Tuesday, March 26, 2019

প্রেমে পড়া বারণ

দাশনগরের এই পাড়াতে নন্দিনীর আসার সবে ছয় মাস হয়েছে। বাবা শিবপ্রসাদ সান্যাল সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। এতদিন মালদা, বহরমপুর ইত্যাদি জায়গায় বদলিসূত্রে থেকে এই এবারে দাশনগরের সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দায়িত্ব পেয়েছেন। নন্দিনীর উচ্চ মাধ্যমিক শেষ হলো এবছর। এতদিন বাবার বদলির জেরে যাতে ওকে জেরবার না হতে হয়, লেখাপড়ায় কোনো ক্ষতি না হয়, তাই শিলিগুড়িতে মামা বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করেছে। মামাবাড়িতে ওর বয়সী তেমন কেউ নেই। একমাত্র মামাতো দিদি, টুলুদি, নন্দিনীর চেয়ে পনেরো বছরের বড়। বহু বছর হলো বিয়ে করে বম্বেতে থাকে। মামা মামীও অন্যের সন্তানকে মানুষ করছেন দায়িত্ব নিয়ে, তাই কড়া শাসনের মধ্যে রাখতেন ভাগ্নিকে। এইসবের জেরেই নন্দিনী হয়েছে এক্কেবারে মুখচোরা, লাজুক। সাত চড়েও রা কাটেনা।
জয়েন্টে রেজাল্ট ভালো না হলেও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফল করে এবছর প্রেসিডেন্সিতে বটানি অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু মনে প্রাণে ইচ্ছে, বাবার মতোই ডাক্তার হবে। তাই সারাদিন কলেজে ক্লাস করে, সিনিয়রদের দাদাগিরি, ক্লাসমেটদের এদিক সেদিক বেফাঁস মন্তব্য সব মুখ বুজে সহ্য করেও নিয়ম করে সপ্তাহে তিনদিন জয়েন্টের স্পেশাল কোচিং ক্লাসে ঠিক যাবেই যাবে। তার অবশ্য দুটো কারণ। মুখ্য কারণ ডাক্তারিতে চান্স পাওয়ার প্রবল ইচ্ছে হলেও, দ্বিতীয় কারণটিও ইদানিং নেহাত গৌণ নয়। অন্তত নন্দিনীর কাছে। এই দ্বিতীয় কারণটি হলো বিশ্বম্ভর রায় চৌধুরী। দাশনগরের বিখ্যাত মাস্টার।  অমন ভারিক্কি নাম শুনে প্রথমদিন দুরুদুরু বুকে ক্লাস করতে গিয়ে তো নন্দিনী একেবারে থ। আরে, এ যে একেবারে ইয়ং স্যর। বছর তেইশ কি চব্বিশ বয়স। নিজে মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে এখন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট পরীক্ষার জন্য পড়ছে। আর সাথে এই একটা ব্যাচ পড়ায়। ভারী আমুদে এই বিশ্বম্ভর স্যর। ছাত্রদের প্রিয় বিশুদা।
নন্দিনীর ওকে খুব ভালো লেগে গেলো। কী সুন্দর মিশুকে। ওদের সাথে ওদের মতন করে মিশে গিয়ে গল্পের ছলে কঠিন কঠিন টপিক পড়িয়ে দেয়। প্রশ্নোত্তর পর্বেও সাহায্য করে।
কলেজের মতোই এই টিউশন ক্লাসেও নন্দিনী প্রায় চুপচাপ থাকে বেশিরভাগ সময়। হয়তো ব্যাচের বেশিরভাগই ওর চেয়ে ছোট বলে। তাও তাদের মধ্যে ওই রমিতা আর পিউয়ের সাথে যা অল্পবিস্তর কথা হয়। তার কারণ অবশ্য ওরা একই রুটের অটোতে যাতায়াত করে। তার মধ্যেও বিশ্বম্ভর স্যর মাঝে মাঝে নন্দিনীর থেকে প্রশ্নের উত্তর ঠিক বের করে নেয়। কনফিডেন্স বাড়ানোর চেষ্টায়।
সেদিন কলেজে হাফ ডে হয়ে ক্লাস অফ হয়ে যায়। বাড়ি এসে নন্দিনী একটু এফ এম রেডিওটা চালিয়ে শুয়েছে। বাবা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। মা দুদিন হলো শিলিগুড়ি গিয়েছে। মামীর শরীরটা ভালো না। তাই ওদের সংসার সামলাতে মাই ভরসা। কোনোদিনও সেরকমভাবে টিভি বা রেডিও দেখার বা শোনার অভ্যেস ছিল না নন্দিনীর। আজ কী মনে হলো, কে জানে। ইয়ারফোন লাগিয়ে চালালো একটা স্টেশন। ভারী সুন্দর ভরাট গলায় একটি মেয়ে গাইছিল।
"তোমায় যত গল্প বলার ছিল
সব পাপড়ি হয়ে গাছের পাশে ছড়িয়ে রয়েছিল,
দাওনি তুমি আমায় সেসব কুড়িয়ে নেওয়ার কোনো কারণ।"
আহা। ভারী মনকাড়া তো। একবার ফোনের নেট অন করে নন্দিনী ইউটিউবে গানটা খুঁজে শুনলো। একবার। দুবার। দশবার। অপূর্ব। কী সুর। কীসব শব্দ। কী গায়কী। দুপুরের ঘুমটা দিলো তো মাটি করে এই গানটা।
সন্ধ্যে হলো। এবার বিশ্বম্ভরের টোলে যাওয়ার পালা। হ্যাঁ, ওর বাবা মজা করে এই নামেই বলে কোচিং ক্লাসটাকে। বাবা ডাক্তার জানার পর এক দুবার বিশ্বম্ভর স্যর এসে বাবার সাথে দেখা করে গিয়েছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও মাঝেসাঝে বসে। তাই নন্দিনীর বাবার সাথে ভালোই আলাপ পরিচয়। কিন্তু নন্দিনী এখনো তেমনভাবে জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মনে মনে অল্প ভালোলাগা জন্মালেও, সেটিকে পাত্তা না দেওয়ার চেষ্টাই করে চলেছে প্রাণপণ। মোটামুটি পারলেও মাঝে মাঝে সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে যায়।
ঠিক যেমন আজ হলো। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়েই আকাশটা কেমন ভার হয়েছিল। ক্লাসে পৌঁছতে পৌঁছতে আকাশ ভেঙে জোরে বৃষ্টি নামলো। চারিদিক অন্ধকার। হাওয়া বইছে বেশ জোরেই। আজকাল প্রায়ই চৈত্র মাসেই ঈশান কোণ কালো করে কালবৈশাখী এসে তান্ডব নৃত্য করে দিয়ে যাচ্ছে।
ছাতা থাকলেও খানিক ভিজেই নন্দিনী যখন ক্লাসে ঢুকল, দেখল ও ছাড়া আর জনা ছয়েক ছেলে মেয়ে বসে আছে। তাদের মধ্যে অবশ্য পিউ আর রমিতা নেই। বিশ্বম্ভর নিজের চেয়ার পেতে সামনে বসে। চুপচাপ ক্লাসের পিছনদিকে একটা কোণে গিয়ে বসতেই যাচ্ছিল নন্দিনী, এমন সময়ে বিশ্বম্ভর স্যরের গম্ভীর গলা শুনল, "এই তো কজন এসছিস তোরা আজ। যা বৃষ্টি নেমেছে, মনে হয় না আর কেউ আসবে বলে। আজকে আর ওই লাস্ট বেঞ্চে যাস না নন্দিনী। এই সামনেটায় চলে আয়।"
নন্দিনী নিরুপায়। কালো সুতির ওড়নাটা দিয়ে ভেজা মুখ মুছে পিঠের ব্যাগটা তুলে গুটিগুটি পায়ে এলো ফার্স্ট বেঞ্চে। বসতে যাবে, ঠিক সেই সময় গেল লোডশেডিং হয়ে। রাস্তার আলো, আসে পাশের সব বাড়ির আলোই চলে গিয়েছে। ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। ছেলেদের দিক থেকে সমবেত প্রস্তাব এলো, 'বিশুদা, আজ প্লিজ ক্লাস করিয়ে এমন দুর্দান্ত ওয়েদারকে নষ্ট করো না। প্লিজ বিশুদা। ছুটি দাও।" বিশ্বম্ভর হেসে বললো, "সে ঠিক আছে। বুঝলাম। ছুটি না হয় দিলাম। কিন্তু একটা কথা বল, এই বৃষ্টির মধ্যে বাইরেই বা যাবি কী করে তোরা? ভিজে স্নান হয়ে যাবি। তারপর জ্বর হলে আরো তিনটে ক্লাস কামাই হবে। উহু। তার চেয়ে বরং সবাই মিলে এখানেই গল্প করি। গানটান গাই।"
হইহই করে ছেলেরা সায় দিলো এই কথায়। বিশ্বম্ভর।বললো, "দাঁড়া, আমি কটা মোমবাতি নিয়ে আসি। তোরা ইতিমধ্যে গান শুরু কর কেউ।" এই বলে বিশ্বম্ভর মোবাইলের আলো জ্বেলে ভিতরের ঘরে গেল। তারপর মিনিট দু তিনেকের মধ্যেই ফিরেও এলো। হাতে গোটা ছয়েক সরু সাদা মোমবাতি। আর একটা দেশলাই বাক্স। সুবীর বলে একটি ছেলে তখন গান ধরেছে। রীতিমতো হেড়ে গলায়। "কিছুতে কেন যে মন লাগে না..."
বিশ্বম্ভর একে একে মোমবাতিগুলো জ্বালাচ্ছে। আর নন্দিনীর হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে। এদিক ওদিক রাখার জন্য। এক আধবার এই দেওয়া নেওয়ার সময়েই আলতো করে দুজনের আঙুল স্পর্শ করে গেলো একে অপরকে।
"সুবীর, এবার থাম। একটুও সুর নেই তোর গলায়।" হেসে বললো বিশ্বম্ভর।
"ঠিক বলেছ বিশুদা, ও গাইলে এই গা ছমছমে পরিবেশে ভূতেরা এসে পড়বে।" ফুট কাটলো রক্তিম বলে আরেক ছাত্র।
বিশ্বম্ভর এবার নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে বলল, "তুই নিশ্চয়ই ভালো গান গাস। একটা গান ধর না।" নন্দিনী খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। কোনোমতে তা কাটিয়ে উঠে বলে, "না। মানে আমি ঠিক গান জানি না।"
"বললেই হলো? তোর গলার আওয়াজ এত মিষ্টি। আবার আজ ক্লাসে ঢুকলি ইয়ারফোন কানে। গান জানিস না বললেই হলো? উহু। গান গাইতে হবেই। নইলে ছাড়ছি না।" বিশ্বম্ভর ঈষৎ গম্ভীর হয়েই বলে কথাগুলো।
নন্দিনী তো ঘেমে নেয়ে একশা। একেই এতজনের সামনে গান। তার ওপর বিশ্বম্ভর রয়েছে। কী মুশকিল। এদিকে মাথায় গানও আসছে না। ওই একটিই ছাড়া। আবার তাড়া খেয়ে এবার চোখ বুজে গান ধরতেই হলো। নন্দিনী নিজেও অবাক। কী গাইছে এটা?
"প্রেমে পড়া বারণ।
কারণে অকারণ।"
মোমের নরম আলো পড়ে তখন ওর নিষ্পাপ মুখখানি ভারী সুন্দর লাগছে। অমায়িক। নির্মল। নিরালা। নরম। বিশ্বম্ভরের চোখদুটিও কারণে অকারণে মাঝে মাঝেই ওর দিকে চলে যাচ্ছে। ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসিতে ওকেও বেশ লাগছে কিন্তু।
বৃষ্টি থেমে আসে। ঘোর বসন্ত।
"শহর জুড়ে যেন প্রেমের মরসুম..."

No comments:

Post a Comment