Thursday, July 27, 2017

উত্তুরে হাওয়া



আমি যাকে বলে খাস দক্ষিণ কলকাতার মেয়ে। জন্ম আমার ল্যান্ডসডাউন রোডের হসপিটালে। তারপরেই সোজা পিন কোড সাত লক্ষ পঁচানব্বই, অবশ্য তখনও পঁয়তাল্লিশ ছিল। প্রাইমারী স্কুল ছিল দেশপ্রিয় পার্কে, তারপরে হাই স্কুল যাদবপুর থানায়। কলেজ পার্ক সার্কাস, ইউনিভার্সিটি যাদবপুর; তারপরে বছর খানেক রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ। তারপরে সেই ২০১৩'র গরমের ছুটির থেকে চেন্নাইতে। দেখতে গেলে উত্তর কলকাতার সাথে আমার নিত্যনৈমিত্তিক যোগাযোগ বলতে শুধু রাজাবাজারের এক বছর। অথচ উত্তর কলকাতার সাথে আমার কোর্টশিপ কিন্তু আরও আগে থেকে। মনে হয় সেই বাগবাজারে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার সময় থেকে।
আমি কিংবা আমার মা বাবা কেউই খুব একটা ভিড়ভাট্টা পছন্দ করিনা। কাজেই দুর্গা পুজোতে আমরা ঠাকুর দেখার পর্বটা সকাল সকাল কি নিদেনপক্ষে দুপুরেই মিটিয়ে ফেলি। আমাদের প্রথম স্টপই হয় বাগবাজার। হয় বাসে নয় ট্রামে যাতায়াতটা হয়, গাড়ি নিয়ে একবার খুব ফ্যাসাদে পড়েছিলাম। সে কথায় পরে আসছি। বেশ একটা impressionable age থেকেই এই পর্ব চলে আসছে বলে, বাগবাজারের ডাকের সাজ ও দুর্গা পুজো আমার কাছে synonymous। পুজো পরিক্রমা অসম্পূর্ণ লাগে বাগবাজারে না গেলে। ওই যে বছর বছর সনাতনী মা দুর্গার রূপ, কেন জানিনা, আমার দেখলেই গায়ে কাঁটা দেয়। মনে আছে কোন এক বছর উত্তরে যাওয়া প্রায় দুইবার ক্যান্সেল করে তৃতীয় বার যখন সম্ভব হল, সত্যি বলছি, অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে দিতে দুই গাল বেয়ে জল পড়ছিল। এছাড়া শোভাবাজার, আহিরিটোলা, হাতিবাগান, শিমলে ইত্যাদি ইত্যাদি বেশ কিছু নামজাদা ঠাকুরই দেখি। উত্তরের তো গলিতে গলিতে প্রবাদপ্রতিম ঠাকুর। এই গলি সেই গলিতে গেলেই মনে হয় যেন কত ইতিহাসের সাক্ষী। ইদানীং বেশীর ভাগ সময়েই পুজোতে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে, তাই মোটামুটি সব বারেই হাতে ছাতা নিয়ে বেরোতে হয়। বৃষ্টি নামলে কোন পুরনো বাড়ির গাড়িবারান্দায় বা ছোট্ট দোকানে আশ্রয় নিতে হয়। একবার আমরা গাড়ী নিয়ে বেড়িয়েছিলাম, সে এমন তুমুল বৃষ্টির তোড়, সামনে প্রায় কিচ্ছুটি দেখা যাচ্ছেনা। প্রায় মিনিট কুড়ি ওইরকম এক জায়গায় গাড়িটাকে পার্ক করে রাখা ছিল। ক্রমশ দেখতে পাচ্ছি রাস্তায় জল জমছে, আমাদের গাড়ি আবার প্রায়ই তখন বেগড়বাই করত, নিতান্তই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। তবে ঈশ্বরের অসীম কৃপা, সেই যাত্রায় কোন অসুবিধে সেরকম হয়নি। হ্যাঁ যেইটুকু হয়েছিল, তা হলে আমরা রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আহিরিটোলা যেতে গিয়ে বোধহয় নিমতলার ঠাকুরের ওদিকে চলে গিয়েছিলাম বা উল্টোটা; কিছু বছর আগের ঘটনা, ঠিক খেয়াল নেই (আমার রাস্তার সেন্সটিও খুবই লজ্জাজনক ভাবে খারাপ)। গত বছর এক বন্ধুর থেকে ফোনে ডিরেকশন নিয়ে নিয়ে বাগবাজার ও শোভাবাজারের ঠাকুর দেখতে পেরেছিলাম।


মায়ের সাথে প্রায় কলেজে পড়াকালীনই কলেজ স্ট্রীট বিধান সরণিতে যেতাম শাড়ি কিনতে। নিজে শাড়িতে খুব একটা পটু না হলেও বাছাই করে অন্যদের জন্য কিনতে আজও ভালো লাগে। গত মাসে কলকাতা গিয়ে আবার সেই একই কাজ করলাম। কি তৃপ্তি যে হয় কি বলব। ওই ঢাকাই শাড়ি গুলো, আহা। হলফ করে বলতে পারি, ওই দামে ওই নকশা আমি কিন্তু দক্ষিণের নামজাদা দোকানে দেখিনি। কলেজ স্ট্রীট অঞ্চল মানেই বই কেনা। আনন্দর দোকানে ঢুকে কিছুক্ষণ কাটানো যে কি আরামের, সে যে না experience করেছে, সে বুঝবেনা। আমার আবার জুতোর সাইজটি বেশ ছোট, সচরাচর মাপের জুতো পাই না। তবে কলেজ স্ট্রীট বাটা (যেটা জানিনা, মা কেন ঘোরা নাকি ঘোড়া বাটা বলে) হল একমাত্র জায়গা যেখানে প্রত্যেকবারে যে মডেলের জুতোই খুঁজি না কেন, আমার সাইজে পেয়েছি।  এই দোকানপাট করতে করতে চলে খাওয়া দাওয়াও। ওই চত্বরে তো আবার সেই অপশনের কোন কমতি নেই। পুঁটিরাম, প্যারাডাইস, কফি হাউস, দিলখুশা - যা চাই তাই পাই। আর একটু এগোলে চাচার দোকান। কুসুম। উফ। একবার কি হয়েছে, আমার এক বান্ধবীর সাথে শীতকালে ঠিক করে গেলাম north calcutta food tripএ। প্রথমেই হামলে পড়লাম বিশ্ব বিখ্যাত গোলবাড়িতে। সেই যে কষা মাংস আর রুটির সাদ, জিভে লেগে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে ঘুরতে ঘুরতে তারপরে হেদুয়া চত্বরে গেলাম। নকুড়ের মিষ্টি চাইই চাই। বি এস সি থার্ড ইয়ারের প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষার সিট পড়েছিল আমার স্কটিশে। প্রথম দিন মা বাবা কে বলে দিয়েছিল যে মিষ্টি দিয়ে পাঠাতে ভুলে গেল, কাজের ফাঁকে টিফিন খাওয়ার জন্য। বাবা যেন ওখানে কোন দোকান থেকে কিনে দেয়। রাস্তায় পড়ল একটা অদ্ভুত রকমের দেখতে দোকান, ঠিক মনে হবে যেন একটা বসতবাড়ির একতলাটাকে দোকান বানিয়েছে। একটু মিষ্টি খেয়ে বাড়ি ফিরতে মা বাক্স দেখে বলে একই কাণ্ড, এ যে দেখি নকুড়ের সন্দেশ। সেই প্রথম আমি মায়ের কাছে নকুড়ের মহিমা শুনলাম। আমার কেন জানি উত্তরের ছোট্ট ছোট্ট মিষ্টির দোকানগুলির মিষ্টির স্বাদও খুব ভালো লাগে। রাজাবাজারে পড়াকালীন ভাইফোঁটার মিষ্টি আমহারস্ট স্ট্রীটের একটা দোকান থেকে কিনেছিলাম। আবার খাজা পাইনি বলে বউবাজারে নেমে জয়শ্রী থেকে কিনেছিলাম। সেখানে তো আবার পাশাপাশি জয়শ্রী, ভীম নাগ। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে ওকে।  গিরীশ পার্ক মেট্রো ষ্টেশনের কাছে একটা প্রায় পুঁচকে দোকান আছে, নিরঞ্জন আগার তার নাম। সেখানেই ডিমের ডেভিল নাকি নেতাজী পর্যন্ত খেতেন। আমার বান্ধবীর কল্যাণে সেই যাত্রায় সেটির স্বাদও পেয়েছি।

একবার কি হয়েছে, রাজাবাজারে পড়াকালীন কখনো বাস স্ট্রাইক জাতীয় কিছু একটা ছিল। নাকি কোথাও অবরোধ হবে হয়তো। শিয়ালদা দিয়ে ফিরতে গেলে ফেঁসে যাব বলে গুগুল ম্যাপের সাহায্যে ওইসব পুলিন দাস স্ট্রীট, আমহারস্ট স্ট্রীট, কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রীট হয়ে কোনমতে এম জি রোড মেট্রো পৌঁছলাম। সে যেন এক্কেবারে বিশ্ব জয় করে ফেলেছি, এমন অবস্থা। সেই যে চিনলাম, তারপর থেকে কথায় কথায় শুরু হল আমার হাতিবাগান মার্কেটে হানা দেওয়া। গড়িয়াহাটে বাজার করে আরাম নেই, হাতিবাগানেও একই স্টক, কিন্তু অনেক শান্তিতে ঘুরে ফিরে বাজার করা যায়। অনেকটাই নিশ্চিন্ত নিরিবিলি গোছের। জগদ্ধাত্রী পুজো চলাকালীন একবার সায়েন্স কলেজের ঠিক পিছনের রাস্তাটা (নামটা এক্ষুণি খেয়াল পড়ছেনা) দিয়ে দুপুরবেলা যাচ্ছি আমরা তিন বান্ধবী। দেখলাম একটা বাড়িতে বড় করে পুজো হয়েছে। তখন বাড়ির লোকজন সবাই ভোগ খেতে বসেছেন। আমরা ঠাকুর নমস্কার করে সবে বেড়িয়ে যেতে যাচ্ছি, ওই মাসীমা জেঠিমারা কিছুতেই আমাদের ছাড়বেন না। রীতিমতো জোর করে আমাদের ভোগ খাইয়ে তবেই মুক্তি দিলেন। আহা, সে ভোগ যেন অমৃত। এইরকম আতিথেয়তা আমি আজ অবধি দক্ষিণে কখনো পাইনি।

উত্তরের রাস্তায় ঘাটে এত ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে, ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি, ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি, মায়ের বাড়ি, প্রেসিডেন্সি, হেয়ার-হিন্দু, সিটি কলেজ, বিদ্যাসাগর কলেজ, কলেজ স্কোয়ার, হেদুয়া - আকাশে বাতাসে ঐতিহ্য। প্রতি শ্বাসে কিছুটা পুরনো কলকাতাকে খুঁজে পাওয়া। 

No comments:

Post a Comment