ঘরের কাজ করে দিন কাটে। শুধু একটাই আক্ষেপ, ক্রিসমাস ক্যারল শোনা হলো না ওর। ফোনেও গল্প হলো না। নাতি নাতনীদর মিষ্টি কলকাকলিও শোনা হয়না। রাত্রে শোয়ার আগে রেবা ভাবতে বসে, সারাদিন কেমন গেল। মন্দ নয়, কিন্তু এই কি ভালো? একটুও শব্দ নেই, পাখির গান নেই, রেডিওর বকবক নেই, রোজের জীবন যেন নীরস। নাঃ, ঘুম হয়তো ভালো হবে, বা হবে না। কিন্তু দিন মোটেই ভালো যায়নি। কে জানে, কাল ডাক্তার কী বলেন। ভাবতে ভাবতে রেবা শুয়ে পড়ে। রাত্রে স্বপ্নে স্যানটা বুড়ো হাজির। হাসিমুখে বলে, "কী? খুব তো শখ ছিল কালা হওয়ার, ভালো লাগেনি তো? কাল সকালে উঠে দেখবে সব আবার আগেরমত। আর হ্যাঁ, বুঝেশুনে উইশ করো। বুঝলে রেবারানী?"
(৫)
- তখন ফোনটা রেখে দিলি কেন?
- ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে চলেছিস, ফোন ধরে থেকে কী করবো? এখন আর জিও টু অন্য নেটওয়ার্ক ফ্রি নেই রে।
- তা বলে তুই ফোন ছেড়ে দিবি?
- আহা, ফোনই তো ছেড়েছি, তোকে তো আর না।
- একদম বাটারিং করবি না। আমি সব জানি। সব বুঝি।
- হ্যাঁ, আমার সমঝদার ম্যাডাম এসেছেন। একদিন ঝগড়া হলো, তারপর দশদিন মুখ দেখাদেখি, কথা বলাবলি সব বন্ধ?
- তুইও তো ফোন করিসনি। আমার মেসেজের উত্তর দিসনি।
- ফাইনালি কল তো আমিই করলাম কাল। তুই তারপর কাঁদতে শুরু করে দিলি। আমি কোথায় যাই?
- ঝগড়া করবো তোর সাথে। জমিয়ে ঝগড়া করবো। অনেক অনেক পেন্ডিং আছে। প্রায়োরিটি লিস্টে আমি কেন এত নীচে, সেটা জানতে চাইতেই অমনি ওরকম করবি? কার না কার ওপর রাগ, তার গোঁসা আমার ওপর দেখবি? ইয়ার্কি না? ওইসব চলবে না।
- আচ্ছা। সরি।
- ইউ বেটার বি। কালকেই ঝগড়া করতাম। কিন্তু তার মধ্যে কেঁদে ফেলতাম অবধারিত। জানিসই তো, আই ক্রাই এট দ্য ড্রপ অফ আ হ্যাট।
- সে জানি।
- কাল ওরকম হলে অমনি ডাকওয়ার্থ লুইসের দোহাই দিয়ে আমি জিতেছি বলে অপবাদ দিতি।
- সে দিতাম। কিন্তু তুই বল, কী করে শিওর হলি যে তুইই জিততি?
- এখনো সন্দেহ আছে?
- তা আছে।
- হয়ে যাক তাহলে। এমনিও প্রচুর রাগ জমে আছে আমার। অনেক অনেক পয়েন্টস। লিখে রেখেছি।
- আপাতত শীতকাল। ওইসব তোলা থাক বরং। এখন না হয় একটু নলেন গুড়ের মতো মাখোমাখো প্রেম করি? ঝগড়াগুলো গ্রীষ্মের জন্য তোলা থাক? কেমন?
- হতভাগা। ঠিক সেই ম্যানেজ দিয়ে ফেলিস।
-হারকে জিতনে ওয়ালো কো বাজীগর কেহতে হ্যায়, গুরু বলে গেছেন! আমি হলাম তাই।
- ঢং যত্তসব।
- ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে চলেছিস, ফোন ধরে থেকে কী করবো? এখন আর জিও টু অন্য নেটওয়ার্ক ফ্রি নেই রে।
- তা বলে তুই ফোন ছেড়ে দিবি?
- আহা, ফোনই তো ছেড়েছি, তোকে তো আর না।
- একদম বাটারিং করবি না। আমি সব জানি। সব বুঝি।
- হ্যাঁ, আমার সমঝদার ম্যাডাম এসেছেন। একদিন ঝগড়া হলো, তারপর দশদিন মুখ দেখাদেখি, কথা বলাবলি সব বন্ধ?
- তুইও তো ফোন করিসনি। আমার মেসেজের উত্তর দিসনি।
- ফাইনালি কল তো আমিই করলাম কাল। তুই তারপর কাঁদতে শুরু করে দিলি। আমি কোথায় যাই?
- ঝগড়া করবো তোর সাথে। জমিয়ে ঝগড়া করবো। অনেক অনেক পেন্ডিং আছে। প্রায়োরিটি লিস্টে আমি কেন এত নীচে, সেটা জানতে চাইতেই অমনি ওরকম করবি? কার না কার ওপর রাগ, তার গোঁসা আমার ওপর দেখবি? ইয়ার্কি না? ওইসব চলবে না।
- আচ্ছা। সরি।
- ইউ বেটার বি। কালকেই ঝগড়া করতাম। কিন্তু তার মধ্যে কেঁদে ফেলতাম অবধারিত। জানিসই তো, আই ক্রাই এট দ্য ড্রপ অফ আ হ্যাট।
- সে জানি।
- কাল ওরকম হলে অমনি ডাকওয়ার্থ লুইসের দোহাই দিয়ে আমি জিতেছি বলে অপবাদ দিতি।
- সে দিতাম। কিন্তু তুই বল, কী করে শিওর হলি যে তুইই জিততি?
- এখনো সন্দেহ আছে?
- তা আছে।
- হয়ে যাক তাহলে। এমনিও প্রচুর রাগ জমে আছে আমার। অনেক অনেক পয়েন্টস। লিখে রেখেছি।
- আপাতত শীতকাল। ওইসব তোলা থাক বরং। এখন না হয় একটু নলেন গুড়ের মতো মাখোমাখো প্রেম করি? ঝগড়াগুলো গ্রীষ্মের জন্য তোলা থাক? কেমন?
- হতভাগা। ঠিক সেই ম্যানেজ দিয়ে ফেলিস।
-হারকে জিতনে ওয়ালো কো বাজীগর কেহতে হ্যায়, গুরু বলে গেছেন! আমি হলাম তাই।
- ঢং যত্তসব।
(শেষ)
#অগ্নি-রুমুন
#সীজন২
#সীজন২
Sunday, December 22, 2019
(৪)
হাতে কফির কাপ। উদাসিনী বেশে, বারান্দায় বসে। নিজের হাতে গড়া সবুজালির মধ্যে, একটু মনকে শান্ত করতে। ঠিক এমন সময় হাতে রাখা ফোনটা বেজে উঠলো। চেনা রিংটোনে। এতদিন পর। ফোনের ভাইব্রেশনের সাথে বুকের ধুকপুকানি রেসোনেট করছে। সত্যিই কি তাহলে অগ্নি ফোন করলো? কাঁপা কাঁপা হাতে সবুজ আইকনটা স্লাইড করলো রুমুন। বললো,
- হ্যালো?
- বলছি শোন, আমি কিন্তু খুব ভালো চিকেন মোমো আর থুপ্পা বানাতে পারি।
- কী?
- বলছি যে আমি মোমো আর থুপ্পাটা ভালোই রাঁধতে পারি।
- হঠাৎ?
- না মানে আজ ওলা শেয়ারে আসতে আসতে শুনলাম একজন আরেকজনকে ফোনে বলছে, তার খুব আক্ষেপ। তার বর রাঁধতে পারেনা কিছু। এমনকী চা পর্যন্ত পারে না। গরম জলে টিব্যাগ চুবিয়ে চা খায়!
- সো?
- সো, আই এম এশিউরিং ইউ। বিয়ের পর তোর কোনো সমস্যা হবে না। আমি তোকে দিব্যি রেঁধে বেড়ে খাওয়াতে পারবো। হয়তো হ্যাঁ, আমার মায়ের মতো ভালো পোলাউ বানাতে পারবো না, বা কাকিমার মতো চিতল পেটিও না। কিন্তু জ্বর হলে স্যুপ থুপ্পা সব যত্ন সহকারে রেঁধে খাওয়াতে পারবো। কাজেই, ইউ আর ইন গুড হ্যান্ডস।
-
- কীরে কিছু বল?
-
- কীরে রুমুন?
-
- ওমা, কাঁদছিস কেনো? ধুর পাগলী। এই, এই রুমুন...
#রুমুন_অগ্নি
#সীজন২
আচ্ছা ধরুন আগামী দুইদিন আপনার প্রচন্ড কাজের চাপ, অসংখ্য ডেডলাইনসের পিছনে ছুটতে হবে। আপনি কী করবেন? নিশ্চয়ই সেইসব কাজকর্মই করবেন, তাই না? কিন্তু আমি? আমি হলাম সে যে তখন উশখুশ করবে, কখন কয়েক লাইন লিখে ফেলি। সে প্রেমের গল্প হোক বা মজার কিছু। রোজ কিছু না কিছু না লিখলে হজম হবে না।
আচ্ছা, রাস্তাঘাটে এমন কখনো হয়েছে যে আপনি কাউকে দেখে হাসলেন, কথা বললেন, খুব চেনাও লাগলো। কিন্তু কিছুতেই নাম মনে করতে পারলেন না? আমি ঠিক ওই স্যাম্পল। এত বেশি বকি, এত বকি, এতজনের সাথে আলাপ, জাস্ট ট্র্যাক রাখতে পারিনা আর!
এই বকবকের সূত্রেই বলে রাখি বাপু, বন্ধুমহলে agony aunt হিসেবেও কিন্তু খুব খ্যাতি। আবার প্রচুর পজিটিভ ভাইবস ছড়াতেও এক্সপার্ট। বেসিকালি, প্রিয় রঙ হলুদের মতোই আমিও সব সময় ঝকঝকে, হাসিখুশি প্রাণবন্ত থাকতে ভালোবাসি।
এই তো, অনেক বললাম। আর বাকিটা চিনতে হলে, আলাপ বাঞ্ছনীয়। কী, হবে নাকি একসাথে এক কাপ কফি?
আচ্ছা, রাস্তাঘাটে এমন কখনো হয়েছে যে আপনি কাউকে দেখে হাসলেন, কথা বললেন, খুব চেনাও লাগলো। কিন্তু কিছুতেই নাম মনে করতে পারলেন না? আমি ঠিক ওই স্যাম্পল। এত বেশি বকি, এত বকি, এতজনের সাথে আলাপ, জাস্ট ট্র্যাক রাখতে পারিনা আর!
এই বকবকের সূত্রেই বলে রাখি বাপু, বন্ধুমহলে agony aunt হিসেবেও কিন্তু খুব খ্যাতি। আবার প্রচুর পজিটিভ ভাইবস ছড়াতেও এক্সপার্ট। বেসিকালি, প্রিয় রঙ হলুদের মতোই আমিও সব সময় ঝকঝকে, হাসিখুশি প্রাণবন্ত থাকতে ভালোবাসি।
এই তো, অনেক বললাম। আর বাকিটা চিনতে হলে, আলাপ বাঞ্ছনীয়। কী, হবে নাকি একসাথে এক কাপ কফি?
Friday, December 20, 2019
3
মায়ের শাড়ি শাল ধার করে বিয়েবাড়ির সাজগোজ সম্পূর্ণ করলো রুমুন। আজ ছোটবেলার প্রিয় বান্ধবী, কস্তুরীর রিসেপশন। মা বাবারও নেমন্তন্ন রয়েছে, তবে ওঁরা যাচ্ছেন না। মাকে সাজটা দেখাতে গেলো রুমুন। অবশ্য মায়ের যে কী রিঅ্যাকশন হবে, সেটা মোটামুটি ও জানতো। মায়ের মুখ গম্ভীর। বক্তব্য এই যে, সব্বাই দিব্যি বিয়ে করে থিতু হয়ে যাচ্ছে। ও কবে করবে। মা বাবাকে এখনও পুরো ব্যাপারটা ভালো করে বলেইনি রুমুন। তাই ওঁরাও দ্বিধায়, দ্বন্দ্বে। অবশ্য, বলবেই বা কী? ও কি নিজেই আদৌ জানে? অগ্নির সাথে সম্পর্কটা এখন কোথায় গিয়ে যে দাঁড়িয়েছে...
বিয়েবাড়িতে ভারী মজা হলো। বরপক্ষের বেশ কিছু নিমন্ত্রিতদের সাথে বিয়ের দিনেই আলাপ হয়েছিল রুমুনের। বিশেষ করে বাসর রাত জাগার সময় সবাই মিলে দারুণ আনন্দ করেছিল। আজ বৌভাতের অনুষ্ঠানেও সেই আলাপ ঝালিয়ে নিয়েছিল রুমুন আর ওর বাকি বান্ধবীরা। তাই সন্ধ্যের অনুষ্ঠানেও খাতির যত্ন আলাপ আড্ডা কোনটারই অভাব হলো না। বরের বন্ধুদের মধ্যে সঙ্কল্প বলে ছেলেটি, ডাক্তার, বেশ মিশুকে। তার সাথে রুমুনের ভালোই বন্ধুত্বপূর্ণ খুনসুটি চলেছে। বাসরের রাতে গান বাজনাও ভালোই হয়েছে। রিসেপশনে দেখা হতেই এক গাল হাসি। "বাঃ, তোমাকে তো বেশ লাগছে দেখতে!" রুমুন একটু ব্লাশ করেই ধন্যবাদ জানায়। বান্ধবীরা কিন্তু কেউ মিস করেনি এই কথা। সারা সন্ধ্যে তারা লক্ষ্য করে গেলো, সঙ্কল্প যেন রুমুনের চারিদিকেই থাকার সঙ্কল্প নিয়েছে। কিছুতেই পিছু ছাড়ে না। সারাক্ষণ ওদের সাথেই রইলো। একসাথে ছবি টবিও উঠলো। হোয়াটসঅ্যাপে শেয়ারও হলো, স্টেটাসও হলো।
ফিরতি পথে রুমুন আর ঋত্বিকা একটা ওলা ধরলো। ঋত্বিকা জমিয়ে রুমুনের পিছনে লাগতে থাকল। "কী রে, তাহলে সঙ্কল্প?"
রুমুন একবার তাকায় বান্ধবীর দিকে, কিছু বলেনা। কিন্তু বান্ধবী, সেই কোন ছোট্টবেলার। মুখ চোখ দেখেই বুঝে যায় সব। বলে, "এখনও মিটলো না তোদের?" রুমুন মাথা নাড়ে উত্তরে। ঋত্বিকা প্রশ্ন করে, "তোদের হলো টা কী?" রুমুন বলে, "জানি না রে। আই অ্যাম স্টিল সারচিং ফর অ্যান আনসার।" ঋত্বিকা কথা বাড়ায় না। শুধু বন্ধুর হাতটা স্নেহের পরশে চেপে ভরসা জোগায়। ওর বাড়ি এসে গেলে, ও নেমে পড়ে। রুমুন চলতে থাকে ক্যাবে।
ক্যাবে তখন বাজছে
"Kaisi Teri Khudgarzi
Na Dhoop Chune Na Chhaaon
Kaisi Teri Khudgarzi
Kisi Thor Tike Na Paaon...
Ban Liya Apna Paigambar
Tar Liya Tu Saat Samandar
Phir Bhi Sookha Mann Ke Andar
Kyun Reh Gaya
Re Kabira Maan Jaa
Re Faqeera Maan Jaa
Aaja Tujhko Pukaare Teri Parchhaaiyan
Re Kabira Maan Ja..."
একবার ফোনটা হাতে বের করে। হোয়াটসঅ্যাপে খোলে অগ্নির চ্যাটটা। মেসেজ করবে? কী লিখবে?
বোঝে না। আবার ফোন বন্ধ করে ব্যাগে রেখে দেয়।
****************
অগ্নি প্রতিদিনের মতো চ্যাট উইন্ডো দেখে। রুমুন অনলাইন। অপেক্ষায় থাকে মেসেজের। আসে না...
#রুমুন_অগ্নি
#সীজন২
Thursday, December 19, 2019
(২)
"কীরে, চুপ করে বসে কেন? ফোনের অপেক্ষা নাকি?" বন্ধু অমৃতর ডাকে অগ্নি পিছন ফিরে তাকালো। মাথা নেড়ে না বললো ও। ফোন? কেই বা করবে? বাবা মা জানে ওরা এখন পার্টি করছে। আজকের মত কথা হয়ে গিয়েছে। আর করবে না। অফিসের কলও নেই। উইকেন্ড মোডে সকলে। কেই বা আর করবে ওকে ফোন?
কোরমঙ্গলায় অমৃতর ব্যাচেলর্স প্যাডে আজ ওদের পাঁচ বন্ধুর গেট টুগেদার। অমৃত, অগ্নি, শুভঙ্কর, পল্লব আর সম্রাট। সেই স্কুলবেলার বন্ধু। আজ কর্মসূত্রে একেক শহরে একেকজন। অনেকদিন পর ওরা পঞ্চ পাণ্ডব এক হয়েছে। উদ্দেশ্য তাই আজ সারা রাত জেগে চুটিয়ে গল্প, আড্ডা। অমৃতই সমস্ত আয়োজন করেছে। সকাল থেকে ফ্ল্যাটটা সাজিয়েছে আলো দিয়ে। খাবার দাবার আনানো হয়েছে। পানীয়ও রয়েছে। গল্পের ফোয়ারা বইছে। স্পিকারে বেজে চলেছে পরপর কিছু রেট্রো গান। কিশোর আশা লতা রফি মান্না।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে উইস্কির গ্লাস হাতে অন্যমনস্ক হয়ে বাইরে তাকিয়েছিল অগ্নি। দূরে ব্যাঙ্গালোর শহরের ঝাঁ চকচকে রাস্তা, স্ট্রিট লাইট, ঝড়ের বেগে ছুটে চলা গাড়ি। এমন সময়ে কানে এলো, আশা ভোঁসলে গাইছেন,
"তু রুঠা তো ম্যায় রো দুঙ্গি সনম
আজা মেরে, বাহো মে আ।।"
মুহূর্তে একটা পরিচিত কণ্ঠের কাতর অনুনয় মাখা হোয়াটসআপ ভয়েস নোট মনে পড়ে গেলো। ফোনে ঢুকেছিলো গত সপ্তাহে। হ্যাঁ। ঠিক গত বৃহস্পতিবার, রাত দশটা পঁচিশে। যেই মেসেজটি রোজ কম করে অন্তত দশবার শোনে ও। অথচ, মেসেজের রিপ্লাই দেয়নি।
"কীরে অগ্নি, ভিতরে আসবি না? বাইরে কেন? আয়।"
এইবারে আর সম্রাটের ডাককে অগ্রাহ্য করেনা অগ্নি। হাতের মুঠো থেকে ফোনটা পকেটে ভরে রেখে ঘরে ঢোকে। হোয়াটসআপটা খোলাই থেকে যায়।
কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে বসে রুমুন হাঁ করে তাকিয়ে থাকে চ্যাট উইন্ডোতে। 'অনলাইন'। কিন্তু 'টাইপিং' আসে না।
#রুমুন_অগ্নি
#সিজন২
1
ট্যাক্সিতে উঠে সশব্দে দরজা বন্ধ করে রুমুন বললো, "চলুন দাদা।" গাড়িতে এফ এম চলছে। রেট্রো গান। কিন্তু রুমুনের এখন সেইসব দিকে কান যাচ্ছে না। টানা আটচল্লিশ ঘন্টা অফিসে কাজ করে ও বিধ্বস্ত। কাল ক্লায়েন্ট মিটিং, এদিকে এখনো টীম প্রেজেন্টেশন নিয়ে তৈরি না। রুমুন ওদের ফোনে সাপোর্ট দেবে এই আশ্বাস দিয়ে বাড়ি ফিরছে। ওর ক্লান্ত শরীরে আর দিচ্ছেনা। এরই মধ্যে অবিনাশের ফোন এলো। রুমুন যথাসাধ্য নির্দেশ দিলো ওকে। এরপর ফোনটা ছেড়ে জানলার কাঁচে মাথাটা এলিয়ে দিলো ও। আড়চোখে দেখতে পেলো শহরের রাস্তা। গভীর রাত। শুনশান রাজপথ। একটা দুটো গাড়ি সোঁ সোঁ করে পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে। হলুদ নিয়নের আলোর আলাদা মাদকতা। রুমুন ট্যাক্সির সীটে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে চোখ বোজে।
এতক্ষণে কানে ঢোকে এফ এম স্টেশনের গান।
"hum Ko Mili Hai Aaj
ye Ghadiya Naseeb Se
jee Bhar Ke Dekh Leejiye
humko Kareeb Se
phir Apke Naseeb Mein
ye Baat Ho Na Ho
shayad phir Is Janaam Mein
mulakaat Ho Na Ho"
বন্ধ চোখে ভেসে ওঠে একটা মুখ। বহু পরিচিত, বড় আপন, বড্ড কাছের সেই জন। কতদিন দেখেনি সেই মানুষটাকে, মনে পড়ে যায় রুমুনের। দু চোখ ভরে আসে জলে।
#রুমুন_অগ্নি
#সীজন২
ট্যাক্সিতে উঠে সশব্দে দরজা বন্ধ করে রুমুন বললো, "চলুন দাদা।" গাড়িতে এফ এম চলছে। রেট্রো গান। কিন্তু রুমুনের এখন সেইসব দিকে কান যাচ্ছে না। টানা আটচল্লিশ ঘন্টা অফিসে কাজ করে ও বিধ্বস্ত। কাল ক্লায়েন্ট মিটিং, এদিকে এখনো টীম প্রেজেন্টেশন নিয়ে তৈরি না। রুমুন ওদের ফোনে সাপোর্ট দেবে এই আশ্বাস দিয়ে বাড়ি ফিরছে। ওর ক্লান্ত শরীরে আর দিচ্ছেনা। এরই মধ্যে অবিনাশের ফোন এলো। রুমুন যথাসাধ্য নির্দেশ দিলো ওকে। এরপর ফোনটা ছেড়ে জানলার কাঁচে মাথাটা এলিয়ে দিলো ও। আড়চোখে দেখতে পেলো শহরের রাস্তা। গভীর রাত। শুনশান রাজপথ। একটা দুটো গাড়ি সোঁ সোঁ করে পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে। হলুদ নিয়নের আলোর আলাদা মাদকতা। রুমুন ট্যাক্সির সীটে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে চোখ বোজে।
এতক্ষণে কানে ঢোকে এফ এম স্টেশনের গান।
"hum Ko Mili Hai Aaj
ye Ghadiya Naseeb Se
jee Bhar Ke Dekh Leejiye
humko Kareeb Se
phir Apke Naseeb Mein
ye Baat Ho Na Ho
shayad phir Is Janaam Mein
mulakaat Ho Na Ho"
বন্ধ চোখে ভেসে ওঠে একটা মুখ। বহু পরিচিত, বড় আপন, বড্ড কাছের সেই জন। কতদিন দেখেনি সেই মানুষটাকে, মনে পড়ে যায় রুমুনের। দু চোখ ভরে আসে জলে।
#রুমুন_অগ্নি
#সীজন২
Monday, December 16, 2019
চুরমুর
বেশ একটা ফুরফুরে মন নিয়েই রুমুন বেরিয়েছিল বিকেলে। উদ্দেশ্য একটাই, একটু সেন্ট্রাল পার্কে কয়েক চক্কর কেটে তারপর ফুচকাওয়ালার সামনে ভিড় ঠেলে কুড়ি টাকার চুরমুর কিনে বাড়ি ফেরা। বাড়িতে সদ্য লাইব্রেরি থেকে আনা শঙ্কু সমগ্র পড়তে পড়তে জমিয়ে চা সহযোগে সান্ধ্য আহার হয়ে যাবে। ভাবতেই জিভে জল এসে যায় রুমুনের।
গেট থেকে বেরোতেই এক প্রৌঢ় ব্যক্তি ও সাথে খুব সম্ভবত তাঁর স্ত্রীর মুখোমুখি। ভদ্রলোকের পরনে অতি সাধারণ ফতুয়া পাজামা, গায়ে ওই মলিন খয়েরিই বোধহয়, চাদর। চুল একটু কোঁকড়া, উস্কোখুস্কো না হলেও, যত্নের ছাপ স্পষ্ট। সাথে ভদ্রমহিলার পরনে ডুরে শাড়ি, গায়ে তেমনই এক জীর্ণ চাদর। ক্ষণিকের ইতস্ততা কাতিয়ে মলিন হাসিমুখে রুমুনের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, "মা, আপনি কি এই এখানেই থাকেন?" রুমুন ভাবল, হয়তো কোন বাড়ির নির্দেশিকা খুঁজছেন। ও ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল। ভদ্রমহিলা এবার একটু সাহস করেই এগিয়ে এসে বললেন, "একটু ওষুধ দিয়ে সাহায্য করবেন মা?" রুমুন এবারে অবাক হয়েই ওঁকে জরিপ করে। কোনো চোট আঘাত নাকি? হয়তো ব্যান্ড এড ডেটল জাতীয় কিছু চাইবেন। ও বলে, "বলুন।" ভদ্রলোক এবার এগিয়ে এসে বললেন, "আসলে গত ছয় মাস ধরে আমার চাকরি নেই। আমার স্ত্রী, সাইকিয়াট্রিক পেশেন্ট। তাই..." ভদ্রমহিলা বললেন কাতর কন্ঠে, "একশোটা টাকা দিলেও হবে। একটু সাহায্য করলে... আমার ওষুধ... আপনি কাছেই থাকেন কি? তাহলে যদি এনে দেন।"
রুমুন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। না বলতে পারে না। আবার যা দিনকাল, কাকে কতটা কী বিশ্বাস করবে, বুঝে ওঠে না। ওয়ালেটে কড়কড়ে তিনটে পাঁচশো আর বেশ কয়েকটা একশোর নোট থাকলেও বের করতে দ্বিধা হয়। মাথা নিচু করে এগিয়ে যায়। ওঁরা পিছন থেকে কিছু বলতে থাকেন, আশায়... রুমুন হয়তো মত বদলাবে। রুমুন এগিয়ে যায়। ও জানে, এইসব পরিস্থিতে পিছনে ফিরে তাকাতে নেই। ক্ষণিকের জন্য হলেও হাতের টিফিন বাক্সটা একটু ভারী লাগে। তবুও এগিয়ে যায় ও।
ফুচকাওয়ালার সামনে আলু সিদ্ধ, পিঁয়াজ লঙ্কা কুঁচি, তেঁতুল জলের আলাদা সুগন্ধ। সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব কেটে যায় ও। "দিন তো, কুড়িটা টাকার চুরমুর" বলে এগিয়ে দেয় টিফিন বাক্স। চুরমুর তৈরি হয়। রুমুন বাড়ি ফেরে। প্রফেসর শঙ্কুর অ্যাডভেঞ্চার অপেক্ষা করে আছে। ভালোই কাটবে সন্ধ্যেটা। একটাই আফশোস, পার্কে কয়েক রাউন্ড হাঁটা হলো না।
রুমুন আজ যথার্থই নাগরিক।
গেট থেকে বেরোতেই এক প্রৌঢ় ব্যক্তি ও সাথে খুব সম্ভবত তাঁর স্ত্রীর মুখোমুখি। ভদ্রলোকের পরনে অতি সাধারণ ফতুয়া পাজামা, গায়ে ওই মলিন খয়েরিই বোধহয়, চাদর। চুল একটু কোঁকড়া, উস্কোখুস্কো না হলেও, যত্নের ছাপ স্পষ্ট। সাথে ভদ্রমহিলার পরনে ডুরে শাড়ি, গায়ে তেমনই এক জীর্ণ চাদর। ক্ষণিকের ইতস্ততা কাতিয়ে মলিন হাসিমুখে রুমুনের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, "মা, আপনি কি এই এখানেই থাকেন?" রুমুন ভাবল, হয়তো কোন বাড়ির নির্দেশিকা খুঁজছেন। ও ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল। ভদ্রমহিলা এবার একটু সাহস করেই এগিয়ে এসে বললেন, "একটু ওষুধ দিয়ে সাহায্য করবেন মা?" রুমুন এবারে অবাক হয়েই ওঁকে জরিপ করে। কোনো চোট আঘাত নাকি? হয়তো ব্যান্ড এড ডেটল জাতীয় কিছু চাইবেন। ও বলে, "বলুন।" ভদ্রলোক এবার এগিয়ে এসে বললেন, "আসলে গত ছয় মাস ধরে আমার চাকরি নেই। আমার স্ত্রী, সাইকিয়াট্রিক পেশেন্ট। তাই..." ভদ্রমহিলা বললেন কাতর কন্ঠে, "একশোটা টাকা দিলেও হবে। একটু সাহায্য করলে... আমার ওষুধ... আপনি কাছেই থাকেন কি? তাহলে যদি এনে দেন।"
রুমুন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। না বলতে পারে না। আবার যা দিনকাল, কাকে কতটা কী বিশ্বাস করবে, বুঝে ওঠে না। ওয়ালেটে কড়কড়ে তিনটে পাঁচশো আর বেশ কয়েকটা একশোর নোট থাকলেও বের করতে দ্বিধা হয়। মাথা নিচু করে এগিয়ে যায়। ওঁরা পিছন থেকে কিছু বলতে থাকেন, আশায়... রুমুন হয়তো মত বদলাবে। রুমুন এগিয়ে যায়। ও জানে, এইসব পরিস্থিতে পিছনে ফিরে তাকাতে নেই। ক্ষণিকের জন্য হলেও হাতের টিফিন বাক্সটা একটু ভারী লাগে। তবুও এগিয়ে যায় ও।
ফুচকাওয়ালার সামনে আলু সিদ্ধ, পিঁয়াজ লঙ্কা কুঁচি, তেঁতুল জলের আলাদা সুগন্ধ। সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব কেটে যায় ও। "দিন তো, কুড়িটা টাকার চুরমুর" বলে এগিয়ে দেয় টিফিন বাক্স। চুরমুর তৈরি হয়। রুমুন বাড়ি ফেরে। প্রফেসর শঙ্কুর অ্যাডভেঞ্চার অপেক্ষা করে আছে। ভালোই কাটবে সন্ধ্যেটা। একটাই আফশোস, পার্কে কয়েক রাউন্ড হাঁটা হলো না।
রুমুন আজ যথার্থই নাগরিক।
Saturday, December 14, 2019
পার্ক
হাঁপানির কষ্টটা শীতকালে ভীষণ জ্বালায়। তাই মর্নিং ওয়াকে প্রতিমা বেরোন একটু বেলা করেই। তা প্রায় আটটা বেজেই যায়। ততক্ষণে অবশ্য সেন্ট্রাল পার্কের বাকি মর্নিং ওয়াকারের দল প্রায় সবাই ফিরে যান, বা ফেরার পথে। প্রতিমা রিটায়ার্ড। পার্ক লাগোয়া ফ্ল্যাটে একা থাকেন। ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি বৌমা জামাই প্রত্যেকেই দেশে বিদেশে যে যার মতো আছে, প্রতিমার এক্কেবারে ঝাড়া হাত পা। মর্নিং ওয়াকে এসে কিছু বন্ধু বান্ধবী জুটিয়ে ফেলেছেন। তাঁরাও প্রায় ওঁরই মতোই। ঝাড়া হাত পা। হোয়াটসআপ গ্রুপ রয়েছে। সেখানেই রোজ লেখালিখি চলে। সময় মিলিয়ে বেরিয়ে পড়েন প্রত্যেকেই। একইসাথে হাঁটাহাঁটি, যোগব্যায়াম চলে। তারপর খানিকক্ষণ বসে গল্প। এরপর আস্তে আস্তে টুকটুক করে যে যার নিজের নিজের ডেরায় ফেরা।
আজ অবশ্য প্রতিমা আর শ্যমলবাবু ছাড়া আর কেউ নেই। বাকিদের মধ্যে কেউ কেউ বেড়াতে গিয়েছে, কেউ বিদেশে পাড়ি দিয়েছে, ছেলে মেয়েদের কাছে। আবার কয়েকজন অসুস্থ। শীতকালের সিজন চেঞ্জে কাবু। শ্যমলবাবু ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিক্সের অধ্যাপক ছিলেন। প্রতিমাও ব্যাংকে উচ্চপদে চাকরি করেছেন। কাজেই দুজনের কথার বিষয়ের অভাব কখনোই হয় না। এমন কি, দুজনেরই বেশ ভালোই লাগে একে অপরের উপস্থিতি। বাকিদের চেয়ে একটু বেশিই যেন একে অপরের সাথে কথা বলতে মনের খোরাক পায়। সাম্প্রতিক বাজারের পিঁয়াজের মহার্ঘ্য অবস্থার কথাই আলোচনা করছিলেন দুজনে, হাতে মাটির ভাঁড়ে গরম চা। পার্কের চার পাক হেঁটে এই চা যেন বড়ই আরামের। আয়েশ করে চায়ের ভাঁড়ে এক চুমুক দিয়ে সবে শ্যমলবাবু কিছু একটা বলতে যাচ্ছেন, এমন সময় প্রতিমা হাত তুলে ইশারায় ওঁকে থামতে বললেন। শ্যমলবাবু একটু অবাক। কী হলো, জানতে চাইলেন। প্রতিমা ওঁকে চুপ করে বসে একটু কান পাততে বললেন। শ্যামলবাবু এবার কান খাড়া করলেন। এবং তারপরেই শুনতে পেলেন। ওঁদের বসার জায়গা থেকে একটু দূরেই বসে আছে এক যুবক যুবতী। দেখে মনে হয় সবে স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছে। পরনে ওই জিন্স টিশার্ট আর জ্যাকেট। পিঠে ব্যাকপ্যাক। একটু উত্তেজিত দুজনেই, তাই কথাবার্তা চলছে উচ্চস্বরেই।
- শোন, এই লাস্ট মোমেন্টে এসে এরকম কিন্তু কিন্তু করলে কী করে হবে?
- না মানে...
- না মানে কী?
- ভয় করছে।
- ভয়? কীসের ভয়?
- বাড়ির থেকে যদি জানতে পারে..
- জানলে জানবে।
- জানলে জানবে আবার কী?
- মানেটা খুব সিম্পল। আমরা প্রাপ্তবয়স্ক। আমরা দুইজনেই যথেষ্ট ওয়াকিবহাল আমাদের ভালো মন্দ নিয়ে। কাজেই আমরা যদি মনে করি আমরা একসাথে কোথাও বেড়াতে যাবো, এতে কীসের যে এত ভয় পাচ্ছ তুমি, আমি জাস্ট বুঝছি না।
- আরে, বাড়িতে নাইটস্টের কথা বলবো কী করে?
- কী আবার, বলবি ক্লাসের পিকনিক। তাজপুর। আমি বলবো কিছু বন্ধুদের কথা। সিম্পল। ওরা জানবে আমরা তাজপুর যাচ্ছি। সেটা সত্যিই। কিন্তু কার সাথে, সেটা জাস্ট চেপে যাবো। তাহলেই হলো। ওরা তো কেউ গোয়েন্দা লাগাতে যাবে না রে বাবা
- তুমি জানো না। আমার বাবা খুব স্ট্রিক্ট।
- ডি ডি এল জের অমৃশ পুরীর মতো?
- কয়েক ধাপ বেশি।
- তাহলে তো আরো ভালো। বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে। (সুর করে) লে জায়েঙ্গে লে জায়েঙ্গে দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে।
- তুমি সবেতেই বড্ড ইয়ার্কি করো।
- আর তুই সবেতেই এক্সট্রা টেনশন নিয়ে নিস।
- কী করবো। ছোট থেকে বাড়িতে যেরকম ভাবে বড় হয়েছি...
- ওই হলো, গেল আমাদের যাওয়া। এত কষ্ট করে সব প্ল্যান করলাম। তুই ভেস্তে দিলি।
- সরি। কিন্তু সত্যি বলছি। আমিই তাল তুলেছিলাম বটে। কিন্তু, দেখো, বাড়িতে পারমিশন পাবো না। উল্টে এর পরে বেরোতে গেলে হয়তো সন্দেহ করে নজরদারি শুরু হবে। তার চেয়ে যেমন চলছে চলুক...
- মানে এই কলেজের নামে এই পার্ক ওই মল?
- হুম। আপাতত। তারপর তুমি আর আমি দুজনে নিজের পায়ে দাঁড়াই। ব্যস। একদম নির্ভয়ে বাড়িতে বলে বুক ফুলিয়ে বেরোতে পারবো।
- বেশ। তাহলে নিউ সী হক ক্যানসেল। চলো, অন্তত সাগরদ্বীপে যকের ধন দেখি। দেখি, কটার শো।
- চলো, যাওয়া যাক।
প্রতিমা আর শ্যামল লক্ষ্য করে, এই দুই যুবক যুবতী কিঞ্চিৎ বিমর্ষচিত্তে এগিয়ে যায়। শ্যামল প্রতিমার দিকে তাকিয়ে বলেন, "কী বুঝলেন?"
প্রতিমা হেসে উত্তর দেয়, "কড়া বাপ মা যুগে যুগে প্রেমে ভিলেন হয়েই রইলো। আর কী!"
শ্যামল আর প্রতিমা দুজনেই হো হো করে হাসে খানিকক্ষণ। তারপর হাসির দমক একটু কম হতে শ্যমলবাবু প্রতিমার দিকে ফিরে বেশ একটা দুঃখী দুঃখী মুখ করে বললেন, "তা, আমাদের দুজনেরই জীবনে ভিলেন বলতে কেউ নেই। আমাদেরও ভিলেনের পার্ট প্লে করা হয়ে গিয়েছে। আমরা দুজন তা হলে সী হকে যাবো নাকি? মালিকের একটা বুকিং ক্যানসেল হয়ে গেল। ভাবলেও খারাপ লাগে।" মিথ্যে কাঁচুমাচু মুখ করে আর কতক্ষণই বা থাকা যায়? ফিক করে হেসে ফেললেন। প্রতিমাও কপট রাগ পুষে না রেখে হেসে উত্তর দিলেন, "ও, পেটে পেটে এতদূর? তা চলুন। ঘুরেই আসি।"
হাঁপানির কষ্টটা শীতকালে ভীষণ জ্বালায়। তাই মর্নিং ওয়াকে প্রতিমা বেরোন একটু বেলা করেই। তা প্রায় আটটা বেজেই যায়। ততক্ষণে অবশ্য সেন্ট্রাল পার্কের বাকি মর্নিং ওয়াকারের দল প্রায় সবাই ফিরে যান, বা ফেরার পথে। প্রতিমা রিটায়ার্ড। পার্ক লাগোয়া ফ্ল্যাটে একা থাকেন। ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি বৌমা জামাই প্রত্যেকেই দেশে বিদেশে যে যার মতো আছে, প্রতিমার এক্কেবারে ঝাড়া হাত পা। মর্নিং ওয়াকে এসে কিছু বন্ধু বান্ধবী জুটিয়ে ফেলেছেন। তাঁরাও প্রায় ওঁরই মতোই। ঝাড়া হাত পা। হোয়াটসআপ গ্রুপ রয়েছে। সেখানেই রোজ লেখালিখি চলে। সময় মিলিয়ে বেরিয়ে পড়েন প্রত্যেকেই। একইসাথে হাঁটাহাঁটি, যোগব্যায়াম চলে। তারপর খানিকক্ষণ বসে গল্প। এরপর আস্তে আস্তে টুকটুক করে যে যার নিজের নিজের ডেরায় ফেরা।
আজ অবশ্য প্রতিমা আর শ্যমলবাবু ছাড়া আর কেউ নেই। বাকিদের মধ্যে কেউ কেউ বেড়াতে গিয়েছে, কেউ বিদেশে পাড়ি দিয়েছে, ছেলে মেয়েদের কাছে। আবার কয়েকজন অসুস্থ। শীতকালের সিজন চেঞ্জে কাবু। শ্যমলবাবু ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিক্সের অধ্যাপক ছিলেন। প্রতিমাও ব্যাংকে উচ্চপদে চাকরি করেছেন। কাজেই দুজনের কথার বিষয়ের অভাব কখনোই হয় না। এমন কি, দুজনেরই বেশ ভালোই লাগে একে অপরের উপস্থিতি। বাকিদের চেয়ে একটু বেশিই যেন একে অপরের সাথে কথা বলতে মনের খোরাক পায়। সাম্প্রতিক বাজারের পিঁয়াজের মহার্ঘ্য অবস্থার কথাই আলোচনা করছিলেন দুজনে, হাতে মাটির ভাঁড়ে গরম চা। পার্কের চার পাক হেঁটে এই চা যেন বড়ই আরামের। আয়েশ করে চায়ের ভাঁড়ে এক চুমুক দিয়ে সবে শ্যমলবাবু কিছু একটা বলতে যাচ্ছেন, এমন সময় প্রতিমা হাত তুলে ইশারায় ওঁকে থামতে বললেন। শ্যমলবাবু একটু অবাক। কী হলো, জানতে চাইলেন। প্রতিমা ওঁকে চুপ করে বসে একটু কান পাততে বললেন। শ্যামলবাবু এবার কান খাড়া করলেন। এবং তারপরেই শুনতে পেলেন। ওঁদের বসার জায়গা থেকে একটু দূরেই বসে আছে এক যুবক যুবতী। দেখে মনে হয় সবে স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছে। পরনে ওই জিন্স টিশার্ট আর জ্যাকেট। পিঠে ব্যাকপ্যাক। একটু উত্তেজিত দুজনেই, তাই কথাবার্তা চলছে উচ্চস্বরেই।
- শোন, এই লাস্ট মোমেন্টে এসে এরকম কিন্তু কিন্তু করলে কী করে হবে?
- না মানে...
- না মানে কী?
- ভয় করছে।
- ভয়? কীসের ভয়?
- বাড়ির থেকে যদি জানতে পারে..
- জানলে জানবে।
- জানলে জানবে আবার কী?
- মানেটা খুব সিম্পল। আমরা প্রাপ্তবয়স্ক। আমরা দুইজনেই যথেষ্ট ওয়াকিবহাল আমাদের ভালো মন্দ নিয়ে। কাজেই আমরা যদি মনে করি আমরা একসাথে কোথাও বেড়াতে যাবো, এতে কীসের যে এত ভয় পাচ্ছ তুমি, আমি জাস্ট বুঝছি না।
- আরে, বাড়িতে নাইটস্টের কথা বলবো কী করে?
- কী আবার, বলবি ক্লাসের পিকনিক। তাজপুর। আমি বলবো কিছু বন্ধুদের কথা। সিম্পল। ওরা জানবে আমরা তাজপুর যাচ্ছি। সেটা সত্যিই। কিন্তু কার সাথে, সেটা জাস্ট চেপে যাবো। তাহলেই হলো। ওরা তো কেউ গোয়েন্দা লাগাতে যাবে না রে বাবা
- তুমি জানো না। আমার বাবা খুব স্ট্রিক্ট।
- ডি ডি এল জের অমৃশ পুরীর মতো?
- কয়েক ধাপ বেশি।
- তাহলে তো আরো ভালো। বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে। (সুর করে) লে জায়েঙ্গে লে জায়েঙ্গে দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে।
- তুমি সবেতেই বড্ড ইয়ার্কি করো।
- আর তুই সবেতেই এক্সট্রা টেনশন নিয়ে নিস।
- কী করবো। ছোট থেকে বাড়িতে যেরকম ভাবে বড় হয়েছি...
- ওই হলো, গেল আমাদের যাওয়া। এত কষ্ট করে সব প্ল্যান করলাম। তুই ভেস্তে দিলি।
- সরি। কিন্তু সত্যি বলছি। আমিই তাল তুলেছিলাম বটে। কিন্তু, দেখো, বাড়িতে পারমিশন পাবো না। উল্টে এর পরে বেরোতে গেলে হয়তো সন্দেহ করে নজরদারি শুরু হবে। তার চেয়ে যেমন চলছে চলুক...
- মানে এই কলেজের নামে এই পার্ক ওই মল?
- হুম। আপাতত। তারপর তুমি আর আমি দুজনে নিজের পায়ে দাঁড়াই। ব্যস। একদম নির্ভয়ে বাড়িতে বলে বুক ফুলিয়ে বেরোতে পারবো।
- বেশ। তাহলে নিউ সী হক ক্যানসেল। চলো, অন্তত সাগরদ্বীপে যকের ধন দেখি। দেখি, কটার শো।
- চলো, যাওয়া যাক।
প্রতিমা আর শ্যামল লক্ষ্য করে, এই দুই যুবক যুবতী কিঞ্চিৎ বিমর্ষচিত্তে এগিয়ে যায়। শ্যামল প্রতিমার দিকে তাকিয়ে বলেন, "কী বুঝলেন?"
প্রতিমা হেসে উত্তর দেয়, "কড়া বাপ মা যুগে যুগে প্রেমে ভিলেন হয়েই রইলো। আর কী!"
শ্যামল আর প্রতিমা দুজনেই হো হো করে হাসে খানিকক্ষণ। তারপর হাসির দমক একটু কম হতে শ্যমলবাবু প্রতিমার দিকে ফিরে বেশ একটা দুঃখী দুঃখী মুখ করে বললেন, "তা, আমাদের দুজনেরই জীবনে ভিলেন বলতে কেউ নেই। আমাদেরও ভিলেনের পার্ট প্লে করা হয়ে গিয়েছে। আমরা দুজন তা হলে সী হকে যাবো নাকি? মালিকের একটা বুকিং ক্যানসেল হয়ে গেল। ভাবলেও খারাপ লাগে।" মিথ্যে কাঁচুমাচু মুখ করে আর কতক্ষণই বা থাকা যায়? ফিক করে হেসে ফেললেন। প্রতিমাও কপট রাগ পুষে না রেখে হেসে উত্তর দিলেন, "ও, পেটে পেটে এতদূর? তা চলুন। ঘুরেই আসি।"
Wednesday, December 11, 2019
মডার্ন পেরেন্টিং (৩)
সুচেতনা
কে জানে কী মনে হতে স্কুলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটা খুলল রিমঝিম। স্কুল বলতে, মেয়ে রুনির স্কুলের। রুনির সবে ক্লাস ওয়ান। বাড়ির কাছেই নামকরা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। বম্বেতে এটাই নিয়ম। স্কুল হতে হবে বাড়ির কাছাকাছি। এই জিনিসটা রিমঝিমের ভারী পছন্দ। কলকাতায় থাকতে নিজের বন্ধুদের তো কত দেখেছে, সেই দমদম, সল্ট লেক থেকে যাদবপুর আসতো নামী স্কুলে পড়বে বলে, বা সেই বেহালা থেকে আসতে হতো বালিগঞ্জ। কম কষ্ট নাকি বাচ্চাদের? এখন দিনকাল কত পালটে গিয়েছে। আগে যেমন ওই স্কুলের বাইরে ভিড় করে থাকা বাবা মায়েরা, বিশেষ করে মায়েরা জটলা পাকিয়ে স্কুলের শেষে হোমওয়ার্ক, পরীক্ষার সিলেবাস, টিউশন ক্লাসের হদিস পেতো, এখন সেইসব হয় ভার্চ্যুয়ালি। whatsapp গ্রুপে চ্যাটে। রিমঝিম দেখলো, আজ নাকি অনেকের ডায়েরিতে নোটিস পড়েছে। পেরেন্টস কল। কে জানে, রুনিরও হলো কি না। বাড়ি ফিরে দেখতে হবে। যা দস্যি মেয়ে।
দস্যি বটে, তবে একদিক দিয়ে রিমঝিম মনে মনে মেয়েকে নিয়ে খুব খুশি। স্কুলে ইতিমধ্যেই গুড টাচ ব্যাড টাচ নিয়ে শিখিয়ে তো দিয়েছে। মা হিসেবেও রিমঝিম ওর দায়িত্ব পালন করেছে। নিজে একটা ছুটির দিনে বসে ভালো করে যত্ন সহকারে মেয়েকে ভালো মন্দ বলেছে। আর সাথে এটাও বলেছে, কেউ কখনো "হার্ট" করতে গেলেই তাইকন্ডো ক্লাসে শেখা কয়েকটা ডেমো দিয়ে দিতে। তাহলে আর সহজে ঘাঁটতে পারবে না। রুনি কিন্তু মায়ের বাধ্য মেয়ে। স্কুলে এরপর বার দুইয়েক স্পোর্টস চলাকালীন ক্লাসের কিছু দুষ্টু ছেলে ওর পিছনে লাগছিলো, দিয়েছে দুই ঘা। রিমঝিম মনে মনে বেশ প্রাউড ফিল করে। যেমন দিন পড়েছে, তেমন করেই মানুষ করতে হবে।
বাড়ি ফিরে রিমঝিম অবাক। মানতুদির কাছে শুনলো, রুনি নীচে খেলতে যায়নি। স্কুল থেকে ফিরেছে বেশ চুপচাপ। খাওয়া নিয়ে রোজের মতো একটুও ঝামেলা পাকায়নি। খুঁটে খুঁটে অল্প একটু খেয়ে উঠে গিয়েছে। টিভিও চালায়নি। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। রিমঝিম শুনে বেশ চিন্তিত হলো। কী ব্যাপার, মেয়ের এরকম আমূল পরিবর্তন কেন? জানতে ওকে হবেই। ও হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে ঝটপট রুনির ঘরে গেল। মেয়ে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। কোলবালিশ আঁকড়ে শুয়ে। গাল বেয়ে চোখের জল, শুকিয়ে দাগ হয়ে গিয়েছে। আহা রে, মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। কী হলো? রিমঝিম একটু ভয় পায়। দিনকাল এত খারাপ। শিউরে ওঠে। রুনির কোনো ক্ষতি হলো না তো? সর্বক্ষণ কাঁটা হয়ে থাকতে হয়।
রিমঝিম স্নেহের বশে মেয়েকে জাপ্টে ওর পাশে শুয়ে পড়ে। মাথায় হাত বোলাতে থাকে। মেয়ের ভয় কাটিয়ে ওর কথা শুনতে হবে। দেখতে হবে কী সমস্যা হয়েছে ওর। মায়ের স্পর্শে রুনির ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলর ড্যাবড্যাব করে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ক্ষণিকের ভেবলে যাওয়াটা কাটিয়ে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে ওঠে। রিমঝিম মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে থাকে। শান্ত করার চেষ্টা করে। স্নেহের সাথে বলে, "কাঁদে না সোনা। বলো আমায়, কী হয়েছে?" রুনি কান্না বন্ধ করার কোনো চেষ্টাই করেনা। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলতে তুলতে যা বলে, তার সারমর্ম এই। ওর ক্লাসের এক বন্ধু, অঙ্কিত নাকি ওকে আজ টিফিন ব্রেকে ওর হাত ধরে পাশে বসিয়ে ওকে বলেছে, "আমি তোকে খুব ভালোবাসি। আজ থেকে তুই আমার গার্লফ্রেন্ড আর আমি তোর বয়ফ্রেন্ড। অন্য কোনো ছেলের সাথে আর কথা বলবি না।" এই বলে নাকি আবার রুনির গালে চুমু খেয়েছে। রুনি নিজেকে বাঁচাতে অবশ্য অঙ্কিতকে ধরে দিয়েছে পেটে একটা ঘুঁষি। কিন্তু ভীষণভাবে বিড়ম্বিত। ও কিছুতেই আর অঙ্কিতের সাথে কথা বলতে চায় না।
রিমঝিম হতভম্ব। এইটুকু বাচ্চা। এরা আবার প্রেম ভালোবাসা গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড এসবের কী বোঝে? যত আজেবাজে সিরিয়াল সিনেমার প্রকোপ। কেন যে বাবা মায়ের যা খুশি টিভিতে দেখতে দেয় এদের। রুনিকে শান্ত করে। বলে, " আমি অঙ্কিতের মাকে বলবো। এরকম আর রিপিট হবে না। গ্লোরিয়া মিসকেও বলবো কালকেই। তুমি চিন্তা করো না মাম্মাম। আর রিপিট হবে না। কিন্তু বাই চান্স যদি হয়, ডু ওয়াট ইউ ডিড টুডে। কেউ তোমায় অস্বস্তিতে ফেললেই সেলফ ডিফেন্স যা শিখেছো, এপ্লাই করবে। আর হ্যাঁ, কান্নাকাটি তুমি করবে না মা একদম। দোষ যে করেছে, সে অঙ্কিত। নট ইউ। হি শুড বি এশেমড অফ হিমসেলফ। হি শুড বি পিনালাইজড। বুঝেছো?"
রুনি মাথা নাড়ে। রিমঝিম মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে থাকে। সাময়িক মিটমাট। কিন্তু কাল অবশ্যই ক্লাস টিচারকে জানাতে হবে। আর খানিকক্ষণ পর, অঙ্কিতের মাকে। ক্লাস ওয়ানের বাচ্চারাও নাকি প্রপোজ করছে। ভাবা যায়? আর এদিকে ওকে পুরো কলেজ লাইফ অবধি হা পিত্যেস করে থাকতে হলো, কবে সুমিত ওকে প্রপোজ করবে। হা ঈশ্বর।
দস্যি বটে, তবে একদিক দিয়ে রিমঝিম মনে মনে মেয়েকে নিয়ে খুব খুশি। স্কুলে ইতিমধ্যেই গুড টাচ ব্যাড টাচ নিয়ে শিখিয়ে তো দিয়েছে। মা হিসেবেও রিমঝিম ওর দায়িত্ব পালন করেছে। নিজে একটা ছুটির দিনে বসে ভালো করে যত্ন সহকারে মেয়েকে ভালো মন্দ বলেছে। আর সাথে এটাও বলেছে, কেউ কখনো "হার্ট" করতে গেলেই তাইকন্ডো ক্লাসে শেখা কয়েকটা ডেমো দিয়ে দিতে। তাহলে আর সহজে ঘাঁটতে পারবে না। রুনি কিন্তু মায়ের বাধ্য মেয়ে। স্কুলে এরপর বার দুইয়েক স্পোর্টস চলাকালীন ক্লাসের কিছু দুষ্টু ছেলে ওর পিছনে লাগছিলো, দিয়েছে দুই ঘা। রিমঝিম মনে মনে বেশ প্রাউড ফিল করে। যেমন দিন পড়েছে, তেমন করেই মানুষ করতে হবে।
বাড়ি ফিরে রিমঝিম অবাক। মানতুদির কাছে শুনলো, রুনি নীচে খেলতে যায়নি। স্কুল থেকে ফিরেছে বেশ চুপচাপ। খাওয়া নিয়ে রোজের মতো একটুও ঝামেলা পাকায়নি। খুঁটে খুঁটে অল্প একটু খেয়ে উঠে গিয়েছে। টিভিও চালায়নি। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। রিমঝিম শুনে বেশ চিন্তিত হলো। কী ব্যাপার, মেয়ের এরকম আমূল পরিবর্তন কেন? জানতে ওকে হবেই। ও হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে ঝটপট রুনির ঘরে গেল। মেয়ে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। কোলবালিশ আঁকড়ে শুয়ে। গাল বেয়ে চোখের জল, শুকিয়ে দাগ হয়ে গিয়েছে। আহা রে, মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। কী হলো? রিমঝিম একটু ভয় পায়। দিনকাল এত খারাপ। শিউরে ওঠে। রুনির কোনো ক্ষতি হলো না তো? সর্বক্ষণ কাঁটা হয়ে থাকতে হয়।
রিমঝিম স্নেহের বশে মেয়েকে জাপ্টে ওর পাশে শুয়ে পড়ে। মাথায় হাত বোলাতে থাকে। মেয়ের ভয় কাটিয়ে ওর কথা শুনতে হবে। দেখতে হবে কী সমস্যা হয়েছে ওর। মায়ের স্পর্শে রুনির ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলর ড্যাবড্যাব করে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ক্ষণিকের ভেবলে যাওয়াটা কাটিয়ে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে ওঠে। রিমঝিম মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে থাকে। শান্ত করার চেষ্টা করে। স্নেহের সাথে বলে, "কাঁদে না সোনা। বলো আমায়, কী হয়েছে?" রুনি কান্না বন্ধ করার কোনো চেষ্টাই করেনা। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলতে তুলতে যা বলে, তার সারমর্ম এই। ওর ক্লাসের এক বন্ধু, অঙ্কিত নাকি ওকে আজ টিফিন ব্রেকে ওর হাত ধরে পাশে বসিয়ে ওকে বলেছে, "আমি তোকে খুব ভালোবাসি। আজ থেকে তুই আমার গার্লফ্রেন্ড আর আমি তোর বয়ফ্রেন্ড। অন্য কোনো ছেলের সাথে আর কথা বলবি না।" এই বলে নাকি আবার রুনির গালে চুমু খেয়েছে। রুনি নিজেকে বাঁচাতে অবশ্য অঙ্কিতকে ধরে দিয়েছে পেটে একটা ঘুঁষি। কিন্তু ভীষণভাবে বিড়ম্বিত। ও কিছুতেই আর অঙ্কিতের সাথে কথা বলতে চায় না।
রিমঝিম হতভম্ব। এইটুকু বাচ্চা। এরা আবার প্রেম ভালোবাসা গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড এসবের কী বোঝে? যত আজেবাজে সিরিয়াল সিনেমার প্রকোপ। কেন যে বাবা মায়ের যা খুশি টিভিতে দেখতে দেয় এদের। রুনিকে শান্ত করে। বলে, " আমি অঙ্কিতের মাকে বলবো। এরকম আর রিপিট হবে না। গ্লোরিয়া মিসকেও বলবো কালকেই। তুমি চিন্তা করো না মাম্মাম। আর রিপিট হবে না। কিন্তু বাই চান্স যদি হয়, ডু ওয়াট ইউ ডিড টুডে। কেউ তোমায় অস্বস্তিতে ফেললেই সেলফ ডিফেন্স যা শিখেছো, এপ্লাই করবে। আর হ্যাঁ, কান্নাকাটি তুমি করবে না মা একদম। দোষ যে করেছে, সে অঙ্কিত। নট ইউ। হি শুড বি এশেমড অফ হিমসেলফ। হি শুড বি পিনালাইজড। বুঝেছো?"
রুনি মাথা নাড়ে। রিমঝিম মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে থাকে। সাময়িক মিটমাট। কিন্তু কাল অবশ্যই ক্লাস টিচারকে জানাতে হবে। আর খানিকক্ষণ পর, অঙ্কিতের মাকে। ক্লাস ওয়ানের বাচ্চারাও নাকি প্রপোজ করছে। ভাবা যায়? আর এদিকে ওকে পুরো কলেজ লাইফ অবধি হা পিত্যেস করে থাকতে হলো, কবে সুমিত ওকে প্রপোজ করবে। হা ঈশ্বর।
Monday, December 9, 2019
মডার্ন পেরেন্টিং (২)
"নিজের বই কোথায় ফেলে আসো, খেয়াল থাকে না কেন?" এই বলে রুকুর গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারলো পিউ। রুকু কাঁদলো না। তবে মুখটা কাঁচুমাচু করে চলে গেল নিজের ঘরে।
অফিস টাইমে এই ভিড় মেট্রো চেপে ফিরতে ফিরতে একেই মাথা গরম হয়ে থাকে। তার ওপর এই যদি ফিরে এসেই শুনতে হয় আগামী সপ্তাহে যে সাবজেক্টের পরীক্ষা, তার বই হারিয়েছে ছেলে, মেজাজ সামলে রাখা ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ে বটে। পিউয়ের খারাপ লাগে। আজকাল বড্ড মেজাজ হারাচ্ছে। কারণে অকারণে বকুনি দিচ্ছে রুকুকে। অনেক চেষ্টা করে নিজেকে সামলাতে, পারে না।
হিন্দি সাবজেক্টটা নিয়ে এমনিই হিমশিম খায় ওরা মা ছেলেতে। অনেক কষ্টে বন্ধু বান্ধবদের ধরে ইন্টারনেট ঘেঁটে নানান কাঠখড় পুড়িয়ে তবে কিনা সমস্ত সিলেবাস শেষ করিয়েছিল। যত ওয়ার্ক শিট, সব সলভ করিয়েছিল। আর এখন, পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে যদি রুকু এসে বলে যে বইটা খুঁজে পাচ্ছে না, কী করে চলে? হ্যাঁ, বাধ্য হয়ে, নিরুপায় হয়ে নতুন আরেকটা বই কিনে আনতে হবে ঠিকই। কিন্তু ওই সলিউশনগুলো? পিউ নিজে বরাবর হিন্দিতে কাঁচা। কখন ওই করেগা আর কখন করেগি, এই নিয়ে চিরকাল জেরবার। আবার ওই অফিসের সৌরভকে ধরতে হবে। এমনিতেই ওকে তেমন পছন্দ নয় পিউয়ের। কিন্তু কী আর করা, হিন্দি মাদার টাং। ও ছাড়া এই লাস্ট মোমেন্টে কেই বা হেল্প করবে। ভাবছে সামনের বছর থেকে একটা টিউটর রাখবে হিন্দির জন্য। ওর পক্ষে এই জোড়াতাপ্পি দিয়ে চালানো বেশ কঠিন।
রুকুর মুখটা ভেবে মায়া হলো পিউয়ের। ওর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো, অঙ্ক খাতা নিয়ে বসেছে। যাক অন্তত একটা বকুনি খেয়ে বাকি আর কিছুর জন্য বকতে হয়নি। এমনিই নিজে থেকেই বসে গিয়েছে পড়তে। হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো পিউ। ফ্রিজ থেকে একটু চিকেন সিদ্ধ বের করলো। অল্প পিঁয়াজ ক্যাপসিকাম কেটে ফ্রায়িং প্যানে দিয়ে নাড়াচাড়া করে একটা টস কারি গোছের রেঁধে ফেললো। ব্রেড টোস্ট করে তাতে হালকা চিজ মাখিয়ে মা ও ছেলে, দুজনের জন্য চিকেন এন্ড টোস্ট নিয়ে রুকুর ঘরে এলো। রুকু পিউয়ের পায়ের শব্দে মাথা তুললো, কিছু না বলে আবার অঙ্ক খাতায় মনোনিবেশ করলো। পিউ ওর সামনে টেবিল পেতে তাতে দুজনের প্লেট রেখে রুকুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, "সরি। তখন পুরো ঘটনা না শুনে তোকে মারা উচিত হয়নি আমার। খেয়ে নে।"
রুকু পেন্সিল নীচে নামিয়ে রাখলো। খাতা খোলা। মায়ের হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে বললো, "মা, সত্যি বলছি। আমার মনে নেই আমি কোথায় রেখেছি বইটা।"
পিউ বললো, "সে তো বুঝলাম। কিন্তু মনে না করলে খুঁজে পাবে কী করে বলো? পরীক্ষাতে কী করবে?"
রুকু উত্তর বলে, "মা, অবিনাশকে ফোন করবো? ওর বইটা যদি ও লেন্ড করে। তুমি জেরক্স করে নেবে।"
পিউ খেতে খেতে মাথা নাড়লো। তারপর বলল, "আচ্ছা, অবিনাশকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখ না। ওর বইয়ের সাথে চলে যায় নি তো? পাশাপাশি বসিস।" রুকু শুনে একটু মাথা নাড়লো। হুম। হতেই পারে। একসাথেই তো ওরা বসে। বইপত্র সব এক টেবিলে থাকে। ও বলে, "মা, তুমি আন্টির নম্বরে কল করো একবার। আমি বলি।"
পিউ মোবাইল বের করে। অবিনাশের মায়ের ফোনে কল করে। অবিনাশ কোচিং ক্লাসে গিয়েছে। তাই পিউই ওর মাকে বলে, "মিসেস বসু, আমার ছেলের হিন্দি বইটা খুঁজে পাচ্ছি না। একবার প্লিজ দেখবেন অবিনাশের ব্যাগে ওর বইয়ের সাথে চলে গিয়েছে কি না?" উল্টোদিক থেকে ঝাঁঝালো উত্তর আসে, "অবি কেন স্বস্তিকের বই নিয়ে আসবে?"
পিউ একটু নরম স্বরেই বলে, "না না, সেটা না। আসলে ওরা পাশাপাশি বসে। তাই ভাব্লাম। বাই মিস্টেক... যাই হোক, আপনি প্লিজ দেখবেন। আই এম শিয়োর, থাকলে আপনি ফেরত পাঠিয়ে দেবেন। খুবই উপকার হয়।" অবিনাশের মা একটু ঠান্ডা গলায় বলে, "হুম। ঠিক আছে। ও ক্লাস থেকে ফিরুক। আমি দেখবো।" এই বলে ফোন ছেড়ে দেয়। পিউ আর বই জেরক্সের কথা বলতে পারে না। রুকুকে বলে, "শোন, একজ্যামের এখন ওয়ান উইক বাকি। একটু দেখ কাল অবিনাশ আনে কি না। আর পরশু তো স্কুলে লস্ট প্রপার্টি আছে। দেখ অপেক্ষা করে। যদি পাস। নইলে আমি ব্যবস্থা করছি। হয় নতুন বই, নয় কারুর থেকে জেরক্স। মিসেস বসুকে তো মনে হল না কথা শুনে যে বই ধার দেবে। আমাকেই কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।"
রুকু প্লেট রেখে হাত মুখ ধুয়ে এসে অঙ্ক খাতা নিয়ে বসলো। পিউ সাংসারিক কাজে মন দিলো।
পরের দিন স্বাভাবিকভাবেই রুকু স্কুলে গেলো। পিউ ওকে একবার মনে করিয়ে দিলো, অবিনাশকে বইয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে। বিকেলে ফিরে রুকু জানালো, অবিনাশ বএলছে, ওর কাছে বই নেই। লস্ট প্রপার্টির জন্য এখন আর একদিন অপেক্ষা।
লস্ট প্রপার্টিতেও বই পাওয়া গেলো না। পিউ এবার একটু চিন্তিত। বই জেরক্স কেউ কি আদৌ করতে দেবে? অবিনাশের মাকেই কি বলবে? দ্বিধা করতে থাকে। স্কুলে আর তো কেউ নেই। এই বছর সেকশন চেঞ্জ হয়ে যাওয়ায় কারুর ফোন নম্বর নেই পিউয়ের কাছে। একবার কি তাহলে কাল স্কুলের পর হিন্দি মিসের সাথে দেখা করবে? নতুন বই নিয়ে গেলে যদি একটু হেল্প করে দেন? সেই আশা অবশ্য কম। এইসব টিচাররা যে যার প্রাইভেট টিউশানি করতে এতই ব্যস্ত। প্রাইভেট স্কুলের হাইফাই ব্যাপার। পিউ কিছুতেই মেলাতে পারে না এইসব, নিজের শৈশবের সাথে। ওরাও তো ভালো স্কুলে পড়েছে, মাঝেসাঝে কামাইও হয়েছে। সব সময় তো বন্ধুরা সাহায্য করেছে। পিউয়ের মনে পড়ে, ওর যখন ক্লাস সেভেন, সেবার সেকেন্ড টার্মের ঠিক আগে ওর সে কী টায়ফয়েড। স্কুলের মিস, ক্লাসের বন্ধুরা সব্বাই মিলে ওকে নোটস বানিয়ে দিত। আর এখন কে জানে এত কম্পিটিশন কেন।
রুকুর স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে পিউ। রুকুর ডায়েরিতে ও লিখে দিয়েছিল, হিন্দি মিসের সাথে দেখা করার কথা। যদি উনি হ্যাঁ বলেন, তাহলে দেখা করবে। রুকু বেরিয়েই এক গাল হাসি হেসে মাকে বলল, "মা, আর মিসের সাথে দেখা করতে হবে না। হিন্দি বইটা আমি পেয়ে গিয়েছি।"
পিউ খানিক অবাক হয়েই বলল, "তাই? বাহ। ভালো তো। তা পেলি কোথায়?"
রুকু হেসে বলল, "অবিনাশের কাছেই ছিল। ওর ব্যাগের ভিতর। ও বলল, এই কদিন নাকি ও খেয়াল করেনি। আমি বলেছিলাম না মা? ওর ব্যাগেই নিশ্চয়ই চলে গিয়েছে। আমি হারাইনি?"
পিউ আর কিছু বলেনা। রুকুর হাত ধরে রাস্তা পার হয়। উল্টো দিকে অটোর লম্বা লাইন। তাড়াতাড়ি না গেলে সেখানেও ভিড় হবে। সর্বত্র কম্পিটিশন, র্যাট রেস। ভাল্লাগেনা।
বাড়ি ফিরে রুকুকে পড়তে বসিয়ে কী জানি কী মনে হতে পিউ হিন্দি বইটা খোলে। উলটে পালটে দেখতে গিয়ে একটা ছোট্ট চিরকুট বেরিয়ে পড়ে। অচেনা হাতের লেখায় কিছু পেজ নম্বর লেখা। আর সাথে লেখা, 'এক কপি'। কৌতূহলবশত ওই পাতাগুলোতে যায় পিউ। গত টার্মের সিলেবাসের কঠিনতম চ্যাপ্টারগুলি। কত কাঠখড় পুড়িয়ে যা সল্ভ করেছিল পিউ। সেইগুলিই জেরক্স হয়েছে। হঠাৎ করেই পুরো ঘটনাটা বুঝতে পারে পিউ। শিউরে ওঠে। এই র্যাট রেসে এমনভাবে ছেলে মেয়েগুলোও নেমে পড়লো? কী দিনকাল। কীসব পেরেন্টিং...
অফিস টাইমে এই ভিড় মেট্রো চেপে ফিরতে ফিরতে একেই মাথা গরম হয়ে থাকে। তার ওপর এই যদি ফিরে এসেই শুনতে হয় আগামী সপ্তাহে যে সাবজেক্টের পরীক্ষা, তার বই হারিয়েছে ছেলে, মেজাজ সামলে রাখা ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ে বটে। পিউয়ের খারাপ লাগে। আজকাল বড্ড মেজাজ হারাচ্ছে। কারণে অকারণে বকুনি দিচ্ছে রুকুকে। অনেক চেষ্টা করে নিজেকে সামলাতে, পারে না।
হিন্দি সাবজেক্টটা নিয়ে এমনিই হিমশিম খায় ওরা মা ছেলেতে। অনেক কষ্টে বন্ধু বান্ধবদের ধরে ইন্টারনেট ঘেঁটে নানান কাঠখড় পুড়িয়ে তবে কিনা সমস্ত সিলেবাস শেষ করিয়েছিল। যত ওয়ার্ক শিট, সব সলভ করিয়েছিল। আর এখন, পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে যদি রুকু এসে বলে যে বইটা খুঁজে পাচ্ছে না, কী করে চলে? হ্যাঁ, বাধ্য হয়ে, নিরুপায় হয়ে নতুন আরেকটা বই কিনে আনতে হবে ঠিকই। কিন্তু ওই সলিউশনগুলো? পিউ নিজে বরাবর হিন্দিতে কাঁচা। কখন ওই করেগা আর কখন করেগি, এই নিয়ে চিরকাল জেরবার। আবার ওই অফিসের সৌরভকে ধরতে হবে। এমনিতেই ওকে তেমন পছন্দ নয় পিউয়ের। কিন্তু কী আর করা, হিন্দি মাদার টাং। ও ছাড়া এই লাস্ট মোমেন্টে কেই বা হেল্প করবে। ভাবছে সামনের বছর থেকে একটা টিউটর রাখবে হিন্দির জন্য। ওর পক্ষে এই জোড়াতাপ্পি দিয়ে চালানো বেশ কঠিন।
রুকুর মুখটা ভেবে মায়া হলো পিউয়ের। ওর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো, অঙ্ক খাতা নিয়ে বসেছে। যাক অন্তত একটা বকুনি খেয়ে বাকি আর কিছুর জন্য বকতে হয়নি। এমনিই নিজে থেকেই বসে গিয়েছে পড়তে। হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো পিউ। ফ্রিজ থেকে একটু চিকেন সিদ্ধ বের করলো। অল্প পিঁয়াজ ক্যাপসিকাম কেটে ফ্রায়িং প্যানে দিয়ে নাড়াচাড়া করে একটা টস কারি গোছের রেঁধে ফেললো। ব্রেড টোস্ট করে তাতে হালকা চিজ মাখিয়ে মা ও ছেলে, দুজনের জন্য চিকেন এন্ড টোস্ট নিয়ে রুকুর ঘরে এলো। রুকু পিউয়ের পায়ের শব্দে মাথা তুললো, কিছু না বলে আবার অঙ্ক খাতায় মনোনিবেশ করলো। পিউ ওর সামনে টেবিল পেতে তাতে দুজনের প্লেট রেখে রুকুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, "সরি। তখন পুরো ঘটনা না শুনে তোকে মারা উচিত হয়নি আমার। খেয়ে নে।"
রুকু পেন্সিল নীচে নামিয়ে রাখলো। খাতা খোলা। মায়ের হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে বললো, "মা, সত্যি বলছি। আমার মনে নেই আমি কোথায় রেখেছি বইটা।"
পিউ বললো, "সে তো বুঝলাম। কিন্তু মনে না করলে খুঁজে পাবে কী করে বলো? পরীক্ষাতে কী করবে?"
রুকু উত্তর বলে, "মা, অবিনাশকে ফোন করবো? ওর বইটা যদি ও লেন্ড করে। তুমি জেরক্স করে নেবে।"
পিউ খেতে খেতে মাথা নাড়লো। তারপর বলল, "আচ্ছা, অবিনাশকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখ না। ওর বইয়ের সাথে চলে যায় নি তো? পাশাপাশি বসিস।" রুকু শুনে একটু মাথা নাড়লো। হুম। হতেই পারে। একসাথেই তো ওরা বসে। বইপত্র সব এক টেবিলে থাকে। ও বলে, "মা, তুমি আন্টির নম্বরে কল করো একবার। আমি বলি।"
পিউ মোবাইল বের করে। অবিনাশের মায়ের ফোনে কল করে। অবিনাশ কোচিং ক্লাসে গিয়েছে। তাই পিউই ওর মাকে বলে, "মিসেস বসু, আমার ছেলের হিন্দি বইটা খুঁজে পাচ্ছি না। একবার প্লিজ দেখবেন অবিনাশের ব্যাগে ওর বইয়ের সাথে চলে গিয়েছে কি না?" উল্টোদিক থেকে ঝাঁঝালো উত্তর আসে, "অবি কেন স্বস্তিকের বই নিয়ে আসবে?"
পিউ একটু নরম স্বরেই বলে, "না না, সেটা না। আসলে ওরা পাশাপাশি বসে। তাই ভাব্লাম। বাই মিস্টেক... যাই হোক, আপনি প্লিজ দেখবেন। আই এম শিয়োর, থাকলে আপনি ফেরত পাঠিয়ে দেবেন। খুবই উপকার হয়।" অবিনাশের মা একটু ঠান্ডা গলায় বলে, "হুম। ঠিক আছে। ও ক্লাস থেকে ফিরুক। আমি দেখবো।" এই বলে ফোন ছেড়ে দেয়। পিউ আর বই জেরক্সের কথা বলতে পারে না। রুকুকে বলে, "শোন, একজ্যামের এখন ওয়ান উইক বাকি। একটু দেখ কাল অবিনাশ আনে কি না। আর পরশু তো স্কুলে লস্ট প্রপার্টি আছে। দেখ অপেক্ষা করে। যদি পাস। নইলে আমি ব্যবস্থা করছি। হয় নতুন বই, নয় কারুর থেকে জেরক্স। মিসেস বসুকে তো মনে হল না কথা শুনে যে বই ধার দেবে। আমাকেই কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।"
রুকু প্লেট রেখে হাত মুখ ধুয়ে এসে অঙ্ক খাতা নিয়ে বসলো। পিউ সাংসারিক কাজে মন দিলো।
পরের দিন স্বাভাবিকভাবেই রুকু স্কুলে গেলো। পিউ ওকে একবার মনে করিয়ে দিলো, অবিনাশকে বইয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে। বিকেলে ফিরে রুকু জানালো, অবিনাশ বএলছে, ওর কাছে বই নেই। লস্ট প্রপার্টির জন্য এখন আর একদিন অপেক্ষা।
লস্ট প্রপার্টিতেও বই পাওয়া গেলো না। পিউ এবার একটু চিন্তিত। বই জেরক্স কেউ কি আদৌ করতে দেবে? অবিনাশের মাকেই কি বলবে? দ্বিধা করতে থাকে। স্কুলে আর তো কেউ নেই। এই বছর সেকশন চেঞ্জ হয়ে যাওয়ায় কারুর ফোন নম্বর নেই পিউয়ের কাছে। একবার কি তাহলে কাল স্কুলের পর হিন্দি মিসের সাথে দেখা করবে? নতুন বই নিয়ে গেলে যদি একটু হেল্প করে দেন? সেই আশা অবশ্য কম। এইসব টিচাররা যে যার প্রাইভেট টিউশানি করতে এতই ব্যস্ত। প্রাইভেট স্কুলের হাইফাই ব্যাপার। পিউ কিছুতেই মেলাতে পারে না এইসব, নিজের শৈশবের সাথে। ওরাও তো ভালো স্কুলে পড়েছে, মাঝেসাঝে কামাইও হয়েছে। সব সময় তো বন্ধুরা সাহায্য করেছে। পিউয়ের মনে পড়ে, ওর যখন ক্লাস সেভেন, সেবার সেকেন্ড টার্মের ঠিক আগে ওর সে কী টায়ফয়েড। স্কুলের মিস, ক্লাসের বন্ধুরা সব্বাই মিলে ওকে নোটস বানিয়ে দিত। আর এখন কে জানে এত কম্পিটিশন কেন।
রুকুর স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে পিউ। রুকুর ডায়েরিতে ও লিখে দিয়েছিল, হিন্দি মিসের সাথে দেখা করার কথা। যদি উনি হ্যাঁ বলেন, তাহলে দেখা করবে। রুকু বেরিয়েই এক গাল হাসি হেসে মাকে বলল, "মা, আর মিসের সাথে দেখা করতে হবে না। হিন্দি বইটা আমি পেয়ে গিয়েছি।"
পিউ খানিক অবাক হয়েই বলল, "তাই? বাহ। ভালো তো। তা পেলি কোথায়?"
রুকু হেসে বলল, "অবিনাশের কাছেই ছিল। ওর ব্যাগের ভিতর। ও বলল, এই কদিন নাকি ও খেয়াল করেনি। আমি বলেছিলাম না মা? ওর ব্যাগেই নিশ্চয়ই চলে গিয়েছে। আমি হারাইনি?"
পিউ আর কিছু বলেনা। রুকুর হাত ধরে রাস্তা পার হয়। উল্টো দিকে অটোর লম্বা লাইন। তাড়াতাড়ি না গেলে সেখানেও ভিড় হবে। সর্বত্র কম্পিটিশন, র্যাট রেস। ভাল্লাগেনা।
বাড়ি ফিরে রুকুকে পড়তে বসিয়ে কী জানি কী মনে হতে পিউ হিন্দি বইটা খোলে। উলটে পালটে দেখতে গিয়ে একটা ছোট্ট চিরকুট বেরিয়ে পড়ে। অচেনা হাতের লেখায় কিছু পেজ নম্বর লেখা। আর সাথে লেখা, 'এক কপি'। কৌতূহলবশত ওই পাতাগুলোতে যায় পিউ। গত টার্মের সিলেবাসের কঠিনতম চ্যাপ্টারগুলি। কত কাঠখড় পুড়িয়ে যা সল্ভ করেছিল পিউ। সেইগুলিই জেরক্স হয়েছে। হঠাৎ করেই পুরো ঘটনাটা বুঝতে পারে পিউ। শিউরে ওঠে। এই র্যাট রেসে এমনভাবে ছেলে মেয়েগুলোও নেমে পড়লো? কী দিনকাল। কীসব পেরেন্টিং...
Sunday, December 8, 2019
মডার্ন পেরেন্টিং (১)
অফিসে সাঙ্ঘাতিক কাজের চাপ। লাঞ্চ পর্যন্ত করার সুযোগ পায়নি গার্গী। এরই মধ্যে হঠাৎ মোবাইলে ফোন এলো। বুবুলের স্কুলের নম্বরটা স্ক্রিনে ভেসে উঠতে একটু অবাক হলো বটে। কী হলো, কী কান্ড ঘটালো? রেজাল্ট খারাপ নাকি? পেরেন্টস কল? একটু ইতস্তত করেই ফোনটা ধরলো।
- হ্যালো?
- মিসেস চক্রবর্তী বলছেন?
- হ্যাঁ। বলুন।
- মিসেস চক্রবর্তী, আমি অর্কর ক্লাস টিচার, হেমশীলা।
- হ্যাঁ বলুন ম্যাম।
- মিসেস চক্রবর্তী আপনাকে এখন একটু স্কুলে আসতে হবে।
- এক্ষুণি? কেন? সামথিং আর্জেন্ট?
- এখুনি আসতেই হবে।
- আচ্ছা। ঠিক আছে। দেখছি।
- দেখছি না। আসুন। আমরা অপেক্ষা করে আছি।
- ওকে।
গেলো আজ কাজের বারোটা বেজে। গার্গী কম্পিউটারে খোলা ডকুমেন্টস সেভ করে ব্যাগ আর গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে বেরোয়। বেরোনোর আগে পাশের কিউবিকলের মিসেস ঘোষকে বলে গেল। "দেখি, শমন এলো কেন। যাই।"
স্কুলে পৌঁছে গার্গী হেমশীলাকে ফোন করলো। প্রিন্সিপালের ঘরে ওর ডাক পড়লো। উফ। ওই ঘরটা মোটেই ভালো লাগে না গার্গীর। কেমন ঠান্ডা, স্যাঁতস্যাঁতে পুরোনো আদ্যিকালের ঘর। আর তেমনি আদ্যিকালের চিন্তাধারা প্রিন্সিপালের। আগে একবার এসে ভালো মতো মতানৈক্য হয়েছিল। স্কুলের টিফিন আইটেম মেনু নিয়ে। নাকি নন ভেজ কিচ্ছু আনা যাবে না। ম্যাগি নেওয়া যাবে না। গার্গী ভাবতেই পারে না এসব। ওরা ছোট থেকে বড় হয়ে গেল ম্যাগি স্যান্ডউইচ খেয়ে। আর এদের নাকি এইসব নিয়ম। নেহাৎ সেইবার সাথে শুভ্র ছিল। তাই মাথা গরম করলেও বাড়াবাড়ি হয়নি। আজ কে জানে কপালে কী আছে। শুভ্রও আজ কলকাতায় নেই। শান্ত হও গার্গী, শান্ত হও। নিজেকে বারবার বলতে থাকে গার্গী।
হন্তদন্ত হয়ে প্রিন্সিপালের ঘরে ঢুকে পড়ে গার্গী। গুড আফটারনুন উইশ করে চেয়ার টেনে বসে। প্রিন্সিপাল ঠিক যেন ওই এনিড ব্লাইটনের গল্পের স্ট্রিক্ট দিদিমণি। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, "মিসেস চক্রবর্তী, আপনার ছেলে আজ সাংঘাতিক কান্ড ঘটিয়েছে। ওর ক্লাসমেট সৌকর্যকে প্রচন্ড মারধর করেছে। উই হ্যাড টু ইন্টার্ভিন।" গার্গী চমকে ওঠে। অর্ক শান্ত ছেলে। ও তো সহজে এরকম করার পাত্র না। তা হলে? কী হলো? ও হেমশীলার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, "ম্যাম, অর্ক কোথায়? ও ঠিক আছে? ওর সাথে কথা বলতে চাই।" হেমশীলা কিছু বলার আগেই প্রিন্সিপাল মাঝখান থেকে বলে দেন, "ইয়েস, অর্ক ইজ ফাইন। ওর সাথে দেখা করবেন। কিন্তু উই মাস্ট ওয়ার্ন ইউ। ইউ হ্যাভ টু টক টু ইয়োর চাইল্ড। সি দ্যাট হি ইজ নট রিপইটিং সাচ এ বিহেভিয়ার।"
গার্গী মাথা নাড়ে। নীচুস্বরে বলে, "সে তো ঠিক আছে। কিন্তু কারণটা কী, জানেন কিছু আপনারা?"
হেমশীলাকে আবারও কিছু বলতে না দিয়ে প্রিন্সিপাল উত্তর দেন, "দেখুন মিসেস চক্রবর্তী, ক্লাস সিক্স সেভেনের বাচ্চাদের আবার কারণ তেমন সিরিয়াস কিছু হয় নাকি। মাস্ট বি সামথিং পেটি। ইউ প্লিজ হ্যান্ডল ইট। এন্ড প্লিজ টেক দিস ওয়ার্নিং সিরিয়াসলি।" গার্গী হ্যাঁ তে মাথা নেড়ে উঠে পড়ে। হেমশীলা ইতিমিধ্যে বাইরে বুবুলকে নিয়ে দাঁড়িয়ে। বুবুলের চোখে মুখে ভয়। একেই প্রিন্সিপাল টিচারের কাছে বকুনি খেয়েছে। তার উপর পেরেন্টস কল। চুপচাপ, একটা কথাও না বলে ও মায়ের হাত ধরে বেরিয়ে গাড়িতে বসে। গার্গীও কোনো কথা বলে না। পার্কিং লট থেকে গাড়ি বের করে সোজা চলে যায় কাছের শপিং মলে। লাঞ্চ হয়নি এখনো।বুবুলেরও মন ভালো নেই। তাই ফুড কোর্টে গিয়ে বুবুলের পছন্দের চিকেন স্যান্ডউইচ মিল্ক শেক আর নিজের জন্য নুডলস অর্ডার করে বসলো। যতক্ষণ না খাবার আসে, গার্গী বুবুলকে এই নিয়ে একটাও কথা বলেনি। বরং স্কুলের হোমওয়ার্ক আসন্ন পরীক্ষার সিলেবাস, এইসব নিয়েই আলোচনা করলো। এতে হলো কী, বুবুল অনেকটাই শান্ত ও নিশ্চিন্ত হলো। ইতিমধ্যে খাবারের ডাক এসে পড়েছে। গার্গী দুই হাতে দুটো ট্রেতে দুজনের খাবার নিয়ে এসে বসলো।খাবারগুলো এত সুন্দর সাজিয়ে সার্ভ করে, ছবি না তুললেই নয়। ছেলের সাথে খাবারের সাথে সেলফি তুললো ও। সোশ্যাল মিডিয়াতে দেবে।
এইবার ও বুবুলের দিকে তাকিয়ে নরমভাবে জিজ্ঞেস করলো, "হ্যাঁ রে, কী হয়েছিল আজ স্কুলে?"
বুবুল একটু আমতা আমতা করে বললো, "মাম, বিলিভ মি। আমি কিন্তু আগে মারতে চাইনি।"
- কন্টিনিউ।
- সৌকর্য আমায় প্রভোক করে।
- কীভাবে?
- ও আমার ওয়াটার বোতল নিয়ে ফেলে দেয়।
- কেন? হঠাৎ?
- এর আগে ওর সাথে আমার ডোরেমন নিয়ে একটু তর্ক হচ্ছিল। তাই রাগ করে ও আমার বোতলটা নিয়ে ফেলে দেয়।
- তারপর?
- আমি ওকে বললাম, এরকম কেন করলি?
- ও কী বললো?
- ও কিছু বলেনি। জাস্ট হাসলো।
- দেন?
- দেন আই আসকড হিম। বাড়িতে আমি কী বলবো? এরকম ভেঙে গেল যে.. ও বলে সে আমি জানি না।
- আর অমনি তুমি মারলে?
- না না।
-তাহলে?
- আমি ওকে বললাম আমি কিন্তু আন্টিকে বলে দেব।
- বলেছো?
- পরে। তো ও তাতে বললো যে ওসব বলে লাভ নেই। তুই একটা বোতল কিনে নিস। কত টাকা দাম, বলে দিস। টাকাটা দিয়ে দেব।
- বাবাঃ। এত বুকনি!
- ওকে তখন বললাম, এটা মিল্টনের ছিল। অনেক দাম। কোথায় টাকা পাবি?
- ও তখন বললো, পকেট মানি পাই। তোর মত নাকি, পুওর নই।
- বললো, আর অমনি তুমি রেগে গিয়ে মাথা গরম করলে?
- করবো না? এরকম কেন বলবে? আগে তো আমার বোতল ভাঙলো। তারপর পুওর বললো।
- ও পুওর বলায় তোমার কী আসে যায় বুবুল?
- না। কেন বলবে?
- তোমার কি কখনো ফিজ দিতে লেট হয়েছে? স্কুলে টিউশন ক্লাসে যখন যা লেগেছে, পাওনি?
- হ্যাঁ।
- বন্ধুদের জন্মদিনে গিফ্টস দাওনি?
-হুম।
- তোমার বার্থডে সেলিব্রেট হয় না? যখন যা প্রয়োজন, পাওনি?
-হ্যাঁ।
- তাহলে? ও পুওর বললো আর তোমার গায়ে লেগে গেলো?
-হুম।
- নট রাইট। তোমায় যখন তখন যে ইচ্ছে এসে প্রভোক করলেই তুমি যদি এরকম react করো, তাহলে তো স্কুলে টিকতে পারবে না।
- কিন্তু তুমিই তো বলেছো, টু ফাইট বুলিজ।
- এগ্রিড। কিন্তু, ইউ মাস্ট চুজ ইয়োর এনিমিস রাইট। এই যে সৌকর্যর সাথে ফাইট করলে, এতে ও কি শাস্তি পেলো? পেলো না। বাট তুমি বকুনি খেলে। পেরেন্টস কল হলো। তোমার বদনাম হলো।
- তাহলে কী করতাম?
- নেক্সট টাইম এরকম হলে আগে ক্লাসটিচার কে বলবে। দেখো উনি কী বলেন, করেন। আমায়ও বাড়ি এসে বলবে। তারপর আমরা দেখবো।
-হুম।
- যতক্ষণ না তোমায় কেউ ফিজিকালি এটাক করছে, তুমি কোনো মারপিট করবে না। ক্লিয়ার?
-হ্যাঁ।
- আর যেন এর রিপিটেশন না হয়। বুঝেছো?
-বুঝেছি। সরি মা।
-ইট ইজ ওকে। উই লার্ন ফ্রম মিসটেকস। কি
- শিখলাম।
- যাক গে। যা হয়ে গেছে, গেছে। বল, এরপর কী খাবি? Let us have an icecream to raise a toast to our learning today...
- ইয়ে!!!
গার্গী আর বুবুল এগোলো ওদের প্রিয় আইসক্রিম পার্লারের দিকে। গার্গী মনে মনে ভাবে, সত্যিই, কত বদলে গিয়েছে পেরেন্টিং। কত পাল্টেছে মা বাবা ও সন্তানের সমীকরণ।
- হ্যালো?
- মিসেস চক্রবর্তী বলছেন?
- হ্যাঁ। বলুন।
- মিসেস চক্রবর্তী, আমি অর্কর ক্লাস টিচার, হেমশীলা।
- হ্যাঁ বলুন ম্যাম।
- মিসেস চক্রবর্তী আপনাকে এখন একটু স্কুলে আসতে হবে।
- এক্ষুণি? কেন? সামথিং আর্জেন্ট?
- এখুনি আসতেই হবে।
- আচ্ছা। ঠিক আছে। দেখছি।
- দেখছি না। আসুন। আমরা অপেক্ষা করে আছি।
- ওকে।
গেলো আজ কাজের বারোটা বেজে। গার্গী কম্পিউটারে খোলা ডকুমেন্টস সেভ করে ব্যাগ আর গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে বেরোয়। বেরোনোর আগে পাশের কিউবিকলের মিসেস ঘোষকে বলে গেল। "দেখি, শমন এলো কেন। যাই।"
স্কুলে পৌঁছে গার্গী হেমশীলাকে ফোন করলো। প্রিন্সিপালের ঘরে ওর ডাক পড়লো। উফ। ওই ঘরটা মোটেই ভালো লাগে না গার্গীর। কেমন ঠান্ডা, স্যাঁতস্যাঁতে পুরোনো আদ্যিকালের ঘর। আর তেমনি আদ্যিকালের চিন্তাধারা প্রিন্সিপালের। আগে একবার এসে ভালো মতো মতানৈক্য হয়েছিল। স্কুলের টিফিন আইটেম মেনু নিয়ে। নাকি নন ভেজ কিচ্ছু আনা যাবে না। ম্যাগি নেওয়া যাবে না। গার্গী ভাবতেই পারে না এসব। ওরা ছোট থেকে বড় হয়ে গেল ম্যাগি স্যান্ডউইচ খেয়ে। আর এদের নাকি এইসব নিয়ম। নেহাৎ সেইবার সাথে শুভ্র ছিল। তাই মাথা গরম করলেও বাড়াবাড়ি হয়নি। আজ কে জানে কপালে কী আছে। শুভ্রও আজ কলকাতায় নেই। শান্ত হও গার্গী, শান্ত হও। নিজেকে বারবার বলতে থাকে গার্গী।
হন্তদন্ত হয়ে প্রিন্সিপালের ঘরে ঢুকে পড়ে গার্গী। গুড আফটারনুন উইশ করে চেয়ার টেনে বসে। প্রিন্সিপাল ঠিক যেন ওই এনিড ব্লাইটনের গল্পের স্ট্রিক্ট দিদিমণি। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, "মিসেস চক্রবর্তী, আপনার ছেলে আজ সাংঘাতিক কান্ড ঘটিয়েছে। ওর ক্লাসমেট সৌকর্যকে প্রচন্ড মারধর করেছে। উই হ্যাড টু ইন্টার্ভিন।" গার্গী চমকে ওঠে। অর্ক শান্ত ছেলে। ও তো সহজে এরকম করার পাত্র না। তা হলে? কী হলো? ও হেমশীলার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, "ম্যাম, অর্ক কোথায়? ও ঠিক আছে? ওর সাথে কথা বলতে চাই।" হেমশীলা কিছু বলার আগেই প্রিন্সিপাল মাঝখান থেকে বলে দেন, "ইয়েস, অর্ক ইজ ফাইন। ওর সাথে দেখা করবেন। কিন্তু উই মাস্ট ওয়ার্ন ইউ। ইউ হ্যাভ টু টক টু ইয়োর চাইল্ড। সি দ্যাট হি ইজ নট রিপইটিং সাচ এ বিহেভিয়ার।"
গার্গী মাথা নাড়ে। নীচুস্বরে বলে, "সে তো ঠিক আছে। কিন্তু কারণটা কী, জানেন কিছু আপনারা?"
হেমশীলাকে আবারও কিছু বলতে না দিয়ে প্রিন্সিপাল উত্তর দেন, "দেখুন মিসেস চক্রবর্তী, ক্লাস সিক্স সেভেনের বাচ্চাদের আবার কারণ তেমন সিরিয়াস কিছু হয় নাকি। মাস্ট বি সামথিং পেটি। ইউ প্লিজ হ্যান্ডল ইট। এন্ড প্লিজ টেক দিস ওয়ার্নিং সিরিয়াসলি।" গার্গী হ্যাঁ তে মাথা নেড়ে উঠে পড়ে। হেমশীলা ইতিমিধ্যে বাইরে বুবুলকে নিয়ে দাঁড়িয়ে। বুবুলের চোখে মুখে ভয়। একেই প্রিন্সিপাল টিচারের কাছে বকুনি খেয়েছে। তার উপর পেরেন্টস কল। চুপচাপ, একটা কথাও না বলে ও মায়ের হাত ধরে বেরিয়ে গাড়িতে বসে। গার্গীও কোনো কথা বলে না। পার্কিং লট থেকে গাড়ি বের করে সোজা চলে যায় কাছের শপিং মলে। লাঞ্চ হয়নি এখনো।বুবুলেরও মন ভালো নেই। তাই ফুড কোর্টে গিয়ে বুবুলের পছন্দের চিকেন স্যান্ডউইচ মিল্ক শেক আর নিজের জন্য নুডলস অর্ডার করে বসলো। যতক্ষণ না খাবার আসে, গার্গী বুবুলকে এই নিয়ে একটাও কথা বলেনি। বরং স্কুলের হোমওয়ার্ক আসন্ন পরীক্ষার সিলেবাস, এইসব নিয়েই আলোচনা করলো। এতে হলো কী, বুবুল অনেকটাই শান্ত ও নিশ্চিন্ত হলো। ইতিমধ্যে খাবারের ডাক এসে পড়েছে। গার্গী দুই হাতে দুটো ট্রেতে দুজনের খাবার নিয়ে এসে বসলো।খাবারগুলো এত সুন্দর সাজিয়ে সার্ভ করে, ছবি না তুললেই নয়। ছেলের সাথে খাবারের সাথে সেলফি তুললো ও। সোশ্যাল মিডিয়াতে দেবে।
এইবার ও বুবুলের দিকে তাকিয়ে নরমভাবে জিজ্ঞেস করলো, "হ্যাঁ রে, কী হয়েছিল আজ স্কুলে?"
বুবুল একটু আমতা আমতা করে বললো, "মাম, বিলিভ মি। আমি কিন্তু আগে মারতে চাইনি।"
- কন্টিনিউ।
- সৌকর্য আমায় প্রভোক করে।
- কীভাবে?
- ও আমার ওয়াটার বোতল নিয়ে ফেলে দেয়।
- কেন? হঠাৎ?
- এর আগে ওর সাথে আমার ডোরেমন নিয়ে একটু তর্ক হচ্ছিল। তাই রাগ করে ও আমার বোতলটা নিয়ে ফেলে দেয়।
- তারপর?
- আমি ওকে বললাম, এরকম কেন করলি?
- ও কী বললো?
- ও কিছু বলেনি। জাস্ট হাসলো।
- দেন?
- দেন আই আসকড হিম। বাড়িতে আমি কী বলবো? এরকম ভেঙে গেল যে.. ও বলে সে আমি জানি না।
- আর অমনি তুমি মারলে?
- না না।
-তাহলে?
- আমি ওকে বললাম আমি কিন্তু আন্টিকে বলে দেব।
- বলেছো?
- পরে। তো ও তাতে বললো যে ওসব বলে লাভ নেই। তুই একটা বোতল কিনে নিস। কত টাকা দাম, বলে দিস। টাকাটা দিয়ে দেব।
- বাবাঃ। এত বুকনি!
- ওকে তখন বললাম, এটা মিল্টনের ছিল। অনেক দাম। কোথায় টাকা পাবি?
- ও তখন বললো, পকেট মানি পাই। তোর মত নাকি, পুওর নই।
- বললো, আর অমনি তুমি রেগে গিয়ে মাথা গরম করলে?
- করবো না? এরকম কেন বলবে? আগে তো আমার বোতল ভাঙলো। তারপর পুওর বললো।
- ও পুওর বলায় তোমার কী আসে যায় বুবুল?
- না। কেন বলবে?
- তোমার কি কখনো ফিজ দিতে লেট হয়েছে? স্কুলে টিউশন ক্লাসে যখন যা লেগেছে, পাওনি?
- হ্যাঁ।
- বন্ধুদের জন্মদিনে গিফ্টস দাওনি?
-হুম।
- তোমার বার্থডে সেলিব্রেট হয় না? যখন যা প্রয়োজন, পাওনি?
-হ্যাঁ।
- তাহলে? ও পুওর বললো আর তোমার গায়ে লেগে গেলো?
-হুম।
- নট রাইট। তোমায় যখন তখন যে ইচ্ছে এসে প্রভোক করলেই তুমি যদি এরকম react করো, তাহলে তো স্কুলে টিকতে পারবে না।
- কিন্তু তুমিই তো বলেছো, টু ফাইট বুলিজ।
- এগ্রিড। কিন্তু, ইউ মাস্ট চুজ ইয়োর এনিমিস রাইট। এই যে সৌকর্যর সাথে ফাইট করলে, এতে ও কি শাস্তি পেলো? পেলো না। বাট তুমি বকুনি খেলে। পেরেন্টস কল হলো। তোমার বদনাম হলো।
- তাহলে কী করতাম?
- নেক্সট টাইম এরকম হলে আগে ক্লাসটিচার কে বলবে। দেখো উনি কী বলেন, করেন। আমায়ও বাড়ি এসে বলবে। তারপর আমরা দেখবো।
-হুম।
- যতক্ষণ না তোমায় কেউ ফিজিকালি এটাক করছে, তুমি কোনো মারপিট করবে না। ক্লিয়ার?
-হ্যাঁ।
- আর যেন এর রিপিটেশন না হয়। বুঝেছো?
-বুঝেছি। সরি মা।
-ইট ইজ ওকে। উই লার্ন ফ্রম মিসটেকস। কি
- শিখলাম।
- যাক গে। যা হয়ে গেছে, গেছে। বল, এরপর কী খাবি? Let us have an icecream to raise a toast to our learning today...
- ইয়ে!!!
গার্গী আর বুবুল এগোলো ওদের প্রিয় আইসক্রিম পার্লারের দিকে। গার্গী মনে মনে ভাবে, সত্যিই, কত বদলে গিয়েছে পেরেন্টিং। কত পাল্টেছে মা বাবা ও সন্তানের সমীকরণ।
Friday, December 6, 2019
সূর্যাস্ত
(১)
"বিকেলের এই পড়ন্ত সূর্যের আলোটা কী মায়াবী, তাই না?" আলতো করে আমার কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে বলতো সুর্মা। আমি প্রাণভরে ওই স্পর্শের ওমটুকু শুষে নিতাম। আর ছোট্ট করে মাথা নেড়ে বলতাম, "হুম।" লেকের ধারে বসে সূর্যাস্ত দেখা ছিল আমাদের একটা নেশার মতো। সময় পেলেই দুজনে ছুটে আসতাম। সুর্মা ভালোবাসতো সূর্যাস্ত, আর আমি ওকে।
(২)
আজ আবারও আমি এসে বসেছি লেকের ধারের সাদা বেঞ্চে। জলের ওপর অস্তমিত সূর্যের রক্তছটা। প্রকৃতির এক মায়াবিনী ক্যানভাস। দু চোখ মেলে দেখছি এই দৃশ্য। কাল ফিরে গিয়ে সুর্মাকে বলবো। ঠিক যেমন রোজ ওর পাশে বসে ওকে নানান গল্প বলি, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে। সুর্মা দুচোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। নাকে মুখে হাতে গুচ্ছ গুচ্ছ নল। বেডের পাশে রাখা গুচ্ছ গুচ্ছ মনিটর, ওর নিস্তেজ শরীরটার ভাইটাল প্যারামিটার্স মেপে চলেছে প্রতিনিয়ত, বিগত এক বছর ধরে। এক বছর, সেই অভিশপ্ত রাতের এক বছর হয়ে গেল।
(৩)
"সুর্মা, যেয়ো না। আমি একা হয়ে যাবো।" আমি প্রবলভাবে আকুতি জানিয়েছিলাম। সুর্মা ওর সহকর্মীদের সাথে উইকেন্ডে মন্দারমনি যাবে বলেছিল। ওর তেমন ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু অফিসের ট্রিপ। সেরকম জোর করে না বলতে পারেনি। সারা রাস্তা আমরা হোয়াটসআপে মেসেজে গল্প করে কাটিয়েছি। কখনো ভয়েস নোটও। ওর থেকে পাওয়া আমার শেষ ভয়েস নোটে ও বলেছিল, "এই তো। আমি তো রইলাম। ফোনে আছিই। পাশে আছি। সব সময়।" সহকর্মীরা টি ব্রেকে হাইওয়ের ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যখন চা খাচ্ছে, সুর্মা আমায় ফোন করছে। আমি ওকে সেদিনের সূর্যাস্তের ছবির বর্ণনা দিচ্ছি। কেমন করে জলাভূমির ওপর লালচে আভা পড়ে সবকিছু সুন্দর করে দিয়েছিল। এক ঝাঁক কাক দিনের শেষে ডানা ঝাপটে ফিরে চলেছিল, বাড়ির দিকে।
আর তখনই, ঠিক তখনই পিছন থেকে আসা একটি ট্রাক, ব্রেক ফেল করে ধাক্কা মারলো সুর্মাদের গাড়িতে। চোখের নিমেষে দুমড়ে মুচড়ে সব শেষ। সূর্যাস্তের রক্তিম আভাকে সরিয়ে মঞ্চ দখল করলো ওর বি পিজিটিভ রক্ত।
(৪)
সুর্মার কঠিন অপারেশন হলো। আমি ওটির বাইরে চুপ করে অপেক্ষা করে রইলাম। একবার বসছি, একবার হাঁটছি। শান্তি স্বস্তি কিচ্ছু পাই না। ডাক্তার এলেন। বললেন অপারেশন সাকসেসফুল। এবার শুধু অপেক্ষা। কতক্ষণে ওর জ্ঞান ফেরে।
(৫)
অপেক্ষা এখনো করছি। এক বছর ধরে। প্রতিদিন নিয়ম করে হাসপাতালে যখন যাই, সুর্মার বন্ধ দুই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। এই বুঝি পাতা কেঁপে উঠলো। এই বুঝি ওর নরম ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে কোনো শব্দ এলো। আমার হাত দিয়ে ওর কপালের ওপর পড়া নরম কালো চুলের গোছা সরিয়ে দিই। ওর সাথে কথা বলি। সব কিছু জানাই ওকে। অফিসের সমস্যা, বাড়ির হাল, নতুন কোনো সিনেমা, দু কলি গান। কিচ্ছু না, কিচ্ছু বাদ যায় না।
ডাক্তাররা আশা ছেড়েই দিয়েছেন। বলেছেন, সুর্মা নাকি প্র্যাকটিক্যালি মৃত। শুধুমাত্র লাইফ সাপোর্টেই ওর নিশ্বাস পড়ছে। আমায় ওঁরা নিয়মিত বোঝান। আর কদিন? আর কতদিন এরকমভাবে চলবে। ওকে তো এবার ছাড়তেই হবে।
আমি ব্যাংক যাই। জমানো পুঁজি নিঃশেষ করে দেওয়ার সংকল্প করি। সুর্মাকে লাইফ সাপোর্ট থেকে সরানো যাবে না। কে বললো ও আর নেই? একদিন হঠাৎ করে সন্ধ্যেবেলা সূর্যাস্তের কথা শুনে ওর নরম আঙ্গুল দিয়ে আমার হাতের আঙ্গুল জড়িয়ে ফেলতেও তো পারে? তখন? সেই আক্ষেপ কি আমার হবে না?
(৬)
"জানো সুর্মা, আজ আকাশ বড়ই মেঘলা। সারাদিন তোমার সূর্যের দেখা প্রায় মেলেনি। তবুও আমি আজ গিয়েছিলাম। লেকের ধারে। বসেছিলাম। অপেক্ষায়। তোমার সূর্য কথা রেখেছে। ঠিক সূর্যাস্তের আগে একবার মুখ দেখিয়েছে। আর তারপর... তারপর? তারপর ম্যাজিক। কালো মেঘের ঘনঘটাকে তুচ্ছ করে মুহূর্তে লাল হয়েছে পশ্চিম আকাশ। সে এক অপূর্ব দৃশ্য সুর্মা। দাঁড়াও, ছবি দেখাই তোমায়।"
"বিকেলের এই পড়ন্ত সূর্যের আলোটা কী মায়াবী, না?" এই বলে সুর্মা আমার কাঁধে মাথা ঠেকালো। আমি পরম মমতায় ওর চুলে বিলি কাটতে লাগলাম। সুর্মা বললো, "এবার আমি আসি? অনেকদিন তো হলো। এইবারে আমায় যেতে দাও? প্লিজ? মুক্ত হয়ে উড়তে দাও। ওই সূর্যের কাছে আমি যাবো। ডানা মেলে উড়ে যাবো দূরে, আরো দূরে। এবার আসি?"
আমি কিছু বলতে পারি না। বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকি ওর মুখের দিকে। ওর ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে। আমি দু হাতে ওর মুখ চেপে ধরি। আলতো করে চুম্বন এঁকে দিই ওর কপালে, গালে, ঠোঁটে। ওর দু গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। আমার আলিঙ্গন ছাড়িয়ে ও এগিয়ে চলে। হাঁটতে থাকে ধীর পায়ে। সুদূর দিগন্তের দিকে। এক ঝাঁক পাখি উড়তে থাকে। বাসার দিকে।
(৭)
ফোনের শব্দে ধড়ফড় করে উঠি। বাজতে বাজতে থেমে যায় ফোন। হাতে নিয়ে দেখলাম, হাসপাতাল। জানি ওরা কেন ফোন করেছে। আমি ফোনটা সরিয়ে রাখি বিছানায়। জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখি। কখন কে জানে চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছিল। এখন বেলা পড়ে এসেছে। পশ্চিমের আকাশে লালচে আভা। পাখিরা করছে কূজন। ফিরছে ঘরের পানে। এই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এই সেই অপূর্ব দৃশ্য। আমি আলতো আবছা কণ্ঠে বলি, "বিকেলের এই পড়ন্ত সূর্যের আলোটা কী মায়াবী, তাই না? সুর্মা, ভালো থেকো। দেখা হবে কখনো, কোনোখানে... শিগগিরই।"
"বিকেলের এই পড়ন্ত সূর্যের আলোটা কী মায়াবী, তাই না?" আলতো করে আমার কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে বলতো সুর্মা। আমি প্রাণভরে ওই স্পর্শের ওমটুকু শুষে নিতাম। আর ছোট্ট করে মাথা নেড়ে বলতাম, "হুম।" লেকের ধারে বসে সূর্যাস্ত দেখা ছিল আমাদের একটা নেশার মতো। সময় পেলেই দুজনে ছুটে আসতাম। সুর্মা ভালোবাসতো সূর্যাস্ত, আর আমি ওকে।
(২)
আজ আবারও আমি এসে বসেছি লেকের ধারের সাদা বেঞ্চে। জলের ওপর অস্তমিত সূর্যের রক্তছটা। প্রকৃতির এক মায়াবিনী ক্যানভাস। দু চোখ মেলে দেখছি এই দৃশ্য। কাল ফিরে গিয়ে সুর্মাকে বলবো। ঠিক যেমন রোজ ওর পাশে বসে ওকে নানান গল্প বলি, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে। সুর্মা দুচোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। নাকে মুখে হাতে গুচ্ছ গুচ্ছ নল। বেডের পাশে রাখা গুচ্ছ গুচ্ছ মনিটর, ওর নিস্তেজ শরীরটার ভাইটাল প্যারামিটার্স মেপে চলেছে প্রতিনিয়ত, বিগত এক বছর ধরে। এক বছর, সেই অভিশপ্ত রাতের এক বছর হয়ে গেল।
(৩)
"সুর্মা, যেয়ো না। আমি একা হয়ে যাবো।" আমি প্রবলভাবে আকুতি জানিয়েছিলাম। সুর্মা ওর সহকর্মীদের সাথে উইকেন্ডে মন্দারমনি যাবে বলেছিল। ওর তেমন ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু অফিসের ট্রিপ। সেরকম জোর করে না বলতে পারেনি। সারা রাস্তা আমরা হোয়াটসআপে মেসেজে গল্প করে কাটিয়েছি। কখনো ভয়েস নোটও। ওর থেকে পাওয়া আমার শেষ ভয়েস নোটে ও বলেছিল, "এই তো। আমি তো রইলাম। ফোনে আছিই। পাশে আছি। সব সময়।" সহকর্মীরা টি ব্রেকে হাইওয়ের ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যখন চা খাচ্ছে, সুর্মা আমায় ফোন করছে। আমি ওকে সেদিনের সূর্যাস্তের ছবির বর্ণনা দিচ্ছি। কেমন করে জলাভূমির ওপর লালচে আভা পড়ে সবকিছু সুন্দর করে দিয়েছিল। এক ঝাঁক কাক দিনের শেষে ডানা ঝাপটে ফিরে চলেছিল, বাড়ির দিকে।
আর তখনই, ঠিক তখনই পিছন থেকে আসা একটি ট্রাক, ব্রেক ফেল করে ধাক্কা মারলো সুর্মাদের গাড়িতে। চোখের নিমেষে দুমড়ে মুচড়ে সব শেষ। সূর্যাস্তের রক্তিম আভাকে সরিয়ে মঞ্চ দখল করলো ওর বি পিজিটিভ রক্ত।
(৪)
সুর্মার কঠিন অপারেশন হলো। আমি ওটির বাইরে চুপ করে অপেক্ষা করে রইলাম। একবার বসছি, একবার হাঁটছি। শান্তি স্বস্তি কিচ্ছু পাই না। ডাক্তার এলেন। বললেন অপারেশন সাকসেসফুল। এবার শুধু অপেক্ষা। কতক্ষণে ওর জ্ঞান ফেরে।
(৫)
অপেক্ষা এখনো করছি। এক বছর ধরে। প্রতিদিন নিয়ম করে হাসপাতালে যখন যাই, সুর্মার বন্ধ দুই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। এই বুঝি পাতা কেঁপে উঠলো। এই বুঝি ওর নরম ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে কোনো শব্দ এলো। আমার হাত দিয়ে ওর কপালের ওপর পড়া নরম কালো চুলের গোছা সরিয়ে দিই। ওর সাথে কথা বলি। সব কিছু জানাই ওকে। অফিসের সমস্যা, বাড়ির হাল, নতুন কোনো সিনেমা, দু কলি গান। কিচ্ছু না, কিচ্ছু বাদ যায় না।
ডাক্তাররা আশা ছেড়েই দিয়েছেন। বলেছেন, সুর্মা নাকি প্র্যাকটিক্যালি মৃত। শুধুমাত্র লাইফ সাপোর্টেই ওর নিশ্বাস পড়ছে। আমায় ওঁরা নিয়মিত বোঝান। আর কদিন? আর কতদিন এরকমভাবে চলবে। ওকে তো এবার ছাড়তেই হবে।
আমি ব্যাংক যাই। জমানো পুঁজি নিঃশেষ করে দেওয়ার সংকল্প করি। সুর্মাকে লাইফ সাপোর্ট থেকে সরানো যাবে না। কে বললো ও আর নেই? একদিন হঠাৎ করে সন্ধ্যেবেলা সূর্যাস্তের কথা শুনে ওর নরম আঙ্গুল দিয়ে আমার হাতের আঙ্গুল জড়িয়ে ফেলতেও তো পারে? তখন? সেই আক্ষেপ কি আমার হবে না?
(৬)
"জানো সুর্মা, আজ আকাশ বড়ই মেঘলা। সারাদিন তোমার সূর্যের দেখা প্রায় মেলেনি। তবুও আমি আজ গিয়েছিলাম। লেকের ধারে। বসেছিলাম। অপেক্ষায়। তোমার সূর্য কথা রেখেছে। ঠিক সূর্যাস্তের আগে একবার মুখ দেখিয়েছে। আর তারপর... তারপর? তারপর ম্যাজিক। কালো মেঘের ঘনঘটাকে তুচ্ছ করে মুহূর্তে লাল হয়েছে পশ্চিম আকাশ। সে এক অপূর্ব দৃশ্য সুর্মা। দাঁড়াও, ছবি দেখাই তোমায়।"
"বিকেলের এই পড়ন্ত সূর্যের আলোটা কী মায়াবী, না?" এই বলে সুর্মা আমার কাঁধে মাথা ঠেকালো। আমি পরম মমতায় ওর চুলে বিলি কাটতে লাগলাম। সুর্মা বললো, "এবার আমি আসি? অনেকদিন তো হলো। এইবারে আমায় যেতে দাও? প্লিজ? মুক্ত হয়ে উড়তে দাও। ওই সূর্যের কাছে আমি যাবো। ডানা মেলে উড়ে যাবো দূরে, আরো দূরে। এবার আসি?"
আমি কিছু বলতে পারি না। বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকি ওর মুখের দিকে। ওর ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে। আমি দু হাতে ওর মুখ চেপে ধরি। আলতো করে চুম্বন এঁকে দিই ওর কপালে, গালে, ঠোঁটে। ওর দু গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। আমার আলিঙ্গন ছাড়িয়ে ও এগিয়ে চলে। হাঁটতে থাকে ধীর পায়ে। সুদূর দিগন্তের দিকে। এক ঝাঁক পাখি উড়তে থাকে। বাসার দিকে।
(৭)
ফোনের শব্দে ধড়ফড় করে উঠি। বাজতে বাজতে থেমে যায় ফোন। হাতে নিয়ে দেখলাম, হাসপাতাল। জানি ওরা কেন ফোন করেছে। আমি ফোনটা সরিয়ে রাখি বিছানায়। জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখি। কখন কে জানে চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছিল। এখন বেলা পড়ে এসেছে। পশ্চিমের আকাশে লালচে আভা। পাখিরা করছে কূজন। ফিরছে ঘরের পানে। এই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এই সেই অপূর্ব দৃশ্য। আমি আলতো আবছা কণ্ঠে বলি, "বিকেলের এই পড়ন্ত সূর্যের আলোটা কী মায়াবী, তাই না? সুর্মা, ভালো থেকো। দেখা হবে কখনো, কোনোখানে... শিগগিরই।"
Thursday, November 14, 2019
children's day
ছোটবেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করে কি না, এই নিয়ে আজ অনেক জায়গায় অনেক পোস্ট দেখলাম। ভাবতে বসলাম।
ফিরে যেতে পারলে তো হয়তো ভালো হতই। ছোটবেলার ঝুট ঝঞ্ঝাট মানে ওই mental sums, preposition আর আরেকটু বড় হতে টাইম এন্ড ডিস্টেন্স। ও হ্যাঁ, ওই কবিতা মুখস্থ করা। দশ নম্বর থাকতো। তখনও মুখস্থ হতো না। এখনও মনে থাকেনা। ওই গড়গড় করে দাঁড়িয়ে এক নিমেষে আস্ত একটা কবিতা বলা বড্ড বিড়ম্বনার। যে কোনো মুখস্থ করার জিনিসেই আমার এলার্জি। এখনের সমস্যাগুলো তো এগুলিকে বলে বলে দশ বারো গোলে হারাবে। মিনিমাম।
কিন্তু তাও, ছোটবেলায় ফিরে গেলে কি সেই বোধ বুদ্ধিটাও সাথে পাবো যে এই শিশু ঝামেলাগুলোর সাথে মানিয়ে নাও বাপু, এরা বিষাক্ত নখ দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আসে না। এরা ঘ্যাঁগাসুর না। বরং এরা অনেকটাই ঈশপের গল্পের চরিত্রগুলোর মতো। টুকটাক ছোটখাটো শিক্ষা দেবে। আখেরে লাভ হবে।
ছোটবেলায় পেরেন্ট টিচার কল হলেই বুক ঢিপঢিপ। এই রে, আবারও ওই talkative আখ্যা পাওয়া। আর এখন? প্রতিটা প্রেজেন্টেশনের আগে বুক ঢিপঢিপ। আদৌ কথা বলতে পারবো তো?
ছোটবেলায় মা বাবাকে লুকিয়ে নিজেরই পকেট মানি দিয়ে কেনা আমসি খেতে খেতে সমানে সচেতন হওয়া, জামায় যেন না পড়ে। পড়লেই শেষ। কপালে বকুনি। এখন দেখো, যেদিন যখন খুশি zomato থেকে যা ইচ্ছে অর্ডার করো, খাও। খাওয়াও। মা বাবাকে পাঠাও। অনেক স্বাধীনতা। কিন্তু, তাও, এই স্বাধীনতার কি মূল্য দিচ্ছি না? দিচ্ছিই তো। কথায় কথায় এন্টাসিড পুরে দেওয়া... ভালো?
ফিরে যেতে পারলে তো হয়তো ভালো হতই। ছোটবেলার ঝুট ঝঞ্ঝাট মানে ওই mental sums, preposition আর আরেকটু বড় হতে টাইম এন্ড ডিস্টেন্স। ও হ্যাঁ, ওই কবিতা মুখস্থ করা। দশ নম্বর থাকতো। তখনও মুখস্থ হতো না। এখনও মনে থাকেনা। ওই গড়গড় করে দাঁড়িয়ে এক নিমেষে আস্ত একটা কবিতা বলা বড্ড বিড়ম্বনার। যে কোনো মুখস্থ করার জিনিসেই আমার এলার্জি। এখনের সমস্যাগুলো তো এগুলিকে বলে বলে দশ বারো গোলে হারাবে। মিনিমাম।
কিন্তু তাও, ছোটবেলায় ফিরে গেলে কি সেই বোধ বুদ্ধিটাও সাথে পাবো যে এই শিশু ঝামেলাগুলোর সাথে মানিয়ে নাও বাপু, এরা বিষাক্ত নখ দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আসে না। এরা ঘ্যাঁগাসুর না। বরং এরা অনেকটাই ঈশপের গল্পের চরিত্রগুলোর মতো। টুকটাক ছোটখাটো শিক্ষা দেবে। আখেরে লাভ হবে।
ছোটবেলায় পেরেন্ট টিচার কল হলেই বুক ঢিপঢিপ। এই রে, আবারও ওই talkative আখ্যা পাওয়া। আর এখন? প্রতিটা প্রেজেন্টেশনের আগে বুক ঢিপঢিপ। আদৌ কথা বলতে পারবো তো?
ছোটবেলায় মা বাবাকে লুকিয়ে নিজেরই পকেট মানি দিয়ে কেনা আমসি খেতে খেতে সমানে সচেতন হওয়া, জামায় যেন না পড়ে। পড়লেই শেষ। কপালে বকুনি। এখন দেখো, যেদিন যখন খুশি zomato থেকে যা ইচ্ছে অর্ডার করো, খাও। খাওয়াও। মা বাবাকে পাঠাও। অনেক স্বাধীনতা। কিন্তু, তাও, এই স্বাধীনতার কি মূল্য দিচ্ছি না? দিচ্ছিই তো। কথায় কথায় এন্টাসিড পুরে দেওয়া... ভালো?
সব মিলিয়ে বলতে গেলে, ছোটবেলাটা হয়তো একটু বেশিই ভালো ছিলো। কম
কমপ্লিকেটেড। তবুও, বড় হয়েও তো কত সুন্দর (এবং অসুন্দর) অভিজ্ঞতা হচ্ছে।
সার্বিক উন্নতির জন্য তো দরকার। আর বেশিদিন ছোট থাকলে কি সত্যিই ভালো হতো?
উঠতে বসতে এই যে দুষ্টুমির জন্য বকুনি খাওয়া... ভাল্লাগতো নাকি?
উঁহু। তার চেয়ে বাবা এই ভালো। সব মেপে বুঝেই থাক। একটা সুন্দর শৈশব ছিল। আনন্দ করেছি। এখনও তো দিব্যি ভালোই আছি। বেশ একটা কিছু হলো কি না হলো, দুম করে "আহা, ছোটবেলাটা কী ছিল" বলার মতো জায়গাও রইলো। আবার সাথে সাথে স্বাধীনতাও। একবার যে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছি, আর কি ছোটবেলায় ফিরে গেলে সমানে supervised হওয়া পোষাবে নাকি? মোটেই না।
উঁহু। তার চেয়ে বাবা এই ভালো। সব মেপে বুঝেই থাক। একটা সুন্দর শৈশব ছিল। আনন্দ করেছি। এখনও তো দিব্যি ভালোই আছি। বেশ একটা কিছু হলো কি না হলো, দুম করে "আহা, ছোটবেলাটা কী ছিল" বলার মতো জায়গাও রইলো। আবার সাথে সাথে স্বাধীনতাও। একবার যে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছি, আর কি ছোটবেলায় ফিরে গেলে সমানে supervised হওয়া পোষাবে নাকি? মোটেই না।
Wednesday, October 30, 2019
'আ মরি বাংলা ভাষা '
Scene 1
Knock
নিখিল: may I come in Raima di?
রাইমা : নিখিল? আয়! কিন্তু এটাই শেষবার।
নিখিল: মানে?
রাইমা: মানে এরপর থেকে আমার ঘরে ঢুকতে হলে আসবো কিনা জিজ্ঞেস করবি, মে আই কাম ইন বললে আর অনুমতি পাবিনা। বস।
নিখিল: কী? মানে??
রা: কীসের কী?
নি: আই মিন, কলকাতা শহরের ঝাঁ চকচকে প্রাইভেট এফ এম স্টেশনে বসে আমার কেন বলোতো সুবালা দেবী বালিকা বিদ্যালয় ভাইবস আসছে?
রা: সুবালা দেবী বালিকা বিদ্যালয় ভাইবস? মানে কী?
নি: না মানে ওই বাংলা বাঁচাও টাইপ।
রা: প্রাইভেট এফ এম বলে কি ভাষার প্রতি একটা দায়িত্ব থাকে না নাকি?
নি: সে থাকে। বাট, তুমি এত সকাল সকাল রেগে কেন? পুরো বেগুন ইন অয়েল সিনড্রোম। কে ডুব দিলো, ছায়াদি? না বর চললো মায়ামি?
রা: চুপ কর নিখিল। খালি ফাজলামি, না?
নি: এই সরি সরি। বলো বলো। সিরিয়াস হয়ে শুনছি। কেসটা কী, বলো।
রাইমা: কেসটা শর্টে হলো, এই স্টেশনে টিকতে হলে তোকে বাঙলাতেই কথা বলতে হবে।
নিখিল : বাংলা??
রাইমা : কেন? মাতৃভাষা নয়? নাকি বাংলা টাংলা আসেনা?
নিক: ইয়ে মানে বাংলাই তো বলি।
রাইমা : না, বলছিস না। কি একটা জগাখিচুড়ী ভাষা আমদানি করেছিস তোরা কে জানে! পরিষ্কার ঝরঝরে বাংলায় কথা না বলতে পারলে আর আর জে গিরি করতে হবেনা।
নিক : কিন্তু রাইমাদি the last time I checked আমার শোটার ফিডব্যাক তো বেশ ভালই ছিল।
রা: আর ফেসবুক ইউটিউবের কমেন্টস?
নি: সে তো কিছু লোকজন অর্বাচিনের মতো কথা বলবেই। প্লাস, দেখো, এই টাইম স্লটে সব চ্যানেলের মধ্যে আমার শোতেই সবচেয়ে বেশি লিসনার্স। সেলস টিমকে দেখো জিজ্ঞেস করে, আমার শোতে ad এর রেট কত!
রাইমা : ব্যস! হয়ে গেলো তো? বাংলা শব্দভাণ্ডারে আর কুলালোনা? একটা অর্বাচীন বলেই শেষ? এই করে করে তোরা শো টার বারোটা বাজিয়েছিস। কি অখাদ্য বাক্য বলিস এক একটা। হে ফ্রেন্ডস, আমি নিক এন্ড ইউ ক্যান কাম হিয়ার এন্ড স্পিক।
নিক : বাহ রে, শোটার নামই তো স্পিক টু নিক। সেখানে একটু আধটু ইংলিশ না বললে
রাইমা : শো টার এরকম ভয়নক নাম যে অনুমোদন করেছিল, তোদের আগের প্রোডাকশন ম্যানেজার, তাকে সরিয়ে আমাকে কেনো এই চেয়ারে বসানো হয়েছে সেটা পরিষ্কার হলো তাহলে? বম্বে থেকে কড়া নির্দেশ আছে, ইয়োর শো নীডস আ ড্রাস্টিক মেক-ওভার। তার প্রথম ধাপই হলো, নাম পরিবর্তন। দ্বিতীয়, কন্টেন্ট।
নিক : অ্যা? নামটাই চেঞ্জ, মানে পরিবর্তন করে দেবে??
রাইমা : হ্যাঁ, দেখ, সামনেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ওইদিন থেকেই এই পরিবর্তনটা করা হবে। এবং অনুষ্ঠানের নাম এমন রাখা হবে যাতে তুই আর একটিও খিচুড়ি বাক্য বললেই তোকে সরিয়ে অন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়া যায়। স্পিক টু নিক! হাঃ!
নিক: এটা কিন্তু... মানে এই তো তুমিই বললে প্রোডাকশন ম্যানেজার, ইংরেজি শব্দ, সে বেলা ...
রাইমা : উৎপাদন ব্যবস্থাপক বলতেই পারতাম আমি, কিন্তু তোর নিরেট মাথায় সেটা ঢুকতো কি?
নিক : সেটাই তো....
রাইমা : আর একটাও কথা নয় নিখিল, বাংলা ভাষার পিঠ দেওয়ালে থেকে গেছে। যে বাংলার ওপরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, তাকে রক্ষা আমাদেরই করতে হবে। করতেই হবে।
নিক : আচ্ছা, বুঝলাম। আসি।
রাইমা : আয়, (গলা উঁচু করে) আর আজ থেকে মোনালি ঠাকুর নয়, চন্দ্রিল ভটচাজ এর ভিডিও গুলো দেখবি।।
নিঃ হু।
Scene 2
নিঃ নমস্কার আমি নিক, আই মিন, আমি নিখিল। আর আপনারা শুনছেন ১০৮.৩ রেডিও মস্তি।
রাঃ অ্যাই অ্যাই অ্যাই। থাম থাম (রাগতস্বরে)
নিঃ what? কী হল রাইমাদি? Why are you looking like Mount Vesuvius, about to explode?
রাঃ নিখিল, আর ঠিক দশ মিনিটে তুই লাইভ যাবি। অন-এয়ার। আর এখনও ওপেনিং সেন্টেন্স বলতে গিয়ে ছড়াচ্ছিস?
নিঃ রাইমাদি, চিল। এই যে প্র্যাকটিস করে নিচ্ছি, থুড়ি, ঝালিয়ে নিচ্ছি, এতেই দেখবে। এক্কেবারে কেল্লা ফতে। আমি তো জাস্ট তোমার লেগ পুল করছি। দেখো না শুধু, অন-এয়ার যাই, সব ঠিক হয়ে যাবে।
রাঃ ও গড, আই অ্যাম ফিলিং সো নার্ভাস। তুই এখনও গোটা একটা বাক্য ইংরেজি শব্দ না ব্যবহার করে বলতে পারলি না, এই তুই নাকি শুদ্ধ বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান করবি?
নিঃ আহ দি, তুমি বড্ড টেনশন করো। চেষ্টা করলে এবং চাইলে এই শর্মা যে অসাধ্য সাধন করতে পারবে না, তা কী করে হয়? তুমি শুধু আমার ক্যাপা, ইয়ে, মানে কী জানি বলে?
রাঃ নিখিল?
নিঃ হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার ক্ষমতা দেখো।
রাঃ ঠিক আছে। নে এবার হেডফোনটা কানে নে। এই জিঙ্গলটা শেষ হলেই লাইভ যাবি।
নিঃ (ব্যাঙও করে সুরে করে) পাঁচতলা মল, সবই শাড়ি
ভাষা নিয়ে এদের ঢং দেখে, আমি হেসেই গড়িয়ে পড়ি।
নিঃ নমস্কার বন্ধুরা, সূর্য অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, পাখিরা ফিরে চলেছে যে যার বাসায়, জানি তোমরাও ফিরছো ঘরমুখো যেখানে অপেক্ষা করে আছে তোমার প্রিয়জন, আর আমি নিখিল, তোমার বেতার বন্ধু, রয়েছি এই ফিরতি পথে তোমায় সঙ্গ দিতে। কি হলো? হিসেব মিলছেনা? ভাবছো এখন তো আর জে নিক এর স্পিক টু নিক নিয়ে আসার কথা? কনফিউশন মানে দ্বিধা দূর করে দিচ্ছি ছু মন্তরে, কিন্তু তার আগে বলোতো আজ কি দিন? হ্যাঁ, ঠিক তাই, আজ ইন্টারন্যাশনাল মানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, আর তাই আমি প্রতিজ্ঞা করেছি আজ থেকে বাংরেজি তে কথা এক্কেবারে বন্ধ! আর আমিও তাই আর নিক নই, নিখিল। আরে বাবা, বাংলার মত একটা tradi... থুড়ি ঐতিহ্যবাহী ভাষার কদর না করে ঝুড়ি ঝুড়ি ইংরেজি শব্দে বাক্য বোঝাই করাতে কোনো পারদর্শিতা নেই। স্মার্টনেস তো নয়ই। এই রে, আবার স্মার্টনেস বলে ফেললাম। আসলে কিছু কিছু শব্দের বুঝলে তো, বাংলা যে কি, অনভ্যাসে ভুলতে বসেছি। দেখো তো, তোমরা মনে করতে পারো কিনা! আর একবার বলি, স্মার্টনেস এর বাংলা খুঁজে পেলেই ফোন করো ৯৮৩০০১০৮৩০ এই নম্বরে, ততক্ষণে আমি বরং তোমাদের শোনাই ভীষণ মিষ্টি একটা বাংলা গান।
অন্বেষা : হেলো।
নিখিল : হেলো, হ্যাঁ বলো। নিকের সাথে মনের কথা ভাগ করে নিতে কে আছো অপর প্রান্তে?
অন্বেষা: হাই, আমি অন্বেষা (বিতিকিচ্ছিরি উচ্চারণে)।
নিখিল : অন্বেষা? মানে অন্বেষা। আমাদের প্রথম কলার মানে কলার খোসায় পা পিছলে পড়লে যে জিনিসটা নেই বলে ধরে নেওয়া যায়, সেই স্মার্টনেস এর বাংলা খুঁজে দিতে এসেছে আমাদের প্রথম বন্ধু। স্বাগতম অন্বেষা।
অন্বেষা : ইসস, কি হয়েছে তোমার? All okay? Ki clown er Moto bokcho ?
নিখিল : ইয়ে মানে আজ আমাদের অনুষ্ঠানটার একটা বিশেষত্ব হলো আমরা আজ খাঁটি বাংলায় কথা বলছি। আমি যে শব্দগুলোর বাংলা জানিনা সেগুলোতে সাহায্য করবে তোমরা, মানে আমার শ্রোতা বন্ধুরা। তো অন্বেষা, স্মার্টনেস এর বাংলা তুমি তো জানোই, আমাদের সাথে ভাগ করে নাও এবার।
অন্বেষা: ওহ প্লিজ! ওসব শব্দের বাংলা টাঙলা আমি জানিনা। অনেকদিন ধরে তোমাকে ফোন করতে চেষ্টা করি, জাস্ট বিকজ আই লাভ ইউর ভয়েস and I am a regular listener of your show. আজকে কল কানেক্ট হয়ে গেল। ব্যস।
Nik : আচ্ছা, মানে বলতে চাইছো, আমার অনুষ্ঠান তোমার খুব ভালো লাগে। সেটা খুব ভালো কথা। শুনতে থাকো। তবে কথা ছিল স্মার্টনেস এর বাংলা জানাতে ফোন করার। তো একটু ভেবে বলো দেখি মাথায় আসছে কিনা?
অন্বেষা: স্মার্টনেস? চালাক চতুর? নট কনভিনসিং। এনিওয়ে, ওসব কে ভাবতে বসবে এখন? এমনিতেই লাইফে এত চাপ, last ek mas ধরে কিসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া। ক্যান ইউ বিলিভ আই failed the exam (ফুঁপিয়ে ওঠে)। নেক্সট টু উইকস আমার পরপর রিটেন আর প্র্যাকটিক্যাল সাপ্লি একজ্যামস। গড নোজ আমি কী করে ক্লিয়ার করবো। সেসব না ভেবে ইউ এক্সপেক্ট মি টু প্লে ডিকশনারি গেম নিক? নো ডিয়ার, নট টুডে।
নিক : ওকে (একটু টেনে সুর করে)। আই অ্যাম সো সরি !
অন্বেষা: তার ওপর ক্যাম্পাসিং, ক্যাট। এই সব কিছুর প্রেপ নেওয়া। আই ডোন্ট নো। আই ফিল সো লো অল দ্য টাইম। সো লস্ট। বাবা মাকে বলে বোঝাতে পারিনা। ওরা এক তো আমার স্ট্রেসের কথা বোঝেই না। উল্টে এমনিই বকে বকে লাইফ টা হেল করে দিয়েছে! সবকিছুর মাঝে ইউ আর the only source of fresh air নিক, মানে তুমি আমার extended family e hoye gecho. মানে বুঝতে পারছো?
নিক : হ্যাঁ অন্বেষা, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি কি বুঝতে পারলে যে গত তিন মিনিটে তুমি ২৪ টা ইংরেজি শব্দ বললে?
অন্বেষা: হ্যাঁ, বলেছি, তো?
নিক: না মানে basically আমাদের তো বলার কথা ছিল শুধু বাংলায়। আমরা না ঠিক করেছিলাম আজ থেকে জগা খিচুড়ি ভাষায় কথা বলবো না?
অন্বেষা : তুমিও তো বললে , basically?
নিক : আহা, সে তো পার্ট of the line।
অন্বেষা : হ্যাঁ, কিন্তু পার্ট of the line ' কথাটা তো আর পার্ট of the line noy, tahole?
নিক : হ্যাঁ , ঠিক এটাই আমি বলতে চাইছি যে ভাষার অন্তর্গত হলে
অন্বেষা : আই নো নিক, সকাল থেকে লোকজনের ফেসবুক আর ইন্সটাতে ওই বাংলা ভাষা, মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ এটসেটরা দেখে দেখে আই এম বোর্ড। আমি সব জ্ঞানের কথা জানি। অল এবাউট হাউ উই, আওয়ার জেনেরশন ইস spoiling দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড অল দ্যাট crap।
নি: হ্যাঁ কিন্তু ভেবে দেখো...
অ(থামিয়ে দিয়ে): নিক, ভাষার আসল কাজ হলো মনের ভাব প্রকাশ করা। সেটা হয়ে গিয়ে থাকলেই I am more than happy. ভাভনাও কো সমঝো। বুঝে গেছো তো কী বলতে চাইছি? তাহলেই হলো।
নিক : হ্যাঁ কিন্তু -
অন্বেষা: আর শোনো না, যা বলতে তোমায় কল করলাম। ইউ আর টু গুড। তুমি বড্ড ভালো, সেনসিটিভ। আই থিংক আই হ্যাভ এ ক্রাশ অন ইউ।
নি: আচ্ছা.. তাই?
অ: হ্যাঁ। ইয়া, আই মিন, নো, নট ক্রাশ। আই থিংক আই লাভ ইউ নিক। একদিন মিট করবে প্লিজ?
নি: অনেক ধন্যবাদ অন্বেষা, তোমার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগলো। কিন্তু এভাবে দেখা তো করা যায়না, তুমি বরং শুনতে থেকো আমার অনুষ্ঠান
অন্বেষা: yes!
নিঃ কী হলো?
অন্বেষা : আমার ক্রাশ ফোন করছে। ফর the first time he is calling me up! ওহ নিক ইউ আর সো লাকি ফর মী। Muah! Gotta go। U take care। Bye bye
( ফোন রাখার শব্দ)
নিক : এই দেখো, অন্বেষা, তোমার ভালো সময় শুরু হয়েই গেলো। তবে বন্ধুরা, স্মার্টনেস এর বাংলার খোঁজ কিন্তু এখনও পাওয়া গেলো না। ফোন লাইন খোলা আছে, চটপট চলে এসো সেই চেনা নম্বরে। আর শুনতে থাকো এক্কেবারে আনকোরা বাংলা গান ১০৮ দশমিক তিন এফ এমে।
(বাংলা গান background a)
রাইমা: এই নিখিল এই! কি হচ্ছে এটা?
নিক : কেনো? আমি তো বাঙলাতেই...
রাইমা: বাঙলাতেই?? ' ওহ আই এম সো সরি ' টা বাংলা??? আর কারা কারা ফোন করে তোকে? দেখছিস তো কি অডিয়েন্স বানিয়েছিস!
নিক : আরে যে ফোন করছে তার ভাষা আমি কি করে কন্ট্রোল করবো!
রাইমা : আজ যেটা পাচ্ছিস সেটা গতকালের কর্মের ফল তো। এতদিন ধরে শো টা এইভাবে চালিয়েছিস বলেই তো এরা ফোন করার সাহস পেয়েছে!
নিক : রাইমা দি, শো টা যে এত মানুষ শুনছে আর ভালোবাসছে, সেটার কি কোনো দাম নেই?
রাইমা: বাংলায় ভালোলাগা নিখিল। গোটা কথোপকথন বাংলায় বলতে না পারাটা কুল নয় নিখিল। এন্ড ইট ইজ নট ইম্পসিবল আইদার। সরকারি বেতার কেন্দ্রে শুনিস না? বাংলাকে ভালোবাস। বাংলায় কথা বল। লোককে বাংলায় কথা বলা। না পারলে, দায়িত্ব থেকে সরে যা।
নিঃ আমি চেষ্টা করছি রাইমাদি।
রাঃ দেখ নিখিল, আই নো, তুই পারবি। একটু এফরট দে। টেক স্মল স্টেপস। সারাক্ষণ কনশাসলি বাংলাতেই কথা বলে যা, ঠিক পারবি। আমি এলাম রে। ক্লায়েন্ট মিটিং আছে।
নিঃ হুম। (চাপা গলায়) নিজে বাংরেজিতে কথা বলবে, এদিকে আমি বললেই দোষ। আরে বাবা, ভাষা কি আর এখন সেই বিশ বছর আগের মতো আছে? ধুস।
জুঁই: কীরে নিখিল, মুখ ব্যাজার করে কেন?
নি: লম্বা গল্প।
জু: ভাষা বিভ্রাট?
নি: হুম।
জু: এই প্রসঙ্গে একটা মজার কথা মনে পড়লো। দাঁড়া ট্র্যাফিক আপডেটটা দিয়ে নিই। গানটা চালিয়ে বলছি।
নমস্কার কলকাতা। শুনছো ১০৮.৩। আর তোমার সাথে এসে গিয়েছি, তোমার বন্ধু, জুঁই। বাইরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি। এইমুহুর্তে কোত্থাও কোনো যানজটের খবর নেই। রাস্তাঘাট এক্কেবারে মসৃণ। গাড়ি নিয়ে একটা লম্বা সফরে বেরোলে জমে যাবে কিন্তু, বলো? শুধু একটাই কথা, গাড়িটা কিন্তু সাবধানে চালিও। সঙ্গে রইলো তোমাদের জন্য একটা টাটকা গান।
(গান বাজবে)
নি: ইশ, কি ভালো বাংলা বলিস রে তুই!।
জু: বাংলা দিয়েই তো মন আর পেট দুইই ভরাচ্ছি রে। যাকগে, মজার কথাটা শোন। বাজারে যে নতুন ফোন টা এসেছে, রাস্তার ধারে বড় বড় করে তার হোরডিং ভরা বিজ্ঞাপন দেখেছিস? বলে নাকি BSI ক্যামেরা দেওয়া।
নিক: BSI, ব্যাকসাইড ইলুমিনেটেড?
জুঁই : তুই বল, ব্যাকসাইড মানে তো পশ্চাৎদেশ! পশ্চাৎদেশ আলোকিত। কোনো মানে হয়?
(দুজনেই হেসে ওঠে)
Scene 3
(মা মনের সুখে গুনগুন করে গান গাইছে কোন)
নিঃ মাতেঃ, আপনার সুপুত্রের ক্ষুধা পাইয়াছে। অনুগ্রহ করিয়া উহার ক্ষুধার অগ্নি নির্বাপণ করুন।
(মা গান গেয়েই চলেছে)
নিঃ (উচ্চ স্বরে) মাতেঃ? আপনি কি শুনিতে পাইতেছেন?
মাঃ ( গান থামিয়ে) কি? কি বলছিস? চিৎকার করছিস কেনো? এটা ভদ্রলোকের পাড়া তো, নাকি?
নিঃ বলিতেছিলাম মাতেঃ, আপনার সুপুত্র ক্ষুধায় একান্তই কাতর। উহাকে খাদ্য দাও। তুমি পুণ্যবতী হইবে।
(কোন কমিক গান/লাইন )
মাঃ সোজাসুজি বল না, খিদে পেয়েছে। পুরো যাত্রাদলের পাঁচ টাকা পাই এর মত ডায়লগ বলছিস কেন?
নিঃ মাতেঃ, আপনার পুত্রের জীবনে চরম সঙ্কট উপস্থিত। উহার দপ্তরে নির্দেশিকা এসেছে উপরমহল থেকে, অনুষ্ঠান সঞ্চালনার সময় বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলতে হবে। অগত্যা...
মাঃ অগত্যা?
নিঃ অগত্যা আমি সঙ্কল্প লইয়াছি, শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলিব। সম্ভব হইলে একটি দুইটি সংস্কৃত শব্দও ব্যবহার করিব।
মাঃ (হেসে) তাই বুঝি?
নিঃ নিশ্চয়! ইয়ে, অদ্য সকালে আপনার অলাবু সহযোগে চিঙ্গোরি মৎস্যের তরিকারী রন্ধন করিবার কথা ছিল। পাকশালে আপনি এমনটাই বলিতেছিলেন কৃষ্ণা মৎসীকে। উহা কি হইয়াছে?
মাঃ চিঙ্গোরী? তরিকারী? মতসী? কীসব আবোল তাবোল বলে যাচ্ছিস রে। হ্যাঁ রে বাবু, অদ্য টদ্য কী বলছিস রে? আদা বেটে দিবি? ও মা, আমার সোনা ছেলেটার আজ দেখছি মতিগতি শুধরে গিয়েছে। বাহ, দাঁড়া, ফ্রিজে আদা আছে। বের করে আনি। বেটে দে না মিক্সিতে। ছেলের আমার সুমতি হয়েছে দেখছি। শরৎ বাবু বেঁচে থাকলে আজ নতুন করে লিখতেন, নিখিলের সুমতি। আহা, ভাবলেও মন ভালো হয়ে যায়।
নিঃ দূর ছাই, তখন থেকে বলছি খিদে পেয়েছে, খেতে দাও। তুমি সমানে অকারণে অন্য টপিকে কীসব ভুলভাল বকেই চলেছ।
মাঃ অ্যাই, একদম বাজে কথা বলবি না বলে দিলাম। মায়ের ওপর চিৎকার করা হচ্ছে? রোজের ওই তিড়িং বিরিং ছাইপাঁশ বকবকের পর একদিন একটু ভালো করে কথা বলছিস দেখে আমি অবাক হবো না বল? বললাম বলেই ওমনি মেজাজ দেখানো আমাকে? একটা বাড়ির কাজ করিস না। জানিস আমি একা হাতে এই বাড়ি সংসার সব সামলাই। তুই আর তোর বাবা, কেউ কুটোটি পর্যন্ত নেড়ে দিস না। ভালো লাগে না আমার। বাবু, একদম ভালো লাগে না।
নিঃ উফ, মা, নট আগেন। সারাদিন বসে বসে ও মাগো গিলবে আর আমার ওপরে সেই ডায়লগ ঝাড়বে! প্লিজ খ্যামা দাও! শোনো না যা বলছিলাম, সকালে লাউ চিংড়ি করবে বলেছিলে না?
মাঃ হ্যাঁ, করা আছে তো।
নিঃ (জিভ দিয়ে একটু লোভ লোভ গোছের শব্দ করে) তাহা হইলে উহাই দাও মাতেঃ। সাথে একটু গোধূমচূর্ণ এবং সলিলের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তাহাকে ভালো করিয়া দলিয়া ও মলিয়া আমাকে রোট্টিকা বেলিয়া দাও।
মাঃ গোধূমচূর্ণ, রোট্টিকা? কৃষ্ণাকে বলছি, ফ্রিজে আটা মাখা আছে। কয়েকটা রুটি বেলে দেবে। লাউ চিংড়ি দিয়ে খাও। আর আমায় উদ্ধার করো।
নিঃ মাতেঃ, তাইই তো বলছি তোমায় তখন থেকে। তুমি আমার আকুলি বিকুলি কাকুতি মিনতি কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছ না।
মাঃ ভুলভাল বাংলা বললে আমি কী করে বুঝব? চিঙ্গোরি? রোট্টিকা? মতসী? যা ইচ্ছে তাই?
নিঃ এই মা, গোধূমচূর্ণ indeed is a word... শরদিন্দু ঐতিহাসিক উপন্যাসে আছে। বের করো, তৃতীয় খণ্ড।
মাঃ শরদিন্দু আবার কী? শরদিন্দু? বলো শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। এই শিক্ষা দিয়েছি আমি তোমায়? এত কষ্ট করে ছোট থেকে ভালো স্কুলে ভালো টিচারের কাছে পড়িয়েছি, এই তার ফল? শোনো, কত রাত জেগে থেকেছি আমি, যাতে অন্ধকার থাকতে থাকতেই বেরিয়ে এডমিশনের ফর্মের লাইনে দাঁড়াতে পারি। তোমার বাবা কিচ্ছুটি করেনি। কিচ্ছু না। উল্টে আমায় বারবার কথা শুনিয়েছে, টাকা খরচের জন্য। আটকাতে চেয়েছে। শিক্ষার মূল্য কেউ দিতে জানে এ বাড়িতে? মাকে বলেছিলাম, এই বাড়িতে আমার বিয়ে দিয়ো না। শুনলো না। জীবনটা আমার শেষ হয়ে গেলো।
নিঃ আরে আবার শুরু হলো! কোথায় ভাবলাম পেটের জ্বালা জলদি মিটিয়ে তোমার সাথে একটু আলোচনা করবো। তুমি আফটার অল, সাহিত্যে এম এ। তা না...
মাঃ (গলা নামিয়ে সহানুভূতির সুরে) কিসের আলোচনা? কি হয়েছে বলবি খুলে? এত তখন থেকে বাংলা শুদ্ধ শব্দের পিছনে পড়েছিস?
নিখিল : (হতাশ গলায়) ধুর, চাকরি টা মনে হচ্ছে থাকবেনা বুঝলে?
মা : সেকি? কেনো রে?
নিক : আরে আর বলোনা, নতুন প্রোডাকশন ম্যানেজার এসেছেন না, রাইমা দি? তাঁর দাবি হলো, গোটা শো টা শুদ্ধ বাংলায় করতে হবে। আরে তুমি বলো, এখন সবাই ইংলিশ মেদিয়াম স্কুলে পড়ে। হলিউড এর সিনেমা, ওয়েব সিরিজ দেখে, সেখানে শুধু বাংলা বলতেই হবে বলে uncommon Kichu Bangla শব্দ ঢোকাতে হবে? এটাই কি আরো অবাস্তব করে দেবে না শো টা কে?
মা : হুম, তুই বলতে মনে পড়লো, দেখছিলাম বটে আজকাল খুব লেখালেখি হচ্ছে যে বেতার মাধ্যমের সঞ্চালোকেরা খিচুড়ি বাংলা বলেছেন। বাংলা ভাষার অস্তিত্ব এমনিতেই বিপন্ন, তার মধ্যে..
নিক: ধুস! আজ try করেছিলাম। ধেরিয়েছি প্রোগ্রাম টা। ভালো লাগছেনা কিসসু।
মা: অ। তা শুদ্ধ বাংলা মানে? সমস্যাটা শুধুই ইংরেজি শব্দ নিয়ে নাকি যে কোনো অবাঙলা শব্দ?
নি: কি ডিফারেন্স?
মা: আছে আছে। বাংলায় এমন অনেক শব্দই আছে যার অরিজিন কিন্তু বিদেশি ভাষা। তবে ইংলিশ না।
নি: যেমন?
মা: যেমন ধর, বাবা বা দাদা। দুটোই তুর্কি শব্দ।
নি: ইন্টারেস্টিং
মা: ইভেন কমনস্য কমন শব্দ, যেমন ধর, খবর, এলাকা। এগুলো আরবি।
নি: দাঁড়াও, আমি নোট করে নিই। আরো কিছু বলো। কাল রাইমাদিকে বলবো। এগুলোই হবে আমার তুরুপের তাস।
মা: তুরুপ বললি, ওটাও ওলন্দাজ শব্দ জানিস তো।
নি: বাবাঃ!
মা: তোর রাইমাদিকে বলবি, ওইসব শুদ্ধ ভাষা চাইলে নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপপুঞ্জে যেতে। ওখানে ছাড়া দুনিয়ায় আর কোথাও uninfluenced pure ভাষা কিচ্ছু পাবে না।
নি: ওহ মা! তুমিই জগৎ জননী, তুমিই বিপত্তারিনি মা আমার!
মা: এই শোনো, তা বলে ভেবোনা পার পাবে। মা বা রাইমাদি সহ্য করে নিলেও তোমার এই ওঁচা ভাষা বউ কিন্তু সহ্য করবেনা!
নিক : হেঁ হেঁ বউ তো ( ও মা গো -র মত ভঙ্গিতে)... এই দাঁড়াও, বউ? কে বউ?
মা : (মৃদু হেসে) কেনো জুঁই? ওর সব প্রোগ্রাম শুনি তো আমি, কি ভালো বাংলা বলে মেয়েটা! আমি কিছু বুঝিনা ভেবেছো?
নিক : এই যাহ, কি যে তুমি.... আচ্ছা শোনো না, বলছি যে সত্যিই আমাকে একটু বাংলাটা পড়াবে? মানে জুঁই না সত্যিই বাংলাটা এত admire kore...
মাঃ এই রুটি দিয়ে লাউ চিংড়ি খেয়ে আমায় উদ্ধার করো এখন, তারপর বামনদেবের বইটা নামাস, আমার আলমারির তিন নম্বর তাকে আছে। আর কাল থেকে রোজ পাঁচটা করে বাংলা শব্দ মুখস্থ করবি।
( কিছুক্ষণের পজ। )
হালকা ' মোদের গরব মোদের আশা ' বাজে, সাথে শোনা যায় নিখিল মুখস্থ করছে :
নিক : ক্রকচ মানে করাত, রিরংসা মানে অদম্য হিংসে, অন্বীক্ষা মানে অনুসন্ধান করিবার ইচ্ছে, ফ্রিকুয়ান্সি র বাংলা কম্পাঙ্ক, মডুলেশন এর বাংলা সামঞ্জস্য বিধান, মেগাহার্টজ এর বাংলা.... (আটকে যায়)
ও মা মেগাহার্টজ এর বাংলা কি??? (গলা উঁচিয়ে) মাআআ?
( গানের ভলিউম ধীরে ধীরে বাড়ে)
সমাপ্ত
Knock
নিখিল: may I come in Raima di?
রাইমা : নিখিল? আয়! কিন্তু এটাই শেষবার।
নিখিল: মানে?
রাইমা: মানে এরপর থেকে আমার ঘরে ঢুকতে হলে আসবো কিনা জিজ্ঞেস করবি, মে আই কাম ইন বললে আর অনুমতি পাবিনা। বস।
নিখিল: কী? মানে??
রা: কীসের কী?
নি: আই মিন, কলকাতা শহরের ঝাঁ চকচকে প্রাইভেট এফ এম স্টেশনে বসে আমার কেন বলোতো সুবালা দেবী বালিকা বিদ্যালয় ভাইবস আসছে?
রা: সুবালা দেবী বালিকা বিদ্যালয় ভাইবস? মানে কী?
নি: না মানে ওই বাংলা বাঁচাও টাইপ।
রা: প্রাইভেট এফ এম বলে কি ভাষার প্রতি একটা দায়িত্ব থাকে না নাকি?
নি: সে থাকে। বাট, তুমি এত সকাল সকাল রেগে কেন? পুরো বেগুন ইন অয়েল সিনড্রোম। কে ডুব দিলো, ছায়াদি? না বর চললো মায়ামি?
রা: চুপ কর নিখিল। খালি ফাজলামি, না?
নি: এই সরি সরি। বলো বলো। সিরিয়াস হয়ে শুনছি। কেসটা কী, বলো।
রাইমা: কেসটা শর্টে হলো, এই স্টেশনে টিকতে হলে তোকে বাঙলাতেই কথা বলতে হবে।
নিখিল : বাংলা??
রাইমা : কেন? মাতৃভাষা নয়? নাকি বাংলা টাংলা আসেনা?
নিক: ইয়ে মানে বাংলাই তো বলি।
রাইমা : না, বলছিস না। কি একটা জগাখিচুড়ী ভাষা আমদানি করেছিস তোরা কে জানে! পরিষ্কার ঝরঝরে বাংলায় কথা না বলতে পারলে আর আর জে গিরি করতে হবেনা।
নিক : কিন্তু রাইমাদি the last time I checked আমার শোটার ফিডব্যাক তো বেশ ভালই ছিল।
রা: আর ফেসবুক ইউটিউবের কমেন্টস?
নি: সে তো কিছু লোকজন অর্বাচিনের মতো কথা বলবেই। প্লাস, দেখো, এই টাইম স্লটে সব চ্যানেলের মধ্যে আমার শোতেই সবচেয়ে বেশি লিসনার্স। সেলস টিমকে দেখো জিজ্ঞেস করে, আমার শোতে ad এর রেট কত!
রাইমা : ব্যস! হয়ে গেলো তো? বাংলা শব্দভাণ্ডারে আর কুলালোনা? একটা অর্বাচীন বলেই শেষ? এই করে করে তোরা শো টার বারোটা বাজিয়েছিস। কি অখাদ্য বাক্য বলিস এক একটা। হে ফ্রেন্ডস, আমি নিক এন্ড ইউ ক্যান কাম হিয়ার এন্ড স্পিক।
নিক : বাহ রে, শোটার নামই তো স্পিক টু নিক। সেখানে একটু আধটু ইংলিশ না বললে
রাইমা : শো টার এরকম ভয়নক নাম যে অনুমোদন করেছিল, তোদের আগের প্রোডাকশন ম্যানেজার, তাকে সরিয়ে আমাকে কেনো এই চেয়ারে বসানো হয়েছে সেটা পরিষ্কার হলো তাহলে? বম্বে থেকে কড়া নির্দেশ আছে, ইয়োর শো নীডস আ ড্রাস্টিক মেক-ওভার। তার প্রথম ধাপই হলো, নাম পরিবর্তন। দ্বিতীয়, কন্টেন্ট।
নিক : অ্যা? নামটাই চেঞ্জ, মানে পরিবর্তন করে দেবে??
রাইমা : হ্যাঁ, দেখ, সামনেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ওইদিন থেকেই এই পরিবর্তনটা করা হবে। এবং অনুষ্ঠানের নাম এমন রাখা হবে যাতে তুই আর একটিও খিচুড়ি বাক্য বললেই তোকে সরিয়ে অন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়া যায়। স্পিক টু নিক! হাঃ!
নিক: এটা কিন্তু... মানে এই তো তুমিই বললে প্রোডাকশন ম্যানেজার, ইংরেজি শব্দ, সে বেলা ...
রাইমা : উৎপাদন ব্যবস্থাপক বলতেই পারতাম আমি, কিন্তু তোর নিরেট মাথায় সেটা ঢুকতো কি?
নিক : সেটাই তো....
রাইমা : আর একটাও কথা নয় নিখিল, বাংলা ভাষার পিঠ দেওয়ালে থেকে গেছে। যে বাংলার ওপরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, তাকে রক্ষা আমাদেরই করতে হবে। করতেই হবে।
নিক : আচ্ছা, বুঝলাম। আসি।
রাইমা : আয়, (গলা উঁচু করে) আর আজ থেকে মোনালি ঠাকুর নয়, চন্দ্রিল ভটচাজ এর ভিডিও গুলো দেখবি।।
নিঃ হু।
Scene 2
নিঃ নমস্কার আমি নিক, আই মিন, আমি নিখিল। আর আপনারা শুনছেন ১০৮.৩ রেডিও মস্তি।
রাঃ অ্যাই অ্যাই অ্যাই। থাম থাম (রাগতস্বরে)
নিঃ what? কী হল রাইমাদি? Why are you looking like Mount Vesuvius, about to explode?
রাঃ নিখিল, আর ঠিক দশ মিনিটে তুই লাইভ যাবি। অন-এয়ার। আর এখনও ওপেনিং সেন্টেন্স বলতে গিয়ে ছড়াচ্ছিস?
নিঃ রাইমাদি, চিল। এই যে প্র্যাকটিস করে নিচ্ছি, থুড়ি, ঝালিয়ে নিচ্ছি, এতেই দেখবে। এক্কেবারে কেল্লা ফতে। আমি তো জাস্ট তোমার লেগ পুল করছি। দেখো না শুধু, অন-এয়ার যাই, সব ঠিক হয়ে যাবে।
রাঃ ও গড, আই অ্যাম ফিলিং সো নার্ভাস। তুই এখনও গোটা একটা বাক্য ইংরেজি শব্দ না ব্যবহার করে বলতে পারলি না, এই তুই নাকি শুদ্ধ বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান করবি?
নিঃ আহ দি, তুমি বড্ড টেনশন করো। চেষ্টা করলে এবং চাইলে এই শর্মা যে অসাধ্য সাধন করতে পারবে না, তা কী করে হয়? তুমি শুধু আমার ক্যাপা, ইয়ে, মানে কী জানি বলে?
রাঃ নিখিল?
নিঃ হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার ক্ষমতা দেখো।
রাঃ ঠিক আছে। নে এবার হেডফোনটা কানে নে। এই জিঙ্গলটা শেষ হলেই লাইভ যাবি।
নিঃ (ব্যাঙও করে সুরে করে) পাঁচতলা মল, সবই শাড়ি
ভাষা নিয়ে এদের ঢং দেখে, আমি হেসেই গড়িয়ে পড়ি।
নিঃ নমস্কার বন্ধুরা, সূর্য অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, পাখিরা ফিরে চলেছে যে যার বাসায়, জানি তোমরাও ফিরছো ঘরমুখো যেখানে অপেক্ষা করে আছে তোমার প্রিয়জন, আর আমি নিখিল, তোমার বেতার বন্ধু, রয়েছি এই ফিরতি পথে তোমায় সঙ্গ দিতে। কি হলো? হিসেব মিলছেনা? ভাবছো এখন তো আর জে নিক এর স্পিক টু নিক নিয়ে আসার কথা? কনফিউশন মানে দ্বিধা দূর করে দিচ্ছি ছু মন্তরে, কিন্তু তার আগে বলোতো আজ কি দিন? হ্যাঁ, ঠিক তাই, আজ ইন্টারন্যাশনাল মানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, আর তাই আমি প্রতিজ্ঞা করেছি আজ থেকে বাংরেজি তে কথা এক্কেবারে বন্ধ! আর আমিও তাই আর নিক নই, নিখিল। আরে বাবা, বাংলার মত একটা tradi... থুড়ি ঐতিহ্যবাহী ভাষার কদর না করে ঝুড়ি ঝুড়ি ইংরেজি শব্দে বাক্য বোঝাই করাতে কোনো পারদর্শিতা নেই। স্মার্টনেস তো নয়ই। এই রে, আবার স্মার্টনেস বলে ফেললাম। আসলে কিছু কিছু শব্দের বুঝলে তো, বাংলা যে কি, অনভ্যাসে ভুলতে বসেছি। দেখো তো, তোমরা মনে করতে পারো কিনা! আর একবার বলি, স্মার্টনেস এর বাংলা খুঁজে পেলেই ফোন করো ৯৮৩০০১০৮৩০ এই নম্বরে, ততক্ষণে আমি বরং তোমাদের শোনাই ভীষণ মিষ্টি একটা বাংলা গান।
অন্বেষা : হেলো।
নিখিল : হেলো, হ্যাঁ বলো। নিকের সাথে মনের কথা ভাগ করে নিতে কে আছো অপর প্রান্তে?
অন্বেষা: হাই, আমি অন্বেষা (বিতিকিচ্ছিরি উচ্চারণে)।
নিখিল : অন্বেষা? মানে অন্বেষা। আমাদের প্রথম কলার মানে কলার খোসায় পা পিছলে পড়লে যে জিনিসটা নেই বলে ধরে নেওয়া যায়, সেই স্মার্টনেস এর বাংলা খুঁজে দিতে এসেছে আমাদের প্রথম বন্ধু। স্বাগতম অন্বেষা।
অন্বেষা : ইসস, কি হয়েছে তোমার? All okay? Ki clown er Moto bokcho ?
নিখিল : ইয়ে মানে আজ আমাদের অনুষ্ঠানটার একটা বিশেষত্ব হলো আমরা আজ খাঁটি বাংলায় কথা বলছি। আমি যে শব্দগুলোর বাংলা জানিনা সেগুলোতে সাহায্য করবে তোমরা, মানে আমার শ্রোতা বন্ধুরা। তো অন্বেষা, স্মার্টনেস এর বাংলা তুমি তো জানোই, আমাদের সাথে ভাগ করে নাও এবার।
অন্বেষা: ওহ প্লিজ! ওসব শব্দের বাংলা টাঙলা আমি জানিনা। অনেকদিন ধরে তোমাকে ফোন করতে চেষ্টা করি, জাস্ট বিকজ আই লাভ ইউর ভয়েস and I am a regular listener of your show. আজকে কল কানেক্ট হয়ে গেল। ব্যস।
Nik : আচ্ছা, মানে বলতে চাইছো, আমার অনুষ্ঠান তোমার খুব ভালো লাগে। সেটা খুব ভালো কথা। শুনতে থাকো। তবে কথা ছিল স্মার্টনেস এর বাংলা জানাতে ফোন করার। তো একটু ভেবে বলো দেখি মাথায় আসছে কিনা?
অন্বেষা: স্মার্টনেস? চালাক চতুর? নট কনভিনসিং। এনিওয়ে, ওসব কে ভাবতে বসবে এখন? এমনিতেই লাইফে এত চাপ, last ek mas ধরে কিসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া। ক্যান ইউ বিলিভ আই failed the exam (ফুঁপিয়ে ওঠে)। নেক্সট টু উইকস আমার পরপর রিটেন আর প্র্যাকটিক্যাল সাপ্লি একজ্যামস। গড নোজ আমি কী করে ক্লিয়ার করবো। সেসব না ভেবে ইউ এক্সপেক্ট মি টু প্লে ডিকশনারি গেম নিক? নো ডিয়ার, নট টুডে।
নিক : ওকে (একটু টেনে সুর করে)। আই অ্যাম সো সরি !
অন্বেষা: তার ওপর ক্যাম্পাসিং, ক্যাট। এই সব কিছুর প্রেপ নেওয়া। আই ডোন্ট নো। আই ফিল সো লো অল দ্য টাইম। সো লস্ট। বাবা মাকে বলে বোঝাতে পারিনা। ওরা এক তো আমার স্ট্রেসের কথা বোঝেই না। উল্টে এমনিই বকে বকে লাইফ টা হেল করে দিয়েছে! সবকিছুর মাঝে ইউ আর the only source of fresh air নিক, মানে তুমি আমার extended family e hoye gecho. মানে বুঝতে পারছো?
নিক : হ্যাঁ অন্বেষা, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি কি বুঝতে পারলে যে গত তিন মিনিটে তুমি ২৪ টা ইংরেজি শব্দ বললে?
অন্বেষা: হ্যাঁ, বলেছি, তো?
নিক: না মানে basically আমাদের তো বলার কথা ছিল শুধু বাংলায়। আমরা না ঠিক করেছিলাম আজ থেকে জগা খিচুড়ি ভাষায় কথা বলবো না?
অন্বেষা : তুমিও তো বললে , basically?
নিক : আহা, সে তো পার্ট of the line।
অন্বেষা : হ্যাঁ, কিন্তু পার্ট of the line ' কথাটা তো আর পার্ট of the line noy, tahole?
নিক : হ্যাঁ , ঠিক এটাই আমি বলতে চাইছি যে ভাষার অন্তর্গত হলে
অন্বেষা : আই নো নিক, সকাল থেকে লোকজনের ফেসবুক আর ইন্সটাতে ওই বাংলা ভাষা, মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ এটসেটরা দেখে দেখে আই এম বোর্ড। আমি সব জ্ঞানের কথা জানি। অল এবাউট হাউ উই, আওয়ার জেনেরশন ইস spoiling দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড অল দ্যাট crap।
নি: হ্যাঁ কিন্তু ভেবে দেখো...
অ(থামিয়ে দিয়ে): নিক, ভাষার আসল কাজ হলো মনের ভাব প্রকাশ করা। সেটা হয়ে গিয়ে থাকলেই I am more than happy. ভাভনাও কো সমঝো। বুঝে গেছো তো কী বলতে চাইছি? তাহলেই হলো।
নিক : হ্যাঁ কিন্তু -
অন্বেষা: আর শোনো না, যা বলতে তোমায় কল করলাম। ইউ আর টু গুড। তুমি বড্ড ভালো, সেনসিটিভ। আই থিংক আই হ্যাভ এ ক্রাশ অন ইউ।
নি: আচ্ছা.. তাই?
অ: হ্যাঁ। ইয়া, আই মিন, নো, নট ক্রাশ। আই থিংক আই লাভ ইউ নিক। একদিন মিট করবে প্লিজ?
নি: অনেক ধন্যবাদ অন্বেষা, তোমার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগলো। কিন্তু এভাবে দেখা তো করা যায়না, তুমি বরং শুনতে থেকো আমার অনুষ্ঠান
অন্বেষা: yes!
নিঃ কী হলো?
অন্বেষা : আমার ক্রাশ ফোন করছে। ফর the first time he is calling me up! ওহ নিক ইউ আর সো লাকি ফর মী। Muah! Gotta go। U take care। Bye bye
( ফোন রাখার শব্দ)
নিক : এই দেখো, অন্বেষা, তোমার ভালো সময় শুরু হয়েই গেলো। তবে বন্ধুরা, স্মার্টনেস এর বাংলার খোঁজ কিন্তু এখনও পাওয়া গেলো না। ফোন লাইন খোলা আছে, চটপট চলে এসো সেই চেনা নম্বরে। আর শুনতে থাকো এক্কেবারে আনকোরা বাংলা গান ১০৮ দশমিক তিন এফ এমে।
(বাংলা গান background a)
রাইমা: এই নিখিল এই! কি হচ্ছে এটা?
নিক : কেনো? আমি তো বাঙলাতেই...
রাইমা: বাঙলাতেই?? ' ওহ আই এম সো সরি ' টা বাংলা??? আর কারা কারা ফোন করে তোকে? দেখছিস তো কি অডিয়েন্স বানিয়েছিস!
নিক : আরে যে ফোন করছে তার ভাষা আমি কি করে কন্ট্রোল করবো!
রাইমা : আজ যেটা পাচ্ছিস সেটা গতকালের কর্মের ফল তো। এতদিন ধরে শো টা এইভাবে চালিয়েছিস বলেই তো এরা ফোন করার সাহস পেয়েছে!
নিক : রাইমা দি, শো টা যে এত মানুষ শুনছে আর ভালোবাসছে, সেটার কি কোনো দাম নেই?
রাইমা: বাংলায় ভালোলাগা নিখিল। গোটা কথোপকথন বাংলায় বলতে না পারাটা কুল নয় নিখিল। এন্ড ইট ইজ নট ইম্পসিবল আইদার। সরকারি বেতার কেন্দ্রে শুনিস না? বাংলাকে ভালোবাস। বাংলায় কথা বল। লোককে বাংলায় কথা বলা। না পারলে, দায়িত্ব থেকে সরে যা।
নিঃ আমি চেষ্টা করছি রাইমাদি।
রাঃ দেখ নিখিল, আই নো, তুই পারবি। একটু এফরট দে। টেক স্মল স্টেপস। সারাক্ষণ কনশাসলি বাংলাতেই কথা বলে যা, ঠিক পারবি। আমি এলাম রে। ক্লায়েন্ট মিটিং আছে।
নিঃ হুম। (চাপা গলায়) নিজে বাংরেজিতে কথা বলবে, এদিকে আমি বললেই দোষ। আরে বাবা, ভাষা কি আর এখন সেই বিশ বছর আগের মতো আছে? ধুস।
জুঁই: কীরে নিখিল, মুখ ব্যাজার করে কেন?
নি: লম্বা গল্প।
জু: ভাষা বিভ্রাট?
নি: হুম।
জু: এই প্রসঙ্গে একটা মজার কথা মনে পড়লো। দাঁড়া ট্র্যাফিক আপডেটটা দিয়ে নিই। গানটা চালিয়ে বলছি।
নমস্কার কলকাতা। শুনছো ১০৮.৩। আর তোমার সাথে এসে গিয়েছি, তোমার বন্ধু, জুঁই। বাইরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি। এইমুহুর্তে কোত্থাও কোনো যানজটের খবর নেই। রাস্তাঘাট এক্কেবারে মসৃণ। গাড়ি নিয়ে একটা লম্বা সফরে বেরোলে জমে যাবে কিন্তু, বলো? শুধু একটাই কথা, গাড়িটা কিন্তু সাবধানে চালিও। সঙ্গে রইলো তোমাদের জন্য একটা টাটকা গান।
(গান বাজবে)
নি: ইশ, কি ভালো বাংলা বলিস রে তুই!।
জু: বাংলা দিয়েই তো মন আর পেট দুইই ভরাচ্ছি রে। যাকগে, মজার কথাটা শোন। বাজারে যে নতুন ফোন টা এসেছে, রাস্তার ধারে বড় বড় করে তার হোরডিং ভরা বিজ্ঞাপন দেখেছিস? বলে নাকি BSI ক্যামেরা দেওয়া।
নিক: BSI, ব্যাকসাইড ইলুমিনেটেড?
জুঁই : তুই বল, ব্যাকসাইড মানে তো পশ্চাৎদেশ! পশ্চাৎদেশ আলোকিত। কোনো মানে হয়?
(দুজনেই হেসে ওঠে)
Scene 3
(মা মনের সুখে গুনগুন করে গান গাইছে কোন)
নিঃ মাতেঃ, আপনার সুপুত্রের ক্ষুধা পাইয়াছে। অনুগ্রহ করিয়া উহার ক্ষুধার অগ্নি নির্বাপণ করুন।
(মা গান গেয়েই চলেছে)
নিঃ (উচ্চ স্বরে) মাতেঃ? আপনি কি শুনিতে পাইতেছেন?
মাঃ ( গান থামিয়ে) কি? কি বলছিস? চিৎকার করছিস কেনো? এটা ভদ্রলোকের পাড়া তো, নাকি?
নিঃ বলিতেছিলাম মাতেঃ, আপনার সুপুত্র ক্ষুধায় একান্তই কাতর। উহাকে খাদ্য দাও। তুমি পুণ্যবতী হইবে।
(কোন কমিক গান/লাইন )
মাঃ সোজাসুজি বল না, খিদে পেয়েছে। পুরো যাত্রাদলের পাঁচ টাকা পাই এর মত ডায়লগ বলছিস কেন?
নিঃ মাতেঃ, আপনার পুত্রের জীবনে চরম সঙ্কট উপস্থিত। উহার দপ্তরে নির্দেশিকা এসেছে উপরমহল থেকে, অনুষ্ঠান সঞ্চালনার সময় বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলতে হবে। অগত্যা...
মাঃ অগত্যা?
নিঃ অগত্যা আমি সঙ্কল্প লইয়াছি, শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলিব। সম্ভব হইলে একটি দুইটি সংস্কৃত শব্দও ব্যবহার করিব।
মাঃ (হেসে) তাই বুঝি?
নিঃ নিশ্চয়! ইয়ে, অদ্য সকালে আপনার অলাবু সহযোগে চিঙ্গোরি মৎস্যের তরিকারী রন্ধন করিবার কথা ছিল। পাকশালে আপনি এমনটাই বলিতেছিলেন কৃষ্ণা মৎসীকে। উহা কি হইয়াছে?
মাঃ চিঙ্গোরী? তরিকারী? মতসী? কীসব আবোল তাবোল বলে যাচ্ছিস রে। হ্যাঁ রে বাবু, অদ্য টদ্য কী বলছিস রে? আদা বেটে দিবি? ও মা, আমার সোনা ছেলেটার আজ দেখছি মতিগতি শুধরে গিয়েছে। বাহ, দাঁড়া, ফ্রিজে আদা আছে। বের করে আনি। বেটে দে না মিক্সিতে। ছেলের আমার সুমতি হয়েছে দেখছি। শরৎ বাবু বেঁচে থাকলে আজ নতুন করে লিখতেন, নিখিলের সুমতি। আহা, ভাবলেও মন ভালো হয়ে যায়।
নিঃ দূর ছাই, তখন থেকে বলছি খিদে পেয়েছে, খেতে দাও। তুমি সমানে অকারণে অন্য টপিকে কীসব ভুলভাল বকেই চলেছ।
মাঃ অ্যাই, একদম বাজে কথা বলবি না বলে দিলাম। মায়ের ওপর চিৎকার করা হচ্ছে? রোজের ওই তিড়িং বিরিং ছাইপাঁশ বকবকের পর একদিন একটু ভালো করে কথা বলছিস দেখে আমি অবাক হবো না বল? বললাম বলেই ওমনি মেজাজ দেখানো আমাকে? একটা বাড়ির কাজ করিস না। জানিস আমি একা হাতে এই বাড়ি সংসার সব সামলাই। তুই আর তোর বাবা, কেউ কুটোটি পর্যন্ত নেড়ে দিস না। ভালো লাগে না আমার। বাবু, একদম ভালো লাগে না।
নিঃ উফ, মা, নট আগেন। সারাদিন বসে বসে ও মাগো গিলবে আর আমার ওপরে সেই ডায়লগ ঝাড়বে! প্লিজ খ্যামা দাও! শোনো না যা বলছিলাম, সকালে লাউ চিংড়ি করবে বলেছিলে না?
মাঃ হ্যাঁ, করা আছে তো।
নিঃ (জিভ দিয়ে একটু লোভ লোভ গোছের শব্দ করে) তাহা হইলে উহাই দাও মাতেঃ। সাথে একটু গোধূমচূর্ণ এবং সলিলের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তাহাকে ভালো করিয়া দলিয়া ও মলিয়া আমাকে রোট্টিকা বেলিয়া দাও।
মাঃ গোধূমচূর্ণ, রোট্টিকা? কৃষ্ণাকে বলছি, ফ্রিজে আটা মাখা আছে। কয়েকটা রুটি বেলে দেবে। লাউ চিংড়ি দিয়ে খাও। আর আমায় উদ্ধার করো।
নিঃ মাতেঃ, তাইই তো বলছি তোমায় তখন থেকে। তুমি আমার আকুলি বিকুলি কাকুতি মিনতি কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছ না।
মাঃ ভুলভাল বাংলা বললে আমি কী করে বুঝব? চিঙ্গোরি? রোট্টিকা? মতসী? যা ইচ্ছে তাই?
নিঃ এই মা, গোধূমচূর্ণ indeed is a word... শরদিন্দু ঐতিহাসিক উপন্যাসে আছে। বের করো, তৃতীয় খণ্ড।
মাঃ শরদিন্দু আবার কী? শরদিন্দু? বলো শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। এই শিক্ষা দিয়েছি আমি তোমায়? এত কষ্ট করে ছোট থেকে ভালো স্কুলে ভালো টিচারের কাছে পড়িয়েছি, এই তার ফল? শোনো, কত রাত জেগে থেকেছি আমি, যাতে অন্ধকার থাকতে থাকতেই বেরিয়ে এডমিশনের ফর্মের লাইনে দাঁড়াতে পারি। তোমার বাবা কিচ্ছুটি করেনি। কিচ্ছু না। উল্টে আমায় বারবার কথা শুনিয়েছে, টাকা খরচের জন্য। আটকাতে চেয়েছে। শিক্ষার মূল্য কেউ দিতে জানে এ বাড়িতে? মাকে বলেছিলাম, এই বাড়িতে আমার বিয়ে দিয়ো না। শুনলো না। জীবনটা আমার শেষ হয়ে গেলো।
নিঃ আরে আবার শুরু হলো! কোথায় ভাবলাম পেটের জ্বালা জলদি মিটিয়ে তোমার সাথে একটু আলোচনা করবো। তুমি আফটার অল, সাহিত্যে এম এ। তা না...
মাঃ (গলা নামিয়ে সহানুভূতির সুরে) কিসের আলোচনা? কি হয়েছে বলবি খুলে? এত তখন থেকে বাংলা শুদ্ধ শব্দের পিছনে পড়েছিস?
নিখিল : (হতাশ গলায়) ধুর, চাকরি টা মনে হচ্ছে থাকবেনা বুঝলে?
মা : সেকি? কেনো রে?
নিক : আরে আর বলোনা, নতুন প্রোডাকশন ম্যানেজার এসেছেন না, রাইমা দি? তাঁর দাবি হলো, গোটা শো টা শুদ্ধ বাংলায় করতে হবে। আরে তুমি বলো, এখন সবাই ইংলিশ মেদিয়াম স্কুলে পড়ে। হলিউড এর সিনেমা, ওয়েব সিরিজ দেখে, সেখানে শুধু বাংলা বলতেই হবে বলে uncommon Kichu Bangla শব্দ ঢোকাতে হবে? এটাই কি আরো অবাস্তব করে দেবে না শো টা কে?
মা : হুম, তুই বলতে মনে পড়লো, দেখছিলাম বটে আজকাল খুব লেখালেখি হচ্ছে যে বেতার মাধ্যমের সঞ্চালোকেরা খিচুড়ি বাংলা বলেছেন। বাংলা ভাষার অস্তিত্ব এমনিতেই বিপন্ন, তার মধ্যে..
নিক: ধুস! আজ try করেছিলাম। ধেরিয়েছি প্রোগ্রাম টা। ভালো লাগছেনা কিসসু।
মা: অ। তা শুদ্ধ বাংলা মানে? সমস্যাটা শুধুই ইংরেজি শব্দ নিয়ে নাকি যে কোনো অবাঙলা শব্দ?
নি: কি ডিফারেন্স?
মা: আছে আছে। বাংলায় এমন অনেক শব্দই আছে যার অরিজিন কিন্তু বিদেশি ভাষা। তবে ইংলিশ না।
নি: যেমন?
মা: যেমন ধর, বাবা বা দাদা। দুটোই তুর্কি শব্দ।
নি: ইন্টারেস্টিং
মা: ইভেন কমনস্য কমন শব্দ, যেমন ধর, খবর, এলাকা। এগুলো আরবি।
নি: দাঁড়াও, আমি নোট করে নিই। আরো কিছু বলো। কাল রাইমাদিকে বলবো। এগুলোই হবে আমার তুরুপের তাস।
মা: তুরুপ বললি, ওটাও ওলন্দাজ শব্দ জানিস তো।
নি: বাবাঃ!
মা: তোর রাইমাদিকে বলবি, ওইসব শুদ্ধ ভাষা চাইলে নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপপুঞ্জে যেতে। ওখানে ছাড়া দুনিয়ায় আর কোথাও uninfluenced pure ভাষা কিচ্ছু পাবে না।
নি: ওহ মা! তুমিই জগৎ জননী, তুমিই বিপত্তারিনি মা আমার!
মা: এই শোনো, তা বলে ভেবোনা পার পাবে। মা বা রাইমাদি সহ্য করে নিলেও তোমার এই ওঁচা ভাষা বউ কিন্তু সহ্য করবেনা!
নিক : হেঁ হেঁ বউ তো ( ও মা গো -র মত ভঙ্গিতে)... এই দাঁড়াও, বউ? কে বউ?
মা : (মৃদু হেসে) কেনো জুঁই? ওর সব প্রোগ্রাম শুনি তো আমি, কি ভালো বাংলা বলে মেয়েটা! আমি কিছু বুঝিনা ভেবেছো?
নিক : এই যাহ, কি যে তুমি.... আচ্ছা শোনো না, বলছি যে সত্যিই আমাকে একটু বাংলাটা পড়াবে? মানে জুঁই না সত্যিই বাংলাটা এত admire kore...
মাঃ এই রুটি দিয়ে লাউ চিংড়ি খেয়ে আমায় উদ্ধার করো এখন, তারপর বামনদেবের বইটা নামাস, আমার আলমারির তিন নম্বর তাকে আছে। আর কাল থেকে রোজ পাঁচটা করে বাংলা শব্দ মুখস্থ করবি।
( কিছুক্ষণের পজ। )
হালকা ' মোদের গরব মোদের আশা ' বাজে, সাথে শোনা যায় নিখিল মুখস্থ করছে :
নিক : ক্রকচ মানে করাত, রিরংসা মানে অদম্য হিংসে, অন্বীক্ষা মানে অনুসন্ধান করিবার ইচ্ছে, ফ্রিকুয়ান্সি র বাংলা কম্পাঙ্ক, মডুলেশন এর বাংলা সামঞ্জস্য বিধান, মেগাহার্টজ এর বাংলা.... (আটকে যায়)
ও মা মেগাহার্টজ এর বাংলা কি??? (গলা উঁচিয়ে) মাআআ?
( গানের ভলিউম ধীরে ধীরে বাড়ে)
সমাপ্ত
Saturday, October 26, 2019
কালীপুজো, বাজি, ইত্যাদি...
আমার ছোটবেলায় কালীপুজোটা দাদাইবাড়ি কাটাতাম, হাওড়ায়। দাদাই, মানে আমার মায়ের বাবা। আমার দাদাভাই তখন পুজোর দিনে নিয়ম করে ছোট্ট করে একটা কালীমূর্তি কিনে এনে নিজের মতো করে পুজো করতও। সেই পুজোয় ছিলনা তেমনভাবে কোন মন্ত্র বা আড়ম্বর। ছিল অগাধ ভক্তি ও শ্রদ্ধা। মইমা, মানে আমার দিদিমা, আমার মা আর মামণি, মানে আমার মাসি, ওরা তিনজনে মিলেই পুজোর প্রসাদের ব্যবস্থা করতো। ফল মিষ্টি লুচি সুজি এইসবই বোধহয়। ভালো মনে নেই কারণ এই পুজো বেশিদিন চলেনি। দাদাই চলে গেলো যখন আমি সবে ছয়, আর তারপর দাদাভাইয়ের পড়ার চাপ, ইত্যাদি। যাই হোক, পুজোর পরে শুরু হতো বাজি ফাটানো। তখন আমরা কেউই পরিবেশ বিষয়ে এমন সচেতন ছিলাম না (ধরে নিচ্ছি আজ আমরা সক্কলেই সচেতন)। এন্তার চকলেট বোম, কালীপটকা ফাটত। আমি অবশ্য সেইসবে খুবই ভয় পেতাম। আমার জন্য বরাদ্দ ছিল তাই ফুলঝুরি। এবং ওই অত ছোটবেলায়, ফুলঝুরিও নিজে হাতে ধরতে সাহস পেতাম না। পাশের বাড়ির অলকা (?) কাকীমা প্যাঁকাটি দিয়ে ফুলঝুরি ধরিয়ে আমায় দিতো। বেশ ইয়া লম্বা দাঁড়াত ব্যাপারটা। অনেকটা দূরে আমার থেকে, অথচ কন্ট্রোল আমারই হাতে। বেশ লাগতো। হইহই করে জ্বালাতাম। দাদাইবাড়ির উঠোনে তারপর চড়কি জ্বালানো হতো। জ্বালানো হতো তুবড়িও। তবে ওই যে, আমার বরাবরের শব্দবাজি বা আগুন থেকে খুব ভয়।
আরেকটু বড় হয়েও ভয় কাটেনি। চিরকাল তাই ওই ফুলঝুরি চড়কিতেই আমার বাজি সীমাবদ্ধ। তাও চড়কিও নিজে জ্বালাইনি। বাবা কিংবা মা ওই কাজটি করত। ওই দু তিন প্যাকেট ফুলঝুরি আর এক বাক্স চড়কি, এই ছিল আমার বাজির বাজার। এর জন্য ঘটা করে বাজি বাজার থেকেও বাজি আনতে হতো না। পাড়ার দোকানেই পাওয়া যেত। কালীপুজোর রেশ কাটতে না কাটতেই ভাইফোঁটা। মামা মামী মামণি দাদাভাই এরা সক্কলে আসতো আমাদের বাড়ি। সেদিন বেশ সুন্দর ফ্যামিলি গেট টুগেদার হতো আমাদের। পাঁঠার মাংসও ফিস ফ্রাই চিংড়ি পাবদা এইসব সাঁটানোর পর আমাদের সকলেরই মন একটু স্প্রাইট আর পান পান করতো। খেয়ে উঠে তাই মামা আর আমি বেরোতাম। একই দোকানে বিক্রি হতো বাজি। তখন ওই পড়ে থাকা কিছু। তবুও তাঁরই মধ্যে থেকে মামা কিনত রঙ মশাল, ইলেকট্রিক তার (এরকমই কিছু নাম তো ছিল মনে হচ্ছে), ছুঁচো বাজি, তুবড়ি, চড়কি, বিভিন্ন রঙের ফুলঝুরি। আমি হলাম গিয়ে মামার আদরের ভাগ্নি, তাই সব স্পেশাল এবং জাম্বো প্যাক আসতো আমার জন্য। মনের সুখে বাজি নিয়ে বাড়ি ফিরতেই মায়ের মুখ ভার। হম্বিতম্বি। কেন এইসব কেনা হলো? আমার একেই সর্দি কাশির ধাত। পরশু থেকে স্কুল। এখন এইসব থেকে নতুন করে জ্বর জ্বালা হলে কে দেখবে? স্কুল খুললেই সেকেন্ড টার্ম। হ্যানা ত্যানা। তবুও তারই মধ্যে বেশ বিকেল হতে না হতে মামার দৌলতে ঝটপট চা পর্ব মিটে যেতেই মা চলে আসতো রসগোল্লার ট্রে নিয়ে। এটাই হলো সিগন্যাল। উৎসব পর্ব এই বছরের মতো শেষ। কিন্তু, উঁহু। হাতে গরম বাজিগুলো এখনও রয়েছে। সবাই চলে গেলে, বই খুলে পড়তে বসতে হতো। ওই যে? সেকেন্ড টার্ম। ফার্স্ট টার্মে এমন ধ্যারান ধেড়িয়েছি, কোন কথা বলার সাহস নেই আমার। কোনমতে সাড়ে নটা বাজতেই ডিনার। আর তারপরেই ম্যাজিকের রাজ্য। কালীপুজোর পরেও আনন্দ শুষে নিতে আরো বাজি, অনেক আলো, অনেক রঙ। তুবড়িগুলো অবধারিত ফেটে যেতো অল্প উঠেই, চড়কিও ফেটেছে। রাত্তিরে মামাকে ফোন করে বাজির ফিডব্যাক দিয়েছি। প্রতিবার ঠিক করি, না, আর এইগুলো কিনব না। ঠকায়। তবুও, এই ট্র্যাডিশন চলেই এসেছে। অনেকগুলো বছর পর্যন্ত।
এখন অবশ্য ক্যাম্পাসে বাজি ফাটানো নিয়ে নিষেধাজ্ঞা আছে। আর ওই এন্থুও নেই ঘুরে ঘুরে বাজি কেনার। এখন তাই কালীপুজো মানে আমার ঘরটাকে একটু আলো দিয়ে সাজানো। আর কালীবাড়ি গিয়ে পুজো দেখা, অঞ্জলি দেওয়া আর ভোগ খাওয়া। পালটাচ্ছে অনেক কিছুই, তবুও, ভালোই তো লাগে।
আমার ছোটবেলায় কালীপুজোটা দাদাইবাড়ি কাটাতাম, হাওড়ায়। দাদাই, মানে আমার মায়ের বাবা। আমার দাদাভাই তখন পুজোর দিনে নিয়ম করে ছোট্ট করে একটা কালীমূর্তি কিনে এনে নিজের মতো করে পুজো করতও। সেই পুজোয় ছিলনা তেমনভাবে কোন মন্ত্র বা আড়ম্বর। ছিল অগাধ ভক্তি ও শ্রদ্ধা। মইমা, মানে আমার দিদিমা, আমার মা আর মামণি, মানে আমার মাসি, ওরা তিনজনে মিলেই পুজোর প্রসাদের ব্যবস্থা করতো। ফল মিষ্টি লুচি সুজি এইসবই বোধহয়। ভালো মনে নেই কারণ এই পুজো বেশিদিন চলেনি। দাদাই চলে গেলো যখন আমি সবে ছয়, আর তারপর দাদাভাইয়ের পড়ার চাপ, ইত্যাদি। যাই হোক, পুজোর পরে শুরু হতো বাজি ফাটানো। তখন আমরা কেউই পরিবেশ বিষয়ে এমন সচেতন ছিলাম না (ধরে নিচ্ছি আজ আমরা সক্কলেই সচেতন)। এন্তার চকলেট বোম, কালীপটকা ফাটত। আমি অবশ্য সেইসবে খুবই ভয় পেতাম। আমার জন্য বরাদ্দ ছিল তাই ফুলঝুরি। এবং ওই অত ছোটবেলায়, ফুলঝুরিও নিজে হাতে ধরতে সাহস পেতাম না। পাশের বাড়ির অলকা (?) কাকীমা প্যাঁকাটি দিয়ে ফুলঝুরি ধরিয়ে আমায় দিতো। বেশ ইয়া লম্বা দাঁড়াত ব্যাপারটা। অনেকটা দূরে আমার থেকে, অথচ কন্ট্রোল আমারই হাতে। বেশ লাগতো। হইহই করে জ্বালাতাম। দাদাইবাড়ির উঠোনে তারপর চড়কি জ্বালানো হতো। জ্বালানো হতো তুবড়িও। তবে ওই যে, আমার বরাবরের শব্দবাজি বা আগুন থেকে খুব ভয়।
আরেকটু বড় হয়েও ভয় কাটেনি। চিরকাল তাই ওই ফুলঝুরি চড়কিতেই আমার বাজি সীমাবদ্ধ। তাও চড়কিও নিজে জ্বালাইনি। বাবা কিংবা মা ওই কাজটি করত। ওই দু তিন প্যাকেট ফুলঝুরি আর এক বাক্স চড়কি, এই ছিল আমার বাজির বাজার। এর জন্য ঘটা করে বাজি বাজার থেকেও বাজি আনতে হতো না। পাড়ার দোকানেই পাওয়া যেত। কালীপুজোর রেশ কাটতে না কাটতেই ভাইফোঁটা। মামা মামী মামণি দাদাভাই এরা সক্কলে আসতো আমাদের বাড়ি। সেদিন বেশ সুন্দর ফ্যামিলি গেট টুগেদার হতো আমাদের। পাঁঠার মাংসও ফিস ফ্রাই চিংড়ি পাবদা এইসব সাঁটানোর পর আমাদের সকলেরই মন একটু স্প্রাইট আর পান পান করতো। খেয়ে উঠে তাই মামা আর আমি বেরোতাম। একই দোকানে বিক্রি হতো বাজি। তখন ওই পড়ে থাকা কিছু। তবুও তাঁরই মধ্যে থেকে মামা কিনত রঙ মশাল, ইলেকট্রিক তার (এরকমই কিছু নাম তো ছিল মনে হচ্ছে), ছুঁচো বাজি, তুবড়ি, চড়কি, বিভিন্ন রঙের ফুলঝুরি। আমি হলাম গিয়ে মামার আদরের ভাগ্নি, তাই সব স্পেশাল এবং জাম্বো প্যাক আসতো আমার জন্য। মনের সুখে বাজি নিয়ে বাড়ি ফিরতেই মায়ের মুখ ভার। হম্বিতম্বি। কেন এইসব কেনা হলো? আমার একেই সর্দি কাশির ধাত। পরশু থেকে স্কুল। এখন এইসব থেকে নতুন করে জ্বর জ্বালা হলে কে দেখবে? স্কুল খুললেই সেকেন্ড টার্ম। হ্যানা ত্যানা। তবুও তারই মধ্যে বেশ বিকেল হতে না হতে মামার দৌলতে ঝটপট চা পর্ব মিটে যেতেই মা চলে আসতো রসগোল্লার ট্রে নিয়ে। এটাই হলো সিগন্যাল। উৎসব পর্ব এই বছরের মতো শেষ। কিন্তু, উঁহু। হাতে গরম বাজিগুলো এখনও রয়েছে। সবাই চলে গেলে, বই খুলে পড়তে বসতে হতো। ওই যে? সেকেন্ড টার্ম। ফার্স্ট টার্মে এমন ধ্যারান ধেড়িয়েছি, কোন কথা বলার সাহস নেই আমার। কোনমতে সাড়ে নটা বাজতেই ডিনার। আর তারপরেই ম্যাজিকের রাজ্য। কালীপুজোর পরেও আনন্দ শুষে নিতে আরো বাজি, অনেক আলো, অনেক রঙ। তুবড়িগুলো অবধারিত ফেটে যেতো অল্প উঠেই, চড়কিও ফেটেছে। রাত্তিরে মামাকে ফোন করে বাজির ফিডব্যাক দিয়েছি। প্রতিবার ঠিক করি, না, আর এইগুলো কিনব না। ঠকায়। তবুও, এই ট্র্যাডিশন চলেই এসেছে। অনেকগুলো বছর পর্যন্ত।
এখন অবশ্য ক্যাম্পাসে বাজি ফাটানো নিয়ে নিষেধাজ্ঞা আছে। আর ওই এন্থুও নেই ঘুরে ঘুরে বাজি কেনার। এখন তাই কালীপুজো মানে আমার ঘরটাকে একটু আলো দিয়ে সাজানো। আর কালীবাড়ি গিয়ে পুজো দেখা, অঞ্জলি দেওয়া আর ভোগ খাওয়া। পালটাচ্ছে অনেক কিছুই, তবুও, ভালোই তো লাগে।
Friday, October 25, 2019
কালী পুজো
বছর ষাটের মীরা। দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলের এক প্রাচীন বাড়িতে থাকেন। একলাই। বাড়িতে উনি ছাড়া লোক বলতে দিনরাত্তিরের কাজের লোক মঞ্জু। সেও আছে প্রায় পনেরো বছর হয়ে গেলো। মীরার ছেলে শোভন কলকাতাতেই থাকে। নিজের এবং স্ত্রী সৃজার অফিসের যাতায়াতের সুবিধার্থে ভবানীপুর ছেড়ে নিউ সংসার পেতেছে নিউ টাউনে। সারাদিন একা একা মীরার মোটেই ভালো লাগেনা। শোভনের যখন বিয়ে দেন, নিজে পছন্দ করে, সম্বন্ধ দেখে, ভেবেছিলেন বৌমা, নাতি নাতনি ছেলে নিয়ে ভরা সংসার হবে। নাহ। মায়ের সাথে সেই যে বিয়ে নিয়ে শোভনের মনোমালিন্য হয়েছিল, তার রেশ এখনও বজায় আছে। ছেলে আর কিছুতেই মায়ের কাছে ফেরেনি। বম্বে থেকে পোস্টিং নিয়ে কলকাতায় এসেও তাই এ মুখো হয়নি। নিয়ম করে কর্তব্যের খাতিরে মাসান্তে মায়ের অ্যাকাউন্টে মোটা টাকা ঢুকে যায় ঠিকই, তবে মা পায়না ছেলেকে। নাতনির সাথেও দেখা হয়না। এমনকি এত পছন্দ করে আনা বৌমা সৃজা, সেও সময়ই পায়না একবার ফোন পর্যন্ত করার।
রোজ সকালের মতোই ঠাকুরঘরের কাজ সেরে বারান্দার বেতের চেয়ারে এসে বসলেন মীরা। সবে সাড়ে নটা। গোটা দিন সামনে পড়ে। মঞ্জু এসে এক কাপ চা আর দু পিস পাউরুটি আর ছানা রেখে গেলো সাইড টেবিলে। মীরা চশমার বাক্স থেকে চশমা বের করতে করতে আনন্দবাজারটা হাতে নিলেন। প্রথম পাতায় বড় বড় করে হেডলাইন। "দেওয়ালির রাতে শিশু পাচার চক্র থেকে ২৫ জন শিশু উদ্ধার করলেন তরুণী পুলিশ অফিসার।" সাথে সেই উদ্ধার হওয়া ২৫টি শিশুর সাথে এক পুলিশ অফিসারের ছবি। একটু চেনা চেনা লাগছে যেন ছবিটা। মীরা চশমাটা ঠিক করে পরে হাতে কাগজটা তুলে দেখলেন।
জ্বলজ্বল করছে তরুণী অফিসারের নাম। সোমদত্তা গুহ। কাগজটা চোখের সামনে এনে ধরলেন মীরা। ঠিকই তো। সেই একই মানুষ। রোগা, লম্বা। কালো। দু চোখে অসম্ভব এক দীপ্তি। পরনে পুলিশের উর্দি। চোখে মুখে এক দারুণ আত্মবিশ্বাসের ছাপ। এতগুলো শিশুকে উদ্ধার করার তৃপ্তি। এই মুখটা যেন অনেক বেশী উজ্জ্বল, অনেক বেশী দৃপ্ত, দৃঢ়। পাঁচ বছর আগের সেই সোমদত্তার চেয়ে। যেদিন ওকে বাড়িতে ডেকে মীরা নিজে বলেছিলেন, "শোনো সোমদত্তা, তুমি শোভনের খুব ভালো বন্ধু হতে পারো। কিন্তু দেখো, তোমার সাথে ওর বিয়ে আমি কিছুতেই দিতে পারবো না। কিছু মনে করো না, তুমি লেখাপড়ায় ভালো, তোমার ফ্যামিলিও ভালো। কিন্তু আমার শোভনের পাশে তোমায় মানাবে না। তোমার ইয়ে, মানে, গায়ের রঙটা তো..." সেদিন সোমদত্তা কিচ্ছু বলেনি। মাথা নিচু করে চলে গিয়েছিল। এবং আশ্চর্যভাবে শোভনের সাথেও আর কোন সম্পর্কও রাখেনি। শোভন অবাক হয়ে গিয়েছিল। মীরার সাথে সোমের এই কথোপকথন জানতো না।
মীরা খবরের কাগজটা হাতে ধরে বসে থাকে খানিকক্ষণ। চোখ বারান্দার বাইরে, শূন্যে। মঞ্জু পাশেই দাঁড়িয়েছিল। একবার আলতো করে মীরার কাঁধে টোকা দিয়ে বলে, "এই সেই দিদিটা না মা? দাদার কাছে খুব আসতো আগে? কাগজে ছবি এলো কেন? কী করেছে?" মীরা নীচুস্বরে উত্তর দেয়, "ও মেয়ে মস্ত বড় হয়েছে। ওই তো কতজনকে অন্ধকার থেকে আজ আলোয় এনেছে। বড্ড ভুল করেছিলাম আমি সেদিন। বড্ড ভুল..." এই বলে মীরা পাশে রাখা এফ এম রেডিওটা ছালায়। আকাশবাণী কেন্দ্রে তখন চলছে রবীন্দ্রসঙ্গীত।
আরেক কালো মেয়েকে বিখ্যাত করে দেওয়া শিল্পী তখন গাইছেন,
"আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব
সারা রাত ফোটাক তারা নব নব।
নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো
যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো--
ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্ব পানে
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।"
রোজ সকালের মতোই ঠাকুরঘরের কাজ সেরে বারান্দার বেতের চেয়ারে এসে বসলেন মীরা। সবে সাড়ে নটা। গোটা দিন সামনে পড়ে। মঞ্জু এসে এক কাপ চা আর দু পিস পাউরুটি আর ছানা রেখে গেলো সাইড টেবিলে। মীরা চশমার বাক্স থেকে চশমা বের করতে করতে আনন্দবাজারটা হাতে নিলেন। প্রথম পাতায় বড় বড় করে হেডলাইন। "দেওয়ালির রাতে শিশু পাচার চক্র থেকে ২৫ জন শিশু উদ্ধার করলেন তরুণী পুলিশ অফিসার।" সাথে সেই উদ্ধার হওয়া ২৫টি শিশুর সাথে এক পুলিশ অফিসারের ছবি। একটু চেনা চেনা লাগছে যেন ছবিটা। মীরা চশমাটা ঠিক করে পরে হাতে কাগজটা তুলে দেখলেন।
জ্বলজ্বল করছে তরুণী অফিসারের নাম। সোমদত্তা গুহ। কাগজটা চোখের সামনে এনে ধরলেন মীরা। ঠিকই তো। সেই একই মানুষ। রোগা, লম্বা। কালো। দু চোখে অসম্ভব এক দীপ্তি। পরনে পুলিশের উর্দি। চোখে মুখে এক দারুণ আত্মবিশ্বাসের ছাপ। এতগুলো শিশুকে উদ্ধার করার তৃপ্তি। এই মুখটা যেন অনেক বেশী উজ্জ্বল, অনেক বেশী দৃপ্ত, দৃঢ়। পাঁচ বছর আগের সেই সোমদত্তার চেয়ে। যেদিন ওকে বাড়িতে ডেকে মীরা নিজে বলেছিলেন, "শোনো সোমদত্তা, তুমি শোভনের খুব ভালো বন্ধু হতে পারো। কিন্তু দেখো, তোমার সাথে ওর বিয়ে আমি কিছুতেই দিতে পারবো না। কিছু মনে করো না, তুমি লেখাপড়ায় ভালো, তোমার ফ্যামিলিও ভালো। কিন্তু আমার শোভনের পাশে তোমায় মানাবে না। তোমার ইয়ে, মানে, গায়ের রঙটা তো..." সেদিন সোমদত্তা কিচ্ছু বলেনি। মাথা নিচু করে চলে গিয়েছিল। এবং আশ্চর্যভাবে শোভনের সাথেও আর কোন সম্পর্কও রাখেনি। শোভন অবাক হয়ে গিয়েছিল। মীরার সাথে সোমের এই কথোপকথন জানতো না।
মীরা খবরের কাগজটা হাতে ধরে বসে থাকে খানিকক্ষণ। চোখ বারান্দার বাইরে, শূন্যে। মঞ্জু পাশেই দাঁড়িয়েছিল। একবার আলতো করে মীরার কাঁধে টোকা দিয়ে বলে, "এই সেই দিদিটা না মা? দাদার কাছে খুব আসতো আগে? কাগজে ছবি এলো কেন? কী করেছে?" মীরা নীচুস্বরে উত্তর দেয়, "ও মেয়ে মস্ত বড় হয়েছে। ওই তো কতজনকে অন্ধকার থেকে আজ আলোয় এনেছে। বড্ড ভুল করেছিলাম আমি সেদিন। বড্ড ভুল..." এই বলে মীরা পাশে রাখা এফ এম রেডিওটা ছালায়। আকাশবাণী কেন্দ্রে তখন চলছে রবীন্দ্রসঙ্গীত।
আরেক কালো মেয়েকে বিখ্যাত করে দেওয়া শিল্পী তখন গাইছেন,
"আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব
সারা রাত ফোটাক তারা নব নব।
নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো
যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো--
ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্ব পানে
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।"
Monday, October 21, 2019
পটলের দোরমা
অফিস থেকে ফিরে সবে চায়ের কাপ হাতে টিভি খুলে বসেছি, ভাবছি আজ রাত্রে কী খাবার খাওয়া যায়, কোত্থেকে অর্ডার করবো, এমন সময়ে মল্লিকার ফোন। মল্লিকা আমার কলিগ, বিগত তিন বছর ধরে আমরা একই ডিপার্টমেন্টে চাকরি করি। সরকারি অফিস। খুব বাড়াবাড়ি রকমের কাজের চাপ প্রায় নেই বললেই চলে। তাই সারাদিনে মোটামুটি গল্পগুজব ভালোই হয়। দুজনেই কাছাকাছি বয়সের হওয়ায়, এই অজ পাড়াগাঁয়ের অফিসের সহকর্মী দুজনের মধ্যে ভাব বেশ ভালো। মল্লিকার দিক থেকে ব্যাপারটা ভাবেই সীমিত। তবে আমার দিক থেকে ভালোবাসার চেষ্টাও যে নেই, তা বলা মিথ্যে।
মল্লিকা ভারী মিষ্টি একটি মেয়ে। লম্বায় প্রায় আমার সমান। ছিপছিপে চেহারা। ব্যক্তিত্বময়ী। ও আমার চেয়ে ঠিক এক বছরের বড়। শুরুতে আমি ওকে মল্লিকাদি বললেও, ওই একদিন বললো, "রুদ্র, এই দিদি দিদি বলিস না তো। বড্ড অসুবিধে হয়" ব্যস। আমিও লাইসেন্স পেয়ে গেলাম। মনে মনে যাকে অল্প হলেও ভালোবাসি, তাকে দিদি বলে ডাকতে অস্বস্তি হতই। যতই হোক, মধ্যবিত্ত বাঙালি বলে কথা। তা এ হেন অলিখিত পারমিশন পাওয়ার পর থেকে আমায় কে আটকায়। শুরু হয়ে গেল ভালোমতন ঠাট্টা ইয়ার্কি গুলতানি। সেই সুযোগে মাঝে মাঝেই হালকা ফ্লার্টও করেছি।
মল্লিকা সিঙ্গল। বছরখানেক আগে তনয়ের সাথে ওর ব্রেক আপ হয়েছে। আমি অবশ্য তার আগে থেকেই ওকে মনে মনে পছন্দ করি। মনের মধ্যে চাপ। ব্রেক আপের সময় ভালো বন্ধুর মতো ওকে সান্ত্বনা দিয়েছি, সঙ্গ দিয়েছি। সামনাসামনি খুব মন খারাপের ভান করলেও ভিতরে ভিতরে খুশিতে নেচেছি। মল্লিকা বোঝেনি। হয়তো। কিন্তু ইদানিং আমার ফ্লার্ট করাটা বেড়ে গিয়েছে। মল্লিকা বুঝতেও পারে। মানে, আমি বোঝাতে চাই বলেই বোঝে। যদিও পাত্তা দেয়না বিশেষ। তবু আমি মনে মনে আশা করে থাকি। যদি কোনোদিনও ওর মন গলে।
আমরা একসাথে মাঝে মাঝে টাউনে যাই। বাজারহাট করতে। সিনেমা দেখতে। আমি একদমই বলা চলে রান্না করতে পারি না। কাজের দিদি এসে রোজ রান্না করে দিয়ে যায়। মল্লিকা মাঝেসাঝে এটা ওটা রেঁধে নিয়ে আসে আমার জন্য। মল্লিকা আমিষ নিরামিষ সব রান্নায় পটু। আমি অনেকবার ওকে বলেছি আমার মায়ের হাতের পটলের দোরমা আমার খুব প্রিয় খাবার। কাজের দিদি একদম বানাতে পারে না। ও এতো রন্ধনপটিয়সী। ও যেন আমায় বানিয়ে খাওয়ায়। কিন্তু পটলের নামে ও এক্কেবারে মুখ ভ্যাটকায়। পটল নাকি ওর মতে সবচেয়ে খারাপ খেতে। অখাদ্য। টাউনে খেতে গেলে অর্ডার করতে দেয়না। এদিকে আমায় বসে বসে ওর সাথে বেগুনের বাসন্তী খেতে হয়। আমার বেগুনে চরম এলার্জি। যাই হোক।
মল্লিকার ফোনে ফিরি। ও বেশ উত্তেজিত অথচ আমুদে কণ্ঠে বললো, "শোন, রাত্রে তোর বাড়ি খাবো। ভাত বসা। বাকি আমি আসছি।" কে জানে, কী প্ল্যান ওর। এইরকম হুটহাট প্ল্যান অবশ্য ও আগেও করেছে। ও রেঁধেছে। আমরা একসাথে খেয়েছি। তারপর বসে ল্যাপটপে সিনেমা দেখেছি। আজও নিশ্চয়ই এর অন্যথা হবে না।
আধ ঘন্টার মধ্যে মল্লিকা এলো। এসেই দরজায় ধাক্কা। আমি দরজা খুলে দিলাম। ও ভিতরে ঢুকলো। একটা হালকা কমলা রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে। ভারী সুন্দর লাগছে খোলা চুলে। ওর হাত থেকে টিফিন ক্যারিয়ারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে ওকে বললাম, "তুমি বসো। আমি এটা টেবিলে রেখে আসছি। ভাত বসিয়েছি রাইসকুকারে। এক্ষুণি হয়ে যাবে।"
মল্লিকা বসলো না। হ্যান্ড ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে সোফায় ছুঁড়ে দিয়ে আমার পিছন পিছন খাবার ঘরে এলো। এক টুকরো হাসি মুখে মেখে বেশ একটা আদুরে গলায় বললো, "ভাত হলো? নিয়ে আয়। সুন্দর গন্ধ বেরিয়েছে।" বাবাঃ, এত উৎসাহ? ব্যাপার কী? আমি বললাম, "তুমি বসো না। আমি খাবার বেড়ে আনছি।" মল্লিকা রহস্যময়ী হাসি হেসে উত্তর দিলো, "উঁহু। আমিও থাকি। তুই ভাত আন। আমি বাড়বো।" মল্লিকা যখন ঠিক করেছে ও করবে, মানে ওই করবে। আমি হাজার বললেও শুনবে না। আমি চুপচাপ আর কোনো কথা না বলে রান্নাঘরে ঢুকে গেলাম। দুজনের জন্য দুটো থালায় ভাত বেড়ে ঘরে ঢুকতেই নাকে এলো একটা সুগন্ধি ঝাপ্টা। এ কী, এই গন্ধটা তো আমার ভীষণ চেনা। ভীষণ প্রিয়।
বড় জামবাটিতে জ্বলজ্বল করছে তেল মসলার রসায় নধর পটল। পটলের দোরমা। মায়ের রেসিপি।
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে। মল্লিকা মুচকি মুচকি হাসছে। আমার মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো, "কী, কেমন লাগলো সারপ্রাইজ?" আমি কী উত্তর দেবো, ভেবে পাচ্ছি না। এমন সময় মল্লিকা আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো, "পটলের দোরমাটা যদি সাকসেসফুল হয়, তাহলে ভাবছি কাকিমার কাছে এপ্লিকেশন দেবো। বৌমা পদের জন্য। ভালো রেকমেন্ডেশন দিবি তো?"
আমি এর কী উত্তর দিই? আমার গালদুটো তখন সামনে রাখা স্যালাডের টমেটোর মতোই লাল।
মল্লিকা ভারী মিষ্টি একটি মেয়ে। লম্বায় প্রায় আমার সমান। ছিপছিপে চেহারা। ব্যক্তিত্বময়ী। ও আমার চেয়ে ঠিক এক বছরের বড়। শুরুতে আমি ওকে মল্লিকাদি বললেও, ওই একদিন বললো, "রুদ্র, এই দিদি দিদি বলিস না তো। বড্ড অসুবিধে হয়" ব্যস। আমিও লাইসেন্স পেয়ে গেলাম। মনে মনে যাকে অল্প হলেও ভালোবাসি, তাকে দিদি বলে ডাকতে অস্বস্তি হতই। যতই হোক, মধ্যবিত্ত বাঙালি বলে কথা। তা এ হেন অলিখিত পারমিশন পাওয়ার পর থেকে আমায় কে আটকায়। শুরু হয়ে গেল ভালোমতন ঠাট্টা ইয়ার্কি গুলতানি। সেই সুযোগে মাঝে মাঝেই হালকা ফ্লার্টও করেছি।
মল্লিকা সিঙ্গল। বছরখানেক আগে তনয়ের সাথে ওর ব্রেক আপ হয়েছে। আমি অবশ্য তার আগে থেকেই ওকে মনে মনে পছন্দ করি। মনের মধ্যে চাপ। ব্রেক আপের সময় ভালো বন্ধুর মতো ওকে সান্ত্বনা দিয়েছি, সঙ্গ দিয়েছি। সামনাসামনি খুব মন খারাপের ভান করলেও ভিতরে ভিতরে খুশিতে নেচেছি। মল্লিকা বোঝেনি। হয়তো। কিন্তু ইদানিং আমার ফ্লার্ট করাটা বেড়ে গিয়েছে। মল্লিকা বুঝতেও পারে। মানে, আমি বোঝাতে চাই বলেই বোঝে। যদিও পাত্তা দেয়না বিশেষ। তবু আমি মনে মনে আশা করে থাকি। যদি কোনোদিনও ওর মন গলে।
আমরা একসাথে মাঝে মাঝে টাউনে যাই। বাজারহাট করতে। সিনেমা দেখতে। আমি একদমই বলা চলে রান্না করতে পারি না। কাজের দিদি এসে রোজ রান্না করে দিয়ে যায়। মল্লিকা মাঝেসাঝে এটা ওটা রেঁধে নিয়ে আসে আমার জন্য। মল্লিকা আমিষ নিরামিষ সব রান্নায় পটু। আমি অনেকবার ওকে বলেছি আমার মায়ের হাতের পটলের দোরমা আমার খুব প্রিয় খাবার। কাজের দিদি একদম বানাতে পারে না। ও এতো রন্ধনপটিয়সী। ও যেন আমায় বানিয়ে খাওয়ায়। কিন্তু পটলের নামে ও এক্কেবারে মুখ ভ্যাটকায়। পটল নাকি ওর মতে সবচেয়ে খারাপ খেতে। অখাদ্য। টাউনে খেতে গেলে অর্ডার করতে দেয়না। এদিকে আমায় বসে বসে ওর সাথে বেগুনের বাসন্তী খেতে হয়। আমার বেগুনে চরম এলার্জি। যাই হোক।
মল্লিকার ফোনে ফিরি। ও বেশ উত্তেজিত অথচ আমুদে কণ্ঠে বললো, "শোন, রাত্রে তোর বাড়ি খাবো। ভাত বসা। বাকি আমি আসছি।" কে জানে, কী প্ল্যান ওর। এইরকম হুটহাট প্ল্যান অবশ্য ও আগেও করেছে। ও রেঁধেছে। আমরা একসাথে খেয়েছি। তারপর বসে ল্যাপটপে সিনেমা দেখেছি। আজও নিশ্চয়ই এর অন্যথা হবে না।
আধ ঘন্টার মধ্যে মল্লিকা এলো। এসেই দরজায় ধাক্কা। আমি দরজা খুলে দিলাম। ও ভিতরে ঢুকলো। একটা হালকা কমলা রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে। ভারী সুন্দর লাগছে খোলা চুলে। ওর হাত থেকে টিফিন ক্যারিয়ারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে ওকে বললাম, "তুমি বসো। আমি এটা টেবিলে রেখে আসছি। ভাত বসিয়েছি রাইসকুকারে। এক্ষুণি হয়ে যাবে।"
মল্লিকা বসলো না। হ্যান্ড ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে সোফায় ছুঁড়ে দিয়ে আমার পিছন পিছন খাবার ঘরে এলো। এক টুকরো হাসি মুখে মেখে বেশ একটা আদুরে গলায় বললো, "ভাত হলো? নিয়ে আয়। সুন্দর গন্ধ বেরিয়েছে।" বাবাঃ, এত উৎসাহ? ব্যাপার কী? আমি বললাম, "তুমি বসো না। আমি খাবার বেড়ে আনছি।" মল্লিকা রহস্যময়ী হাসি হেসে উত্তর দিলো, "উঁহু। আমিও থাকি। তুই ভাত আন। আমি বাড়বো।" মল্লিকা যখন ঠিক করেছে ও করবে, মানে ওই করবে। আমি হাজার বললেও শুনবে না। আমি চুপচাপ আর কোনো কথা না বলে রান্নাঘরে ঢুকে গেলাম। দুজনের জন্য দুটো থালায় ভাত বেড়ে ঘরে ঢুকতেই নাকে এলো একটা সুগন্ধি ঝাপ্টা। এ কী, এই গন্ধটা তো আমার ভীষণ চেনা। ভীষণ প্রিয়।
বড় জামবাটিতে জ্বলজ্বল করছে তেল মসলার রসায় নধর পটল। পটলের দোরমা। মায়ের রেসিপি।
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে। মল্লিকা মুচকি মুচকি হাসছে। আমার মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো, "কী, কেমন লাগলো সারপ্রাইজ?" আমি কী উত্তর দেবো, ভেবে পাচ্ছি না। এমন সময় মল্লিকা আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো, "পটলের দোরমাটা যদি সাকসেসফুল হয়, তাহলে ভাবছি কাকিমার কাছে এপ্লিকেশন দেবো। বৌমা পদের জন্য। ভালো রেকমেন্ডেশন দিবি তো?"
আমি এর কী উত্তর দিই? আমার গালদুটো তখন সামনে রাখা স্যালাডের টমেটোর মতোই লাল।
Friday, September 27, 2019
কোনো ফ্লাইটে জানলার ধারের সীটটা সচারচর রুমুনের ভালো লাগে না। বরং আইলটাই ওর প্রেফারড সীট। কিন্তু ওই যে, পেঁজা তুলোর মধ্যে দিয়ে যখন প্লেনটা নামবে ক্রমশ, নীচে সেই চিরপরিচিত কংক্রিটের জঙ্গল, সরু সুতোর মতো গঙ্গা, কালো ধোঁয়ার আস্তরণ। কাঁচের জানলায় মাথা এলিয়ে দিয়ে তখন দু চোখ ভরে দেখতে ভালোবাসে ও। দীর্ঘ সাত আট ঘণ্টার বিমানযাত্রার শেষে ক্যাপ্টেনের কণ্ঠে "উই আর অ্যাবাউট টু ল্যান্ড অ্যাট দ্য নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ইন কলকাতা" যেন সেই ছোটবেলায় পড়া রূপকথার সোনার কাঠি। রুমুনের মনের মধ্যে তখন বাজতে থাকে ঢাকের ঢ্যাংকুরকুর, বিলিতি পারফিউমকে উপেক্ষা করে নাকে ভেসে আসে ছাতিম ফুলের পাগলকরা গন্ধ। বিদেশি বিমানসংস্থার সীটের কাভারে যেন দেখতে পায় ভোরের শিশির ভেজা সাদা শিউলির ঢেউ।
বিমানবন্দরের হইহই, রাস্তার যানজট, প্রিপেড ট্যাক্সির লম্বা লাইন। কেউ না। কেউ এই মুহূর্তে ওর জীবনে ভিলেন হয়ে আসতে পারবে না। আগামী কটাদিন শুধুই আনন্দ। শুধুই উৎসব।
ঘরে ফিরছে রুমুন। আরো অনেকের মতোই।
শারদোৎসবের আনন্দে মাততে। মায়ের স্নেহে। বাবার আদরে। বন্ধুদের আলিঙ্গনে। সদ্য কেনা শারদীয়ার সাদা কালো অক্ষরে।
এই পুজো সর্বজনীন। এই পুজো সার্বজনীন।
বিমানবন্দরের হইহই, রাস্তার যানজট, প্রিপেড ট্যাক্সির লম্বা লাইন। কেউ না। কেউ এই মুহূর্তে ওর জীবনে ভিলেন হয়ে আসতে পারবে না। আগামী কটাদিন শুধুই আনন্দ। শুধুই উৎসব।
ঘরে ফিরছে রুমুন। আরো অনেকের মতোই।
শারদোৎসবের আনন্দে মাততে। মায়ের স্নেহে। বাবার আদরে। বন্ধুদের আলিঙ্গনে। সদ্য কেনা শারদীয়ার সাদা কালো অক্ষরে।
এই পুজো সর্বজনীন। এই পুজো সার্বজনীন।
Wednesday, September 25, 2019
অষ্টমীর
অঞ্জলি চলছে দফায় দফায়। পাড়ার কাকীমারা ভিড় সামলে সকলকে পুজোর ফুল দিতে
ব্যস্ত। রুমুনও সাধ্যমতো ওদের সাহায্য করছে। হাতে হাতে ফুল এগিয়ে দেওয়া, এক
রাউন্ড অঞ্জলি হয়ে গেলে পুজোর ফুল ফেরত নেওয়ার জন্য ঝুড়ি এগিয়ে দেওয়া,
এইসব। ছোট থেকেই ও ওদের এই কমপ্লেক্সের পুজোতে হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করে
গিয়েছে, তাই এটা নতুন কিছু না। আশেপাশে আরো কিছু বাড়ি আছে, ওখানে পুজো হয়
না। তাই ভিড়টা বরাবরই লেগেই থাকে ওদের পুজোয়, বিশেষ করে অষ্টমীর সকালে।
সক্কাল সক্কাল স্নান সেরে সাদা আর গোলাপি রঙা লিনেনের শাড়ি পরে মণ্ডপে চলে এসেছে ও। মায়ের তাড়া খেয়ে বিশেষ সাজগোজ করা হয়ে ওঠেনি। ছোট্ট একটা টিপ, লিপগ্লস আর আলতো করে একটু কাজল। ভিজে চুল দিয়ে এখনো টপটপ করে জল পড়ছে। তবুও, দেখতে যে ওকে বেশ ভালো লাগছে, এ কথা রুমুন ভালোভাবেই বুঝেছে। অনেক্ষণ ধরেই মণ্ডপের এক কোণায় সাদা চেয়ারে বসে থাকা সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা এক সুদর্শন যুবকের মুগ্ধ দৃষ্টি ওকে অনুসরণ করে চলেছে। চোখাচুখি হতেই আলতো হেসে ঈষৎ রক্তিমবর্ণ গন্ডদেশকে উপেক্ষা করেই মাঝেমাঝেই চোখাচুখিটা দিব্যি বজায় রয়েছে। বেশ একটা রোমাঞ্চ লাগছে রুমুনের।
আর ঠিক এমনই সময় বিলিতি পাখির মিষ্টি টুইট টুইট শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল রুমুনের। অন্যান্যদিন এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙলে বড্ড বিরক্ত লাগে। কিন্তু আজ যে তার ভালোই ব্যতিক্রম, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। ঠোঁটের কোণে এখনো হালকা হাসি ছুঁয়ে আছে। রুমুন একবার এলার্মটা স্নুজ করলো। আলতো করে পর্দা সরিয়ে দেখলো, বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। উঁহু। এই ওয়েদারে কম্বলের তলা থেকে বেরোনো মহা পাপ। আজ স্টিভও ডে অফ নিয়েছে। পেন্ডিং কাজও তেমন নেই। একটু আলসেমি করাই যায়। তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি। প্যান্ডেলের কোণে বসে মুগ্ধ এক জোড়া চোখ যে ব্যাকুল হয়ে খুঁজে চলেছে সাদা গোলাপি লিনেনকে। মনে মনেই হেসে রুমুন আবার ঢুকে গেলো কম্বলের ওমে। হোকই না স্বপ্ন। মনটা ভালো তো হবে। তা ছাড়া, ভোরের স্বপ্ন। সত্যি না হয়ে যায় কোথায়...
পুজোয় তো সেও আছে এবারে।
"যা দেবী সর্বভূতেষু নিদ্রারূপেণ সংস্থিতা"
সক্কাল সক্কাল স্নান সেরে সাদা আর গোলাপি রঙা লিনেনের শাড়ি পরে মণ্ডপে চলে এসেছে ও। মায়ের তাড়া খেয়ে বিশেষ সাজগোজ করা হয়ে ওঠেনি। ছোট্ট একটা টিপ, লিপগ্লস আর আলতো করে একটু কাজল। ভিজে চুল দিয়ে এখনো টপটপ করে জল পড়ছে। তবুও, দেখতে যে ওকে বেশ ভালো লাগছে, এ কথা রুমুন ভালোভাবেই বুঝেছে। অনেক্ষণ ধরেই মণ্ডপের এক কোণায় সাদা চেয়ারে বসে থাকা সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা এক সুদর্শন যুবকের মুগ্ধ দৃষ্টি ওকে অনুসরণ করে চলেছে। চোখাচুখি হতেই আলতো হেসে ঈষৎ রক্তিমবর্ণ গন্ডদেশকে উপেক্ষা করেই মাঝেমাঝেই চোখাচুখিটা দিব্যি বজায় রয়েছে। বেশ একটা রোমাঞ্চ লাগছে রুমুনের।
আর ঠিক এমনই সময় বিলিতি পাখির মিষ্টি টুইট টুইট শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল রুমুনের। অন্যান্যদিন এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙলে বড্ড বিরক্ত লাগে। কিন্তু আজ যে তার ভালোই ব্যতিক্রম, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। ঠোঁটের কোণে এখনো হালকা হাসি ছুঁয়ে আছে। রুমুন একবার এলার্মটা স্নুজ করলো। আলতো করে পর্দা সরিয়ে দেখলো, বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। উঁহু। এই ওয়েদারে কম্বলের তলা থেকে বেরোনো মহা পাপ। আজ স্টিভও ডে অফ নিয়েছে। পেন্ডিং কাজও তেমন নেই। একটু আলসেমি করাই যায়। তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি। প্যান্ডেলের কোণে বসে মুগ্ধ এক জোড়া চোখ যে ব্যাকুল হয়ে খুঁজে চলেছে সাদা গোলাপি লিনেনকে। মনে মনেই হেসে রুমুন আবার ঢুকে গেলো কম্বলের ওমে। হোকই না স্বপ্ন। মনটা ভালো তো হবে। তা ছাড়া, ভোরের স্বপ্ন। সত্যি না হয়ে যায় কোথায়...
পুজোয় তো সেও আছে এবারে।
"যা দেবী সর্বভূতেষু নিদ্রারূপেণ সংস্থিতা"
Tuesday, September 24, 2019
এ
কদিন ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে কাটছে রুমুনের। একগাদা ডেডলাইন। গুচ্ছের
প্রেজেন্টেশন। লেখালিখি। প্রায় পাগল পাগল অবস্থা। রিসার্চটা একদম গুটিয়ে
এনেছে প্রায়। তারই মধ্যে শেষ মুহূর্তের হাজার ব্যস্ততার ভিতরেও কোথাও গিয়ে
একটা অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে আছে রুমুনের মন।
এই তো যেমন আজ। ভারলেট এলগরিদ্ম সল্ভ করতে বসে নাকানি চোবানি অবস্থা। এক ঘন্টার মধ্যে সলিউশন বের করে সুপারভাইজরকে দিতে হবেই হবে। তারই মধ্যে হঠাৎ করে ইউটিউবের অটো প্লেলিস্টে বেজে উঠলো "মঙ্গলদীপ জ্বেলে"। মনে পড়ে গেলো, সেই নার্সারি ক্লাসে পড়াকালীন হাউজিং কমপ্লেক্সের পুজোর অনুষ্ঠানের কথা। মা সেবার কালীঘাট থেকে কিনে এনে দিয়েছিল লাল পাড় সাদা শাড়ি। ওই পুঁচকি বয়সে সে কী আনন্দ। পাড়ার দোকান থেকে কেনা লাল সাদা প্লাস্টিকের ব্যাঙ্গেল। বাড়িতে সেই ছবি মা এখনো যত্ন করে রেখে দিয়েছে। লাল লিপস্টিকের পাকাবুড়ি।
সেদিনও যেমন ভয়ানক স্টেজ ফ্রাইট কাটিয়ে মিষ্টি করে গান গেয়ে সবার ভালোবাসা কুড়িয়ে নিয়েছিল সেই ছোট্ট রুমুন, এবারও তো অমন সুযোগ এলো বলে।
সপ্তমীর রিহার্সাল যে ইতিমধ্যেই স্কাইপে পুরোদমে চলছে।
পেন্ডিং যাবতীয় কাজ শেষ করেই মুক্তি। এক রাশ আনন্দ। ভালোলাগা। উৎসব। নতুন করে কুড়িয়ে পাওয়া উদ্যম নিয়ে রুমুন লেগে পড়ে অঙ্কের জালে।
"যা দেবী সর্বভূতেষু, বুদ্ধিরূপেণ সংস্থিতা"
এই তো যেমন আজ। ভারলেট এলগরিদ্ম সল্ভ করতে বসে নাকানি চোবানি অবস্থা। এক ঘন্টার মধ্যে সলিউশন বের করে সুপারভাইজরকে দিতে হবেই হবে। তারই মধ্যে হঠাৎ করে ইউটিউবের অটো প্লেলিস্টে বেজে উঠলো "মঙ্গলদীপ জ্বেলে"। মনে পড়ে গেলো, সেই নার্সারি ক্লাসে পড়াকালীন হাউজিং কমপ্লেক্সের পুজোর অনুষ্ঠানের কথা। মা সেবার কালীঘাট থেকে কিনে এনে দিয়েছিল লাল পাড় সাদা শাড়ি। ওই পুঁচকি বয়সে সে কী আনন্দ। পাড়ার দোকান থেকে কেনা লাল সাদা প্লাস্টিকের ব্যাঙ্গেল। বাড়িতে সেই ছবি মা এখনো যত্ন করে রেখে দিয়েছে। লাল লিপস্টিকের পাকাবুড়ি।
সেদিনও যেমন ভয়ানক স্টেজ ফ্রাইট কাটিয়ে মিষ্টি করে গান গেয়ে সবার ভালোবাসা কুড়িয়ে নিয়েছিল সেই ছোট্ট রুমুন, এবারও তো অমন সুযোগ এলো বলে।
সপ্তমীর রিহার্সাল যে ইতিমধ্যেই স্কাইপে পুরোদমে চলছে।
পেন্ডিং যাবতীয় কাজ শেষ করেই মুক্তি। এক রাশ আনন্দ। ভালোলাগা। উৎসব। নতুন করে কুড়িয়ে পাওয়া উদ্যম নিয়ে রুমুন লেগে পড়ে অঙ্কের জালে।
"যা দেবী সর্বভূতেষু, বুদ্ধিরূপেণ সংস্থিতা"
Sunday, September 22, 2019
সুদূর লন্ডনে এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙে রুমুনের। ভোর চারটে। গতকাল অনেক রাত অবধি জেগে ক্লাসের প্রেজেন্টেশন বানিয়েছিল ও। এখনো তাই চোখে ঘুম লেগে আছে। সেই ঘুম ঘুম চোখেই এলেক্সাকে বলে, "প্লে মহিষাসুরমর্দিনী এলেক্সা।" ইকো ডট স্পিকারে গমগম করে ওঠে শঙ্খধ্বনি। আর সাথে সাথেই সেই চিরপরিচিত ব্যারিটোনের হাত ধরেই সূচনা হয় দেবীপক্ষের।
বাইরে বেশ শিরশিরে ঠান্ডা। গায়ের কম্বলটা আরো একটু আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেয় রুমুন। হাতে মোবাইল। হোয়াটসআপে স্কুলের বন্ধুদের গ্রুপে ছোট্ট একটা মেসেজ ছেড়ে রাখে ও। "তাহলে ষষ্ঠী, যাদবপুর থানা। ১১:৩০টা তো?" স্কুল ছাড়ার এতগুলো বছর পর, আবার চারমূর্তির পুজোয় একসাথে বেরোনোর প্ল্যান। চোখ বুজে আসে আরামে। আনন্দে।
ঘুম ভাঙে "রূপং দেহি জয়ং দেহি"র সুরে।
কিছু কিছু জিনিস সেই সনাতনী রয়েই যায়। ভাগ্যিস।
বাইরে বেশ শিরশিরে ঠান্ডা। গায়ের কম্বলটা আরো একটু আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেয় রুমুন। হাতে মোবাইল। হোয়াটসআপে স্কুলের বন্ধুদের গ্রুপে ছোট্ট একটা মেসেজ ছেড়ে রাখে ও। "তাহলে ষষ্ঠী, যাদবপুর থানা। ১১:৩০টা তো?" স্কুল ছাড়ার এতগুলো বছর পর, আবার চারমূর্তির পুজোয় একসাথে বেরোনোর প্ল্যান। চোখ বুজে আসে আরামে। আনন্দে।
ঘুম ভাঙে "রূপং দেহি জয়ং দেহি"র সুরে।
কিছু কিছু জিনিস সেই সনাতনী রয়েই যায়। ভাগ্যিস।
Sunday, September 8, 2019
দেবী
গতকাল রাত্রে মুম্বাইয়ের এক লাউঞ্জ বারের ঘটনা। দেবিকা ওর সহকর্মীদের সাথে গিয়েছে, একটা সাংঘাতিক ব্যস্ত সপ্তাহের শেষে একটু রিল্যাক্স করতে। বেশ কয়েক রাউন্ড মদ্যপান ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। দেবিকার মাথাটা কেমন জানি ঝিম মেরে আছে। ভেবেছিল হাল্কা হবে, হয়নি। উল্টে যেন আরো বেশিই অস্বস্তি হচ্ছে। ও আসতে চায়নি। কিন্তু রুহি, ওর রুমমেট, যে কিনা আবার কলিগও, ওকে একটু জোর করলো। বললো, "আরে ইয়ার, আর কত এমনি আপনে আপ কে কষ্ট দিবি। এক তো অফিস কা ইতনা ঝুট ঝামেলে। উপর সে তেরা ও আশিক। বস কর। একদিন দারু পী লে। মজা আয়গা।" দেবিকা না বলতে পারেনি। ভেবেছিল রুহির কথায় যুক্তি আছে। রোহন যেন ওর জীবনে আবার ফিরবো ফিরবো করছে। বাড়তি ঝঞ্ঝাট।
রোহন ওর প্রাক্তন। স্কুলজীবনের বন্ধু। প্রায় দশ বছর ডেট করার পর যখন দুই বাড়ি থেকে কথাবার্তা বলে বিয়ের ডেট পর্যন্ত ঠিক হয়ে যায়, রোহন অফিসের কাজে লন্ডন যায় দু মাসের জন্য। এবং সেখানে গিয়ে এক পাকিস্তানী মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খায়। সৌভাগ্যক্রমে সোশ্যাল মিডিয়ায় ও কম পটু হওয়ায়, দেবিকা জানতে পারে গোটা ব্যাপারটা। রোহন প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার করতে বাধ্য হয়। দুই বাড়ির মধ্যে ঝগড়াঝাটি, কেচ্ছা কেলেঙ্কারি বাদানুবাদ চলে। বিয়ে বাতিল হয়। আস্তে আস্তে সব চাপাও পড়ে যায়। দেবিকার হৃদয়ের ক্ষতস্থান এখন আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ। অন্তত এমনটাই ভেবেছিল।
কিন্তু নিজের ভুল বুঝলো এক মাস আগে। ওদের মুম্বাই অফিসে যোগ দিল রোহন। দেবিকারই টিমে। এখন একটা বড় প্রজেক্টের কাজ চলছে। তাই সর্বক্ষণ একসাথে ওঠা বসা। দেবিকার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকে। কথায় কথায় রোহনের ওর সাথে দরকারের চেয়ে বেশিই কথা বলার চেষ্টা, ঘনিষ্ঠ হওয়ার প্রবণতা। দেবিকা সহ্য করতে পারে না। একবার দুবার ও স্পষ্ট করে বলেছে রোহনকে। কিন্তু রোহন পাত্তা দেয়নি। দেবিকা ঠিক করেছে, এইচ আরে কমপ্লেন করবে।
এইসবের মধ্যেই এই লাউঞ্জে আসা। রুহি, শালিনী আর মধুরের সাথে। এবং এখানে এসেও শক। অদূরে একটা টেবিলে বসে আছে রোহন। একা এক ড্রিংক করছে। আর সমানে দেবিকাদের টেবিলের দিকে তাকাচ্ছে। দেবিকার মাথা গরম হতে লাগলো। রাগে কপালের শিরা দপদপ করছে। লাউঞ্জে মিউজিক আরো জোরে বাজছে। ডিজে মনের সুখে ফ্রাইডে নাইট পালন করছে। এমন সময়, রোহন হঠাৎ করেই এগিয়ে এলো ওদের টেবিলের দিকে। এসে সোজা দাঁড়ালো দেবিকার সামনে। হাঁটু গেড়ে বসে ওর দিকে এক হাত বাড়িয়ে বললো, "উইল ইউ ডান্স উইথ মি? প্লিজ?" দেবিকা থ। রুহি শালিনী মধুর সব্বাই হতবাক। আসে পাশের টেবিলের লোকজন অবশ্য গান, মদ আর খাওয়া নিয়েই ব্যস্ত। এদিকে কারুর চোখ কান নেই। দেবিকা ঠান্ডা গলায় বলল, "সিন ক্রিয়েট করোনা রোহন। জাস্ট লিভ।" রোহন নাছোড়বান্দা। বসেই রইলো। দেবিকার হাতটা এবার সাহস করে ধরে আবার বললো, কাতর কণ্ঠে, "প্লিজ, ওয়ান ডান্স?" দেবিকা রাগে ঘামছে। ঠোঁটের ওপর, কপালের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। ও এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, "লিভ, এলস আই উইল কল সিকিউরিটি।" রোহন আচ্ছা জেদী। কোনো মেয়ে ওর কথায় সায় দিচ্ছে না, পৌরুষে গিয়ে আঘাত করলো। হিংস্র স্বরে ও চিৎকার করে বললো, "নাচবি না মানে? নাচতেই হবে। সবার সাথে নাচবি। সবার সাথে শুবি। আর আমার সাথে নাচতে হলেই এই? আমি সব জানি। শালী, নাচতে তো তোকে হবেই। শুতেও হবে আমার সাথে।"
রুহি অল্প অল্প বাংলা বোঝে। ইতিমধ্যে যে ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে ও বুদ্ধি করে মধুরের মারফত লাউঞ্জ বারের সিকিউরিটি ডাকিয়ে নেয়। তারপর সিকিউরিটির সাথে চলে রোহনের এক প্রস্থ হাতাহাতি মারামারি। ধস্তাধস্তিতে টেবিলের কোণে ধাক্কা লেগে রোহনের ঠোঁটের পাশে কেটে যায়। রক্ত বেরোতে থাকে। সিকিউরিটি ওকে বের করে দেয়। ম্যানেজার এসে দেবিকাদের কাছে প্রভূত ক্ষমা চেয়ে যায়। "ইয়ার ইসনে পুরা মুড খরাব কর দিয়া", রুহি আক্ষেপ করে। শালিনী আর মধুরেরও ইচ্ছে নেই বসে থাকার। দেবিকা ওদেরকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
ফ্ল্যাটে ফিরে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে খাটে শুয়ে কাঁদতে থাকে দেবিকা। এত অপমান? এত রাগ? এত ঘেন্না? যাকে একদিন ভালোবেসেছিল, তার থেকে এরকম ব্যবহার? আদৌ কি কোনদিনও রোহন ওকে ভালোবাসতো? নাকি সবই দেখনদারী। দেবিকা বিহ্বল হয়ে যায়। চোখ বন্ধ করলে সিনেমার মতো আগে একসাথে কাটানো ভালো ভালো মুহূর্তগুলো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। আর সেই মিষ্টি দৃশ্যের মধ্যে তাল কাটতে আসে আজকের লাউঞ্জ বারের এই কর্কশ চিৎকার, দুর্ব্যবহার। রোহনের রক্তাক্ত মুখটা ভাবতে ভাবতে এক ঝটকায় চোখ খুলে ফেলে। সারা রাত দেবিকা এপাশ ওপাশ করতে থাকে খাটে। মধ্যে মধ্যে উঠে বেসিন থেকে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দেয় মুখে চোখে। কিন্তু আরাম পায় না। জানলার ধারে এসে চুপ করে বসে থাকে ও। ক্রমে আকাশ ফর্সা হয়।
কফি বানায়। কফি খেতে খেতে দেবিকা সিদ্ধান্ত নেয়। রোহনের সাথে দেখা করবে। ঝটপট তৈরি হয়ে ক্যাব ডাকে। পনেরো মিনিটে পৌঁছে যায় রোহনের বাড়ি। দরজায় কড়া নাড়ে। বেশ খানিকক্ষণ পর ঘুম ঘুম চোখে এসে দরজা খোলা রোহন। গা দিয়ে বিদেশি মদের গন্ধ। চোখগুলো ঢুলুঢুলু। দেবিকাকে দরজায় দেখে একটু অবাক হয়েই বললো,
- গুড মর্নিং বেবি। এসো।
- রোহন..
- এসো। বসো।
- না রোহন। বসতে আসিনি। কিছু কথা বলার ছিল।
- সে বলবে। দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাকি?
- রোহন কাল রাতে..
- কাল রাতে?
- যা ঘটলো, তা ঠিক..
- আই নো, আই নো বেবি।
- লুক, রোহন। আই
- ইটস নট ওকে বেবি। বাট আই ক্যান ফোর্গেট ইট ইফ..
দেবিকা অধৈর্য্য হয়ে উঠছে। কিছুতেই ওকে কথা শেষ করতে দিচ্ছে না। এবারে প্রায় মরিয়া হয়েই ও বললো, "লেট মি ফিনিশ রোহন।"
- ফিনিশ করতে হবে না বেবি। আই নো। কাল আমার টাচ পেয়ে পরে তুমি আরাউজড হয়েছিলে। এন্ড লেটার ইউ রিপেন্টেড। রাইট? ইউ ওয়ান্ট টু কাম ব্যাক টু মি? লেটস হ্যাভ এ ট্রায়াল ফার্স্ট বেবি।"
- লিসিন রোহন, লেট মি প্রিক ইয়োর বাবল। আমি এটাই বলতে এসেছিলাম যে কাল রাত যা হলো লাউঞ্জে, ঠিক হয়েছে। আই এম নট সরি ফর ইট এট অল। ইউ ডিজার্ভড ইট। আই কেম টু ওয়ার্ন ইউ। কালকের ঘটনার সাক্ষী অনেকেই আছে। তুমি যদি আর একবার আমায় ডিস্টার্ব করতে আসো, আই উইল গো টু দ্য পুলিস। ডু ইউ গেট দ্যাট? নাউ গো টু হেল ড্যাম ইট।"
রোহনের নেশা এক লহমায় গায়েব। চিরকাল যে নিজে অন্যের ওপর জোর খাটিয়ে গিয়েছে, একদা নরম স্বভাবের একটা মেয়ে এসে এরকম কথা শুনিয়ে গেল। ও ভাবতে পারছে না। নেশা উড়ে গিয়েছে। মাথায় হাত চেপে সোফা ভর করে মেঝেতে বসে ও।
দেবিকা গটগট করে শব্দ করে এগিয়ে যায় লিফটের দিকে। অনেক দিন পর, আজ ও মাথা উঁচু করে হাঁটছে।
ফ্ল্যাটের মার্বেলের মেঝেটা ঠান্ডা। খুব ঠান্ডা। কিন্তু আরো ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে যায় রোহনের শিরদাঁড়া দিয়ে। মনে পড়ে যায় হঠাৎ, দেবীপক্ষ আসতে আর বেশিদিন নেই।
গতকাল রাত্রে মুম্বাইয়ের এক লাউঞ্জ বারের ঘটনা। দেবিকা ওর সহকর্মীদের সাথে গিয়েছে, একটা সাংঘাতিক ব্যস্ত সপ্তাহের শেষে একটু রিল্যাক্স করতে। বেশ কয়েক রাউন্ড মদ্যপান ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। দেবিকার মাথাটা কেমন জানি ঝিম মেরে আছে। ভেবেছিল হাল্কা হবে, হয়নি। উল্টে যেন আরো বেশিই অস্বস্তি হচ্ছে। ও আসতে চায়নি। কিন্তু রুহি, ওর রুমমেট, যে কিনা আবার কলিগও, ওকে একটু জোর করলো। বললো, "আরে ইয়ার, আর কত এমনি আপনে আপ কে কষ্ট দিবি। এক তো অফিস কা ইতনা ঝুট ঝামেলে। উপর সে তেরা ও আশিক। বস কর। একদিন দারু পী লে। মজা আয়গা।" দেবিকা না বলতে পারেনি। ভেবেছিল রুহির কথায় যুক্তি আছে। রোহন যেন ওর জীবনে আবার ফিরবো ফিরবো করছে। বাড়তি ঝঞ্ঝাট।
রোহন ওর প্রাক্তন। স্কুলজীবনের বন্ধু। প্রায় দশ বছর ডেট করার পর যখন দুই বাড়ি থেকে কথাবার্তা বলে বিয়ের ডেট পর্যন্ত ঠিক হয়ে যায়, রোহন অফিসের কাজে লন্ডন যায় দু মাসের জন্য। এবং সেখানে গিয়ে এক পাকিস্তানী মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খায়। সৌভাগ্যক্রমে সোশ্যাল মিডিয়ায় ও কম পটু হওয়ায়, দেবিকা জানতে পারে গোটা ব্যাপারটা। রোহন প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার করতে বাধ্য হয়। দুই বাড়ির মধ্যে ঝগড়াঝাটি, কেচ্ছা কেলেঙ্কারি বাদানুবাদ চলে। বিয়ে বাতিল হয়। আস্তে আস্তে সব চাপাও পড়ে যায়। দেবিকার হৃদয়ের ক্ষতস্থান এখন আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ। অন্তত এমনটাই ভেবেছিল।
কিন্তু নিজের ভুল বুঝলো এক মাস আগে। ওদের মুম্বাই অফিসে যোগ দিল রোহন। দেবিকারই টিমে। এখন একটা বড় প্রজেক্টের কাজ চলছে। তাই সর্বক্ষণ একসাথে ওঠা বসা। দেবিকার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকে। কথায় কথায় রোহনের ওর সাথে দরকারের চেয়ে বেশিই কথা বলার চেষ্টা, ঘনিষ্ঠ হওয়ার প্রবণতা। দেবিকা সহ্য করতে পারে না। একবার দুবার ও স্পষ্ট করে বলেছে রোহনকে। কিন্তু রোহন পাত্তা দেয়নি। দেবিকা ঠিক করেছে, এইচ আরে কমপ্লেন করবে।
এইসবের মধ্যেই এই লাউঞ্জে আসা। রুহি, শালিনী আর মধুরের সাথে। এবং এখানে এসেও শক। অদূরে একটা টেবিলে বসে আছে রোহন। একা এক ড্রিংক করছে। আর সমানে দেবিকাদের টেবিলের দিকে তাকাচ্ছে। দেবিকার মাথা গরম হতে লাগলো। রাগে কপালের শিরা দপদপ করছে। লাউঞ্জে মিউজিক আরো জোরে বাজছে। ডিজে মনের সুখে ফ্রাইডে নাইট পালন করছে। এমন সময়, রোহন হঠাৎ করেই এগিয়ে এলো ওদের টেবিলের দিকে। এসে সোজা দাঁড়ালো দেবিকার সামনে। হাঁটু গেড়ে বসে ওর দিকে এক হাত বাড়িয়ে বললো, "উইল ইউ ডান্স উইথ মি? প্লিজ?" দেবিকা থ। রুহি শালিনী মধুর সব্বাই হতবাক। আসে পাশের টেবিলের লোকজন অবশ্য গান, মদ আর খাওয়া নিয়েই ব্যস্ত। এদিকে কারুর চোখ কান নেই। দেবিকা ঠান্ডা গলায় বলল, "সিন ক্রিয়েট করোনা রোহন। জাস্ট লিভ।" রোহন নাছোড়বান্দা। বসেই রইলো। দেবিকার হাতটা এবার সাহস করে ধরে আবার বললো, কাতর কণ্ঠে, "প্লিজ, ওয়ান ডান্স?" দেবিকা রাগে ঘামছে। ঠোঁটের ওপর, কপালের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। ও এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, "লিভ, এলস আই উইল কল সিকিউরিটি।" রোহন আচ্ছা জেদী। কোনো মেয়ে ওর কথায় সায় দিচ্ছে না, পৌরুষে গিয়ে আঘাত করলো। হিংস্র স্বরে ও চিৎকার করে বললো, "নাচবি না মানে? নাচতেই হবে। সবার সাথে নাচবি। সবার সাথে শুবি। আর আমার সাথে নাচতে হলেই এই? আমি সব জানি। শালী, নাচতে তো তোকে হবেই। শুতেও হবে আমার সাথে।"
রুহি অল্প অল্প বাংলা বোঝে। ইতিমধ্যে যে ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে ও বুদ্ধি করে মধুরের মারফত লাউঞ্জ বারের সিকিউরিটি ডাকিয়ে নেয়। তারপর সিকিউরিটির সাথে চলে রোহনের এক প্রস্থ হাতাহাতি মারামারি। ধস্তাধস্তিতে টেবিলের কোণে ধাক্কা লেগে রোহনের ঠোঁটের পাশে কেটে যায়। রক্ত বেরোতে থাকে। সিকিউরিটি ওকে বের করে দেয়। ম্যানেজার এসে দেবিকাদের কাছে প্রভূত ক্ষমা চেয়ে যায়। "ইয়ার ইসনে পুরা মুড খরাব কর দিয়া", রুহি আক্ষেপ করে। শালিনী আর মধুরেরও ইচ্ছে নেই বসে থাকার। দেবিকা ওদেরকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
ফ্ল্যাটে ফিরে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে খাটে শুয়ে কাঁদতে থাকে দেবিকা। এত অপমান? এত রাগ? এত ঘেন্না? যাকে একদিন ভালোবেসেছিল, তার থেকে এরকম ব্যবহার? আদৌ কি কোনদিনও রোহন ওকে ভালোবাসতো? নাকি সবই দেখনদারী। দেবিকা বিহ্বল হয়ে যায়। চোখ বন্ধ করলে সিনেমার মতো আগে একসাথে কাটানো ভালো ভালো মুহূর্তগুলো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। আর সেই মিষ্টি দৃশ্যের মধ্যে তাল কাটতে আসে আজকের লাউঞ্জ বারের এই কর্কশ চিৎকার, দুর্ব্যবহার। রোহনের রক্তাক্ত মুখটা ভাবতে ভাবতে এক ঝটকায় চোখ খুলে ফেলে। সারা রাত দেবিকা এপাশ ওপাশ করতে থাকে খাটে। মধ্যে মধ্যে উঠে বেসিন থেকে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দেয় মুখে চোখে। কিন্তু আরাম পায় না। জানলার ধারে এসে চুপ করে বসে থাকে ও। ক্রমে আকাশ ফর্সা হয়।
কফি বানায়। কফি খেতে খেতে দেবিকা সিদ্ধান্ত নেয়। রোহনের সাথে দেখা করবে। ঝটপট তৈরি হয়ে ক্যাব ডাকে। পনেরো মিনিটে পৌঁছে যায় রোহনের বাড়ি। দরজায় কড়া নাড়ে। বেশ খানিকক্ষণ পর ঘুম ঘুম চোখে এসে দরজা খোলা রোহন। গা দিয়ে বিদেশি মদের গন্ধ। চোখগুলো ঢুলুঢুলু। দেবিকাকে দরজায় দেখে একটু অবাক হয়েই বললো,
- গুড মর্নিং বেবি। এসো।
- রোহন..
- এসো। বসো।
- না রোহন। বসতে আসিনি। কিছু কথা বলার ছিল।
- সে বলবে। দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাকি?
- রোহন কাল রাতে..
- কাল রাতে?
- যা ঘটলো, তা ঠিক..
- আই নো, আই নো বেবি।
- লুক, রোহন। আই
- ইটস নট ওকে বেবি। বাট আই ক্যান ফোর্গেট ইট ইফ..
দেবিকা অধৈর্য্য হয়ে উঠছে। কিছুতেই ওকে কথা শেষ করতে দিচ্ছে না। এবারে প্রায় মরিয়া হয়েই ও বললো, "লেট মি ফিনিশ রোহন।"
- ফিনিশ করতে হবে না বেবি। আই নো। কাল আমার টাচ পেয়ে পরে তুমি আরাউজড হয়েছিলে। এন্ড লেটার ইউ রিপেন্টেড। রাইট? ইউ ওয়ান্ট টু কাম ব্যাক টু মি? লেটস হ্যাভ এ ট্রায়াল ফার্স্ট বেবি।"
- লিসিন রোহন, লেট মি প্রিক ইয়োর বাবল। আমি এটাই বলতে এসেছিলাম যে কাল রাত যা হলো লাউঞ্জে, ঠিক হয়েছে। আই এম নট সরি ফর ইট এট অল। ইউ ডিজার্ভড ইট। আই কেম টু ওয়ার্ন ইউ। কালকের ঘটনার সাক্ষী অনেকেই আছে। তুমি যদি আর একবার আমায় ডিস্টার্ব করতে আসো, আই উইল গো টু দ্য পুলিস। ডু ইউ গেট দ্যাট? নাউ গো টু হেল ড্যাম ইট।"
রোহনের নেশা এক লহমায় গায়েব। চিরকাল যে নিজে অন্যের ওপর জোর খাটিয়ে গিয়েছে, একদা নরম স্বভাবের একটা মেয়ে এসে এরকম কথা শুনিয়ে গেল। ও ভাবতে পারছে না। নেশা উড়ে গিয়েছে। মাথায় হাত চেপে সোফা ভর করে মেঝেতে বসে ও।
দেবিকা গটগট করে শব্দ করে এগিয়ে যায় লিফটের দিকে। অনেক দিন পর, আজ ও মাথা উঁচু করে হাঁটছে।
ফ্ল্যাটের মার্বেলের মেঝেটা ঠান্ডা। খুব ঠান্ডা। কিন্তু আরো ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে যায় রোহনের শিরদাঁড়া দিয়ে। মনে পড়ে যায় হঠাৎ, দেবীপক্ষ আসতে আর বেশিদিন নেই।
Sunday, September 1, 2019
আলোতে আলো ঢাকা ৬
সন্ধ্যে নেমে আসে বম্বের রাস্তায়। চিকচিক করছে সমুদ্রের তট। পৃথা আর উপমন্যু আস্তে আস্তে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে ব্যান্ডরার রাস্তা বরাবর। পাশ দিয়ে ঝাঁ চকচকে গাড়ি হুহু করে ছুটে চলে। অটোগুলো যেতে যেতে একবার ওদের পাশে এসে স্পিড কমায়, সওয়ারীর আশায়। পৃথা একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে এখনো। সব শাহরুখ ফ্যানের মতোই ও আজ উপমন্যুর সাথে এসেছিল "মন্নত" দেখতে। খুব মন দিয়ে হাঁ করে উপরে তাকিয়ে ছিল, বারান্দার দিকে। যদি ভুলেও এক ঝলক দেখতে পাওয়া যায় স্বপ্নের মানুষটাকে। না, দেখা মেলেনি ঠিকই। আরো কিছু এস আর কে ফ্যানদের মতোই মন্নত লেখাটার সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলেছে বটে। কিন্তু এই অভিজ্ঞতাই মন ভালো করে দিয়েছে।
উপমন্যু গোটা সময়টা পৃথার দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিল। একটা আপাত ধীর স্থির ম্যাচিয়র্ড মেয়ে যে এক ফিল্ম স্টারের বাড়ির সামনে এসে এরকম পাগলামি করতে পারে, ভেবেই অবাক। তবু, ভালো লাগে ওর। এই ছেলেমানুষি, এই আবেগ, এগুলোই তো বেঁচে থাকার রসদ। ওরা হাঁটতে থাকে। এদিক ওদিক গল্প করে। শাহরুখের সিনেমা নিয়ে। বলিউড নিয়ে। নাইন্টিজের গান নিয়ে। এমন সময় পৃথার মোবাইলটা বেজে ওঠে। উফ। "বড্ড ভিলেন তো দেখি আপনার এই ফোনটা?" উপমন্যু মিথ্যে রাগের স্বরে বলে। পৃথা হাসে। ফোনের স্ক্রিনে দেখে আবারও ঋষির নাম। নাঃ। এইবার একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। উপমন্যুকে একটু থামতে বলে। তারপর ফোনটা রিসিভ করে বলে, "কেমন আছো ঋষি?"
- ভালো। তুমি?
- খুউউব ভালো।
- একটা কথা বলার ছিল।
- বিয়ে করছো, জানি। সুদেষ্ণা বলেছে। কংগ্র্যাটস। অন্য কোনো বক্তব্য থাকলে বলো?
- পারলে আমায় ক্ষমা করে দেবে প্লিজ? আমি তোমায় ঠকিয়েছি।
- রিয়েলাইজ করেছ তো? এতেই হবে। ভালো থেকো। আর প্লিজ, যোগাযোগ, রেখো না।
পৃথা ফোনটা ছেড়ে দেয়। খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর সারা শরীর কাঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। খুব। খুউউব। পাশে দাঁড়ানো উপমন্যু বিহ্বল হয়ে যায়। কী করবে, কিচ্ছু বোঝে না। স্ক্রিপ্টের পর স্ক্রিপ্ট লিখতে পারে, বিজ্ঞাপনের কপি লিখতে এক্সপার্ট। কিন্তু পাশে দাঁড়ানো খুব কাছের মানুষটাকে কাঁদতে দেখে যে কী করবে, ভেবে পায় না। পৃথা ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে চোখ নাক মুছতে মুছতে বলে, "দেখছেন আমি কাঁদছি, একটু কান্না থামানোর চেষ্টাও করবেন না?" উপমন্যু ভ্যাবলার মতোই দাঁড়িয়ে থাকে এখনো। "সবই দেখি আমায় বলতে হবে। উফ। নিন। রুমাল দেওয়ার সুযোগ হারালেন। এবার অন্তত আইসক্রিম খাওয়াতে অফার করুন!"
উপমন্যুর মনে পড়ে যায় নিজের লেখা পুরোনো স্ক্রিপ্ট। একটু ইতস্তত করেই ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে পৃথার কাঁধে। পৃথা যেন এই স্পর্শেরই অপেক্ষায় ছিল। সেঁটে আসে উপমন্যুর দিকে। উপমন্যুও কনফিডেন্স ফিরে পায়। পৃথার চুলে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলে, "দেখো, যা হবার তা হয়েই গিয়েছে। গুরুর কথায় বড়ে বড়ে দেশো মে এইসি ছোটি ছোটি চিজে হোতি রেহতি হ্যায় সেনরিটা। কাজেই পুরোনোকে ভুলে এগিয়ে চলা ভালো। ক্যা পতা, কাল হো না হো?" পৃথা হাঁটা থামিয়ে দেয়। বাঁদিকে মুখ তুলে উপমন্যুর দিকে তাকায়। চোখে চোখ রেখে বলে, "তুম তো বড়ে ফিল্মি নিকলে?" উপমন্যু হেসে বলে, "কাম হি এইসা হ্যায়। ক্যা করে?"
এক জোড়া হাত একে অপরের নরম স্পর্শ পেয়ে এগিয়ে চলে স্বপ্নের নগরী দিয়ে। সারা শহর আলোতে ঝলমল করতে থাকে। আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় ওরা। দুজন। ওদের কথাও ক্রমশ মিলিয়ে যেতে থাকে।
"ভাবছি পুজোয় বাড়ি যাবো। টিকিট কেটে নিই?"
"চলো। একসাথেই যাই। আমারটাও কাটো একইসাথে।"
"হ্যাঁ অবশ্যই। পাশে পাশে থাকি। নইলে আবার কে না কে সহযাত্রী পটিয়ে নেবে।"
"সেই তো।"
"এই তো। সস্তা টিকিট। বুক করি। পৃথা সোম। ইশ। কী ছোট্ট নাম।"
"শর্ট এন্ড সুইট। তোমার মত নাকি? উপমন্যু রায় চৌধুরী। উফ। ২০টা লেটার।"
"তাও গোনা হয়ে গিয়েছে দেখছিই। গুড গুড। বাই দ্য ওয়ে, তুমি এস এইচ ও এম ই লেখো তো?"
"হ্যাঁ।"
"বেশ। তাহলে তোমার ২৩ হবে। এইবার সমানে সমানে হবে।"
"মানে?"
"পৃথা সোম রায় চৌধুরী। ২৩টা লেটার।"
"ডিড ইউ জাস্ট প্রোপোজ ম্যারেজ?"
"হ্যাঁ! ওল্ড স্কুল রোমান্সে বিশ্বাসী।"
"আমিও..."
আর শোনা যায় না ওদের কথা। না শোনাই ভালো। বাকিটা তো ব্যক্তিগত, না?
উপমন্যু গোটা সময়টা পৃথার দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিল। একটা আপাত ধীর স্থির ম্যাচিয়র্ড মেয়ে যে এক ফিল্ম স্টারের বাড়ির সামনে এসে এরকম পাগলামি করতে পারে, ভেবেই অবাক। তবু, ভালো লাগে ওর। এই ছেলেমানুষি, এই আবেগ, এগুলোই তো বেঁচে থাকার রসদ। ওরা হাঁটতে থাকে। এদিক ওদিক গল্প করে। শাহরুখের সিনেমা নিয়ে। বলিউড নিয়ে। নাইন্টিজের গান নিয়ে। এমন সময় পৃথার মোবাইলটা বেজে ওঠে। উফ। "বড্ড ভিলেন তো দেখি আপনার এই ফোনটা?" উপমন্যু মিথ্যে রাগের স্বরে বলে। পৃথা হাসে। ফোনের স্ক্রিনে দেখে আবারও ঋষির নাম। নাঃ। এইবার একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। উপমন্যুকে একটু থামতে বলে। তারপর ফোনটা রিসিভ করে বলে, "কেমন আছো ঋষি?"
- ভালো। তুমি?
- খুউউব ভালো।
- একটা কথা বলার ছিল।
- বিয়ে করছো, জানি। সুদেষ্ণা বলেছে। কংগ্র্যাটস। অন্য কোনো বক্তব্য থাকলে বলো?
- পারলে আমায় ক্ষমা করে দেবে প্লিজ? আমি তোমায় ঠকিয়েছি।
- রিয়েলাইজ করেছ তো? এতেই হবে। ভালো থেকো। আর প্লিজ, যোগাযোগ, রেখো না।
পৃথা ফোনটা ছেড়ে দেয়। খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর সারা শরীর কাঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। খুব। খুউউব। পাশে দাঁড়ানো উপমন্যু বিহ্বল হয়ে যায়। কী করবে, কিচ্ছু বোঝে না। স্ক্রিপ্টের পর স্ক্রিপ্ট লিখতে পারে, বিজ্ঞাপনের কপি লিখতে এক্সপার্ট। কিন্তু পাশে দাঁড়ানো খুব কাছের মানুষটাকে কাঁদতে দেখে যে কী করবে, ভেবে পায় না। পৃথা ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে চোখ নাক মুছতে মুছতে বলে, "দেখছেন আমি কাঁদছি, একটু কান্না থামানোর চেষ্টাও করবেন না?" উপমন্যু ভ্যাবলার মতোই দাঁড়িয়ে থাকে এখনো। "সবই দেখি আমায় বলতে হবে। উফ। নিন। রুমাল দেওয়ার সুযোগ হারালেন। এবার অন্তত আইসক্রিম খাওয়াতে অফার করুন!"
উপমন্যুর মনে পড়ে যায় নিজের লেখা পুরোনো স্ক্রিপ্ট। একটু ইতস্তত করেই ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে পৃথার কাঁধে। পৃথা যেন এই স্পর্শেরই অপেক্ষায় ছিল। সেঁটে আসে উপমন্যুর দিকে। উপমন্যুও কনফিডেন্স ফিরে পায়। পৃথার চুলে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলে, "দেখো, যা হবার তা হয়েই গিয়েছে। গুরুর কথায় বড়ে বড়ে দেশো মে এইসি ছোটি ছোটি চিজে হোতি রেহতি হ্যায় সেনরিটা। কাজেই পুরোনোকে ভুলে এগিয়ে চলা ভালো। ক্যা পতা, কাল হো না হো?" পৃথা হাঁটা থামিয়ে দেয়। বাঁদিকে মুখ তুলে উপমন্যুর দিকে তাকায়। চোখে চোখ রেখে বলে, "তুম তো বড়ে ফিল্মি নিকলে?" উপমন্যু হেসে বলে, "কাম হি এইসা হ্যায়। ক্যা করে?"
এক জোড়া হাত একে অপরের নরম স্পর্শ পেয়ে এগিয়ে চলে স্বপ্নের নগরী দিয়ে। সারা শহর আলোতে ঝলমল করতে থাকে। আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় ওরা। দুজন। ওদের কথাও ক্রমশ মিলিয়ে যেতে থাকে।
"ভাবছি পুজোয় বাড়ি যাবো। টিকিট কেটে নিই?"
"চলো। একসাথেই যাই। আমারটাও কাটো একইসাথে।"
"হ্যাঁ অবশ্যই। পাশে পাশে থাকি। নইলে আবার কে না কে সহযাত্রী পটিয়ে নেবে।"
"সেই তো।"
"এই তো। সস্তা টিকিট। বুক করি। পৃথা সোম। ইশ। কী ছোট্ট নাম।"
"শর্ট এন্ড সুইট। তোমার মত নাকি? উপমন্যু রায় চৌধুরী। উফ। ২০টা লেটার।"
"তাও গোনা হয়ে গিয়েছে দেখছিই। গুড গুড। বাই দ্য ওয়ে, তুমি এস এইচ ও এম ই লেখো তো?"
"হ্যাঁ।"
"বেশ। তাহলে তোমার ২৩ হবে। এইবার সমানে সমানে হবে।"
"মানে?"
"পৃথা সোম রায় চৌধুরী। ২৩টা লেটার।"
"ডিড ইউ জাস্ট প্রোপোজ ম্যারেজ?"
"হ্যাঁ! ওল্ড স্কুল রোমান্সে বিশ্বাসী।"
"আমিও..."
আর শোনা যায় না ওদের কথা। না শোনাই ভালো। বাকিটা তো ব্যক্তিগত, না?
Saturday, August 31, 2019
meeting at beach. vent out. mannat er samne. filmy dialogue. propose. pujoy bari fera
আলোতে আলো ঢাকা ৫
আরো একটা রবিবার। আজ আবার পৃথা আর উপমন্যু দেখা করবে। আজকের এজেন্ডা এমনিই পায়ে হেঁটে একটু বম্বে শহরটা ঘুরে বেড়ানো। তারপর কোথাও একটা ডিনার। এবং এই উদ্যোগটা পৃথারই নেওয়া। সত্যি বলতে কী, গত সপ্তাহে উপমন্যুর সাথে লাঞ্চটা মন্দ লাগেনি। আর পাঁচটা ছেলের থেকে একটু হলেও আলাদা লেগেছে ওকে। কথাবার্তা, হাব ভাব। অ্যাডভারটাইজিং জগত থেকে এসে এখন এক বিখ্যাত ইউটিউব চ্যানেলের স্ক্রিপ্ট রাইটার হয়ে বম্বে এসেছে। সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারে। কাজের ব্যাপারেও বেশ প্যাশোনেট। ভালো লেগেছে পৃথার। নিজে প্রাইভেট ব্যাঙ্কে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। সারাদিন ওই হিসেব নিকেশের মধ্যে কেটে যায়। সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোও কেমন ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। এই জন্যই আরো উপমন্যুর সাথে কথা বলতে ভালো লাগে পৃথার। নিজের ভিতরের সৃজনসত্ত্বাটা যেন একটু সাথী পায়। এই এক সপ্তাহে প্রতিদিনই সন্ধ্যেয় অফিস ফেরতা অনেকক্ষণ চ্যাটে কথা হয়েছে দুজনের। একদিন তো ভয়স কলও হয়েছে। উইকেন্ডের প্ল্যান বানাতে গিয়ে নির্দ্বিধায় পৃথা উপমন্যুকে জিজ্ঞেস করেছে দেখা করার কথা। সেই কথোপকথনটিও ছিল খুব মজার। বৃহস্পতিবার, ক্যাবে বসে বসে পৃথা মেসেজ করছিলো উপমন্যুকে। "বন্ধু বান্ধব হলো অফিসে?" উপমন্যুর উত্তর এলো, " কলিগ কখনও তেমন বন্ধু হতে পারে না। তবে ওই আর কী, মারামারির পর্যায়ে পৌঁছইনি।"
পৃথাঃ মারামারি নাকি? আপনি বুঝি এত ভায়োলেন্ট?
উপমন্যুঃ এত বলতে?
পৃথাঃ এত বলতে, অফিস কলিগদের সাথে বন্ধুত্বের কথা জিজ্ঞেস করতে মারামারির প্রসঙ্গ আনলেন যে...
উপমন্যুঃ ও, তাই বলুন। ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমার মতো এমন নিরীহ একটা মানুষকে আপনি এরকম দুমদাম ভায়োলেন্ট বলে দিলেন...
পৃথা হাসির ইমোজি পাঠালো।
উপমন্যুঃ হাসলে হবে না। বলুন বলুন।
পৃথাঃ আমিও তো অবাক। আপনার মতো একজন... মনে তো হয় না একটা মশাও মারতে পারেন বলে।
উপমন্যুঃ একসাথে ২৫টা।
পৃথাঃ অ্যাঁ?
উপমন্যুঃ একসাথে ২৫টা মশা মেরেছি। রেকর্ড আছে।
পৃথাঃ ধ্যাত। বললেই হলো?
উপমন্যুঃ রনি বান্টি সাক্ষী।
পৃথাঃ তারা কারা?
উপমন্যুঃ আমার রুমমেট ছিল কলেজে।
পৃথাঃ বাই দ্য ওয়ে, আপনার কোন কলেজ?
উপমন্যুঃ জে এন ইউ। ইংলিশ অনার্স।
পৃথাঃ আই সি।
উপমন্যুঃ আপনি তো সেন্ট জেভিয়ারস। কমার্স।
পৃথাঃ রিসার্চ করে নিয়েছেন?
উপমন্যুঃ মোটামুটি। স্ক্রিপ্ট লিখতে হয়। নানান মানুষের সাথে পরিচয় হওয়া ভালো। চরিত্রগুলো বানাতে সুবিধে হয়।
পৃথাঃ রিয়েলি?
উপমন্যুঃ আবার কী? এমনি এমনি কি ডেটিং অ্যাপে আছি নাকি?
পৃথাঃ ডেটিঙের জন্য অ্যাপে নেই?
উপমন্যুঃ এই বুড়ো বয়সে ওইসব চক্করে কে যায়? আমি তো স্রেফ রিসার্চ পারপাসে আছি।
পৃথাঃ হুম। বুঝলাম।
উপমন্যুঃ কী বুঝলেন?
পৃথাঃ কিছু না।
উপমন্যুঃ আপনি কি এখানে ডেট ফেটের জন্য এসেছেন নাকি?
পৃথাঃ ঠিক তা না...
উপমন্যুঃ তবে ঠিক কী?
পৃথাঃ উফ, আপনি বড্ড ইন্টারোগেট করেন।
উপমন্যুঃ ওই যে বললাম, রিসার্চ।
পৃথাঃ শুনুন।
উপমন্যুঃ বলুন?
পৃথাঃ রবিবার ফ্রি আছেন? দেখা করবেন? আপনার রিসার্চের সুবিধে হবে হয়তো।
উপমন্যুঃ দোহাই আপনার, আমার রিসার্চের নামে চালাবেন না। বলুন আমার সাথে দেখা করার ইচ্ছে হয়েছে।
পৃথাঃ ওয়াট রাবিশ।
উপমন্যুঃ আহা, রাগ করছেন কেন।
পৃথা উত্তর দেয়নি। পরপর উপমন্যুর কয়েকটা মেসেজ আসতে লাগলো ফোনে। "ও কী, গেলেন কই?" "কী হলো? এ বাবা, রাগ করলেন? সরি সরি", ইত্যাদি। পৃথা সব মেসেজই দেখছে, কিন্তু উত্তর দিচ্ছেনা। রাগ কিন্তু মোটেই করেনি ও। বরং ধরা পড়ে যাওয়ায় মনে মনে একটু আনন্দও পাচ্ছে। তবুও উপমন্যুকে একটু মজা করে বিব্রত করতে ভারী আনন্দ হচ্ছে ওর। ও ঠিক করেছে, ঘণ্টা দুই পর রিপ্লাই দেবে। তার আগে না। দেখিই না, কতক্ষণ চেষ্টা করে যায়। ওর দিকটাও তো বুঝতে হবে।
আধ ঘণ্টা ধরে গ্যাপ দিয়ে দিয়ে সমানে টুং টুং করে মেসেজ এসেই যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ একটা ভয়েস নোট এলো। কৌতূহলবশতই পৃথা প্লে করলো। উপমন্যুর গলা। গান গাইছে। "Jo dil mein hain hothon pe lana bhi mushkil
Magar usko dil mein chhupana bhi mushkil
Nazar ki zubaan se samajh jaiyega
Nazar ki zubaan se samajh jaiyega
Samajh kar zara gaur farmaiyega
Aji rooth kar ab kahan jaiyega
Jahan jaiyega hamein paiyega
Aji rooth kar ab"
এক তো এমন সুন্দর গান, তার ওপর অসামান্য কণ্ঠস্বর... পৃথা আর নিজেকে সামলাতে পারে না। মুচকি হাসি হেসে রিপ্লাই পাঠায় ছোট্ট করে, "জানা রইলো। গোঁসা করলে এমন ভালো গান শোনা যায়। রবিবার বিকেল পাঁচটায় আমায় পিক-আপ করবেন। লোকেশন পাঠিয়ে দিচ্ছি।"
পৃথাঃ মারামারি নাকি? আপনি বুঝি এত ভায়োলেন্ট?
উপমন্যুঃ এত বলতে?
পৃথাঃ এত বলতে, অফিস কলিগদের সাথে বন্ধুত্বের কথা জিজ্ঞেস করতে মারামারির প্রসঙ্গ আনলেন যে...
উপমন্যুঃ ও, তাই বলুন। ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমার মতো এমন নিরীহ একটা মানুষকে আপনি এরকম দুমদাম ভায়োলেন্ট বলে দিলেন...
পৃথা হাসির ইমোজি পাঠালো।
উপমন্যুঃ হাসলে হবে না। বলুন বলুন।
পৃথাঃ আমিও তো অবাক। আপনার মতো একজন... মনে তো হয় না একটা মশাও মারতে পারেন বলে।
উপমন্যুঃ একসাথে ২৫টা।
পৃথাঃ অ্যাঁ?
উপমন্যুঃ একসাথে ২৫টা মশা মেরেছি। রেকর্ড আছে।
পৃথাঃ ধ্যাত। বললেই হলো?
উপমন্যুঃ রনি বান্টি সাক্ষী।
পৃথাঃ তারা কারা?
উপমন্যুঃ আমার রুমমেট ছিল কলেজে।
পৃথাঃ বাই দ্য ওয়ে, আপনার কোন কলেজ?
উপমন্যুঃ জে এন ইউ। ইংলিশ অনার্স।
পৃথাঃ আই সি।
উপমন্যুঃ আপনি তো সেন্ট জেভিয়ারস। কমার্স।
পৃথাঃ রিসার্চ করে নিয়েছেন?
উপমন্যুঃ মোটামুটি। স্ক্রিপ্ট লিখতে হয়। নানান মানুষের সাথে পরিচয় হওয়া ভালো। চরিত্রগুলো বানাতে সুবিধে হয়।
পৃথাঃ রিয়েলি?
উপমন্যুঃ আবার কী? এমনি এমনি কি ডেটিং অ্যাপে আছি নাকি?
পৃথাঃ ডেটিঙের জন্য অ্যাপে নেই?
উপমন্যুঃ এই বুড়ো বয়সে ওইসব চক্করে কে যায়? আমি তো স্রেফ রিসার্চ পারপাসে আছি।
পৃথাঃ হুম। বুঝলাম।
উপমন্যুঃ কী বুঝলেন?
পৃথাঃ কিছু না।
উপমন্যুঃ আপনি কি এখানে ডেট ফেটের জন্য এসেছেন নাকি?
পৃথাঃ ঠিক তা না...
উপমন্যুঃ তবে ঠিক কী?
পৃথাঃ উফ, আপনি বড্ড ইন্টারোগেট করেন।
উপমন্যুঃ ওই যে বললাম, রিসার্চ।
পৃথাঃ শুনুন।
উপমন্যুঃ বলুন?
পৃথাঃ রবিবার ফ্রি আছেন? দেখা করবেন? আপনার রিসার্চের সুবিধে হবে হয়তো।
উপমন্যুঃ দোহাই আপনার, আমার রিসার্চের নামে চালাবেন না। বলুন আমার সাথে দেখা করার ইচ্ছে হয়েছে।
পৃথাঃ ওয়াট রাবিশ।
উপমন্যুঃ আহা, রাগ করছেন কেন।
পৃথা উত্তর দেয়নি। পরপর উপমন্যুর কয়েকটা মেসেজ আসতে লাগলো ফোনে। "ও কী, গেলেন কই?" "কী হলো? এ বাবা, রাগ করলেন? সরি সরি", ইত্যাদি। পৃথা সব মেসেজই দেখছে, কিন্তু উত্তর দিচ্ছেনা। রাগ কিন্তু মোটেই করেনি ও। বরং ধরা পড়ে যাওয়ায় মনে মনে একটু আনন্দও পাচ্ছে। তবুও উপমন্যুকে একটু মজা করে বিব্রত করতে ভারী আনন্দ হচ্ছে ওর। ও ঠিক করেছে, ঘণ্টা দুই পর রিপ্লাই দেবে। তার আগে না। দেখিই না, কতক্ষণ চেষ্টা করে যায়। ওর দিকটাও তো বুঝতে হবে।
আধ ঘণ্টা ধরে গ্যাপ দিয়ে দিয়ে সমানে টুং টুং করে মেসেজ এসেই যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ একটা ভয়েস নোট এলো। কৌতূহলবশতই পৃথা প্লে করলো। উপমন্যুর গলা। গান গাইছে। "Jo dil mein hain hothon pe lana bhi mushkil
Magar usko dil mein chhupana bhi mushkil
Nazar ki zubaan se samajh jaiyega
Nazar ki zubaan se samajh jaiyega
Samajh kar zara gaur farmaiyega
Aji rooth kar ab kahan jaiyega
Jahan jaiyega hamein paiyega
Aji rooth kar ab"
এক তো এমন সুন্দর গান, তার ওপর অসামান্য কণ্ঠস্বর... পৃথা আর নিজেকে সামলাতে পারে না। মুচকি হাসি হেসে রিপ্লাই পাঠায় ছোট্ট করে, "জানা রইলো। গোঁসা করলে এমন ভালো গান শোনা যায়। রবিবার বিকেল পাঁচটায় আমায় পিক-আপ করবেন। লোকেশন পাঠিয়ে দিচ্ছি।"
Friday, August 30, 2019
আলোতে আলো ঢাকা ৪
চোখের ওপর বারবার চুলের গোছা এসে পড়ছে। পৃথা সমানে সেগুলিকে সরাচ্ছে। হাতের চুড়িগুলো রিনরিন করছে। বিরক্তির মধ্যেও ভালো লাগছে পৃথার। আজ বেশ সেজেগুজেই এসেছে। সাজতে খুবই ভালোবাসে পৃথা। তবে সোম থেকে শুক্র অফিসে বিজনেস ক্যাজ্যুয়ালের চক্করে পড়ে মনের মতো সাজগোজ হয়ে ওঠেনা। তাই আজ সুযোগ ছাড়েনি। একটা কলমকরি কাজের লম্বা হাতা ব্লাউজ দিয়ে সাদা লিনেনের শাড়ি পরেছে, সাথে মানানসই রূপোর গয়না। শ্যাম্পু করা চুলটা আলতো খোঁপায় বাঁধা। কপালে ছোট্ট টিপ। বেরোনোর আগে আয়নায় নিজেকে দেখে ভালোই লেগেছে। টুক করে একটা সেলফি তুলে ইন্সটাগ্রামেও দিয়ে দিয়েছে। সেই ছবিতে ইতিমধ্যেই ঝড়ের গতিতে লাইকের বন্যা বয়ে গিয়েছে। ওয়েটার ইতিমধ্যে চতুর্থ রাউন্ড মাটন বোটি কাবাব পরিবেশন গিয়েছে। পৃথা সর্বভুক হলেও স্বল্পাহারী। খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। উল্টোদিকে উপমন্যু পাক্কা খাদ্যরসিক। বিনা বিরতিতে দিব্যি সাঁটিয়েই চলেছে একের পর এক কাবাব। মেনু দেখে বলেছে এরপর নাকি বিরিয়ানিতে হামলা করবে। পারেও বটে। পৃথা ভাবে। ওই জন্যই একটা নাদুসনুদুস ভুঁড়িও রয়েছে। নীল জিন্স আর কালো শার্টের আড়ালে যাকে লোকানো যায়নি বিশেষ। পৃথা নিজে ছিপছিপে চেহারার। দিনের শুরুই হয় ওর যোগব্যায়াম দিয়ে। আনফিট লোকজন দেখলে খুব রাগ হয় ওর। নিজের শরীর, নিজে যত্ন না নিলে হয়? উপমন্যুকে দেখেও রাগ হওয়ার কথা। গোগ্রাসে খাচ্ছে। ভুঁড়িখানাও রয়েছে। কিন্তু কে জানে, কোন অদ্ভুত কারণে ওকে দেখে পৃথার খারাপ লাগছে না। হয়তো খাওয়াটাকে বড্ড ভালোবেসে খাচ্ছে বলে, নাকি? চোখে মুখের তৃপ্তি বুঝি স্বাস্থ্য অস্বাস্থ্য এইসবকে কয়েক গোলে হারিয়ে দিয়েছে? পৃথা নিজেই নিজের চিন্তায় অবাক হয়। উল্টোদিক থেকে উপমন্যুর কথায় খেয়াল পড়ে, "চুলটা বেঁধে নিন না। খাওয়াতে এত ব্যাঘাত ভালো নাকি?" পৃথা মুহূর্তের জন্য খাওয়া থামিয়ে ফেলে। তারপর মুচকি হেসে ফেলে। এত সেজেগুজে আসা, অন্তত উল্টোদিকের মানুষটি সামান্য কমপ্লিমেন্ট তো দিতে পারতো। কমপ্লিমেন্ট তো দেয়ইনি একবারও। উল্টে এই উপদেশ? সত্যি। এই ছেলে পৃথার পরিচিত অন্য ছেলেদের থেকে একটু হলেও আলাদা। ও পাশে রাখা টিস্যুতে হাতটা মোছে। চুলটা বেঁধেই নেবে টাইট করে। এমন সময় ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ঋষির নাম। পৃথা বিরক্ত হয়। হাতটা নিশপিশ করে লাল আইকনে স্লাইড করতে। নিজেকে সংযত রাখে। ফোনটা ভাইব্রেট হতে হতে থেমে যায়। খোঁপা বাঁধার কথা পৃথা ভুলে যায়। উপমন্যুকে বলে মেন কোর্সের দিকে এগিয়ে যায়।
পাতে এক হাতা ওয়াইট রাইস, ইয়েলো ডাল আর মাংস নিয়ে ফিরে আসে টেবিলে। উপমন্যু ওকে দেখে বলে, "আপনার ফোনটা আবার বাজছিল।" পৃথা থালা রেখে একবার ফোনের দিকে তাকায়। দেখে ঋষির নম্বর। ও কিছু বলে না। খাওয়াতে মন দেয়। উপমন্যু ব্যাপারটা লক্ষ্য করে। পরিস্থিতি হাল্কা করতে কি কে জানে, বলে, "এত অল্প খেয়ে এই রেস্টুরেন্টগুলোর লাভ বাড়াচ্ছেন কেন?" পৃথা কিছু বলে না। একটু হাসে। উপমন্যু বলতে থাকে, "আমি যাই। ভালো করে ঘুরে ফিরে মেন কোর্স কী আছে দেখি। প্লেটটা ভরে আনি। আপনি বরং ততক্ষণ ফোনটা রিসিভ করুন। নিন। আবার কল করছে ঋষিকুমার। দেখুন দেখুন। এতবার করছে, নিশ্চয়ই খুব দরকারি। কথা বলে নিন। আমি এখানে এক্ষুণি ফিরছি না। আপনি নির্দ্বিধায় কথা বলুন।" এই বলে উপমন্যু এগিয়ে যায় মেন কোর্সের দিকে। পৃথা খাওয়া ছেড়ে তাকিয়ে থাকে পাশে রাখা ফোনটার দিকে। নাহ। ধরবে ও না। যত ইচ্ছে ফোন করুক। শুনবে না। আবার ঠকবে না। ও জানে, ঋষি দুটো মিষ্টি করে কথা বলবে, আর পৃথা আবার গলে যাবে। উঁহু। এ হতে পারে না। পৃথাকে নিজেকে বাঁচাতেই হবে। ফোন ও ধরবে না।
Thursday, August 29, 2019
আলোতে আলো ঢাকা ৩
"আপনি কি বরাবরই ফোন এলে বা মেসেজ এলে এমন অন্যমনস্ক হয়ে যান?" উপমন্যুর প্রশ্নে অবাক হয়ে ফোন থেকে মুখ তুলে দেখলো পৃথা। বিস্ময় প্রকাশ করেই ও জিজ্ঞেস করলো, "মানে?" উপমন্যু হাসলো। কিছু বললো না। ইতিমধ্যে একজন ওয়েটার এসে ওদের টেবিলে ওয়েলকাম ড্রিংক হিসেবে তরমুজের জ্যুস রেখে গেল। আরেকজন এসে স্টার্টারের প্রথম রাউন্ডের মাছ মাংসের কাবাব এনে রাখলো। উপমন্যু জ্যুসের গ্লাসটা তুলে পৃথার দিকে তাকিয়ে বললো, "উল্লাস।" পৃথাও নিজের গ্লাসটা উপমন্যুর গ্লাসে ঠেকিয়ে নামাতে যাচ্ছিল, উপমন্যু বাঁ হাত দিয়ে পৃথার ডান হাতটা চেপে ধরে প্রায় আর্তনাদ করে উঠলো, "আরে আরে। রাখবেন না। রাখবেন না। এক চুমুক খান। তারপর নামিয়ে রাখবেন। উল্লাস বলে গ্লাস নামাতে নেই।" পৃথা এমন অপরিকল্পিত ঘটনায় খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে সামলে জ্যুসের গ্লাস থেকে এক চুমুক জ্যুস খেয়ে নামিয়ে রাখলো গ্লাস। উপমন্যু ইতিমধ্যে হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে। এবং দুই হাতে কাঁটা চামচ ছুরি সব সহযোগে মনের সুখে কাবাবে মন দিয়েছে। পৃথা কী দিয়ে শুরু করবে, বুঝে উঠতে পারে না। একটু এদিক ওদিক করছে দেখে উপমন্যু বলে, "ফিশ দিয়ে শুরু করুন। মেছো বাঙালি আফটার অল। ওটাই বেস্ট লাগলো।" পৃথা উত্তর দেয়না। কিন্তু ফিশ অমৃৎসরী দিয়েই খাওয়া শুরু করে। মুখে এক টুকরো পুরে বোঝে, সত্যিই বড় সুস্বাদু। "কী, ভালো না?" পৃথার হাসিমুখ দেখে উপমন্যু প্রশ্ন করে। পৃথা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। তারপর উপমন্যুকে জিজ্ঞেস করে, "তখন কিছু একটা বলছিলেন। ওয়েটার চলে এলো। কথা থেমে গেলো।" উপমন্যু খাওয়া থামিয়ে খানিক ভাবে। তারপর মাথা নেড়ে বলে, "ও কিছু না। খান খান। নেক্সট আইটেম আনতে বলি? নাকি এটার রিপিট?" পৃথা উত্তর দেয়, "নেক্সটটাই বলুন। কিন্তু কিছু না বললে তো হবে না। বলুন, তখন কী বলছিলেন ফোন নিয়ে।" উপমন্যু বলে, "আরে, বললাম তো। কিছু না। যেই জন্য আজ এখানে আসা, সেটাতেই বরং মন দিই?" পৃথা একটু ক্ষুণ্ন হয়। ফোন মেসেজ অন্যমনস্ক কী বলছিল। কেন। যাক গে, বলতে না চাইলে আর কীই বা করতে পারে, এই ভেবে ও খাওয়াতে মন দেয়। ঠিকই তো। উপমন্যুর সাথে এই লাঞ্চ প্ল্যানটা তো ভালো মন্দ খাবে বলেই। গোড়া থেকেই বলি তাহলে।
সেদিন এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফিরেই ফেসবুকে উপমন্যু রায় চৌধুরী নামে সার্চ দেয় পৃথা। তিনটে প্রোফাইল আসে। প্রত্যেকটিতে গিয়ে ঢুঁ মেরে হতাশ হয়। একটাও যে ওর সহযাত্রীর না। কে জানে, হয়তো কোন ট্যাশ নামে আছে। একটু দমে যায় পৃথা। কিন্তু হাজার ব্যস্ততার মধ্যে আর মনে পড়ে না। নতুন শহর। নতুন চাকরি। এইসবের মধ্যেই কেটে যায় এক সপ্তাহ। উইকেন্ডে অফিস নেই। সারাদিন কী করবে, ভেবে পায় না। শনিবার সারা সকাল ঘরদোর গুছিয়ে বাজারহাট করে মোটামুটি কেটে গেলেও সন্ধ্যে থেকে কাঠ বেকার। পৃথা বরাবরই খুব মিশুকে। আর তাই যে কোনো জায়গায় বন্ধু পাতিয়ে ফেলে। সেই জন্যই কখনো একা সময় কাটায়নি স্বেচ্ছাতে। আর এখন তো আরোই কষ্ট হচ্ছে। মন কেমন করছে। কলকাতার জন্য। ঋষির জন্য। বন্ধুও খুব একটা এখনো এত তাড়াতাড়ি হয়নি যে উইকেন্ডে প্ল্যান করবে। প্রিয় বান্ধবী সুদেষ্ণাকে ফোন করলো পৃথা। এদিক ওদিক কথা প্রসঙ্গে শেষমেশ ঋষির কথা সেই উঠলোই। জানতে পারলো, সামনের মাঘেই ঋষির বিয়ে। এতক্ষণে সেদিন ঋষির "প্লিজ একবার ফোন ধরো, কথা আছে" লেখা মেসেজের মানে বোঝে পৃথা। মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। যতই ঋষি ওকে ঠকাক, ভালো তো বেসেছিলো পৃথা ওকে। আর তাই সুদেষ্ণার কাছে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে ও। সুদেষ্ণা বিহ্বল হয়ে যায়। কীভাবে বন্ধুকে সামলাবে, বোঝে না। শনিবার রাতটা ঘুমোতে পারে না পৃথা। সারা রাত ছটফট করতে থাকে। বিছানায় শুয়ে একবার এপাশ একবার ওপাশ। শেষমেশ ভোর রাত্রির দিকে প্লে স্টোর থেকে ডেটিং app নামায়। নিজের প্রোফাইল বানায়। বেশ ঝকঝকে আকর্ষণীয় করে। তারপর এলোমেলো করে একটার পর একটা ছেলের ছবি আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে দেখতে থাকে। ধুর। একটা কারুর প্রোফাইলে গিয়ে একটুও মনে ধরলো না। প্রেম তো দূর অস্ত, সামান্য কথোপকথনের যোগ্যও কাউকে লাগলো না। আরো বিরক্তি ধরে গেল ওর। ফোনটা নামিয়ে রাখবে, এমন সময় চোখ আটকে গেলো স্ক্রিনে। আরে, এ যে সহযাত্রী। উপমন্যু রায় চৌধুরী। বয়স একত্রিশ। পেশায় কপিরাইটার। সেপিওসেক্সুয়াল। খাদ্যরসিক। বিড়াল ভালোবাসে। হুম। ইন্টারেস্টিং। মনে মনে ভাবে পৃথা। একটা সুযোগ দেওয়াই যায়। কিছু না হোক, অজানা শহরে একজন চেনা জানা বাঙালি তো হবে। রাইট সোয়াইপ করেই দেয় পৃথা। আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই নোটিফিকেশন আসে, "ম্যাচ"। শুরু হয় চ্যাটে কথাবার্তা। আর সেই থেকেই ঠিক হয় পরেরদিন, অর্থাৎ আজকের এই লাঞ্চ প্ল্যান।
সেদিন এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফিরেই ফেসবুকে উপমন্যু রায় চৌধুরী নামে সার্চ দেয় পৃথা। তিনটে প্রোফাইল আসে। প্রত্যেকটিতে গিয়ে ঢুঁ মেরে হতাশ হয়। একটাও যে ওর সহযাত্রীর না। কে জানে, হয়তো কোন ট্যাশ নামে আছে। একটু দমে যায় পৃথা। কিন্তু হাজার ব্যস্ততার মধ্যে আর মনে পড়ে না। নতুন শহর। নতুন চাকরি। এইসবের মধ্যেই কেটে যায় এক সপ্তাহ। উইকেন্ডে অফিস নেই। সারাদিন কী করবে, ভেবে পায় না। শনিবার সারা সকাল ঘরদোর গুছিয়ে বাজারহাট করে মোটামুটি কেটে গেলেও সন্ধ্যে থেকে কাঠ বেকার। পৃথা বরাবরই খুব মিশুকে। আর তাই যে কোনো জায়গায় বন্ধু পাতিয়ে ফেলে। সেই জন্যই কখনো একা সময় কাটায়নি স্বেচ্ছাতে। আর এখন তো আরোই কষ্ট হচ্ছে। মন কেমন করছে। কলকাতার জন্য। ঋষির জন্য। বন্ধুও খুব একটা এখনো এত তাড়াতাড়ি হয়নি যে উইকেন্ডে প্ল্যান করবে। প্রিয় বান্ধবী সুদেষ্ণাকে ফোন করলো পৃথা। এদিক ওদিক কথা প্রসঙ্গে শেষমেশ ঋষির কথা সেই উঠলোই। জানতে পারলো, সামনের মাঘেই ঋষির বিয়ে। এতক্ষণে সেদিন ঋষির "প্লিজ একবার ফোন ধরো, কথা আছে" লেখা মেসেজের মানে বোঝে পৃথা। মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। যতই ঋষি ওকে ঠকাক, ভালো তো বেসেছিলো পৃথা ওকে। আর তাই সুদেষ্ণার কাছে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে ও। সুদেষ্ণা বিহ্বল হয়ে যায়। কীভাবে বন্ধুকে সামলাবে, বোঝে না। শনিবার রাতটা ঘুমোতে পারে না পৃথা। সারা রাত ছটফট করতে থাকে। বিছানায় শুয়ে একবার এপাশ একবার ওপাশ। শেষমেশ ভোর রাত্রির দিকে প্লে স্টোর থেকে ডেটিং app নামায়। নিজের প্রোফাইল বানায়। বেশ ঝকঝকে আকর্ষণীয় করে। তারপর এলোমেলো করে একটার পর একটা ছেলের ছবি আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে দেখতে থাকে। ধুর। একটা কারুর প্রোফাইলে গিয়ে একটুও মনে ধরলো না। প্রেম তো দূর অস্ত, সামান্য কথোপকথনের যোগ্যও কাউকে লাগলো না। আরো বিরক্তি ধরে গেল ওর। ফোনটা নামিয়ে রাখবে, এমন সময় চোখ আটকে গেলো স্ক্রিনে। আরে, এ যে সহযাত্রী। উপমন্যু রায় চৌধুরী। বয়স একত্রিশ। পেশায় কপিরাইটার। সেপিওসেক্সুয়াল। খাদ্যরসিক। বিড়াল ভালোবাসে। হুম। ইন্টারেস্টিং। মনে মনে ভাবে পৃথা। একটা সুযোগ দেওয়াই যায়। কিছু না হোক, অজানা শহরে একজন চেনা জানা বাঙালি তো হবে। রাইট সোয়াইপ করেই দেয় পৃথা। আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই নোটিফিকেশন আসে, "ম্যাচ"। শুরু হয় চ্যাটে কথাবার্তা। আর সেই থেকেই ঠিক হয় পরেরদিন, অর্থাৎ আজকের এই লাঞ্চ প্ল্যান।
Subscribe to:
Posts (Atom)