দামী গাড়ী চেপে চ্যাটার্জি দম্পতি যখন পৌঁছলো মাল্টিপ্লেক্সে, তখন উপচে পড়ছে ভিড়। ফ্ল্যাশবাল্বের ঝলকানি। মাইক হাতে নিউজরিপোর্টার। ইন্ডাস্ট্রির হুজ হু সব্বাই হাজির। ছবির প্রযোজক মিস্টার আগরওয়াল নিজে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে সব অতিথিকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। ওদের দেখে এক গাল হেসে বললেন, "আরে দাদা, এত লেট করলেন। আসুন আসুন। বসুন। বৌদি, থ্যাংক ইউ ফর কামিং।" "প্রীতি, স্যর আর ম্যামকে ওদের সিটে পৌঁছে দাও।" নির্দেশমতো এক সুসজ্জিতা যুবতী ওদের দিকে এগিয়ে এলো। নিয়ে গেল প্রেক্ষাগৃহে। এক্কেবারে সামনের সারিতে ওদের বসার জায়গা দেখিয়ে দিয়ে প্রীতি এগিয়ে গেলো পরবর্তী অতিথিদের জন্য।
যথাসময়ে আগরওয়াল বাবু এলেন। দু চার মিনিট বক্তৃতা দিলেন। কেউ কেউ পরিচালক কই জিজ্ঞেস করায়, বললেন, "ও তো এক্কেবারে নতুন। খুব নার্ভাস। বলেছে আড়াল থেকে আপনাদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে তারপরে সিনেমার শেষে এসে পরিচয় করবে। তাহলে চলুন, আর সময় নষ্ট না করে সিনেমাটা দেখি। আশা করছি, আপনাদের সকলের ভালো লাগবে।"
প্রেক্ষাগৃহের সমস্ত আলো নিভে গেল। কালো পর্দার ওপর ভেসে উঠলো একটা ঝকঝকে নীল আকাশ। সামনে আরো ঝকঝকে সাদা কাঞ্চনজঙ্ঘা। আবহে ভেসে উঠলো শান্তিদেব ঘোষের চিরপরিচিত কণ্ঠে "অমল ধবল পালে"। গাঢ় নীল গোটা গোটা অক্ষরে এবার লেখা উঠলো "রডোডেনড্রোন"। নয়নিকা চমকে উঠলো। তাহলে কি...
প্রেসিডেন্সির কোয়াড্রঙ্গেলে শীতের দুপুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিক ওদিক বসে থাকা আর পাঁচটা সাধারণ যুগলের মতোই ওরা দুজনে বসে আছে। পিলারে হেলান দিয়ে। ছেলেটি মেয়েটির কাঁধে মাথা এলিয়ে। হাতে একটা খয়েরি মোটা বাঁধানো ডায়রি।
"বুঝলি নয়না, তোর আজ অবধি যত লেখা পড়েছি, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ এটা। প্রচন্ড সিনেম্যাটিক। এমনিতেই এত সুন্দর ডিটেলিং করেছিস, স্ক্রিপ্ট বানানো জলভাত। কোনোদিন যদি সিনেমা বানাতে চাস এটা দিয়ে, আমায় বলতে পারিস। আই এম সো কনভিন্সড উইথ দ্য স্টোরি।"
"বেশ। এই গল্পটা তোকেই দিলাম। তবে আমার একটা ইচ্ছে আছে। পারলে পূরণ করিস।"
"কী বল? তেরে লিয়ে সর আঁখো পর।"
"বাবাঃ, সিনেমা করার আগেই এত ড্রামাটিক!" নয়না হেসে বলে।
"ইয়ার্কি না। বলে ফেল তোর ইচ্ছেটা। কাঞ্চির রোলে তুই অভিনয় করবি? আর হিরো কাকে চাই? বুম্বাদা?"
"ধ্যাৎ। আমায় কে অভিনয়ে নেবে?"
"আমার এমন সুন্দরী বান্ধবীকে যে কেউ লুফে নেবে।"
"বাজে কথা থামা। বলছি যে যখন টাইটেল কার্ড আসবে স্ক্রিনে, প্লিজ অমল ধবল পালে গানটা দিস আবহে। শরতের সেটিংয়ে গল্প তো। তাই। আমার সবচেয়ে প্রিয় শরতের গান ওটা।"
"নিশ্চয়ই। আর যে সে গাইবে না। শান্তিদেব ঘোষের ভার্সানটাই বাজবে। আমি জানি, ওটা তোর প্রিয়।"
নয়নিকা অবাক হয়ে দেখতে থাকে সিনেমাটা। প্রতিটি সিন ওর চেনা। এমনকী কোনটার পর কী হতে চলেছে, সব বলে দিতে পারে। সংলাপ পর্যন্ত। থরথর করে কাঁপতে থাকে ও। ইন্টারভালের আগেই সুপ্রতিমকে "আমি একটু বাইরে যাচ্ছি" বলে বেরিয়ে যায়। বাইরে লবিতে তখন প্রায় কেউ নেই। শুনশান। কোল্ড ড্রিঙ্কের দোকান থেকে একটা স্প্রাইটের গ্লাস কিনে ঢকঢক করে খেলো পুরোটা। গলাটা শুকিয়ে গিয়েছিল। পার্চমেন্ট পেপারের মতো। ঠান্ডা পানীয়র ফলে এতক্ষণে একটু স্বস্তি। কালো গদির সোফায় বসলো নয়নিকা। হাতে ক্লাচ ব্যাগটা মুঠোর মধ্যে চেপে। ওই তীব্র এসির মধ্যেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে।
এও কি সম্ভব? ওর এত বছর আগের লেখা গল্প। হুবহু। টাইটেল সিনসহ। ও ছাড়া আর জানতো বাণী। প্রেসিডেন্সির সহপাঠী। কিন্তু...কিন্তু মধুজা যে বলেছিল, বাণী রিহ্যাবেই আত্মহত্যা করে?
কলেজ পাস করার পর বাণী এক দুটো সিনেমা কুড়িয়ে বাড়িয়ে প্রযোজক জোগাড় করে করেছিল। সব ফ্লপ। ইতিমধ্যে নয়না ওরফে স্ক্রিনের নয়নিকা একটার পর একটা হিট দিচ্ছে। ওকে সাইন করাতে বাড়ির বাইরে প্রোডিউসারের ভিড়। বাণীকে অনেকবার টাকা দিয়ে ও সাহায্য করতে চেয়েছিল। বলেছিল ওর প্রযোজক হবে। কিন্তু বাণীর তখন মেল ইগো চরমে। নয়নার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে শেষ পর্যন্ত ওদের সম্পর্কটাও শেষ হয়ে যায়। বাণী চেষ্টা চালিয়ে যায় সিনেমা বানানোর। নিজের সর্বস্ব দিয়ে একটা মাঝারি মাপের সিনেমাও বানায়। গ্রামের দিকে চলেছিল। সেই দেখে একটি বড় প্রোডাকশন হাউজ ওর সাথে চুক্তি করে তিনটে সিনেমার। সেই সিনেমার না আছে কোনো গল্প, না কোনো রুচি। তবুও ধার দেনা শোধ করতে ওকে এগুলো করতেই হয়।
নয়না ততদিনে সুপ্রতিমকে বিয়ে করেছে। প্রেম করেই। খবর পেয়েছে বাণীও ওর ক্যামেরম্যানের মেয়েকে বিয়ে করে ভরপুর সংসারী। এক দুটো রুচিশীল সিনেমার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু কপাল খারাপ। শহরের দর্শক তখন বাংলা সিনেমা দেখে না। গ্রামে সেসব জাত সিনেমা বোঝার লোক নেই। পরপর তিনটে ফ্লপ। বাজার মন্দা। প্রোডিউসারেরা আর রাজি নয় পরীক্ষা নিরীক্ষাতে। তাদের শুধুই চাই যাত্রাপালা গোছের সিনেমা। যা দেখে গ্রামের মানুষ খুশি হবে। দলে দলে এসে সিনেমা দেখবে।
বাণী ভুগতে লাগলো চরম হতাশায়। আস্তে আস্তে মদের নেশায় পড়লো। লিভারের বারোটা বাজলো। রিহ্যাবে ছিল। সেখানে একদিন ভোরবেলা ওর ঝুলন্ত দেহ আবিষ্কার হলো।
"কী? ভালো লাগছে না সিনেমাটা?" কাঁধে একটি হিমশীতল হাতের স্পর্শে চমকে তাকালো নয়নিকা। দেখলো এক বছর কুড়ি একুশের মেয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে। সাধারণ সাজগোজ। ও উত্তর দিলো না। মেয়েটি বললো আবার, "বেরিয়ে এলেন যে?"
"ইচ্ছে হলো না।" নয়নিকা উত্তর দিলো।
"আপনি প্লিজ দেখবেন। আপনার মতামতের জন্য ভীষণভাবে আমি ব্যাকুল। প্লিজ।"
"কে তুমি?" নয়নিকা বিস্ময়ভরে জিজ্ঞেস করে।
মেয়েটি স্মিত হেসে বলে, "আমি এ সিনেমার ডাইরেক্টর। আমার নাম তিতলি।"
"তুমি এই গল্প কোথায় পেলে? এই স্ক্রিপ্ট?" নয়নিকা জানতে চায়।
"বাণীব্রত মুখোপাধ্যায় আমার বাবা। ধরুন, পৈতৃক সম্পত্তিতে আমি একটি মোটা খয়েরি ডায়রি পাই। সেখানে ছিল ওই গল্পের স্ক্রিপ্ট। অরিজিনাল লেখাটাও। আমার খুব পছন্দ হয়। তাই সিনেমাটা বানাই। মায়ের কাছে শুনেছি, বাবার খুব ইচ্ছে ছিল এটা বানানোর। পারলো না। আমি তাই ফিল্ম স্কুলে গেলাম। হাত পাকালাম এক দুটো শর্ট বানিয়ে। এইটা আমার প্রথম ফুল লেন্থ ফিচার। তাই খুব নার্ভাস।"
নয়নিকা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তিতলির দিকে। কোনো শব্দ বেরোয় না মুখ দিয়ে।
তিতলি ওর হাত ধরে উঠিয়ে বলে, "আপনাকে এটা পুরোটা দেখতেই হবে। দয়া করে চলুন।"
নয়নিকা তিতলির হাত ধরে প্রেক্ষাগৃহে ঢোকে। নিজের সিটে বসে। সুপ্রতিমের " কোথায় ছিলে? ইন্টারভাল হয়ে আবার শুরু হলো। ভালো এগোচ্ছে। মিস করলে"র উত্তরে "একটু দরকার ছিল" বলে পর্দায় চোখ ফেরালো। সিনেমা চলতে থাকে। দু ঘন্টা পর যথারীতি শেষও হয়। শেষ সিনে লেখা ওঠে, "থ্যাংক ইউ বাবা (বাণীব্রত মুখোপাধ্যায়)। থ্যাংক ইউ নয়না আন্টি।"
গোটা প্রেক্ষাগৃহ হাততালিতে ফেটে পড়ে। সকলের চোখেই জল, মুখে তৃপ্তির হাসি। অনেকদিন পর এমন এক চমৎকার সিনেমা দেখে সবাই অভিভূত।
নয়নিকা চ্যাটার্জি আঁচলের কোণ দিয়ে একবার চোখ মোছে। এগিয়ে যায় তিতলির দিকে। জড়িয়ে ধরে ওকে। ওর মধ্যে দিয়ে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে নিজের মেয়েবেলার সেই প্রিয় বন্ধুটিকে।
No comments:
Post a Comment