Sunday, July 9, 2017

আমি কৌশাণি বলছি।

আমি কৌশাণি। কি বললেন, চিনলেন না? আরে এই যে আজ বিকেলে অর্ণব লিখল না শুভ বিবাহ? ওই সপ্তম জন...আমি!  অর্ণবের লেখাটা পড়ে নিশ্চয়ই প্রথম প্রথম ভেবেছিলেন যে কি ডাঁটিয়াল মেয়ে রে বাবা! এত চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে। হলফ করে বলতে পারি, আপনার জায়গায় থাকলে আমিও এরকমই ভাবতাম। আপনাদের একটা সত্যি কথা বলি। আসলে বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে তো, তাই একটু প্যাম্পারড। ছোট থেকে বড় হয়েছি কায়ামাত সে কায়ামাত তক, রাজু বন গয়া জেন্টিল্ম্যান, মেয়নে প্যার কিয়া, দিল তো পাগল হ্যায়, কুছ কুছ হোতা হ্যায় দেখে। এরেঞ্জড ম্যারেজের এক্কেবারে বিপক্ষে ছিলাম। খালি মনে হত সিনেমার মত বেশ মিষ্টি মিষ্টি প্রেম হবে আমার, শাহরুখ-জুহির মত জুটি হবে। তবে কি বাজে ভাগ্য আমার, আমার দ্বারা প্রেমটা হয়ে উঠল না। বাবা  আর্মিতে ছিলেন যখন, তখন আমি স্কুলের গন্ডি টপকাইনি। তাই সর্বক্ষণ বাড়িতে একটা মিলিটারি রেজিম চলত। প্রেম করার বয়সে তাই শুধু মাত্রই বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতে হত। দেখতে, বলতে নেই, জুহির মত অত সুন্দরী না হলেও, প্রীতি জিন্তার মত এক খানা মিষ্টি টোল পড়ে বাঁ গালে।   জন্ম আমার কাশ্মীরে, তাই বোধহয় গায়ের রঙও পেয়েছিলাম ওদের মত। মানে সোজা কোথায়, লাখো দিওয়ানে থে হামারে, কিন্তু মিলিটারি বাবার কল্যাণে প্রেমের ঝুলি সেই শূন্য।

মাসিমণির ২৫ বছরের anniversaryতে গিয়ে যখন ওই কমল বাবুর সাথে মা বাবার বেশী রকমের ফুসুর ফুসুর গুজুর গুজুর শুরু হল, তখনই বুঝেছিলাম যে ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। নইলে মেসোর খুড়তুতো বৌদির মাসতুতো ভাইঝির দেওরের সাথে তো মা বাবার এত গপ্প ঠিক স্বাভাবিক না। আমার সন্দেহ যে ভুল না, তার হাতেনাতে প্রমাণ পেলাম দুইদিন বাদে। সবে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরেছি, ওমনি মা বাবা পাকড়াও করল। নাকি বিশাল কেউকেটা ছেলের বাড়ির থেকে সম্বন্ধ এসেছে, কারটেসি কমল বাবু। আমি যেন একবার দেখা সাক্ষাতে রাজী হই।

এতদিন অবধি এই ছেলে দেখা মেয়ে দেখা ব্যাপারটা নিয়ে ভীষণ হাসাহাসি করতাম। কলেজের কিছু ক্লাসমেটদের গ্র্যাজুএশনের পরপরই বিয়ে হয়ে যায়। কারুর দাদা দিদির বিয়ে এরকম "দেখেশুনে" হয়। এদের সকলের থেকে নানান অভিজ্ঞতার গল্প শুনে যেমন খিল্লি ওড়াতাম, তখন মনে হয় ওপর থেকে একজন মিটকি মিটকি হাসতেন। ওই সেই ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে কেস আর কি। কস্মিনকালেও ভাবিনি যে আমায়ও এই পথের পথিক হতে হবে। তখনো মনের কোনে ক্ষীণ আশা ছিল যে যাদবপুরে পড়ছি যখন, নিশ্চয়ই একটা প্রেম করবই করব। সে আশায় জল ঢেলে কমল ভিলেন একখানা সম্বন্ধ আনল। ফটোটা দেখে প্রথমে তো একচোট হাসলাম, কি বিটকেল ছবি। পুরো জিতেন্দ্র মার্কা সাদা ট্রাউজার আর গোভিন্দা মার্কা ফুল ছাপ শার্ট। বাঁকা হাসি। ইশ। ছবি দেখেই তো আমি নাকচ করতে যাচ্ছিলাম। বাবা একটা কড়া বকুনি দিল। নাকি এরকম চেহারা দেখে বিচার করা ভালোনা। বাবার ব্যাঙ্কে নাকি এমন অনেকে আসেন যাদের পরনের বেশভূষা অত্যন্ত সাধারণ, অথচ এদের একাউন্টে নাকি কয়েক কোটি টাকা। মা শুরু করল নিজের জাস্টিফিকেশন, বাবার ছবি দেখে নাকি মা ভিলেন ভেবেছিলেন প্রথমবার, অথচ এত দিলদরিয়া লোক তো দুটো নেই (হ্যাঁ এটা আমিও মানি, মাই ড্যাডি ইজ দা বেস্ট)। এরপরে আর আমার কাছে কোন অপশন ছিলনা। রাজী হলাম "ছেলে দেখতে"। মনে মনে ভাবলাম, এই ছেলে দেখার ফ্রীডমটা যদি ঠিক বয়সে পেতাম তো আজ এরকম একটা ভুলভাল লোকের সামনে সং সেজে বসতে হত না।

কলেজের বন্ধুদের থেকে শলাপরামর্শ যে নেব, তারও উপায় নেই। হেল্প করা তো দুরের কথা, শুধু আমার পিছনে লেগে গেল। অরকুট খুলে অর্ণবের ছবি দেখে খালি হেসেই কুটিপাটি। ওর আগ্রার সামনে বোকাবোকা পোজের ছবি দেখে তো একেবারে এমন হাসি শুরু হল যে গোটা রিসেস কেটে গেল, হাসি আর থামেনা। শেষে এস বি বির কটমটে টনক নড়ল। তা যাই হোক, অবশেষে সেই ডি-ডে এল। আমার হাজার বারণ সত্ত্বেও সেই আমায় শাড়ী পড়তেই হল। গত পুজোয় কেরলে গিয়ে যেই সিল্কটা মা কিনেছিল, সেইটা। যে মেয়ে সালওয়ার কামিজ পড়তে চায়না ওড়না সামলাতে পারবেনা বলে, তাকে নাকি পড়তে হচ্ছে শাড়ী। সাঙ্ঘাতিক রাগ উঠছিল ওই জিতেন্দ্র-গোভিন্দা হাইব্রিডের ওপর।   কেন রে বাপু, সুখে থাকতে ভুতে কিলোয় কে জানে এদের। দিব্যি দিল্লির মত জায়গায় আছিস নিজের মত, চাকরি করিস, এঞ্জয় করবি, তা না। ওমনি একেবারে বিয়ে করতে হবে। উফ, এই করেই বাঙালি ছেলেগুলো গোল্লায় গেল। লাইফে কোন আডভেঞ্চার নেই। ঠিক করেই রেখেছিলাম, এ ছেলেকে ক্যান্সেল করতেই হবে। তবে বাবা মায়ের যা পছন্দ হয়ে গেছে অলরেডি একে, আমি সহজে জিতবনা। অগত্যা, ওই পক্ষ থেকে ক্যান্সেল করাতে হবে।

মিলিটারি মেজাজের বাবা কে এক্কেবারে ইম্প্রেস করে তেনারা বাড়িতে ঢুকলেন ঠিক কাঁটায় কাঁটায় এগারোটায়। আমি আমার নিজের ঘরে বসেছিলাম, কান খাড়া করে শুনবার চেষ্টায় যে কি হচ্ছে ওঘরে। মিনিট পনেরো পরে মা এসে আমায় তো নিয়ে গেল ড্রয়িং রুমে। আমার বাবা মা খুব মডার্ন, তাই ওই চায়ের ট্রে হাতে কামধেনুর মিষ্টি আর শিঙাড়া কে নিজের বানানো বলে চালিয়ে এন্ট্রি নিতে হয়নি। একদম নর্মাল ভাবেই এলাম। সেদিন আবারও একটা বিটকেল কম্বিনেশন পড়ে এসছিল অর্ণব। উফ। ব্রাউন স্ট্রাইপ প্যান্টের সাথে কেউ সাদা ব্রাউন স্ট্রাইপ শার্ট পড়ে?? একী শাড়ী ব্লাউজ নাকি এরকম ম্যাচ করতে হবে? ওই জন্যই কোয়ালফায়েড হয়েও বিয়েটা প্রেম করে করতে পারেনি। বরং ওর মা বাবাকে অনেকটাই স্বাভাবিক লেগেছিল, মানে ওই আর কি। মুখে স্মিত হাসি রাখতে হচ্ছে, কোথায় কোথায় ন্যাকা ন্যাকা লজ্জা লজ্জা মুখ করে ঘাড় কাত করতে হচ্ছে পদে পদে। ওদিকে তো ভিতরে ভিতরে আমি তখন নার্ভাস, না জানি কি প্রশ্ন করবেন ওনারা। শুক্তোয় কি ফোড়ন পড়ে জিজ্ঞেস করলে না হয় রাঁধুনি বলব (এটা আমার হাজার হাজার সপ্তাহ ধরে সানন্দা পড়ার ফল),   কিন্তু আনকমন প্রশ্ন হলে? এই সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কানে এল বাবার গলা। "মা অর্ণবকে তোর ঘরে নিয়ে যা"। এই রে, মা পইপই করে বলা সত্ত্বেও সেই চেয়ারের ওপরে আমার আঁকার খাতা আর রঙ তুলি ফেলে রেখেছি। মা জানতে পারলে না বড্ড বকা খাব। টুক করে দিমাগ কি বত্তি জ্বলে গেল।  হ্যাঁ, এটাকে নিজের সুবিধার্থে ব্যাবহার করতে হবে। আশা করি এরকম অগোছালো ঘর দেখলে আমায় অপছন্দ হবে (তখন কি আর জানতাম যে এ ছেলে আমার চেয়েও বেশী অগোছালো)।

প্রীতি জিন্টা টোলটা ডিস্প্লে করে মিষ্টি করে বললাম "আসুন"। তারপরের গল্প তো অর্ণব যা লিখেছে, এক বর্ণও মিথ্যে লেখেনি। সামনাসামনি দেখলাম যখন, হুম, মন্দ না দেখতে। শাহরুখ না হলেও আবীর বলা যেতেই পারে। আর ওই ড্রেসিং সেন্স, সামলে নেব। তবে পর মুহূর্তেই মনে পড়ল কেয়ার সাবধান বাণী, "যার হিস্ট্রি ভাল, তার জিওগ্রাফি ভাল হয়না এন্ড ভাইস ভারসা"। এর যেহেতু জিওগ্রাফিটা ৯০ আপ না হলেও লেটার মার্কস, তাই হিস্ট্রিটা বাজিয়েই নিতে হল। কিন্তু ওই পি জে টা যখন ক্র্যাক করল না, আমার ইচ্ছে হল বলি যে ও মশাই ইহারে পিজে নয়, ডিজে বলে। ডাউন মারকেট জোক। পুরো কপিল শর্মা স্ট্যান্ডারড। ঘষে মেজে বিগ ব্যাং থিয়োরির লেভেলে আনতে গেলে অনেক পরিশ্রম করতে হবে। অত ঝক্কি কি নেব? ডিসাইড করতে পারছিলাম না। কোথাও যেন ওই ক্যাবলাপনা ভাবটাই খুব টানছিল জানেন। তাই ভাবলাম যে যা আছে কপালে। আমি কিচ্ছু বলব না। ওপরওালার হাতেই ছেড়ে দিই।   ড্রয়িং রুমে আবার ওই টিপিকাল পোসেঞ্জিত মার্কা ফিল্মি লাইন শুনে কিরকম গা পিত্তি জ্বালা করে উঠবে ভেবেছিলাম, তা কিন্তু হলই না! আমি নিজেই অবাক, বরং উলটে কিরকম একটা অজানা ভালো লাগা হল। ওরা চলে যাওয়ার পরে সারাদিন আমি নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়ে শুয়ে প্রচুর ভাবলাম। সানন্দার টিপ্স দেখে প্রোজ অ্যান্ড কন্সের লিস্ট করলাম। ফাইনালি যা দেখলাম, জাস্ট এক নম্বরের জন্য পাস করে গিয়েছেন। ট্রাস্ট মি, যখন টোটাল করছিলাম, প্রোজে দেখলাম ১৩ আর কন্সটা গুণছি, খালি ভাবছিলাম যে হে মা কালী প্লীজ যেন ১৩টা আমার জীবনে গেঁড়ো না হয়। কন্সটা যেন ১২.৯৯ এর ওপরে না ওঠে। উফ। প্রোজ গ্রেটার দ্যান কন্স দেখে যে আনন্দ হয়েছিল, সেটা মনে হয় মাধ্যমিকে অঙ্কে পাস করেও হয়নি!

আর কি, বাবা মা কে জানিয়ে দিলাম। তারাও খুশি খুশি ও বাড়িতে খবর দিল। অর্ণব তো তার পরে পরে দিল্লি চলে গিয়েছিল। এয়ারপোর্টে গিয়ে একটু ফিল্মি ইস্টাইল রোম্যান্স হল। এরপরে ওই এস টি ডি কল আর এস এম এস প্যাক আমাদের প্রেমের সাক্ষী। তারপরে অঘ্রাণে বিবাহ। মা ষষ্ঠীর কৃপায় এখন দুইটি অতি বিচ্ছু অথচ ভারী মিষ্টি ছেলে মেয়ের আমি গর্বিত জননী।


পুনশ্চঃ ওই যে হাম দো হামারে দো তে বিশ্বাস করিনা লিখেছে না ও? ওটি কিন্তু ডাহা মিথ্যে। রাত বিরেতে উঠে যখন তাতান আর তিতিরের জন্য ফর্মুলা মিল্ক রেডি করতে বসতে হয়, তখন মনের আসলি কথা বেরিয়ে আসে।

No comments:

Post a Comment