সারাদিনের জন্য তৈরি হতে, সমস্ত রকম বাধা বিপত্তির মোকাবিলা করতে দিনের শুরুটা খুব সুখকর হওয়াটা প্রয়োজন, দেয়া এটা খুব বিশ্বাস করে। তাই ওর একান্তই নিজের সময় বলতে এই জিম ও সুইমিঙের সময়টুকু ওর কাছে খুব মুল্যবান। কানে পছন্দের গান লাগিয়ে ছুটতে ছুটতে চলে নিজের সাথে নিজের কথোপকথন, একটু ফেসবুক আর whatsapp। আজও তার ব্যাতিক্রম নয়।
পাঁচ মিনিট; ০.৫ কিঃমিঃ। কানে চলছে শানায়া টোয়েনের গান।
রাহুলের মেসেজ ঢুকল whatsappএ।
- আমি বেরোচ্ছি আধ ঘন্টা পরে। দিল্লিতে একটা মিটিং আছে জরুরী। পরশু রাত্রে ফিরব।
ভুরুটা একটু কুঁচকল বটে দেয়ার।
- কবে ঠিক হল? আমায় আগে জানাওনি তো?
- কালই। যতক্ষণে ফিরেছি তুমি ততক্ষণে শুয়ে পড়েছিলে, তাই আর জাগাইনি।
- ঠিক আছে।
মনে পড়ে গেল বছর চারেক আগের কথা, তখন সদ্য বিয়ে হয়েছে। রাহুলের অফিসের কাজের জন্য হঠাৎ করে বম্বে যেতে হত, দিনটা ছিল দেয়ার জন্মদিন। কত বুঝিয়ে শুনিয়ে দেয়াকে রাহুলকে পাঠাতে হয়েছিল, সে তো প্রায় চাকরীতে রেসিগনেশন দিতে পারলে বাঁচে এমন অবস্থা, কি না কেন বউয়ের জন্মদিনে সাথে থাকতে পারবেনা। তারপরে, ওদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে দেয়ার একটা অফিস ট্যুর পড়েছিল চেন্নাইতে। রাহুল নিজের বিজি শিডিউল থেকে সময় বের করে সাথে গিয়েছিল দেয়ার, যাতে একসাথে এনিভারসারিটা কাটাতে পারে। আর এখন চার বছরেই এরকম দাঁড়িয়েছে যে এয়ারপোর্ট যাওয়ার আধ ঘন্টা আগে একে অপরে জানছে ট্যুর প্ল্যান। নিজের অজান্তেই একটা হাল্কা দীর্ঘশ্বাস পড়ল।
দশ মিনিটঃ ১.১ কিঃ মিঃ
ওদের স্কুল গ্রুপের চ্যাটে নজর পড়তে দেখল, রত্নাবলী পোস্ট করেছে ওর বেরানোর ছবি। ও আর ওর বর ঘুরে এল অরুণাচল থেকে। ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যায় কতটা আনন্দ করেছে। ওরাও তো দুজনেই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করে, অথচ একসাথে সময় কাটাতে পারে দিব্যি। মনে পড়ে গেল, শেষ বোধহয় দেড় বছর আগে একসাথে ঘুরতে গিয়েছিল, তাও মোটে সপ্তাহখানেকের ছুটি ম্যানেজ হয়েছিল। এদিকে ব্যাঙ্গালোরে পড়াকালীন ওই অত লেখাপড়ার চাপের মধ্যেও দুজনে একসাথে বা বন্ধুবান্ধব্দের পুরো বড় দল মিলে কত ঘুরে বেরিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সেই বন্ধুদের গ্রুপ এখনো বেরাতে যায়, বাদ পড়ে যায় শুধু দেয়া আর রাহুল।
পনেরো মিনিটঃ ১.৮ কিঃ মিঃ
ঘাম মুছে ফেসবুকটা খুলল। হাবিজাবি পোস্টের ভিড়ে যখন হারিয়ে গিয়েছে, হঠাৎ একটা নোটিফিকেশন এল। " Byomkesh Bakshi wants to connect with you", ব্যোমকেশ বক্সী নামটা দেখে খুব কৌতূহল হল। ক্লিক করতে দেখল একটা মেসেজ।
- আমার সাথে পরকীয়া করবেন?
এরকম একটা অদ্ভুত মেসেজ দেখে খুবই অবাক হল দেয়া। এ আবার কিরকম উৎকট মেসেজ। কে এই পাব্লিক, করে কি, জানবার খুবই ইচ্ছে হল। দেখল মোটামুটি ফেক প্রোফাইল। ডিস্প্লে পিচারে আবীর চট্টোপাধ্যায়ের ছবি, ফ্রেন্ড লিস্টে গোটা দশেক ব্যাক্তি, প্রত্যেকের প্রোফাইলই এরকমই, ফেক, দেখেই বোঝা যায়। ছবি বলতে ব্যোমকেশের সিনেমার কিছু পোস্টার। পাত্তা দিয়ে কাজ নেই ঠিক করে মেসেজটি ডিলিট করল। হাতঘড়িতে সময় দেখে একবার ভাবল একদিন জিম বাদ দিয়ে টুক করে রাহুল কে সি-অফ করে আসবে কি না। পর মুহূর্তেই নিজেকে থামাল দেয়া। রাহুল কি আদৌ চায় যে ও যাক? আদৌ কি এক্সপেক্ট করে? করলে কি আগের মত ওর কাছে আবদার করত না ব্যাগ গুছিয়ে দেওয়ার জন্য? সেইবারে রাহুল আর সৌরভ যখন এডিনবরা যায় একটা কনফারেন্সে পেপার প্রেজেন্ট করতে, দেয়ার ভিসা কোন কারণে আটকে যাওয়ায় ওর যাওয়াটা ক্যান্সেল হল, মনে আছে রাহুল কত চেষ্টা করেছিল ওর মুড ঠিক করতে। বেরনোর তিনদিন আগে দেয়াকে নিজের রুমে ডাকে।
- এই আমার লাগেজ প্যাক করে দাও।
- পারব না।
- প্লীজ দেয়া রানী।
- না পারব না বলেছি তো। যে যাচ্ছে তার লাগেজ সে নিজে প্যাক করবে।
- ছায়া ঘনাইছে বনে বনে। গগনে গগনে ডাকে দেয়া।
রাহুলের হেঁড়ে গলায় এই গান শুনে আর দেয়া না হেসে পারেনি। প্রথম যখন দেয়া নিজের পরিচয় দিয়েছিল ক্লাসে, তখন দেয়া শব্দের মানে বোঝাতে উদাহরণ দিতে এই গানটি গেয়েছিল। রাহুল পরে স্বীকার করেছিল যে ওই মধুর কণ্ঠে গান শুনেই সে একেবারে ফ্ল্যাট হয়ে যায়। আর তাই মান অভিমান পর্বে এই গানটি খুব কাজে দিত। আজকাল আর গানটার কোনরকম প্রয়োজন পড়েনা। দুজনের মধ্যে কথাবার্তাই বা হয় কতটুকু। কথা হলে তো ঝগড়া বিবাদ মান অভিমানের প্রশ্ন উঠবে। এয়ারপোর্ট যাওয়ার ইচ্ছেটা কে স্থগিত রেখে নিজের নিত্যনৈমিত্তিক রুটিন মাফিক ট্রেডমিলের পর্ব চলতে থাকে। পঁচিশ মিনিটে ২.৬ কিঃ মিঃ দৌড়ে থামে।
দেয়া অফিস পৌঁছল নটা নাগাদ। লিফটে ঢুকতে যাচ্ছে, আবার মেসেঞ্জারে মেসেজ। সেই ব্যোমকেশ বক্সী।
- কি ম্যাডাম, পরকীয়াটা করুন না আমার সাথে।
কি অদ্ভুত রকমের নাছোড়বান্দা রে বাবা। কলেজ লাইফের কিছু বন্ধুদের কথা মনে পড়ে গেল। মেয়ে পটাতে তারা এরকম ছিনে জোঁকের মত লেপ্টে থাকত, কেউ কেউ ফল পেলেও বেশিরভাগই ফেল করত। এও নির্ঘাত কোন টিনেজার হবে, দেয়ার প্রোফাইল পিচার দেখে এই ধরণের অনেক মেসেজ পায় নিয়মিত, তবে এই প্রথম এত কম সময়ের ব্যাবধানে একই লোকের থেকে এরকম মেসেজ। যাক গে, প্রতিবারের মতই এবারেও দেয়া কোন উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। সোমবার, অফিসে সাঙ্ঘাতিক কাজের চাপ থাকে। নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ থাকেনা, সেখানে এসব টুকরো টাকরা মেসেজে কি বা এসে যায়।
কাজ করতে করতে হঠাৎ খেয়াল পরে যে একটা বেজে গিয়েছে। ক্যাফেটেরিয়াতে লাঞ্চ করতে যেতে যেতে ভাবল, এতক্ষনে নিশ্চয়ই রাহুল ল্যান্ড করে গিয়েছে। একবার কল করে দেখা যায় ভেবে ফোন বের করল। স্পীড ডায়ালে রাহুলের নম্বর প্রথমেই থাকে। অন্য প্রান্তে কল দুইবার রিং হয়ে কেটে গেল। তারপরে ছোট একটা মেসেজ এল, " Busy. Will call later. Love." পর মুহূর্তেই আবার মেসেঞ্জারে বক্সী বাবুর মেসেজ, " ম্যাডাম ভেবে দেখলেন?" সত্যি বাপু, এত টেনাসিটি? উত্তর না পেয়েও তিন বার এর মধ্যেই মেসেজ? ব্লক করবে নাকি? না থাক, দেখাই যাক না কত পেশেন্স, সাধারণত দুই একদিনের বেশী এরা চালায় না।
পরের দিন সুইমিং থেকে ফিরে এসে দেয়া দেখল রাহুল সবে ফিরেছে। এক ছুট্টে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল I missed you।
- আমিও।
- অফিস যাবে তো?
- হ্যাঁ। শোনো আজ ডিনারে যাবে একসাথে? কতদিন বেরোইনা।
- নিশ্চয়ই।
এই তো, আগের মতই যেন সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। ওরা একসাথে খেতে যাবে। গল্প করবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।
বিকেল সাড়ে চারটে বাজতে মেসেঞ্জারে ব্যোমকেশ বক্সীর মেসেজ ঢুকল।
- আমি এই বেরোচ্ছি। একটা নীল ফুল স্লীভ শার্ট পরেছি, সি সি ডির সামনে দাঁড়াব। আপনি চলে আসুন।
- শুনুন, আমি পরকীয়া করব না। বন্ধুত্বও করতে চাই না। আমি আসব না। মাফ করবেন।
- প্লীজ, একবার আসুন। কথা দিচ্ছি, আর এরকম ডাকব না। আপনাকে একটা জিনিস দেওয়ার ছিল।
- সরি, আমি যাব না।
- প্লীজ...
যাব না যাব না করেও কি যে হল, দেয়া ঠিক গেল। পাঁচটা বেজে পাঁচ মিনিটে পৌঁছল সি সি ডির সামনে। দেখল ওর দিকে পিঠ করে এক ভদ্রলোক একটা আকাশী নীল রঙের ফুল হাতা শার্ট পরে দাঁড়িয়ে। হাতে তার একটি ব্রাউন পেপারের ব্যাগ। পিছন দিক থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে দেয়া বলে উঠল
- এসছি রাহুল। Oops, মিঃ বক্সী। এবার বল কি দেবে?
- সে দিচ্ছি। কিন্তু আগে বল তুমি কি করে বুঝলে?
- কি?
- যে আমিই ব্যোমকেশ?
- স্যার, মেয়েদের সিক্সথ সেন্সটি খুবই ভালো কাজ করে। ব্যোমকেশ বক্সী, কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ আওড়ানো; ছয় বছরের পরিচিতিটা নেহাত কম না তোমাকে, তোমার কথা বলার ভঙ্গি, তোমার আচরণের মানে বুঝবার।
- I am impressed!
- You ought too! I am, after all, the perfect Satyabati to your Byomkesh.
- এবারে গিফট টা নাও। অনেক খুঁজে খুঁজে রেড ফোরটের এই রেপ্লিকাটা পছন্দ করে আনলাম। প্রপোজের স্থানটিকে memorable করে রাখলাম। Happy anniversary sweetheart.
- ডিনারটা কোথায় হচ্ছে তাহলে? বেঞ্জারং চলবে?
- দৌড়বে।
- চল আগে কফিটা খেয়ে আসি। খুব তেষ্টা পেয়েছে।
- এই আমার লাগেজ প্যাক করে দাও।
- পারব না।
- প্লীজ দেয়া রানী।
- না পারব না বলেছি তো। যে যাচ্ছে তার লাগেজ সে নিজে প্যাক করবে।
- ছায়া ঘনাইছে বনে বনে। গগনে গগনে ডাকে দেয়া।
রাহুলের হেঁড়ে গলায় এই গান শুনে আর দেয়া না হেসে পারেনি। প্রথম যখন দেয়া নিজের পরিচয় দিয়েছিল ক্লাসে, তখন দেয়া শব্দের মানে বোঝাতে উদাহরণ দিতে এই গানটি গেয়েছিল। রাহুল পরে স্বীকার করেছিল যে ওই মধুর কণ্ঠে গান শুনেই সে একেবারে ফ্ল্যাট হয়ে যায়। আর তাই মান অভিমান পর্বে এই গানটি খুব কাজে দিত। আজকাল আর গানটার কোনরকম প্রয়োজন পড়েনা। দুজনের মধ্যে কথাবার্তাই বা হয় কতটুকু। কথা হলে তো ঝগড়া বিবাদ মান অভিমানের প্রশ্ন উঠবে। এয়ারপোর্ট যাওয়ার ইচ্ছেটা কে স্থগিত রেখে নিজের নিত্যনৈমিত্তিক রুটিন মাফিক ট্রেডমিলের পর্ব চলতে থাকে। পঁচিশ মিনিটে ২.৬ কিঃ মিঃ দৌড়ে থামে।
দেয়া অফিস পৌঁছল নটা নাগাদ। লিফটে ঢুকতে যাচ্ছে, আবার মেসেঞ্জারে মেসেজ। সেই ব্যোমকেশ বক্সী।
- কি ম্যাডাম, পরকীয়াটা করুন না আমার সাথে।
কি অদ্ভুত রকমের নাছোড়বান্দা রে বাবা। কলেজ লাইফের কিছু বন্ধুদের কথা মনে পড়ে গেল। মেয়ে পটাতে তারা এরকম ছিনে জোঁকের মত লেপ্টে থাকত, কেউ কেউ ফল পেলেও বেশিরভাগই ফেল করত। এও নির্ঘাত কোন টিনেজার হবে, দেয়ার প্রোফাইল পিচার দেখে এই ধরণের অনেক মেসেজ পায় নিয়মিত, তবে এই প্রথম এত কম সময়ের ব্যাবধানে একই লোকের থেকে এরকম মেসেজ। যাক গে, প্রতিবারের মতই এবারেও দেয়া কোন উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। সোমবার, অফিসে সাঙ্ঘাতিক কাজের চাপ থাকে। নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ থাকেনা, সেখানে এসব টুকরো টাকরা মেসেজে কি বা এসে যায়।
কাজ করতে করতে হঠাৎ খেয়াল পরে যে একটা বেজে গিয়েছে। ক্যাফেটেরিয়াতে লাঞ্চ করতে যেতে যেতে ভাবল, এতক্ষনে নিশ্চয়ই রাহুল ল্যান্ড করে গিয়েছে। একবার কল করে দেখা যায় ভেবে ফোন বের করল। স্পীড ডায়ালে রাহুলের নম্বর প্রথমেই থাকে। অন্য প্রান্তে কল দুইবার রিং হয়ে কেটে গেল। তারপরে ছোট একটা মেসেজ এল, " Busy. Will call later. Love." পর মুহূর্তেই আবার মেসেঞ্জারে বক্সী বাবুর মেসেজ, " ম্যাডাম ভেবে দেখলেন?" সত্যি বাপু, এত টেনাসিটি? উত্তর না পেয়েও তিন বার এর মধ্যেই মেসেজ? ব্লক করবে নাকি? না থাক, দেখাই যাক না কত পেশেন্স, সাধারণত দুই একদিনের বেশী এরা চালায় না।
সন্ধ্যেবেলা দেয়া ফিরল বাড়ি, তখনো রাহুলের ফোন আসেনি। ফেরার পথে গাড়ি থেকে একবার কল করার চেষ্টা করেছিল বটে, একই উত্তর এল। ব্যাস্ত। নটা নাগাদ ডিনার করতে বসেছে যেই, রাহুলের ffফোন এল।
- হ্যাঁ শোনো, খুব ব্যাস্ত আছি। এখনও মিটিং চলছে। মাঝে একবার বেরিয়ে এসে ফোন করে নিলাম। সব ঠিক আছে তো?
- হুম, ফ্লাইট ঠিক ছিল?
- হ্যাঁ।
- আমি এক্সপেক্ট করেছিলাম তুমি নেমে জানাবে।
- খুব খুব ব্যাস্ত দেয়া, পরে কথা বলি?
- ঠিক আছে।
- গুড নাইট।
- খেয়ে নিয়ো ঠিক করে...
ততক্ষণে ওদিক থেকে কল কেটে গিয়েছে।
এরকম করে কি ভাবে চলে? এইটা কোন সম্পর্ক হচ্ছে? এ কিরকমের দাম্পত্য? ওরাই তো একমাত্র এম এন সি কাপল না, তাহলে... ফোন নিয়ে খুটুর খুটুর করতে করতে কৌতুহলবশত ব্যোমকেশ বক্সীর প্রোফাইলে চোখ চলে গেল। দেখল খানিক আগে একটা স্টেটাস দিয়েছে।
"ছায়া ঘনাইছে বনে বনে।
গগনে গগনে বাজে দেয়া।"
সাথে রয়েছে কোন এক শহরের স্কাইলাইন, আকাশে ঘন কালো মেঘ।
এত প্রিয় গানের এরকম বিতিকিচ্ছিরি বিক্রিতি দেখে খুব অপছন্দ হল। সটান মেসেজ করল।
- এই যে শুনুন, ওটা বাজে নয়, ডাকে হবে। দেয়া মানে জানেন? মেঘ।
- ও সরি সরি। মাই মিস্টেক, ক্ষমা করবেন। দেয়ার মানে জানি। অনেকদিন আগে এই গানটি শুনে মানে জেনেছিলাম।
- হুম।
- তা কি ভাবলেন? করবেন আমার সাথে পরকীয়া?
- আপনি আচ্ছা বিটকেল মানুষ তো? সকাল থেকে শুরু করেছেন এই পরকীয়া পরকীয়া।
- আহা বলুনই না। করবেন?
- কেন করব বলুন? আমার জীবনে কিসের অভাব?
- প্রেমের অভাব। Attentionএর অভাব।
- বাজে কথা বলবেন না। বড্ড বেশী জেনে রয়েছেন।
- ভুলে যাবেন না ম্যাডাম, আমার নাম ব্যোমকেশ বক্সী, আমি সব খবর রাখি।
- আপনার সাহস তো কম না, সমানে বাজে বকে চলেছেন।
- শুনুন, আমি জানি, আপনি খুব একলা ফীল করছেন। আকাশের মুখ এমনিই ভার হয়ে আছে। আর প্লীজ বাড়াবেন না। একটু নিজের নামের সার্থকতা রক্ষা করুন?
তিতি বিরক্ত হয়ে আর রিপ্লাই করলনা দেয়া। সারাদিনের ব্যাস্ততা আর রাহুলের থেকে একটু আগে এরকম ঠাণ্ডা ব্যবহার পেয়ে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল। সি ডি প্লেয়ারে বেজে চলেছে শ্রী রামকৃষ্ণ আরাত্রিক মন্ত্র, মন অশান্ত হলে এর চেয়ে ভালো টোটকা আর কিচ্ছু কাজ করেনা দেয়ার, সেই ছেলেবেলা থেকেই। ছোটবেলায় স্কুলে বোকা খেলে, বাড়িতে মা বাবার কাছে বকুনি খেলে ঠাম্মির কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকত; ঠাম্মি চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে গেয়ে চলত "খণ্ডন ভব বন্ধন জগ বন্দন বন্দি তোমায়।" শুনতে শুনতে কখন যে ছোট্ট দেয়া সব রাগ দুঃখও ভুলে ঘুমিয়ে পড়ত...
পরের দিন জিমে গিয়ে যথারীতি ট্রেডমিলে দৌড়তে দৌড়তে ফেসবুক চেক করতে করতে মেসেজ এল শ্রী বক্সীর।
- গুড মর্নিং ম্যাডাম। ঘুম ভালো হল?
কোন উত্তর দিল না দেয়া।
- আমার মুক্তি জানেন তো, আলোয় আলোয় না। আপনার হাসিতে। প্লীজ হাসুন, আপনাকে গম্ভীর মুখে দেখলে খুব মন কেমন করে।
- আমি হাসছি না গম্ভীর হয়ে আছি, কি করে জানলেন?
- আমি অন্তর্যামী। সব টের পেয়ে যাই।
- তাই বুঝি?
- হ্যাঁ, আবার কি? এই যে আমার মেসেজটি পড়তে পড়তে কিন্তু আপনার মুখে একটা হাল্কা হাসি এসছে, আমি পরিষ্কার দেখছি।
- আপনি কি আমায় স্টক করছেন নাকি?
- না না, স্টক করছিনা।
- সেই চেষ্টাও করবেন না। বুঝেছেন?
- বুঝলাম। কিন্তু ম্যাডাম... আমার প্রশ্নের উত্তরটা?
- না। করব না।
- আমার সাথে অন্তত বন্ধুত্ব করুন?
- ভেবে দেখব।
সারাদিন রাহুলের থেকে ফোন পায়নি। মাঝে একবার মেসেজ এসছিল, সব ঠিকঠাক জানাতে ও জানতে চেয়ে। অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকায় ফেসবুক খোলেনি আর দেয়া আজ গোটা দিন। রাত্রে খেতে বসে অনলাইন হতে বক্সীর মেসেজ।
- দিন কেমন কাটল?
- আচ্ছা আমি তো আপনাকে চিনিও না, জানিও না। কেন বলুন তো আপনি এত মেসেজ করে যাচ্ছেন?
- আপনাকে তো বললাম বন্ধুত্ব করি।
- পারলাম না। এরকম অচেনা লোকজনের সাথে আমি বন্ধুত্ব করিনা।
- ম্যাডাম সকলেই প্রথমে অচেনা থাকে, তারপরেই কিনা মিতা হয়ে যায়। কিছু কিছু ভাগ্যবান রা আবার তার মধ্যে থেকে একে অপরের সাথে প্রাণ বেঁধে ফেলেন।
- আপনি অত্যন্ত প্রগল্ভ।
- কি করি? আমি যে কথার ব্যাপারী।
- আমি ঘুমোতে গেলাম।
- দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা পরবেন এবারে?
- সত্যি মশাই, আপনার ধৈর্য আছে বটে।
- ব্যোমকেশ বক্সী কি অত সহজে হাল ছাড়ে? ছাড়লে চলে নাকি?
- উফ।
- তা বলছি, চলুন না। একবার দেখা করি?
- দেখা করতে যাব কেন?
- প্লীজ? আপনি সত্যি করে বলুন তো, আমি কে, কি বৃত্তান্ত জানবার একটুও ইচ্ছে করছেনা?
- বয়ে গেছে। আমি তো জানি আপনি কে?
- কে বলুন?
- কে আবার। কোন ডেস্পারেট জবলেস টিনেজার।
- মোটেই না।
- বললেই হল? আমি সব জানি। হুহ।
- তাহলে কাল বিকেলে আপনার অফিসের কাছের সি সি ডি তে প্লীজ কফি খেতে আসুন? পাঁচটা নাগাদ। আপনার তো তখন কফি তেষ্টা পায়ই।
- বাব্বাহ! এও জানেন? নাহ, আপনাকে সামনা সামনি দেখতেই হচ্ছে। এত খবর জেনে গিয়েছেন আমার ব্যাপারে। আর কি কি জানেন, একটু সরেজমিনে দেখে আসতে হচ্ছে। ঠিক আছে, যাব।
সারা রাত ছটফট করে কাটল। এ কি করছে, এরকম ছেলেমানুষি করছে কেন ও? তাহলে কি সত্যিই ও এতটা একাকীত্বে ভুগছে যে এরকম যে কেউ দুদিন দুটো মিষ্টি করে কথা বলল আর ওমনি ও ছুটে যাবে দেখা করতে তার সাথে?
পরের দিন সুইমিং থেকে ফিরে এসে দেয়া দেখল রাহুল সবে ফিরেছে। এক ছুট্টে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল I missed you।
- আমিও।
- অফিস যাবে তো?
- হ্যাঁ। শোনো আজ ডিনারে যাবে একসাথে? কতদিন বেরোইনা।
- নিশ্চয়ই।
এই তো, আগের মতই যেন সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। ওরা একসাথে খেতে যাবে। গল্প করবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।
বিকেল সাড়ে চারটে বাজতে মেসেঞ্জারে ব্যোমকেশ বক্সীর মেসেজ ঢুকল।
- আমি এই বেরোচ্ছি। একটা নীল ফুল স্লীভ শার্ট পরেছি, সি সি ডির সামনে দাঁড়াব। আপনি চলে আসুন।
- শুনুন, আমি পরকীয়া করব না। বন্ধুত্বও করতে চাই না। আমি আসব না। মাফ করবেন।
- প্লীজ, একবার আসুন। কথা দিচ্ছি, আর এরকম ডাকব না। আপনাকে একটা জিনিস দেওয়ার ছিল।
- সরি, আমি যাব না।
- প্লীজ...
যাব না যাব না করেও কি যে হল, দেয়া ঠিক গেল। পাঁচটা বেজে পাঁচ মিনিটে পৌঁছল সি সি ডির সামনে। দেখল ওর দিকে পিঠ করে এক ভদ্রলোক একটা আকাশী নীল রঙের ফুল হাতা শার্ট পরে দাঁড়িয়ে। হাতে তার একটি ব্রাউন পেপারের ব্যাগ। পিছন দিক থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে দেয়া বলে উঠল
- এসছি রাহুল। Oops, মিঃ বক্সী। এবার বল কি দেবে?
- সে দিচ্ছি। কিন্তু আগে বল তুমি কি করে বুঝলে?
- কি?
- যে আমিই ব্যোমকেশ?
- স্যার, মেয়েদের সিক্সথ সেন্সটি খুবই ভালো কাজ করে। ব্যোমকেশ বক্সী, কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ আওড়ানো; ছয় বছরের পরিচিতিটা নেহাত কম না তোমাকে, তোমার কথা বলার ভঙ্গি, তোমার আচরণের মানে বুঝবার।
- I am impressed!
- You ought too! I am, after all, the perfect Satyabati to your Byomkesh.
- এবারে গিফট টা নাও। অনেক খুঁজে খুঁজে রেড ফোরটের এই রেপ্লিকাটা পছন্দ করে আনলাম। প্রপোজের স্থানটিকে memorable করে রাখলাম। Happy anniversary sweetheart.
- ডিনারটা কোথায় হচ্ছে তাহলে? বেঞ্জারং চলবে?
- দৌড়বে।
- চল আগে কফিটা খেয়ে আসি। খুব তেষ্টা পেয়েছে।
No comments:
Post a Comment