Sunday, July 16, 2017

অন্তর জ্বলে রে জ্বলে



অফিস থেকে ফেরার পথে লেটার বক্সটা চেক করাটা অনেকদিনের অভ্যেস মিঠির। বছর পাঁচেক আগে অবধি অল্প বিস্তর চিঠি আসত, নিয়মিত না হলেও, অন্তত নিউ ইয়ার, ক্রিসমাসে, বিজয়ায় আত্মীয় স্বজনদের থেকে আসত। তার কারণ তখন অবশ্যই ওর শ্বশুর শাশুড়ি; এখন আর তাঁরা এখানে থাকেন না, তাই চিঠিপত্রের হিড়িক অনেক কম। আজকাল আবার চিঠি বলতে শুধুই ওই ব্যাঙ্কের স্টেটমেন্ট, ইলেক্ট্রিসিটির বিল আর কিছু বিজ্ঞাপনের কাগজ। বিল ও স্টেটমেন্ট অনলাইনে দেখে নেওয়া হয় বলে লেটার বক্সের কোন দরকারই নেই, তবুও মিঠি নিজের অভ্যেস থেকে সরতে পারে না। আর এই নিয়ে রোজ ওর পিছনে লাগে রাহুল। আজ লেটার বক্স হাতড়ে যখন একটা ঝলমলে নীল রঙের খাম পেল, আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় আর কি! ওর এতদিনের অভ্যেসের ফল মিলল তাহলে।

কোনমতে ঘরে ঢুকেই ঝটপট খামটা খুলে ফেলল মিঠি। কোনোদিনও ওর খুব একটা সূক্ষ্ম কারুকার্যে মনোযোগ ছিল না, ক্রাফটে তো একবার ফেল গ্রেড পেয়েছিল! তাই বেশ বিচ্ছিরি ভাবেই খামখানি ছিঁড়ে ভিতর থেকে চিঠিখানা বের করল। খামের কন্টেন্ট দেখে আনন্দে আত্মহারা হওয়ার জোগাড়। মাধ্যমিক ২০০৪ ব্যাচের প্রথম রিউনিয়নের নিমন্ত্রণ। ফেসবুকে ওদের একটা গ্রুপ আছে, সেখানে কিছুদিন ধরে এই নিয়ে নানান প্ল্যান চলছিল, খুব বেশী তাতে না থাকলেও খবর ঠিক রাখত মিঠি। রাহুল ফিরলে বলতেই হবে। এত আনন্দ হচ্ছে ভাবতে, কি করবে বুঝেই উঠছেনা। কতদিন পরে সব বন্ধু বান্ধবীদের সাথে দেখা হবে। আহা, সেই ছোট্টবেলাকার বন্ধুত্ব, কাজের চাপে একেক জন একেক জায়গায় থাকে বলে অনেকের সাথেই বহু বছর দেখা নেই। কিন্তু এই রিউনিয়নে অন্তত যদি ৫০ জন ও আসে, তাদের সাথে তো আবার সাক্ষাতটা ঝালাই হয়ে যাবে। টুক করে ওইয়াটসাপে ওদের এক বন্ধু বান্ধবীর গ্রুপে মেসেজ ছেড়ে দিল।

রাত্রে খাবার টেবিলে বসে রাহুল তো অবাক যখন পাতে দেখে রোজের কেনা রুটি আর চিকেন কারীর জায়গায় একেবারে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, ঘি, মুগের ডাল, আলু ভাজা আর চিংড়ি মাছের মালাইকারি।
- কি ব্যাপার? আজ এত এলাহি খাবার?
- এমনিই, ইচ্ছে হল। রেঁধে নিলাম।
- বাব্বা! সপ্তাহের মাঝখানে এরকম ইচ্ছে। লটারী টটারী জিতলে নাকি গো?
- বলতে পারো!
- রিয়েলি?
- হুম, তুমিও শুনলে বিশাল খুশী হবে।
- সাস্পেন্স থামাও প্লীজ মিঠি। কি হয়েছে সেটা বল।
- আজ লেটার বক্স থেকে একটা দারুন জিনিস পেয়েছি! তুমি চ্যালেঞ্জ হেরেছ, আমায় একটা সিল্ক এনে দেবে কাল। হ্যাঁ, যেটা বলার, চিঠি এসছে স্কুলের থেকে। আমাদের ব্যাচ রিউনিয়ন। আগামী শনিবার।
- তুমি যাবে নাকি?
- অফ কোর্স! তুমিও যাবে!!! স্পাউস নিয়ে যেতে বলেছে। ককটেল পার্টি।
- প্লীজ, তোমার ব্যাচের রিউনিয়নে গিয়ে আমি কি করব? তুমি যাও!
- প্লীজ রাহুল, চলো না!
- আহা আমি তো ওখানে কাউকেই প্রায় চিনব না, গিয়ে সাঙ্ঘাতিক বোরড হব।
- শোনো আমিও তোমার অফিস পার্টিগুলোতে কিন্তু যাই, কাউকে তেমন না চিনলেও দাঁত ঠিক কেলিয়ে দিই। তুমিও সেরকম করো।
- মিঠি প্লীজ, নেক্সট উইকেন্ডে আমার অন্য প্ল্যান। স্পোর্টস বারে গিয়ে ম্যাচ দেখার প্ল্যান আছে আশিসদের সাথে। বিসাইডস সেই পারুর বিয়েতে গিয়ে কি বোরিং কেটেছিল। বাপ রে। তুমি নিজের বন্ধুদের নিয়ে ছিলে আর আমায় ভিড়িয়ে দিয়েছিলে ওই কার একটা বরের সাথে। কি বোর পাব্লিক ছিল মাই গড!
- সত্যিই রাহুল। তোমায় আর কি বলব বল। একবার যখন ঠিক করে ফেলেছ, আর কি বলি বল? আমি এত করে বললাম, তাও আসবে না। সবাই বর বৌ নিয়ে আসবে।
- প্লীজ।
- কিন্তু আমি যাব, এই বলে দিলাম।
- হ্যাঁ যাও। আনন্দ করো। আমি বারণ করছি না তো!
- আর এমন কিছু দুরেও না, গাড়িটা আমি নিয়ে বেরবো।
- হুম ঠিক আছে।
- উফ, ভাবতেই কি আনন্দ হচ্ছে। ফাইনালি ফেসবুক গ্রুপ্টা একটা কাজের কাজ করল!
- হুম।
- কি তখন থেকে হুম হুম করে যাচ্ছ?
- হুম।
- ধ্যাত! কোন কথাই কানে যাচ্ছেনা। দেখো বসে অর্ণব গোস্বামীর চেঁচামিচি। হুহ। আমি পারুকে কল করি। প্ল্যান বানাই।
- হুম।

- হ্যালো পারু?
-
- হ্যাঁ রে, আমি আজই চিঠিটা পেলাম।
-
- সত্যি রে, কি এক্সাইটেড লাগছে। কে কে আসছে জানিস?
-
- শেলী আর মণীষা? ওরা কোথায়?
-
- ও। শেলীর খবর নিশ্চয়ই অনিরুদ্ধ জানবে? হিহি!
-
- সেই সেই, অনির বিয়ে হয়ে গেল তো। ও কি আর খোঁজ রাখবে!
-
- ছেলেরা কে কে আসছে?
-
- নির্মাল্য মানে যে ওই ক্লাস এইটে তোকে প্রেমপত্র দিয়েছিল?
-
- এখনো তোর সাথে যোগাযোগ আছে নাকি? রণদা জানে?
-
-রাহুল যদি জানত যে আমার সব এডমায়রাররা আসছে, নির্ঘাত অস্থির হয়ে যাবে!!!!
-
- না রে, ও আসবে না। ওর বন্ধুদের সাথে নাকি প্ল্যান করা আছে।
-
- আরে একদিক দিয়ে ভালোই হল। ও থাকলে মন খুলে ফ্লারট করতে পারতাম না! হি হি!
-
- ওমা। রজত বেচারাটা নেহাত সাহস জুটিয়ে আমায় লাভ লেটারটা দিতে পারল না। হেমার কাছে পরে শুনে মনে আছে হেসে কুটিপাটি আমরা! ও যদি সেদিন আমায় প্রোপোজ করত, আমি ভেবে দেখতাম ঠিক।
-
- তা বলে কি হবে। না হয় আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ওর তো আর হয়নি। আর হলেই বা। জানিস এখনো ওর প্রোফাইল স্টক করি ফেসবুকে, হেবি স্মার্ট দেখতে হয়েছে। হিল্লি দিল্লি করে বেড়ায়। এক দুটো ডান্স না হয় করব ওর সাথে।
-
- ধুর, রাহুল পাশেই আছে। কিন্তু এত জোরে টিভি দেখছে, কিচ্ছু শুনতেই পাচ্ছেনা!!
-
- ওরা যখন কলিগদের সুন্দরী বৌদের সাথে ঢং করে বেড়াবে? সে বেলা? আমরা একটু পুরনো ক্লাসমেটদের সাথে না হয় হাল্কা মস্করা হাসি ঠাট্টা করব। তাতেই ওমনি দোষ?
-
- এই স্যামুয়েল আসবে রে?
-
- আরে স্যামুয়েল রে। ওই যে সি সেকশনের টিমে ক্রিকেট খেলত। ব্রাউন চুল, নীল চোখ।
-
- হ্যাঁ হ্যাঁ। সেই ছেলেটা। ক্লাস সেভেনে আমার পাশে বসেছিল পিকনিক বাসে বলে টেনের দিদিগুলোর কি হিংসা!
-
- মজা হবে কিন্তু। ওই বয়সে যাদের থেকে চোখ ফেরাতে পারতাম না, তাদের আবার দেখব।
-
-যাক গে, সেসব ছাড়। বলছি কাল একবার সন্ধ্যেবেলা কোয়েস্টে যাবি? ড্রেস আর ম্যাচিং জুতো কিনতাম।
-
- অবশ্যই! যোগা করে শরীরটা কে মেন্টেন করেছি এত সুন্দর, একটু ফ্ল্যাটারিং ড্রেস না পড়লে হয় নাকি? হেব্বি সেজেগুজে যাব দেখিস।
-
- মনে আছে স্কুলে কিরকম কালার ড্রেস হলে আমরা সব প্ল্যান করে কালার ম্যাচ করে সাজতাম? ঠিক সেই রকম করব। দাঁড়া, আমি কাজরীকে মেসেজ করি। নিয়ে কাল বা পরশু চল একসাথে শপিঙে যাই।
-
- চল, তাহলে দেখা হচ্ছে শিগগিরি। বাই।

- বাব্বাহ, হল তোমার ফোন পর্ব!
- হুম।
- কত বকে যেতে পারো।
- তুমি বুঝি কান পেতে শুনছিলে?
- আমি শুনতে যাব কেন? জাস্ট অনেকক্ষণ ধরে কানে শব্দ আসছিল তো। তাই।
- বুঝলাম।

***********************************************************************

সারা সপ্তাহ মিঠি আর ওর বান্ধবীর প্রচুর দোকান বাজার করল। পছন্দসই ড্রেস, ম্যাচিং জুতো, ব্যাগ আর গয়না সবই হল। শনিবার সকাল থেকেই একটা উত্তেজনা। অবশেষে ডি ডে এসেছে। পার্লারের মেয়েটা এসে চুল সেট করে দিয়ে বেরিয়ে যেতে মিঠি নিজের ঘরে ঢুকতে যাচ্ছে ড্রেস চেঞ্জ করতে, এমন সময় রাহুলের হাঁকডাক।

- মিঠি আমার সুটটা কোথায়?
- কোন সুট?
- আরে যেটা জন্মদিনে তুমি গিফট করলে।
- ওটা তোমার আলমারিতেই আছে। একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখো।
- পাচ্ছি না। প্লীজ একটু খুঁজে দিয়ে যাও।
- উফ আমার দেরী হয়ে যাবে। এখন ওটা দিয়ে কি করবে?
- ওটাই পরব তো।
- বল কি? স্পোর্টস বারে সুটেড বুটেড হয়ে যাবে??
- ওখানে যাচ্ছিনা তো।
- তাহলে কোথায় যাবে?
- তোমার সাথে, রিউনিয়নে।
- এ?? আর তোমার প্ল্যান?
- ক্যান্সেল করে দিয়েছি।
- কেন? কি কান্ড!
- ভেবে দেখলাম। এই বয়েসে বন্ধুরা গেলেও নতুন বন্ধু জুটে যাবে। কিন্তু যা চেহারা হয়েছে, বৌ গেলে আর নতুন করে মেয়ে পটানো মুস্কিল হয়ে যাবে। যে পার্টিতে বউয়ের এত এডমায়রার ঘুর ঘুর করবে, সেখানে না যাওয়াটা ভারী বোকামো!
- যাক! পারুর সাথে ফোন কলটা তাহলে কাজে দিল!!!

********************************************************

No comments:

Post a Comment