Thursday, March 7, 2019

Song এ আমার

এককালে সুর তাল ছন্দ মোটামুটি ঠিকঠাক বজায় রাখতে পারতাম বলে সেই ছোট থেকেই আমার কয়েকবার স্টেজে গান গাইবার অল্পবিস্তর অভিজ্ঞতা রয়েছে। মনে আছে, তখন অনেকটাই ছোট। বছর ছয় সাত হবে হয়তো। বা আরো ছোট। গানের দিদিমণির স্কুলের ফাংশান হবে। আমি তখন সবে উনা বিনা কছুনা সো আর বিলাবল ভূপালির আরোহণ অবরোহণ ছেড়ে এক পিস রবীন্দ্রসংগীত শিখেছি। মজার ব্যাপার, সেটা কিন্তু 'আলো আমার আলো' না। বরং সেটা ছিল দুই লাইনের একটি গান। 'ওরে ওরে ওরে আমার মন মেতেছে'। যখন গানের দিদিমণি এটা শেখাতেন, বা আমি রেওয়াজ করতাম, আমার ঠাকুমার সে কী হাসি। নাতনি নাকি গান গাইছে। তাও এসব কীসব গান। সে যাই হোক, দিদিমণির বাড়ি নিয়মিত গিয়ে তবলচির সাথে প্র্যাকটিস করতে করতে (এবং প্রচুর বকাও খেয়েছি) শেষমেশ কোনো এক সন্ধ্যায় ঢাকুরিয়ার সি এল টি মঞ্চে গানটা গেয়ে দিদিমণি, মা বাবা এবং আমি নিজে, সকলকে উদ্ধার করেছিলাম। শুনেছি নাকি টুকটাক প্রশংসাও কুড়িয়েছিলাম নাকি সেদিন। মনে নেই।

আজকে বিশেষ করে দুটি স্টেজ পারফরমেন্সের গল্প বলবো।

১।
২০১১র জানুয়ারি। তখন যাদবপুরে এম এস সি সেকেন্ড ইয়ার চলছে। একদিন ঠিক হলো, ডিপার্টমেন্টের রিইউনিয়ন হবে। এপ্রিলে। হাতে এই চার মাসের কম সময়। এর মধ্যেই সমস্ত ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে। মোটামুটি হুজুগে থাকতে ভালোবাসি। ব্যস। দায়িত্ব নিয়ে নিলাম। ফার্স্ট আর সেকেন্ড ইয়ার মিলেই সমস্ত অনুষ্ঠান হবে। বাজেট নেই। তাই বাইরের শিল্পী আসবে না। আর বড় চ্যালেঞ্জ। অনুষ্ঠানের মান রাখতে হবে। ম্যাগাজিন বের করা, স্পন্সর জোগাড়, পুরোনো ছাত্র ছাত্রীদের সাথে যোগাযোগ করা.. সব চলছে। কালচারাল এ কী কী হতে পারে, কে কী পারে, এসবের একটা লিস্ট তৈরি হলো। ঠিক হলো আলাদা করে কিছু সমবেত, একক গান তো হবেই, নাচ হবে, এছাড়া যেটা মূল আকর্ষণ, সেটা হলো"শাপমোচন"।
সুমেধা আর আমি দায়িত্ব নিয়ে নিলাম। ও নাচাটা সামলে দেবে। আমি গান। এরপর শুরু হলো হৈ হৈ করে রিহার্সাল। রোজ বিকেলে থিয়োরি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের শেষে সবাই ফাঁকা ক্লাসরুম দখল করে হারমোনিয়াম তবলা ঘুঙুরের সাথে নাচ গান। অনেকদিনের পুরোনো ও অব্যবহৃত হারমোনিয়ামটা যে তখনও চলছে, ভেবেই কী খুশি।
পুরো দেড় ঘন্টার নাটককে ৪৫ মিনিটে আনতে গেলে পুরোটা করা সম্ভব না। তাছাড়া সব গান সবাই জানিনা। তাই বসা হলো একদিন ধ্রুব ঈপ্সিতার সাথে স্ক্রিপ্ট নিয়ে। মোটামুটি আলাপ আলোচনার পর গান ঠিক হলো কী কী হবে। "জাগরণে যায় বিভাবরী", "রাঙিয়ে দিয়ে যাও", "দে পড়ে দে আমায় তোরা", "এসো আমার ঘরে", "যখন এসেছিলে", "মোর বীণা ওঠে"। ফিমেল ভয়েস পাওয়া কঠিন না। অনেককেই পেয়ে গেলাম। সমবেত, সোলো সবের জন্যই। রানীর রোলে ছিল আমার তৎকালীন বেস্ট ফ্রেন্ড, দেবাঞ্জনা। ওর আর আমার ইচ্ছে, ওর সবচেয়ে পছন্দের গান, "এসো আমার ঘরে"টা আমি গাই। আমিও খুব খুশি। প্রথিতযশা শিল্পী স্বর্গীয় প্রসাদ সেন, আমার দাদু হন সম্পর্কে। বাড়ির কাছাকাছিই থাকতেন। একদিন ফোন করে ছুটলাম। গান তুলতে। দে পড়ে দে আর রাঙিয়ে দিয়ে যাও। এই দুটো আমি সমবেততে গাইবো।
 কিন্তু যা বলছিলাম, অনেক নারী কন্ঠ পেলেও, রাজার কণ্ঠে কে গাইবে, তার আর লোক খুঁজে পাইনা। যাকে পারছি, জিজ্ঞেস করছি। গান গাইবে? গান গাইবি? মনে আছে তখন শিল্পী খোঁজার জন্য এমনই অবস্থা, নীলয়দাকে ডেকে বলছি একদিন, "তোমায় দেখলেই মনে হয় ভালো গান গাও। প্লিজ দুটো গান গেয়ে দাও।"
শেষমেশ অনেক খোঁজাখুঁজির পর ফার্স্ট ইয়ারের তন্ময়কে পাওয়া গেলো। সে ব্যান্ডের গান গায়। নিজেকে রূপম ইসলাম ভেবে টেবে নেয়। আর কেউ নেই, অগত্যা ওকেই ধরো। যেহেতু আমি গানের ইন চার্জ, আমার ঘাড়েই দায়িত্ব পড়লো ব্যান্ড গায়ককে দিয়ে শুদ্ধ (ওই যতটা সম্ভব) রবীন্দ্রসংগীত গায়কীতে গান গাওয়াতে হবে। তখন টিভিতে "গানের ওপারে" সিরিয়ালটার দারুণ রমরমা চলছে। সবাই তারই রেফারেন্সে আমায় দিদি ঠাম্মি তকমা দিয়ে দিল। আর তন্ময় হলো আমাদের গোরা। রিহার্সাল বেশ ভালোই চলছে। সুমেধার নির্দেশনায় নাচের দল রেডি। বিদিশা অদিতি দেবাশিস তিশা এরা গান তবলা নিয়ে রেডি। এদিকে তন্ময়কে বকে বকেও আমি কিছুতেই আর সুর ঠিক করতে পারছিনা। ওর সাথে গলা মেলাতে হচ্ছে রোজ। অনুষ্ঠানের আগেরদিন পর্যন্ত। এদিকে ওর স্কেল খুব উঁচু। আমি সাধারণত খুব নিচু স্কেলে গাই। ব্যস। পড়লো গলায় স্ট্রেন। অনুষ্ঠানের ঠিক একদিন আগে আমার গলা দিয়ে আর কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছেনা। কী মুশকিল। সমবেত নাহয় ম্যানেজ হয়ে যাবে। কিন্তু "এসো আমার ঘরে"?
বসলাম অদিতিকে নিয়ে। "শোন, গানটা তুলে নে। হয়তো তোকেই কাল গাইতে হবে।"
দেবাঞ্জনার মন খারাপ। ওর নাচে আমি গাইছিনা। আমার আরো মন খারাপ। অত্যন্ত প্রিয় গানটা গাইতে পারবো না। তারই মধ্যে ফাইনাল রিহার্সাল চলছে। সাথে চলছে ধ্রুবর দেওয়া হোমিওপ্যাথি ওষুধ। কস্টিকাম।
অনুষ্ঠানের দিন দুপুরবেলা যখন সবাই ব্যস্ত খাওয়া দাওয়া নিয়ে, আমার কী মনে হলো, ভাবলাম আচ্ছা একবার দেখি তো, মাইকে কতটা খারাপ শোনাচ্ছে আমার গান। দেবাঞ্জনাকে শ্রোতা করে গানটা গাইলাম। তোলা গান। বারবার প্র্যাকটিসের প্রয়োজন নেই। তাল ঠিক আছে। দেখলাম টেনে দিতে পারবো। নিশ্চিন্তে লাঞ্চ সারলাম। অনুষ্ঠান শুরু হলো।
পরপর নাচ। গান। তারপর শাপমোচন। কেউই পারফেক্ট করিনি। তবুও স্ট্যান্ডিং ওভেশন পেয়েছিলাম। আজও শাপমোচনের গান শুনলেই, বিশেষ করে "এসো আমার ঘরে" গানটি গুনগুন করলেই ওই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। ওই একটি অনুষ্ঠানের দৌলতে ফার্স্ট ইয়ার সেকেন্ড ইয়ার পি এইচ ডির দাদা দিদিরা আর স্যার ম্যামেদের সাথে অদ্ভুত হৃদ্যতা স্থাপিত হয়। সেই সুসম্পর্ক এখনও রয়েছে।

২।

এবারের গল্পটা আরো একটু সাম্প্রতিক। ওই ২০১৫র। তখন আমি আমাদের ক্যাম্পাসের বেঙ্গলি এসোসিয়েশনের কালচারাল সেক্রেটারি। সহকারী অয়ন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। বাড়ি গিয়েছে। ঋতেন্দু সাহায্য করছে আমায়। গোটা অনুষ্ঠানটা সাজাতে। সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছে। শুধুমাত্র অনুষ্ঠানের দুই তিনদিন আগে অবধি কোনো উদ্বোধনী গানের ব্যবস্থা হয়নি। সবাইকে বলছি, প্লিজ গেয়ে দে। কেউই সারা দেয়না। শেষমেশ ঠিক হলো আমিই গাইবো। কিন্তু পরেও আলাদা গান গাইতে হবে। তাই ভরসা হচ্ছিল না এক গাইবার। রাহুলকে বললাম। গাইবি? ও রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়না। বললো শিখিয়ে দে। মনোসিজ আর আমি দুজনে মিলে রাত্তিরবেলা প্রায় মেরেধরে ওকে দিয়ে গানটা তোলালাম। "প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে"। মোটামুটি রেডি। অনুষ্ঠানের দিন ট্র্যাক চালিয়ে গান গাওয়া হবে। যথাসময়ে ট্র্যকটি চললো। আমি রাহুলকে সাহস জোগাতে বলেছি, তুই চাপ নিস না। আমি শুরু করবো। তুই ধরিস তারপর। আর কী। ঝোলালাম আমি। ট্র্যাকের চেয়ে স্লো স্পিডে গাইলাম। মাঝে ট্র্যাকটা ভাগ্যিস বেগড়বাই করলো। মাঝামাঝি জায়গা থেকে যখন শুরু হয়েছে, ম্যানেজ দিয়ে ফেলেছি। খুব অভিজ্ঞ কান না হলে বোঝার কথা না তেমন। তাছাড়া হল খালি ছিল প্রায়।
তবুও, আজও ওই অটো প্রিয় গানটা এমন ছড়িয়ে লাট করেছিলাম, ভাবলেই লজ্জা লাগে। আক্ষেপ হয়। আজও ওই গানটা জনসমক্ষে গাইতে গেলে এখনও গলা কাঁপে।

No comments:

Post a Comment