Monday, March 30, 2020

রঙ রুট (২০)

VI

বেরিয়ে ফেরার প্রায় মাসখানেক পর, জাহ্নবী তিনটি ইমেল পাঠিয়েছিল। শুভঙ্কর, অভি আর আঙ্কেলকে।

প্রিয় শুভ
জানি তুমি হয়তো আমার ব্যবহার ও আচরণে খুব অবাক হয়েছ। ফিরে এসে অবধি আমি তোমার কোন ফোনের উত্তর দিইনি, মেসেজ পড়ে রেখে দিয়েছি। জবাব পাঠাইনি। রাগ করেছ নিশ্চয়ই? করারই কথা। আসলে বাড়ি ফেরার পর থেকে একটা অদ্ভুত বাজে রকমের পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছি এ কদিন। না না চিন্তা করো না। আমি ভালো আছি। মাও ভালো আছে। শুধু কিছু ব্যাপার ঘটে গিয়েছে, যা আমায় মানসিকভাবে বিহ্বল করে তুলেছিল। তবে এখন সব শান্ত। আমি ভালো আছি। তবে সেসব কথা তোমায় ফোনে বা ইমেলে জানাবো না। দেখা করে সামনাসামনি বলবো।
তুমি কি এর মধ্যে দিল্লী আসবে? এসো না। তাহলে দেখা করবো। তুমি আমাদের বাড়িতেই থেকো। মায়ের খুব ইচ্ছে তোমার সাথে আলাপ করার। ভালো লাগবে তুমি এলে। মন খুলে কথা বলবো তোমার সাথে। প্রমিস। এসো কিন্তু।
জানিয়ো কবে আসবে।
ইতি
জাহ্নবী



প্রিয় অভি
দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে যে একটা আস্ত ভাই পেয়ে যাবো, ভাবতেই পারিনি। বন্ধু তো পেয়েইছি, সাথে পেয়ে গেলাম একটা ভাই। আজ থেকে, আমায় দিদি বলে ডাকবি। ঠিক আছে? কী? সব ঘেঁটে যাচ্ছে? কিচ্ছু বুঝছিস না তো? তাহলে সোজাসাপ্টা বলি। আমার বাবা হলো তোড় বাবা। মিস্টার অর্জুন রাঠোড়। কাজেই, আমরা ভাই বোন।
অবাক হচ্ছিস? কী করে এসব কী বলছি? ওই যে সেদিন আঙ্কেল বলছিলেন না? ছোট বয়সে কাউকে পছন্দ হয়ে গিয়েছিল? আর আমায় দেখে বারবার তার কথা মনে হচ্ছিলো... হবেই তো, কারণ সে যে আমার মা। সত্যি বলছি, আমিও দিল্লী ফেরার আগে অবধি জানতেই পারিনি। আমি এমনই গাধা, অর্জুন আঙ্কেলের নাম শোনার পরেও মাথায় স্ট্রাইক করেনি কিছু। শেষ রাত্রে মাকে আমাদের ছবি পাঠাতে মা চিনতে পারে তার এতগুলো বছর আগের ফেলে আসা কাছের মানুষটিকে। যাকে নানান কারণে সেই সময়ে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। আমি দিল্লী ফেরার পর মা আমায় বলে সে কথা। তবে কারণ, এখনও জানি না। এইটুকু জানি, দুজনের মান অভিমান বোধহয় এখনও রয়েছে। বলছি, একটা কমপ্লিট পরিবার চাই তো তোর? তাহলে আমায় সাহায্য করিস। মা আর আঙ্কেলের ভাব করাতেই হবে। আমি ক্রমশ তোকে সব জানাবো। তোর সাহায্য নেব। ঠিক আছে?
আর ওদের মিলমিশ না হলেও, আমরা কিন্তু ভাই বোন হয়ে গেলাম। আগাম নেমন্তন্ন করে দিলাম রাখীর দিন। দিল্লী। চলে আসবি। ঠিক আছে?
ইতি
তোর দিদি


শেষ চিঠিটা লিখতে যে জাহ্নবীকে কতবার ব্যাকস্পেস প্রেস করতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। তবু, শেষমেশ এই দাঁড়িয়েছে।

প্রিয় অর্জুন আঙ্কেল
আশা করি ভালো আছেন। প্রথমেই জানাই, আমি খুবই দুঃখিত একদিন আপনাকে মেল করিনি বলে। আসলে বাড়ি ফিরে এসে একটা অদ্ভুত রকমের অনুভূতির মধ্যে দিয়ে চলছিলাম। খুলেই বলি তবে।
আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে, দার্জিলিং শহরে আপনার আলাপ হয়েছিল একটি বাঙালি পরিবারের সাথে। মনে আছে? দাদা বৌদি আর ওদের ছোট বোন। মেয়েটি তখন সবে গ্র্যাজুয়েশন পাশ করেছে।  আপনার সাথে দেখা হতো প্রায় প্রতিদিন, ম্যালে। সকাল সন্ধ্যে। খুব জমাটি আলাপ আড্ডা চলত। তারপর একদিন সবাই মিলে বেড়াতে গেলেন লোকাল সাইটসিয়িং করতে। দিব্যি চলছিল। এর মধ্যে একদিন ঠিক হলো সবাই মিলে গাড়ি করে ধারেকাছে বেড়াতে যাবেন। কিন্তু দিনের দিন দাদা বৌদি যেতে পারলেন না। বৌদির তখন হঠাৎ ধুম জ্বর। বোনটিকে নিয়ে আপনি গেলেন ঘুরতে। ততদিনে অবশ্য দুই পক্ষেরই মন দেওয়া নেওয়া হয়ে গিয়েছে। তারপর আর কী, ক্ষণিকের অসাবধানতা। দুদিন পর ওরা ফিরে এলো। মেয়েটি এক মাস পর বুঝলো, ও আপনার সন্তানের মা হতে চলেছে। বাড়িতে জানানোর প্রশ্নই নেই। ভয়ানক রক্ষণশীল পরিবার। মেরেই ফেলতো হয়তো। আপনার সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু আপনি তখন দিশেহারা হয়ে যান। আশ্বস্ত করতে পারেন না। মেয়েটির আবার প্রবল আত্মসম্মান। একবার না শুনে আর চেষ্টা করেনি। সরকারী চাকরীর পরীক্ষা দিচ্ছিলোই। পেয়েও গেলো ভাগ্য ভালো। পোস্টিং দেরাদুন। চলে গেলো। আর সেখানেই কিছু মাস পর, আমার জন্ম।
আমার মা কোনদিনও আপনার সাথে, আপনার পরিবার বা মায়ের পরিবারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেনি। কেন? হয়তো অভিমান। একা হাতে আমায় বড় করেছে। আমি মানুষ হয়েছি। মা আর আমার এখন দুজনের সুখের সংসার।
আপনাকে লেপচাজগতে খুব ভালো লেগেছিল। মনে মনে ভেবেছিলাম (না চিনেই) যে আপনার সাথে মাকে ভালো মানাবে। সেই জন্যই মাকে জানাই সে কথা। ছবিও পাঠাই। মা আপনার ছবি দেখেই চিনতে পারে। তবে আমায় বারবার বারণ করে আপনাকে জানাতে। এই প্রথম আমি মায়ের কথা রাখছি না। আপনাকে লুকিয়ে চিঠি লিখছি। সবটা জানালাম আপনাকে। এদিকে মান অভিমান চুড়ান্ত পর্যায়ে আছে। বল এইবার আপনার কোর্টে। আপনি এবার যা ভালো বোঝেন।
ভালো থাকবেন। আঙ্কেল হিসেবেই শ্রদ্ধা করে যাবো চিরদিন।
ইতি
জাহ্নবী


তিনটে ইমেল পাঠিয়ে দিয়ে জাহ্নবী খানিক নিশ্চিন্ত। অনেক হাল্কা লাগছে। মাকে এখন এইসব কিচ্ছু বলা যাবে না বটে। দেখাই যাক, জীবন কী রেখেছে ওদের জন্য। কিছু হোক না হোক, একটা বন্ধু আর একটা ভাই তো পেলো। পিতৃপরিচয় জানলো, স্নেহ... সেও কপালে থাকলে জুটেই যাবে। অত আর ভাববে না। ডক্টর আস্থানা বলেছেন, "লিভ লাইফ ওয়ান ডে অ্যাট আ টাইম।" সত্যিই, সেই ভালো।


(শেষ)

Sunday, March 29, 2020

রঙ রুট (১৯)
সুচেতনা

অনেক রাত করে শুলেও, জাহ্নবীর ঘুম ঠিক সাড়ে ছটার মধ্যে ভেঙে গেল। ততক্ষণে অবশ্য সূর্যোদয় হয়ে গিয়েছে। পর্দার আড়ালে দুধ সাদা কাঞ্চনজঙ্ঘা রাজকীয়ভাবে বিদ্যমান। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। শুভকে দেখতে পেলো একটু দূরে, রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে। অভির দেখা নেই। জাহ্নবী এগিয়ে গেলো শুভর দিকে। "সুপ্রভাত", বললো ও।
শুভ হাসিমুখে ওকেও অভিবাদন জানালো। তারপর বলল, "তাহলে, কাল রাত্রে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা হলো?"
জাহ্নবী কপট রাগতস্বরে বললো, "আপনাদের দুই বন্ধুর পেটের ভিতরে কথা আর থাকে না। সত্যি।"
"কী করব, বেস্ট ফ্রেন্ডস।"
"আমার জানো আজ অবধি কখনো খুব ভালো বন্ধু হয়নি। কোনো বন্ধুত্বই খুব গভীরে যায়নি। তোমাদের দুজনের এই বন্ধুত্ব ভারী ভালো লাগে আমার। মনে হয়, আমারও  যদি এমন বন্ধু হতো।"
"রইলাম তো। শুভ অভি জাহ্নবী। ত্রিমূর্তি। এই বন্ধুত্ব কোনো অবস্থাতেই ভাঙবে না। দেখো। কথা দিলাম।"
জাহ্নবী মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলে, "এই স্নিগ্ধ পরিবেশে এমন অঙ্গীকার নিলে। এই প্রমিস কিন্তু কোনো অংশেই অগ্নিসাক্ষীর কম নয়। খেয়াল রেখো..."

ওদের কথার মধ্যেই দূর রাস্তা থেকে গাড়ির শব্দ শুনতে পায়। এত সকাল সকাল এদিকে কে এলো?
"আঙ্কেল বোধহয়।" শুভ বলে।
অল্প সময়ের মধ্যেই একটা সিলভার রঙের বোলেরো গাড়ি এসে থামে। ভিতর থেকে নেমে আসেন বছর পঞ্চান্নর এক সুপুরুষ ব্যক্তি। লম্বা, দীর্ঘদেহী ঋজু চেহারা। কাঁচা পাকা চুল। পুরু মোটা গোঁফ। সেই গোঁফের আড়াল থেকেই বেরিয়ে আসে এক চওড়া হাসি। শুভ ওঁকে দেখে এগিয়ে গিয়ে ঢিপ করে একটা প্রণাম সেরে ফেলে। ভদ্রলোক শুভকে জড়িয়ে ধরে বলেন, "ইয়ং ম্যান। এ কী, গলে মিলো। ইয়ে সব প্রণাম শনাম কিউ?"
"কেমন আছো আঙ্কেল? অনেক দিন পর দেখা হলো।"
"বেটা, খুব ভালো আছি। তুমি বলো। কাম ওয়াম সব ঠিক?"
"হ্যাঁ আঙ্কেল।" তারপর হঠাৎই শুভর মনে পড়লো জাহ্নবীর কথা। জাহ্নবী একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে ওদের। শুভ ওকে ইশারায় ডেকে নিয়ে বললো, "আঙ্কেল, মিট হার। শি ইজ জাহ্নবী। দিল্লীতে থাকে। চাকরি করে। জাহ্নবী, দিস ইজ অর্জুন আঙ্কেল। অভির বাবা।"
জাহ্নবী ভদ্রলোককে প্রণাম করেন। উনি ব্যস্ত হয়ে জাহ্নবীকে বাধা দিতে যান। "আরে আরে, করো কী? বেটিরা বাড়ির লক্ষ্মী। তারা কখনো আমাদের পায়ে হাত দেয়না। বুঝলে মা? এসো, ভিতরে চলো। শুভ, চলো। অভি আমায় বলেছে ওর কথা। আমি জানি। চলো বাকি গল্প চা খেতে খেতে।"
ইতিমধ্যে বেয়ারা এসে পড়েছে। সে আঙ্কেলের মালপত্র নিয়ে এগিয়ে যায়। ভদ্রলোক ওকে ডেকে বলেন, "ছোটবাবুকে ডেকে দাও। আর আমাদের জন্য চা পাঠাও।"

"তারপর, বলো। দার্জিলিং কেমন লাগলো তোমাদের?"
জাহ্নবী উত্তর দিলো, "ভালো। খুবই ভালো। তবে ওয়েদার ভালো ছিলো না। তাই একটু কম এনজয় করেছি। টাইগার হিল যাওয়া হয়নি।"
"হুম। দার্জিলংএর ওয়েদার নিয়ে একটা ব্যাপার আছে। ভেরি আনপ্রেডিক্টেবল।"
"আঙ্কেল আপনার ট্রিপ কেমন হলো?"
"ভালো রে শুভ। খুব ভালো। ওখানে একটা কাজেই গিয়েছিলাম। সেটা সেরে এলাম।"
"আরেকটা হোটেল কিনলে?"
"হ্যাঁ রে। ওই গৌহাটির আউটস্কার্টে। ওটাকে একটা ইকো রিসোর্টে কনভার্ট করতে হবে। এরকমই ইচ্ছে।"
"গ্রেট। ঐটা রেডি হয়ে গেলে নেক্সট টাইম চলে এসো। জাহ্নবী, তুমিও এসো। ইনভাইট করে রাখলাম।"
"হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। মাকে নিয়ে আসবো। মার খুব কামাখ্যা যাওয়ার ইচ্ছে। অনেক দিনের।"
"খুব ভালো। শিয়র। উই উইল বি গুড হোস্টস। কী বলিস অভি?" ইতিমধ্যে অভি এসে গিয়েছে ওদের মধ্যে। ঘুম ঘুম চেহারা এখনো।
"বাবা, শোনো না। তুমি কি টায়ার্ড নাকি আমাদের সাথে বেরোবে?"
"কোথায় যাবি?"
"ভাবছিলাম গাড়ি নিয়ে তিনচুলে ঘুরে আসবো।"
"আমি ড্রাইভ করতে পারবো না। তোরা কেউ করলে আমি রাজি।"
"আমি চালাবো আঙ্কেল?" জাহ্নবী প্রশ্ন করে।
"তুমি হিল ড্রাইভিং জানো?" আঙ্কেল একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন।
"হ্যাঁ! এই তো, লাস্ট ইয়ার সামারে মাকে নিয়ে আমি শিমলা থেকে ঘুরে এলাম। নিজেই ড্রাইভ করে।"
"গ্রেট, গ্রেট ইয়ং লেডি। খুব ভালো লাগে এইসব বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলো কী সুন্দর স্মার্ট। আমাদের ছোটবেলায় এরকম ছিলই না। ফ্রি মিক্সিং ও ছিল না। থিংজ হ্যাভ চেঞ্জড।"
অভি এইবারে একটু বাবার পিছনে লাগতে গেল। বললো, "তা ফ্রি মিক্সিং থাকলে কী হতো? কাউকে পছন্দ ছিল নাকি?"
আঙ্কেল হাহা করে গলা ছেড়ে হেসে বললেন, "সে তো ছিল। তবে দ্যাট লেডি ওয়াজ অলসো ভেরি মডার্ন। ভেরি স্মার্ট। একদম এই জাহ্নবীর মতো। ইন ফ্যাক্ট জাহ্নবী সো রিমাইন্ডস মি অফ হার।"
"আচ্ছা? তাই? বেশ বেশ। আমার কাজ তাহলে একটু ইজিই হলো।" জাহ্নবী মুচকি হেসে বলে। ওর অঙ্কেলকে খুব পছন্দ হয়েছে। মায়েরও যদি হয়...
"কী ব্যাপার?" কৌতূহলী হয়েই জিজ্ঞেস করেন আঙ্কেল। জাহ্নবী ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বলে, "এখন না। পরে ঠিক সময় হলে।"
"এই আজকালের বাচ্চাগুলো না..." এই বলতে বলতে আঙ্কেল নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যান। স্নান সেরে তৈরি হতে হবে।

পথেই লাঞ্চ করে নেবে, এই মর্মে ব্রেকফাস্ট শেষ করে ওরা চারজন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। দেড় ঘন্টার যাত্রাপথ গানে গল্পে দুর্দান্ত জমাটি হয়েছিল। তিনচুলে গিয়েও খুবই ভালো সময় কেটেছে। অসাধারণ সেই ভিউপয়েন্ট। সবুজালি। বরফ ঢাকা পাহাড়। গরম স্যুপ। মোমো। ছবির পর ছবি। সেলফি। হইহই করে সারাদিন যে কীভাবে কেটে গেল, টেরই পায়না ওর। তারপর ফেরার পালা। এমনিও খুব দেরি করলে চলবে না। কাল জাহ্নবীর ফেরার ফ্লাইট। ওকেও এসে লাগেজের ফাইনাল প্যাকিং করতে হবে। ফেরার পথে গাড়ি চালালো শুভ। পাঁচটার মধ্যে ওরা এসে পৌঁছল কটেজে।
জাহ্নবী ঘরে ফিরে মাকে ফোন করে গল্প করলো সারাদিনের। ফিরিস্তি দিলো। তারপর কথাটা কিন্তু কিন্তু করে পেড়েই ফেললো। বললো, "মা, আঙ্কেলকে কিন্তু আমার খুব পছন্দ হয়েছে। হি ইজ এ গ্রেট জেন্টিলম্যান। তোমারও ওঁকে খুব ভালো লাগবে। দেখো। দাঁড়াও ছবি পাঠাই।"
এই বলে জাহ্নবী সুভদ্রাকে ওর আর আঙ্কেলের একটা সেলফি পাঠায়। খুব প্রিয় এই ছবিটা। দুজনের চোখে মুখে হাসি।
মাকে ছবি পাঠিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে সুভদ্রার ফোনের। তবে কোনো ফোন আসে না। তাহলে হয়তো সিগনালের প্রব্লেম, জাহ্নবী ভাবে। ও ফোন করার চেষ্টা করে। লাইন লাগে না। ও ফিরে যায় লিভিং রুমে। গল্পের আসর বসেছে সেখানে। আঙ্কেল রসিয়ে রসিয়ে শুভ আর অভির ছোটবেলার নানান মজার কীর্তি বলে যাচ্ছেন। কথায় কথায় নিজের বিভিন্ন দেশভ্রমণের গল্পও বলেন। কত দেশ ঘুরেছেন আঙ্কেল। শখে। ব্লগ লিখতেন এক সময়। আঙ্কেল কথা বলেন ভারী ভালো। মুগ্ধ হয়েই শুনতে থাকে ওরা।
ডিনারের পর জাহ্নবী রুমে ফিরে আসে। মোবাইলে এখনো টাওয়ার নেই। তাই ফোন বা মেসেজ কোনো নোটিফিকেশনই নেই।
জাহ্নবীর মনটা একটু কেমন কেমন করে। এসেছিল এক অদ্ভুত মানসিক অবস্থায়। এখন যেন এখানে এসে অভি আর শুভর মতো এমন ভালো বন্ধু পেলো। বেড়ানো হলো ভালোই। তারপর শেষ পাতে আঙ্কেলের মতো মানুষের সাথে পরিচয়। পিতৃহীন জীবনে আঙ্কেল যেন কিছুটা হলেও সেইখানে স্নেহের স্পর্শ বুলিয়ে দিয়েছেন ইতিমধ্যেই। জাহ্নবী মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, এদের সকলের সাথে যোগাযোগটা বজায় ও রাখবেই। হয়তো একটু একটু করে হলেও, এইভাবেই ও একটা সুস্থ জীবনে ফিরতে পারবে। অনেকটা কৃতজ্ঞতা ও মন ভালো করা অনুভূতি নিয়ে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোল। রঙের সন্ধানে এলেও, এই রুটটা কোনোভাবেই, "wrong" বোধহয় হয়নি ওর।

পরেরদিন সকালে শুভ, অভি আর আঙ্কেল তিনজনে মিলে ওকে বাগডোগরা অবধি পৌঁছে দিয়ে এলো। মাঝে সিগনাল পাওয়ায় মেসেজ ঢুকলো। মায়ের মেসেজ। গতকাল রাতে পাঠানো। এইটুকুই। "তুই কোনো কথা বলবি না আর এই নিয়ে। আই ওয়ার্ন ইউ। বাড়ি আয় সাবধানে। আমি এয়ারপোর্ট যাবো।" মায়ের এই মেসেজে অবাক হয় জাহ্নবী। ও তো মায়ের সাথে একটু মজাই করছিল। অবশ্যই মায়ের অনুমতি না নিয়ে ও কিছুই করতো না। তাও, কে জানে। গাড়িতে অবশিষ্ট সময়টা আর এই নিয়ে মাথা ঘামায়নি জাহ্নবী। সবার সাথে আড্ডা দিয়েই কাটানোটা বেশি দরকারি মনে করল। মায়ের সাথে সামনাসামনি কথা বললেই সব সমস্যা ভুল বোঝাবুঝি মিটে যাবে। ও নিশ্চিত। কিন্তু এই তিনজনকে খুব শিগগিরই তো আর একসাথে পাবে না।
দুটো নাগাদ ওরা পৌঁছে গেল। এয়ারপোর্টের কাছে একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁয় ওরা একসাথে লাঞ্চ সারলো। আঙ্কেল কিছুতেই টাকা দিতে দিলেন না। জাহ্নবীর ফেয়ারওয়েল লাঞ্চ।
এত স্নেহ, এত ভালোবাসা। সত্যিই, জাহ্নবী অভিভূত। এক বুক ভালোবাসা, আবার দেখা হওয়ার ও যোগাযোগ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জাহ্নবী ঢুকে যায় এয়ারপোর্ট টার্মিনালে।

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

বি: দ্র: রিলিফ ফান্ডে টাকা দিলেন? বই নিলেন? আরো পাঁচজনকে জানালেন সেটার কথা?
রঙ রুট (১৮)
সুচেতনা

গভীর রাতে জাহ্নবীর ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎই। কিছু কি শব্দ কানে এলো? কী হলো? ও লেপের তলা থেকে হাত বের করে বেডসাইড টেবিলে রাখা মোবাইলে সময় দেখলো। আড়াইতে। ঢাকা দেওয়া জলের গ্লাসটা থেকে এক ঢোক জল খেলো। তারপর কী মনে হতে উঠে জানলার ধারে গেল। ভারী পর্দাটা সরাতেই চোখের সামনে যেন ম্যাজিকের মতো দৃশ্য। সে দৃশ্য না দেখলে কল্পনা করা যায় না। দুধ সাদা বিরাট কাঞ্চনজঙ্ঘা। তার ওপর চাঁদের জ্যোৎস্না ভেসে যাচ্ছে। সে এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্য। অবশেষে তাহলে মেঘ কাটলো। দেখা মিলল তার। গায়ে শালটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে জাহ্নবী একটু সাহস করেই দরজার বাইরে বেরোলো। আরো একটু ভালো করে যাতে দেখতে পারে। ক্যামেরাটা সাথে নিলো না। কিছু দৃশ্য মনের ক্যামেরায় বন্দী থাকাই ভালো বোধহয়।
দু চোখ ভরে দেখতে দেখতে কখন জানি গুনগুন করে গান শুরু করেছিল জাহ্নবী।
"সেই রাতে রাত ছিল পূর্ণিমা
রঙ ছিল ফাল্গুনী হাওয়াতে..."

"সত্যিই, আপনার গানের গলা কিন্তু অসামান্য। নিয়মিত চর্চা করেন?" অভির কথা শুনে চমকে যায় জাহ্নবী।
"ও মা, আপনি? কখন এলেন?"
অভি গেয়ে উঠলো, "যখন এসেছিলে, অন্ধকারে চাঁদ উঠেনি, সিন্ধুপারে চাঁদ উঠেনি।"
"আপনি তো অবাঙালি হয়েও বেশ ভালোই বাংলা গানের স্টক মেন্টেন করেন!"
"আসলে বেস্ট ফ্রেন্ড বাঙালি। তার ওপর আমার বাবা বাংলা ভালোবাসে। ছোট থেকেই শুনে এসেছি। বাঙালিরাই আসল ঐতিহ্য বজায় রেখেছে। তাই আর কী..."
জাহ্নবী কিছু বলে না আর। দু চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে সামনে। খানিক পর একটু গলা খাকরি দিয়ে অভি বলে, "একটা কথা ছিল।"
"বলুন?"
"বলছি যে এই দুদিন আমার ব্যবহারে নিশ্চয়ই আপনার খুব খারাপ লেগেছে।"
"কেন? খারাপ লাগবে কেন?"
"না মানে এটা খুবই অনভিপ্রেত। আপনার সামনে এরকম কথা কাটাকাটি, ঝগড়া। উচিত হয়নি।"
"সে বন্ধুদের মধ্যে ঝগড়া করা কখনোই উচিত না। আমার সামনেই হোক কি আড়ালে। তাই না?"
"হুম। আরো একটা কথা ছিল।"
"বলুন না।"
"আপনাকে আমি খুবই শ্রদ্ধা করি। আপনি ভীষণ লজিকাল। এবং ভালো মনের মানুষ।"
"ব্যস ব্যস। আর না। এত প্রশংসা আমার হজম হবে না।"
"না সত্যি বলছি। আপনি..."
"থাক না অভি। কিছু কথা, না বলাই থাকুক। তাই না?"
"থাকবে বলছেন?"
"হ্যাঁ। সেই ভালো।"
"আমারে না হয় না জানো..." (সুর করে)
"আমার ব্যাকুল নয়নও নেই, নেই উতল আঁচল বা এলোথেলো চুল।"
"সে ভাবনা ভাবতে হবে না। সেসবের আমার ব্যবস্থা অন্য। এই রে, আপনিও কি শুভর মতো ভাবলেন নাকি যে আমি আপনার প্রেমে পড়েছি?"
"পড়েননি?"
"উঁহু। আপনাকে ভালো বন্ধু মনে করেছি। ব্যস। আসলে আমাদের দেশে এইটাই সমস্যা। ছেলে মেয়ের বন্ধুত্ব যেন হতেই পারে না।"
"আপনি বাঁচালেন আমায়। নইলে ভীষণ অস্বস্তি হতো। খারাপ লাগতো। আসলে, আমি এখনো কাউকেই ভালোবাসতে, সেই অর্থে, বা কোনো সম্পর্কে জড়ানোর মতো মেন্টাল স্টেটে নেই। চাইনি কোনো কমপ্লিকেশন।"
"শুভ জানে?"
"কী?"
"এই যে, সম্পর্কে জড়াবেন না।"
"সবটা জানাতেই হবে? আমি তো বলিনি যে জড়াবো। বন্ধু হিসেবেই তো থাকতে পারি। সেই কথা জানে।"
"হুম। ভালো তবে।"
"অনেক রাত হলো। এবার ঘুমোতে যাই। আপনিও শুয়ে পড়ুন।"
"হুম। কাল কিন্তু একটা দারুণ সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাবো। ওয়েদার ভালো হয়ে গিয়েছে। কাজেই  ভিউ পয়েন্ট থেকে খুব সুন্দর দেখতে পাবেন। তিনজনেই যাবো।"
"আর আঙ্কেল?"
"যদি বাবা আমাদের বেরোনোর আগেই ফিরে আসে, তাহলে বলবো জয়েন করতে।"
"বেশ বেশ। আলাপ করতে আগ্রহী।"
"গুড নাইট।"
"গুড নাইট।"

(ক্রমশ)

বি: দ্র: আর হয়তো দুটো পর্ব। তারপর শেষ।
করোনা রিলিফ ফান্ডের জন্য বই নিলেন? বন্ধুমহলে জানালেন?

Friday, March 27, 2020

রঙ রুট (১৭)
সুচেতনা

জাহ্নবী আর শুভঙ্কর ফিরে আসে প্রায় পাঁচটা নাগাদ। এসে দেখে অভি নিজের ঘরে। দরজা বন্ধ করে রয়েছে। বেয়ারা জানালো, ও ঘুমোচ্ছে। ওকে যেন কেউ না ডাকে। বিরক্ত না করে। এই মর্মে নির্দেশ দিয়ে রেখেছে। শুভ আর জাহ্নবী একটু মুখ চাওয়াচাওয়ি করে যে যার নিজের ঘরে ফিরে গেল। অনেক হাঁটাহাঁটি হয়েছে। দুজনেই ক্লান্ত। বেয়ারা জিজ্ঞেস করলো, চা পাঠাবে কি না। শুভ পাঠাতে বললো। জাহ্নবী বললো ও পরে খাবে। ঘরে ফিরে ও সুভদ্রাকে ফোন করলো। সারাদিন পর মেয়ের গলা শুনে মায়ের একটু স্বস্তি। জমিয়ে রোডোডেনড্রোন দেখার কথা বললো। সুভদ্রা বললেন, "যাক। তোর এই যে রঙের খেলা দেখতে আসার ইচ্ছে, তাহলে সেটি পূর্ণ হলো। বল?"
"হ্যাঁ মা। খুব ভালো লাগলো। জানো তো, আই হ্যাড গুড কম্পানি। শুভঙ্কর। প্রবাসী বাঙালি। বম্বেতে থাকে। এখানকার যে মালিক, অভিমন্যু, ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। ওরই গেস্ট হয়ে এসেছে। ওদের দুই বন্ধুতে ঝগড়া হয়েছে। মান অভিমান পর্ব চলছে। তাই অভি আমাদের সাথে যায়নি।"
"কী নাম বললি?"
"শুভঙ্কর। এই রে পদবীটা কখনো জিজ্ঞেস করিনি।"
"না না। অন্য ছেলেটি। কী নাম ওর?"
"অভিমন্যু। ও ওর বাবার পালিত পুত্র। ও ও সিঙ্গল পেরেন্টের ছেলে জানো। তাই আমার সাথে খুব ভালো আলাপ হয়েছে। মিলমিশ খুব ভালো। বেসিকালি আমরা তিনজন দারুণ বন্ধু। দাঁড়াও, তোমায় ছবি পাঠাই।"
সুভদ্রা খানিকক্ষণ কিছুই বলেন না।
জাহ্নবী আবার বলতে থাকে, "কী গো মা? দেখলে?ছবি পাঠালাম।"
সুভদ্রা উত্তর দিলো, "হ্যাঁ। ওই লাল সোয়েটার ছেলেটি?"
"না। ওটা শুভ। অন্যজন অভি।"
"বাঃ। দুজনকেই কী ভালো দেখতে।"
"হ্যাঁ। শুনেছি ওর বাবা নাকি দারুণ হ্যান্ডসাম। সিঙ্গলও। কাল আসবেন। দেখা হবে। আলাপ করবো। শুভ তো ওর আঙ্কেল বলতে অজ্ঞান। সারাক্ষণ আঙ্কেল এই করেছে, আঙ্কেল এই বলে, এই করতেই থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয়, বাপ রে, এত ভালোও কেউ হয় নাকি? আচ্ছা মা, একটা আইডিয়া এলো। এই আঙ্কেল তো সিঙ্গল। তোমার সাথে প্যাচ আপ করাবো নাকি? কী? বলো বলো।"
সুভদ্রা রেগে গিয়ে বলেন, "চুপ চুপ। যত ফাজলামি ইয়ার্কি, না? কোথায় নিজের বিয়ে করার বয়স হচ্ছে, তা না। এখন তিনি মায়ের বিয়ে দিয়ে হেডলাইন হবেন। হুহ।"
"কেন মা? অসুবিধে কী? আমি বড় হয়ে গিয়েছি। আমার নিজস্ব জগৎ আছে। তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছ। ব্যস। এবার ঝাড়া হাত পা। নিজেকে এটেনশন দাও।"
"তুই থামবি?"
"আহা আহা, রেগে যাও কেন?"
"তুই চুপ কর।"
"আচ্ছা বেশ। কাল আঙ্কেলের সাথে দেখা হোক। ছবি তুলে পাঠাবো তোমায়। দেখো পছন্দ হয় কি না। অবশ্য আমায়ও দেখতে হবে। এলিজিবল কি না। তোমার জন্য অবভিয়াসলি।"
সুভদ্রা আর কোনো কথা না বলে ফোনটা কেটে দেয়। অদ্ভুত লাগে জাহ্নবীর। ওর মা যে কেন এতটা ক্ষেপে গেল, বুঝতে পারেনা। এমন নয় যে মায়ের বিয়ে দেবে বলে ও আগে কথা তোলেনি। মা রেগে যাননি। বরং মজায় যোগ দিয়েছেন। কে জানে।

ফোনটা চার্জে বসিয়ে জাহ্নবী ঘরে তালা দিয়ে বেরোয়। চা তেষ্টা পেয়েছে। পাশের বাড়ি যেতে গিয়ে হৈচৈ খোসগল্পের শব্দ কানে আসে। একটু থমকে দাঁড়ায়। শুনতে পায় অভি আর শুভর গলা। অভির ঘর থেকে। দরজা বন্ধ। গতকালের পর থেকে ওদের দুজনের এই বন্ধ ঘরের আলাপ ভাবলেই ভয় লাগে। তবে এখন তো মনে হচ্ছে সব ঠিকঠাক। হাসির রোল ভেসে আসছে দমকে দমকে। জাহ্নবী ভাবলো, থাক। পুরোনো বন্ধু। নিজেদের ঝামেলা নিজেরাই মিটিয়ে নেবে। ও বরং এর মধ্যে আর ঢুকবে না। বেয়ারকে এক কাপ চা দিতে বলে সোফায় বসলো।

চায়ের কাপে প্রথম চুমুকটা দিয়েছে, এমন সময়ে কানে এলো গীটারের টুংটাং। শোনা গেল শুভর কণ্ঠে
"কিছুদিন মনে মনে
কিছুদিন মনে মনে শ্যামের পিরিত রাখ গোপনে।
ইশারায় কইবি কথা গোঠে মাঠে..."

আঃ। এইটা তো মায়ের কাছে শেখা। প্রিয় গান। জাহ্নবী আর থামাতে পারলো না নিজেকে। দরজায় ঠ্যালা দিয়ে ঢুকে পড়ল ওদের আসরে।

বিছানার ওপরে দুজনে বসে। অভির হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। হাঁটুতে অন্য হাত দিয়ে তাল দিচ্ছে। শুভ বিভোর হয়ে গান গাইছে। জাহ্নবী তার সাথে ধরে ফেলল গান।

"শ্যামকে যখন পড়বে মনে
চাইবি কালো মেঘের পানে..."

শুভ অবাক হয়ে গান থামিয়ে তাকালো। জাহ্নবী ইশারায় ওকে গেয়ে যেতে বললো। ব্যস। তারপর সারা সন্ধ্যে চললো একের পর এক গান। কখনো অভি, কখনো শুভ। জাহ্নবীও গেয়েছে। বনফায়ার বার্বিকিউ প্ল্যান সব মুলতুবি। বেয়ারা এসে মাঝে মাঝে হুইস্কি আর পকড়া দিয়ে যাচ্ছিল। উষ্ণ পানীয়ে গলা ভিজে গান আরো খোলতাই।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যে নেমে রাত হয়ে আসে। ডিনারের তাড়া আসতে থাকে কিচেন থেকে। ওরা খেলে তবে বাবুর্চি বেয়ারা কাজ মিটিয়ে শুতে পারবে। জাহ্নবীরাও তাই দেরি করতে পারেনা আর। ডিনার টেবিলে গরম গরম ফ্রায়েড রাইস আর চিলি পনির। সাথে স্যালাড। আড্ডাও জমে ভালোই। জাহ্নবী খুব খুশি। অভি আর শুভর মনোমালিন্য যে কেটে গিয়েছে, এতেই আনন্দ। ও বলেও ফেলে সে কথা। শুনে দুই বন্ধু হো হো করে হেসে উঠে বলে, "আরে, আমরা এরকমই। সেই চাড্ডি আমলের বন্ধু। ঝগড়া ভাব, লোগেই থাকে। We fight like crazy and make up easier!"
"হলেই ভালো", জানায় জাহ্নবী।

খাওয়া দাওয়া মিটিয়ে এবার ওরা নিজেদের ঘরে ফেরার উদ্যোগ করে। সারাদিনের পরিশ্রমে দুজনেরই চোখে ঘুম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একবার আকাশের দিকে তাকালো শুভ। মেঘ একটু কাটবো কাটবো করছে। তারাও দেখা যাচ্ছে অল্প। শুভঙ্কর বললো, "দেখছো আকাশটা? মনে হয় রাত্রে ক্লিয়ার হতে পারে। আর তাহলেই কাঞ্চনজঙ্ঘা।
জাহ্নবী মাথা নেড়ে বলে, "দেখা যাক। আমার সাধনার ফল কী দাঁড়ায়..."

(ক্রমশ)

বি: দ্র: আপনাদের থেকে সাড়া পেয়েছি ত্রাণ তহবিলের জন্য। অপেক্ষায় আছি আরো স্বতঃস্ফূর্ত সাড়ার। আপনারা বার্তাটি ছড়িয়ে দিন পরিচিত মহলে। এমার্জেন্সী ফান্ডে টাকাটা দ্রুত পৌঁছে যাওয়া খুব খুব দরকার এখন। বিস্তারিত জানতে আমার সকালের পোস্টটি দেখুন।


রঙ রুট (১৬)
সুচেতনা

লেপচাজগতের হোমস্টেটা আরো সুন্দর। একদম জঙ্গলের মধ্যে। দুটো একতলা কাঠের বাংলো পাশাপাশি। একটাতে অভি থাকে ওর বাবার সাথে। সেখানেই কিচেন, ডাইনিং রুম আর ছোট অফিস। অফিসঘরেই থাকে বাবুর্চি আর বেয়ারা। পাশের বাড়িতে তিনটে ঘর। সেখানেই দুটোতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে জাহ্নবী আর শুভর। অভি থাকবে নিজের বাড়িতেই। ওর বাবা কাল সকালে এসে পৌঁছবেন গৌহাটি থেকে। আজ এখন ব্রেকফাস্ট সেরে ওদের রোডোডেনড্রোন দেখতে যাওয়ার কথা। অভি ওদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসছিল, এমন সময়ে শুভ ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, "অভি, আমরা তাহলে কখন বেরোচ্ছি? লাঞ্চের আগে না পরে?" অভি একবার তাকালো শুভর দিকে। তারপর জাহ্নবীর দিকে। তারপর ঠান্ডা গলায় কেটে কেটে শুভর দিকে ফিরে বললো, "আমি যাব না। তোরা দুজনে বরং যা। সাথে যদি অরিজিৎকে লাগে, ও যাবে। তোরা একাও যেতে পারিস। সোজা রাস্তা। কোনো অসুবিধে হবে না। ইন ফ্যাক্ট, সুবিধেই হবে। তোরা প্রাইভেসি পাবি।" এই বলে অভি বেরিয়ে গেল, গটগট করে।
জাহ্নবী বিহ্বল। শুভর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো, "ব্যাপারটা কী হলো?" শুভ ওকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে বললো, "চাপ নিয়ো না। অভিটা ওরকম। চিরকাল। হি উইল বি ফাইন।" জাহ্নবী বুঝে ওঠেনা এদের ব্যাপার। শুভ আর অভি, দুজনেই দুজনের সম্পর্কে ঠিক এক কথা বলে। আসলে ওরা দুজন দুজনের ভীষণ ভালো বন্ধু। তাই হয়তো এই মান অভিমান, এবং তার পরে যে সব ঠিক হয়ে যাবে, তার নিশ্চয়তা।

কিচেন থেকে স্যান্ডউইচ, কফি আর স্যালাড প্যাক করে দেয় বাবুর্চি। শুভ আর জাহ্নবী সেই ফুড হ্যাম্পার সাথে নিয়ে এগিয়ে চলে রঙের উদ্দেশ্যে। রঙ রুটে। সবুজ পাইনের জঙ্গল। টাটকা বাতাস। বুক ভরা নিঃশ্বাস। হালকা মেঘ। রোদের তেজও কম। পথে চলতে বেশ আরাম। জাহ্নবীর গলায় ঝুলছে ওর ভারী ক্যামেরাটা। চলতে চলতে মাঝে মাঝে এদিক ওদিকের ছবি তুলে চলছে। টের পাচ্ছে গুনগুন করে গান করতে করতে শুভর মোবাইলের লেন্স মাঝে মাঝেই ওর দিকে তাক হচ্ছে। মৃদু প্রতিবাদ করায় শুভ সুন্দর যুক্তি দিয়ে বলে দিলো, "তুমি তো সারাক্ষণ অন্যদের ছবি তুলছো। তোমার ছবিও তো কাউকে তুলতে হবে। মাকে পাঠাবে না নাকি?" এরপরে আর কিছু বলার থাকে না জাহ্নবীর। মোক্ষম জায়গায় শুভ মোচড়টা দিয়েছে।
এইবার ক্রমশ হাঁটার পথের দুই দিকের দৃশ্য বদলাতে থাকে। ঘন সবুজের মাঝে মাঝে কয়েক ঝলক লাল। থোকা হয়ে ফুটে আছে রোডোডেনড্রোন। আরো খানিকটা হাঁটতে থাকে ওরা। পথ একটু চড়াই। অল্প হাঁপ ধরছেও বটে। একটু বসলে হয়। জাহ্নবী সে কথা বলে শুভঙ্করকে। শুভ হাতের কব্জি ঘুরিয়ে সময় দেখে বলে, "আড়াইটে বাজতে যায়। বরং এর একটু এগিয়ে ঐখানে যাই। ফাঁকা ফাঁকা আছে। বসে লাঞ্চ সেরে আবার ফিরি। নইলে অন্ধকার হয়ে যাবে। এইসব জায়গায় ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে। এই জঙ্গলে আবার লেপার্ড টেপার্ড আছে কি না কে জানে।" জাহ্নবী শুভর কথায় সম্মতি জানিয়ে এগিয়ে চলে। মিনিট দশেক পর ওরা পৌঁছয় একটা খোলা জায়গায়। একটু সমতল গোছের। দুধারে গাছের সংখ্যা কম। চারিদিকে রোডোডেনড্রোন গাছের সারি। হ্যাম্পার থেকে খাবার বের করে ওরা খেতে থাকে। চলতে থাকে গল্প।
জাহ্নবী হঠাৎ সামনের পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে, "আচ্ছা শুভ, কাল রাতে অভিমন্যুকে তুমি কী বেশ একটা গ্রাজ নিয়ে বলছিলে, সেটা কী?"
শুভ খাওয়া থামিয়ে জাহ্নবীর মুখের দিকে তাকায়। জাহ্নবী নিষ্পলক দৃষ্টিতেই তাকিয়ে থাকে, যেমন ছিল। শুভর উত্তরের অপেক্ষায়। শুভ একটু ইতস্তত করে বলে, "ও বেশ পুরোনো কাসুন্দি। না ঘাটলেই ভালো। দরকার কী?"
"দরকার আছে শুভ। বলো।"
"ওয়েল, শুনতে যদি চাওই তো শোনো। নাথিং এক্সট্রা অর্ডিনারি। আমরা কলেজে দুজনেই বিশাখাকে ভালোবাসতাম। আমি আগে। তারপর অভি। ইন ফ্যাক্ট, বিশাখা আমায় ডিচ করে। তারপর অভি সিনে আসে। ন্যাচারালি আই ওয়াজ শকড। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমারই এক্স গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঘুরছে। ওই সময়ে আমাদের খুব ঝামেলা হয়। কথা বন্ধ হয়েছিল অনেক মাস। খুবই অকওর্ড সিচ্যূএশন। তারপর ইয়ারের শেষের দিকে বিশাখা অভিকেও ডিচ করে। অভি অনেকদিন অবধি ভেবে এসেছে এর জন্য আমি দায়ী। আংকেল, মানে ওর বাবা, সব জেনে শুনে আমাদের দুজনকে একসাথে বসিয়ে অনেক বোঝান। উই মেড পিস। অর সো আই থট। এখন দেখছি, উই ডিড নট। কাল আঙ্কেল আসবেন। মে বি উই উইল নিড হিম টু পুট সাম সেন্স ইন্টু আস।"
জাহ্নবী আলতো করে চেপে ধরে শুভর হাত। ওর কাঁধে মাথা দিয়ে বলে, "দেখো, ইট উইল বি ইজি। অভিও রিপেন্ট করছে কালকের ঝগড়া। আই কুড সি ইট ইন হিজ আইজ। আর তুমিও যথেষ্ট আগ্রহী টু সর্ট থিংজ। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর আমার দিকে থেকে একটা কথা বলতে পারি, তুমি আর অভি, দুজনেই আমার খুব ভালো বন্ধু। আশা করি সেটা বজায় থাকবে।"
পড়ন্ত দুপুরের সোনালী আলো এসে পড়ে ওদের মুখে। খানিকক্ষণ শান্ত হয়ে বসে উপভোগ করে নিস্তব্ধতা। তারপর ফিরতে হবে, নইলে অন্ধকার, এই চিন্তায় হাঁটা লাগায়।

(ক্রমশ)

Thursday, March 26, 2020

রঙ রুট ১৫
সুচেতনা

V

মেঘ এখনো কাটেনি। দার্জিলিংয়ে  থাকার মেয়াদ আজ সকালেই শেষ হলো। জাহ্নবীর কপালে কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন, মেলেনি। মা বোধহয় ঠিকই বলেছে, সবার জন্য নয়। সাধনা করতে হয়। আর জাহ্নবীর সাধনা বুঝি যথেষ্ট হয়নি। আজ লেপচাজগৎ যাচ্ছে ওরা। সন্দীপের ওখানে ব্রেকফাস্টের পর রেজিস্টারে প্রয়োজনীয় সই সাবুদ মিটিয়ে রওনা দিয়েছে, অরিজিতের গাড়িতেই। দার্জিলিংয়ের আবহাওয়া ভালো না থাকায় টাইগার হিল ওরা যায়নি। মূলত পায়ে হেঁটেই যা ঘুরে বেরিয়েছে। তবে গতকাল একবার ঘুম আর বাতাসিয়া লুপ ঘুরে এসেছে।
লেপচাজগৎ মোটে এক ঘন্টার পথ। আড্ডার ছলে গাড়িতে উঠতে না উঠতেই প্রায় পৌঁছে যাওয়া। দুই ধারে সারি সারি পাইনের রাজি, সবুজ। টাটকা তাজা বাতাস। হ্যাপি হিল হোম স্টের সামনে গাড়ি থেকে নেমে বুক ভরে টাটকা বাতাসে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিলো জাহ্নবী। আহা, কী পরিষ্কার এই বাতাস। কোনো দূষণের জায়গাই নেই। শুভঙ্করকে ডেকে বললো, "কী অদ্ভুত সুন্দর না জায়গাটা? দেখো শুভ, কী শান্ত, নিস্তব্ধ। একটু কান পাতলেই কত রকমের পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। শোনো।" শুভ মাথা নেড়ে সায় দেয়। জাহ্নবীর সাথে যাবতীয় মান অভিমান পর্ব মিটে গিয়েছে ওর। দার্জিলিংয়েই। সেদিন অভি আর জাহ্নবী ম্যাল থেকে তারপর জলাপাহার রোডের দিকটা অবধি দেখে এসেছিল। শুভর দেখা মেলেনি। তবে ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে শুভ হাজির। ও নাকি কোনো এক ছোট্ট তিব্বতি দোকানে বসে কয়েক কাপ চা আর ম্যাগি সহ স্থানীয়দের সাথে এমনই কথা বলতে ব্যস্ত ছিল যে ম্যালে এসে ওদের সাথে দেখা করার সুযোগ পায়নি। "বলো ভুলে গিয়েছিলে।" জাহ্নবীর অভিযোগ অবশ্য সরাসরি না করে উড়িয়েই দিয়েছিল। সন্ধ্যের বনফায়ার, বার্বিকিউ সব সময়ই একটা চোরা চাপা টেনশন, জাহ্নবী আর অভি ভালোই বুঝতে পারছিল। শেষমেশ ওরা আর নিজেদের দমিয়ে রাখতে পারেনি।
রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে জাহ্নবী বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। মন খারাপ। মন অস্থির। এমন সময় দূরে অভির ঘর থেকে কথা কাটাকাটির শব্দ ভেসে আসছিল। নির্জন, নিরিবিলি। তাই মোটামুটি কথা বোঝাই যাচ্ছিল। শুভঙ্কর একটু মাত্রাতিরিক্ত মদ খেয়ে বসেছিল। আর মদ পেটে পড়তেই বীর বাঙালির মতোই কথার ফুলঝুরি শুরু।
"শুভ তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস।"
"বাড়াবাড়ি? আমি করছি না তুই?"
"তুই।"
"সেই তো, সেই তো। সারা বিকেল জাহ্নবীর সাথে ম্যালে বসে সোহাগ কে করেছিল রে? আমি? না তুই?"
"আস্তে শুভ, আস্তে। নিরিবিলি। সবাই শুনতে পাবে।"
"শুনুক। লোকের জানা উচিত। ভদ্রতার মুখোশের আড়ালে আসল অভিমন্যুকে।"
"আসল অভিমন্যুর কী হয়েছে?"
"এই যে যেই দেখলি, যেই বুঝলি, মেয়েটাকে আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে, ইউ হ্যাড টু কাম ইন বিটুইন আস। তুই এখনো বিশাখার সাথে তোর ঝামেলার জন্য আমায় দায়ী করিস। তোদের ব্রেক আপের দায় আমার নয় অভি। ফর গডস সেক। আন্ডারস্ট্যান্ড, বিশাখা ব্রোক আপ বিকজ অফ হার ওন রিজনস। আই হ্যাড নাথিং টু ডু দ্যেয়ার। প্লিজ তুই সেই গ্রাজটা আমার আর জাহ্নবীর মধ্যে এনে ফেলিস না। প্লিজ। বিন এ লং টাইম সিন্স আই গট দ্য কারেজ টু লাভ। জাহ্নবীকে আমি ভালোবাসি। ওকে আমি ভালো করে চিনতে চাই। ডোন্ট কাম ইন বিটুইন আস। প্লিজ অভি।"

জাহ্নবী স্তব্ধ হয়ে শুনে গিয়েছে কথাগুলো। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। টুঁ শব্দটি না করে দুই চোখ দিয়ে গরম নোনতা কান্না নেমে চলেছে। কাঁদতে কাঁদতে জাহ্নবী কখন জানি ধপ করে পড়ে গিয়েছে বারান্দায়। টাল রাখতে না পেরে। সেই সময়ে কাঠের টেবিলটা উল্টে পড়ে। তারই শব্দে চমকে বারান্দায় এসে ওকে এই অবস্থায় দেখে অভি আর শুভ। ছুটতে ছুটতে আসে ওরা দুজন। ওর ঘরের দরজা ভাগ্যিস ভ্যাজানো ছিল। জাহ্নবীকে সযত্নে, পরম মমতায় দুই হাতে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয় শুভঙ্কর। অভি জলের ছিটে দেয়। সেই স্পর্শে জাহ্নবীর জ্ঞান ফিরলেও ডুকরে কেঁদে ওঠে আবার। শুভঙ্কর সারা রাত থেকে যায় ওই ঘরে। জাহ্নবীর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে ও। চুলে বিলি কেটে দেয়। ওর কোলে মাথা কখন জানি জাহ্নবী নিশ্চিন্তে ঘুমের ঘোরে পৌঁছে যায়। শুভ তবু ওঠে না। কষ্ট হলেও, নড়ে না। পাছে জাহ্নবীর কষ্ট হয়। অভি খানিক চেয়ে থাকে ওদের দিকে। তারপর ফিরে যায় নিজের ঘরে। শুভটা আজ অনেকগুলো পুরোনো ক্ষত চাগাড় দিয়ে দিয়েছে। সারাতে হবে। প্রলেপ, সেই আদি অকৃত্রিম বৃদ্ধ, বৃদ্ধ সন্ন্যাসী।

(ক্রমশ)

Wednesday, March 25, 2020

রঙ রুট ১৪

চা খেয়ে জাহ্নবী আর অভি ম্যালের দিকে হাঁটা লাগালো। যেতে যেতেই দুজনের মধ্যে টুকরো গল্প চলতে লাগলো। ম্যালে পৌঁছে অবশ্য এদিক ওদিক খুঁজেও শুভর দেখা মিলল না। অভি জাহ্নবীকে আশ্বস্ত করে বলল, "ঠিক আছে। শুভ হয়তো এগিয়ে গিয়েছে, এদিক ওদিকে ঘুরছে। কোন অসুবিধে নেই। ম্যাপ দেখে দেখে ঠিক চিনে ফিরে আসবে, দেখা না হলেও। আসুন, আমরা এইদিকটা বসি।" জাহ্নবী সায় দিল। অভির সাথে গল্প করতে খুব ভালো লাগছে। মিশুকে ছেলে। এবং বেশ মজার মজার কথা বলে। জাহ্নবী বেশিরভাগ সময়ই চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। কথায় কথায় অভি জানালো, ও সিঙ্গল পেরেন্টের কাছে মানুষ। বাবার কাছে। ছোট থেকে বড় হওয়া, পুরোটাই হোস্টেলে কাটিয়েছে। বাবার সাথে সময় কাটানো বলতে ওই স্কুলের ছুটিগুলোতে। খুবই আনন্দের ছিল সেসব দিন। কিন্তু বাবা ব্যস্ত ব্যবসা নিয়ে। আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। তাই ছোট্ট অভিকে হোস্টেলেই থাকতে হয়েছে। হোস্টেলের বন্ধুরাই কখন জানি বন্ধুর গন্ডি টপকে হয়ে গিয়েছে পরিবার। শুভঙ্করও তেমন। একদম স্কুল জীবনের বন্ধু। এখনো যোগাযোগটা সমানভাবে বজায় রয়েছে। অভির কথা শুনতে শুনতে জাহ্নবীর বারবার মনে হচ্ছিল, এ যেন ও নিজের কথা শুনছে। অভির শুধু বাবা আছে। ওর আছে মা। আর এই যে বন্ধুরা, পরিবারের চেয়ে কোনো অংশে কম না। এইটাও তো একদম বর্ণে বর্ণে সত্যি। জাহ্নবী বললো, "আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি অভি। আমারও জীবনের গল্প ডিটো।" অভি ওর দিকে তাকিয়ে বলল, "তাই ভাবি। এত মিল লাগছে কেন। আপনিও তার মানে এক ধাতুতেই গড়া। ও আরেকটা কথা, আপনাকে সকাল থেকে দেখেই খুব চেনা চেনা লাগছিলো। মনে হচ্ছিল যেন কোথায় দেখেছি এই মুখ। এখন বুঝছি। এটা বোধহয় আমাদের মতোদের চেহারার বৈশিষ্ট্য। আমরা ইন্ডিপেন্ডেন্ট, আমরা একটু আলাদা। তাই না?" জাহ্নবী একটু থেমে উত্তরে বলে, "আলাদা কি না জানি না। তবে হ্যাঁ, মানুষ হয়েছি আলাদা ভাবে। অন্যদের তুলনায়। ছোট থেকে সব সময় দেখে এসেছি বন্ধুরা সবাই পেরেন্ট টিচার্স মিটিংয়ে বাবা মা সহ এসেছে। আই হ্যাড ওনলি মাই মাদার। ফেস্টিভ্যালসে, জন্মদিনে, ভেকেশনে, সব্বাই মা বাবা নিয়ে আনন্দ করেছে। কিন্তু আমি? শুধু মা। এমন কী, আই ডিড নট ইভেন হ্যাভ আ সেট অফ গ্র্যান্ডপেরেন্টস।" অভি মাথা নাড়লো, তারপর জিজ্ঞেস করলো, "ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, হোয়াট এবাউট ইয়োর ড্যাড?"
"লেফ্ট। মাকে ছেড়ে চলে যায়, আমার জন্মের আগে।"
"আই সি। আর তোমার, আয়াম সরি, আপনার মায়ের রিলেটিভস? তারা?"
"তুমিটাই বরং থাকুক বুঝলে? ঐটাই বেস্ট। আমারও অসুবিধাই হচ্ছিল আপনিতে। জানি না। তোমায় কেন সব কথা বলছি। ইউজ্যুয়ালি আমি বলিনা কাউকে। অনেকেই শুনলে ভাবে আমি সিমপ্যাথি গ্যাদার করার চেষ্টা করছি। কিন্তু না। আই হ্যাড এ ডিফিকাল্ট চাইল্ডহুড। আমার মায়ের রিলেটিভসরাও মাকে ডিচ করেছিল। অল বিকজ শি chose টু হ্যাভ মি as an unmarried লেডি। আই হ্যাভ অলওয়েজ হ্যাড দিস সেন্স অফ ইনকমপ্লিটনেস। এই জন্য, ছোট থেকে অনেক কষ্ট পেয়েছি। ভুগেছি। মেন্টালি। আমার লেখাপড়া হ্যাম্পার্ড হয়েছে। থ্যাংকফুলি আমি এখন প্রফেশনাল হেল্প নিচ্ছি। তাই অনেক ভালো আছি। মাঝে মধ্যে মুড সুইংস হয়। থেরাপিস্টের সাহায্যে আমি নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছি।"
অভি কয়েক পলক তাকায় জাহ্নবীর দিকে। তারপর "এক মিনিট, আসছি" বলে এগিয়ে যায় আইসক্রিম বিক্রেতার দিকে। তারপর দু হাতে দুটো সফটি কিনে নিয়ে এসে বসে বেঞ্চে, জাহ্নবীর পাশে। ওর দিকে একটা কোন এগিয়ে দিয়ে বলে, "এই নাও। ধরো। বাবা বলে, দেয়ার ইজ নো স্যাডনেস দ্যাট এন আইসক্রিম ক্যান নট সল্ভ। এটা খাও। ভালো লাগবে। আর রাত্রে ভালো ভালো গান গেয়ে আমরা দারুণ টাইম স্পেন্ড করবো। ঠিক আছে? সন্দীপকে বলে দিই, বার্বিকিউ এর ব্যবস্থা রাখতে। গুড ফুড, গুড মিউজিক। সব মন খারাপ সেরে যাবে।" জাহ্নবী মাথা নেড়ে যোগ দেয়, "গুড কম্পানি টু।"
অভি বলে, "দেখো, তোমার সাথে আমি এমপাথাইজ করতে পারছি। অনেকটা একইরকম আমাদের অবস্থা। আরো শুনবে? আমি আবার হলাম গিয়ে, adopted। কাজেই বুঝতে পারছ। তবে হ্যাঁ, আমার বাবা কোনোদিনও আমায় সেটা ফিল করতে দেয়নি। বাবা আমায় খুব ভালোবাসে। বাবা ইজ মাই লাইফ। আমার বাবা খুব ভালো। খুব মিশুকে। খুব ফ্রেন্ডলি। আই থিংক ইউ উইল লাভ হিম। এই তো, আমরা পরশু লেপচাজগৎ যাবো। বাবা ওখানে থাকবে। রোডডেনড্রোন ট্রেইলে বাবা আমাদের গাইড করবে। মিট হিম। ইউ উইল ফিল হ্যাপি।"
জাহ্নবী সম্মতি জানায়। অভির মধ্যে একটা বন্ধু খুঁজে পেয়ে ভালো লাগে ওর। অনেক হালকা লাগে কথা বলে।


(ক্রমশ)

Tuesday, March 24, 2020

রঙ রুট ১৩
সুচেতনা

তেল মেখে স্নান, এক রাত্তিরের জার্নির ধকল, আর তারপর গরম গরম ডাল ভাত আলু ভাজা মুর্গির মাংসের ঝোল দিয়ে লাঞ্চ। ঘুমটা যে জাহ্নবীর রীতিমতো সেরা হয়েছিল, সে আর বলতে? বিকেলে ঘুম ভাঙল শুভঙ্করের দরজা ধাক্কানিতে। "কী হে, বেড়াতে এসে খালি ঘুমোলেই চলবে নাকি?" জাহ্নবী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। "বিকেলে তো আমাদের ম্যালে যাওয়ার কথা। তাই তো?" প্রশ্ন করে শুভঙ্করকে। শুভ উত্তর দেয়, "হ্যাঁ। ওই জন্যই তো ডাকতে এলাম। চারটে বেজে গিয়েছে। চলো নীচে নামি। কফির জন্য তাগাদা দিই। তারপর বেরোই। অভিকেও ডেকে নিয়েছি। আজ ঘুরতে ঘুরতে কালকের বেড়ানোর প্ল্যানটা করে ফেলতে হবে। শুনেছি এখন রডোডেনড্রোনের সময়। চারিদিক লালে লাল। রঙের খেলা। যেতেই হবে।" জাহ্নবী উত্তর দেয়, "হ্যাঁ। মূলত ওই রঙের টানেই আমার আসা। অন্য একটা এক্সট্রা টান আছে বটে।" শুভঙ্কর ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, "এক্সট্রা টান?" জাহ্নবী বলে, "হুম। সে আছে একটা।" শুভঙ্কর একটু দুষ্টু হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বলে, "বাবা, আমি তো জানতাম না যে তুমি ভবিষ্যৎ দেখতে পাও?" জাহ্নবী প্রশ্নসূচক দৃষ্টি মেলে তাকালো শুভর দিকে। শুভ নিজের কথা খোলসা করে জানালো, "ইয়ে মানে আমি বলতে চাইছিলাম যে তুমি কি এটাও জানতে যে দার্জিলিংয়ে এলে আমার সাথে দেখা হয়ে যাবে?" জাহ্নবী উত্তরে বেশ বিরক্ত হয়েই বললো, "কোনো মানে হয়? আর হ্যাঁ, শোনো, ফ্লার্টিং ইজ ফাইন। তবে লিমিট রেখে। বুঝলে? এখন প্লিজ আমায় যদি এক্সকিউজ করো, আমি তবে তৈরি হয়ে নীচে নামি।" এই বলে জাহ্নবী মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলো। শুভঙ্কর হা। এ আবার কী। মেয়েটার কিছু একটা ব্যাপার আছে। এক সময় এই কত হেসে কথা বলে, আবার হঠাৎ হঠাৎ কেমন চুপ করে যায়। রেগে যায়। অদ্ভুত কেস।
বন্ধ দরজার আড়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জাহ্নবী। নিজের মনের ওপর, হাবভাবের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না। কেন? এ কী। দার্জিলিংয়ে আসা, পুরোটাই ডক্টর আস্থানার পরামর্শে। কিন্তু এখানে এসে যে এরকম মুড সুইং হবে, ভাবতে পারেনি। ফোন বের করে ডক্টরকে মেসেজ করলো ও। লিখলো মনের অবস্থার কথা। ডক্টর অনলাইন ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ওকে উত্তরে শান্ত হওয়ার পরামর্শ দিলেন। সাথে বললেন, ওর ওই ফিলিং রেকর্ড বইয়ে গোটা ঘটনাটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিখে রাখতে। এতে উপকার পাবে। আগেও যেমন পেয়েছে। জাহ্নবী ব্যাগ থেকে চকলেট বের করে খেলো একটু। চকলেট খেলে নাকি হ্যাপি হরমোন সৃষ্টি হয়। মন ভালো থাকে। দেখা যাক। খসখস করে খাতায় লিখতে থাকে। পরপর ঘটনা। শুভর কথা শুনে ওর রাগের কারণ। রাগ? না দুঃখ? লিখতে লিখতে মনে হয়, আচ্ছা, শুভঙ্কর তো সত্যিই জানে না ওর অতীত। ওর মায়ের অতীত। তাই ও এও জানে না যে দার্জিলিংয়ের কী আলাদা মূল্য ওর জীবনে। তাই মজার ছলে বলেছে। জাহ্নবীর খারাপ লেগেছে। তবে শুভ তো যেচে ওকে কষ্ট দিতে যায়নি। অপরাধবোধ জাগে জাহ্নবীর মনে। শুভর সাথে এরকম ব্যবহার করা উচিত হয়নি।
তড়িঘড়ি বাথরুমে ঢুকে ঠান্ডা জলের ছিটে দেয় চোখে মুখে। তারপর পোশাক পরিবর্তন করে তৈরি হয়ে দরজা খুলতে যাবে, টোকা। নিশ্চয়ই শুভ। ইশ। ক্ষমা চাইবে। দরজা খুলেই জাহ্নবী বলে, "ভেরি সরি।" সামনে দাঁড়িয়ে অভি। জাহ্নবীর কথা শুনে অবাক। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো, "না মানে ইয়ে, ঠিক আছে। দেরি হয়নি তেমন। আমি জাস্ট জানতে এসেছিলাম। আপনি কফি খাবেন, না চা।" জাহ্নবী ছোট্ট করে মাথা নেড়ে "চা" বলে এগিয়ে যায় দরজার বাইরে। অভি অবাক হয়েই তাকিয়ে থাকে। ঘরের চাবি লাগাতে লাগাতে জাহ্নবী প্রশ্ন করে, "আপনার বন্ধু কই?" অভি উত্তরে জানায় যে শুভঙ্কর একটু আগেই বেরিয়েছে। ম্যালের দিকেই গেছে। বলে গেছে অভি যেন জাহ্নবীর সাথে বেরোয়।
জাহ্নবী বোঝে, ওইদিকেও গোঁসা হয়েছে। হুম। কিছু একটা করতে হবে। চা খেতে খেতে অভিকে জিজ্ঞেস করে, "আপনার বন্ধু বুঝি খুব অভিমান করে কথায় কথায়?" অভি এমন অবাক হয় এই প্রশ্নে, চা চলকে ওঠে। জাহ্নবী "এই রে, সরি সরি" বলে এগিয়ে যায় অভির দিকে। অভি কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, "ইটস ওকে। আসলে শুভ আর অভিমান, এই দুটো শব্দ একই বাক্যে শুনে একটু চমকে গিয়েছিলাম। একদম চিন্তা করবেন না। ও ব্যাটা মোটেই রাগে না।"
জাহ্নবী লক্ষ্য করে, অভির কথাবার্তাতে একটা অবাঙালি টান আছে। ওর কথার উত্তরে জিজ্ঞেস করে, "আপনি কি ওয়েস্ট বেঙ্গলে পড়াশোনা করেননি? আপনার বাংলায় একটা টান আছে.."
অভি উত্তর দেয়, "আমি তো বাঙালি নই। আমরা হিমাচলের। এখানে সেটেল্ড।" জাহ্নবী "আচ্ছা" বলে কাপ নামায়। চা শেষ। এইবার বেরোতে হবে।

(ক্রমশ)

বি: দ্র: আগের পর্ব খুব ছোট বললেন সবাই, তাই আজ আর একটু লিখলাম। প্লিজ আর পারবো না লিখতে আজ। লেখা আসবে না।
রঙ রুট ১২
সুচেতনা

হোম স্টেটা একটি ছোট্ট দোতলা কাঠের বাড়ি। এক তলায় সন্দীপ থাকে সপরিবারে। ওপর তলায় চারটি ডবল বেড ঘর। ট্যুরিস্টদের ভাড়া দেওয়া হয়। রান্নাঘর একতলাতেই। সাথে ছোট্ট একটা অফিস। আর ডাইনিং রুম। লিভিং রুম। দোতলায় ঘরগুলিতে বারান্দা রয়েছে। ওয়েদার ভালো থাকলে সেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়া যায়। ওইখানেই কাঠের টেবিল আর দুটি চেয়ার পাতা। ব্রেকফাস্ট আর মর্নিং টি ঐখানেই সার্ভড হয়। গোটা বাড়িটাই সন্দীপের। হ্যাপি হোম লেপচাজগৎরা এটিতে টাকা লগ্নি করেছে। হোম স্টে চালানোর রোজকার রোজ কাজ সন্দীপই করে। একটি বাচ্চা ছেলে, যে এতক্ষণ কিচেনে জিনিসপত্র তুলে রাখছিল গাড়ি থেকে, সে এসে জাহ্নবী আর শুভঙ্করের লাগেজ নিয়ে গেল ওপরে। ওরা দুজন পিছন পিছন উঠলো। জাহ্নবীর রুম নম্বর এক, শুভঙ্করের তিন। জানলো, অভি বা অভির পরিবারের কেউ এলে সাধারণত চার নম্বর ঘরে থাকেন। দুই নম্বর আপাতত খালি। বুকিং নেই। শুভ একবার হেসে বললো, "কী, রাত্রে খালি পাশের ঘর বলে ভয় পাবে না তো? ভূত তুত তো থেকেই থাকে এখানে। কী ভাই, ভূত আছে নাকি?" ছেলেটি লাজুক ভাবে মাথা নেড়ে জানায় যে সেইসব উৎপাত এখানে নেই। ওরা যেন নিশ্চিন্তে থাকে। জাহ্নবী শুভর দিকে চোখ কটমট করে তাকালো একবার। কিছু বললো না। শুভ দুষ্টু হাসি হেসে কানে দুই হাত দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিলো।
জাহ্নবী নিজের ঘরে এসে জুতো মোজা খুলে চিত হয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। নরম গদি। আঃ। কী আরাম। এখন একটু ঘুম দরকার। শুয়ে শুয়েই মাকে ফোন করলো।
"হ্যালো মা, দার্জিলিং পৌঁছে গিয়েছি। এই সব রুমে এলাম। তুমি ঠিক আছো তো মা?"
"হ্যাঁ। তুই ঠিক আছিস? ঠান্ডা কেমন? একদম ঠান্ডা লাগাবি না। জানিস তো কথায় কথায় সর্দি কাশি বাধাস।"
"আরে না না। সাবধানে থাকবো। জানো মা, এখনো কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাইনি। মেঘলা।"
"অত সহজে তিনি দেখা দেন না। সাধনা করতে হয়। Only the deserving see the majestic Kanchenjungha... উনি রাজা। যাকে তাকে দর্শন দেবেন না। কাজেই..."
"কাজেই?"
"কাজেই well behaved থাকতে হবে। তবেই।"
"মা! আমি এখন নার্সারিতে পড়ি না যে এখন এইভাবে শায়েস্তা করবে, ভালো রাখবে। এ কি স্যানটা ক্লজের গল্প নাকি?"
সুভদ্রা হাসেন। বেশ খানিকটা। তারপর বলেন, "সে যা ইচ্ছে ভাব। কিন্তু দেখিস। কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা সহজে মিলবে না।"
"ইশ। কি হিংসুটে তুমি। নিজে আসতে পারোনি বলে এইসব থ্রেট করছো। আমি বুঝিনা যেন?"

ওদের মায়ে মেয়েতে খুনসুটি চলছিল দিব্যি, এমন সময় দরজায় টোকা পড়লো। জাহ্নবী ফোনটা কেটে দরজা খুলল। বাইরে সন্দীপ দাঁড়িয়ে। বলতে এসেছে যে জাহ্নবী যেন ফ্রেশ হয়ে নেয় ঝটপট। গিজার চালানোই আছে। গরম জল পেয়ে যাবে। রান্নাও রেডি হয়ে যাবে আধ ঘন্টায়। জার্নি করে এসেছে। খেয়ে একটু রেস্ট নিক। তারপর বিকেলে কফি খেয়ে ম্যালে যাবে। সন্ধ্যেয় অভি স্যারের নির্দেশে বনফায়ারের ব্যবস্থা হবে। জাহ্নবী মাথা নেড়ে সায় জানায়। হুম। এখন একটু টানা ঘুম খুব দরকার। সুটকেসটা খুলে জামাকাপড় বের করে। মাথায় তেল মালিশ করে স্নান সারবে।
যাক। এই তাহলে ওর দার্জিলিং আসা হলো। মায়ের জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা। দার্জিলিং।

(ক্রমশ)

বি: দ্র: সুস্থ থাকুন। ঘরে থাকুন। আশেপাশে কেউ নিয়ম ভাঙছে দেখলে বোঝান। না শুনলে থানায় জানান। এখন কঠোর হতেই হবে। নইলে কেউ বাঁচবো না।

Monday, March 23, 2020



রঙ রুট (১১)
সুচেতনা

IV
তিন ঘন্টার একটু বেশি জার্নির পর অবশেষে ওরা এসে পৌঁছলো দার্জিলিং। জাহ্নবী যখন ট্রিপটি প্ল্যান করে, শুরুতে লেপচাজগৎ দেখলেও, সাথে দার্জিলিংকেও জুড়েই নেয়। হ্যাপি হিল হোম স্টের দুটি হোম স্টে। একটা দার্জিলিং, একটা লেপচাজগৎ। তাই একইসাথে দুই জায়গাতেই বুকিং করে জাহ্নবী।
দার্জিলিংয়ে পৌঁছে একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করতে লাগল ওর মধ্যে। এই তবে সেই দার্জিলিং? এত গল্প শুনেছে ছোট থেকে, ভূগোল বইয়ের পাতায় পড়েছে, দেখেছে সিনেমার পর্দায়। এই তবে সেই পাহাড়ের রানী? ইনোভা থেকে নেমে এখনো হোম স্টের দরজার সামনে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জাহ্নবী। এই জায়গাটা একদম মহাকাল মন্দিরের কাছেই। ম্যাল হাঁটা পথ। এমনিও, ঘর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়ার কথা। আবহাওয়া ঠিক থাকলে। আপাতত মেঘে ঢেকে আছে সামনেটা। তাই আন্দাজ করতে পারছে না জাহ্নবী। তবে বুক ভরে টাটকা তাজা নিঃশ্বাস নিয়ে চাঙ্গা হচ্ছে ও। পাশে শুভঙ্কর আর অরিজিৎ গাড়ি থেকে ওদের দুজনের লাগেজ নামাচ্ছে। হোটেলের জন্য কিছু আনাজপত্রও কিনে এনেছিল অরিজিৎ। সেইসব নামবে এরপর। জাহ্নবীর মন অন্য কোথাও নেই। এক দৃষ্টে হোম স্টের কাঠের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। অপেক্ষা শুভঙ্করের আর অরিজিতের। ওরা এলে ভিতরে ঢুকবে। চেক ইন করবে। মাকেও একটা ফোন করতে হবে। জাহ্নবী ঠিক করেছে, মাকে ভিডিও কল করবে, পঁচিশ বছর আগে মায়ের ফেলে আসা দার্জিলিংয়ের সাথে এখনের দার্জিলিংকে মিলিয়ে দেবে, পরিচয় করাবে।
বাগানে একটা নাম না জানা পাখি সমানে ডেকে চলেছে, আপনমনে। কোনো চিন্তা দুঃখ ভয়, কিচ্ছুটি নেই। শুধু গান আর গান। জাহ্নবী ভাবে, ওর জীবনটাও যদি এরকম হতে পারতো... কাঁধ থেকে ক্যামেরার ব্যাগটা নামায় বারান্দাতে। ক্যামেরা বের করে জুম লেন্স তাক করে পটাপট ছবি তুলতে থাকে আশেপাশের। লেন্সে ইতিমধ্যে ধরা দেয় শুভঙ্কর। ধরা দেয় অরিজিৎ। আরো একজন।
এক অচেনা যুবক। বয়স, ওই চব্বিশ পঁচিশ হবে। কোঁকড়া চুল, রোগা, লম্বা। পরনে সাদা সবুজ ভি গলা ফুল হাতা সোয়েটার, খয়েরি কর্ডের ট্রাউজার। পায়ে রঙিন বাহারি রানিং শু। হাঁপাতে হাঁপাতে এসেছে। সোজা শুভঙ্করের কাছে। জাহ্নবী ক্যামেরা নামালো। দেখলো আগন্তুক আর শুভঙ্কর একে অপরের গলা জড়াজড়ি করে অভিবাদন জানাচ্ছে। বুঝলো, তাহলে এই অভি। মালিক। শুভর বন্ধু। অভি এবার এগিয়ে এলো জাহ্নবীর দিকে। এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, "হাই, আমি অভিমন্যু। নাইস টু মিট ইউ। জার্নি কম্ফোর্টেবল ছিল তো?" জাহ্নবী হ্যাঁতে মাথা নাড়লো।
"আসুন। ভিতরে আসুন।" এই বলে অভিমন্যু এগিয়ে চললো বাড়ির ভিতর। শুভঙ্করও এসে পড়েছে, জাহ্নবীকে ডেকে নিলো। এর মধ্যে, বাড়ির পিছন থেকে এতক্ষণে মালপত্র নামিয়ে গুছিয়ে এগিয়ে এলেন যিনি, বছর পঁয়ত্রিশ বয়স, মোটাসোটা কেজো চেহারা, জাহ্নবীর কাছে নিজেকে সন্দীপ বেল পরিচয় দিলেন। হোম স্টের ম্যানেজার। জাহ্নবী নমস্কার জানিয়ে ভিতরে ঢুকলো।
শুভঙ্কর ইতিমধ্যেই রেজিস্টারে নাম লিখে ফেলেছে। অভিমন্যু জাহ্নবীর দিকে পেন আর রেজিস্টার এগিয়ে দিল। শুভঙ্কর পাশ থেকে দেখে বললো, "বাঃ, তোমার হাতের লেখাটা তো বেশ খারাপ। যাক। এতক্ষণে একটা ইমপারফেকশন দেখলাম।" জাহ্নবী উত্তর দিলো না। শুধু মুচকি হাসলো। শুভঙ্কর আবার বলতে থাকলো, "জানিস অভি, জাহ্নবী দুর্দান্ত গান গায়। চল না, আজ সন্ধ্যেয় একটা বনফায়ার হোক। তোর গিটারটা আছে তো?" অভি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। সাথে এও জানালো যে সদ্য কাহন কিনেছে ও। কাজেই, গান বাজনা জমবে ভালো।
জাহ্নবীর হঠাৎ সব খুব ভালো লাগতে লাগলো। কিছু ভালো নিশ্চয়ই হতে চলেছে, মন বলছে ওর।

(ক্রমশ)


রঙ রুট (১০)
সুচেতনা

অরিজিতের মিউজিক প্লেয়ারে হঠাৎ শুরু হয় কিশোর কুমারের উদাত্ত কণ্ঠে "রুক যানা নহি, তু কভি হারকে..."। জাহ্নবী এতক্ষণ টুকটাক নিজের মনে গুনগুন করলেও এইবারে বেশ গলা ছেড়েই গানটি ধরলো। জানলার বাইরে দিয়ে উত্তরবঙ্গের ছোট ছোট গ্রাম নগর পেরিয়ে যাচ্ছে গাড়িতে। রাস্তার ধারে ছোট ছোট দোকান। কত মানুষ। যে যার পসরা নিয়ে, কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। আকাশ একটু মেঘলা। বৃষ্টি, এখনো হয়নি। গান গাইতে গাইতে জাহ্নবী টের পায়, শুভঙ্কর মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। স্মিত হাসি ছুঁড়ে দেয় ও, শুভঙ্করের দিকে। অরিজিতেরও বেশ পছন্দ হয়েছে জাহ্নবী দিদির গান। গান শেষ হতেই ও তাই "আরে দিদি, আপনি তো দুর্দান্ত গান করেন! খুব খুব ভালো হয়েছে।" বলে স্টিয়ারিংয়ে হাত চাপড়ে দেয়। শুভঙ্কর এক মুখ মুগ্ধতা নিয়ে জাহ্নবীর দিকে ফিরে বলে, "জাহ্নবী, এক্সিলেন্ট। তুমি তো দেখি নাইটিঙ্গেল।" জাহ্নবী আবার এইসব স্পটলাইট, লাইমলাইটে কোনোটাই পছন্দ করেনা। অস্বস্তি হয়। এখনও হতে শুরু করলো। ইশ, গোটা রাস্তাটা ও দিব্যি চুপচাপ নিজের মতোই গান গাইতে গাইতে আসছিল। কেন যে হঠাৎ বেখেয়ালে গলা ছেড়ে ফেললো।
শুভঙ্কর পাশ থেকে সমানে ওকে অনুরোধ করে চলেছে আরো একটা গান শোনানোর জন্য। অরিজিৎও সেই আবদারে সায় দিয়েই চলেছে। ছেলেটা এমনই বিচ্ছু, বলে কি না, "দিদি আপনি যদি আরো একটা গান ধরেন, তাহলে আপনাকে একটা ফার্স্ট ক্লাস ভিউ পয়েন্ট নিয়ে গিয়ে একদম ধোঁয়া ওঠা দার্জিলিং লিকার চা খাওয়াবো।" জাহ্নবী ইতস্তত করে। চা খাওয়ার টোপটা বেশ ভালো মতোই লোভনীয় ওর কাছে। বিশেষ করে এখন। গাড়ি এখন একটু উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছে। আর মেঘ করার দরুণ, হালকা শিরশিরানি রয়েছে হাওয়ায়। পাতলা সোয়েটশার্ট মোকাবিলা করছে বটে এখনো, তবু, এক কাপ চা পেলে মন্দ হয়না। সাথে আবার বলছে ভালো ভিউ পয়েন্ট। হুম। এইটুকু চেষ্টা করাই যায়।
জাহ্নবী আরো কিছুক্ষণ কিন্তু কিন্তু করে। তারপর গানটা ধরেই ফেলে। "আমি কোন পথে যে চলি, কোন কথা যে বলি..."। গান শেষ হতেই শুভঙ্কর হাততালিতে মাতিয়ে দেয়। জাহ্নবী সলজ্জ হাসি হাসে। গালদুটি রক্তিম। কিছুটা লজ্জায়, কিছুটা ভালোলাগায় আর কিছুটা গানের উঁচু স্কেলের জন্য।
অরিজিৎ কথা রেখেছে। ঘুম শহরে পৌঁছে ওদের নিয়ে গিয়েছে একটা ছোট্ট ক্যাফেতে। ক্যাফের জানলা দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়ার কথা। কিন্তু আজ মেঘ করে আছে। তাই দর্শন, হলো না। কিন্তু চা পান বেশ আনন্দ সহকারেই হলো। লালচে সোনালী লিকার চা। সাথে ফ্রেশলি বেকড কুকিজ। আহা। কুকিজগুলি এতই সুস্বাদু, মুখে দিলে মিলিয়ে যায়। দু চোখ বুজে আসে ভালোলাগায়। শুভঙ্কর নিজের প্লেটেরগুলো শেষ করেছে। এবার হাত বাড়িয়েছে জাহ্নবীর প্লেটে। জাহ্নবী দেখেও দেখলো না। চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে জানলার বাইরে, ক্যাফে সংলগ্ন ঝোপে ফুটে থাকা গোলাপী বেগুনী জংলা ফুলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বললো, "জানো শুভ, তখন ওই গানটা কেন হঠাৎ জোরে গাইলাম? আসলে ওই গানটা ছোটবেলা থেকে এতবার শুনেছি, এত বেশিবার শুনেছি, গেয়েছি.... আমায় তো আমার মা একলা হাতে মানুষ করেছে, তাই সব সময় এই গানটির কথা বলতো। কিভাবে হিম্মত রাখতে হবে কঠিন সময়ে। ভয় না পেতে। গানটা আমার জীবনের এন্থেম। তাই ঐটা শুনেই কেমন জানি নিজেকে সামলাতে পারলাম না। গেয়ে ফেললাম।"
শুভঙ্কর আলতো করে জাহ্নবীর হাতের ওপর নিজের হাতটা রেখে বলে, "ভাগ্যিস!"

(ক্রমশ)

বি: দ্র: দয়া করে আজ জনতা কারফিউকে মেনে চলুন। আর কারফিউ শেষ হলেই দুম করে সবাই মিলে কোথাও জমায়েত হবেন না। বারবার সরকার থেকে যা যা নিয়ম বলছেন, মেনে চলুন। প্লিজ। ভারতবর্ষের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে করোনা মহামারী রূপে এলে সব ধ্বংস হয়ে যাবে, তছনছ হয়ে যাবে। তাই প্লিজ, দায়িত্বশীল নাগরিক হোন। নিজে সচেতন হোন। অন্যকেও সচেতন করুন। প্লিজ প্লিজ প্লিজ। কয়েকটা দিন, দাঁতে দাঁত চিপে থাকুন। সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ধৈর্য রাখুন। সহায়তা করুন। নিয়ম মানুন। বুদ্ধি খরচ করুন। দয়া করে।

Saturday, March 21, 2020

রঙ রুট (৯)
সুচেতনা

গাড়ি চলছে। অরিজিৎ সিংয়ের গানও সমান তালে চলছে। বেশিরভাগ গানই বড্ড দুঃখের। এবং বিরহের। শুভঙ্করের সেইসব পছন্দ হচ্ছে না। ওরা যখন শিলিগুড়ি ঢুকছে, শুভঙ্কর বললো, "বস, খিদে পেয়েছে খুব। ভালো দেখে কোনো ধাবায় থামিয়ো তো। গরমাগরম আলুর পরোটা খেতে ইচ্ছে করছে। সাথে চাই ধূমায়িত এক কাপ চা। ক্লাসিক দার্জিলিং টি। আর হ্যাঁ তারপর মুড সেরা হয়ে যাবে। তখন প্লিজ গাড়িতে অন্য গান দিয়ো। কিছু আনন্দের গান। বা ডান্স মিক্স। এইসব বিরহ টিরহ অনেক হলো। আর না। ভাই, তুমি এই এইটুকু ছেলে, এখনই কীসের এত বিরহ বলো তো? আর এই যে এই ম্যাডাম। উনি মুখে বলছেন না বটে, তবে আমি জানি। ওঁরও মোটেই পছন্দ হচ্ছে না গানটা।" এতক্ষণ অবধি ঠিকই চলছিল সব। জাহ্নবী শুনে মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছিল। খিদে তো ওরও পেয়েছে। এবং কে জানে কেন, এই যাত্রাপথে ধবার ধারে খেতে গেলে আলু বা পনির পরোটা পেলে একেবারে দিলখুশ হয়ে যায়। তবে গানের ব্যাপারে যেই ওর নাম এসে গেল, ব্যস। রেরে করে উঠলো ও। বললো, "এ কী, না না। আমার মোটেই অপছন্দ না। অরিজিৎ সিংকে খুবই ভালো লাগে। মস্ত মগন গানটা শুনেছেন? ওইটা আমার অল টাইম ফেভারিট।" শুভঙ্কর হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে বললো, "ধুর ধুর। দাঁড়ান, খেয়ে আসি। দেখবেন, আমার কাছে একটা সেরা প্লেলিস্ট আছে। ওইটা চালাবো। তখন বলবেন। বন্ধুমহলে আমার মিউজিকের টেস্ট বেশ সুখ্যাত ও বিখ্যাত।" এরপর আর কথা বাড়ানোর মানে হয় না। ওরা ধাবা দেখে গাড়ি থেকে নামে।
খাওয়াটা ছিল জম্পেশ। পুরু মাখন মাখানো পরোটা। সাথে চা। অবশ্য দার্জিলিং চা বোধহয় না। ছিল দুধ চা। খেতে খেতে শুভঙ্কর অনেক গল্প বলতে লাগল। ওর বেড়ানোর নেশার কথা, বিভিন্ন বয়সে বন্ধুদের সাথে নানান দুষ্টুমি, স্কুল কলেজের মজার মজার সব কীর্তি। একেকটা শুনতে শুনতে তো জাহ্নবী প্রায় হেসে কুটিপাটি যাওয়ার জোগাড়। সত্যিই, শুভঙ্কর ভারী মজার মজার কথা বলে।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে ওরা গাড়িতে ফেরে। শুভঙ্কর জাহ্নবীকে বলে, "আমি বন্ধুমহলে বাচাল বলে পরিচিত। দেখছি ব্যাপারটা ইউনিভার্সাল। আপনিও গোটা সময়টা চুপ করে আমার বকবকের অত্যাচার শুনে গেলেন। নিজের কথা কিছুই বললেন না।" জাহ্নবী হেসে উত্তর দিলো, "বাবাঃ, বন্ধুমহলে আপনি তো খুবই বিখ্যাত দেখছি। গানের টেস্ট, বাচাল, কত ব্যাপারে আপনার খ্যাতি!" শুভঙ্কর বললো, "চাটুন চাটুন। এই চাট খেতেও আমি বিখ্যাত। তা বন্ধুত্ব যখন, এক তরফ থেকে সব গল্প করলে ব্যাপারটা কেমন ইনকমপ্লিট হয় না? তাই আর কী। আপনার সম্পর্কে কিছুই তো বললেন না।" জাহ্নবী বললো, "ভয় পাচ্ছেন? ভাবছেন, এ কার পাল্লায় পড়লাম? ডাকাত নয় তো?" শুভঙ্কর ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো, "আই বেগ টু ডিফার। এমন সুন্দরী ও সফিস্টিকেটেড ডাকাত, আমাদের দেশে অসম্ভব।" কথাটা শুনে জাহ্নবী হো হো করে হেসে উত্তর দিলো, "এবার কি শুনবো যে বন্ধুমহলে আপনার ফ্লার্টিং স্কিলসও বিখ্যাত?" শুভঙ্করও হাসি না চেপেই বললো, "দিন দিন। প্যাঁক দিন। আমি শুধু আপনার কথা শুনতে চাইছিলাম। আপনি মানুষটা কেমন, কেমন সব অভিজ্ঞতা আপনার।" জাহ্নবী জবাব দিলো, "আমি খুব বোরিং ও সাধারণ একটি মেয়ে। দিল্লীতে থাকি, মায়ের সাথে। চাকরি করি। গান শুনি। বই পড়ি। সিনেমা কম দেখি। ব্যস। এর চেয়ে বেশি আর কিচ্ছু নেই। আমার লাইফে কোনো ইন্টারেস্টিং বা হ্যাপেনিং ঘটনাই নেই।" শুভঙ্কর বলে, "তাই বুঝি? তা বেশ তো। লেটস মেক দিস ট্রিপ হ্যাপেনিং!" জাহ্নবী হাসে। জানলার বাইরে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। খানিকটা যাওয়ার পর মুখ না ফিরিয়েই বলে, "শুভ, তুমি যে বলছিলে তোমার গানের স্টক ভালো। কই? আমরা শুনবো না?"
শুভঙ্কর জাহ্নবীর দিকে ফিরে তাকায়। অদ্ভুত এক হাসি। যুদ্ধজয়ের? কে জানে। উত্তরে কিছু না বলে নিজের ব্যাগ থেকে পেনড্রাইভ বের করে। অরিজিৎকে সেটা ধরিয়ে দিয়ে বলে, সেকেন্ড ফোল্ডারটা চালাও বস। ম্যাডাম পরীক্ষা নেবে বলছে।"
গাড়ি এগিয়ে চলে। স্টিরিও প্লেয়ারে বাজতে থাকে "মুসাফির হু ইয়ারো। না ঘর হ্যায়, না ঠিকানা।" জাহ্নবীর পছন্দ হয়েছে গান। বেশ পছন্দ। মাথা নেড়ে তাল দিতে থাকে গানে।

(ক্রমশ)

Friday, March 20, 2020

রঙ রুট ৮
সুচেতনা

চালকের নাম অরিজিৎ। বয়স ওই একুশ। ডিগ্রি কলেজে পড়ে। সাথে প্রয়োজন মতো হোম স্টের হয়ে গাড়িও চালিয়ে দেয়। আসলে হোম স্টের চালক ওর বাবা, সুরজিৎ। তবে বর্তমানে উনি মালিকের সাথে কোনো কাজে গৌহাটি গিয়েছেন। তাই অরিজিতের দায়িত্ব পড়েছে জাহ্নবী আর শুভঙ্করকে নিয়ে আসার। এইসব কথাই এক নাগাড়ে ও নিজেই বললো জাহ্নবীকে। জাহ্নবীও খুশি মনেই শুনলো। নিজের নামের সাথে মিল অরিজিৎ সিংএর। অরিজিৎ নিজেও গান ভালোবাসে। তাই জাহ্নবী গাড়িতে উঠতেই মিউজিক প্লেয়ারে চালিয়ে দিলো বেস্ট অফ অরিজিৎ। হালকা খিদে পেয়েছে। তাই জাহ্নবী হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা চকোলেটের বার বার করে নিজেও নিলো দুটো টুকরো, অরিজিৎকেও দিলো।
অরিজিৎ হাসি মুখে "থ্যাংক ইউ দিদি" বলে সাগ্রহে তা গ্রহণ করলো। ইতিমধ্যেই নিজের লাগেজ নিয়ে হাজির শুভঙ্কর।
অরিজিতের সাথে করমর্দন করে বলল,"কী ভাই অরিজিৎ, ডিকিটা খুলে দাও। সুটকেস রাখি।" জাহ্নবী মুখ তুলে জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখলো শুভঙ্করকে। একটা হলুদ সাদা শর্ট ঝুলের চেক শার্ট , নীল জিন্স আর উডল্যান্ডসের জুতো। চোখে নীলচে কেতাদুরস্ত সানগ্লাস। দেখলেই কেমন একটা বিদেশ ফেরত মনে হয়।
জাহ্নবী হাসিমুখে শুভঙ্করকে চকোলেট এগিয়ে দিয়ে বলল, "নিন। যাত্রার শুরুতেই মিষ্টি মুখ। যাত্রা শুভ হবে।"
শুভঙ্কর ততক্ষণে গাড়ির সামনের সিটের দরজা খুলে  উঠতে যাচ্ছে, চকলেটটা নিয়ে মুখে পুরে উত্তর দিলো, "সে ম্যাডাম, আমার নামেই শুভ। যাত্রা তো শুভ হবেই। দ্যাট রিমাইন্ডস, আপনিও আমাকে শুভ বলেই ডাকতে পারেন। অনেক বেশি ইনফরম্যাল হবে। আফটার অল, বেশ কিছুদিনের ঘুরে বেড়ানোর ব্যাপার যখন, খুব বেশি ফরম্যালিটি বজায় রাখলে বেশ মুশকিল।"
জাহ্নবী কয়েক সেকেন্ড ভাবলো। তারপর অরিজিতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "অরিজিৎ, এই দাদা কিন্তু রাত্রে এয়ারপোর্টে ঘুমাননি। ভোরের ফ্লাইটেও না। কাজেই জার্নিতে ঘুমিয়ে পড়ার হাই চান্সেস। তাহলে তো তোমার পাশে সামনের সিটে বসা উচিত না। বলো?"
অরিজিৎ ব্যাপারটা ভালো বুঝলো না। একটু বোকা বোকা হাসি হেসে বললো, "সে কোনো প্রব্লেম না দিদি।"
জাহ্নবী বললো, "উঁহু। তোমার প্রাণের মায়া না থাক। আমার আছে। আমি ছাড়া আমার মায়ের আর কেউ নেই। কাজেই আমার প্রাণের মূল্য আছে। পাহাড়ি রাস্তায় তাই নো রিস্ক। শুভঙ্কর বাবু, আপনি বরং ব্যাগটা সামনের সিটে রেখে এই পিছনে এসে বসুন আমার এখানে। আমি অত মোটাও নই। আর ইনোভার স্পেস বেশ ভালোই। জায়গা হয়ে যাবে। আরামসে।"
শুভঙ্কর বুঝি এই আমন্ত্রণের অপেক্ষাতেই ছিল। তড়িঘড়ি পিছনের সিটে বসে বেজায় খুশি মনে বলল, "এইবার যাত্রা সত্যিই শুভ হবে। চলো অরিজিৎ, চলো।"
অরিজিৎ গাড়িতে স্টার্ট দেয়। গাড়ি গুটিগুটি পায়ে এগোতে থাকে এয়ারপোর্ট থেকে, দার্জিলিংয়ের পথে।
জাহ্নবী জানলার বাইরে চেয়ে দেখে। একটা নতুন সকাল। নরম আলো। নিজের আচরণে নিজেই আশ্চর্য, কিন্তু খুব আনন্দ হয় ওর। ব্যাগ খুলে ডায়রি বের করে ঝটপট লিখে রাখে মনের কথা, ভাব। আজ মনে হয় দিনটা বেশ ভালোই যাবে ওর।

(ক্রমশ)

Wednesday, March 18, 2020

রঙ রুট (৭)
সুচেতনা


III


বাগডোগরা এয়ারপোর্টের লাগেজ ক্যারুজেল থেকে নিজের সুটকেসটা নিয়ে বেরোনোর উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো জাহ্নবী। ভাগ্যিস ওরটা আগে এসেছে, নইলে আবার ওই শুভঙ্করের সাথে কথা বলতে হতো। বাপ রে, কীভাবে যে দিল্লী এয়ারপোর্টে বাকিটা সময় ওকে অ্যাভোয়েড করে কাটিয়েছে জাহ্নবী, তা ওইই জানে। তারপর কপাল ভালো, প্লেনেও দূরে দূরে সীট পড়েছিল। কলকাতা এয়ারপোর্টে ঘুমের কারণ দেখিয়ে সময় কাটিয়েছে। আসলে শুধু শুভঙ্কর বলেই না, জাহ্নবী যে কোনো অচেনা মানুষ, বা অনেক সময় চেনা মানুষের সাথেও খুব একটা ভালো করে মিশতে বা কথা বলতে পছন্দ করে না। অস্বস্তি হয়। একটা অদ্ভুত বাজে অনুভূতি হয়। ও চায় এই ব্যাপারটা এড়াতে, এই ভয়কে জয় করতে। এই নিয়ে তাই ও ওর কাউন্সেলর, ডক্টর আস্থানার সাথে বেশ অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছে। ডক্টর ওকে নানান টোটকা দিচ্ছেন, কিন্তু জাহ্নবী পারছে না। যেমন, ওর খুব ইচ্ছে ছিল, কলকাতা এয়ারপোর্টে বসে গল্প করবে শুভঙ্করের সাথে। সেই জন্য নিজে থেকে আগ্রহ দেখিয়ে শুভঙ্করের পাশে বসেছিল, নিজের স্যান্ডউইচ অফার পর্যন্ত করেছিল, কিন্তু তারপর ওই, যেই শুভঙ্কর একটু হেসে আড্ডা জুড়তে বসেছে, অমনি কী যে হলো। বুকের ভিতর ধড়পাকড়, হাত পা ঘামতে থাকা। কোনমতে ঘুমের অজুহাত দেখিয়ে কানে ইয়ারফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে ছিল।
জাহ্নবী অনেক পড়াশোনা করেছে এই নিয়ে ইন্টারনেটে। জেনেছে যে এই সমস্যা ওর একার নয়। এই সমস্যা বিভিন্ন কারণে হতেই পারে। যেহেতু সিঙ্গল পেরেন্টের কাছে মানুষ, সেটাও কোন কারণ হয়তো হতেই পারে। তবে জাহ্নবী এও জানে যে চেষ্টা করলেই এই ভয়টাকে কাটানো যায়। ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, কাটাবেই। থেরাপিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী বাগডোগ্রার ফ্লাইটে বসে ও সাথে রাখা নোটবইতে এই ঘটনা, মানসিক টালমাটাল অবস্থা, সমস্তটা লিখে রেখেছে। লিখলে নাকি উপকার হয়। অনেক বেশি ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা যায়। শেষের কলামে ও লিখেছে, কী করে এই অবস্থা কাটাবে? না, বাগডোগ্রা থেকে দার্জিলিং, এই রাস্তাটা ও শুভঙ্করের সাথে একদম স্বাভাবিকভাবেই কাটাবে। স্বাভাবিকভাবে কথা বলবে, গল্প করবে, ওর কথা শুনবে। ভয় ও পাবে না। এম্নিও এক গাড়িতে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। সন্দীপের সাথে কাল কথা বলে জেনে গিয়েছে। হোম স্টের নিজস্ব গাড়ি একটাই আপাতত। তাই দুই গেস্টের জন্যই একি ব্যবস্থা। সন্দীপ খুব করে ক্ষমা চেয়েছে জাহ্নবীর কাছে। প্রথমে ভয়ানক রেগে থাকলেও পরে জাহ্নবী বুঝেছে, এ ছাড়া সত্যিই আর কোনো উপায় ছিল না। ও নিজে সন্দীপের জায়গায় থাকলেও হয়তো একই কাজ করত। অগত্যা...
মোবাইল বের করে ও সন্দীপকে ফোন করে জানালো। সন্দীপ উত্তরে বলে দিলো যে গাড়ি এয়ারপোর্টের বাইরেই রয়েছে। ও ড্রাইভারকে জানিয়ে দিচ্ছে সামনে চলে আসতে। জাহ্নবী যেন গাড়িতে অপেক্ষা করে। জয় মা, জয় মা মনে মনে বলে জাহ্নবী এগোলো। WB21J2305 গাড়ির নম্বর। গাঢ় লাল ইনোভা। দরজা খুলে ওর লাগেজ ডিকিতে রেখে এক গাল হাসি মেখে নমস্কার জানালো এক কিশোর। পরনে জিন্স ও রঙ বেরঙের টিশার্ট। "নমস্কার দিদি। আপনি বসুন গারিতে। দাদা আসছেন। আমার সাথে ফোনে কথা হয়ে গিয়েছে।"
চালকের হাসিটি বড্ড মিষ্টি। কিছু কিছু মানুষ হয় না, যাদের দেখলেই ভালো লাগে? এও মনে হয় সেইরকম। জাহ্নবী খুশি হয়।




(ক্রমশ)
‍‍

Tuesday, March 17, 2020

রঙ রুট (৬)
সুচেতনা

জাহ্নবী একটু অবাক হয়েই এদিক ওদিক তাকালো, তারপর বলল, "সে বসলে বসুন।" যুবকটি স্মিত হেসে "ধন্যবাদ" বলে চেয়ারটা টেনে বসলো। জাহ্নবী নিজের কফির কাপে মনোযোগ দিল। সবে এক চুমুক কফি মুখে গিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে এই আগন্তুকের "আমি শুভঙ্কর" গলার স্বরে জাহ্নবী চমকে, বিষম খেয়ে একাকার। সে কী কাশি, চোখ মুখ লাল হয়ে যাওয়ার জোগাড়। আগন্তুক রীতিমত অপ্রস্তুত। নিজের ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে জাহ্নবীকে জল অফার করে বলল, "আই অ্যাম সরি। আমি বুঝতে পারিনি আসলে যে এরকম রিঅ্যাক্ট করবেন আপনি।"
জাহ্নবী মনে মনে অত্যন্ত লজ্জিত বোধ করে। এ বাবা, কী যে সব কাণ্ড কারখানা বাধিয়ে ফেলে ও, না চাইতেই। ছি ছি, উনি কী ভাবলেন। কতটা লজ্জাজনক হয়ে দাঁড়ালো গোটা মুহূর্তটা।
জাহ্নবী অন্তর্মুখী মেয়ে। আর তাই তখন লাউঞ্জে লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেলার ভয়ে কফিশপে এলো। আর এখানেই এসেও এই। কী যে করবে, ভেবে পায় না। কফি এখনো পড়ে আছে কাপে। বেশ খানিকটা। এখন এখান থেকে উঠেও যাওয়া যায় না। খুবই খারাপ দেখায়। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, "না না। ইটস ওকে। আই অ্যাম অলরাইট। আপনি ব্যস্ত হবেন না। আর হ্যাঁ, আমিও সরি। এরকম হলো বলে। আসলে আমি অন্যমনস্ক ছিলাম কিছুটা। তাই আর কী..." জাহ্নবীকে থামিয়ে দিয়ে আগন্তুক বলে, "ও ঠিক আছে। যাক সেসব মিটে গেলো। লেটস স্টার্ট অ্যাফ্রেশ?" জাহ্নবী আর কীই বা বলে, নিরুপায় হয়েই বলল,"ইয়েস অফ কোর্স। ওকে।" আগন্তুক নিজের ডান হাতটা জাহ্নবীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, "হাই, আমি শুভঙ্কর।" জাহ্নবী নিজের ডান হাতটা একটু কিন্তু কিন্তু করেই এগিয়ে দিয়ে উত্তরে জানালো, "আমি জাহ্নবী।"
কয়েক সেকেন্ডের হ্যান্ডসেক। তারপর জাহ্নবীই নিজে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কফির কাপে চুমুক দিল। এইবারে আর শুভঙ্কর ভুল করেনি। অপেক্ষা করল জাহ্নবীর কফিটা ঢোঁক গেলা অব্ধি, তারপর বলল, "সরি, তখন আপনার কথা ওভারহিয়ার করে ফেললাম। তবে নেহাতই কোয়েন্সিডেন্স, তাই নিজেকে সামলাতে না পেরে আলাপ করব ভাবলাম। তার মধ্যেই দেখি আপনি লাউঞ্জ থেকে কফিশপের দিকে চলে এলেন। অগত্যা..."
"অগত্যা, আপনিও আমার পিছু পিছু এলেন, তাই তো?" জাহ্নবী নিজের মনেই বলল কথাগুলো। অবশ্য সামনাসামনি শুধুই হাসি। উঁহু, অস্বস্তি হচ্ছে। কী আবার কোয়েন্সিডেন্স?
শুভঙ্কর জাহ্নবীর কৌতূহলের উত্তর দিল সঙ্গে সঙ্গে। বলল, "আপনি তো হ্যাপি হিল হোম স্টেতে যাচ্ছেন? আমিও। ইন ফ্যাক্ট আমাদের সেম শিডিউল। আমাদের দুজনেরই সেম ত্র্যাল আইটিনারি।"
জাহ্নবী অবাক। এ যে দেখি কোয়েন্সিডেন্সেরও বড় ব্যাপার। বলে কী? লোকজনের ফ্লাইট এক হয়, এ দেখি গন্তব্য পর্যন্ত এক।
শুভঙ্কর বোধহয় মুখের ভাব ভালোই পরতে জানে। জাহ্নবীর মুখ দেখে এইবারে হেসে বলল, "আসলে এই হোম স্টেটার ওনার আমার বন্ধু অভি। ওই বলেছিল আমায় যে একই দিনে আপনিও ট্র্যাভেল করছেন। তখনো আমার ফ্লাইট টিকিট কাটা ছিল না। তাই একই ফ্লাইটের টিকিট কাটতে জানায় আমায়। যাতে একই সাথে ওরা পিক-আপ করতে আসতে পারে।"
জাহ্নবী কিন্তু এই কথা শুনে বেশ বিরক্ত হলো। এ কেমন হোম স্টে, মানলাম না হয় ওদের ট্র্যাভেল অ্যারেঞ্জমেন্টে সুবিধে হবে। কিন্তু তাই বলে ওকে না জিজ্ঞেস করে এরকম ওর ট্র্যাভেল শিডিউল জানিয়ে দিল? এবং ওর সাথে কথা না বলেই একই সাথে ট্র্যাভেল প্ল্যান পর্যন্ত? দিস ইস সো নট ডান। এর একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। সন্দীপের সাথে কথা বলতেই হবে। ঢকঢক করে কফিটা শেষ করে, শুভঙ্করের সাথে আর একটি কথাও না বলে, হতভম্ব শুভঙ্করকে কফিশপে ফেলে নিজের লাগেজ নিয়ে গটগট করে এগিয়ে গেল, এয়ারপোর্টের নির্ধারিত ডিপারচার গেটের দিকে।
শুভঙ্কর ঘড়ি দেখল। বোর্ডিং শুরু হতে এখনো মিনিট কুড়ি বাকি। ও হতবাক। এই মেয়েটা এত কথায় কথায় পালিয়ে যায় কেন?
ধুর, এই ভেবে নিজেও তাড়াতাড়ি নিজের কাপ থেকে চা শেষ করে উঠতে যাবে, তাড়াহুড়োয় পড়ে থাকা চা চলকে পড়লো জিন্সে। ধ্যাত্তেরিকা।

(ক্রমশ)
রঙ রুট (৫)
সুচেতনা

এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটটা এক্ষুণি জানালো, ডিলেয়েড। পরিবর্তিত সময় রাত নটা। জাহ্নবীর অবশ্য অসুবিধে নেই এতে। এমনিতেও ওকে রাত্রে কলকাতা এয়ারপোর্টেই সময় কাটাতে হতো। এখন না হয় সেটা একটু কমলো। মোবাইলটা ব্যাগ থেকে বের করে সুভদ্রাকে জানিয়ে দিল ও। তারপর ওর ফ্লাইটের নির্দিষ্ট গেটের কাছে, লাউঞ্জের এক কোণে একটা খালি চেয়ার পেয়ে গুছিয়ে বসলো। হাতে অনেকটাই সময়। গতবারের দিল্লী বইমেলা থেকে মায়ের কিনে দেওয়া "সেই সময়" উপন্যাসটা সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে। যদিও ওজন বেশ ভালোই, তবুও, পড়তে পড়তে একটা নেশা লেগে যায়, ছাড়তেই ইচ্ছে করেনা। তাই সেটিই সঙ্গে এনেছে। এখন হাতে যা সময়, অন্তত ঘন্টা দুইয়েক ও পড়তে পারবে, নিশ্চিন্তে।
বই পড়ছে জাহ্নবী। ইতিমধ্যে কখন যে ওর পাশের মানুষটি উঠে চলে গিয়েছেন, খেয়াল করেনি ও। সম্বিৎ ফিরল মোবাইলের আওয়াজে। স্ক্রিনে নাম লেখা সন্দীপের। সন্দীপ হ্যাপি হিল হোম স্টের ম্যানেজার। বুকিং, গাড়ি, সব ওই তদারকি করেছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে জাহ্নবী ফোনটা রিসিভ করলো। সন্দীপ গাড়ির নম্বর, ফ্লাইটের ডিটেলস এইসব আরো একবার কনফার্ম করতেই ফোন করেছিল। জাহ্নবী সমস্ত ডিটেল জানালো। এবং সাথে কথায় কথায় দিল্লী কলকাতা ফ্লাইটের ডিলের কথাও জানালো। কথা বলতে বলতেই নজরে এলো, উল্টোদিকে এক যুবক। ওরই দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এই রে, জাহ্নবী কি একটু বেশি জোরেই কথা বলে ফেললো? যাঃ, এই এক সমস্যা ওর। কথা বলতে বলতে এমনই বিভোর হয়ে যায় যে স্থান কাল পাত্র বজায় রাখতেই হিমশিম খেয়ে যায়।
একটু সঙ্কুচিত হয়েই ফোনটা ছেড়ে জাহ্নবী উঠে দাঁড়ায়। উঁহু, একটু দূরে গিয়েই বসবে না হয়। ফ্লাইটের তো দেরি আছে এখনো। বোর্ডিং শুরু হতে আরো আধ ঘন্টা। একটু কফি খেয়ে এলে হয় না? মায়ের দেওয়া স্যান্ডউইচ এখনো খোলেনি। ওটা কলকাতা এয়ারপোর্টের জন্য তোলা রইলো। কেক খেয়েছে অবশ্য। মায়ের স্পেশাল ক্যারোট কেক। বেশ ভারীও। তাই খিদে বিশেষ নেই। একটু কফিই তাই আপাতত যথেষ্ট। প্লেনে উঠলেই তো ডিনার দেবেই। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে একটা কফি শপ নজরে পড়লো। ব্যাকপ্যাকটা পিঠে আর ক্যামেরার ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে জাহ্নবী এগোলো সেদিকে। কাউন্টারে টাকা দিয়ে একটা ক্যাপুচিনো অর্ডার করে ও বসল। দোকানে ভিড় তেমন নেই। অন্তত বসার জায়গায়। সবাই প্রায় ওই আসছে, কফি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দোকানদার কফির কাপটা রেখে গেলেন। জাহ্নবী চিনির প্যাকেটটা ছিঁড়ে ফেলছে, এমন সময় কানে এলো, "হাই। আমি কি এখানে বসতে পারি?"
হঠাৎ করেই বাংলা শুনে জাহ্নবী চমকে উঠলো। মাথা তুলে দেখে, সামনে দাঁড়িয়ে লাউঞ্জের সেই ছেলেটি।

(ক্রমশ)

Sunday, March 15, 2020

রঙ রুট (৪)
সুচেতনা

II

জাহ্নবী আজ হাফ ডে নিয়েছে অফিসে। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় ওর ফ্লাইট। দিল্লী থেকে বাগডোগরা ডাইরেক্ট ফ্লাইট পায়নি। তাই এক রাত্তির কলকাতায় থেকে, সোজা পরেরদিন সক্কাল সক্কাল গন্তব্য। বাগডোগরাতে গাড়ি বলা আছে। হোম স্টে থেকেই পাঠিয়ে দেবে। তাই চিন্তার বা অসুবিধের কোনো ব্যাপার নেই। তবুও, দেশের যা অবস্থা, যা দিনকাল পড়েছে, সুভদ্রা নিশ্চিন্ত হতেই পারেন না। বারবার মনে কুডাক ডাকে, মেয়েকে যেতে এই যে অনুমতি দিলেন, এটা ঠিক করলেন কি আদৌ? পরে আফসোস হবে না তো? মায়ের মন। অথচ মেয়েকে বলতেও দ্বিধা করছেন। যদি জাহ্নবী রাগ করে? কিছু যদি বলে?
মেয়ের জন্য স্যান্ডউইচ আর কেকের টুকরো প্যাক করতে করতে বারবার সুভদ্রার চোখ চলে যাচ্ছে বড় ঘড়িটার দিকে। তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ ও বেরোবে। আর মোটে কয়েকটা ঘন্টা। যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার, এরই মধ্যে নিতে হবে। আলমারি থেকে টিফিন বাক্স বের করতে গিয়ে একবার থমকে দাঁড়ালেন। কী মনে হতে সোজা চলে গেলেন মেয়ের ঘরে। জাহ্নবী তখন আলমারি খুলে কী কাপড় জামা পরে যাবে আজ, তা খোঁজাখুঁজি করছে। মাকে দেখে বললো, "মা, ওভারনাইট তো এয়ারপোর্টে বসে থাকতে হবে। ঠান্ডা পাবো, বলো? তাহলে বরং আমি সোয়েটশার্ট পরেই যাই। কী বলো?" সুভদ্রা মাথা নেড়ে খানিক তাকিয়ে থাকেন। তারপর বেরিয়ে যায়। কিছু বলতে পারেন না। আবার মিনিট দশেক পর ফিরে যান জাহ্নবীর ঘরে। প্রশ্ন করেন, "বাবু, গরম জামা ঠিক করে নিয়েছিস তো? সোয়েটার? মাফলার?" জাহ্নবী মাকে আশ্বস্ত করে। সব নিয়েছে ও। এক্কেবারে লিস্ট মিলিয়ে প্যাক করেছে সে। সুভদ্রা আবার ফিরে যান ডাইনিং হলে। কেকের টুকরোগুলো বক্সে ভরে, তা হাতে নিয়েই চলে আসেন আবার। মেয়ের ঘরে ফেরত। জাহ্নবী মুখ তুলে প্রশ্ন করে, "কী হলো?" সুভদ্রা একটু ইতস্তত করে বলেন, "শোন মা, ওখানে কিন্তু বৃষ্টি হয় হঠাৎ হঠাৎ। মোজা ভিজে যেতে পারে। নিয়েছিস সঙ্গে এক্সট্রা মোজা?" জাহ্নবী মায়ের হাত ধরে এনে বসায় নিজের খাটে। নিজে হাঁটু গেড়ে বসে সামনে। তারপর মায়ের দুটো হাত নিজের নরম দুই হাতের ভিতর শক্ত করে ধরে বলে, "তোমার কী হয়েছে বলো তো মা? সামথিং ইস বদারিং ইউ, না?" সুভদ্রা এবার কাঁদো কাঁদো হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, "আমার তোকে নিয়ে খুব টেনশন হয় রে মা। তোর যদি কিছু হয়ে যায়... আমার তো কেউই নেই আর মা। সেই জন্যই..."
"বুঝেছি। সেই জন্যই তুমি বারবার আষ্টেপৃষ্টে আমার কাছে থাকার জন্য নানান অজুহাতে ঘরে আসছো। তাই তো?"
সুভদ্রা উত্তরে চুপ থাকেন।
জাহ্নবী বলল, "মা, দেখো। আমি তোমার জাহ্নবী যমুনা হলেও বিগলিত করুণা নই। আমি তোমার ট্রেনিংয়ে শক্তপোক্ত মেয়ে। নিজের যত্ন, নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে পারি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো, আই উইল বি সেফ। কিন্তু তবুও, যদি তুমি চাও, তাহলে আমি যাবো না। নাথিং এট দ্য কস্ট অফ ইয়োর হ্যাপিনেস মা।"
সুভদ্রা ভেবে পান না কী বলবেন। নিজের ভয়ের জন্য মেয়ের এই আনন্দে বাধা হয়ে দাঁড়াবেন? হতেই পারে না। নাঃ। ভয়কে জয় করতে হবেই। জাহ্নবী তাঁর মেয়ে। তাঁরই মতো লড়াকু। ভয় পেলে চলবে না।
হাসিমুখে সুভদ্রা এগিয়ে গেলেন ডাইনিং রুমের দিকে। মেয়েকে বলে গেলেন, "বাবু, রেডি হয়ে যে তাড়াতাড়ি। বেরোতে দেরি করিস না। ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে শেষে!"

জাহ্নবী অবাক হয়ে চেয়ে থাকে মায়ের দিকে।

(ক্রমশ)

Friday, March 13, 2020

রঙ রুট
সুচেতনা

(৩)
"কী হল মা? কিছু বলছ না কেন?" জাহ্নবীর প্রশ্নে সম্বিৎ ফেরে সুভদ্রার। দার্জিলিং। নামটার সাথে যেন কত অজস্র স্মৃতি জড়িয়ে। সেই কুয়াশা মাখা সকালগুলো, উঁচু নিচু রাস্তা, জলাপাহাড়ের দিকে উঠে যাচ্ছে, সেই সোনালী আলো মাখা ম্যাল, আর সেই খয়েরি কালো চেক চেক মাফ্লার। সব মনে পড়ে যাচ্ছিল সুভদ্রার। জাহ্নবীর ডাকে অন্যমনস্কতা কাটিয়ে জবাব দিলো, "এত জায়গা থাকতে সেই দার্জিলিং?" জাহ্নবী উত্তর দিল, "কেন? দার্জিলিঙে কী সমস্যা? তাছাড়া, আমি অবশ্য ঠিক দার্জিলিং যাচ্ছি না। আমি যাচ্ছি লেপচাজগত। তবে তুমি যে বলো দার্জিলিং খুবই সুন্দর? তাহলে?"
সুভদ্রা কী বলবে বুঝে ওঠেন না। সময় নিয়ে কফির কাপে চুমুক দেন। জাহ্নবী ছাড়ার পাত্রী নয়। ছাড়েও না। আবার মাকে জিজ্ঞেস করে, "কী গো? বলো?"
সুভদ্রা আর কোন উপায় খুঁজে পান না। অনেক বছর পর আবার ফিরতে হয় জীবনের সেই ফেলে আসা অধ্যায়ে। সেই অতীত, যেখানে ফিরতে একটা সময় ভীষণ কষ্ট হতো, চাননি ফিরতে। কফির কাপটা নামিয়ে রেখে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, "দার্জিলিং। এবং সেই ফাল্গুন মাস। সেইবার কলেজের পরীক্ষার পর গিয়েছিলাম দাদা বৌদির সাথে। দার্জিলিং বেড়াতে। সেখানে গিয়েই তোর বাবার সাথে দেখা হলো। আর তারপর..." কথায় ক্ষণিকের বিরতি দিয়ে আবার বলতে থাকেন সুভদ্রা, "আর তারপর তো তুই জানিসই। আমার সর্বনাশ। তাই চাই না তুই যাস। তুই গেলে তোরও যদি... "
মাকে থামিয়ে দিয়ে জাহ্নবী বলে, " প্রথমত, ওটা সর্বনাশ না। অই ভদ্রলোকের সাথে দেখা না হলে, আজ আমি থাকতাম না। আমায় ছাড়া এই নাকি তোমার আর কেউ নেই, তাহলে? সেই ঘটনাকেই বলছ সর্বনাশ? আর সেকেন্ডলি, মিস্টার অর্জুন রাঠোড়ের মত অমন চারমিং ভদ্রলোক আর দ্বিতীয় কাউকে খুঁজে পাওয়া বেশ বেশ কঠিন মা। কাজেই, স্টে রেস্ট অ্যাশিয়রড, আমি তোমার হিস্ট্রি রিপিট করব না। আর যদি করেও ফেলি, আমার সাপোর্ট সিস্টেম তোমার সিস্টেমের চেয়ে ঢের বেশি স্ট্রং। কাজেই, আমি সামলে নেব। আমরা সামলে নেব। বুঝেছ? আর থার্ড পয়েন্ট, মোস্ট ইম্পরট্যান্ট, আমি লেপচাজগত যাচ্ছি। দার্জিলিং না। রডোডেন্ড্রনের সন্ধানে। রঙের সন্ধানে। বাংলা রঙ। ইংরেজির কোন রঙ রুটে ভুলেও যাবো না। বুঝলে?"
সুভদ্রা আধুনিকা। জানেন মেয়ে বড় হয়েছে। ওর ইচ্ছেকে স্বাধীনতাকে মর্যাদা দেওয়াটা কর্তব্য। তাই আর দেরি না করে বললেন, "বেশ। যাবে। তবে হ্যাঁ, সব ডিটেলসে জানিয়ে যাবে আমায়। কবে কোথায় যাচ্ছ, থাকছ কোথায়, সব। আর শুনে রাখো, লেপচাজগত যাও যতই, মনে রেখো তোমার জগত কিন্তু এই আমি। দিল্লীতে বসে হাঁ করে অপেক্ষায় থাকবো। কেমন?"

"লাভ ইউ মা" এই বলে খুশীতে ডগমগো জাহ্নবী মায়ের গলা জড়িয়ে ফেলে আদরে, আহ্লাদে।


(ক্রমশ)


পুনশ্চঃ শনি রবি ছুটি। লেখা না আসারই চান্স বেশি। পুরো প্যাকড শিডিউল উইকেন্ডে।

Thursday, March 12, 2020



রঙ রুট
সুচেতনা

(২)
সুভদ্রা সিঙ্গেল মাদার। একা হাতেই মেয়েকে মানুষ করেছেন। মেয়ে রীতিমত তাই মায়ের বন্ধুরই মতন। ইদানীং মেয়ের কিছু সমস্যা হয়েছে, মানসিকভাবে একটু বিপর্যস্ত। তাই মাঝে মধ্যে থেরাপিস্টের কাছে যায়। থেরাপিস্টটি মোটামুটি ভালোই। সুভদ্রার অন্তত তাই মনে হয়। জাহ্নবীর মুড সুইংস আজকাল আগের চেয়ে অনেকটাই কম। একেকদিন সেশন থেকে এসে একেকরকম টোটকা শোনায় মাকে। আজও বুঝই সেরকমই ব্যাপার।
সুভদ্রা মেয়ের কথায় বিশেষ উত্তর দিচ্ছে না দেখে জাহ্নবী ব্যস্ত হয়ে বলল, "কী গো মাতৃদেবী, কন্যার কথা শুনছ না যে? বড়ই অবহেলা করছ? কী ব্যাপার?" সুভদ্রা মেয়ের জন্য হট চকলেট আর একটু চিকেন পপকর্ন ভেজে এনে সামনে গুছিয়ে বসে জিজ্ঞেস করলেন, "বল। শুনছি তো। কিন্তু এমন কথা তো দুদিন অন্তরই শুনে থাকি। তা এইবারে বাড়তি কী আছে যে খুব পাত্তা দেবো?" মায়ের কথায় জাহ্নবী স্পষ্টই বিরক্ত। কাঁচুমাচু মুখ করে বল্য, "দেখলে তো? আমার কথার কোন ইম্পরটেন্সই নেই।" মায়ের সটান উত্তর, "ও মা, গুরুত্ব নেই কে বলেছে? এই তো শুনছি, বাবু, সবই শুনি। শুধু তোদের মত সবেতে রিঅ্যাক্ট করে বসিনা। বল, যা বলছিলি। শুনছি আমি।"
খানিক শান্ত হয়ে জাহ্নবী বলল, "শোনো না মা, আজ ডক্টর শালিনী বলছিল যে আমার নাকি একটা ব্রেক দরকার। আই নিড আ চেঞ্জ ফ্রম দ্য রুটিন। তাই একটু বেড়াতে বেরনো খুব প্রয়োজন আমার।" সুভদ্রা উত্তর দিলেন, "তা ভালোই বলেছে। তোকে তো কত বলি। একটু ছুটি নে। কাছে পিঠে কোথাও থেকে ঘুরে আসি। চল না, আগ্রা যাবি উইকেন্ডে?" জাহ্নবী মাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, "উফ মা। আমার পুরো কথাটাই তো শুনলে না। আই হ্যাভ টু ট্র্যাভেল অ্যালোন। টু ডিস্কাভার মাইসেল্‌ফ। বুঝলে?" সুভদ্রা শুনে হতবাক। কী বলে কী এরা? একলা একলা না ঘুরলে নিজেকে জানবে না? কেন ওরা নিজেদের চেনেনি? মানুষ হয়নি? যতসব অদ্ভুত সব চিকিৎসা পদ্ধতি। অবাক লাগে ভাবতেই। তবুও, ডাক্তার বলেছেন যখন, একেবারে ফেলনা করা যায় না। মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, "তা কোথায় যাবি ঠিক করলি?"
মেয়ে দুমিনিট চুপ থাকে। ফোনের ভিতর কীসব খুটখুট করতে থাকে। এই হয়েছে এই প্রজন্মর এক নেশা। সারাক্ষণ মোবাইল। অ্যাপেই এদের জীবন।
জাহ্নবী মোবাইলের স্ক্রিনটা ধরে মায়ের সামনে। একটা হোটেল বুকিং অ্যাপ। সেখানে জ্বলজ্বল করছে লেখা "হিল হ্যাপি হোমস্টে"। দার্জিলিঙের কাছেই। ঝকঝকে এক গাল হাসি হেসে জাহ্নবী বলে, "মা, তুমি তো বলেছ দার্জিলিং অসাধারণ সুন্দর? তোমার তো থাকা দার্জিলিঙে, বলো? আমি ভাবলাম, আমিও সোলো ট্রিপ ওখানেই করি।"
সুভদ্রা চুপ। কী উত্তর দেবেন, বুঝতে পারেন না।


(ক্রমশ)

Wednesday, March 11, 2020



রঙ রুট

সুচেতনা




(১)

"শোনো, আমি বেড়াতে যাব। আমার একটা চেঞ্জ দরকার। খুব।" বাড়ি ঢুকেই প্রথম কথা জাহ্নবীর। জাহ্নবীর মা, সুভদ্রা, উনি অবশ্য এই ধরণের কথায় তেমন আর বিচলিত হন না আজকাল। মেয়ের এই যখন তখন হঠাৎ করেই এইসব বক্তব্য, এসবে তিনি অভ্যস্ত। নির্ঘাত জাহ্নবী ফেসবুকে কোনো বন্ধুর পোস্ট দেখেছে, কোথাও ঘুরতে টুরতে গিয়ে ছবি দিয়েছে। আর ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে মেয়ের উঠলো বাই তো কটক যাই। তবে এই কটক যাওয়াটা অবশ্য আজ অবধি শুধুমাত্র বলা অবধিই সীমাবদ্ধ থেকেছে। নইলে যে হারে জাহ্নবী একেকদিন অফিস থেকে ফিরে ওই "বেনারস যাবো। আজ ত্রিপর্ণার প্রোফাইলে অসাধারণ আরতির ছবি দেখলাম। ওর চেয়ে ঢের ভালো ছবি আমি তুলতে পারবো" বা "মা, চলো লাদাখ যাই। কী অসাধারণ সিনারি গো মা" বা "মা মা, লাস্ট টাইম তো দেখো কানহা গিয়েও বাঘের দেখা মিলল না। চলো না, সরিস্কা যাই। শিয়র শট বাঘের দেখা মিলবেই" করে, এতদিনে সব যদি সত্যিই ও যেত, অফিসের পাওনা ছুটি আর ব্যাংক ব্যালেন্স, দুইই ফাঁকা গড়ের মাঠ হয়ে যেত। জাহ্নবী কাজপাগল মেয়ে। সারাক্ষণ কিছু না কিছু নিয়ে মেতে থাকতে এতই ভালোবাসে, আর অফিসে ওর সুপারভাইজার এই ব্যাপারটা এতটাই ভালো বুঝে গিয়েছেন যে, সারা অফিসের সব দায়িত্বই প্রায় জাহ্নবীর ঘাড়েই পড়েছে। অমুক মিটিং, জাহ্নবী প্রেজেন্ট করবে, তমুকের সেলস কল, জাহ্নবী হ্যান্ডেল করবে। অমুক ডেটা চাই, ওই তো, জাহ্নবী আছে তো। এই করে করে বেশিরভাগ শনি রবিও জাহ্নবীর অফিসে গিয়ে বা ওয়ার্ক ফ্রম হোম দিয়েই কেটে যায়। কিন্তু তবুও, মেয়ের এদিক ওদিক ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে, ষোলো আনা। আর তাই রোজের এই এখানে যাবো আর ওখানে যাব, এই ফিরিস্তি শুনতে হয় সুভদ্রাকে। সুভদ্রা আজকাল পাত্তা দেন না। শুনেই যান। আজকের এই ডিক্লারেশনকেও সেরকমই ভেবে উড়িয়ে দিয়ে রান্নাঘরে চললেন, মেয়ের জন্য চা করতে। কিন্তু এইবারে যে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম, এইটা বুঝলেন মেয়ের পরের কথায়।




(ক্রমশ)




পুনশ্চ: চেষ্টা করবো রোজ লেখার। তবে এইটুকুই। চাইলে একসাথে পুরোটা পড়তে পারেন।

Sunday, March 8, 2020

এশিয়ান ক্যুইজিন বড়ই প্রিয়। বিশেষ করে ভালোবাসি থাই রান্না। থাই রান্না বলতেই সবচেয়ে প্রথমে মাথায় যা আসে, এটি সেই। থাই রেড কারী। চিকেন দিয়ে করলাম। স্পেনসার্স থেকে রেড কারী পেস্ট কিনে এনেছিলাম। খুবই সহজ প্রণালী। চটজলদি রান্না হয়ে যায়। মিনিমাম পরিশ্রম। স্বাদে ভালো।

রেসিপি দিয়েই দিলাম। যদিও অনেকেই জানেন।
চিকেনটাকে (৫০০গ্রাম) অল্প নুন জলে সিদ্ধ করে রেখেছিলাম। বোনলেস দিয়ে করলে বেশি ভালো।

গরম জলে ম্যাগির নারকোলের দুধ পাউডার (৩ চামচ দিয়েছিলাম। আরো একটু দেওয়াই যায়) গুলে রেখেছিলাম।

কড়াইতে দুই টেবিল চামচ সাদা তেল গরম করে তাতে একে একে গাজর, পেঁয়াজ, ক্যাপসিকাম (ইচ্ছে অনুযায়ী। চাইলে নাও দিতে পারেন) একে একে দিয়ে সাঁতলে নিলাম। এরপর ওই তেলেই একটু রসুন বাটা আদা বাটা দিলাম (দুটোই কুচি দিলে ভালো হতো। ছিল না।)। খানিক নাড়াচাড়া করলাম। এবার এতে দিলাম দুই চামচ (উঁচু করে) রেড কারী পেস্ট। আবার খানিক নাড়াচাড়া করলাম। এবার এতে চিকেনের টুকরোগুলো দিয়ে আবার নাড়লাম। ভালো করে মশলা মাখামাখি করে নারকেলের দুধটা ঢেলে দিলাম। চিকেন সিদ্ধর জলও দিলাম। এরপর আন্দাজ মতো নুন আর চিনি দিলাম। খেয়াল রাখতে হবে, রেড কারী পেস্টটাতে নুন, গুড় দুইই আছে। কাজেই বুঝেশুনে। আর রান্নাটা মিষ্টি মিষ্টি ঝাল ঝাল হয়। তাই মিষ্টত্ব আনতে নারকোলের দুধ বেশি দিলেও হয়। এরপর খানিক ফোটালাম। গোটা চার পাঁচেক লেবু পাতা (কাফির লেবুর পাতা দেওয়ার কথা। আমি গন্ধরাজ দিলাম।) দিয়ে ফোটালাম। এরপর গ্যাস বন্ধ করে দিলাম।

জ্যাসমিন রাইস দিয়ে সার্ভ করার কথা। আমি প্লেন ভাতের সাথেই খাবো। তবে ভাত রাঁধার সময় ওই দু তিনটে লেবুপাতা দিয়ে ফুটিয়েছি।
সকলের রাতের খাওয়া কমপ্লিট? তাহলে এই ফাঁকে একটু গপ্পো করি। আজকে সকালেই লিখলাম ওই উইকেন্ড নিয়ে। পড়েছেন? সেখানে বাহারি রান্নার কথাও বলেছি। তা হয়েছে কী, লিখতে লিখতে আমার নিজেরও মনে হলো যে না। ওই উইকেন্ডে নিজেই কিছু অন্যরকম রান্না করি। প্রত্যেকবার তো মায়ের ওপরই হম্বি তম্বি করি। লেখালিখিতে যতই ভালো ভালো জ্ঞান দিই না কেন, আমি আসলে জ্ঞানপাপীই বটে। তা যাই হোক। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। ছটার সময় ইনস্টিটিউট থেকে বেরিয়ে সোজা চলে এলাম শপিং মল। বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে এসে টুকটাক কিছু কিনলাম বটে। তবে বাড়ি ফিরতে ফিরতেও ঠিক করে উঠতে পারলাম না, কী রান্না করা যায়। তারপর আর কী, ওই অগতির গতি। সকালে শুনে গিয়েছিলাম ফ্রিজে চিকেন আছে। আর সবচেয়ে সহজ রান্না চিকেন। কাজেই...

কিন্তু তাও তো হলো। তবে রাঁধবো টা কী? এই চিকেন ওই চিকেন সেই চিকেন নাকি সেই ওই যে ওইটা? ভেবে ভেবে একসা।

এবার সত্যি কথা বলি একটা। আমি না জীবনেও পড়া মুখস্থ করতে পারিনি। চিরকাল ওই পড়তাম ঠিকই। কিন্তু তারপর পরীক্ষার হলে গিয়ে নিজের মতো করে বানিয়ে বানিয়ে লিখে আসতাম। দু তিনটে রেফারেন্স বই থেকে পড়তাম। তাই এ বই সে বই মিলিয়ে মালমশলা মন্দ থাকত না। কাজেই নম্বর, বলতে নেই, ভালোই পেতাম।

একই গল্প হলো তাই আজও। সারাদিন সময় পেলেই রান্নাবান্নার ভিডিও আর পোস্ট দেখি। তবে কী রান্না করবো, ভেবেই পাইনি। অগত্যা, মস্তিষ্কপ্রসূত ও বাড়িতে যা যা সরঞ্জাম ছিল, সেসবের সাহায্যে এই রান্নাটি করলাম। খেতেও উপাদেয় হয়েছিল। নামকরণ করেছি "বাদাম চিকেন"। করে দেখবেন নাকি? খুব সোজা। আমার মতো অপদার্থ মানুষ রাঁধতে পেরেছে মানে দুনিয়ায় যে কেউ (অবশ্যই বেসিক হাতে খড়িটা হয়ে থাকতে হবে রান্নাঘরে) এটা সহজেই রেঁধে ফেলবেন। দেখুন দেখি, এই লম্বা ছুটি আসছে সামনে। এর মধ্যে করেন কি না। বিশেষ করে বলবো, আপনাদের, যাঁরা অন্যদিন অন্যের রান্না খান। একবার এইটা রেঁধেই খাওয়ান না তাঁকে। রান্নার স্বাদ যেমন খুশি হোক না কেন, জেশ্চারটা কিন্তু খুবই ভালো লাগবে। প্রশংসা পেলে আমায় একটা ক্যাডবেরি খাইয়ে দেবেন। ঠিকানা বলে দেব। ঠিক আছে?

নিন, এবার রেসিপি লিখেই দিচ্ছি।
(গতকাল বেনুদির রান্নাঘর বইটা পড়ছিলাম। তাই ওই স্টাইলে লিখতে চেষ্টা করেছি। অবশ্যই হয়নি। না রান্না, না লেখা।)

"আদা রসুন বাটা (দুই থেকে আড়াই চামচ, উঁচু উঁচু), টমেটো বাটা (একটা মাঝারি মাপের আস্ত টমেটো ঘষে দিয়েছি গ্রেটারে), টক দই (দুই টেবিল চামচ), নুন (স্বাদ অনুসারে), লঙ্কা গুঁড়ো (স্বাদ অনুসারে) দিয়ে চিকেনের টুকরোগুলো ম্যারিনেট করলাম। পাঁচশো চিকেন ছিল। ততক্ষণে পরপর বাকি কাজ সারলাম। বাড়িতে যাবতীয় যা যা বাদাম ছিল, সেই কাজু, আমন্ড, চিনেবাদম, আখরোট নিলাম। সব মিলিয়ে হাফ কাপ হবে। (ছোট কাপের হাফ কাপ) জলে ভিজিয়ে রাখলাম মিনিট পাঁচেক। সেই জলসহ ভিজে বাদাম, পেঁয়াজ (দেড়খানা, মাঝারি মাপ), একটা শুকনো লঙ্কা, অল্প নুন দিয়ে মিক্সিতে ভালো করে বেটে নিলাম। এবার কড়াইতে সাদা তেল (আমি একটু কমই দিই। তাও ধরুন, দুই টেবিল চামচ। দই দেওয়া আছে মাংসে, তাই তেল ছাড়বে) গরম করে পেঁয়াজ কুচি (আধখানা মাঝারি মাপের), অল্প নুন আর চিনি (চিনি দেওয়া ক্যারামেলাইজ করতে) দিয়ে কড়া খয়েরি করে ভাজলাম। তুলে রাখলাম। এর পরের স্টেপ, অপশনাল। আমাদের বাড়িতে চাইনিজ ছাড়া মাংসের সব প্রিপারেশনেই আলু পড়ে। তাই তেলে আলু ভাজলাম অল্প। একই কড়াইতে (প্রয়োজন হলে একটু তেল আরো দেওয়া যায়। তবে আমি কম তেল প্রেফার করি। এক কেজি ওজন আজই দেখলাম কমেছে কি না!) এবার শুকনো লঙ্কা (২টা), তেজ পাতা (২টা) আর আস্ত গোল মরিচ (গোটা পাঁচ ছয়েক)
এবং ইঞ্চি দেড়েক দারুচিনি ফোড়ন দিলাম। এরপর ওই বাদাম বাটার মিশ্রণ প্রায় ৩/৪ ঢেলে দিলাম। কষাতে লাগলাম খানিক। আলুর সাথে মাখামাখি হলো খানিক। এরপর চিকেনের টুকরো দিয়ে দিলাম। নাড়াচাড়া চলতে লাগল। বাকি বাদাম বাটা দিলাম। প্রয়োজন মতো এরপর নুন চিনি আর জল দিয়ে দিলাম। কড়াই ঢেকে মাংস সিদ্ধ হতে রাখলাম খানিকক্ষণ। হয়ে গেলে একটু (এক চামচ) ঘি ছড়ালাম। এবার ঢাকনা খুলে আরো একটু নাড়াচাড়া। তারপর নামানোর ঠিক আগে বেরেস্তা ছড়িয়ে নেড়ে ঘেঁটে গ্যাস বন্ধ।

স্পেনসার্স গিয়েছিলাম আজ গ্রসারি (পড়ুন খ্যাটনের সরঞ্জাম জোগাড় করতে) শপিং করতে। রেডিমেড কুলচা কিনেছিলাম। মাইক্রোতে গরম করে মাংসটা দিয়ে খেলাম। তবে এই প্রিপারেশন পরোটা বা গরম ভাত দিয়েও খাওয়া যায় মনে হয়। আর ভালো হবে যদি তেলের সাথে ঘি মিশিয়ে রাধলে ফোড়ন দেওয়ার সময়। তবে ওই যে, আমি হেলদি ইটিংয়ে বিশ্বাসী!😊😊

কেউ এটা ট্রাই করলে জানাবেন কিন্তু!

(তা বলে ভাববেন না এবার থেকে এখানে আমি লেখা আসছে না বলে ফাঁকি মেরে গান যেমন দিই, তোমন রান্না দেব। উঁহু। নেহাৎ এই বিশেষ রান্নাটি সম্পূর্ণ আমার ঊর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত, অগত্যা "ক্রিয়েটিভ ও অরিজিনাল কন্টেন্ট"। তাই সাম্পানের পাতায় স্থান দিলাম। হজম হলে হয়।)

- সুচেতনা
"থাপ্পড়" সিনেমাটি দেখেছেন? আমার দেখা হয়নি। তবে ট্রেলার দেখেছি। পারলে দেখবেন। খুব প্রয়োজন। আপাতত তিনটি ঘটনা বলি যখন এই থাপ্পড়টা খুব জরুরি।

থাপ্পড়
সুচেতনা

(১)
বিতান, অভ্র, রঞ্জিত, সুকোমল সেই কোন ছোট্টবেলা থেকে বন্ধু, যাকে একেবারে বলে "চাড্ডি বাডিজ"। একই স্কুলে লেখাপড়া করেছে। তবে বর্তমানে কলেজ আলাদা। বিতান ফোর্থ ইয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে ব্যাঙ্গালোরের কলেজে, অভ্র কোনো এক আই আই টিতে এম এস সি ফার্স্ট ইয়ার, রঞ্জিত হলদিয়াতে মেডিকেল থার্ড ইয়ার আর সুকোমল মাস কম পড়ছে কলকাতাতেই। আপাতত হোলির ছুটিতে চার বন্ধু একসাথে। অনেকদিন পর। আড্ডা জমেছে শহরের এক বিখ্যাত শপিং মলের ফুড কোর্টে। এদিক সেদিক নানান গল্পই চলছে। তবে মাঝে মধ্যেই এক কমন টপিক বারবার উঠে আসছে। তাদের চারজনের জীবনেই কোনো বিশেষ বান্ধবীর অভাব।
বি: ধুর, ফোর্থ ইয়ার হয়ে গেল। গিটার গাঁজা কিছুই বাদ দিলাম না। প্লেসমেন্টেও চাকরি জুটে গেল। কিন্তু গার্ল ফ্রেন্ড? ধুর ধুর। আমার কপালে ওই আনন্দবাজার নাচছে।
র: শোন ভাই, ওসব মেয়ে ফেয়ে নেই লাইফে, অনেক শান্তিতে আছিস। বুঝেছিস?
সু: কেন বে? নিজে ব্যাটা সারাদিন এনাটমি ক্লাসে জমিয়ে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দেখছো সব, তোমার ভাই লাগে না। কিন্তু আমাদের তো লাগে। নাকি? কীরে অভ্র, চুপ করে কেন, বল? কাহাতক আর পোস্টার দেখে কাজ সারতে ভাল্লাগে বল তো?
অভ্র কোনো উত্তর দেয়না। চুপচাপ বসে শোনে ওদের কথা।
বি: সুকোমল ভাই একদম রাইট কথা বলেছিস। রঞ্জিত তো সারাদিন ওই ক্যাডাভার ঘাঁটে। ওর আর কী বল। রাত্রে ওতেই চলে যায়। আমাদের বাপু জীবনে ওই জন্যই শপিং মল লাগে। ওই দেখ, দেখ, দেখ। ওই যে। ওই যে ওই পিঙ্ক হট প্যান্ট পরা চিংকিটাকে দেখ। দেখেছিস? পুরো মাখন ভাই, মাখন।
সু: হ্যাঁ। উফ ঠিক যেন ভিটের ক্যাটরিনা। কী ঠ্যাংখান ভাই। আঃ।
র: তোরা চুপ করবি? তখন থেকে বাজে কথা বলেই যাচ্ছিস। লিমিট ক্রস করছিস কিন্তু।
বি: ওই যে বললাম, আমাদের কষ্টটা তুই আর কী বুঝবি বল। তুই রোজ ঘাঁটিস হিউম্যান ঠ্যাং। আর আমাদের কপালে জোটে ম্যাক্সিমাম ওই কে এফ সির ঠ্যাং। আর সাইডে একটু আধটু ওই চিংকি মামনিগুলো। তুই আর কী বুঝবি ভাই, প্রিভিলেজড মানুষ। কীরে অভ্র, বল?
অভ্র আর চুপ থাকতে পারে না। রাগে ওর কান লাল হয়ে গিয়েছে। ও উঠে দাঁড়িয়ে সুকোমল আর বিতানের গালে দুটো থাপ্পড় মারে, জোরে। "যেদিন তোরা ভালো মানুষ হবি, সেদিন আসবি কথা বলতে", এই বলে উঠে চলে যায় টেবিল ছেড়ে। বাকি তিন বন্ধু সাময়িক ভাবে বিহ্বল হয়ে গেলেও তারপর একে অপরের মুখ চাওয়াচাউই করতে থাকে। ওরা জানে না, অভ্র, যে কিছু মাস আগে অবধিও ওদেরই মতন ছিল, কয়েক সপ্তাহ হল বদলে গিয়েছে। বদলটা অবশ্য বাধ্য হয়েই। নিজের বোনের মলেস্টেশনের পর মানসিক রুগীতে পরিণত হওয়াটা স্বচক্ষে দেখে।

(২)
নয়নিকা আর দীপাঞ্জনের বিয়েটা দুই বছর পূর্ণ করেছে সদ্য। কাগজ দেখে সম্বন্ধ করেই বিয়ে। পাল্টি ঘর। সবাই জানে, বেশ আনন্দেই আছে ওরা। হ্যাঁ, এমনি সবই ঠিকঠাক। শুধু ওই মাঝে মাঝে দীপ অফিস থেকে ফেরে মদ খেয়ে। নেশায় চুর। আর তখন কাণ্ডজ্ঞান থাকে না কোনো। নয়নিকা কিছু বলতে গেলেই তখন জোটে অকথ্য ভাষায় গালাগালি। আর মার। এ ছাড়া অবশ্য মাঝে মাঝে নয়নিকার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে শারীরিক মিলনও ঘটে। নয়নিকার হাজার বারণ, কাকুতি মিনতি তখন হয়ে যায় "বাহানা"। সমস্ত "পৌরুষ" ঢেলে নিজের "অধিকার" ফলায় দীপ। নয়নিকা একেই নিজের ভাগ্য বলে মেনেই নিচ্ছিল। ঠিক যেমন ছোট থেকে শিখে এসেছে, মেয়েরা মানিয়ে নেয়। স্বামীই দেবতা। পুরুষ মানুষ। একটু আধটু ওরকম করতেই পারে। প্রায় যখন অভ্যেস করেই ফেলছিল ও, হঠাৎই স্কুলের বন্ধুদের গ্রুপ থেকে পুনরায় যোগাযোগ হয় পারমিতার সাথে। পারো উকিল। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স বিষয়ে একদিন একটা পোস্ট শেয়ার করার সূত্রেই ওর সাথে নয়নিকার আলাদা করে কথা হয়। নয়নিকা আস্তে আস্তে বুঝতে শেখে যে এগুলি ওর প্রাপ্য নয়। রুখে দাঁড়াতেই হবে ওকে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকুক কি না। আর তাই সেকেন্ড এনিভার্সারির দিন রাতেও যখন দীপাঞ্জন নেশা করে এসে মারতে যায় নয়নিকাকে, নয়নিকা উল্টে একটা পাল্টা থাপ্পড় মারে দীপের গালে।
ঘটনার আকস্মিকতায় দীপ থমকে যায়। নেশা তখন কেটে গেছে। অবাক সে। ওর এই নরম বউ ওকে মারতে পারলো? আঁতে ঘা লাগে ওর। পার্স আর একটা ছোট ব্যাগ গোছানোই ছিল। হাতে নিয়ে গটগট করে বেরিয়ে যায় নয়নিকা বাড়ি থেকে। মুক্তির সন্ধানে।

(৩)
শর্মী আর ওর  পাঁচ বছরের মেয়ে পুপাই এই কিছু মাস হলো এসে থাকছে নেস্ট হাউজিংয়ের তিনতলার এই ফ্ল্যাটে। ওদের ঘিরে পাড়া প্রতিবেশীর অপার কৌতূহল। কেন বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ স্থায়ীভাবে নেই, বাড়িতে কখন কে এলো গেল, সব ব্যাপারেই সকলের বড়ই জিজ্ঞাসা। অনেকে তো আবার কেন মিত্তিররা ওদের ফ্ল্যাট ভাড়া দিলো, এই নিয়েও নানান মতামত রেখেছেন।
শর্মীদের এই ফ্ল্যাটে আসার পর আজ প্রথম জেনারেল বডি মিটিং। এমনিতেই ওর ইচ্ছে ছিল এই সুবাদে বিল্ডিংয়ের সকলের সাথে আলাপ পরিচয় করবে, তা ছাড়া সিকিউরিটি, জলের ব্যবস্থা এসব নিয়েও জিজ্ঞাস্য ছিল কিছু। তাই শর্মী এসেছে মিটিংয়ে। কিন্তু এসে যে এমন কিছু ঘটবে, সেটা এই একবিংশ শতাব্দীর কলকাতাতে বসে ও আশা করেনি। কী হলো? শুনুন তাহলে।
মিস্টার দত্ত, হাউজিংয়ের সেক্রেটারি, প্রথমেই শর্মীর সাথে সকলের পরিচয় করালেন। তারপর পরবর্তী এজেন্ডাতে যেতে যাবেন, এমন সময় বাধ সাধলেন শর্মীর উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের সিনিয়র মিসেস সিনহা। "আচ্ছা, শর্মী, তুমি একা থাকো কেন?" শর্মী একটু তাকালো, এইসব প্রশ্নে ও অভ্যস্ত। তাই হেসেই উত্তর দিলো, "না তো মাসিমা। আমি আমার মেয়ে পুপাইকে নিয়ে থাকি।" মিসেস সিনহাও দমবার পাত্রী নন। উনি বললেন, "না মানে তোমার হাজব্যান্ড? উনি কোথায়?" শর্মী মাথা ঠান্ডা রেখেই বললো, "নেই।" মিসেস সিনহা অবাক। বললেন, "নেই মানে? উনি কি মারা..." শর্মী ওকে থামিয়ে বললো, " না না। বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন। আমরা ডিভোর্স নিয়েছি, তিন বছর হলো।" ব্যস। এইবার যেন মিসেস সিনহা লোপা বল পেয়েছেন, ঠুকে ওভার বাউন্ডারি। বললেন, "ও মা। সে কী, ডিভোর্স কেন, কী সমস্যা?" শর্মী ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলো, "ওটা পার্সোনাল।" মিসেস সিনহা ছাড়বার পাত্রী নন। বললেন, "নিশ্চয়ই তোমার কোনো এফেয়ার টেফেয়ার..." ওর কথা শেষ করতে না দিয়েই হঠাৎ কোণ থেকে এতক্ষণ বিরক্ত হয়ে চুপচাপ শুনে যাওয়া, ওরই পুত্রবধূ, স্বাগতা সিনহা বলে উঠলো, "মা, অন্তত ওর সেই সাহসটা আছে, একসাথে থাকা যাচ্ছিল না বলে বেরিয়ে এসেছে। অন্তত আমার চেয়ে ভালো আছে। প্রতিদিন আপনার ছেলের ওই লুচ্চামি, নোংরামি সহ্য করে আছি শুধুমাত্র সাহসের অভাবে। ও অন্তত নিজের মতো করে বাঁচছে। কে কী বলবে, তা পাত্তা দেয়নি। আর এফেয়ারের কথা বলছেন, আপনার ছেলেকে একবার ফিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন তো, আজকাল উনি কার সাথে এফেয়ার করছেন? মিস রুহি না মিসেস মিত্র?"
উপস্থিত সকলে চুপ। কারুর মুখে একটা কথা নেই। শব্দের থাপ্পড়টা ভালোই খেয়েছেন সিনিয়র মিসেস সিনহা।

Friday, March 6, 2020

হোম মিনিস্টার

শনি আর রবি, এই দুদিন বাড়ির সবার আলাদাই আনন্দ। সারা সপ্তাহ অফিসের ঘানি টানার পর পরপর দুদিন শুধুই আরাম আর আলস্য। এই দুটোদিন বাকি পাঁচদিনের মত সকাল ছটার অ্যালার্মে ঘুম না ভাঙলেও চলে। নাকে মুখে কিছু একটা গুঁজে শেয়ার ক্যাবে চেপে অফিস পৌঁছাও, তারপর সারাদিন কীবোর্ডের দিকে তাকিয়ে লাইনের পর লাইন হয় কোড লেখো, নয় ভুল সংশোধন করো। তারপর আবার সন্ধ্যে হলে সেই অ্যাপ ক্যাবের সার্‌জ। সব মিলিয়ে সোম থেকে শুক্র, একটুও শান্তি নেই, নেই অবসর। তবে হ্যাঁ, স্নিগ্ধার অবশ্য যাহাই শনি তাহাই সোম। বরং শনি রবি বাড়তি কাজই বটে। এই যেমন, দুধওয়ালা ঠিক সেই ছটাতেই দুধ দিয়ে যাবে, সাড়ে সাতটাতে ময়লা নেওয়ার গাড়ি এসে উইস্‌ল বাজিয়ে যাবে। তারপর আটটার মধ্যে নিরুদি আসবে বাসন মাজতে। না এলে তো আরোই চিত্তির। শুক্রবার, উইকেন্ড শুরু, একটু বেশীমাত্রাতেই রান্না খাওয়া হয়েছে। সিঙ্ক্‌ ভর্তি এঁটো বাসন। সব মাজতে হবে। স্বামী ইন্দ্রজিৎ আর কন্যা পুপ্লুর ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সাড়ে নটা, এর মধ্যেই তাই মুখরোচক নাস্তাও তৈরি করতে হবে। নইলে তো আবার পুপ্লুর বাক্যবাণ ধাঁ করে এসে বিঁধবে। "সারাদিনই তো বাড়ি বসে থাকো। এত কুকারি শোজ্‌ দেখতে থাকো। এদিকে রান্নার সময় সেই একঘেয়ে রান্না। দুটোদিন একটু আয়েস করে খাবো দাব, তাতেও যদি সেই ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে বাটার টোস্ট নয় একঘেয়ে লুচি আলুর চচ্চড়ি পাই, ভালো লাগে বলো? উঁহু। জাস্ট ভাল্লাগেনা। একটু ইউনিক্‌ কিছু তো করতে পারো।" পাশ থেকে ইন্দ্রও সায় দেবে, "হ্যাঁ স্নিগ্ধা, রোজ তো অফিসে টিফিনে পাউরুটি আটা রুটি নয় রবারের সোলের মত ঠাণ্ডা লুচি চিবোই। একটু অন্যরকম কিছু করো প্লিজ?" অগত্যা, সব্জি চিকেন ডিম ময়দা সব নিয়ে তোড়জোড়, রাজকীয় ব্রেকফাস্ট বানাও। পুপ্লু আর ইন্দ্রর সারা সপ্তাহের ছাড়া জামাকাপড় মেশিনে দাও, এরই মধ্যে দুপুরের খাওয়ার আয়োজন। বলাই বাহুল্য, সেখানেও চাই "ভেরিয়েশন'। নইলে একগাদা টাকার শ্রাদ্ধ করে জোম্যাটো। মাগ্যিগণ্ডার বাজার। হিসেব করে চলতে হয়। সবদিক সামলাও। কাজের লোকের মাইনে, সংসারের খরচ, দেওয়া থোওয়া। সব হিসেব তো ম্যাডাম স্নিগ্ধাকেই করতে হয়। বাড়ির লোক তো মাসের শুরুতে থোক টাকা ধরিয়েই খালাস।  জামাকাপড় কাচা চলাকালীনই দুপুর আর রাতের রান্নার ব্যবস্থাটাও করে ফেলতে হয়। শনি রোব্বার মানেই হয় বাড়িতে গেস্ট, নয় নিজেরা কারুর বাড়ি যাওয়া। বা শপিং মলে ঘুরে বেরানো। নইলে সিনেমা থিয়েটার। বয়স যে হচ্ছে, তা স্নিগ্ধা আজকাল ভালোই টের পায়। আগে এত কাজ দিব্যি সামলে নিত, আজকাল অল্পেই হাঁপ ধরছে। হাঁটুর ব্যথাও জানান দিচ্ছে মাঝে মধ্যেই। পঁয়তাল্লিশেই শরীর ভাঙতে শুরু করে দিয়েছে। নিয়মিত আজকাল বাড়িতে ব্যায়াম করছে বটে, পুষ্টিকর খাওয়া দাওয়াও করছে। কেউ দেখবে না, খোঁজ নেবে না। নিজেরটা নিজেকেই বুঝে নিতে হবে। নিজের যত্ন নিজেকেই করতে হবে। যানে স্নিগ্ধা। বোধহয় এবার পরিশ্রমটা একটু একটু করে কমাতে হবে। চাকরিরত হলে চিন্তা ছিল না।  ষাটের পরই রিটায়ারমেন্ট। কিন্তু এই চাকরিতেতো আবার সেই বালাইও নেই। কায়দা করে "ডেজিগ্‌নেশন" দেওয়া আছে বটে, "হোম মিনিস্টার" নাকি "হোম ম্যানেজার"। হাসি পায় স্নিগ্ধার মাঝে মাঝে। এইসব যত গাল ভরা নাম। সবই "গিমিক"। কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক লাভের জন্য আর কিছু ওই সমাজের জন্য। বেশ এরকম নাম ধাম দিয়ে বিনে পয়সায় কাজ করইয়ে নেওয়া যায়। ওই বছরে কিছু বিশেষ বিশেষ দিনে, যেমন উইমেন্‌স্‌ ডে, মাদার্‌স্‌ ডে, এইসব দিনে যা একটু আধটু উদযাপন হবে। ব্যস। তারপর সারা বছর সেই যে কে সেই। নাহ, উইকেন্ড মোটেই ভালো লাগেনা স্নিগ্ধার।

চাই না বাপু এই দুদিনের উদযাপন, চাই না এই "গিমিক"। তার চেয়ে শুধু আর বাকি সদস্যদের মত প্রাপ্য সম্মান, কাজের স্বীকৃতি ও প্রাপ্য অবসর দাও, এতেই হবে। এইটুকুই তো চায় স্নিগ্ধা, স্নিগ্ধারা। পাবে না ওরা? 

Saturday, February 22, 2020

দ্য লাস্ট লিফ

গ্রিনিচ ভিলেজ। শহরের এই অঞ্চলটা ওয়াশিংটন স্কোয়ারের খানিক পশ্চিমে অবস্থিত। পথঘাট বেশ আঁকা বাঁকা। এই স্থানটি চিত্রশিল্পীদের খুবই প্রিয়। এখানকার পরিবেশ, আলো বাতাস, সবই বেশ প্রশস্ত। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এখানে ঘরভাড়া নিতান্তই কম। তাই সবদিক দিয়েই, এই গ্রিনিচ ভিলেজ যেন চিত্রশিল্পীদের স্বর্গ।

সু আর জন্সি, দুই বান্ধবী, দুজনেই শিল্পী। গ্রিনিচে এমনই এক তিনতলা বাড়ির সবচেয়ে ওপরতলায় ওরা থাকে। ওদের বন্ধুত্ব অবশ্য এই গ্রিনিচে এসেই। এমনিতে একজনের বাড়ি মেইনে, অন্যজন ক্যালিফোর্নিয়া নিবাসী। বসন্তের এক মনোরম দিনে এইট্থ স্ট্রিটের একটি রেস্তোরাঁয় ওদের দুজনের পরিচয়। আর অল্পক্ষণেই দুজনেই দেখলো দুজনের পছন্দ অপছন্দ অনেকাংশেই মিলে যাচ্ছে। আর তাই ওরা বিশেষ দেরি না করে একসাথে এই বাড়িটিতে থাকা স্থির করলো।

গ্রিনিচ ভিলেজে দিন কেটে যায় আপনমনে। গ্রীষ্ম বর্ষা চলে গিয়ে আসে শীত। সাথে আনে এক নতুন অতিথিকে, নাম তার "নিউমোনিয়া"। এই অতিথি সারা শহরে তার হিমশীতল আঙুলের স্পর্শে একে একে বহু মানুষকে করছে কুপোকাত। শহরের ডাক্তাররা মোটেই খুশি নন একে নিয়ে। যদিও শহরের পূর্বদিকে এর অবাধ গতি, তবু পশ্চিমে, গ্রিনিচের দিকে এই নব্য অতিথি একটু ধীর লয়েই ঘুরছে বটে। অবশ্য তা হলেও, এই অতিথিকে মোটেই সাধুপুরুষ বলা চলে না। বলবোই বা কী করে? কোন ভদ্র ভালো মানুষ কখনও কোন যুবতীকে ব্যতিব্যস্ত করে? এই যে, এই আমাদের অতিথি, তার জ্বালাতনে আমাদের ক্যালিফোর্নিয়া নিবাসী জন্সি ব্যতিব্যস্ত। সে ঠিক নিজের দুষ্ট ঠাণ্ডা আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়েই দিলো মেয়েটিকে। বেচারি জন্সি। বিছানা ছেড়ে আর উঠতে পারে না। পারে না চলতে। সারাদিন শুয়ে থাকে খাটে, জানলার ধারে। আর চেয়ে দেখতে থাকে জানলার বাইরে। এক মনে।

এরই মধ্যে একদিন, জন্সির চিকিৎসক, বেশ চিন্তান্বিত হয়েই সু'কে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, "আচ্ছা, তোমার বন্ধুর ব্যাপারটা কী বলো তো? ওর কি বাঁচবার এতটুকুও ইচ্ছে নেই?" সু কী উত্তর দেবে, ভেবে পায় না। অনেক কষ্টে বলে, "কেন ডাক্তারবাবু? কী হয়েছে? জন্সির কতদিনের শখ, ইতালি যাবে। সেখানে গিয়ে বে অফ নেপলসের ছবি আঁকবে।" ডাক্তার মাথা নেড়ে বলেন, "উঁহু। দেখো, যে রুগী নিজেই বাঁচতে চায় না, আমি হাজার চেষ্টা করলেও তাকে বাঁচাতে পারবো না। বাঁচবার জন্য ইচ্ছেশক্তি রোগীর নিজের ভিতর থেকে আসতে হবে। বুঝলে? আর সেইটা কিন্তু আমি তোমার বন্ধুর মধ্যে এতটুকুও পাচ্ছি না। খুবই চিন্তার বিষয়।" সু অবাক হয়। কী হলো জন্সির, এরকম আচরণ কেন? কীসের কষ্ট ওর? তবে কি এটা কোন হৃদয়ঘটিত ব্যাপার? কই, ও তো কিছু জানে না। না না, এ হতেই পারে না। ডাক্তার বলেন, "দেখো, জন্সির শরীর অত্যন্ত দুর্বল। আমি আমার দিক থেকে সব রকম চেষ্টা তো করছিই। করবোও। কিন্তু রুগী যদি নিজেই তার বাঁচবার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলে, তাহলে ডাক্তার হিসেবে আমার বিশেষ কিছু আর করার ক্ষমতা থাকে না। দেখো, ওর সাথে গল্প করো। কথা বলে দেখো, ওর কী সমস্যা। আগামীদিনের কথা বলো, নানান পরিকল্পনা করো। শোনো ও কী বলছে। ভবিষ্যতের কথা বললে যদি ও প্রাণশক্তি ফেরত পায়। দেখো।"

ডাক্তারের মুখে বান্ধবীর শরীরের এই অবস্থার কথা শুনে সু মনের দুঃখে ভেঙ্গে পড়ে। পাশের ঘরে বসে নিভৃতে খানিক চোখের জল ফেলে। তারপর মনে পড়ে যায় নিজের দায়িত্ব। নাহ, বন্ধুকে বাঁচাতেই হবে। ওকে ভালো রাখতেই হবে। তাই চোখ মুছে হাসিমুখে, প্রিয় গান গুনগুন করতে করতে রঙ তুলি ক্যানভাস নিয়ে পৌঁছে যায় জন্সির ঘরে। গিয়ে দেখে সেই একই পরিচিত দৃশ্য। জানলার দিকে পাশ ফিরে চুপ করে শুয়ে আছে জন্সি। রোগে জীর্ণ ক্লান্ত জন্সি। ও ঘুমোচ্ছে, পাছে ওর গানের শব্দে ওর ঘুমের ব্যাঘাত হয়, এই ভেবে সু গান থামিয়ে দেয়। তারপর আঁকা নিয়ে বসে।

কাজ করতে করতে সু'র কানে একটি মৃদু শব্দ আসতে থাকে। মিনমিনে রিনরিনে স্বরে যেন কোন কথা বলছে। ও আঁকা ফেলে উঠে যায় জন্সির খাটের পাশে। গিয়ে দেখে, বন্ধুটি জেগে শুয়ে আছে। আর আপন মনে বাইরে তাকিয়ে কী যেন গুনে চলেছে। এবং যে সংখ্যাগুলো বিরবির করছে, তার গুনতি উল্টো। বারো। খানিক থেমে আবারএগারো, দশ। মুহূর্তেই এরপর নয়, আট, সাত...  শেষের সংখ্যাগুলো যেন হুড়মুড়িয়ে একের পর এক এসে গেলো।

সু অবাক হয়। জন্সি কী গুনছে? কীই বা আছে গোনার? কৌতূহলী সু জানলার বাইরে তাকায়। চোখে পড়ে পাশের বাড়ির ন্যাড়া দেওয়াল। সেই দেওয়ালের গা বেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লতানে গাছটিতেও শীতের স্পর্শ দৃশ্যমান। ইতিমধ্যেই শীতল হাওয়ায় পাতাঝরা শুরু হয়ে গিয়েছে। দেওয়ালের সাথে তাল মিলিয়ে সেও যেন ন্যাড়া হওয়ার জন্যই পথ চেয়ে আছে, অপেক্ষায়।

"কী হলো জন্সি?" সু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
জন্সি দুর্বল কন্ঠে উত্তর দেয়, "ছয়... ওই দেখো সু, তিনদিন আগেও ওখানে শয়ে শয়ে ছিলো। তখন গুনতে গুনতে আমার মাথা ব্যথা করতো সু। আর এখন দেখো, সব শেষ। প্রায় সব শেষ। ওই, ওই। ওই যে। আরো একটা। পাঁচ। ওই দেখো। আরো তাড়াতাড়ি যেন কমে যাচ্ছে এখন।"
বন্ধুর এই হাহাকার কিছুই বোধগম্য হয়না সু'র। অবাক হয়েই প্রশ্ন করে, "কী গুনছ জন্সি? কী? পাঁচটা কী?"
কাঁপা কাঁপা স্বরে জন্সি বলে, "পাতা। ওই যে, সামনের গাছটা দেখছো, ওই যে। ওই গাছের পাতাগুলো ঝরতে ঝরতে এখন মোটে পাঁচে এসে ঠেকেছে। যেদিন শেষ পাতাটি ঝরে যাবে সু, সেদিনই, সেদিনই জেনো, আমিও মরে যাবো। ডাক্তার বলেনি তোমায়?"

সু'র ভিতরটা দুঃখে কেঁপে ওঠে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে পরম মমতাভরে জন্সির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, "ওসব যত বাজে কথা। ওরকম হয় নাকি জন্সি? তুমি ভুল জানো। তাছাড়া তুমি ওই গাছটাকে কত ভালোবাসো বলো তো? ওর সাথে তোমার আয়ু মোটেই জড়িত না। হতেই পারে না। তাছাড়া, সবচেয়ে বড় কথা। এই তো, একটু আগেই আমার ডাক্তারের সাথে কথা হলো। উনি বলেছেন। তোমার শরীর এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো আছে। উন্নতি হচ্ছে স্বাস্থ্যের। দেখো, দুর্বলতা তো এখনো রয়েছে। সেটা কাটালেই ব্যস, তুমি পুরো সুস্থ হয়ে উঠবে। নাও, এখন কিছু খাও দেখি। চাঙ্গা হতে হবে তো? তুমি খেয়ে নাও। তুমি খেয়ে নিলে আমি কাজ নিয়ে বসবো। আঁকা বাকি বেশ কিছু। দেখি, আঁকাগুলো বিক্রি করে তোমার জন্য কী কিনতে পারি।"

জন্সি অবুঝ বালিকার মতো উত্তর দেয়, "না সু। আমি কিচ্ছু খাবো না। আমার জন্য তোমায় কিছু কিনতেও হবে না। দেখো, ওই যে। আরো একটা পাতা ঝরে গেলো। আমি জানি। পরপর সব পাতা ঝরে যাবে। আজ রাতের মধ্যেই সব পাতা ঝরে গাছটা একদম ন্যাড়া হয়ে যাবে। আর কী, সব শেষ। আমিও চলে যাবো। আমারও আয়ু ফুরাবে।"

বন্ধুর এমন ব্যবহারে সু বিহ্বল হয়। কী বলবে ও? কীভাবে শান্ত করবে জন্সিকে? শেষ চেষ্টা করে। কাতরস্বরে বলে, "জন্সি, তুমি এখন একটু শুয়ে থাকো। চোখ বন্ধ করে থাকো। আর বাইরে তাকিয়ো না। দেখো, আমায় আজ রাতের মধ্যে এই কাজটা শেষ করতেই হবে। আলো লাগবে। তাই আর জানলাটা বন্ধ করতে পারছি না। কিন্তু তুমি বাইরে তাকিয়ো না। জন্সি, দোহাই তোমার, একটু ঘুমাও।"
জন্সি জিজ্ঞেস করে, "পাশের ঘরে গিয়ে কাজ করা যায় না?"
সু মাথা নাড়ে। বলে, "না জন্সি। আমি তোমার পাশে থাকতে চাই। আমি চাই না তুমি ওই পাতাগুলোর দিকে তাকাও।"
রোগে ক্লিষ্ট জন্সি অবোধ শিশুর মতোই অবুঝ।  বলে, "ঠিক আছে। আমি চোখ বন্ধ করে থাকছি। কিন্তু তুমি কথা দাও। কাজ শেষ করেই আমায় বলবে। আমি বাইরে তাকিয়ে থাকতে চাই। দেখতে চাই পাতাগুলো কীভাবে ঝরে পড়ে। আমার প্রাণও যে ওর সাথে জড়িয়ে আছে। ওই যে, ওই শেষ পাতাটার সাথেই দুলে দুলে পরম আনন্দে আমিও চলে যেতে চাই।"
"জন্সি, তুমি কথা বলো না। দোহাই। আমি আমার আঁকাটা শেষ করি। আজকের মধ্যে এটা করতেই হবে। আঁকায় একটি পুরুষ চরিত্র থাকবে। দেখি, তাকে মিস্টার বারম্যানের মতোই দেখতে আঁকবো। ওঁকে ডেকে আনি। আমি এই যাবো আর এই আসবো। তুমি কথা দাও, জন্সি, নড়াচড়া করবে না এর মধ্যে। কথা দাও ঘুমোবে?" 

বারম্যান ওদেরই বিল্ডিঙে থাকেন, ষাটোর্দ্ধ চিত্রশিল্পী। দীর্ঘ চল্লিশ বছরের ওপর উনি ছবি আঁকছেন। মনে সাধ, একদিন কোন দুর্দান্ত ছবি এঁকে বিশ্ববিখ্যাত হবেন। অবশ্য তাঁর আঁকার বিশেষ কদর শিল্পমহলে নেই। টাকার জন্য তাই মাঝেমাঝেই অন্য শিল্পীদের হয়ে মডেলের কাজও করে দেন। যা রোজগার, বেশিরভাগই উড়িয়ে দেন মদের নেশায়। তবুও এত কিছুর মধ্যেও সু আর জন্সির খোঁজখবর নেওয়া, ওদের সাহায্য করাটাকে নিজের পরম কর্তব্য বলেই মনে করেন বারম্যান।

বারম্যানের ঘরে পৌঁছে সু দেখলো, ঘর অন্ধকার। উনি চুপ করে বসে আছেন। ঘরভর্তি মদের গন্ধ। নির্ঘাত নেশা করে আছেন। সু এরই মধ্যে মনের দুঃখে জন্সির অসুখ, দেওয়ালের ধারের শুকনো গাছটার ঝরাপাতা, তার সাথে জন্সির নিজের আয়ুকে জুড়ে নেওয়ার কথা সব বলে ভেঙে পড়ে, "আমি আর পারছি না। কোনদিক যে সামলাই? আঁকাটাও শেষ করতে হবে। আপনি আসবেন মিস্টার বারম্যান? আমার মডেল হয়ে যান দয়া করে।" সব শুনে মিস্টার বারম্যান রাগে ফেটে পড়লেন। চেঁচিয়ে বললেন, "এমন অলুক্ষুণে কথা কে বলে? কে ঢোকাচ্ছে এইসব আবোল তাবোল কথা জন্সির মাথায়? মেয়েটা মরতে বসেছে আর তুমি আমায় বলছো বসে বসে এখন মডেল সেজে বসে থাকতে? যাবো না আমি। এ হয় না।" সু কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে, "দোহাই মিস্টার বারম্যান। এরকম বলবেন না। জন্সি দুর্বল। এই দুর্বল চিত্তে ওর মাথায় যত উদ্ভত খেয়াল হচ্ছে। এরই মধ্যে আপনিও সাহায্য না করলে আমি তবে কোথায় যাই?"

মিস্টার বারম্যান এবার শান্ত হয়ে বললেন, "দেখো সু। আমি আসছি। আমি কোথায় বললাম আমি যাবো না। শুধু জন্সি বেচারির জন্য মন কেমন করছে। ওইটুকু একটা মেয়ে, এমন অসুখে ভুগবে কেন? এখানে থাকাই উচিত না তোমাদের। আমাদের। দেখো, আমি একদিন একটা সাঙ্ঘাতিক কিছু ছবি আঁকবোই। বিখ্যাত হবোই। অনেক খ্যাতি হবে। হবে যশ। আর সেদিন তোমাদের নিয়ে আমি এই বাজে জায়গা থেকে চলে যাবো। অনেক দূরে। দেখো। নাও চলো দেখি, আঁকার জোগাড় করো। আমি আসছি।"

এরপর আর কোন কথা হয় না। দুজনে চুপচাপ নেমে আসে নীচে। জন্সির ঘরে। জন্সি তখন রোগক্লিষ্ট ঘুমে আচ্ছন্ন। পর্দা সরিয়ে জানলা ভেজিয়ে পাশের ঘরে আসে সু আর মিস্টার বারম্যান। সেই ঘরের জানলা দিয়ে দুজনে একবার বাইরে তাকায়। প্রবল ঝড় বইছে, সাথে বৃষ্টি। বৃষ্টির সাথে মাঝে মাঝে নরম বরফকুচি ঝরে পড়ছে। পাতাঝরা লতানে গাছটার দিকে তাকিয়ে দেখে দুজনে, একদৃষ্টে। কোন কথা বেরোয়না ওদের মুখ দিয়ে। তারপর চুপচাপ জায়গায় ফিরে আঁকা শুরু করে সু। প্রায় সারা রাত জেগে কাজটা শেষ করেছে ও। ভোরের দিকে ঘন্টাখানেকের জন্য একটু ঘুমিয়েও পড়েছিল সু। এইবার উঠে পাশের ঘরে যায়, ধীরপায়ে। দেখে, জন্সি জেগে শুয়ে আছে। ব্যাকুল দৃষ্টিতে জানলার পর্দার দিকে চেয়ে। সু'কে দেখে বলে, "পর্দাটা সরিয়ে দাও। আমি দেখতে চাই। আমি দেখতে চাই আমার গাছটাকে। দেখি, পাতাগুলো কেমন আছে।"

সু আস্তে আস্তে জানলা থেকে পর্দাটা সরিয়ে দেয়। চোখ যায় ন্যাড়া দেওয়ালের গায়ে লতানে গাছটার দিকে। সারা রাত ঝড় বৃষ্টি চলেছে।  তবুও, শেষ একটা পাতা এখনও টিকে আছে। শুকনো খয়েরি ডালের ভিতর থেকে। একটা সবুজ পাতা। ধারগুলো অবশ্য ইতিমধ্যেই হলুদ হতে শুরু করেছে। তবুও, একা লড়ে যাচ্ছে, প্রবলভাবে। একটা শেষ সবুজ পাতা। জন্সি দেখে অবাক হয়, বলে, "সারা রাত যা বৃষ্টি হলো, হাওয়া দিলো, আমি ভেবেছিলাম বুঝি... না। আজ আর পারবে না ও। আজ ও ঝরে পড়বেই। আর সাথে আমিও। দেখো সু।" সু ভেবে পায় না কী বলবে এর উত্তরে। যে কিনা নিজেই বাঁচবার শেষ ইচ্ছেটুকু বিসর্জন দিয়েছে, চলে যাওয়ার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হয়ে আছে, তাকে কীই বা বলে আটকানো যায়? সু অপারগ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে বন্ধুকে। অপলকে। ইচ্ছে করে বন্ধুত্বের দোহাই দেবে। কিন্তু জানে, তাতেও কাজ হবে না। যে জীবন থেকে সব মোহ ক্রমশ সরিয়ে ফেলছে, সেখানে বন্ধুত্বের দোহাই বা টিকবে কেন?

দিন কেটে যায়। রাত্রে আবার ঝড় ওঠে। বৃষ্টি। ঘুটঘুট্টে অন্ধকার। তারই মধ্যে ওরা দেখতে পায়, সেই শেষ সবুজ পাতাটা এখনও টিকে আছে। লড়ছে, প্রবল বিক্রমে, সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। একা। বীরদর্পে।

পরদিন সকালে আবার জন্সির আব্দারে জানলার পর্দা সরে যায় ঘরের। দুই বন্ধু দেখে অবাক হয়ে, সেই গতকালের শেষ সবুজ পাতাটা এখনও টিকে গেছে। খানিকক্ষণ সেদিকে দেখে এরপর সু চলে যায় রান্না করতে। জন্সির জন্য পথ্য রান্না করবে ও। জন্সি খানিক তাকিয়ে থাকে বাইরে, তারপর বন্ধুকে বলে, "সু, আমি অনেক ভাবলাম। এই যে পাতাটা টিকে গেলো, কেন জানো? কারণ ও কিছু বলতে চায় আমায়। আমায় বোঝাতে চায় যে এত সহজে হার মানলে চলবে না। আমায় লড়াই করতে হবে। আমি এ কদিন বড় ভুল করেছি, আর এমন করবো না। আমায় বাঁচতে হবে। নতুন উদ্যম নিয়ে। আগে দেখি, একটু আমায় আয়নাটা এনে দাও দেখি। একবার দেখি এ কদিনে কী অবস্থা হয়ে আছে আমার চেহারার।"
সু ওকে খাইয়ে নিজের কাজ করতে থাকে। জন্সি বসে থাকে বিছানার ধারে। কিছুক্ষণ পরে সুর দিকে তাকিয়ে বলে, "জানো সু, আমি একদিন ঠিক ইতালি যাবো। দেখো। বে অফ নেপলসের ছবি আমি আঁকবোই।" বন্ধুর কথা শুনে সু খুশী হয়। এই তো, এই তো ও আগামীর কথা ভাবছে। এই তো, ফিরছে। ওর জীবনীশক্তি ফিরছে। তাহলে হয়তো এ যাত্রায় বাঁচাতে পারলো বন্ধুকে।

বিকেলের দিকে ডাক্তার আসেন রুগীকে পরীক্ষা করতে। জন্সিকে দেখে পরীক্ষা নিরিক্ষা করে উনি আজ বেশ সন্তুষ্ট। সুকে বলেন, "তোমার বন্ধুর শারীরিক উন্নতি হয়েছে দেখছি। যত্ন ভালোই করেছো। চালিয়ে যাও। খাওয়া দাওয়া, বিশ্রাম আর যত্ন। এই তিনটিই মূল ওষুধ ওর। ভালো হয়ে যাবে ও। খুব শিগগিরই সুস্থ হয়ে উঠবে। আমি এখন যাই, ওদিকে ডাক পড়েছে। নতুন রুগী। বারম্যান নাম। মাইকের বয়স হয়েছে। মনে তো হচ্ছে নিউমোনিয়া। ওঁকে সারানো কঠিন। দেখি হাসপাতালে নিয়ে যাই যাতে যতটা কম কষ্ট পায় আর কী।"

পরের দিন আবার ডাক্তার ফিরে আসেন। জন্সির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখেন। তারপর খুশি হয়ে সু'কে বলেন, "তুমি বড় ভালো সেবা করেছো রুগীর। ও এখন অনেক ভালো আছে। চিন্তার আর কোন কারণ নেই। ঠিক করে খাওয়া দাওয়া করিয়ো। ব্যস। তাহলেই সব ঠিক। "

বেলার দিকে জন্সির কাছে এসে বসে সু। ওকে সস্নেহে জড়িয়ে ধরে বলে, "জন্সি, একটা খবর দেওয়ার ছিল।" জন্সি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় বন্ধুর দিকে। সু বলতে থাকে, "মিস্টার বারম্যান। মিস্টার বারম্যান আর নেই। আজকেই মৃত্যু হয়েছে ওঁর। হাসপাতালে। তবে একটাই ভালো কথা। উনি বেশি ভোগেননি। বেশি কষ্ট পাননি। দুদিনের কষ্ট। প্রথম দিন কেউ একজন ওঁকে নিজের ঘরে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখে ডাক্তার ডেকে দেন। ওঁর জামাকাপড় জুতো সব ভিজে। হিমশীতল। কে জানে কী করে? তারপর একটু এদিক ওদিক খুঁজতে গিয়ে অবশ্য নজরে আসে একটা আলো। বাইরে নিয়ে যাওয়ার আলো। হয়তো কোথাও বেরিয়েছিলেন। আর পাওয়া যায় কিছু আঁকার সরঞ্জাম। একটু হলুদ রঙ, একটু সবুজ রঙ তখনও লেগে আছে প্যালেটে।"

জন্সি থামিয়ে দেয় বন্ধুকে। বলে, "দেখো সু। জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখো। ওই গাছের শেষ পাতাটি দেখছো? দেখেছো কেমন এত ঝড় বৃষ্টিতেও ওটা অটুট আছে। এতটুকু নড়ে পর্যন্ত নি। এবার বুঝছি কেনো। ওই তো, ওই যে, ওইটাই সেদিন রাত্রে মিস্টার বারম্যান এঁকে গিয়েছেন। এতদিনে ওঁর মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে। দেখেছো কেমন অদ্ভুত সুন্দর ওই সৃষ্টিটি? এটাই মিস্টার বারম্যানের এঁকে যাওয়া শ্রেষ্ঠ শিল্প। ওঁর গুণের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। ওই শেষ সবুজ পাতাটা। শিল্পী মহলে দেখো, অমর হয়ে থাকবে। ওঁর শেষ শিল্প।"